You are currently viewing বাংলা নববর্ষ ১৪২৯,  ৫টি গল্প

বাংলা নববর্ষ ১৪২৯, ৫টি গল্প

ভাত দে

অলকানন্দা রায়

আমারে একটু পানি দিবা? নামাজের সময় ওইয়া গ্যালো জ্ঞা…। ক্যারা যাও এইহান দিয়া? ও বউ হুনছো…?  ও সকিনার মাও, কতক্ষণ ধইরা ডাকতাছি হুনোও না। তোমরা এবা ক্যা? আমি বুড়া অইয়া গেছি। হাত রথ গেছে সুমসারে আমার আর কদর নাই। বুঝবা বুঝবা! দিন তুমগোরও আবো। হক্কল হিসাবই তহন মিটান নাগবো।

ওই সামিনা, সকিনারে হুনছস! ফাঁডা কপাল! ওই ছেড়া সবজল… এক নাগাড়ে ডাকতে ডাকতে মিইয়ে আসে নব্বই কী পঁচানব্বই পেরুনো বৃদ্ধ মোয়া খাঁর গলা।  তার ঘরের কোণা-কানচিতে টুক-পলান্তি খেলছে তারই নাতি নাতনি আমিনা, শরিফা, সামিনা, ছকিনা, বুলবুলি, সবজলদের বিশাল দল।

ঘরের সামনে দিয়ে এ কাজে, ও কাজে হনহনিয়ে যাচ্ছে আসছে ছেলে বউরাসহ তার নিজের বউও। তাদের কাঁখে ধান ভর্তি ধামা। হয় বারবাড়িতে শুকাতে নিয়ে যাচ্ছে নয়তো শুকনো ধান ঘরের গোলায় তুলতে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। নয়তো যেখানে সদ্যই কামলারা ক্ষেত থেকে কেটে এনে তেলের ড্রামে বা শক্ত কাঠের ওপর পিটিয়ে পিটিয়ে আঁটি থেকে ধান ছাড়াচ্ছে সেখান থেকে ভেজা ভেজা ধান তুলে নিয়ে যাচ্ছে খোলায়, দক্ষিণা ফিনফিনে বাতাসে ধান উড়িয়ে খড়-কুটো পরিস্কার করতে। আবার সেই পরিস্কার ধান তুলে নিয়ে উঠোনের রোদে ছড়িয়ে দিচ্ছে শুকাতে। একটু পর পর আবার ছুটে আসছে সেই ছড়ানো ধান দু’পায়ের নিপুণ কায়দায় উল্টেপাল্টে দিতে। যাতে সমান ভাবে শুকোয় প্রত্যেকটা ধান। ধানগুলো চড়া রোদের আঁচে খসখসে সোনা রঙ খোসার ভেতরের শাঁসটা শুকিয়ে শক্ত দানা হলে তবেই না নোটে ফেলে রাতজুড়ে বাড়ির বউ, ঝি মিলে ঢেঁকিতে পাড়ের পর পাড় দিলে বেরিয়ে আসবে চাল। সেই চালই আবার হাঁড়িতে মাপা জল, তাপে সেদ্ধ করলে উথলে ওঠা ঘন ফ্যানের ভেতর উঁকি দেবে ভাত। আহা! ভাত। সাদা সাদা ভাত। বিলের জলে সাত সকালে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের পাপড়ির মতো সাদা!

এতটুকু জিরোবার সময় নেই কারো হাতে। না বউ, না ছেলে, না বৌমাদের, না নাতি-নাতনিদের। সকলেই এদিক দিয়ে যাওয়া আসার পথে শুনতে পায় ‘‘কেউ একটু ওজুর পানি দিবা গো?”  কিন্তু কারো এক চিমটি সময় নেই অশতিপর সেই সাথে অকর্মন্য বৃদ্ধের ডাকে তৎক্ষনাৎ সাড়া দেবার।

নাতি-নাতনিরা খুব যে ছোট তা নয় আবার খুব যে বড় তাও নয়। বৃদ্ধ দাদার ওজুর পানি তারা এনে দিতে পারে এতটা বড় তারা হয়েছে। ক’ আঁটি ধানও তারা কাটতে পারবে। মাথায় তুলে বাড়ি বয়ে আনতেও পারবে। এমন প্রায় সব বাড়ির ছেলেমেয়েরাই হাত পা একটু বড় হতেই করে থাকে। আসলে তাদের করতে হয়! এদের বাবা-মা চুলের ঝুঁটি ধরে কাজে নামায় না তবে আরেক বাড়ির ছেলেটা মেয়েটা বড় হয়ে গেছে তবুও কাজ করে কম তা নিয়ে বিস্তর কানাঘুষো করে।

সাত গাঁয়ের ডাকাবুকো ঝগড়– মানুষটি তাদের দাদী হওয়া সত্তে¡ও নাতি নাতনিরা কেমন করে যেন ছাড়া পেয়ে তাই খেলছে তো খেলছেই। তবে খেলাই যে তাদের কাজ তা নয় চরম ঝগড়া-ঝাটি, কুটনামি, বদনাম, অন্যের খেলনাবাটি চুরিতে তারা সিদ্ধহস্ত। গালাগাল- গলাবাজিতে দাদীর ওপরে!

এত কিছুর চাপে তাদের সময় হয় না বুড়ো মোয়া খাঁর ওজুর পানি এনে দিতে। ইচ্ছেও করে না তাদের।

মোয়া খাঁ ফের ডাকতে থাকে ‘‘একটু ওজুর পানি দেও গো… বেইল পইড়া গ্যালো… খিদা নাগছে।

ওই ওই ছেড়ি তুই কেড়ারে? গোসাইর বুইনে? একটু ইনু আহেক ছে! টিপ টিপ পায়ে এগিয়ে যায় ও বাড়ির গোসাইর বোনটা। লাঠি হাতে চৌকির কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে মোয়া খাঁ। বয়েসের ভারে সমস্ত শরীরটা বেঁকে ইংরেজি ইউ হরফের মতো হয়ে গিয়েছে। মুখের চামড়ায় অজস্্র ভাজ। ঝুলছে হাতের চামড়া। কাছে যেতেই খপ করে মেয়েটার হাতটা শক্ত করে ফেলে প্রায়ান্ধ মোয়া খাঁ। পরম পাওয়ার মতো ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে জানতে চায় “তুই হুমারে?” মেয়েটি উত্তরে হ্যাঁ জানালেও মোয়া খাঁ আরো খানিকটা চিৎকার করেই ফের প্রশ্ন করে ‘‘তুই হুমা? মেয়েটি এবার মুখ মোয়া খাঁর কানের কাছে নিয়ে একটু জোরেই বলে, ‘হ্যাঁ’। শুনতে পেয়ে খুশি  মোয়া খাঁ আব্দারের সুরে বলে, আমারে একটু ওজুর পানি আইন্না দিবি?

-হ্যাঁ দেবো।

– ওইখানে বদনি আছে। ডান হাতের তর্জনী তুলে চিড়ে-চ্যাপ্টা ঘরের দরজার কোণ দেখায়। হাতের আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখতে পায় একটা সীসার অতি পুরানো বদনা ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেঝে খানিটা ভেজা। বৃদ্ধ মোয়া খাঁর মতো শতবর্ষী হাজারটা ট্যাপ খাওয়া বদনিটায় বোধহয় ফুটো আছে। তার গায়ের ময়লা জমে জমে এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে মেয়েটির কেমন ঘিনঘিনে ভাব হয়। তবুও তো…

মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে বদনা আনতে গেলে বৃদ্ধ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আরো জোরে হাতখানা চেপে ধরে। যদি সে পালিয়ে যায়! মেয়েটি তাকে আশ্বস্ত করে-

-আপনাকে পানি এনে দেই।

– না না বদনিটাসহ আমারেও কলপাড়ে নিয়া যা। ওইহানেই কল চাইপা এক বদনা পানি দেইস।

মেয়েটি এক হাতে প্রাচীন বদনা, অন্য হাতে প্রাচীন মোয়া খাঁকে ধরে ঘরের বার হয়ে পা টিপে টিপে কলপাড়ে নিয়ে যেতে থাকে। খেলে বেড়ানো বৃদ্ধর নাতি নাতনির দল এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে একচোট হেসে নেয়। বুইড়্যা আইজকা তোরে ধরছে! ভালাই অইছে তুই বুইড়ার হাতে (সাথে) অজু অজু খ্যাল।

তারা যেমন ঝড়ের বেগে এদিকে এসেছিলো তেমনি ঝড়ের মতেই পুব থেকে পশ্চিমে নাকি উত্তর থেকে দক্ষিণে ধেয়ে যায় অসভ্য বানের জলের মতো কলকল খলখল করতে করতে। ধানের ধামা কাঁখে নিয়ে হনহনিয়ে দেখেও না দেখার ভানে চলে যায় মোয়া খার বয়সী বউ। গা থেকে প্রায় খুলে পড়ছে তার এক প্যাচে পরা বারো হাতি শাড়িটা। পেটিকোট, বøাউজের বালাই নাই। আড়াল থেকে নয় প্রায় সরাসরিই দু’পাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে তার শুকিয়ে ঝুলে পড়া স্তন জোড়া। মেঝ ছেলের বউ ছকিনার মা দেখতে পেয়ে যেতে যেতে বলে যায়, হুমা তোর ভালা অবো রে। তোর ভালা অবো। বুড়া মাইনষ্যেরে অজুর পানি আইন্না দিলে আল্লায় তার ঠিকই ভালা করবো। কে জানে! ছকিনার মায়ের চুন লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়া সাদা মার্বেলের মতো চোখে কী খেলা করে!

মোয়া খাঁ অজু করে পরম ভক্তি ভরে। কোন এক সুরা আওড়াতে আওড়াতে মেয়েটির ছোট হাতে ভর করে ফের ঘরে ঢোকে। একটা প্রায় শেষ হয়ে আসা দিনে এই একরত্তি মেয়েটা ছাড়া আর কেউ তার কাছে আসে নাই। তাই বুঝি হাতটা সে ছাড়তে চায় না। বয়সী খসখসে মুঠোর দখলে রেখেই সে বলে,

-ওই হুমা আমারে এক থালি ভাত দিবি? খামু।

মেয়েটি চমকে ওঠে ভাত! ভাত সে কোথায় পাবে? নিজের বাড়ির হাড়িতে এক থালা ভাত তো দূর, এক কনা ভাতও নেই। ঘরের কোণে ধোয়া মোছা হাঁড়ি পাতিল উপুড় করে রাখা। একটা চালই যে তাদের ঘরে নেই। ভাত হবে কী করে? ক্ষিধেয় পেট তারও যে জ্বলতে জ্বলতে থেমে গেছে সেই কখন! কাঁদো কাঁদো কন্ঠে সে জানায়

-আমি ভাত কোথায় পাবো? আমাদের ঘরে তো ভাত নাই। মোয়া খাঁ যেন শুনেও শুনতে পায় না। অবুঝ ছেলের মতো বায়না করে বলতেই থাকে,

-ওই হুমা খাড়াইয়া রইছস ক্যা? দে-রে চাইড্ডা ভাত। মেলা খিদা নাগছে। চোখে আন্ধার দিতাছে। হেই কোন বিয়ানবেলায় দুইডা পান্তা দিছাল… মেয়েটির দুই চোখ ভরে জল আসে। ফুলে ফুঁপিয়ে ওঠে ঠোঁট জোড়া। বুক খুলে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, “মাআআআ!” সে আর থাকতে পারে না। জোর করে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালায়।

ছুটতে ছুটতে শুনতে পায় মোয়া খাঁ আহির ভৈরবে গাইছে, ‘‘আমারে এক থালি ভাত দিবি? খিদা নাগছে। আমি খামু-উ-উ-উ…।’’

 

বাংলাদেশ

আকিমুন রহমান

আউজকা বাসে ওটোনের সোম একটা আচানক বিত্তান্ত ঘটছে। আমি- এই যে রিয়াজুল- আমি এই- নাক চোখ খোলা রিয়াজুলে তক- ট্যাপ খাইয়া গেছি- বিত্তান্তের গুণে! বিত্তান্তটা বিরাট কিছু না। কিন্তুক আমারে টাসকি খাওয়াইয়া দিছে। আতকা ঘটছে কিনা! টাসকি না খাইয়া যাই কই! নাইলে, এই ত্রিয়েস্তে আমি আছি আউজকা ধরতাছি পাঁছ বচ্চর যাইতাছে গা, নিয়ম-সিয়ম ভালাবুরা- এই দেশের চলাচলতি- বালামতন বোজার আমার বাদ নাই। সে কয়জন দেশি পোলা আমরা আছি এই ত্রিয়েস্তায়, সবটি সবটিরে চিনি! ঠায়-ঠেকায় সগলতে লগে লগে থাকি, নাইলে যে যার মোতন থাকি ছাড়া ছাড়া! কেউঅইর খোঁজ কেউঅই রাখি না। খইয়া-লইয়া তো কাম আর নাই, যে, খালি এর-তার পোন্দের পিছে এয়-তায় থাকতে থাকমু!

তয়, আমাগো সবটির লগেই সবটির দেখাসাক্ষাৎ হয়, কিন্তুক দিইন-রাইত একলগে গলাগলি নাই! যেরা যেরা এক বাসাত থাকে, তারা তারা এক গুরুপ নিজেরা নিজেরা। এই যেমুন আমি থাকি সুবার বাসায়। ফেলাটটা অয় কিনছে। তার একটা ঘর আমি ভাড়া লইছি। আরেক ঘর ভাড়া লইছে ইলিয়াছে। অন্যটাতে সুবা হালার পুতে নিজে থাকে। অয়ে এই দেশে আছে-নয় বছর দইরা। কয় বোলে, উয়ে এইনেই থাইক্কা যাইবো পুরা জিন্দিগি। তয় উয়ে থাকতে পারে! অরা তো আমাগো মোতন না। অগো দ্যাশ-খেশের লেইগা টান কম। আমাগো যেমুন বাড়ির লেইগা কইলজা ফাইট্টা যাইতে থাকে সব সোম, উয়ে তো দেখতাছি হেমুন না!

উয়ে কয়, এইনেই উয়ে বাদবাকি জিন্দিগির লেইগা থাম্বা গাইড়া বইবো! আর হেইটাই তো করছে অয়ে! ফেলাট কিইন্না বাড়িঅলা অইয়া গেছে গা, একদমে। তয় অরা পারেও শালার! দেশবাড়ির লেইগা কান্দাকান্দি করতে থাকা পরান নিয়া- অর তো দেহি কোনো ঝামেলা অয় না। আমি অরে হেইটাই খালি জিগাই! টাইমে টাইমে জিগাই, ‘আরে সুব্রইত্তা, তুই পারস কেমনে?’

সুব্রত পারে। উয়ে পারে পারুক, কিন্তুক আমি এমুন পারতে চাই না। আমি এই দেশে পইড়া থাকোনের লেইগা আহি নাই। ট্যাকা কামানের লেইগা আইছি। কামাইতাছি। বাইত পাটাইতাছি দুই হাতে। বাবায় জায়গা জমি কিনতাছে। বিল্ডিং তোলছে বাইত। সুদিতে ট্যাকা লাগাইছে। দেখতে দেখতে চাইর বচ্ছর গেছে গা। আমার তো ইচ্ছা, যাউক গা আরো চাইর পাঁচ বচ্ছর। হাতে বালামোতন ক্যাশ টাকা বাইন্দা, আল্লা আল্লা কইরা দ্যাশো ফিরা যামু। ব্যবসা করুম হেইর পর! দ্যাশে থাইক্কা ব্যবসা করমু।

ট্যাকা খেপে খেপে বাইতও পাটাইতাছি, নিজের কাছেও ব্যাংকে রাখতাছি এইনে। খায়-খরচ আর বাড়িভাড়া বাদে বেহুদা খরচার মইদ্দে আমি নাই। ট্যাকা অইলো জমানের লেইগা! এই ট্যাকা কামাইয়ের লেইগাই তো এইনে আওন, নাকি? কিন্তুক, কথাটা কি পুরা হাছা হইলো! এই যে কইলাম- ট্যাকা কামাইয়ের লেইগাই আইছি। পুরা হাছা না এইটা ! আরো কথা আছে- এইর পিছে। তয়, অহন কতা কিন্তু হেইটা না।  কতা অইলো- এতো চোখকান খোলা থাকোনের পরেও- এই যে বাসে ধরাটা খাইলাম আমি! যেমুন তেমুন ধরা খাওয়া না কিন্তু!

হইছিলো কি, কামের তেনে ফিরতি কালে, আমি খাড়াইয়া রইছি বাস ইস্টপে। কুড়ি মিনিট পরে বাস। এহন, আমার ইস্টপে যাইতে গেলে ৬ নং বাসে গেলেও চলে,  ৩৬-এ গেলেও অয়। আমি খাড়াইয়া রইছি, এহন যে কোনো একটা আইলেই উটমু। দেহি যে ৩৬ জন আইতাছে। আহুক। যাওন দা হইছে কথা। অমা, বাসে উইট্টা সারি নাই, কে জানি হুড়ামুড়াইয়া উইট্টা- আমারে এই  বিরাট এক ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিতে দিতে, ঝুপ্পুস কইরা ধইরা ফালাইলো; আর নিজের পড়োন ঠেকানের লেইগা, ঝপঝপন্তি সিটের একটা হাতল ধইরা লইলো!

কালা আন্ধাইরা এক- কালা বাউশ হালার পুতে! আবার কয়, ছরি ছরি ছরি- ইস্কটিমি ছরি। তর ছরির খ্যাতা পুড়ি। আরে,  বাসের অই শেষ টাইমে, দরজা বন্ধ হয় হয় টাইমে, দৌঁড় পাইড়া তর ওটোনের কাম কি রে ব্যাটা! ধাক্কা খাইয়া আমি যেই দুঃক্ষুটা পাইলাম- ছরি দিয়া হেইটা উশুল হইবো! মনে মনে গাইল দিয়া তো অখন আমার কোরোধ কমবো না! মুখ দিয়া গাইল দিতে হইবো। বাংলা এইনে কেটায় বুঝতাছে! আমি অন্যদিকে চাইয়া-গাইল দেওয়া ধরলাম। ‘শালার পুতেরা! শ্রীলংকা থুইয়া এইনে কোন মরা মরতে আইছস রে বেটা! শালার পুত। হালার ঘরের হালা!’

“আপনি গালিটা বেশি দিয়ে ফেলছেন না ভাই? আমি ইচ্ছে করে করিনি কাজটা। ব্যালান্স রাখতে পারি নাই যে!”

‘হায় হায়- শ্রীলঙ্কাইন্নাটায় দি বাংলা কয়! আমার দেশি ভাই নি? ইয়া আল্লা!’ হুড়ুত কইরা মনের ভিতরে আফশোস আইসা ধাক্কা দিলো। শরম পাইলাম। দেশি পোলা না? নতুন আইছে লাগে। আমরা পুরানরা এমুন করলে- অগো উপায় কি! চলতি বাসেই শেষে অর লগে কোলাকুলি করোন খালি বাকি রাখি। কেমনে আইলো – কোন রাস্তা দিয়া আইলো – কয়দিন ধইরা আসছে- আমাগো দেশিগো কার বাড়িত আছে- এমুন কতো কতাই না হেরে জিগাই  আমি! হেয় খালি চক্ষু বড়ো বড়ো কইরা আমার কতা শোনে। কিন্তু কোনো জব দেয় না! ঘটনা কি? পোলাটায় এমুন ক্যান! নাকি দুই নম্বর! দুরঅ- কি কই- আমরা সকলতে- দুই নম্বর না অইয়া- এইনে আইতে পারতাম নি? আমরা বেবাকটিই হইতাছি  দুই নম্বর। তয়, অয়ে কি? কতা খালি হোনে, জব দেয় না। আমার ইস্টপ অইয়া পড়তাছে না! আমি আবার জিগাই, বিত্তান্ত কি? শেষে সেয় মোক  খোলে। কয়, আমি স্টুডেন।

আরে আল্লা! দেশে অখন স্টুডেন  ভিসা দিয়া বিদেশ পাঠানোর সুবিধা হইছে নাকি! নামে স্টুডেন কামে ট্যাকা কামাইয়েরর ধান্দা- সেই কেইস নাকি! হইলে, খুইল্লা কইতে দোষটা কোনখানে! এইনে, এই বিদেশে, দেশি ভাইগো মইদ্যে আবার লুকাছাপা কি?

আমি তারে কই, ‘আরে মিয়া! খোলাসা কইরা কন। কতো লাগলো আইতে- আওয়া হইলো কোন রাস্তা দিয়া, এহন কি করোনের ধান্দা-’

আমার কথা শুইন্না সে- করকরা চক্ষে আমারে দেখতে থাকে তো দেখতেই থাকে, কোনো কথা নাই! অনেক খোন কোনো কথা নাই। শেষে মুখ খোলে।

“আমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছি এখানে।”

‘বাড়িত তেনে কত ট্যাকা পয়সা নিয়া আসতে হইছে?’

“নিয়ে আসতে হয় নি তো তেমন কিছু! ক্যান?”

‘তাইলে চলেন ক্যামনে? খরচাপাতি চলে ক্যামনে?’

“ইউনিভার্সিটি দেয়- বললাম না? এসব কেন জিজ্ঞেস করেন?”

‘না জিগাইলে জানমু ক্যামনে?’ আমি তারে বুঝ দিয়া বলি। বলি বটে, তবে আমার কইলজাটা চিনচিনায়। পোলাটা ল্যাখাপড়া করতে আসছে- কলারশিপ বোলে পায়- দেশি পোলা। কিন্তু ব্যবহারের তাছির দ্যাখো! কথা বাইর করতে হইতাছে- ঠেইল্লা! গুতা দিয়া দিয়া!  ফুটানি করতাছে নি! করলে করুক গা! শিক্ষিত কিনা- ফুটানি দেহায়! দুইদিন পর কই যাইবো গা, গুড়–ম গাড়–ম। তহন দেশি ভাইগো বিছারাইয়া- বেদিশা হইয়া কুল পাইতো না!

“আপনি ধারে কাছেই থাকেন?” পোলাটায় আমারে জিগায়। এইত্তো বোল ফুটতাছে- আমি মনে মনে এই কথা বইল্লা মুখে কই, ‘এই যে আর দুই ইস্টপ পরেÑ রাইয়ানো। সেইখানে আমার বাসা।’ এইটা তো ধইরাই নেওয়া যায় যে, এইর পর সেয় নিজেই- তার থাকানোর জায়গার কথা বলবো! আমার তো তেমুনই মনে হইছিলো। কিন্তুক শেষে দেখি, সে সে আর কোনো কথাই তোলে না! না-পাইরা আমিই জিগাই; ‘আপনে কই থাকেন?’

“ এই-একটু দূরে- বারকোলায়! সালিতা কনতোভেল্লিতে আমার ফ্ল্যাট।”

অ! সেইটা খুব বেশি দূরে না। আমার ইস্টপের পরে তিনটা ইস্টপ। তার বাদেই বারকোলা। আমি ঝুম ধইরা বইসা থাকি, দেখি সে আর কোনো কথা কিনা! রাইয়ানো- আমি ইস্টপ আসতে তো আর বাকি নাই।

কিন্তুক পোলাটার মুখে কোনো কথা নাই। আরে! ঠায়-ঠিকানা না নিলে, চলতে-ফিরতে ঠেকায় পড়লে যাবি কই! কিন্তুক ঠায়-ঠিকানা নেওনের লেইগা- তার কোনো লড়াচড়ি দেখা যায় না! তাইলে আমার দিক দিয়া আমি কিলিন হইয়া থাকি। দেশিভাই যখন, আমার বাসার নম্বরটা অন্তত- দিয়া থুইয়া যাই। বাস আইসা আমার ইস্টপে থামতে থামতে, আমি তারে আমার বাসার নাম্বার বলি। রাস্তা পার হইয়া- হাতের ডাইনে গিয়া- হাতের ডাইনের চাইরতলা বিল্ডিংয়ের তিনতলা। কি মনে কইরা- সে আমারে তার নাম বলে। তারপর আমার নাম জিগায়। আমার নাম তো রিয়াজুল। অর নাম বোলে রকিব।

বাস থেকে রিয়াজুলের, নাকি রেজাউল- ওই, আই অ্যাম কনফিউজড- নামা দেখতে দেখতে মনে হলো- আরে! এর সঙ্গে তো আরেকটু কথা বলা যেতো! কিন্তু, ও থাকতে থাকতে এ-কথাটা আমার মনেই আসে নি! বা আমিই মনে আসতে দেই নি যে, আরেকটু কথা বলা যেতে পারে! বাঙালির সঙ্গ খোঁজার জন্য কি এখানে এসেছি আমি? তাইলে বাংলাদেশ আছে- কোন প্রয়োজনে! ওইসব দেশি ভাইবন্ধু খুঁজে বের করে- একটা কর্ণার বানিয়ে- মিনি বাংলাদেশ দাঁড় করানোর ইমোশন- আমি ফিল করি নাকি? নাহ্, করি না তো! তাই রিয়াজুলের সঙ্গে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না। ত্রিয়েস্ত আর এমন কী বড়ো শহর! ডাউন-টাউন কী পিয়েৎসা ওবেরদানে- কোনো না কোনো উইকঅ্যান্ডে দেখা হয়ে যাবেই। এই সাতদিনে দেখা গেছে- যখুনই ডাউন-টাউনের দিকে আসা গেছে- ঘুরে-ফিরে অনেকবার- একটা-দুটো মুখের সঙ্গে দেখা হয়েছে! আর একই রুট ধরে যখন আসা-যাওয়া চালাতে হবে- দেখা হয়ে যাবেই। ওফ! এই ব্যাপারটা- এখনই মনে করে-আমার অশান্তি লাগছে! আমার কোনো বঙ্গদেশী দরকার নেই! একজনও দরকার নেই! আমি কমপ্লিটলি বঙ্গভাষা ব্যবহার না-করার পরিস্থিতি পেতে চাই! অনেক হয়েছে বঙ্গভাষা ব্যবহার। অনেক হয়েছে বাঙালির মুখ দেখা, বাঙালি দিয়ে ঘিরে থাকা। বাট লুক রকিব- হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ দ্যাট ইয়ু কুডন্ট ফরগেট অ্যানি থিং। সাতদিন হলো তো। হাজার মাইল দূরে আসা হলো তো- ঘোর মনোযোগ দিয়া পড়া শুরু করে দেওয়া তো হলো! এই সাতদিনে মনে হলো-  বাসার সকলের কাছ থেকে-সাত আলোকবর্ষ দূরে চলে আসা হলো! মনে মনে চলে আসা হলো! কিন্তু যেগুলো থেকে দূরে চলে আসার জন্য অ্যাডামেন্ট হয়ে উঠেছিলাম, সেগুলো আমার মধ্যেই আমার সঙ্গেই পায়ে পায়ে চলছে।  খুব আশ্চর্যের ব্যাপার তো! বিষয়টা মনে রাখতেই চাই না। বাট নাউ মাই রিয়ালাইজেশন এমন যে, ওগুলো আমার রক্তকণা হয়ে গিয়েছিলো! এখন, ওই রক্তকণা ঝরিয়ে ফেলে নতুন রক্তকণা বানাতে কতোদিন লাগবে? কতোদিন! হেই অ্যাড্রিয়াটিকÑ ডু ইয়ু হ্যাভ এনি আইডিয়া হাউ লং ইট উইল টেক? অ্যাড্রিয়াটিক কি আমার কথা শোনে, শুনতে পায়?

অ্যাড্রিয়াটিক- এই তো আমার বাঁয়ে! ওকে বাঁয়ে রেখে চলতে চলতে শেষে মিরামারে- লাস্ট স্টপ! অ্যাড্রিয়াটিকের একদম পাশে- আমার য়্যুনিভার্সিটি। ডাউন-টাউন থেকে অনেকখানি দূরে। ওই যে রিয়াজুল ছেলেটা নেমে গেলো- রাইয়ানোতে- ওখান থেকেও বেশ দূরে। ডাউন-টাউনে আজকে আসাটা-একেবারে অকারণেই ছিলো। ক্লাস শেষে মনে হলো, যাই! একটু চেনাশোনা হয়ে আসি ডাউন টাউনের সঙ্গে! জাস্ট একটু হ্যালো বলা আর কী মনে মনে, পথ-ঘাটগুলোকে! শহরের গন্ধটার সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার হয়ে ওঠা! এই আর কী! ঘুরতে ঘুরতে বাসস্টপের কাছে যেতে যেতে দেখি, বাস ছেড়ে দেয় দেয়! বাস থার্টিসিক্স। ওহ! ওটাকে মিস করলে ফের বিশ মিনিটের ধাক্কা! দৌঁড়ে উঠে যাওয়া ছাড়া- দেয়ার ওয়াজ নো আদার ওয়ে! কিন্তু উঠে – তাল সামলাতে না পেরেই তো- ওই ঝক্কিটা বাঁধলো!

তো স্যরি বলো আর অ্যাপোলজি যতো করো- সে লোকের বিড়বিড়ানো বকা দেওয়া থামে না। আরে! দুষছে কাকে! শ্রীলঙ্কানদের। ফানি। আই নো, মাই কমপ্লেকশান এই ধারণা মনে আনতে পারে, খ্বুই পারে যে, আমি শ্রীলঙ্কান। ইট ইজ ডার্ক – ভেরি ডার্ক! দেশে থাকতে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি! কিন্তু যেই দুবাই থেকে রওয়ানা দিলাম ত্রিয়েস্তের দিকে; আমি জিজ্ঞাসিত হওয়া শুরু করলাম- শ্রীলঙ্কান? আচ্ছা! এরকম বাংলা বানানো শুরু করেছি আমি? জিজ্ঞাসিত হওয়া শুরু করলাম! হা হা হা! আমরা এভাবে বলি? নয় কেন! আম্মাকে ফোনে বলবো এই কথা। আর বলবো- পার হয়ে এসেছি তো! তুমি এখন নির্বিঘ্ন মনে করো আম্মা- নির্ভাবনা হও। উহু! হলো না! এখানে বলতে হবে, ভাবনামুক্ত হও। কিন্তু কেনো বলা যাবে না- নির্ভাবনা হও! নির্ভাবনা হও- বলাটা অনেক বেশি জোরালো শোনায় না, ভাবনামুক্ত হও বলার চেয়ে? যা খুশি তা হোক গে। তো, বাসের ভাইজান আমাকে ঠেসে বকা দিচ্ছিলো শ্রীলঙ্কান বলে। ফানি। দেন ইট মেড মি ইগার টু মেক হিম সারপ্রাইজড। সে কারণেই বাংলা বলা! দেখি না কী করে! কী করে আবার! হতভম্ব হয়ে যায়! হা হা হা। পার হয়ে আসার পরে, আবার, বঙ্গভাষীর বেষ্টন আমাকে নিতে হবে কেনো! আই হেইট আই হেইট আই হেইট য়্যু বাংলাদেশ- মাই লাভÑ মাই লাভ- মাই লাভ-

আম্মা খালি বলতেন- তোকে আল্লা আল্লা করে- পার করতে হবে এইখান থেকে। আল্লা! আমার বাচ্চাটাকে নিরাপদে পার করতে দিয়ো। আমি কি ঘোর ঝঞ্ঝার কালে অথৈ নদীতে পড়েছিলাম নাকি? কোথায় ছিলাম! কোথায়! আমার দেশে। বাংলাদেশে।

বাস তেনে নামোনের এক সেকেন আগে পর্যন্ত মনে অয় নাই যে, আমার এহন বাইত যাইতে মোন চাইবো না। পুরাটা দিন কাম করতে হইছে- কম্পানি পাঠাইছে ডাউন-টাউনের শেষ মাথার একটা বাড়ির কামে। আমি করি ওয়েল্ডিংয়ের কাম। সারাটা দিন খাড়ার উপরে! ঝালাই দেও জোড়া দেও। কাহিলের উপরে দিয়া কাহিল হইয়া গেছি গা! অন্যদিন হইলে তো রুমে গিয়া ধুপ্পুস। এহন মনে অইতাছে, একটা রেস্টুরেনে বইয়া এট্টু কাফি খাই! নাকি হাঁটমু! পোলাটার বেবহার আমার মিজাজটা গা›ন্ধা কইরা দিছে! উয়ে ফুটানি করলো না? ল্যাখাপড়া জানোনের ফুটানি? আরে! আমরা কমলা মানুষ আছি- একেকজোনে কত্তা ট্যাকা কামাই করি- দেশের হিসাবে! খেয়াল করবি তো! ল্যাখাপড়া আমাগোও হইতো না, বাও মোতন চললে? বাও মোতন চলোনের উফায় আছিলো- সম্বন্ধীর পুতের দেশে !

চৈত মাসের বিয়ানবেলা- আমি খাড়াইয়া রইছি গোলাপ জাবুন গাছের সামনে। হায়রে ফুলের ফুল, গাছে! ফুলের গন্ধ কী! কালা কালা ভোমরার ভোনভোনানি কী ! ফুলে ফুলে! আমি মায়রে ডাক পারতাছি; ‘অ মা! মা গো! এদিক আহ । দেইক্কা যাও। এইবার দুনিয়ার গোলাপ জাবুন অইবো গাছে!’ এইর মইদ্যে বাবায় কামে যাওনের লেইগা মেলা দিয়া- আমারে কয় কী, ‘অই রিয়াজুইল্লা! এট্টু পর দশটার সোমে নয়াপাড়া যাবি।’ নয়াপাড়া ভইরা হুসিয়ারি আর ডাইংয়ের দোকান! আমি অইনে গিয়া কী করমু? বাবায় কয়, ‘ অইনে গিয়া হোসেন মিয়ার ডাইংয়ের দোকানে কামে লাগবি তুই!’

আমার ইস্কুল আছে না?

‘আউজকার তেনে তর পড়া বন।’  কইয়া বাবায় কামে মেলা দেয়। বাবায়ই যুদি কামে লাগাইয়া দেয়, তাইলে আমার আর করোনের উফায় থাকে কী! আমার দশ ভাই। সব এমা-ডেমা- পাই -সিকি! একটার পিঠে আরেকটা। মাইয়া মাইয়া করতে করতে বাবায় বোলে বেচইন হইয়া গেছিলো! কিন্তুক বারে বারে খালি পোলা। মায় কয় যে, এই কইরা কইরা দশ জোন হইয়া গেলো, কিন্তুক মইয়ার নামগন্ধ নাই। মাইয়া নাই দেইক্ষা – বাড়ির আলিক্ষিও ছোটন নাই। আমি পাঁচ নম্বরে। সবার বড়ো যে- মিয়া ভাইয়ে- ভাদাইম্মা! কামে-কাইজে হের বোলতে মোন নাই! মেজু ভাইয়ে খালি দরগাত দরগাত ঘোরে। তাগো পরের দুইজনে – দর্জির দোকানে সিলির কাম শিখে। আমার ছোটোটি খালি ঘুরাঘুরি করে। তার মইদ্দে একলা আমারে- মায় ইস্কুলে দিছে। ফাইবে উইট্টা সারি নাই- হেইর মিদে বাবায় কয়- ডাইংয়ের কামে গিয়া লাগতে। লাগলাম। দিন-রাইত ডাইংয়ের ফ্যাট্টরিতে কাম। ল্যাখাপড়া কতোদিন হইলো ছাড়ছি? আরে ছোবান্নালা! বহুত বহুত দিন। পোলাটা- রকিব কইলো না নামটা- পোলাটা মনে লয় আমার বয়সী হইবো! অর লগে আর কোনো দেশি পোলা আইছে নাকি পড়তে!

এই ত্রিয়েস্তে – আইসিটিপিতে- পড়তে আসাটা কী রকম জটিল-ঘোরালো-অসম্ভব একটা ব্যাপার হয়ে উঠতে যাচ্ছিলো! আমার ইচ্ছেটা ছিলো ইউএসএ- তে যাওয়ার। জনস হপকিন্স আমাকে যেতে ডাকছে, গ্রান্ট দিচ্ছে- মন ভরে যাওয়ার মতো- যাই ওখানেই? আম্মা খালি বলে, ‘না! আগে ইউরোপ ঘুরে যা। আইসিটিপি ঘুরে যা!’ আচ্ছা। জনস হপকিন্স তবে এ-বছর বাদ। আমি আইসিপিটিতে যাওয়ার জন্য- কাজ করা শুরু করি। আশ্চর্য কান্ড! তাই  নিয়ে কথা কথা কথা! কতো রকম কথা! আমার ক্লাসমেটদের- স্যারদের- কী অন্য ডিপার্টমেন্টের কতোজনের!  কি রকম কথা সেইসব? হা হা হা! মনে পড়ে, সব মনে পড়ে!

আরে রকিব তো চাল মারছে। ইউএসএ হইলে কেউ আবার ইতালি যায়?

অই রকিব অই! সত্যি যদি জনস হপকিন্স অফার দিয়া থাকে- সেইটা ছাইড়া তুমি ইতালি যাইতাছো? এট্টু বেশি চাপা দিয়া দিছ না?

হয় নাই, হয় নাই- মিছা ফুটাইছে! একটা চাল ঝারছে-

ওয়াল্ডের বেস্ট জায়গাটা রাইক্ষা- আইসিটিপি পাড়াইতে যাবে- এইটাতে কী বুঝায়-সেইটা তো গাধায়ও বুঝে! হি হি হি।

“আম্মা আম্মা দ্যাখো, এইগুলি আমাকে শুনতে হচ্ছে- ক্যাম্পাসে ঢুকলেই- শুনতে হচ্ছে! তোমার জন্য তোমার কথা শুনে!” আমি গোঙাই, রাগ ঝারি। ‘এসব কানে তুলতে হয় না! আগে পার হও- পার হয়ে নাও- তারপর পেছনে ফিরে দেখো।’

স্যারদের রিকমেন্ডশন নেওয়া তো লাগে! আমি টেবিল টেনিস বলের মতো ঝটকা খেতে থাকি- নানান রকম মতের ঝটকা! স্যারদের মত। সিনিয়র মোস্ট স্যার ড. আজাহার আলী। আমাকে স্যার কথা শেষ করতে দেন না। হাউ হাউ করে ওঠেন। নো নো- আইসিটিপি ইজ নট অ্যা ম্যাটার অফ জোক। তুমি সেখানে সারভাইভ করতে পারবা না।

জ্বী স্যার, কোনো?

ওদের সিস্টেমটা উন্নত। পড়াশোনার লোড আনইমাজিনেবল। ইয়ু কান্ট সারভাইভ হিয়ার।

ড. শামসুল আলম কী সহজে দেবেন, না পরিস্থিতি কঠিন করে তুলবেন? আমি অনুমান করতে পারি না। তাঁর কাছে যাই।

ওয়েল রকিব! এখন বাইরে যেতে চাইতেছো ক্যান?

পড়ে আসি স্যার।

বোঝলা,ইটস অ্যা রং স্টেপ! হোয়াট ইয়ু আর গোয়িং টু ডু- আমি তো বলব রং ডিসিশান। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইছ। এখন দেশে মাস্টার্সটা করো। পরে ফিরে আসলে ডিপার্টমেন্টে হোল্ড থাকবে না- জয়েন করতে পারবে না। চাকরি পাওয়া কঠিন হবে। রিসার্চ করতে চাইলে জয়েন করেও যাওয়া যাবে। চাকরিটা আগে। রিচার্স কিছু লাফায়ে চলে যাচ্ছে না। খেতে তো হবে, নাকি?

ঠিক! আমি তো না-খেতে পাওয়া জাতি। আমার আবার হায়ার স্টাডিজের স্বপ্ন দেখা কী! আম্মা, আমার ছিঁড়ে- ফেঁড়ে যেতে ইচ্ছে করে! আমি যে ছেলে – সেটা আমার মনে থাকে না। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই, না? আমার চোখ দিয়ে ঝপঝপিয়ে পানি ঝরতে থাকে। জ্ঞানে আমাদের কোনো দরকার নেই- কিচ্ছুর দরকার নেই- শুধু খাওয়া দরকার।

‘দাঁড়া দাঁড়া- একটুখানি। পার হয়ে নে! তারপর- তারপর দেখিস!’ আম্মাও আমার সঙ্গে কাঁদতে থাকে।

ডায়িং ফ্যাট্টরিতে কামে তো লাগলাম! সারাদিন অইনে খালি -শাটে গেঞ্জিতে ছাপ্পা দেও- সাইজ করো- মাল সাপ্লাই লও আর দেও। কামে কামে দিন যায়। সন্ধ্যাকালে বাইত আসলে পরে, দোস্ত-বন্ধুগো লগে, এট্টু টাইম পাস তো করোন লাগে!  অগো লগে কথাবার্তা, রং-তামাসা করতে করতে একেকদিন- রাইত বাইজ্জা যায় দশটা এগারোটা। মায় ভাত লইয়া বইয়া বইয়া ঝিমায়, আর আমার লেইগা রাস্তা চায়।

‘এত্তা রাইত করোনের কাম কি তর, রাস্তায়?’ মায় আমারে ঝামটা মারে।

“দোস্তগো লগে এট্টু চলাচলতি করোন লাগবো না নি আমার?” আমিও লগে লগে মায়েরে খেঁজি দেই।

বিত্তান্ত শেষ অয়, কিন্তুুক য্যান শেষও অয় না। সেজু ভাইয়ে টেইলারিং কাম – এই কয় বছরে যা শিখোনের শিইক্ষা -নিজেই  অখন এক দোকানে মাস্টারের কাম করে। সেয় যা পায়- হেইটা দিয়া কোনোমতে দিন চলে! কিন্তুক আমি দেখি যে, সেয় বাইত খাওন-দাওন  আনোনের ধুম ফালাইয়া দিছে। একদম বহুত ঘনঘন সেয় অইটা করতাছে! এই না শবেবরাত আসছে! হেয় ধুম কইরা নিয়া আসলো তেরোটা মুরগি- ছয় সের পোলাওর চাইল- হাবিজাবি -বহুত কিছু! কতা নাই বার্তা নাই -ঘরের সবটিরে সেয় সিনেমা দেখতে লইয়া যাইতাছে! যহন-তহন লইয়া যাইতাছে! শাটের উপরে শাটের- কী বাহার হের! খালি হেয় ট্যাকা লাড়ে-চাড়ে! ট্যাকার উপরে ট্যাকা। দরজি কামে এত্তা ট্যাকা কুনদিক দিয়া আহে! রাস্তাঘাটে বাইর হইলে- দোস্তবন্ধুরা কেমুন জানি আওয়াজ দেয় আমারে, ‘কিরে? ফুইল্লা তো তরা হাত্তি হইয়া যাইতাছস গা!’

কিয়ের হাত্তি!

অরা যে কী কয় – অরাই বোঝে! আমারে তারা সবকতা ভাইঙ্গা কওনের আগেই- এক সন্ধ্যা রাইতে পুলিশ আইসা- খেও দিয়া আমাগো বেবাকাটিরে ধইরা – ভ্যানে তোললো। আমরা  দোস্তবন্ধুরা হগলটি খালি গিয়া তহন রাস্তার মোড়ে খাড়াইছি, পুলিশ আইয়া দমাদম মাইর দিয়া,  গাড়িত ঠেইল্লা দিলো। ক্যান আমরা আরেস্ট হইলাম? পুলিশের কাছে বোলে খবর গেছে- কোন এক ডাকাতি মামলার আসামি বোলে হইতাছে- এই পাড়ার চ্যাংড়া পোলাপাইনটি! হাজতে পইড়া পইড়া আমাগো দিন যায়; আর তারিখের দিন আমরা কোমরে দড়িবান্ধা হইয়া কোর্টে যাইতে থাকি। মোটা মোটা শিকের ঘের দেওয়া একখান খাঁচার মোতন খুপড়ির ভিতরে ঢুইক্যা- জজ হুজুরের দিকে দুই হাত জোড়া কইরা খাড়াইয়া থাকি, কিন্তু বিছার আর আগ্গায় না! খালি টাইম পড়ে খালি টাইম পড়ে। এমনে সেমনে একবছর যায়- কোনো বিছার নাই, খালি টাইম পড়া ছাড়া-আর কোনো কারবার নাই! আমাগো সবটির বাবায় মিল্লা- আমাগো সবগিলির লেইগা – একজোন উকিল রাখছে! য্যান হেই মিয়ায় আমাগো জাবিন লইয়া হেয়! কিন্তুক হেই উকিলে কই যায়,কী করে, কী কয়,কী বোলে! আমাগো জাবিনের কোনো খবর নাই! আমরা হগলটিয়ে খালি হাজত খাইট্টা যাইতাছি তো যাইতাছি! হাজতে কুকড়ি-মুকড়ি খাইয়া হুইয়া থাকতে থাকতে কাইন্দা জারেজার হই। আরে! এইটা কী বিষয়- আমারে ক্যান হাজত খাটতে হইতাছে!

আমি ফিজিক্স পড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। যেতে হবে তাত্তি¡ক জ্ঞানের পথে! মেঘরাজ্য না-ছোঁয়া পর্যন্ত থামবো না- এই হচ্ছে আমার জন্য আমার পণ। আমি যে একটা মারাত্মক অন্যায় করে ফেলতে যাচ্ছি- সেটা ভর্তি পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে ঢুকেই – বুঝতে পেরেছিলাম। আমার অপরাধ বা অন্যায় এই যে, আমি ইউনিভার্সিটিতে আমার একমাত্র পছন্দের বিষয় হিশেবে নিতে চাচ্ছি – ফিজিক্স। পিওর ফিজিক্স। ভাইবা বোর্ড টুকরা-টাকরা হাসি দিয়ে দিয়ে- আমার পাগলামির তল মাপা শুরু করে। দুই দুইবার স্ট্যান্ড করা ছেলে- ফিজিক্স পড়তে আসবে কেনো! তার জন্যে তো পশ সব সাবজেক্ট অপেক্ষা করে আছে! সে কম্পিউটার সায়েন্স পড়বে, নয় পড়বে ফার্মেসি, নয় অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স। নয় মাইক্রোবায়োলজি। ফিজিক্স! হোয়াই ফিজিক্স!

হ্যালো! হ্যাভ ইউ গন ক্রেজি ! ফিজিক্স নিতে চাও!

দ্যাখো ছেলে- হ্যাভ ইউ কাম ফ্রম আ রিমোট ভিলেজ? ঢাকায় তোমার কেউ নাই – পরামর্শ দেওয়ার? ভালো সাবজেক্ট কোনটা, সেইটা বলার কেউ নাই তোমার?

ফিজিক্স কেন নিবা তুমি? এর চাকরির ভবিষ্যৎ কি?

ডাবল স্ট্যান্ড একটা ছেলে ফিজিক্স নিয়া ভবিষ্যৎ মাটি করতে চায়!!!

রকিব নিরুত্তর থাকে। ফিজিক্স পড়লে ভবিষ্যৎ মাটি হয়! রকিবের তো ফিজিক্স ছাড়া নো আদার চয়েস। রকিব ফিজিক্স চায়- হি ওয়ান্টস টু বি স্পয়েল্ড ইন দিস ওয়ে। রকিব ফিজিক্স চায়! ভাইভা বোর্ড ওর অই বেকুবি দেখে বিদ্রূপে হেসে ওঠে আবার! জনা দুই আফসোস করে!  দু-একজন শেষবারের মতো- ওর মত ফেরাতে চায়! তারা একটু কেমন ভীতি প্রদর্শনের পথ ধরে আগায়!

‘এখন তো বুঝতাছো না। পরে কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও সাবজেক্ট বদলাতে দিবো না তোমাকে। তোমার নাম রোল নাম্বার-সব মার্ক করে রাখলাম।

পরে কিন্তু ভালো বিষয়ে যাবার আর চান্স পাবা না।

এই শেষবার সুযোগ দেওয়া হলো- নিবে কম্পিউটার সায়েন্স?

রকিব ফিজিক্স চায়। হেই ফিজিক্স! হেই! হ্যাভ ইউ হার্ড হোয়াট দে সে- তোমার সম্পর্কে! তুমি রাগ কোরো না শুদ্ধতম জ্ঞান! রকিব তোমাকে চায়। কিন্তু রকিবকে কী বিড়ম্বনা ঘিরে ফেলে দ্যাখো! ক্লাস শুরু হবার পর- সকলে তাকে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ডিপার্টমেন্টের মামুরা দেখে, ক্যান্টিনের ক্যাশিয়ার দেখে, বয়-বাবুর্চি দেখে।  দেখে, আর চোখ ছানাবড়া করে। মাথা গরম নাকি ছেলেটার! ভালো ভালো সাবজেক্ট রেখে  কিনা- সে আসছে  রদ্দি-মদ্দি ফিজিক্স ঘাঁটতে। ওহ! আমি পারছিলাম না- পারছিলাম না – ওইসব চাউনির বিদ্রূপ সহ্য করতে! ফিজিক্স পড়তে চাওয়ার অপরাধের কারণে যে দন্ড আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিলো- আমি পারছিলাম না সেটা সহ্য করতে। ওহ! আম্মা! এটা আমি কোথায়! কোথায়! আমি বাংলাদেশে।

জিয়োগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট থেকে দলেবলে পোলাপান আসতে থাকে! নব্য আঁতেলের খোঁজ করতে আসে তারা! কেমিস্ট্রির দঙ্গল হি হি করে ওঠে! ইন্টেলেকচুয়াল অফ নিউ এরা! ওই যে যায়। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি গলায় অদ্ভুত আওয়াজ তোলে! মাইক্রোবায়োলজি হাঁক দেয়; আঁতলামি  আঁতলামি…।

“আম্মা- আম্মা! এরা এমন করে কেনো! আমি কীভাবে পড়বো এখানে!”

‘একটু সহ্য কর- একটু পুরু কর চামড়াটা, কালো! একটু!’  নিবিড় দুঃক্ষের দিনে আম্মা আমাকে এই নামে ডাকে। আম্মা- তোমার কালো- তার চামড়াটা পুরু করে নেবে- গন্ডারের মতো পুরু!

‘তোকে আগে পার করি -এই আন্ধার সুড়ঙ্গ! তারপর রাগ করা যাবে- কালো।’

টিটকারিগুলো আমার ওপর আছড়ে পড়তে থাকে! এদিক থেকে ওদিক থেকে- পড়তেই থাকে ননস্টপ। ওহ! অ্যাম আই গোয়িং টু বি সামথিং লাইক জড় প্রস্তর! টিটকারি সহ্য হয়ে যায় আমার! সহ্য হয়ে যায়! হাউ কাম!

জামিনের লেইগা রাস্তা গোণতে গোণতে, শেষে, হাজতের মোশার কামড়ও সহ্য হইয়া যায় আমার। না-ফুরাইতে চাওয়া দিনগুলাও সইজ্জ হইয়া যায়! এমুন সোমে আঁতকা খবর আসে- মামলা বোলে খারিজ হইয়া গেছে। কিসের মামলা ক্যান খারিজ হইলো ক্যামনে খারিজ হইলো- কিছুই বোঝার উপায় নাই। খালি এক বচ্ছর সাত মাস বাদে বাইত আইলাম আমি- হাড্ডিকাটা সার হইয়া। হাজতখাটা দাগী এক ঢ্যাঙা বেটা হইয়া।

আমি  কিনা  হালার জেলে দিন পার করি কাইন্দা-কাইট্টা,ওদিগে বাড়িত আইয়া দেহি যে, বাড়িত বহুত চমচমি চলতাছে! বেশুমার খাওন-লওন হইতাছে!   দুনিয়ার নয়া নয়া  কাপড়চোপড় কিনা হইতাছে- অহন তহন! সব সেজু ভাইয়ে করতাছে। হেয় বোলে- কিয়ের ব্যবসা ধরছে। দর্জি কাম থুইয়া সেয় কিসের ব্যবসা করে! হেয় বোলে- কিয়ের ব্যবসা ধরছে। দর্জি কাম থুইয়া- সেয় কিসের ব্যবসা করে! আমি তারে জিগাই! সে কয়, ‘আছে। তর হোননের কাম কি?’ তাইলে আমি আর জিগাই ক্যান! অন্য সকলতের লগে লগে তাইলে- আমিও খালি খাইয়্যা যাই।

বাড়িত কী রান্ধার ধুম রে বাবা! এই দুই ডজন ডিমের কোরমা রানতাছে মায়! এই ছয় সের গরুর গোশত। গোশতের লগে খাওনের লেইগা- দুনিয়ার পারটা বানানী হইতাছে। আমি খাই-লই, আর টাউনে গিয়া কাম বিছরাই। আগের ডায়িং ফ্যাট্টরি  আমারে কয় যে, হেরা আর আমারে নিবো না! তাও আমি রোজই গিয়া-তাগোই ধরাধরি করতে থাকি। বেহুদা কতখোন তাগো ধরাধরি কইরা – আমি সিনেমা হলের ভিতরে যাই। হেইনের পুস্টারটি ভালামতন দেইখ্যা- আমি হেইরপর দোফরের টাইমে বাইত আহি! আইয়া, ধুম-ধাড়াক্কা খাওন খাই! আরে আল্লারে! দুনিয়ার খাওন!

আমারে খাওন বাইড়া দিতে দিতে মায় কয়, ‘অইবো নে কাম! আউজকা না অয় কাউলকা অইবো। তুই বেজার অইয়া থাকিস না!’ হেই দিন দোফরেও কামের লেইগা বেহুদা ধরাধরি কইরা, সিনেমা হলে ঘোরান দিয়া,আমি বাড়িত পাও দিয়া দেখি-বাড়ি ভইরা কুদাকুদি চলতাছে! ঘরের জিনিসপাতি সব ছন্নভন্ন! হাড়ি পাতিল উল্টাইন্যা! আর উঠান ভইরা পুলিশ।

সেজু ভাইয়েরর দোস্ত জালাইল্লার কোমরে দেহো- দড়ি বান্ধা। সেয় কতোক্ষণ পরপর পুলিশের রুলের বাড়ি খাইতাছে, আর চিক্কার দিয়া উঠতাছে। কি হইছে কি- বিষয়টা? আমাগো বাইত পুলিশ ক্যান! জালাইল্লায় আমারে দেইক্ষাই কয় কী, ‘পুলিশ ছার- কইতাছি-কইতাছি- এই হইলো আমার ফেনছি ব্যবসার পাটনার!’

আয় হায়! আমি কবের থেইক্যা ফেনছিডিলের কারবার করা ধরলাম! জালাইল্লায় এটি কয় কী! আমি কই, “অই শালার পুত, এইটা কি কলি? আমি তর লগে ফেনছির ব্যবসা করি!” কিন্তুক তহন কে কারে কথা কইতে দেয়!

আমার কোমরে আবার দড়ি পড়ে! ঠেইল্লা লাত্থি দিয়া- পুলিশে আমারে গাড়ির ভিতরে ফিক্কা দেয়! শালার পুতের দেশ! কার মাইর- কার উপরে দেও তুমি! সেজু ভাইয়ের এত ট্যাকার চমচমির পিছে তাইলে এই বিত্তান্ত! পুলিশে আমাগো পুষ্কুনীতে খেও দিয়া- গাট্টি বান্ধা ফেনছিডিলের বোতল তুইল্লা আনে। মামলা পাকতে কতোক্ষণ! তয় হাতে- নাতে ধরতে পারে নাই তো! সেই কারোনেই  এই-সেই কইরা কইরা- ছয়মাসের মাথায়-জাবিন পাওন গেলো। অখন তারিখে তারিখে গিয়া কোর্টে হাজিরা দেও। কিসের মইধ্যে যে পড়লাম- এই শালার পুতের দেশে!

জাবিন লইয়া আহোনের পর -আরেক মুসিবত আইয়া খাড়া হয়। আমাগো মইল্লার যেই পোলাপাইনটি- এই হেইদিনও গুঁড়াগাড়া আছিলো; আতকা কেমনে জানি অরা ডাঙর হইয়া উইট্টা আমারে কয়; ‘মালপানি ছাড়!’

কিয়ের মালপানি?

‘ফেনছি দিয়া কামাইতাছো না? তুমি একলাই লাল অইবা নি- পুঙ্গির পুত?’

রাস্তা দিয়া হাঁটতাছি- হাঁটতাছি-  আতকা কথা নাই বার্তা নাই, কোন মহল্লার জানি- কত্তটি ড্যাকরা ছেড়ায় কুঁদাইয়া আইসা খাড়ায় আমার সামনে! কয়, ‘আমাগো দশ বতল ডাইল দেওন লাগবো।’

“কিয়ের ডাইল?” আমি বেবুদ্ধি মোখে জিগাই!

‘আমাগো আতে টাইম কম!’ ড্যাকরাটিয়ে আমারে ধামকি দেয়; ‘ কইতাছি দিতে, এক্ষণ দেওন লাগবো!’

“‘অই তরা কি কস? কইতাছস কি? শালার পুতেরা, আমি ডাইল পামু কইনে?”

‘ডাইল পাইবা কইনে? গুষ্টি সুদ্ধা ডাইলের ব্যবসা কইরা- দুনিয়া ভাসাইয়া দিতাছ, আবার জিগাও ডাইল কই পাইবা? ভালা চাইলে এক্ষণ দেও- দশ বতল।’

“শালার পুতেরা!” আমার ত দেহি আর সহ্য হয় না! “‘অই শালার পুতেরা, দিতাম না তগো ডাইল। দেহি তো কী করস তরা!”

অরা সবটিয়ে মিল্লা -হুড়–ত কইরা- আমার উপরে ঝাইপ্পা পড়ে। ঘুষি কিল গুঁতা লাথ্থি- দিতাছে তো দিতাছেই। আমি একলা কয়টারে খেদামু- কয়টারে কাবু করমু- মানইষেরা দ্যাহো খাড়াইয়া খাড়াইয়া – আমার মাইর খাওন দেখতাছে! একজোনেও নি  আমারে বাঁচানের লেইগা আগাইয়া আহে! এইটা শালার কেমুন চুতমারানির দেশ হইয়া গেছে!

ফয়সাল আমাকে বলে যে, দোস্ত তোর ফার্স্ট ইয়ারের নোটগুলা আমারে দে।

“হোয়াই? হোয়াট ইজ দ্যা ইউজ অফ ইট?”

‘আমারে তো দোস্ত – ফার্স্ট ইয়ারের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষাটা দেওন লাগবে! নম্বর দ্যাখ- থার্ড ক্লাসের নম্বরও আসে নাই এইবার!’

“ওহ্। এতো খারাপ করলি কেমনে!” আমি বেদম দিশাহারা বোধ করি। আঁতেল আঁতেল বলে চিৎকার দিতে  থাকা সকলের মধ্যে- ফয়সালই একজন- যে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে! ক্লাশে আমার পাশে বসে। আমার সঙ্গে চা খেতে যায়, একসঙ্গে ল্যাবওয়ার্ক করে। উফ! আই অ্যাম গ্রেটফুল টু হিম! ফয়সাল এত্তো খারাপ করলো ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট!

‘কাম অন রকিব! সকলেই কি তুই হবে নাকি? আমরা সকলেই কি তোর মতো? রেকর্ড মার্কসের চেয়ে দশ নম্বর বেশি পেয়ে বসে থাকবো!’ ফয়সাল খুব রাগ করে -আমার সঙ্গে!

আচ্ছা-ঠিক আছে- অই নোটগুলো তো আমার আর দরকার নেই! ওকে দিয়ে দিই তবে অইগুলো! “ কিছু বোঝানোর দরকার হলে বলিস- একসঙ্গে বসবো নে!” আমি ওকে বলি! কিন্তু ফয়সাল কতোটা পড়তে থাকে, আমি খোঁজ নেবার সময় পাই না। ও সামলাতে যাচ্ছে ওর ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা- আমার তো সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল। ওফ, কোনো যে পরীক্ষা দিতে হয় ছাত্রকে! সিস্টেমটা বদলানো যায় না? আই ডিসলাইক ইট। তবুও তো মাথাগরম না-করে,সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল শেষ করতে হলো! রেজাল্ট এখন যবে আসেÑ আসুক! থার্ড ইয়ার ক্লাশ যে দৌড়ুনো শুরু করেছে, গড!

এদিকে সে-এক কান্ড! ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো আমার। যে মুখের স্বপ্ন আমি দেখি- ফিজিক্সের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে- সেই মুখ! আম্মা য-মুখকে বলে পানপাতা মুখ- সেই মুখ-এইখানে আমার ডিপার্টমেন্টে! তার নাম লাবনী। ক্লাশে যাওয়া, ল্যাবে ঢোকা, লাইব্রেরিতে কাজ করা-সবকিছু ঢের বেশি ভালো লাগার হয়ে ওঠে! ওইখানে লাবণী আছে যে! কিন্তু আমি কি করে ওই মেয়েটিকে- এই কথা বলি? কেমনে করে বলি! কেমন করে বলতে হয়! শিট! আই ডোন্ট নো দ্যা ওয়ে! শিট। হোয়াট অ্যা অপদার্থ আই অ্যাম! আমি আমার ভেতরে গোমড়াই। কিভাবে কাছে যেতে হয়? কীভাবে!

আহ্ ন্যাচার! আই অ্যাম থ্যাংকফুল টু ইয়ু! দূরকে তুমি কীভাবে নিকট করো! ইন্টারেস্টিং! লাবণী নিজে নিজেই আমাকে এসে বলে, ‘ভাইয়া, ফিজিক্স পড়তে আসছি। কিন্তু অনেক কঠিন লাগতেছে! আপনার হেল্প না হইলে আগাইতে পারবো বলে মনে হইতাছে না।’  দূর এসে পৌঁছায় কাছে! কিন্তু লাবণী কেমন ভাষায় কথা বলে। এটা কেমন বাংলা! এটা কেমন বাংলা! আমার কানে সহ্য হতে চায় না! ওকে! সব ঠিক করে নেওয়া যাবে। কিন্তু লাবনীকে কখন সময়টা দেই! আমার পড়া আছে না! থার্ড ইয়ার ফাইনাল ঘনাচ্ছে না? কিন্তু সময় তো দিতে হবে। ওয়েল! সপ্তাহে তিনদিন লাইব্রেরি ওয়ার্ক বাদ। আমি পুরো বিকেল ভরে লাবনীকে পড়াই। পুরো ক্যাম্পাস জেনে যায়, রকিব লাবনীর জন্য উতলা! লাবনী জানে না ক্যানো! সারা ক্যাম্পাস আরো কতো কী জানে রকিবের বিষয়ে! রকিব সে-সব জানে না ক্যানো!

ক্যাম্পাস জানে, ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের কাছে- রকিব তার ফার্স্ট ইয়ারের নোটগুলা বিক্রি করছে- খুব ভালো রেটে বিক্রি করছে! অলমোস্ট সব স্টুডেন্টই খাচ্ছে অই নোট! লাস্ট দুবছর ধরেই খাচ্ছে! এবার যে ফার্স্ট ইয়ার এসেছে- তারা একেবারে শুরু থেকেই অই নোটগুলা- হন্যে হয়ে খুঁজছে। তবে রকিবের চক্ষুলজ্জা আছে। সে নিজে নোট বেচাবিক্রির কাজে নাই!  রকিবের হয়ে ওগুলো সেল করছে ফয়সাল। বন্ধুর জন্য কাজ করে দেওয়া আর কী! আঁতেল হলে কী হয়, ধান্দাটা ভালো জানে রকিব! টাকা আর্ন করার যেই ফন্দিটা বের করেছে সে! তার বুদ্ধির তুলনা নাই!

ফয়সাল রকিবের নোটগুলা বিক্রি করে, পকেটে টাকা তুলতে তুলতে, সবকথা শোনে। শুনে ঠা ঠা হাসে। শালা আঁতেল!  দ্যাখছো ধরা খাওয়া কারে বলে? তুই শালা এখন-ফয়সালের হাতে ধরা খাওয়া! তুই কারে বিশ্বাস করাবি যে- এইটা আমার চাল!

“আম্মা- এটা আমি কোথায় আছি! কোথায়? ফয়সাল আমার নোটগুলো – পড়ার জন্য নিয়েছিলো! এসব কী হচ্ছে আম্মা! আমি কী করবো- কী করবো!” আমি লাবনীর কাছে যাই। আমার চলতে ইচ্ছে করে না, তবু চলি। আমার মনের কথাটা-আজ ওকে বলা দরকারই ! আজই স্পষ্ট করে বলা দরকার! ও আজ আমার মুখেই সেই কথাটা শুনুক! এতোদিন কথা দিয়ে -যা প্রকাশ করা হয় নি; আজ তার প্রকাশ হোক! এতোদিন আমার চোখ,ওর দিকে আমার ছুটে যাওয়া, আমার ভঙ্গি আমার কণ্ঠস্বর – বারেবারে মিনিটে মিনিটে ওকে যা বলেছে; আজ তার স্পষ্ট উত্তর আমাকে শুনতেই হবে। আমি বলি,“লাবনী! আমি তোমাকে ভালোবাসি!”

‘এসব আপনি কী বলতেছেন, ভাইয়া? আমার শুনতে খারাপ লাগতাছে।’ লাবনী চেহারা কালো করে- রুক্ষ কণ্ঠে বলে।

“আমি তোমাকে ভালোবাসি! তুমি বোঝো না?”

‘আমি ক্যান এইসব বুঝবো? আমি আপনারে বড়ো ভাইয়ের মতো দেখি! ভালোবাসার কথা এইখানে আসতাছে ক্যান!’

লাবনী আমাকে বড়ো ভাইয়ের মতো দেখে! ও গড, ও গড ওহ্ গড! বেশ তোÑ দেখতেই পারে! দুজন কী একই সঙ্গে প্রেমে পড়তে পারে? কেনো পড়লো না! কেনো। হোয়াই। হোয়াটস দ্যা প্রবলেম উইথ মি! কেনো! আই লাভ ইয়ু লাবনী!  প্রিয়তমা সুন্দরীতমা- হে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার- আমাকে তোমার ভালোবাসা দাও! ‘ওই কালাকুষ্টির সঙ্গে প্রেম! ছেঃ! কথা বলতে গিয়া- তোতলাতে তোতলাতে আমার কানের মাথা নষ্ট কইরা দেয়! ওইটার সঙ্গে কী প্রেম! লাবনী এতো সস্তা না! আরে, হাবাটারে তো খালি পড়া বোঝানের কাজে ইউজ করা যায়! ওইটার বেশী আর কিছু করা যায় নাকি! ওর সঙ্গে প্রেম করতে হবে। ছাগল নাকি!’ অন্যদের মুখে মুখে – লাবণীর মনের কথাগুলো-উড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে! সেই কথারা আমার কাছেও এসে পৌঁছায়! আম্মা বলে, ‘ এই ঘোর সুড়ঙ্গ অন্ধকার তোকে পেরুতে হবে! কালো!’

“হ্যাঁ-হ্যাঁ, আম্মা! পেরুতে হবে।”

‘টলিস না-টলিস না! খবরদার টলবি না!’

রকিব যদি কষ্টে কষ্টে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে শেষও হয়ে যায় – সেই ছেঁড়াখোঁড়া রকিবকে রকিবেরই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেরোনোর আর কতো বাকি- কতো বাকি!

আফিয়ায় আমারে রোজ দুপুরের টাইমে, অগো বাড়ির, ওর-বরই গাছতলায় যাইতে কয়। এত্তবার হাজতখাটা জেলখানা ফিরত আমি, তাও দেহি উয়ে আমারে দেখলে মুখ মটকায় না! আমারে এট্টুও য্যান ঘিন করে না! উল্টা আমারে দেখলে সেয় হাসি দেয়, আর ডাক পারে। আমি হেষে না-পাইরা একদিন দোপোরের টাইমে, আফিয়াগো,  ওর-বরই গাছতলায় যাই! অয়ে আমার লগে কতো বাহারের কথা কয়, হাসি মশকরা করে! আমার খারাপ লাগবো ক্যান!  উয়ে কয়, আমি য্যান অরে একদিন রুবেলের- ওই যে হিরু রুবেল- হের একটা পিকচার দেহাইতে লইয়া যাই!

আচ্ছা নিমু। এইটা কোনো ব্যাপার!

উয়ে আমার লগে পিকচার দেহে, এক রিকশায় গাও ঘেঁষাঘেঁষি কইরা- আমরা সিনেমা হলে যাই-আসি, বাদামভাজা খাই- চেনাচুর! আমি বুজতে থাকি যে, এইনে,আমাগো দোনোজোনের ভিতরে, ভাব- ভালোবাসা ঘইট্টা যাইতাছে!  হউক না! প্রেম- মোহব্বত না থাকলে কী জুয়ানকি জমে! ঈদে-চান্দে আমি অরে জরজিটের থিরি পিচ কিন্না দেই! এক ঈদে দিলাম পাঁচশ ট্যাকা! এই যে দেওয়া-দেওয়ি! এটি দিয়াই প্রেম- মোহব্বত জমে। আমরা চুমাচুমি খাই, জাবড়া-জাবড়িও বাদ নাই! অম্মা- কিয়ের মইদ্যে কী! একদিন শোনা যায়, আফিয়ার বোলে কার লগে পলাইয়া গেছে গা!

আরে, পলাইলে তো আমার লগে পলাইবো! অর লগে তো আমার প্রেম- মোহব্বত! কিন্তুক আফিয়ায় পলাইলো কার লগে? না! মহল্লার মিদে যেই ছেড়ার বেশি ট্যাকা আছে-  অই যে মোহসীন- আফিয়ায়  ওইটার লগে পলাইছে! মোহসীনে কয়দিন জানি -কই গিয়া- নাই হইয়া থাকলো! তার বাদে আবার সেয় মহল্লায় আইয়া ঘোরে- খায় লয়! য্যান কিছু অয় নাই! য্যান আফিয়া কেটায় – উয়ে তার কিচ্ছু জানে না!

মোহসীনে তো ফিরা আসলো, তাইলে আফিয়ায় কই আছে?  আফিয়ার সন্ধান কেউ জানে না। আর তামশাটা দ্যাখো! আফিয়ার মায়-বাবায় গিয়া কিনা – আমার নামে-নাবালক মাইয়া অপহরণের মামলা দেয়! হায়রে মজা! চুতমারানির দেশের তামশা দ্যাখছো! পুলিশ আমারে বিছরাইয়া – বাড়িঘর ফাতাফাতা করে! আরে- আমি এর কী জানি! আমি কেমনে আসামি হই! কিন্তুক আমি আসামি। তবে এইবার আর আমারে ধরোন খায় না! বহুত ধরা খাইছি! ভালামানষীর কারণে বহুত জোতা খাইছি! অহন আমি কী আর চোখ-নাক-কান খোলা হই নাই! হইছি! শালার পুতের দেশÑ গাদ্দারের গুষ্টির দেশ! মার পিছা! অর নাক মুখ বরাবর-পিছা মার! যামু গা শালার এই দেশ ছাইড়া। হাঁটোন পার্টির লগে ম্যালা দিলে- দেশ ছাড়তে কতোক্ষণ!

আমার কিন্তুক পাসপোটও আছিলো না। এক কাপড়ে এক জোতায়- ছাড়লাম শালার দেশ! এই ইন্ডিয়া দিয়া যাই পাঞ্জাবের দিগে! ধরা খাইয়া জেল খাটি ছয় মাস। পাকিস্তান দিয়া ইরান গেলাম- ইরান ছাইড়া টার্কি। টার্কি থুইয়া রুমানিয়া, রুমানিয়ার বাদে হাঙ্গেরি। বাউন্না বাতাসের মোতন জানপরান হাতে লইয়া লৌড় পারলাম। মার সোনার গয়নাটি যা আনছিলাম- কোন্দিনে হেটি দালালেরা লইয়া গেছে গা! আর আনছিলাম- সেজু ভাইয়ের ফেনছি বেচোনের এক বোন্দা ট্যাকা! হেইগিলিও দালালে – চক্ষের পলকে তুইল্লা লইয়া গেছে। জায়গায় জায়গায়, বাগানে ক্ষেতে, যেইনে পারে দালালে আমাগো কাম করায়! মাসের পর মাস-কাম করাইয়া যাইতে থাকে! এক মাইল আগাইলে- তিন মাস থোম ধইরা বইয়া থাকোনের হুকুম দেয়! থাকলাম। খাটলাম। মনে মনে এই কিরা কাটলাম যে, এই জীবনে ওই শালার পুতের দেশে আর ফিরুন্তি নাই! দেহি এমনে কদ্দুর যাওন যায়! যদ্দুর যাওন যায়, যামু।

রুমানিয়ার আইসা দালাল আমাগোরে কয় যে, যাইতে হইলে- এইর পর – বন্ধ ভ্যানের ভিতরে, লেটকি খাইয়া বইয়া, যাইতে হইবো। এই ছাড়া অন্য রাস্তা নাই। কী সব গোশত-মোশত নেওনের আজদাহা এক ভ্যান। হেইটার চাইর দিগ- ঠাসা বন্ধ! খালি উপরে এক কোণায় একটা এট্টুক গর্ত! কোনোমতে বাতাস ঢোকে কী ঢোকে না- এমুন অবস্থা। তয় যাওন তো লাগবো! সেইটা নিয়া আবার কথা কী! যাওন লাগবো, যামু!

হায়রে ঘুটঘুট্টি আন্ধার! ভ্যানের ভিতরে- হায়রে আন্ধার! মনে হয়, কব্বরের তেনে বেশি আন্ধার। কোণার ছিদ্রি দিয়া, হাছা- মিছা এট্টু বাতাস আহে কী আহে না! সেইটুকই হড়হড়াইয়্যা শইল্লের ভিতরে  নেই! চাইর চাক্কার আন্ধার কব্বর যায় যায় যায়!  কতোবার দিন গেলো রাইত  আসলো, কে জানে! ঘুরঘুট্টি কব্বর যাইতাছে তো যাইতেছে! কই গেছে খাওন- কই গেছে গোছল- কিসের বোলে ঘুম- কিসের বোলে জাগনা থাকা! সব জাবড়া- জাবড়ি কইরা- হইয়া উঠছে নিঃসাড় আন্ধার! এই হুঁশ আছে, এই হুঁশ নাই হইয়া যায়। আহ্হারে! এট্টু পানি যুদি পাইতাম! কব্বর চলে চলে চলে! কোনোখানে থামোন নাই! হায়রে! পানির লেইগা কইলজা ফাইট্টা যাইতে চায়! পানি খামু। পানি খাওন লাগবো। পানি কই পামু। পানি কেমনে পামু! শেষে সগলতে মিল্লা- একদমে পানির বন্দোবস্ত – কইরা ফালায়। চড়চড়াইয়া মোতা ধইরা-একেকজোনে আঁজলায় আঁজলায়- সেই মুত নেয়। মুত খাওন যায় না- কেটায় কয়?  খাওন যায় তো! খাওন যায়। পানির মতোনই তো লাগে। মুত মোনে অয় না! পানি পানি লাগে! শেষে একদিন কব্বরের দরজা ফাঁক হয়। আমাগো সামনে অইটা কী দেহা যায়?  একখান সীমাছাড়া  ধু ধু ময়দান দেহা যায়!

ফয়সাল আমার নোটগুলা বছরের পর বছর ধরে বিক্রি করে চলছিলো! আমার নাম করে করে বিক্রি করে চলছিলো! সকলেই জেনেছে সেই কথা, শুধু আমি জানি নি! আমার জানতে দেরি হলো কেনো! আমি ফেরি হচ্ছি- আমি বিক্রি হচ্ছি- আমি কেনো জানবো না! তাহলে আমি সারভাইভ করার যোগ্যতা রাখি না? আমি তো প্রেম পাবারও যোগ্যতা রাখি না। আমি তবে কি? কি? কোনো আমি! কোথায়- কোথায় আমি!

কারা নাকি আমাকে খুঁজছে খুব করে, কিন্তু একটুর জন্য ধরতে পারছে না! হয় আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছি, ল্যাবে গিয়ে তারা আমার খোঁজ করছে! আমি নেই। ক্লাশ শেষে  আমি দৌঁড়ে গেছি বাস ধরতে, তারা ক্লাশের সকলের কাছে- আমার সন্ধান করছে। কারা তারা? তারা পার্টির লোক।  শেষে একদিন তারা আমাকে ধরে ওঠে। আমার তখন খুব তাড়া ছিলো।  সকালের ক্লাশ আটটায়, আমি ওদিকে আটটা পাঁচ করে ফেলেছি। তখন সিঁড়ি ডিঙোচ্ছি দু’তিনটা করে করে, তেমন সময়ে তারা আমাকে  ঘিরে ফেলে! তারা ওপর থেকে নেমে এসে, আমাকে ঘিরে নিয়ে, হ্যান্ডশেকের ওপরে হ্যান্ডশেক করা শুরু করে।

‘আরে ভাই- আসেন চা খাই!’ তাদের প্রধানজন বলে।

“না ভাই, স্যরি! আমার ক্লাশ।”

‘কিন্তু কিছু ইম্পরট্যান্ট আলাপ ছিলো!’ তারা চা খেতে চাওয়ার কারণটা জানায়।

‘চিনছেন তো আমাগো? আমরা দলের নেতা-কর্মী!’ একজন আরো স্পষ্ট হয়।

‘এখন আপনেরে আমাদের পার্টিতে জয়েন করতে হইবো!’

‘একজন ভালো ছাত্র পার্টিতে আসলে – আমাদের ইজ্জত বাড়বে!’

‘কী কী সুবিধা আপনি পাবেন, বলতেছি!’

‘হলে একটা পুরা রুম আপনেরে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। আজকা থেকে।’

‘আপনার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব পার্টির।’

‘এইটা তো একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। ভার্সিটিতে আপনার ঢোকার জন্য- পার্টি সবকিছু করবে!’

‘আপনার টাকা-পয়সার বিষয়টা পার্টি দেখবে। আমরা শুধু আপনারা ফেসভ্যালুটা চাইতেছি!’

‘একটা বাইক আপনার জন্য থাকবে- ফুয়েল কোনো ব্যাপার না!’

‘যদি আমাদের সঙ্গে না এসে, ওদেরটাকে যান! পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে! আমরা আগে আসছি!’

‘হয় আমাদের পার্টিতে, নাইলে কোনোখানে না!’

তাহলে ওরা একটা অপশন রেখেছে – আমার জন্য! হয়তো ভুল করে, নাকি দয়া করে! আমি-আমি – পড়াটা শেষ করতে চাই! আমার ক্লাশ এখন! আমি কি যেতে পারি? তারা শেষ কথা বলে দিয়ে- চলে যায়। তারপর অন্য গ্রুপ আসে। তাদের মুখেও আমার জন্য-একই রকম নিরাপত্তা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশ্বাস- বাজতে থাকে! আমার ফেসভ্যালু এতো! এতো! আমি কোন পথ দিয়ে বের হবো এই ঘের থেকে? এই ঘিরে থাকা থেকে- কেমন করে বের হবো!।  ‘ওদের সঙ্গে গলা চড়াস নে কালো! খবরদার রে!’- আম্মা কাঁপতে থাকে, ‘বল- ওদের  বলে দে, তুই রাজনীতি বুঝিস না! বল যে, তুই শুধু পড়াটা করতে চাস! আর কিছু চাস না।’

আর কি চাইব আমি? আর কিছু কি চাওয়ার থাকতে পারে!

আমার আগে যারা অনার্স করে গেলো- তারা সব তিন বছরের কোর্স করা গ্রাজুয়েট। আমাদের সেশন থেকে অনার্স কোর্স চার বছরের। আমরা প্রথম ব্যাচ-চার বছরের গ্রাজুয়েশন কোর্সের প্রথম ব্যাচ! ওয়েল! পৃথিবীর অন্য সকলের মতো তাহলে হতে চলেছি আমরা!

স্যারদের অনেকে আমাকে তাদের রুমে যেতে বলতে থাকেন। কেনো? কেনো কে জানে! জুলফিকার হায়দার স্যার কথা বলেন সোজাসাপ্টা!  স্যারদের কতো দল, রঙের নামে নাম সব দল। জুলফিকার স্যার খয়েরি -না যেনো কালো দল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান।

‘শোনো রকিব, তুমি ফোর্থ ইয়ারে লেজার ফিজিক্স নিবা। আমার সাবজেক্ট।’ স্যার আমাকে জানায়ে দেন।

“আমি-আমি তো মডার্ণ ফিল্ড থিয়োরি পড়বো স্যার!”

‘দেখো। এইটা আমার প্রেস্টিজ ইস্যু। ওরা আমার সাবজেক্টের পাশে কিনা দাঁড় করায় মডার্ন ফিল্ড থিয়োরি! এই সাবজেক্টের কোনো বাজার আছে? এইটা পড়লে ভাত পাবা না!’

“ আমি স্যার-”

‘ফার্স্ট ক্লাস নম্বরের উপরে আরো কতো বেশি চাও তুমি? সমস্যা হবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে চাকরির ব্যাপারটা তো আছে। আমার দল ক্ষমতায় আসবেই!’

“স্যার-”

‘মর্ডান ফিল্ড থিয়োরির মতো পদার্থবিদ্যা – আমাদের জন্য না! ওইটা ওইসব ডেভেলপড কান্ট্রির পিপলদের জন্য। আমার সাবজেক্টে অনেক কাজ হয়ে গেছে। এইটা আমাদের স্টুডেন্টেদের জন্য অনেক হেল্পফুল সাবজেক্ট। ওই ফিল্ড থিয়োরি- এইটার ভাত নাই!’

“স্যার, আমি থিয়োরিটিক্যাল হাই এনার্জি ফিজিক্স পড়বো। ওটার জন্য ফিল্ড থিয়োরি না নিলে হবে না স্যার! এই জন্যই আমার ফিজিক্স পড়া!”

‘কি? তুমি নিজের মত ফলাও? কি বোঝো তুমি ফিজিক্সের? মডার্ন ফিল্ড থিয়োরি পড়বা ? আমার বিষয় বাদ দিয়া? যাও, মর গিয়া। দেখবো ক্যামনে তুমি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করো!’

পদার্থবিদ্যার অই নবীন শাখাটায় – কাজ করার ভীষণ ইগারনেস যে আমার ভেতরে! কেনো সেটা আমার জন্য হবে না? আমি কেমন করে থাকবো এখানে – এমন বিরূপ ক্রুদ্ধ চোখের নিচে-কেমন করে থাকবো! আরো কতো কতো ধমকা-ধামকি আছে আমার জন্য? আর কতো পেতে হবে?

ড. কবির হোসেন স্যার বলেন যে, বিষয়টা তো নতুন- এই যে ফোর্থ ইয়ারের জন্য যে-কোর্সটা চালু হয়েছে- তাই তোমরা নিজেরা নিজেরা আগে বইপত্র পড়ে নাও । আর রকিব, তুমি সিলেবাস ধরে ধরে নোট তৈরি করো তো? অমুখ তারিখের মধ্যে নোট তুমি – আমার কাছে সাবমিট করবে। তারপর আমি দেখবো- কীভাবে আমি পড়াবো।

স্যার যখনই যেভাবেই পড়ান গে না- আমার তাতে সমস্যা কী! আমার এদিকে খুব মজা লাগতে থাকে! একেবারে নতুন একটা বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-খুব থ্রিলড লাগতে থাকে আমার! নোট করতে করতে-অই নতুন সাবজেক্টটাকে- বেশ ভালো লাগতে থাকে।  স্যারের কাছে নোটটা নিয়ে যাবার পরে,স্যার বলেন; ‘এটা আমার কাছে থাকুক!’  ইইস! আমার একটু মনখারাপ লাগতে থাকে! নোটটার একটা ফটোকপি করে রাখলে তো হতো! ব্যাপারটা খেয়াল আসে নি!

রকিবের নোট ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে পড়ানো হতে থাকে, রকিবের ক্লাসে!  পরের ইয়ারে হুবহু পড়ানো হতে থাকে! আর কতোক্ষণ লাগবে- এই সুড়ঙ্গটা পার হতে? অতোটা  সময় – মাথাটা খাড়া রাখা যাবে তো! আমি পার হতে পারবো নাকি! নাকি পারবো না! চোখের সামনে ধু-ধু হলুদ- খালি লাফ-ঝাঁপ দেয়- আমার চোখের সামনে! রকিবের কান্না পেতে থাকা চোখ- রকিব কাঁদে- পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদে- হুঁ হুঁ! কেমনে পার হতে হয়- পার হয়ে কোথায় যাওয়া…

ভ্যান কব্বর থেইক্কা নাইম্মা দেখি, ধা-ধা মাঠ! মদ্যিখানে কতো কতো তারের বেড়া! লগে কাঁটাতারও আছে। দালালে কয়,ঐ তারগিলি পার হইয়া ঐপারে যাইতে হইবো। আমরা আছি অহন শ্লোভেনিয়ায়! হরেক রকম তারের বেড়ার এই পারে আছি! ওই পারে ইটালিয়া। আমার যাওনের শেষ জায়গা। এই তারগিলির ভিতরে দিয়া যাইতাছে কারেন্ট। কাজেই অই তারেরে কাইট্টা যে কেউ যাইবো-  সেইটার সাধ্য নাই। অই তারগিলিরে ডিঙ্গাইয়াও যে- কেউ যাইবো-  সেইটারও উপায় নাই!

দুইদেশের দুইপাশ থেইক্যা তারগিলি আইসা- একটা পাইপের ভিতরে-ঢুইক্যা গেছে ! আরে বাপ্পুস রে- বাপ্পুইস! কী বিরাটের বিরাট অই পাইপ! আর অই পাইপটা গিয়া যে কোনখানে ঠেকছে-  শ্লোভেনিয়ার এই মুড়া থেইক্যা- সেইটার কিছুই বোঝোন যায় না! কোন আসমানের কাছে জানি গিয়া – শেষ হইছে এইটার আরেক মাথাটায়! দেইক্ষা আমি টাসকি খাইয়া যাই! দালালে কয়, এই পাইপ তিন কিলোমিটার লাম্বা। আমি বুঝি মাইলের হিসাব! কিলুমিটারের আমি কী বুঝি!

পাইপের ভিতরটা বহুত চওড়া, কিন্তুক বোলে এইটার ভিতরে দিয়া গেছে- পাঁচ হাজার ভোল্ট কারেন্ট! ওই যে তারগুলা! সেইগুলার মধ্য দিয়া নি গেছে -পাঁচ হাজার ভোল্ট কারেন! আয় হায়! আমাগো বোলে এই পাইপের ভিতরে দিয়া যাইতে হইবো! হামা দিয়া দিয়া বোলে- যাইতে অইবো সেই তিন কিলোমিটার। তবেই বোলে পামু ঐ ইটালিয়ারে!  আমরা বিশজনে, মোনে মোনে, ঝলৎ কইরা চিক্কুর দিয়া উঠি! ডরে, আগামাথা ছাড়া ডরে, আমাগো শইল থরথরাইতে থাকে! কেমনে যামু ! কারেন্টের তারে ঠাসা পাইপের ভিতর দিয়া-কেমনে যামু!

অন্য উনিশ জনে যেমুন পিন্দে, আমিও তেমুন  প্লাস্টিকের টুকরাটিরে পিন্দি। পিন্দন তো না- দালালে কেমনে জানি তেনার মোতন কইরা সেই প্লাস্টিকরে-আমার শইলে  পেঁচাইয়া দেয়! শইল্লের এক তিল অংশ, এক চিমটি জায়গা য্যান খোলা না থাকে! একদম মোড়ানো রাখোন লাগবো শইল! একদম। এইটা তো আর শুইয়া করল্ করোন না! প্লাস্টিক মোড়া হইয়া, বইসা বইসা, পা টিপ্পা টিপ্পা আগানো! কোনো বেহুদা নড়নচড়ন নাই! শইল থেইক্যা খবরদার যানি প্লাস্টিক- এট্টুও কোনো দিক দিয়া না সরে! পাঁচ হাজার ভোল্টের কারেন চলতাছে কইলাম!  রিয়াজুলে দ্যাহো গো মা, বইয়া বইয়া পাও ফেলতাছে- টিইপ্যা টিইপ্যা পাও ফেলতাছে সেয়! প্লাস্টিক য্যান একচুল না লড়ে রে রিয়াজুল!  ইয়া আল্লা!  কতো কুটি বছর লাগবো- এই পাইপ পার হইতে! ইয়া আল্লা- পেলাস্টিক সইরা গেলো নাকি- মাথার তেনে! কান্দিস না, কান্দিস না রিয়াজুল! আরে সম্বন্ধীয় পুতের দেশ রে! তুই আমার তর কাছে ঠাঁই দিলি না!

আমি দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি করছিলাম শুধু ওইখানে- ওই দেশে- আমার দেশে! আসলে আমি থুবড়ে পড়ে গেছিলাম- ক্রল করছিলাম আমি- কোনোমতে ক্রল করা! ভাতের ব্যবস্থা করার জন্য যেখানে, জীবনের সব আয়োজন! সেই পশুস্তরের জীবনে- আমি চাই থিয়োরিটিক্যাল হাই এনার্জি ফিজিক্স পড়তে! পাগল না আমি? চতুষ্পদ! আইসিটিপির সব কাগজপত্র হাতে পাওয়া মাত্র- আম্মা আমাকে প্লেনে তুলে দিলো। আম্মা, তুমি কাঁদবা নাকি আম্মা! একা হয়ে যাচ্ছো  যে! একদম একা!

‘আহ্! আমার বাচ্চাটা এবার বাঁচবে। এবার স্কলার হবার রাস্তা ধরে মাথা তুলে হাঁটতে পারবে! আমার বাচ্চাটাকে আামি পার করতে পেরেছি- ভয়াল অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার করে দিতে পেরেছি! আমি ওকে উন্মূল উদ্বাস্তু করে অথৈ বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দিয়ে পেরেছি। ও বাঁচবে! ও বাঁচবে- ও বাঁচবে-’

ওহ বাংলাদেশ- ও আমার দেশ- এটা কেমন বেঁচে থাকা। অ্যাই রকিব অ্যাই! কাঁদবে না! এটা বিভুঁই! চোখে পানি আসা চলবে না! রকিব! কাঁদে না ধুর-

 

 

ইঁদুর পুরাণ: অন্ধকারের মাংসখেকো

আনিফ রুবেদ

ফড়াৎ করে একটা তেলাপোকা তার কপালের উপর পড়লে হঠাৎ করে ভয় পেয়ে যায় মদুল খাঁখারি এবং ভয়টা কাটলে সে ব্যথাটা অনুভব করে। ডান চোখের উপরে কেটে গিয়ে এখনো ফুলে আছে জায়গাটা এবং জমাট বেঁধে আছে কালো রক্ত। মূল গাঁ থেকে আধা মাইল দূরে তার কুঁড়েটি। ইতস্তত ঝোঁপ ঝাড়, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। এদিকে তেমন কেউ আসে না। হাত দিয়ে কপালের ব্যথাটা ছুঁয়ে দেখতে গেলে হাতের ব্যথাটাও টের পায় বেশ ভেতর থেকে। পায়ের কথা বাদ, সেটা আরো কয়দিন নাড়াতে পারবে না তার ঠিক নাই। তবে তেমন কিছু নয়, সামলে উঠতে সময় লাগবে না, এমন কথা চিন্তা করে চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই।

পা আর হাতের ব্যথাটার জন্য নির্দিষ্ট কেউ দায়ী নয়, প্রায় সকলেই দায়ী তবে কপালের ব্যথাটার কথা তার মনে আছে। মোসাহাক দফাদারের ছেলের ঘুঁষিতে এমন হয়েছে। তার হাতের অষ্টধাতুর আঙটি সমেত ঘুষিটা বেশ একটা ব্যথা এবং ক্ষতদান করেছে তার কপালে।

এর পূর্বে তার নিজগ্রামবাসী এমন করে মারেনি। ছোটখাটো বিচার বসিয়েছে। জহমত মেম্বার শপথ করিয়ে নিয়েছে – ‘বল, আমি আবুল খাঁখারির ছেলে মদুল খাঁখারি…’ সঙ্গে সঙ্গে বলেছে – ‘তুমি আবুল খাঁখারির ছেলে…’ বিচারের লোকজনদের মধ্যে হাসির হল্লা পড়েছে।তখন জহমত মেম্বার ভীষণ রেগে গেছে। সে সংশোধন করে দিয়েছে কয়েকবার তারপর কোরান শরীফের উপর হাত রেখে শপথ পাঠ করিয়েছে আবার – ‘তুমি আবুল খাঁখারির ছেলে মদুল খাঁখারি…’ মদুল খাঁখারি বলেছে – ‘আমি আবুল খাঁখারির ছেলে মদুল খাঁখারি’ এভাবে শপথ বাক্য পাঠ করে প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করেছে ‘সে আর চুরি করবে না’। শপথ নেওয়া শেষ হলে লোকজন তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু বিচার শেষ হলে, সেই রাত ভোর হলেই, চুরির খবর শোনা গেছে এবং মদুল খাঁখারিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শপথের বেড়া ভেঙে কোথাকার কোনদিকে চলে গেছে সে। এভাবে বারবার সে গ্রামের বাইরে কয়েকমাস কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছে। এভাবে বছরের পর বছর চলেছে ব্যাপারটা।

এবার নির্দয় ব্যবহার করেছে তার নিজ গাঁয়ের মানুষেরা।

প্রচন্ড ব্যথা ঝরছে শরীরে এবং সন্ধ্যা পার হলেও সে শুয়ে থাকে এবং বেদনায় কাতরায়। রাত নেমে এলে তার শরীরে আঠার মতো লেগে যায় গাঢ় অন্ধকার। বাম হাত দিয়ে শরীর থেকে কালো অন্ধকারগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করে। শতবার মুছেও শরীরে লেগে থাকা অন্ধকার মুছে শেষ করতে পারে না। আরো লেপ্টে যায়। নাক, মুখ দিয়ে ঘন তরল অন্ধকার ঢুকে পড়ে। শেষে মুছে মুছে কোনো কূল কিনারা করতে না পেরে ক্লান্ত হলে, নিশ্চল পাথরের মত শুয়ে থাকে। হাতটাও থেকে যায় স্থির। পা, মাথা, পেট সবকিছু স্থির। বরফের গুড়ার মতো অন্ধকার তার দেহের উপর পড়ছে। আলকাতরার মতো তরল অন্ধকার তার চোখ দিয়ে, নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে, কান দিয়ে, শিশ্ন দিয়ে, পায়ুদ্বার দিয়ে ঢুকে পড়ছে। তার পেট, তার বুক, তার ফুসফুস, তার হৃদয় ঘন কালো তরল অন্ধকারে ভরে গেল।

স্থির শরীর নিয়ে পড়ে আছে মদুল খাঁখারি। একটা পেটমোটা নেংটি ইঁদুর তার সাথে ইয়ারকি করে পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দেবার চিন্তা করে, ধীর পায়ে এগিয়ে আসে এবং থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সে খেয়াল করে দেখে, মদুল খাঁখারির হাতে ছুরি, সে দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে চেয়ে আছে। ইঁদুরটি ভয় পেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভালো করে লক্ষ করে দেখে, মদুল খাঁখারি ঘুমুচ্ছে এবং স্বপ্ন দেখছে। এই ছুরি হাতে দাঁড়ানো মদুল খাঁখারি হলো, মদুল খাঁখারি যে স্বপ্ন দেখছে সে স্বপ্নের মদুল খাঁখারি। ইঁদুরটি মদুল খাঁখারি কী স্বপ্ন দেখছে সেটা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে এবং সে ছুরি দেখে আর ভয় পায় না। ইঁদুরটি আরো ভালো করে দেখে বুঝতে পারে মদুল খাঁখারি আসলে মরে গেছে। এই মরা মদুল খাঁখারিই স্বপ্ন দেখছে। ইঁদুরটি আরো অবাক হয়ে নড়ে চড়ে বসে আর ভালো করে দেখতে থাকে মৃত মদুল যে স্বপ্ন দেখছে সে স্বপ্নটাকে।

মৃত মদুল খাঁখারির স্বপ্নের ভেতরের জিন্দা মদুল খাঁখারি ছোট ছুরিটা নিয়ে তার কুটিরের বাইরে বের হয় এবং কী খাবে এমন চিন্তা করতে থাকে। পেটে বড্ড খিদে। মৃত মদুল খাঁখারির স্বপ্নের জিন্দা মদুল খাঁখারি নিজেকে বলে – ‘তোমার খিদে পেয়েছে এখন তুমি খাবে, মৃথিবীতে (সে ভাবল প্রাণ থাকলে পৃথিবীবাস আর মৃত হলে মৃথিবীবাস) খাদ্যের কোনো অভাব নেই।’

মদুল খাঁখারি বাইরে এসে দাঁড়াল। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানের অন্ধকারের গায়ে ছুরি চালালে অন্ধকার আর ছুরির সংঘর্ষে আগুন জ্বলে ওঠে। সে ভাবে এখানের অন্ধকারগুলো বেশ শক্ত এবং একটু এগিয়ে গিয়ে নরম অন্ধকারের গা থেকে কয়েক চাকতি অন্ধকারমাংস কেটে নেয়, এবং নদীর ধারে হাঁটা শুরু করে। নদীর জলের উপর এই কয়েক টুকরা অন্ধকার রেখে দিলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কয়েকটা মরিচঅন্ধকার, কিছুটা তেলঅন্ধকার, একটু লবণঅন্ধকার সে ইতিমধ্যে পথিমধ্যে যোগাড় করে ফেলেছে। অন্ধকার কাটা এই ছুরিটা বেশ ভালো। নেতারা কথা বললে সেসব কথা দিয়ে যেসব অন্ধকার তৈরি হয় সেসব অন্ধকার থেকে এ ছুরি তৈরি হয়েছে।

একেবারে নদীর ধারে গিয়ে একটা অন্ধকারের গা থেকে হাঁড়ির সাইজের মতো করে অন্ধকার কেটে নেয় এবং সমস্ত কিছু চাপিয়ে জলচুলাতে বসিয়ে অপেক্ষা করে। এখন তার আর কোনো কাজ নেই। চাঁদটা উঠলে, চাঁদের আলো কেটে দুতিনটা রুটি বানিয়ে নিলেই হবে। আজকের জোছনার জোছনারুটির স্বাদ হবে অপূর্ব। প্রতিদিনের জোছনার স্বাদ একরকম নয়। এমনকি সব জায়গার জোছনার স্বাদও একরকম নয়। যেমন চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছের জোছনার স্বাদ বেশ সুস্বাদ কিন্তু কৈবর্তপাড়ার জোছনার স্বাদ তেমন ভালো নয়। সে এখন যেখানে আছে সেখানের জোছনার স্বাদ নিখাদ ভালো। যেহেতু এদিকে মানুষ আসে না তেমনভাবে সেহেতু মানুষের মল মূত্র বা কাশ পোঁটা তেমন লেগে থাকে না জোছনার গায়ে। তার উপরে আজ সোমবার। সাধারণভাবেই সোমবারে সব জায়গার জোছনার স্বাদ ভালো।

ইঁদুরটি খেয়াল করে দেখে, মদুল খাঁখারি জলচুলাতে রান্না বসিয়েছে বটে কিন্তু আগুন জ্বালাতে ভুলে গেছে। হঠাৎ করে মদুল খাঁখারির খেয়াল হয়, জলাগুন ধরাতে সে ভুলে গেছে। যে কোনো একটা গান গাইলেই সুরের চাপে জলে আগুন জ্বলে উঠবে এবং সিদ্ধ হবে মাংস। সে গান মনে করতে চেষ্টা করে কিন্তু গান তার মনে পড়ে না এদিকে খিদেও বেড়েছে। শেষে তার একটা গান মনে পড়ে এবং গায়-

জ্বল আগুন জলে জ্বলজ্বল

অন্ধকার আগুনে ভরুক হাঁড়িতল

পেটের ভেতর জ্বলন বড় ক্ষুধার

সিদ্ধ হয়ে যাক ওরে আমার খাবার

অন্ধ আকাশ অন্ধ বাতাস

অন্ধজীবন তরে

অন্ধসব খাবার আমার

সিদ্ধ হোক ত্বরে

রান্না হয়ে গেলে তুই নিভিয়ে যাস আবার

গান শেষ হওয়া মাত্র জলাগুন জ্বলে ওঠে। মাংস সিদ্ধ হবার গড়গড় শব্দ উথলে উঠলে মদুল খাঁখারি শক্ত ধরনের অন্ধকারের গায়ে ছুরি ঘষে ঘষে ধার করতে থাকে। একটু পর চাঁদ উঠে এবং জোছনার গা থেকে রুটির সাইজের কয়েক ফালি কেটে নেয়। মাংস রান্না হলে মাংসের হাঁড়ি নামিয়ে কুটিরের দিকে হাঁটতে থাকে।

ইঁদুরটি অবাক হয়ে দেখতে থাকে, মদুল খাঁখারি তার শিশুকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সবকিছুই বেশ আনন্দের সাথে দেখছে এবং হাসছে এবং কাঁদছে। কত প্রাচুর্যভরা এই মৃথিবী। অথচ কত অভাব ভরা পৃথিবী। শিশুকালেই এখানে চলে এলে অহেতুক খাবারহীন থাকতে হত না এতদিন। এখানে অন্ধকার আর জোছনা কেটে সবকিছু করা যায়। মৃথিবীতে খাদ্যের কোনো অভাব নেই।

অবশ্য সব রাতের অন্ধকারে সবকিছু হয় না। অমবশ্যা রাতের অন্ধকার দিয়ে বেশ ভালো সন্দেশ তৈরি করা যায় কিন্তু বাতাসা করতে গেলে অমাবশ্যা রাতের অন্ধকার দিয়ে হবে না, পূর্ণিমা রাতের আখখেতের কাছের অন্ধকার দিয়ে তৈরি করতে হবে। বর্ষাকালের অন্ধকার ছাড়া মুগডাল তৈরি করা যায় না, তখনের অন্ধকার দিয়ে তৈরি করা যায় ভালো জিলিপিও। আর ভালো স্যান্ডেল তৈরি করতে গেলে বসন্তকালের অন্ধকারের কোনো বিকল্প নেই, শীতকালের অন্ধকার দিয়ে স্যান্ডেল করতে গেলে দুদিনও টিকে না। আর কার্তিক মাসে কৃষাণ পাড়াতে অন্ধকার বেশ জমে ওঠে, এসব অন্ধকারের ক্ষীর একেবারে অমৃতের মত। নির্বাচন অফিসের অন্ধকার আর পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার অন্ধকার মরিচ আর লবণ তৈরির জন্য বেশ ভালো।

তার যে কুটির তা অন্ধকার কেটে যে পাথর, তা থেকে তৈরি। সে যে জামাটি গায়ে দিয়ে আছে তা গতমাসের ২ নম্বর সপ্তাহের মঙ্গলবারে যে অন্ধকার হয়েছিল, সে অন্ধকারের সুতো থেকে রহমত মেম্বারের ছোট ভাই তৈরি করে দিয়েছিল। মুজুরি হিসেবে নিয়েছিল শিবগঞ্জের মিয়াদের আমবাগানের তিন চার ডালি অন্ধকার। রহমত মেম্বারের ভাই রহমত মেম্বারের চাল-গম চুরির, বেচার আর তার টাকার হিসাব রাখে। আর কোনো কাজ করে না।

ইঁদুরটি দেখল, মদুল খাঁখারি মাংস এবং রুটি নিয়ে এসে খেতে বসেছে। সে আচারের জন্য কাঁচের বয়ামের ছিপি খুলে। এই আচারঅন্ধকার এদিকে পাওয়া যায় না, রামচন্দ্রপুর থেকে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এতদিন খায়নি। কিন্তু এখন দেখল, এই আচারগুলো গন্ধ হয়ে গেছে। সে ঢেলে ফেলে দিলে এখানের অন্ধকারের সাথে মিশে মাংস-অন্ধকার হয়ে গেল। সে শুধু মাংস আর রুটি বেশ পেটপুরে খেয়ে নিল এবং বাকিটা ফেলে দিল। ভোর হলে কোনো খাবার পাওয়া যাবে না। রাতের পৃথিবী মানে ছোট চোরের পৃথিবী, ভোরের পৃথিবী মানে বড় চোরের পৃথিবী।

সূর্যের আলোতে কোনো খাবার তৈরি করা যায় না। দিনের চোরদের জন্য সূর্যের আলো। তারা সূর্যের আলো কেটে বড় বড় বাড়ি বানায়, গাড়ি চড়ে, কোর্ট প্যান্ট তৈরি করে। দিনের আলোতে একজন দিনের চোর আরএকজন দিনের চোরের পকেট কাটে। তাদের যার ছুরির যেমন ধার তার তেমন বাড়ি, তেমন গাড়ি, তেমন খাবার দাবার। রাজধানী এসব ছুরি দেয় সরাসরি তাদের হাতে। যেমন পুলিশ থানার ছুরি, ডিসি অফিসের ছুরি, ফুড অফিসের ছুরি সব থেকে বেশি ধারাল। অন্যান্য আরো মেলারকমের ছুরি আছে। জনসংখ্যা প্রচুর, মানুষই কম। মানুষ হিসেবে জন্ম নেয় মানুষ আর বড় হতে থাকে ছুরি হিসেবে। পৃথিবীতে মানুষের অভাব থাকতে পারে কিন্তু ছুরির কোনো অভাব নেই। ইঁদুরটি খেয়াল করে দেখে স্বপ্নের ভেতর মদুল খাঁখারি খাওয়া শেষ করে বিশ্রামের জন্য বিছানায় গা গড়িয়ে দিয়েছে। মৃত মদুল খাঁখারির স্বপনের ভেতরের জিন্দা মদুল খাঁখারি মৃতদেহের ভেতর ঢুকে লুকিয়ে গেল। ভোর হব হব হয়ে গেল।

তার লাশ উত্তরের জঙ্গলার পূব কোনে পড়ে আছে। হাজার হাজার ইঁদুর আর টিকটিকি তার শরীর নিয়ে যাচ্ছে গোরস্থান অন্ধকারের দিকে। কিন্তু আসলে তারা এক বিন্দুও নড়াতে পারেনি।

ভোর হলে গাঁয়ের লোকজন মদুল খাঁখারির লাশ উদ্ধার করে। এবং দেখে, একটা পেট মোটা নেংটি ইঁদুর তার পায়ের নিচে চাপা পড়েছিল সেটা চাপা পড়েই মারা গেছে।

চাপা পড়া ইঁদুরটি গর্ভবতী ছিল। পিছন দিয়ে একটা বাচ্চা ইঁদুর অর্ধেক ভেতরে আর অর্ধেক বেরুনো অবস্থায় নড়াচড়া করছে। যেন সে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করছে সে পৃথিবীতে আসবে, না আবার ফিরে যাবে মায়ের গর্ভে, তারপর, মায়ের গর্ভ থেকে যেখানে ছিল সেখানে। কিন্তু বাচ্চাটা পায়ের চাপের কারণে ফিরে যেতে পারছে না। পৃথিবীতে বের হয়ে এলো মানুষের পায়ের চাপাচাপিতে। ইঁদুর বাচ্চার চোখ এখনো ফোটেনি। সুতরাং এখনো সে দিন আর রাতের ফারাক বুঝতে পারছে না। গর্ভ ত্যাগ করা মানে প্রকৃতপক্ষে মা’কে ত্যাগ করে সংসারসমুদ্রে সাঁতার কাটতে থাকা। গর্ভথিবী ছেড়ে ইুঁদরসন্তান পৃথিবীতে অন্ধ অবস্থাতেই জীবন শুরু করে দিল, হেঁটে বেড়াতে লাগল।

মদুল খাঁখারির পায়ের চাপে মরা ইঁদুর তার সদ্য হওয়া বাচ্চার দিকে তাকিয়ে ইঁদুরপুরাণ থেকে পাঠ করতে লাগল ধীরে ধীরে –

ক্ষুধা রে, আহা ব্যথা আমার! আমার নিজের ব্যথা!

তুমি আমার জন্মসঙ্গী।

আর, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে মানুষের মারে

যে ব্যথা পেয়েছি, সে ব্যথা আমার ব্যথা নয়।

অন্যরা তাদের ব্যথা চাপিয়ে দিয়েছে আমার উপর।

একজনের ব্যথা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেবার খেলা চলছে জগতে।

আমি যখন চুরি করতে যাই,

তখন আমিও অন্যের উপর আমার ব্যথা চাপিয়ে দিতেই যাই।

 

 

 

এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার

আফসানা বেগম

তুমি জানতে চাইলে ‘বৈশাখ’ শব্দটা শুনলে কিরণের মাথায় সবচেয়ে প্রথমে কী আসে। মাটির দিকে তাকিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘রক্ত।’

‘রক্ত! কী আবোলতাবোল বকছ? আমি বলতে চাচ্ছি বৈশাখের একটা চেহারা আছে না? মানে, বৈশাখ বৈশাখ গন্ধ?’

‘হুম। রক্তের গন্ধ।’

তুমি কৌত‚হলী হয়ে কিরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে। তাকে উদাস আর অন্যমনষ্ক দেখাল যেন যা বলার বলা হয়ে গেছে। রক্তের গন্ধের কোনো ব্যাখ্যা সে আর দেবে বলেও মনে হলো না। তোমারও আর জবরদস্তি জানতে চাইতে ইচ্ছে করল না। তোমার আশা ছিল যে কিরণ বলবে বৈশাখ বললে তোমার কথা মনে হয়, কারণ কোনো এক বৈশাখেই তোমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তা না, কোত্থেকে এল রক্ত। গন্ধের কথাই যদি বলবে তবে ইলিশ ভাজা আর পান্তাভাতের গন্ধের কথা তার মনে এল না? কিরণের উপরে একটু মেজাজ খারাপ হলো তোমার। মনে মনে ভাবলে, আমি বলি বৈশাখ আর সে কিনা বলে রক্ত! আরে বাবা, কোরবানি ঈদের কথা বললেও না হয় চলত, কিন্তু বৈশাখ আর রক্ত? এই কিরণটা মাঝেমধ্যে বড্ড আবোলতাবোল বকে। একরকম রাগ করেই তুমি বললে, ‘তোমার না খানিক মাথা খারাপ আছে, বুঝলা?’ কিরণ হেসে বলল, ‘ক্যান? কী করছি?’ তুমি বললে, ‘না, ঠিক খারাপ না, একটা স্ক্রু মিসিং আর কী।’ কিরণ মুচকি হাসল। বলল, ‘স্ক্রুটা কই গেল বলো তো? তুমি ঠোঁট উলটে জবাব দিলে, ‘গেছে আর কী, ওই যে, রক্তে ভেসে গেছে।’ তুমি ভেবেছিলে কিরণ হাসবে কিন্তু অবাক হয়ে দেখলে যে তার মুখটা খানিক গম্ভীর হয়ে গেল। ফরসা মুখের উপরে ভরদুপুরে যেন একটা গাঢ় ছায়া অযাচিত আসন গেড়ে বসল। তোমার মন্তব্যের শাস্তিস্বরূপ নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারটা পেরোনোর পর থেকে হোম ইকনমিক্স কলেজের গেট পর্যন্ত কিরণ আর একটাও কথা বলল না। পায়ের গতিও খানিকটা বেড়ে গেল। রাস্তার উলটোদিক থেকে ¯্রােতের মতো আসা মানুষ, বাস আর রিকশাকে বাঁচিয়ে তাকে অনুসরণ করতে কষ্টই হচ্ছিল তোমার। তারপর কলেজের সামনে এসে কিরণ এমনভাবে গেট পেরিয়ে ঢুকে গেল যেন রাস্তায় বরাবর সে একাই ছিল, সঙ্গে যে ছিল সে অদৃশ্য। তুমি হা করে কিছুক্ষণ আধা খোলা গেটের ভিতরের দিকে তাকিয়ে থাকলে। কিরণ একবারও ফিরে তাকায়নি। লম্বা পথটা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা সাদা করিডোরে মিলিয়ে গেছে। তারপর কী আর করা, বৈশাখ আর রক্তের মধ্যে সম্পর্ক কিংবা পার্থক্য ভাবতে ভাবতে তুমি নিজের হলের দিকে রওনা দিলে। আসলে তোমার মনে বৈশাখ নিয়ে অনেক মজার মজার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল। তুমি ভেবেছিলে কিরণকে সেসব বলে খুব একচোট হাসাবে। কিন্তু সে তা হতে দিল না। অথচ ক্লাস শেষ হবার পরে বৈশাখের কথা উঠিয়েছিল কিরণই। তবে বছর দুয়েক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে আর আশেপাশে কিরণকে দেখতে দেখতে তার সম্পর্কে তোমার যথেষ্ট জানা হয়ে গেছে। কী কারণে হুট করে রেগে যায় বলা যায় না। তারপর পেটে হাতুড়ি মারলেও আর কথা বলবে না। রাগ পড়লে নিজেই এসে বিস্তারিত বিবরণসহ রাগের কারণ আর স্যরি-টরি বলবে।

ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে কিরণ ছায়ানটে ভর্তি হয়েছিল। তাই চারটা সেমেস্টার শেষ হতে হতে ছায়ানটে সে উঠে গেল দ্বিতীয় বর্ষে। কলাভবনের পাশে শিশু গাছের ছায়ায় বসে প্রায়ই কিরণ গান ধরত। তোমরা অনেকে বসে শুনতে। তুমি প্রায়ই বলতে, ‘ওই গানটা ধরো না কিরণ, ওই যে, আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা, তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।’ সে কপট রাগ দেখিয়ে বলত, ‘একই গান বারবার শুনতে চাও অথচ প্রথম লাইনটা কিছুতেই মনে রাখতে পার না, এটা কেমন ব্যাপার, হুম? গানটা হলো, আজি বিজনঘরে নিশিথ রাতে আসবে যদি শূন্যহাতে, বুঝেছ?’ তুমি হেসে বলতে, ‘কী করব, কিরণ, আমি যে দুই লাইন মনে রেখেছি তার কাছে ওই ভদ্রলোকের ওই গানের তো বটেই, অন্য অনেক গানের হাজার লাইনও যে মার খেয়ে যায়, যায় না?’ কিরণ হেসে বলত, ‘তা যায় বটে।’ তারপর বলত, ‘জানো, কত দিন কত রাত ওই দুটো লাইন আমাকে কত হতাশা আর কান্না থেকে মুক্তি দিয়েছে!’ বলে নিয়ে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থাকত। তারপর ভিতরে ভিতরে নিজের মধ্যে ফিরে এসে গুনগুন করে গাইতে শুরু করত। ওই সঞ্চারি থেকেই গানটা আরম্ভ হতো কিরণের ঠোঁটে, আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ করা, তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।

কিরণের মুখে রক্ত শব্দটার গাম্ভীর্যতার কথা ভাবতে ভাবতে সেদিন তুমি হলে ফিরে এসেছিলে। এখনো তোমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন ক্লাস শেষ করে কিরণ খুশির চোটে বলতে গেলে উড়ে এসেছিল খবরটা দিতে, ‘শোনো, আমি না এবারে ছায়ানটের বৈশাখের অনুষ্ঠানে গাইব। মানে, আমাদের ক্লাস থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও সিলেক্ট করেছে!’ তুমি খুশি হয়েছিলে কিরণের উত্তেজনা দেখে। কিরণ এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছিল, ‘ছোটোবেলা থেকে টিভিতে আর নিউজ পেপারে যে অনুষ্ঠানের ছবি দেখেছি, এবারে আমি নিজেই সেই অনুষ্ঠানে গাইব, ভাবা যায়?’ তুমি হেসে বলেছিলে, ‘কেন ভাবা যাবে না, এত সুন্দর গাও তুমি! তোমাকে নেবে না তো কাকে নেবে?’ কিরণ নিজের প্রশংসায় আড়ষ্ট হয়েছিল। ঢোক গিলে বলেছিল, ‘না, মানে, আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না। যা হোক, তুমি আসবে তো?’ তুমি মাথা চুলকে বলেছিলে, ‘দেখি।’

‘দেখি মানে? তুমি বৈশাখের অনুষ্ঠান দেখতে রমনায় যাও না?’

‘নাহ্, মানে, অ্যাত্ত সকালে উঠে খামোখা এত ভীড় ঠেলে… পরে তো টিভিতেই দেখা যায়।’

‘আশ্চর্য, ঢাকার মানুষ হয়েও ওই অনুষ্ঠান মিস কর কী করে? আমি তো ছোটোকাল থেকে টিভিতে দেখতাম আর ভাবতাম কবে ঢাকায় পড়তে আসব আর সামনে বসে ওই অনুষ্ঠানটা দেখব।’

‘দূরে ছিলে তো তাই এমন মনে হতো। ধীরে ধীরে দেখবে তুমিও আর যাবে না, ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকবে।’

‘কখনো না। অসম্ভব!’

‘অসম্ভব না, কিরণ। কক্সবাজারে থাকে এরকম বহু মানুষ আছে যারা হয়ত গত দশ বছরে একবারও সমুদ্রের তীরে যায়নি। আবার ধরো বৃষ্টিতে গোসলের বাতিকঅলা কিছু মানুষও কোনো একসময় ঘরে শুয়ে-বসে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনতে পায়, বাতাসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি টের পায় কিন্তু উঠে গিয়ে জানালার পরদা সরিয়ে বৃষ্টি দেখে না।’

কিরণের সঙ্গে বলা প্রায় পনেরো বছর আগের এই সমস্ত কথা তোমার হয়ত মনেই পড়ত না যদি আজ ভোর রাতে ঝড়ের শব্দে ঘুম না ভাঙত। পাশ ফিরতে গিয়ে চোখটা হালকা খুলে গেল। আর সরু করে চোখ মেলতেই তোমার মস্তিষ্ক হালকামতো কাজ করতে শুরু করল। তোমার মনে হলো তেপান্তরের মাঠের এক প্রান্তে তুমি ঘুমিয়ে আছ আর তোমার শরীরের উপর দিয়ে বাতাসের প্রলয় বয়ে যাচ্ছে। চোখটা ভালোমতো খুলতেই দেখলে হাজার ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতো তীব্র আলো আর পরমুহূর্তে ঘরঘুটি অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পালা। বুঝতে পারলে, কোনো মাঠ-ঘাট নয়, তুমি আছ তোমার ঘরে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। বিজলির উজ্ঝ¦ল আলোয় নিজের মাথার উপরে আর চারপাশে ফিনফিনে পরদাগুলোকে উড়তে দেখলে; যেন কেউ উড়ে চলেছে, দেখা যাচ্ছে কেবল উড়ন্ত পাখা। মনে পড়ল, কাল রাতে বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাস ছিল। শরীর জুড়িয়ে দেয়া বাতাসটাকে তুমি উপেক্ষা করতে পারনি, তাই শোয়ার আগে জানালাগুলো খুলে কেবল নেটের কপাটগুলো লাগিয়ে রেখেছিলে। বিছানায় উঠে বসলে তুমি। পায়ের দিকের তোষকটা ভিজে গেছে প্রায়। বৃষ্টির এলোমেলো ছাঁট আসছে, কোনদিক থেকে আসছে আর কোনদিক থেকে আসছে না তা বুঝতে বুঝতে তোমার ঘুম পুরোপুরি ছুটেই গেল। জানালার কাচগুলো টেনে লাগাতে ঘরে বাতাসের প্রলয় বন্ধ হলো ঠিকই কিন্তু বাইরের শোঁ শোঁ শব্দ চলতে থাকল। শব্দের তালে তালে হাজার স্মৃতির ঢেউ তোমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। কিছুতেই আর ঘুমাতে দিল না। বৈশাখের আগে আগে আসা এই ঝড়কে বলে কালবৈশাখি- প্রাইমারি স্কুলে অর্জিত জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে স্মৃতির পরত একে একে খুলে যেতে লাগল। খুলতে খুলতে এসে ঠেকল কিরণের মুখের উপরে। সেই কিরণ যে কোনোদিন তোমার সবসময়ের সঙ্গী ছিল অথচ যাকে তুমি প্রায় দশ বছর দেখনি। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা তোমার কাছে এত অস্বাভাবিক লাগল! একই শহরে থেকে কী করে তুমি কিরণের সঙ্গে এতদিন যোগাযোগ করনি? বন্ধুরা কতবার এর-ওর বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছে, নানান ব্যস্ততার অজুহাতে তুমি যাওনি। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে অফিস আর বিয়ের পর থেকে বিয়ের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে গত বছর দশেক তুমি আর কারো কথাই ভাবোনি। অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস, এই চক্রে কে জানে কত কাল তুমি আটকে আছ! উথালপাতাল ঝড়ের শব্দ আর ভেজা ভেজা তোষকের স্পর্শে হঠাৎ তোমার অসহায় লাগল। বাচ্চা হবে বলে বউ মায়ের বাড়িতে চলে গেছে মাস দুয়েক আগে, আর আজ এতদিন পরে ভোর রাতে কালবৈশাখির ঝড়ের টানে তুমি আবিষ্কার করলে যে তুমি কত একা! তোমার কোথাও কোনো শূন্যতা ছিল না, যদি থেকেও থাকে তবে বলতে গেলে এতটুকু একাকিত্ব ছিল না যে তুমি তোমার শূন্যতা নিয়ে ভাববে। ভরপুর বাড়ি আর অফিসের মাঝখানে ঘণ্টা দুয়েকের ট্র্যাফিক জ্যামপূর্ণ রাস্তায় তুমি বসে বসে অজানা আর অচেনা মানুষের জীবন আর যাপন নিয়ে ব্যস্ত থাকো। কে কী খায়, কার কী দর্শন, কে কোথায় বেড়াতে যায়, কে কোথায় প্রতারিত হয়- হাতের ফোনের উপরে এই সমস্ত গালগল্পের আড্ডা দেখতে দেখতে হয় তোমার অফিস এসে পড়ে নয়তো বাসা। কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়ে আসা ভোরে বিছানার উপরে একাকী বসে তোমার মনে হলো, কতদিন যেন তুমি সত্যিকারের মানুষের সংস্পর্শ পাওনি!

কিরণ কিরণ… কিরণের নামটা হঠাৎ তোমার মাথার মধ্যে কিরকির করে উঠল। ঘড়িতে জ্বলজ্বলে রেডিয়ামে সময় দেখলে সাড়ে ছয়। ফোনে দেখে নিলে, হ্যাঁ, কিরণের একটা ফোন নম্বর তোমার কাছে আছে বটে। কবে, কার কাছে নেয়া হয়েছিল মনে পড়ল না। কোনোদিন ফোন করা হয়েছিল কি না তা মনে করতেও মাথা সায় দিল না। সে যাই হোক, এই সাত সকালে হুট করে কাউকে ফোন করে ফেলা যায় না। তাই বেলা বাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলে তুমি। কেন যেন কিরণকে লাগেইনি এত বছর যাকে ছাড়া কোনো একসময় একটা দিনও চলত না তোমার। কিরণের সঙ্গে শেষ দেখার দিন বা ক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলে তুমি। কিন্তু মাথার ভিতরে কালবৈশাখীর মতো ঝড় বইয়ে দিয়েও মনে করতে পারলে না। হয়ত যোগাযোগ কমতে কমতে কোনোদিন সুমধুর গান ধীর লয়ে ফুরিয়ে যাবার মতো তার সঙ্গে সম্পর্কটা কোথাও মিলিয়ে গেছে, তোমরা কেউই তা মনে রাখনি।

শেষ পর্যন্ত ভালোমতো সকাল না হওয়া অব্দি মূর্তির মতো বিছানাতেই বসে থাকলে তুমি। কখনোবা একটু গড়িয়ে নিলে। কিন্তু কিরণের ভাবনা ছাড়ল না। অন্য কোনো বন্ধু বা জুনিয়র কারো কাছে কি কিরণের খোঁজ থাকতে পারে? তুমি ভাবতে থাকলে। ফ্যানের বাতাসে মাঝেমধ্যে পরদা সামান্য নড়ে উঠলে তুমি বাইরে আলো ফোটার আভাস দেখলে। ঝড়ের উত্তাল শব্দ আর নেই। ধীরে ধীরে পরদা সরাতেই বাইরের লন্ডভন্ড দৃশ্য দেখতে পেলে। বাড়ির সামনের রাস্তায় পাতার বিছানা হয়ে গেছে। কিছু ডালপালাও পড়ে আছে। ডালগুলো এখানকার গাছের নয়। নিশ্চয় দূর থেকে ভাঙা ডাল উড়ে এসেছে। ভালো করে দেখার জন্য বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে। আশ্চর্য! পুরো এলাকাটাই অন্যরকম লাগছে। রাস্তার মোড়ের দিকে তাকাতেই দুমড়ানো মোচড়ানো কতকগুলো জং ধরা টিন পড়ে থাকতে দেখা গেল। মনে হলো, শুধু ডাল নয়, কোনো বাড়ির চাল-ও উড়ে এসেছে। আর ওই পরিস্থিতি দেখে প্রথমেই মনে পড়ল তোমার বউয়ের কথা। ছুটে এসে ফোন করলে তাকে। নাহ্ সিলেটের দিকে তেমন কোনো ঝড়-টড় হয়নি। বউ বলল, ‘ছুটির দিনে বাড়িতে একা একা করবেটা কী? হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে গিয়ে কফি শপে বসে নাস্তা সেরে আসো গে যাও।’ আসলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমিও তেমনটাই ভাবছিলে, ওদিকের রাস্তাঘাটের অবস্থাটা কী দেখা দরকার। একবার গিয়ে ঘুরে আসলে হয়।

রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। এত সকালে বলে নাকি রাস্তায় প্রচুর গাছের ডাল পড়ে আছে বলে তুমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলে না। শীতকাল গেছে সেই কবে, অথচ বাতাসে শীত শীত গন্ধ। ফুলহাতা টি-শার্ট গলে তোমার চামড়ায় হুল ফোটানোর মতো ছুঁয়ে গেল কয়েকবার। শীতলতাটা তুমি ভালোই উপভোগ করলে। ভাবলে বউয়ের কথামতো কফিশপে গিয়ে নাস্তা করলেই ভালো। এই বাতাস গায়ে মেখে তারপর ধোঁয়া ওঠা কফি পেলে বেশ হয়। তোমার বাড়ির গলিটা ছাড়তেই মোড়ে দিকে একটা বাড়ির পাঁচিল পড়ে গেছে। পুরোনো ছিল অবশ্য। সেই আগেকার যুগের বাগানওলা দোতলা বাড়ি। এখনো রিয়েল এসটেটের লোকেরা হয়ত ওখানে সুবিধা করতে পারেনি। তবে পারবে। ঝড়ের যা ফল দেখা গেল, তার পরে আর বাড়িটা থাকবে বলে মনে হলো না। বাড়িটার শেষ মাথায় প্রাচীন এক কৃষ্ণচ‚ড়া গাছ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে বরাবর তোমার চোখ ওই গাছটার দিকে যায়। বিশেষ করে ওটাতে যখন রঙ লাগে। আগের দিনেও তুমি লক্ষ করেছিলে কী ভীষণ আগুন লাগার মতো লালচে কমলা কৃষ্ণচ‚ড়ায় ভরে আছে গাছটা। ফুলগুলো এতটাই ঘন হয়ে ফুটেছে যে দূর থেকে দেখলে একটা আস্ত গোলাপের মতো দেখায়। আজ সেই ফুলের বেশিরভাগটা পড়ে আছে রাস্তায়; প্রচুর পাতাও। শীত শীত অনুভ‚তিটা ঠেকাতে তুমি পকেটের মধ্যে হাতদুটো গুটিয়ে নিলে। তারপর রাস্তায় পা ফেলতেই দেখলে নীলচে পিচের উপরে লাল বা কমলা পাপড়ি, কোথাও আবার আস্ত ফুল পড়ে আছে। একের পর এক ভেজা পাপড়ির উপরে কিংবা তাদের বাঁচিয়ে পা ফেলতে ফেলতে তুমি তোমারই অজান্তে অতীতের এক রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলে।

‘ধরো, অনেকদিন আগে কোনো এপ্রিলে কৃষ্ণচ‚ড়ার কোনো পথ ধরে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম। কাল-বৈশাখির পরে ভেজা লাল-কমলা পাপড়িগুলো মাড়িয়ে, ধরো, বহুদূর হেঁটেছিলাম আমরা। মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে, কৃষ্ণচ‚ড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে, গুনগুনিয়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। জানো তো, কাছাকাছি না থাকাটা তখন ছিল কেবলই ফ্যান্টাসি। ধরো, আরো অনেকদিন পরে গাঢ় নীল পিচের ব্যাকগ্রাউন্ডে লালচে সে পাপড়িগুলো আবার আমাদের দলতে ইচ্ছে হলো। একটা-দুটো পাপড়িতে কেমন ছোপ দেখেছ? এমন ছবি দেখনি কচুরিপানার ফুলে কি ময়ূরের পালকে? ধরো, দুটো পাপড়ি তুমি কুড়িয়ে রাখলে; পকেটে নাকি মনে? স্যুভেনিয়র কি?

ধরো আরো বহুবছর পরে আরেক বৈশাখে একই রাস্তায় আমরা হেঁটে গেলাম। কৃষ্ণচ‚ড়ার ডালপালার ফাঁকে মেঘশূন্য আকাশে চোখ রেখে ভাবলাম, বহুবছর আগে এই পথ ধরে আমরা হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।’

আশ্চর্য, কথাগুলো তুমি স্পষ্ট কিরণের গলায় শুনতে পেলে। এ কী করে সম্ভব! এতদিনে একটা শব্দও ভোলোনি অথচ আস্ত কিরণটাকেই ভুলে ছিলে? কথাগুলো আরেকবার আওড়াবে নাকি ভাবতে ভাবতে তোমার পায়ের গতি ধীর হয়ে এল। দাঁড়িয়েই পড়লে শেষে। তারপর খানিকটা নীচু হয়ে রাস্তা থেকে একটা ফুল তুলে নিলে। একটা পাপড়িতে লাল-সাদা-কমলা ছোপ, বাকিগুলো লালচে। কিরণ ঠিক বলেছিল, ময়ূরের পালকে এমনটাই আছে। নিজের অজান্তেই কি না কে জানে, পাপড়ি উঠিয়ে তুমি পকেটে চালান করলে। পকেট আর হাতটা খানিক ভিজে গেল। তারপর কিরণের কণ্ঠস্বর ধাওয়া করতে করতে তুমি আবারো হাঁটতে শুরু করলে। সে বহু আগেকার কথা। ক্লাসের কয়েকজন মিলে তোমরা সাভারে বেড়াতে গিয়েছিলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৃষ্ণচ‚ড়ায় লাল। বিকেল নাগাদ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলে তোমরা। তারপর প্রান্তিকের মোড় থেকে লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়েছিলে। ঝড়ের পরে ঠিক এমনই শান্ত আর শীতল পরিবেশ ঘিরে ছিল তোমাদের। ভেজা রাস্তায় চ্যাপটা হয়ে লেগে ছিল অসংখ্যা পাপড়ি আর ফুল আর পাতা। পরিবেশটাই ছিল আনন্দে পাগল হবার মতো, কিরণ ওড়না উড়িয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। তারপর হঠাৎ বলেছিল, ‘একটা গান শুনেছ কেউ? মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে, কৃষ্ণচ‚ড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে… শুনেছ?’ বেশিরভাগই ঠোঁট উলটেছিল। তাই দেখে কিরণ গানটা গাইতে শুরু করেছিল। তোমার তখন মনে হয়েছিল এর আগে এত সুন্দর গান তুমি কোনোদিন শোনোনি। কিরণকে বলাতে সে অবশ্য বলেছিল, ‘পরিবেশ, বুঝলে? পরিবেশ। এইখানটাতে এই সময়ে যদি না শুনতে তবে কি আর এত ভালো লাগত?’ তুমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে। আসলেই কি তাই? কিরণ তখন হেসে বলেছিল, ‘আজকের পরে এ গানটা যদি কখনো শোনো, তোমার ঠিক আজকের এই বিকেলটার কথা মনে পড়বে। মানে, আজকের বিকেলের এই কৃষ্ণচ‚ড়ার রাস্তাটার সঙ্গে সুমন কল্যাণপুরের এই গানটাকে আচ্ছামতো বেঁধে দিলাম,’ বলে জোরে জোরে হেসেছিল কিরণ। তারপর ঢাকায় ফিরে পরেরদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে গাছের নীচে বসে বলেছিল, ‘কয়েকটা লাইন শুনবে?’ তুমি জানতে চেয়েছিলে, ‘কীসের লাইন? কার?’ সে লাজুক হেসে বলেছিল, ‘এই তো, আমারই। কাল রাতে লিখেছি।’ তারপর বইয়ের ভিতর থেকে ভাঁজ করা কাগজ খুলে পড়তে শুরু করেছিল, ‘ধরো অনেকদিন আগে কোনো এপ্রিলে কৃষ্ণচ‚ড়ার কোনো পথ ধরে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম। কাল-বৈশাখির পরে ভেজা লাল-কমলা পাপড়িগুলো মাড়িয়ে, ধরো, বহুদূর হেঁটেছিলাম আমরা…’ পড়া শেষ হলে তোমার মুগ্ধতা কাটতে সময় লেগেছিল। তারপর একসময় তুমি বলেছিলে, ‘কিরণ, তুমি তো কবি!’ কিরণ হেসেছিল। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছিল কিছুটা লজ্জিত, আবার গর্বিতও। ওর হাত থেকে কাগজটা টেনে নিয়ে তুমি কয়েকবার পড়েছিলে লাইনগুলো। পড়তে পড়তে একসময় না দেখেই আবৃত্তি করতে শুরু করলে। কিরণ তখন সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তারপর আর কোনোদিন সুমন কল্যাণপুরের ওই গানটা তুমি শোনোনি। এই ক’বছরে গানইবা শুনেছিলে কবে তেমন। কিন্তু কিরণ যে সময়টাকে ওই গানটার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল, তা কি সেই গানটা শোনেনি বলেই ভুলে ছিলে? তবে তুমি নিশ্চিত যে তুমি কিছুই ভুলে যাওনি, ভুলে ছিলে কেবল।

ততক্ষণে ধীরে ধীরে বেশ কিছু মানুষ বেরিয়ে এল রাস্তায়। বড়ো রাস্তার দিকে বাসও দেখা গেল। চারদিকে ভরে উঠল হর্ন আর রিকশার বেলের শব্দে। কিছু লোক নিজেরাই উদ্যেগী হয়ে রাস্তা থেকে ডালপালা সরাতে লেগে গেল। কোথাও কোথাও তুমিও একটু হাত লাগালে। এই করতে করতে বড়ো রাস্তার নতুন কফিশপের সামনে চলে এলে। মাত্র দরজা খুলছে তারা তখন। কফি পেতে নিশ্চয় সময় লাগবে। একলা ছুটির দিনে তোমার সময়ের অভাব নেই। কোণের একটা টেবিলে বসে কাচের ঘেরাটোপের বাইরে রাস্তার চলাচলের দিকে চোখ রেখে বসে থাকলে তুমি। হঠাৎ মনে হলো, কেমন ছিল সেই গানটা? পকেট থেকে ফোন বের করে ইউটিউবে খুঁজতে লাগলে। বাহ্, খুবই জনপ্রিয় গান তো! পুরোনো ধাঁচের মিউজিক কম্পোজিশন অথচ একটানে সেদিনের সেই বিকেলে নিয়ে যেতে অব্যর্থ। ঠিক কিরণের প্রতিজ্ঞামতো, সে বলেছিল, গানটাকে আজকের বিকেলের সঙ্গে বেঁধে দিলাম। নাহ্, যত সকালই হোক, কিরণও নিশ্চয় ঝড় দেখেছে, এত বেলা করে ঘুমিয়েও নেই হয়ত। ভাবতে ভাবতে তার নম্বরে কল করে ফেললে তুমি। দু’এক সেকেন্ডের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার পরে রেকর্ডেড মেসেজ শোনা গেল। এই ফোন নম্বর কিরণ হয়ত কবেই বদলে ফেলেছে। কিংবা এটা আদৌ কোনোদিন কিরণের ছিল কি না তা বেবে বের করতে তোমার স্মৃতি তোমাকে ধোঁকা দিয়ে চলল।

কফিতে চুমুক দিয়ে পাশের টেবিলে তাকালে তুমি। উনিশ-বিশ বছর বয়সের তিনজন ছেলেমেয়ে এসে বসেছে। খাবারের অর্ডার দিয়েছে হয়ত, তারপর ডুবে গেছে নিজেদের জগতে। মনে পড়ল, এ বয়সে তিন বন্ধু একসঙ্গে হলে আশেপাশের মানুষ তোমাদের চিৎকার-হাসাহাসিতে চমকে তাকাত। অথচ তাদের টেবিলে ভয়ানক নীরবতা। একজনের কানে হেডফোন, তিনজনেরই চোখ ফোন বা ট্যাবে। সেদিন এক বন্ধু বলছিল, ‘দেখেছ, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কত ভদ্র! মাথা সবসময় নীচে।’ পাশের টেবিলে তাকিয়ে মনে হলো, সময় করে একসাথে খেতে আসার তেমন দরকার পড়ে না এদের । তবু পুরোনো নিয়ম অন্ধের মতো পালন করে যাচ্ছে।

আর এদিকে, চলিশের কাছাকাছি এসে তোমার চোখ খুলে গেছে। তুমি আড্ডায় যাও না। সেসব পুরোনো প্যাটার্ন। এখন ভার্চুয়াল আড্ডা আছে। ‘তোমাকে খুব মিস করছি’ মন্তব্য দেখলে ভেতরে উত্তেজনা হয়। তবে জানো না কেন, ওই উত্তেজনাটা ধরে রাখতেই ভালো লাগে। একটা সাজানো দুঃখবোধ। ওরকম কিছু না থাকলে নিঃস্ব লাগে। ভয় হয়, হায় হায়, কেউ আমাকে চায় না! তবে পুরোনো বন্ধুর ফোন নম্বরটা চাইতে ইচ্ছে করে না। সব সম্পর্ক ওখানেই আটকে থাকুক, ভার্চুয়াল জগতের নির্ঝঞ্ঝাট আকাশে। কিন্তু বিপদ কি সেখানেও কম? সবসময় সম্পর্কের বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখতে পার না। নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছ, কেন এত মিলে যাই, মিশে যাই? মনে পড়ল, একবার তো বলতে গেলে মিশেই গিয়েছিলে। পুরোনো সম্পর্ক ভালো। চুপচাপ থাকে পুরোনো সম্পর্কের জায়গাতেই। কেবল মনে রাখা, বাড়া-কমার কোনো ব্যাপার নেই। নতুন সম্পর্ক ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অথচ সেদিন পুরোনো সম্পর্কই ভাসাতে লাগল তোমাকে। কিরনকে এখন কোথায় পাবে সে নিয়ে চিন্তাটা বেশিদূর এগোলো না অথচ আগের ঝাপসা বা মুছে যাওয়া দিনের ছবিগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল।

তখনকার সময়ে, পহেলা বৈশাখের ভোর বেলা কিরণ বটতলায় লম্বা সারিতে বসে গান গাইবে আর তুমি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবে, কিরণের অত্যাচারে তা হবার কোনো উপায় ছিল না। তারপর থেকে প্রতিবারই তোমাকে অনুষ্ঠানে আসতে হয়েছিল। বেশ আগেভাগেই আসতে হতো। সামনের দিকে বসতে হতো, কিরণ যেন তোমাকে দেখতে পায়। মঞ্চের উপরে কী সুন্দরই না দেখাত তাকে! কখনো সাদা, কখনো লাল, কখনো সবুজ কি হলুদ শাড়ি আর মাথার দু’পাশ থেকে নেমে আসা বেলি বা গাঁদার মালায়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভিতরটা কেঁপে উঠল তোমার। কফির কাপটা হাতে ধরে রাখা অবস্থায়ই নড়ে গেল। ছলকে টেবিলে কফি পড়ল খানিকটা। কফিশপের লোগোর ছাপওলা টিস্যু দিয়ে তুমি যত্ন করে টেবিলে পড়া কফিটুকু মুছতে লাগলে। মুছতে মুছতে তোমার মনে হলো, কোনো নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি ঠিক এভাবে মুছে দেয়া যেত! কিন্তু মোছা যায়নি। সেই যে কিরণদের বৈশাখী অনুষ্ঠান দেখতে তুমি শেষ যখন রমনার বটমূলে গিয়েছিলে। তারপর আর না গেছ সেই অনুষ্ঠানে আর না গেছ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে নাকি জোর করে ভুলে যেতে চেয়েছিলে? তোমার ঠিক জানা নেই। মাথার উপরে জোর দিতেই ঠিক মাঝখানে তীব্র ব্যথার মতো যন্ত্রণা শুরু হলো তোমার। তুমি কফির কাপ রেখে মাথার দুদিকে চেপে ধরে কনুই টেবিলে ঠেকালে। কিছুতেই সেই মুহূর্ত থেকে বেরোনো গেল না। বেরোতে চাইলে উলটো মাথার মধ্যে কতকগুলো ভয়ানক বিষ্ফোরণের শব্দ বাজতে থাকল। শব্দটা আশেপাশে কোথাও নয়, তাই এর থেকে পালিয়ে বাঁচাও যাবে না, তুমি জানো। তুমি যেখানে যাবে, শব্দটাও পেছনে পেছনে তোমাকে ধাওয়া করবে। হাতের তালুতে চোখমুখ ভালো করে মুছে নিলে তুমি। চোখ বন্ধ করলে শব্দ আরো তীব্র আর স্পষ্ট হলো…

কিরণ বলেছিল, ‘হলুদ শাড়ি এবারে আমাদের।’ আগের রাতে শাহবাগ থেকে শাড়ির সঙ্গে মানানসই মাথায় ঝোলানোর ফুলের মালা কেনার সময়ে কিরণের সঙ্গে তুমিও ছিলে। কিরণ গাঁদা নিতে চায়নি; বলেছিল, ‘হলুদের উপরে তো এই হলুদ রঙের ফুল দেখাই যাবে না। তার চেয়ে বরং বেলি ভালো। দেখ, এই মালাটার গন্ধটাও দারুণ।’ হাঁটতে হাঁটতে তাকে হলের গেট অব্দি পৌঁছে দিয়ে নিজের হলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তুমি। পরেরদিন খুব ভোরে উঠেই রমনা। অনুষ্ঠানের আগে আগে, আলো তখনো ফুটেছে কি ফোটেনি, তুমি গিয়ে সামনের দিকে বসেছিলে। কিরণকে দেখা যাচ্ছিল একইরকমের হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। ধাপে ধাপে বানানো মঞ্চটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো ঝাপসা হয়ে আসছিল চোখ, ঘুম তখনো কাটেনি হয়ত তোমার। সামনের হলুদ কাপড়গুলোতে তাই আক্ষরিক অর্থেই চোখে সরিষার ফুল দেখছিলে। তারপর একসময়, প্রভাতে বিমল আনন্দে বিকশিত কুসুমগন্ধে… শান্ত এক সঙ্গীত শুরু হতেই ঘুমের বদলে উলটো বিস্ময় নিয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিলে তুমি। ভাবছিলে, কী স্নিগ্ধ সুর, কী অপূর্ব এই সুরের ওঠানামা, এই করতেই মাসখানেক ধরে পরীক্ষার পড়াশোনা রেখে কিরণ রিহার্সেলের জন্য ওই ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ছুটে যেত! বসুনিয়া গেটের কাছে তাকে ছাড়তে গিয়ে প্রায়ই তাকে তুমি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার দিনক্ষণ কথা মনে করিয়ে দিতে। সে এমন ভাব করত যেন তার চেয়ে গানের রিহার্সেলটা ঢের জরুরি। আর তখন ওই মঞ্চের সামনে বসে তোমার মনে হলো, এতদিন প্র্যাকটিস না করলে কি আর এরকম তাল মিলিয়ে সমবেত গলায় গাওয়া সম্ভব? গানের টানে চারদিকে যেন অপার অপার্থিবতা ভর করল। মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও কোনো অপশক্তি নেই, কোথাও মন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে তুমি তোমার ভেতর থেকে উচ্চারণ করছিলে, চারিদিকে করে খেলা, বরণ-কিরণ-জীবন মেলা… অুনষ্ঠান এগোচ্ছিল, তোমার মুগ্ধতা বাড়ছিল। আরো পরে শ্রোতায় ভরে গিয়েছিল চারপাশ। মানুষে গিজগিজ করছিল, অথচ সবাই নীরব আর সঙ্গীতে মগ্ন। কিন্তু আটটার দিকে ঠিক কী হলো তোমার জানা নেই, গানের সুললিত সুরের মাঝখানে একেবারেই বেমানান বিষ্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলে। কয়েক মুহূর্ত তোমার চোখ-কান কিছু কাজ করছিল না। তোমার মনে হচ্ছিল যেন অসীম কাল কেটে যাচ্ছে তারই মাঝখানে। তোমার ঠিক পাশেই কিছু পোড়া মানুষ কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে ছিল। বারুদ আর চামড়া পোড়ার গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল মুহূর্তে। নিথর মানুষদের স্তূপের পাশ থেকে মানুষজন উঠে দ্রæত দূরে সরে যাচ্ছিল। তোমার শরীরেও একসময় তাগিদ ফিরে এল, তুমিও তাড়াতাড়ি পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করলে। ধাক্কা খেলে। ধাক্কা খেয়ে কোনোমতে টাল সামলালে। দূর থেকে দেখলে কিছু মানুষ আর পুলিশ ছুটে গেল মৃত মানুষদের স্ত‚প লক্ষ্য করে। টানাহেঁচড়া করে যেই তাদের নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। তারই মধ্যে দ্বিতীয় বিষ্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলে তুমি। এবারে আর ততটা জোরে নয়, কিংবা আগের বিষ্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গিয়েছিল তোমার। কিন্তু ধোঁয়ার কুÐলীর পিছনে মঞ্চের উপরে হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবিদের আতঙ্কিত ছোটাছুটি দেখতে পেলে তুমি। তোমার মনে পড়ল, কিরণ! তুমি জীবিত মানুষদের ঠেলাঠেলি আর মৃত মানুষের স্ত‚প ফেলে, বারুদের গন্ধ ভেদ করে সেদিকে ছুটে গেলে। মঞ্চের প্রায় সবাই ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসেছে। ভীড়ের মধ্যে কিরণকে খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল তোমার। দারুণ বিভ্রান্তি নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো একের পর এক হলুদ শাড়ির মাঝে তুমি কিরণের মুখ খুঁজতে লাগলে। কিছু পরে দেখলে মঞ্চের সিঁড়ির নীচে পাখির ভয় পাওয়া বাচ্চার মতো থরথর করে কাঁপছে কিরণ। তুমি ছুটে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত রাখলে, ‘কিরণ, ঠিক আছ তো, না? ঠিক আছ?’ কিরণ কিছু বলেনি। কেবল তোমার গলা শুনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তোমাকে। তুমিও তাকে জড়িয়ে ধরেছ শক্ত করে। মানুষের হুলুস্থুল ছোটাছুটির মাঝখান দিয়ে তুমি তাকে নিয়ে চলে আসতে শুরু করলে। কিরণ যেন স্থবির হয়ে গেছে তখন। তার পা তোমার গতিতে আগাচ্ছিল না।  তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছিল তোমার। মাঝখানে সে একবার দাঁড়িয়েই পড়ল। তোমার হাত টেনে বলল, ‘বলেছিলাম না তোমাকে, বৈশাখ মানেই রক্তের গন্ধ? বলেছিলাম, মনে আছে?’ তুমি তাকে আরেকবার হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলেছিলে, ‘বাদ দাও তো, কিরণ। এখন চলো এখান থেকে।’

শত শত মানুষ সামনের দিকে হাঁটছিল। দৌড়ে যাচ্ছিল। তোমরাও চলছিলে তাদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে এত জোরে পা চালাচ্ছিলে যেন তোমরা দৌড়ে যাচ্ছ। তোমার মাথায় ঘুরছিল কিরণের কথা, সে কী করে জানত বৈশাখ মানে রক্তের গন্ধ? কিরণ যেন কোনোভাবে তোমার ভাবনা জেনে গিয়েছিল। কলাভবন পেরিয়ে বড়ো বড়ো শিশু গাছগুলোর নীচে এসে একটু থামল, তারপর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তুমিও প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে। কিরণ বলল, ‘শুনবে, কেন আমি বৈশাখ থেকে রক্তের গন্ধ পাই?’ তুমি কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ ওর হাত ধরে থাকলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়েছিল সে। সেখানে রাস্তার পাশে তখন ভীড় অনেকটা কমে এসেছে। ফুটপাথের দিকে সেঁটে গিয়ে কিরণ বলেছিল, ‘আমি যখন ক্লাস টেন-এ পড়ি, বৈশাখের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম আমাদের শহরের টাউন হলে। গান শেষ হতেই শুনি বাইরে নাকি কী এক অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। দর্শক-শ্রোতারা অনেকেই হল ছেড়ে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি রাস্তার বাতাসে রক্তের গন্ধ। এত গুমোট গন্ধ, কী বলব, আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার কেন যেন একটুও ভালো লাগছিল না। তাই বাকি অনুষ্ঠান হবে কি না কিছু না জেনেই বাড়ি চলে এসেছিলাম। আসার পথে টাউন হলের মোড়ের উপরে দেখলাম রক্তাক্ত অনেকগুলো শরীর শোয়ানো। উৎসুক মানুষ চারদিকে ঘিরে আছে, তাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে মৃত শরীরগুলোর কারো হাত, কারো পিঠ দেখতে পেলাম। সেখানটায় গন্ধ এত তীব্র, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছে আমার। পাশেই প্রায় চ্যাপটা হয়ে থাকা একটা মাইক্রোবাস কাত হয়ে ছিল। আমি একটা রিকশা পেয়ে একরকম পালিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’

‘তারপর?’ ততক্ষনে তুমিও ধাতস্ত হতে পেরেছিলে। কিরণের গল্পের মধ্যে ঢুকে গিয়ে তোমার কৌত‚হল বাড়ছিল।

‘তারপর বাড়ি পৌঁছানোর কিছু পরে একটা পিক-আপ ভ্যানে করে আমাদের বাড়িতে একটা লাশ এল। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না কী ব্যাপার। আমাদের জানানো হলো ওটা আমার বাবার লাশ। টাউন হলের সামনে ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসের অ্যাক্সিডেন্টে তিনি মারা গেছেন। ছোটো শহর, বলতে গেলে সবাই সবাইকে চেনে। বাবাকে চিনতে পেরে পাশের পাড়ার কিছু ছেলে লাশটা নিয়ে এসেছিল। বাবা তার বন্ধুর অফিসের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।’

তুমি আর কিছু বলোনি। কিরণের ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখেছিলে। কিরণের চোখের দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে কিন্তু সে নির্দিষ্ট কিছুই দেখছিল না। মনে হচ্ছিল ভবিষ্যত কালের মতো ধোঁয়াসা কিছু তার দৃষ্টিকে দখল করে ফেলেছে, সেখানে দুর্বোধ্য কিছু সংকেত ছাড়া আর কিছুই নেই। তুমিও তখন অব্যক্ত কল্পনা চোখে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলে। শিশু গাছের ছড়ানো ডালপালার ছোটো-বড়ো ফাঁক দিয়ে উপরের ঝকঝকে আকাশের নানান আকৃতির টুকরো উঁকি দিচ্ছিল, অথচ মাটিতে সমস্তকিছু ছিল রক্ত আর দুরাশায় মাখামাখি।

কিরণ তার কানের পাশ থেকে বেলির মালাগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছিল। মাটিতে সাদা বেলির পাপড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। তুমি তাকে মানা করনি। তারপর কাঁদতে কাঁদতে কিরণ ফুটপাথে বসে পড়েছিল। কোনো কথা না বলে কিরণের একটা হাত ধরে তুমিও বসে পড়েছিলে তার পাশে।

কফি শপে বসে স্যান্ডুইচ খাবার পরে অন্তত দু’গ্লাস পানি আর কফি খাওয়ার পরেও তোমার কেন যেন গলা শুকিয়ে আসতে থাকল। মনে হলো তোমার ভেতরের তৃষ্ণাটা এত তীব্র, কিছুতে মেটার নয়। কাচের বাইরে রাস্তায় তখন তুমুল কোলাহল। সাধারণ একটা দিনের প্রথম ভাগ। তাকিয়ে দেখলে মানুষ যার যার কাজে উন্মাদের মতো ছুটছে; কারো এতটুকু সময় নেই। শুধু তোমার যেন অসীম স্থবিরতা সেদিন। যা খুশি করে কাটাতে পার অথচ তোমার তখন কেবল কিরণকে ছাড়া আর কারো কাছে যেতে মন চাইল না। সেখানে বসেই তুমি কিরণের ফোন নম্বরে আরো কয়েকবার চেষ্টা করলে। কোনো লাভ হলো না। ফেসবুকে কিরণের নামের তিনটা শব্দকে নানাভাবে লিখে খুঁজে দেখলে, কোনো ফল হলো না। কত মানুষই তো এর বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিরণও হয়ত তাই। শেষে একসময় একটা রিকশা নিয়ে ধানমন্ডি থেকে বেরিয়ে কলাবাগানের সিডির দোকানগুলোর দিকে চলে গেলে। এতদিনে কিরণের কোনো গানের সিডি বেরিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। শত শত সিডি ঘেঁটেও কিরণের নাম বা ছবি কোথাও পেলে না তুমি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে কিরণ তার পর থেকে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছে! হতেই পারে। সে খুব আঘাত পেয়েছিল। কিরণের গান ছেড়ে দেবার চিন্তাটা মাথায় আসতেই তোমার মনে হলো কিরণকে খুঁজে পাওয়ার সব রাস্তা যেন অন্ধগলিতে গিয়ে মিলে গেল।

বাড়ি ফিরে তুমি ভাবতে লাগলে কী করা যায়। ক্লাসের কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে কিরণের কথা জানতে চাওয়ায় কেউ তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। একজন বলল, বছর দুয়েক আগে একবার একজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল, ঢাকাতেই থাকার কথা। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে তুমি ঠিক করে ফেললে, তিন দিনের ছুটি, শনি-রবি আর পহেলা বৈশাখ। এই তিন দিনের মধ্যে তুমি কিরণের খোঁজ বের করবেই করবে। আর এটা ভাবতেই তোমার প্রথমে যা মনে পড়ল, তা হলো, পহেলা বৈশাখে রমনায় গিয়ে দেখলেই তো হয়! কিরণ যদি ঢাকায় থেকে থাকে, তবে নিশ্চয় ওই অনুষ্ঠানে গাইতে আসবে। গান ছেড়ে দিলেও কিরণ নিদেনপক্ষে অনুষ্ঠানটা দেখতে আসবে। সে-ই তো বলেছিল, ঢাকায় থেকে ওখানে না যাওয়া তার মতে অসম্ভব। ঠিক করে ফেললে ওই অনুষ্ঠানে অন্ধকার থাকতেই তুমি গিয়ে হাজির হবে। মঞ্চ থেকে শুরু করে দর্শক আর পুরো রমনায় তন্ন তন্ন করে খুঁজবে তুমি তাকে। সেখানে না পেলে আর্ট কলেজের সামনের নববর্ষের র‌্যালিতে ঘুরে ঘুরে দেখবে। তোমাকে খুঁজে পেতেই হবে তাকে।

দুটো দিন অস্থিরতায় কাটালে তুমি। এর মধ্যে নানান পত্রিকার অনলাইন আর উইকিপিডিয়া ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করলে, কী হয়েছিল পরে রমনায় বোমা ফোটানোর সেই বিচারে? হতাশ হয়ে তুমি দেখলে যে কিছুই হয়নি। বিচার কোথাও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। দশজন মানুষ মারা গিয়েছিল, পঞ্চাশ জনের মতো আহত হয়েছিল। তারিখের পর তারিখ পড়েছে বিচারের। বারবার বলা হয়েছে সাক্ষী অনুপস্থিত। চৌদ্দ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আর এদিকে এর মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলানো হয়েছে সাতবার। বিস্ময়ের হলেও বাস্তব যে আজ চৌদ্দ বছর কেটে গেছে, কোনো সুরাহা হয়নি। শনি-রবিবার জুড়ে তুমি বিচারহীনতার সংষ্কৃতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিলে। তারপর পহেলা বৈশাখে সত্যিই খুব ভোরে পৌঁছে গেলে রমনার বটমূলে। ইলিশ আর পান্তা বিক্রির জন্য মানুষ মোটে তখন বাঁশের খুঁটি দিয়ে টেবিল সাজাচ্ছে। বড়ো ঝোলায় করে বাতাসা, কদমা কিংবা মুড়ি-মুড়কি নিয়ে কেউ পার্কের দিকে ঢুকছে। পুলিশ সমস্তকিছু খুলে খুলে দেখছে। যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করছে। তোমার পাঞ্জাবির পকেটও দফায় দফায় খতিয়ে দেখা হলো। তুমি বুঝলে, সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এটুকুই হয়েছে। চৌদ্দ বছর পরে তুমি রমনার অনুষ্ঠানে আবার সেই জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলে যেখান থেকে একদিন কিরণের হাত ধরে কিছু হতাহত শরীরকে পিছনে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে। মঞ্চের সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকলে। একে একে অনেক শিল্পী মঞ্চে উঠতে লাগল। আজকে তাদের গায়ে সাদা আর লাল রঙের কাপড়। শ্রোতার ভীড় বাড়তে থাকলে তুমি সামনে গিয়ে বসলে। আর বসে মঞ্চের দিকে তাকাতেই তুমি কিরণকে দেখতে পেলে। একইরকম আছে প্রায়। এই কটা বছরে কী আর এমন বদলাবে। নিশ্চিন্ত চেহারা আর অনুষ্ঠানের সারিতে আসন গেড়ে বসা কিরণের দিকে তোমার চোখ আটকে থাকল। সে হয়ত তোমার দিকে তাকাবে না, সে তো আর জানত না যে তুমি আসবে, তবু অন্য মানুষদের মাথার পিছনে নিজেকে একটু আড়াল করে রাখলে। একসময় অনুষ্ঠান শেষ হলো। মঞ্চের সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি। অন্যদের সঙ্গে একসময় কিরণ নেমে আসতে লাগল, হাতে তানপুরা। কিরণের চলন আগের চেয়েও শান্ত। তোমার দিকে চোখ পড়তেই সে থমকে গেল।

‘সাইফ, না?’

‘কেমন আছ, কিরণ?’

‘আমি ভালো। তুমি কোথায় ছিলে এতদিন বলো তো? আমি তোমার খোঁজ করেছিলাম। বিদেশ থেকে ফিরে এলে কবে?’

‘ফিরেছি কয়েক বছর আগে। খুব স্ট্রাগল গেল, কিরণ। হাজার ঝামেলায় কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম। তুমি ঠিক আছ তো?’

‘আমি একদম ঠিক। তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। মনে আছে, ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমি ঠিক আছি কি না? চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি আর চেঁচামেচি তখন, মনে পড়ে?’

‘হ্যাঁ, তার মাস তিনেক পরেই চলে গিয়েছিলাম আমি দেশ ছেড়ে।’

‘তুমি কি ভিতু, সাইফ?’

‘পুরোপুরি না। এই দেখ না ফিরে এলাম আবার। তখন মনে হয়েছিল, আর কী থাকল আমাদের? সবই তো গেল।’

‘কিছুই যায়নি আমাদের, সাইফ। ওইটুকুতে কিছু যায় না।’ কিরণ অদ্ভুত সুন্দর করে হাসল। তার কানের দু’পাশের লাল গোলাপ আর বেলির মালা দুলে উঠল। বারুদ আর রক্তের গন্ধের স্মৃতির জায়গায় অদ্ভুত বেলির গন্ধ জায়গা করে নিল। কাছেধারেই কোথাও বাঁশি আর ঢোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। কেউ বাজিয়ে শুনিয়ে বিক্রি করছে হয়ত। অসম্ভব সুন্দর সাজসজ্জায় কিছু ছেলেমেয়ে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিতে গ্রæপ ছবি তুলতে লাগল। সবকিছুর দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তুমি কিরণের দিকে তাকালে। কিরণ যেন তোমার মুখ থেকে কিছু শোনার প্রতীক্ষায়। তার মুখে তৃপ্তির একটা হাসি লেগে থাকল। তোমার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, ‘তুমি আর বৈশাখ শুনলে রক্তের গন্ধ পাও না এখন, তাই না, কিরণ?’

‘ঠিক ধরেছ। পাই না। আমি ভয়কে জয় করেছি। দেখছ না, চারদিকে কতকিছুর সুগন্ধ? এত সুন্দরের মাঝখানে রক্তের গন্ধের জায়গা থাকে আর?’

তুমি অবাক-বিস্ময়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে থাকলে। মনে মনে বললে, এবারে আর তোমাকে হারাব না, কিরণ।

 

 

 

কালপুরুষের কুকুর

আব্দুল আজিজ

সামনের নির্জন স্টেশনটাতে পৌঁছানোর আগে একটা পুল পড়ে সেটার কাছাকাছি  যেতেই আমাকে সহ ‘কল্পনা’ নামক বগির আরো শ’খানেক যাত্রীকে নিয়ে কী কারণে ট্রেনটি থেমেছিল আমার মনে নাই। কারণ জিজ্ঞাসা করতে ভয় পাচ্ছিলাম, হাতের রেখার মধ্যে মনে হলো রক্ত নদী বইছে। তখন বগির ভেতর সবাই একে অন্যকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, এতক্ষণ যে তারা পরস্পর পরস্পরের পাশাপাশি বসেছিল কিন্তু কেউ কাউকে এখনকার মতো এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। কিন্তু কেন করেনি? আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করলোইনা বা কেন? অনেকে কথা বলেনি ঠিকই তবে চোখে চোখ পড়লে তাকিয়ে হেসে থেকেছে।

ট্রেনের ইঞ্জিনটা দুর্বল ষাঁড়ের মাছি তাড়ানো লেজের মতো নড়ে উঠল কয়েকবার, তবে হুইশেল বেশ চেঁচিয়েই বাজল, আড়ৎ এর দালালদের মতো তার চিৎকার।
জানালায় লেগে থাকা বাসি বমির গন্ধে টেকা যাচ্ছে না, যাত্রীরা সেদিকে কোন নজর দিলো না, এমনকি নাকটাও না  সিটকে তারা শুধু নিজেদের থুথু অজান্তেই গিলে ফেলল।

এরইমধ্যে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কী যুবক ছেলে ভেতরে বলদের মতো বসে না থেকে দেখগে বাইরে গিয়ে, কি সমস্যা তুমি না হবু ইঞ্জিনিয়ার!

আমি খানিকটা আশ্চর্য হই একজন অপরিচিত ব্যক্তি কীভাবে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারটা ধরে ফেলল। আমি কৌতুহলী হয়ে তাকে লবণ দিয়ে জোঁক খোঁচাবার মতো খোঁচাতে নেমে পড়লাম।

আমার লবণ ছিটানোটি ছিল এইরকম, এই যে ভদ্রলোক আপনি যে অল্প বয়স্ক মেয়েটিকে নিজের আত্মীয় বলে  শহরে পালিয়ে যাচ্ছেন বিয়ে করবার জন্য এটা কি সত্য নাকি গুজব?

ভদ্রলোকটি অ্যাটাক আসার মতো হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলেন, পাশের মেয়েটি তাকে  অনটাইম চায়না হাতপাখা দিয়ে বাতাস শুরু করে, সেটা তার ভ্যানিটিব্যাগেই ছিল যেন খাঁচায় বন্দি চ্যাপ্টা ডানাওয়ালা পাখি। বেরিয়েই ডানা ঝাপ্টানি শুরু করেছে।

ভদ্রলোকটি ঢোক গিলে বলল, এই যে যুবক তুমি কী করে এতটা জানলে? তুমি কি আমাকে জানো অথবা চেনো?

আমি তাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য আবার লবণ ছিটালাম। বললাম, আপনি এই শর্তে আপনার মেয়েদের রাজি করিয়েছেন যে, অল্প বয়স্ক সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ের বদলে আপনি বাড়িটা আপনার সন্তানদের উইল করে দিবেন, কিন্তু তা না করে বাড়িটি অন্য একজনের কাছে চুপচাপ বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পালাচ্ছেন।
এবার সত্যি সত্যি ভদ্রলোকটির আগে আমি নিজেই ভড়কে গেলাম কারণ সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে নিশ্চয় আমি সত্য বলে ফেলেছি।

আমি আমার মুখে হাত দিয়ে চেপে রইলাম অনেক্ষণ যতক্ষণ না আমার নিজেরই ঘোর কাটে।

স্টেশনের অদূরে যেখানে ট্রেনটি থেমে আছে তার দুপাশ জুড়ে বিঘের বিঘে আখ ক্ষেত। জারুল আর শিমুলের গাছগুলো ছিল পাশাপাশি সতীনের মতো এক সংসারে। গাছে গাছে গায়, গাছে গাছে সই। শালিক পাখি সাইজের শিমুল ফুলগুলো রেললাইনের উপর থেঁতলে পড়ে থাকে। ট্রেন বুনো শুয়োরের মতো দৌড়ে এসে চলে যায়।

একজন আখ চাষীর সাথে কথা হল, সে তাড়ার উপরে ছিল বলে আমি গল্পটা বেশ জমাতে পারলাম না, দেখি তাকে ঘিরে মাছির ছা ছিমড়ি উড়ছে। ভনভন শব্দের তুড়ি আমার কানে যেতেই, আখ চাষী আমাকে বলল, এই যে যুবক ছেলে প্রেমটা ভেঙে গেল বলে মেয়েটাকে গালিগালাজ করে ফিরে যাচ্ছ শহরে?

আমি তার গুড় তৈরির বয়লারে ফুটন্ত আখের রসের মতো ফুটছিলাম, আখ চাষীর দাঁতগুলো কাস্তের মতো খচখচে। সে গামছা থেকে বিড়ি বের করে ধরিয়ে আমার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টায় দূরের এক গ্রামের কৃষকের কথা তুলল। যে কৃষকের ঘরে দুই মেয়ে, কোন ছেলে ছিলো না। আরও অদ্ভুত শোনালো যখন শুনলাম তারা দু’জনই অন্ধ।

আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়ার ধান্ধা করার আগেই আখ চাষী শেকলে বাঁধা একটি শেয়াল টেনে বার করে, তারপর  দেখি শেয়ালটি আখ চিবুচ্ছে  আর তার কষা বেয়ে নামছে সাদা ফেনা। মনে হচ্ছে শেয়ালটি বমি করছে।
শেয়ালটিকে খুবই আনুগত্য মনে হল এমন কাণ্ড জীবনে এই প্রথম দেখলাম।

আখ চাষী হেসে বলল, শোনো কাঁটা দিয় কাঁটা তোলার চেষ্টা করেছি মাত্র, কত্তো বড় সাহস আমার ভেড়ার পালে একদিন দিনদুপুরে একটা ভরা পোয়াতি শেয়াল এসেছে, মতলব শিকারের। আমি বয়লারে আখের রস জ্বাল দিচ্ছি। আল্লার কি হুকুম ভেড়ার পালের কাছাকাছি শেয়ালটির প্রসব বেদনা উঠল, আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি একটা বাচ্চা পয়দা করে শেয়ালটি মারা গেছে। আমার কূটচালের মাথা, ভাবলাম শেয়াল পিটিয়ে ভেড়া বানাব। এবং এই শেয়ালকে দিয়েই জোগাবো আমার ভেড়ার পাল। তাই হচ্ছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছি, ভেড়ার পাল বাড়ছে দিনকে দিন।

-এটাও সম্ভব?

-কেন না মগজে খেলিয়েছি। শোন এখন ট্রেনে হিজড়া উঠবে, তারা পুলের নিচ থেকে আত্মপ্রকাশ করে, আত্মগোপন করবে স্টেশনের পেছনের খ্রিস্টান  সাঁওতালদের গোরস্তানে, তুমি দেখো…

সত্যি ট্রেনে উঠল একদল হিজড়া আর তাদের সবার নাম দুই অক্ষরের মধ্যে যেমন- চম্পা, নিপা, মধু, মতি, লতা এবং জয়া। তারা এখন পর্যন্ত কেউ জানেনা যে তাদের সকলের নাম দুই অক্ষরের। আদৌতে কি তারা পড়াশোনা জানে? অথবা চাঁদাবাজির পয়সাগুলোর গণনা কিংবা হিসাবনিকাশ করা তারা কি এমনি এমনি শিখে গেছে? প্রশ্ন আর প্রশংসা দু’টোই করতে মনের মধ্যে খচখচ ভাব তৈরি হতে থাকে। তাদের কায়দায় তারা তালি বাজাচ্ছিল। জয়ার কপাল থেকে চান্দির মাঝামাঝি নিয়ে টাক। ছাটা চুল। বিদঘুটে মেকাপ। এবং নকল স্তন। সে বাকি হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে লুডুর গুটির মতো।

জয়া বেশ উগ্র, বদ মেজাজি। অন্যরা নিমিষেই বগির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং টাকা তুলতে শুরু করে এটা তাদের একধরণের চাঁদাবাজি বলা যায়। আমি তাদের এসব কায়কারবার দেখে আমার ফোনের ক্যামেরাটা অন করি। সেটা জয়া দেখে আমার কাছে আসে, আর নরম ভাষায় (যদিও তার কণ্ঠস্বর নর বতকের মতো খসখসে শোনাচ্ছিল) বলল এই যে সোনা তুমি কি আমাকে পছন্দ করেছ? যদি করে থাকো তাহলে তোমার কাছ থেকে টাকা নেবো না, আর যদি ঘেন্না কর ওদের মতো যাদের স্বাভাবিক শরীর, লিঙ্গ আর উঁচু বুক আছে তাহলে কিন্তু তোমাকে টাকা দেওয়া লাগবে। আমি উত্তর না দিয়ে ক্যামেরাটা তার দিকে উঁচিয়ে ধরতেই সে বলল এতো ছবি তোলার শখ? আমরা সহজে ন্যাংটা হতে পারি আবার ন্যাংটা করেও দিতে পারি। জয়া তার কটকটে কমলা রং এর সায়া দোলাতে দোলাতে বলল তুলব নাকি – দেখবে..? দেখবে?

তাকে থামাতে আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাত্রদের জন্য কি বিশেষ কোন ছাড় আছে?

জয়া শান্ত থাকার চেষ্টা করেও কিন্তু পারল না সে রেগে গিয়ে আমাকে তার পুরুষালী কন্ঠে খিচড়ানি শব্দে গালি দিতে গিয়েও কেন যেন থেমে গেল। তার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়।

আমি লবণ ছিটানোর পরিকল্পনা করে দিলাম ছিটিয়ে, তোমাদের দল গোরস্তানে কী করে বুঝি না বুঝি, আর পুলের নিচ থেকে কতদিন খোলস বদল করবে?
জয়া হতভম্ভ হয়ে গেল, মনে হচ্ছে সে বিশাল ভয় পেয়ে গেছে। তার টাকে ঘাম জমছে, নকল স্তনটাও  কাঁপছে।

সে আমার কাছ থেকে দূরে সরতে চেষ্টা করে এবং পরপর ডাকতে থাকে যাদের সবার নাম দুই অক্ষর দিয়ে।

হিজড়াদের দলটিকে পেছনে রেখে কয়েক সিট এগিয়ে গেলে দেখি জনৈকা এক মহিলা বুলন্দ শাহের মাজার থেকে নিয়ে আসা একটি নীতি গল্প মুখস্ত করে চলেছে, তাকে জিজ্ঞেস করতেই বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা নিঃশ্বাসের পর ঢোক গিলে বলল, বড্ড ভুলা মন বাপ তাই মুখস্ত করছি, যা জামানা, শুইন্যা আইনু গেল বকরা ঈদের কুরবানির গোস্তে নাকি আল্লাহু আর নবিজির নাম মুহাম্মদ ল্যাখা উইঠ্যাছে এ্যার চেয়েও ভয়ানক কথা শুইন্যাছ কি?

আমি বললাম, না।

-শুনো নি? হায় খোদা এগল্যা খবর রাখে না বল্যায় দুনিয়্যা আখের হইতে চইল্যাছে।

-ঘটনা বলেন, কী হয়েছে?

-বেশি পুরানা ঘটনা লয় এই তো দশ বারো দিন আগের কথা পচ্ছিমপাড়ার এক পুয়াতির সান রাইতে ব্যথা উঠলো আর ভোররাইতে ফজর অক্তে ব্যাটা ছ্যালা হইল…

-তারপর?

-তখনই তো ঘটনাটা ঘটল ছ্যালাটা হওয়া মাত্রই আজান দিতে লাগল, দিয়া এক দৌড়ে ডাবের গাছে উইঠ্যা কহিলে যার যার একটা ব্যাটা ঘরে, সে মা যেনে পিতলের কলসি ভরা পানি ডাবের গাছের গোড়ায় ঢালে। তারপর গায়েব। সইত্য ঘটনা গো।

আমি ঘটনাটি শোনার পর সেই গল্পবলা মহিলার কাছে এমন ভঙ্গিতে বুলন্দ শাহের মাজারের ঠিকানাটা চাইলাম, মনে হল তিনি বুঝতে পেরেছেন যে আমি তার গল্পে আমল এনেছি।

তবে কেন যে ট্রেনটা থেমেছে এই প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ কিছু বলছে না দেখে আমি আরও কয়েক সিট সামনে এগিয়ে যাই। আর দেখি এক ভিক্ষুককে যিনি লেটা মেরে বসে আছেন মাটিতে। পরে বুঝতে পারি যে ভিক্ষুকটি অন্ধ, খুব ছোটো বয়সে তার গুঁটি বসন্ত হয়েছিল গ্রামে ছিলো না ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রচলিত ঝাড়ফুঁক আর কবিরাজ দেখিয়ে গা থেকে গুটি বসন্ত বিদায় হলেও, রেখে গেছে তার চিহ্ন।  গোটা মুখে ফুটি ফুটি দাগ আর দৃষ্টিহীন কানা  দুই চোখ।

ভিক্ষুকের কথাটা ভাবতে গিয়ে আখ চাষীর গল্পের সেই কৃষকের দুই অন্ধ মেয়ের গল্পটা শুনতে ইচ্ছা জাগল, তাকে জিজ্ঞাস করতাম তারা কি পেটের অন্ধ নাকি গুটি বসন্তে চোখ হারিয়েছিল। আমি ভিক্ষুকটির কাছে যেতে না যেতেই সে বলল, তোমার ঘাটা দেখছিনু।

চোখে দেখতে পেলে হয়তো তার লজ্জা  লাগতো, কিন্তু  অন্ধ হয়ে এ এক সুবিধা সেই লজ্জাটা এই না দেখার ব্যাপারে অনেকটা পুষিয়ে নিয়েছে। সে কিন্তু কিছু একটা বলার মধ্যেই আছে, হু কহছি যে হারঘে বরিন দিয়াড়্যা মানুষের মইধ্যে এ আর এমন কি! অরা তো জ্যান্যাই লিয়্যাছে যে হামি কানা আর ভিখ করি টেনে টেনে (ট্রেনে)। অর্থাৎ জীবনের কাছে লজ্জা শরম টানতে নাই।

তারপর কেন যেন মনে হল কৃষকের অন্ধ দুই মেয়ে আমার দু’কানে ভর করেছে, তারা বলছে, তুমি কি জানো আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।

আমি বললাম, আপনারা নিজেদের বলছেন অন্ধ কিন্তু দেখছি সবই দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, তারা বললেন কই আমি বলিনি তো যে আমরা দেখতে পাইনা। অন্ধের ভান করা দুনিয়ার সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের বুলি যে আমরা অন্ধ, হ্যাঁ সত্যিই আমরা অন্ধ, অন্ধত্ব আমাদের শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের বিকাশ এবং প্রকাশ এই অন্ধত্ব থেকেই। দেখেছ রংহীন অন্ধত্বের দোহায় দিয়ে ভিক্ষুকটি আজও বেঁচে আছে, বাল বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে, অন্ধত্ব তার শরীর বা চক্ষু জুড়ে আছে বলেই যখন তখন এই দুনিয়াটাকে বন্ধ, সুরক্ষিত নিজের ঘর মনে করে সঙ্গমে গিয়ে বছর বছর নিজের অন্ধত্ব কণা উপহার দিচ্ছে এই পৃথিবীকে। আমরা কি অনুমান করছি তার অন্ধত্ব লাভের মজা অথবা যখন তখন উসকে যাওয়া তার প্রেমের পরশ। তাকে এখন দিনের বা আলোর জগতে নিয়ে গেলে সে নিশ্চিত সেখানে বেশিদিন থাকতে চাইবে না কারণ অন্ধত্বের মজা যে একবার পেয়েছে সে রঙিন আলোর জটিলতায় ফিরতে চাইবে না। এমন কি আমরাও চাইবো না। তবে তুমি যে আমাদের ভান করার ব্যাপারটা মনে মনে ধরে ফেলেছ এতে মোটেও আশ্চর্য হইনি কারণ যারা আমাদের এই ব্যাপারে জেনেছে তারা সবাই একই চরিত্রের অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত।

তাদের সংজ্ঞায় প্রত্যেকটা মানুষ অন্ধ।

এবার আমি আমাদের ‘কল্পনা’ নামক বগির শেষ প্রান্তে এসে দেখি, একটা জটলা। এখানে বেশ হৈ চৈ। তবে কেন?

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার (দেখে শিক্ষিত মনে হল) কাছ থেকে জানলাম, দেড় বছরের এক শিশুর জন্যই এত কাণ্ড।

আমি বললাম, এই দেড় বছরের শিশু আবার কি করল?

আপনি জানেন না শিশুটি ট্রেনে উঠার পর থেকে এত কাঁদছিল যে, অগত্যা তার মা মুখ ফসকে বলে বসে তুই যদি না চুপিস তাহলে তোকে জানলা দিয়ে ফেলে দেব। অমনি ব্যস হয়ে গেল।

-এটুকুই কাহিনি!

-তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি জানেন না যে চলন্ত ট্রেনে কিংবা নৌকায় এসব কথা বলতে হয়না। ওই হতভাগী মায়ের জন্যই তো ট্রেনটা থেমে আছে।

না বলে ঐ কথা আর না আমাদের দেখতে হয় একসাথে দুজনের করুণ পরিণতি।
-ট্রেনটা কি অন্য কোন ভাবেই গড়ানো সম্ভব নয়।

-না। এটা অসম্ভব। আমরা এই কথা বহু বছর ধরে মেনে আসছি। শিশুটিকে

জানালা দিয়ে না ফেললে আমরা কেউ-ই কোথাও যেতে পারবো না।

-এসব কুসংস্কারে এখনো বিশ্বাস করেন আপনারা?

এ ফাঁকে শুনতে পেলাম বুলন্দ শাহের মাজার থেকে আসা জনৈকা মহিলার কণ্ঠস্বর তিনি আফসোস নিয়ে বলছেন, আহারে বহুটা মনে হয় ডাবের গাছের গোড়ায় পিতলের কলসি ভরা পানি ঢালেনি।

কি আর হতভম্ব হব! জটলা হটিয়ে দেখতে পেলাম মেয়েটি কীভাবে তার কোলের শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে। সে তার ভাগ্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। হাত চাপড়ে মাথায় মাথায় বাড়ি দিচ্ছে। আর তা কোথায় লাগছে, ভাগ্যে, জন্মে, নাকি পরিহাসমূলক বিশ্বাসে! জানিনা।

ভূগোল ক্লাসে স্যারের বকবকে থুথু ছিটানো ভূতত্ত্বের ব্যাখ্যাগুলো আজো মনে পড়ে, তখন বহু কিছু জানার আগ্রহ ছিল। সেই ভূগোল ক্লাসের স্মৃতির কিছু অংশ মনে করে এই সময় মহাশূন্যের গহব্বরে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।  জানিনা সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের কথা যেটা পরিচিত সিরিয়াস বা লুব্ধক নক্ষত্র নামে ।  হতে পারে তার উজ্জ্বলতা  আমাদের বিশ্বাসের মতো বিকট চকচকে অথবা ধারালো। যেটাকে আমরা ছোটোবেলায় কালপুরুষের কুকুর বলে জানতাম। ভূগোল ক্লাসে স্যারের সেই ব্যাখ্যা, ভাবনার ভুলগুলো চুরমার করে দিতে থাকে। আচ্ছা সেই লুব্ধক নক্ষত্র কিংবা ছোটোবেলার শুভ কালপুরুষের কুকুর যদি আমাদের কল্পনায় আটকে পড়া কুসংস্কারের ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে যেত। সম্ভব কি?

তবে সম্ভব হয়েছে আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে যাওয়া। সেখানে সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা ছাড়া একুশ ইঞ্চি টিভির পর্দার সামনে বুক ফুলিয়ে সিংহের সিংহভাগ কামড়ে হরিণভাগ হয়ে যেতে দেখেছি। আর সেই ভাগ বা শিকার শেষে সিংহ যেভাবে গা ঝাড়া দিয়ে গর্জন ছাড়ে তেমনি ভাবে ট্রেনটি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার পর গর্জন হিসেবে হুইশেল দিলো। দ্রুত গড়তে থাকল ট্রেনের চাকা, যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বাচ্চাটিকে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পর, তার মা অজ্ঞান হয়ে যায়। জানালা দিয়ে দেখি বোবা গাছপালা সহ চলন্ত ভূমি, তেলে চলা যন্ত্রটির সাথে কীভাবে সাই – সাই শিশ তুলে নগ্ন পাল্লা দিয়ে ছুটছে। থামো… থামো, দেখছি আমার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না, মনে হয় গন্তব্যে ফেরার আনন্দে সবাই নিশ্চুপ।  দ্রুত আমি দৌড়ে গাঢ় লাল রঙের শেকলটা খুঁজতে থাকি যার পাশে লেখা সতর্কীকরণ বার্তা, “প্রয়োজনে গাড়ি থামাইতে শেকল টানুন, অযথা টানিলে ২০০ টাকা জরিমানা।”

আসলে এই মুহূর্তে আমার কি শেকল টানা উচিৎ?