You are currently viewing বাজান/দলিলুর রহমান

বাজান/দলিলুর রহমান

বাজান

দলিলুর রহমান

ড. আতিকুল্লাহ চৌধুরী আজকে নিয়মিত সময়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। সকালে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেকনোলজি মিটিং। অফিসে যাওয়ার পথে স্টারবাকে থেমে একটি ক্রসেন্ট আর এক কাপ কফি নিয়ে ছুটলেন অফিসে। মিটিংয়ে আতিকুল্লাহ চৌধুরীর একজন এমপ্লয়ি প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। গত এক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আতিকুল্লাহ চৌধুরী কোম্পানির একটি জটিল সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। তাই নিয়ে এই মিটিংয়ে কোম্পানির উচ্চপদস্থ সব কর্তা ব্যক্তিদের চোখ আতিকুল্লাহ চৌধুরীর দিকে। তার গবেষণার এই ফলে নির্ভর করছে কোম্পানির টিকে থাকা। প্রেজেন্টেশন শেষ হলো এবার আলোচনা-সমালোচনা ও পর্যালোচনাল পালা। নানা রকমের প্রশ্ন উঠছে আর আতিকুল্লাহ চৌধুরী তার উত্তর দিচ্ছেন। সবাই খুশি। মনে হচ্ছে এই জটিল সময়ে কোম্পানিটি বেঁচে যাচ্ছে। মিটিংয়ের একদম শেষের দিকে এসে হঠাৎ আতিকুল্লাহ চৌধুরী ঢলে পড়লেন তার চেয়ারে। ছোটাছুটি লেগে গেল। নাইন ওয়ান ওয়ান কল তারপর হাসপাতালে নেওয়া হলো। নানা রকমের টেস্ট করা হলো, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন। কিন্তু তাকে হাসপাতালে রাখা হলো ডাক্তারদের পরামর্শ। অসম্ভব স্টেসে তার এই দুরবস্থা হয়েছে বলে ডাক্তার অভিমত দিলেন এবং দীর্ঘদিনের জন্য বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিলেন। কোম্পানি তাকে টেম্পোরারি ডিজেবিলিটি মঞ্জুর করল, এখন তিনি তাঁর প্রকাণ্ড বাড়িতে বিশ্রামে থাকলেন। আতিকুল্লাহ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী নিঃসন্তান তার তেমন বন্ধু বান্ধব নেই। তারা ভীষণ একাকীত্বে বসবাস করেন। নিঃসন্তান বলেই তিনি নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হন এবং ওসব থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি কারো সাথে তেমন মিশেন না। আতিকুল্লাহ চৌধুরী অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সচ্ছল। দুজন মাত্র মানুষ প্রকাণ্ড একটি বাড়িতে থাকেন। প্রতিবছরই তিনি দেশে ছুটি কাটাতে যান। এবারও দুজনে মিলে চলে গেলেন ঢাকা। ঢাকাতেই যেটা তিনি বরাবর করেন একটি গাড়ি করে চলে গেলেন তাঁর গ্রামের বাড়ি চৌহাট। সেখানে তিনি একটি চমৎকার বাড়ি করেছেন। বাড়িতে দুজন লোক রাখা হয়েছে দেখাশোনা করার জন্য। সকালে তিনি সর্ষের মাঠ ঘেষে মেঠো পথ, সেই পথের হাঁটাচলা করেন। বিকেল হলেই গ্রামের নানা রকমের লোক আসে তার সাথে কথা বলতে তাদের নিয়ে তিনি বাগানের সামনে বসে চা খান গল্প করেন মানুষের নানা রকম সমস্যার কথা শুনেন অনেক লোক আসেন এবং তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান। একদিন সন্ধ্যার একটু আগে তার কাছে এলেন একজন খুব গরিব মহিলা সাথে একটি ছোট্ট মেয়ে। মহিলা তাকে জানালেন যে তার স্বামী ভীষণ অসুস্থ। তাদের আরো দুটো সন্তান আছে তারা কিছুতেই তাদের সন্তানদের ভরণপোষণ করতে পারছেনা। মহিলাকে তিনি যত্ন করে বসালেন। বাড়ির কাজের লোকদেরকে বললেন কিছু খাবার এনে দিতে কিন্তু মহিলা বললেন আমার একটি জরুরী কথা আছে আপনার সাথে।

মহিলা: আপনার তো কোনো মাইয়া-পোলা নাই আপনি আমার এই মাইয়াটা কে নেন আর আমাদেরকে কিছু টাকা পয়সা দেন আমরা যাতে চলতে পারি। আমাগো উনি ঘরে পড়া বাচ্চাগুলোকে খাওয়াইতে পড়াইতে পারিনা। আপনার টাকা পয়সার অভাব নাই। আপনি আমার মাইয়াটাকে মানুষ করবেন। সে আপনারে বাজান কইয়া ডাকবো।

চৌধুরী: তোমার স্বামীরে আমি চিনি, তোমারেও চিনি। তোমার স্বামী রহিজ উদ্দিন  রাজি আছে?

মহিলা: হেরেও কইছি তিনায়ও রাজি।

এমন সময় আতিকুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী ও সেখানে এলেন। সব শুনে তিনিও অভিভূত হয়ে পড়লেন।

রোজ সকালে সান্ত্বনাকে নিয়ে স্কুলে যান আতিকুল্লাহ চৌধুরী। সান্ত্বনাকে তিনি চোখের আড়াল করতে পারেন না। ক্লাসে দিয়ে আতিকুল্লাহ চৌধুরী স্কুলের পাশেই একটি পার্কে বসে থাকেন কখন মেয়ের ক্লাস শেষ হবে। আতিকুল্লাহ চৌধুরী অবসর নিয়েছেন তার হাতে প্রচুর সময়। মেয়েকে তিনি যত্ন করে পড়াশোনা করেন, সময়ে সময়ে কোলে বসিয়ে টিভি দেখেন। মেয়েটি তার জীবন। তাকে পেয়ে তিনি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। সান্ত্বনা অস্থির করে ফেলে আতিকুল্লাহ চৌধুরীকে। মেয়ে বড় হয়েছে তবুও রাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। শুয়ে শুয়ে মেয়ে বলে, বাজান।

আতিকুল্লাহ চৌধুরী মেয়েকে বলে, কিরে কি বলবি।

কিছু না বাজান।

ডাকলি যে।

এমনি-

আবার ডাকে, বাজান

হু-

মেয়ে আবার নিরব

কিছু বলছিস না কেন ডাকিস

বলবো না। তোমাকে শুধু ডাকবো। আরো জড়িয়ে ধরে, বাজান

শুধু বাজান বাজান করছিস কিছু বলতে পারিস না?

কি বলবো? তুমি আমাকে আদর করো না—

কি বললি আমি তোকে আদর করি না?

কই তুমি আমাকে একটা চুমু দাও নি।

সান্ত্বনার গালে সাথে সাথে কে চুমু খায় আতিকুল্লাহ চৌধুরী। মেয়ের মুখের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কি সুন্দর মেয়েটি তার।

বাজান- আবার ডাকে

কিরে?

তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরো নাই-

সান্ত্বনাকে জড়িয়ে ধরেন আতিকুল্লাহ। তারপর ডাকে, মা—

কি বাজান?

তুই যখন চলে যাবি আমি বাঁচবো কেমনে রে?

কোথায় যাব আমি, কেন চলে যাব বাজান?

ওমা, তোর একদিন বিয়ে করতে হবে না?

কি যা তা বল বাজান!

খুব সুন্দর একটা ছেলে তোর জামাই হবে তোর বাচ্চা হবে এটাই তো নিয়ম

বাজান আমি কিন্তু কাঁদবো- সান্ত্বনা ঠোঁট ফোলায়।

এখন না মা, কাঁদবি না-এটাই জীবন। তুই কাঁদলে আমার হার্ট অ্যাটাক হবে।

বাজান! বলে চিৎকার করে ওঠে সান্ত্বনা। বাবার মুখে হাত দিয়ে মুখ আটকে দেয় চুপ কর, বাজান চুপ করো।

চুপ করে বসে থাকে আতিক উল্লাহ চৌধুরী। এ কেমন করে সম্ভব? কিছুতেই তিনি বুঝে উঠতে পারেন না । তার জীবন কেমন মরুভূমি ছিল। এখন তা সুখের কণায় কানায় কানায় ভরা। সান্ত্বনা দেখে তার বাবা চুপ করে কি ভাবছেন?

বাজান কি হল আবার? চুপ করে আছো কেন?

ভাবছি—

কি ভাবছো?

বলতে সাহস পাচ্ছিনা—

গলা জড়িয়ে ধরে বাবার গালে চুমু দিয়ে বল না বাজান বলোনা- জান, বলোনা কি চিন্তা করছো?

আমাকে তোর কথা দিতে হবে কি তুই রাগ করবি না

ঠিক আছে আমি রাগ করবো না এবার বল—

তোর কোন ছেলে বন্ধু আছে?

হা হা আমার বাজান । কত ছেলে বন্ধু আছে না? ক্লাসে।

ধুর বোকা! আমি কি তাই বললাম? মানে, তোর কোন ছেলে—

বুঝেছি আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা, তাই তো? হ্যাঁ বাসি, হিংসা হচ্ছে?

অ্যা! চমকে উঠে আঅকুল্লাহ চৌধুরী।

বাবার অবস্থা দেখে সান্ত্বনা মনে মনে হাসে। আতিকুল্লাহ চৌধুরি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিরে, আমি চিনি?

হ্যাঁ চেনো, খুব ভালো করে চেন বাবা।

কে, নাম কি?

তুমি বাবা, বাজান বলে সান্ত্বনা জড়িয়ে ধরে বাবাকে, বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা। তুমি আমার ছেলে বন্ধু, তুমি আমার বাজান, তুমি আমার প্রেমিক। আর হিংসে করতে হবে না। এবার আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।

আতিকুল্লাহ চৌধুরীর আগের দিন আর নেই। রোজ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ভীষণ আনন্দে তার সময় কাটে। রোজ আড্ডা হয় তার বাসায়। সান্ত্বনা গান গায়, গাড়ি চালায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু বাবা তাকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলেই নয়। একটা ফাইভ স্টার হোটেলের কনফারেন্স রুম। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ভর্তি। সানাই বাজছে। বউ সেজে বসে রয়েছে সান্ত্বনা। ফটোগ্রাফাররাও ছবি তুলতে ব্যস্ত। আতিকুল্লাহ চৌধুরী বন্ধুদেরকে সম্বর্ধনা জানাতে ব্যস্ত। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান, এত সুন্দর দেবীর মত তার মেয়েটি! আজকে তাকে বিদায় দিতে হবে। এবার গান বাজে; গান বাজছে “বাবুলে মোরা—নাইহারি ছোটা হি যাএ চারি কাহারি মিলি মুরা ডুলিয়া সাজায়ে।”

টেলিফোনের শব্দে আতিকুল্লাহ চৌধুরীর ঘুম ভাঙ্গে। ডাক্তারের অফিস বলছে তার এমআরআইর রিপোর্ট নিয়ে, আগামীকাল আলোচনা করতে হবে ডাক্তারের অফিসে। ডক্টর আতিকুল্লাহ চৌধুরী টেলিফোনের কথা কিছুই ধরতে পারেন না। তিনি কেবল এদিক ওদিক তাকান। তিনি বুঝতে পারেন না কোথায় আছেন। তিনি যখন বুঝতে পারেন, তিনি তার ঘরে আছেন, তখন আতিকুল্লাহ চৌধুরী হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। আমি তোর বা-জান, সান্ত্বনা-সান্ত্বনা, আমি তোর বা-জান। আমাকে ফেলে তুই কই গেলি মা।