You are currently viewing বসন্ত শেষে > জাকিয়া শিমু

বসন্ত শেষে > জাকিয়া শিমু

বসন্ত শেষে

জাকিয়া শিমু

মোহন মিয়াঁ দাওয়া’র কোনে কাঁচা-মিঠে আমগাছের গোঁড়ায় দিনভর সিঁধিয়ে বসে থাকেন। মনটা সারাক্ষণ হুহু করে। অসোয়াস্তি পিছু ছাড়ে না। চোখে-মনে কোথাও স্বপ্নের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই। স্বপ্নহীন মানুষের মনে শান্তি বাস করার জায়গা কোথায়? শান্তির বাস- স্বপ্নের ভেতর। গাঁয়ের লোকজন আড়চোখে তাঁকে দেখে,দন্তনির্গত হাসি হাসে ! অবজ্ঞার হাসি শুধু পড়শি নয়, নিজের ঘরেরজনেরাও কি পিছিয়ে আছে ! তাঁকে নিয়ে অহরহ ঠাট্টা মশকরা চলে। মোহন মিয়াঁর নিজের দোষটা আসলে কোথায়? তিনি নিজেও ঠিকঠাক ধরতে পারেন না ! সারাক্ষণ মরে- যাওয়া মানুষের চোখের মতো অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন – জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের দিকে।

গত প্রায় দু’কুড়ি বছর তার দুর্দান্ত ব্যতিব্যস্ত সময় ছিল। চোখভরা স্বপ্নের নহর বইত। অন্যের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে যেয়ে নিজের সুখের ঘুড়িটা সুতো কেটে কখন ছুটে গিয়েছে, টের-ই পাননি। জীবনভর মানুষের দেখভাল করলেন। জীবনের নানান অধ্যায় বিচরণ শেষে, যা পেলেন, তা কি আসলে তার প্রাপ্য ছিলো? এমন অযুত-নিযুত ভাবনারা আজকাল অনেকটা জোর করেই মনের মধ্যে ঠেশে বসে। মনেরজঠর থেকে খুব করে চেয়েও ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। মাথার উপর আকাশটা ক্ষণে ক্ষণে সুরত বদলায় কিন্তু তার মনের আকাশটায় ঘনমেঘ জমে আছে। আকাশের বিশালতার কাঁছে মেঘের মিছিল বড়ো তুচ্ছ, খুব সহজে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু মন- তো আকাশ নয়, সে সুযোগ মনকে দেয়া হয় নাই। মনের মেঘ বড়ো বেদনায় ডুবায়।

দাওয়া’র দখিনে আধ-পাকা একখানা পাকঘর। বহুকাল আগের। ছাল ওঠা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বউটা মাটির চুলার মুখে পাটশোলা গুঁজে আর নিজের মনে বিরবির করে খিস্তি আওরায়। নাঃ, মোহন মিয়াঁকে উদ্দেশ্য করে নয়, নিজেকে নিজে অভিশাপ দেয়। দিনভর, নিজের অদৃষ্টরে শাপশাপান্ত করে ! চুলার হাঁড়িতে ঝিঙ্গেশাইল চালের ভাত টগবগিয়ে ফোটে। তাতিয়ে উঠা চুলার পাঁশে চৌকোনা কাঠের পিঁড়িতে জবুথবু হয়ে বসে থাকা বউটার জন্য বড্ডো মায়া জমে আছে, মোহন মিয়াঁর। সেই পনের-ষোলো বছর বয়সে লাল জমিনের ওপর সোনালি পাড়ের বেনারসিতে জড়িয়ে, এবাড়িতে তুলে আনলেন। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। চোখের তারায় সেসব দিন ঝলমল করে বসে আছে।

তারপর… কতো শত সহস্র দিনক্ষণ চলে গেলো, দুজনে পাশাপাশি বসে একবেলা মনেরকথা বলার জো হয়ে উঠল না। নিজের জীবনযৌবন সাধআহ্লাদ অমাবস্যার ভরা অন্ধকারেই রয়ে গেল। সাথে বউটার উপর-ও অবিচার করা হল। মোহন মিয়াঁর বিবেকের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এখনো ক্ষয়ে যায়নি। তার ভাবনার বলয় বহুদূর অবধি চলে যায়। নিজের উপর খুব রাগ হয়, ঘৃণা ধরে। মনে মনে অদৃষ্টের চৌদ্দগুষ্ঠীকে মনের খায়েশ মিটিয়ে অভিশাপ দেন। দিনরাত অভিসম্পাত করেন। তারপরও মনটায় একদণ্ড স্থিতি ফিরে আসে না।

মোহন মিয়াঁর বাবার বিষয়আশয় বলতে-বাপের আমলের ভাঙ্গাচুড়া দুটি তাঁতের কল। পনের ষোলো শতাংশের উপর ক্ষয়িষ্ণু একখণ্ড ভিটেমাটি। ভিটের ওপর পক্ষঘাতগ্রস্ত দেহের ন্যায় ঢলে পড়া একখানা দুচালা টিনকাঠের ঘর। চার ভাইবোন, দাদিসহ বাবা মায়ের হাভাতের সংসার। ভাঙ্গা তাঁতকলে সপ্তাহে বড়োজোর চার পাঁচজোড়া লুঙ্গি পরিবারের সবার একত্রে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী শেষে নামানো যেত। তা বিক্রিবাট্টায় যা জুটত তার দৌলতে সংসারে্র নুনপান্তার যোগারযত্ন কোনোমতে চলছিল। কায়ক্লেশে প্রাইমারিটা শেষ করে মোহন মিয়াঁ। এরপর হাইস্কুলে পড়ার যোগ্যতা থাকলেও সামর্থ্যের সংকুলান ছিল না। বাধ্য হয়ে বাবার সাথে সংসারের হাল না ধরতে নেমে পড়েন।

কিন্তু ততদিনে দেশজুড়ে বাঁধে আরেক ফ্যাসাদ। মেশিনেরকল’ নামক দানব মেশিন দস্তুরমতো দখল করে নেয় তাঁত শিল্পকে। প্রথমে যদিও মেশিনের-কলের সাথে বিগ্রহ ঘটে আদি হাতে চালানো তাঁতকলের। কিন্তু একসময় পর মেশিন- কলের জোরের তোরে কুলাতে না পেরে দেশ থেকে হাতের তাঁতকল প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এসব গ্রামগুলো একসময় প্রানবন্ত ছিলো তাঁতকলের ঠকঠক আওয়াজে। গাঁয়েরলোকের কাঁছে গভীররাতে তাঁতের কলের ঠকটক শব্দ ছিলো, ঘুমপাড়ানি গানের সুরের মতো মধুময়। ধীরে ধীরে চিরাচরিত সেসব শব্দ প্রায় নিভে-ই যায়, তাঁতপাড়ায় ঘিরে থাকা এসব গ্রামগুলো থেকে। বংশপরম্পরায় অভ্যস্ত জাত ব্যবসা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে বহুলোক।

গাঁয়ে সংসার চালানোর মতো তেমন কোনো কাজ নেই। শিল্পমনা এসব তাঁতিদের পূর্বপুরুষরা তাঁতকাজ করেই এ-যাবতকাল টিকে ছিল। বিষয়সম্পদ-জমিজিরত এসব খুব কম তাঁতীর আছে। বেশিরভাগ তাঁতীর জমিজমা নাই। বেকার হয়ে যাওয়া তাঁতিরা নিন্মশ্রনির কাজের খোঁজে শহরে ভিড় করল। কেউ কেউ নিজ গাঁয়ে এবং আশপাশের গাঁয়ে খুব অল্প মূল্যে পৈরত দিতে শুরু করে। মোহন মিয়াঁর বাবা ছিলেন শ্বাসেররোগি। খুব কষ্ট করে শুয়ে বসে জিরিয়ে তাঁতের কাজ করতেন। তার পক্ষে বাড়ি ছেড়ে যত্রতত্র কাজ করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে মোহন মিয়াঁ গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরে গেলেন। দৈবক্রমে অচিন সে শহরে দূরসম্পর্কের এক খালার বাসায় আশ্রয়ও পেয়ে গেলেন।

হেমন্তের বেলা চটজলদি পড়ে যায়। বউটা এ বয়সে একা হাতে রান্নাবান্না সামলে ওঠতে হিমসিম খায়। সকালের জলখাবারের ঝামেলা না চুকতে দুপুরের আয়োজনে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ার তাগাদা পড়ে যায়। দু’ ছেলের বউকে অবশ্য ঘরের বাইরে খুব একটা দেখা যায় না। বাচ্চাকাচ্চা সামলে কূল কিনারা করতে পারে না। সংসারের অন্যকাজে এরা খুব একটা বিপদে না পড়লে ঘেঁষে না। একজন কাজেরলোক অবশ্য আছে। সেও ছেলের বউদের ফুটফরমায়েশ খেটে দম ফেলার সময় পায় না। মোটের উপর কথা সেটা নয়, উদ্দেশ্য ভিন্ন, তা অবশ্য বুঝতে মোহন মিয়াঁ কিংবা তার বউ’র অসুবিধা হয় না। এরা খয়রাতি মনমানসিকতার মেয়েছেলে। তাঁদের এ সংসারের উপর থেকে মায়া উঠে গেছে। মায়া, বড্ডো জটিল বিষয়। একবার চলে গেলে জোর-জবরদস্তি করে বসানোর চেষ্টা বিফলে যায়। অবশ্য শুরু থেকে এ-সংসারে তাদের মনোযোগ ছিল না। তাঁদের আলাদা সংসারের স্পৃহা ছিল। অন্যের সংসারের দায়িত্ব নিতে এরা রাজি নয়। ছেলেরা ইনিয়ে বিনিয়ে আলাদা সংসারের কথা পাড়ে মোহন মিয়াঁর কাঁছে। মায়ের কাঁছে অবশ্য এমন অন্যায় আবদারের সাহস পায় না।

মোহন মিয়াঁর বউর জীবনের সমস্ত চাওয়া-বিসর্জনের বিনিময়ে পাওয়া এ-সংসারটা । তার জীবনের সাধ-আহ্লাদ- সুখ এসব আবশ্যক বিষয় বলতে গেলে কিছুই তার ভাগ্যে জুটে নাই। কাঁছের মানুষটা বছরের পর বছর মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর জীবন পার করেছে। মানুষটার জন্যে তার মনে ছিলো এক- আসমান সমান মায়া-ভালোবাসা। মনটা সারাক্ষণ বিক্ষিপ্ত থাকত, অসহনীয় দুঃখ হতো মানুষটার জন্যে। সে সময়ে, কষ্ট ভুলে থাকতে সমস্ত মনোযোগ দিত সে সংসারটার উপর। সংসারটা তাঁর কাঁছে হেলাফেলার বিষয় নয়, সাক্ষাত উপচার।

এ-সংসারে একটা সময় পর্যন্ত বলতে গেলে কিছুই ছিল না। আব্রুহীন ছিল। এখন নেই, এমন একটা কিছু খুঁজে বের করা মুশকিল হবে। একটা সংসার গড়তে টাকাকড়ির চাইতেও যে বিষয়টা বেশি আবশ্যক, তা হলো- মায়া। বউটা খুব কষ্টে বিন্দু বিন্দু মায়া জমিয়ে মালা গেঁথে আজকের এই সংসার গড়েছে। সবার সংসারের উপর দরদ থাকে না। যাদের অন্তরে সংসারের জন্যে দয়ামায়া নেই তাদের কাঁছে সোনার সংসারও হয়ে ওঠে তামস্রি। সংসারের মানুষগুলো বাস করে সংসার নামক যমালয়ে। তাই সংসারের গায়ে ছুরিকাচি চালিয়ে এখনই খণ্ডবিখণ্ড করতে বউটা নারাজ। মোহন মিয়াঁ নিজেও বউকে সমীহ করে চলেন। বউর জ্ঞান বিবেচনা সাধারণ মেয়েছেলের মতো নয়। ছেলের বউরা দায়দায়িত্বের পাশ কাটিয়ে সোনার সংসারটা ভাগ বাটোয়ারা করে নিবে, তাতে মোহন মিয়াঁর নিজেরও আপত্তি আছে ।

খালার বাসায় আশ্রয় পেয়ে কাজের জন্যে খুব একটা সময় নষ্ট করতে হয় না, মোহন মিয়াঁর। খালুর, পুরান ঢাকায় রাস্তারপাড়ে ঝুপরিঘরের তেহারির দোকান। খালুর রান্নার হাত উদাহরণ হয়ে আছে জনমুখে। আশপাশের মানুষজন তার দোকানে খাবার খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেকের সাথে তার ওঠাবসা। তাছাড়া মোহন মিয়াঁ ছেলে ভালো। খালু তাকে বেশ পছন্দ করেন। খালু নিজের আগ্রহে চারপাশে খোঁজখবর করছেন তার একটা কাজকামের। অল্প কিছুদিন পর তা মিলেও যায়। খালুর এক খদ্দেরের ইসলামপুরে থান কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে খালুর অনুরোধে মোহন মিয়াঁর মোটের ওপর ভালো বেতনের কাজ জুটে যায়।

কিন্তু সবকিছু যখন ভালোয় ভালোয় চলছিল তা’র অল্পকিছুকাল পরে, ঘটে এক বিপর্যয় ! ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমের মধ্যদুপুরে খালু কাজ থেকে কাহিল শরীরে বাসায় ফিরেন। শরীর অস্থির লাগছে বিধায় খানিকক্ষণ জিরিয়ে উঠোনের কুয়ায় গোসল করতে যান। কুয়োধারে সহসা বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। মাসখানেক বিছানা নেন এরপর পরপারে পাড়ি দেন।

খালুর বড়ো ছেলে তখন সবে কলেজ যাওয়া শুরু করেছে। মোহন মিয়াঁর সমবয়সী। বন্ধুর মতো সম্পর্ক তাঁদের। সংসারের হাল ধরতে তাকে পাড়ি দিতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। বাড়ির বড় ছেলে বিদেশে, সংসারের দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে মোহন মিয়াঁর ঘাড়ে। খালুর একমাত্র মেয়ে তখন সবে হাইস্কুল শুরু করেছে। মোহন মিয়ার দায়িত্ব তাকে স্কুল-এ পৌঁছে দেয়া। মোহন মিয়াঁ সাতসকালে উঠে তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজে কাজে চলে যান। এমনভাবে চলছিল দিনকাল। বছর না ঘুরতে মেয়েটা তিরতিরিয়ে তালগাছের মতো হাতেপায়ে বেড়ে ওঠে। মোহন মিয়াঁ অবশ্য তাকে নিজবোনের মতো দেখেন। সত্যি বলতে, মনে তখনকার ভাবনায় খালুর মেয়ের বিষয়ে তেমন কিছুই ছিলো না। তাছাড়া তার নিজের সংসারের পুরো- ভার মাথার উপর ঝেঁকে বসে আছে। বাবা গত হয়েছেন। বছর দুই ঘুরতে অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। খালুর মেয়ে মোহন মিয়াঁর প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। মোহন মিয়াঁ অবশ্য গোপনে প্রেমের ডুবসাঁতারে থাকলেও প্রকাশ করার সাহস করে ওঠে না। শেষতক অবশ্য ঝুঁটঝামেলা ছাড়াই পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়।

 

এক বর্ষার ভরা যৌবনের শ্রাবণে মোহন মিয়াঁর সাথে খালুর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়। দিনটির কথা এখনো সেই গতকালের সময়ের মতো আগাগোড়া স্পষ্ট মনে আছে তার। টানাসপ্তাহ ভরে দিনমান ঘোর বর্ষণ। আকাশ ভরা ছাই-রঙা ভারি মেঘ, গর্ভবতী গাভির মতো হেলেদুলে ঘুরে বেড়ায়। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। এমন ঘোর বাদলদিনে, ডিঙিনৌকায় জনাদশেক লোক নিয়ে বরযাত্রী রওনা করে বাড়ির কাছের নদী, ইছামতী ধরে। নৌকা ধলেশ্বরী নদীর বুকে পৌঁছতে ঘোলাজলের আকাশ সমান ঢেউ তেড়ে আসে। সারাদিন কাগজের নৌকার মতো ভেসেছুটে অবশেষে নাও ভিড়ে পুরানঢাকার সীমানায় বুড়িগঙ্গারপাড়ে, ভরসন্ধ্যাবেলায়। রাতে বিয়ের কাজ শেষে পরেরদিন ভোরসকালে বউ নিয়ে গাঁয়ে ফেরত আসেন। আহা! সময়!

বিয়ের পাঁচমাসের মাথায় পৌষের এক পইলভরা সকালে, ডাকপিয়ন এসে মোহন মিয়ার হাতে নীলখামের এক চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। সেই সকাল-বেলাটা ছিল অন্যরকম এক সকাল ! টলমল চোখে সকালটা আজও ভাসে। চিঠিতে তার দেশ ছাড়ার সংবাদ আসে। বাড়িসুদ্ধ লোক খুশির বানে ভাসে। শুধু বউয়ের চোখে সেদিন কষ্টেরজল আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো ঝরছিল। আচমকা এমন সংবাদে কষ্টটা তার নিজের বক্ষেও যে কম ছিলো তা কিন্তু না।

মোহন মিয়াঁ যখন দেশ ছাড়েন, ঘরে মাত্র পাঁচ কেজি চালের যোগান ছিল। ঘরে নতুন বউ। লজ্জায় তার মরে যেতে মন চাইছিল। পথচেয়ে তাকিয়ে থাকে মা-বাবা, ভাইবোন এবং বউটা। খুব কষ্ট নিয়ে দেশ ছাড়েন মোহন মিয়াঁ। মাত্র হাজার খানেক টাকা হাওলাতের জন্যে গাঁয়ের প্রায় সবার বাড়ি ধন্যা দিয়েও পাননি। কিন্তু যাকে নিয়ে তার ভয়টা সবচেয়ে বেশি ছিল, সে বউ, অতোটুকু মেয়ে সমস্তটা একহাতে সামলে নিয়েছিল। সংসারটা দেখতে দেখতে তার হাতে পড়ে স্বর্গ হয়ে ওঠে। তবে সে সংসারের সংস্পর্শে লম্বা সময় ধরে বাস করার ভাগ্য হয় নাই, মোহন মিয়ার। চার পাঁচ বছর পরপর ছুটিছাটায় খুব কম সময়ের জন্যে আসা হত দেশে। কুটুমের মতো অল্পকটা দিন বাড়ি থেকে,  ফিরে যেতে হোত। বউটা গাধার মতো খাটতো সংসারটাকে ভারসাম্যে রাখতে, এখনো এ বয়সে এসেও ঠিক আগেও মতো করে খেটে চলেছে।

এরপর অনেক বছর এভাবেই কেটে যায়। মোহন মিয়াঁ মরুর দেশে দিনরাত স্বপ্ন দেখত, একদিন এমন ভরা সংসারে সে ফিরে আসবে। কিন্তু সময় করে আর ফেরা হয় নাই। সময়ের ফেরে বাবা-মা চলে গেছে পরপারে। শেষসময়ে দেখার সুযোগটুকু হয়নি। বোন দুটোকে বিয়ে দিয়েছেন। ভাইদের দেশ বিদেশে চলার মতো অবস্থা করে দিয়েছেন। তারা তাদের সংসার নিয়ে এখন ভীষণ  ব্যস্ত ! যেমন ব্যস্ত একসময় তিনি নিজে ছিলেন। তবে তার ব্যস্ততার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।

 

মোহন মিয়াঁ পাকের ঘরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। ভাতের হাঁড়ির মাড় কাটতে ঠেকা দেয়া হয়ে গেছে টাও বেশ আগে।। গরম ফেনের সুবাস হাওয়ায় ভেসে পুরোবাড়িজুড়ে বইছে। মসুর ডালে চলছে পাঁচমিশালির ফোঁড়ন। মৌরীর গন্ধটা নাকে এসে লাগছে। জোড়া- চুলার একপাশে বসেছে ডালের বড়িতে ভাঁজা কই মাছের ঝোল। সরষে বাটায় ইলিশের পাতুরির আয়োজনও চলছে। এসবই মোহন মিয়াঁর পছন্দের খাবার। বউটা বেছে বেছে তাঁর পছন্দের খাবার রান্না করে। এবয়সে এসে, এসব খাবার এখন আর পেট নিতে ইচ্ছুক নয়। অবহেলিত খাবারে অভ্যস্ত, দুঃসহ পরিশ্রমী শরীরটা আসলে এসব খাবারের স্বাদ ভুলেই গেছে। ইলিশমাছের পেটির টুকরোগুলোতে তেলমসলা মেখে, বউটা লাউয়ের মাচায় কচি লাউপাতা তুলতে আসে। মোহন মিয়াঁকে গোসলের তাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু মোহন মিয়াঁ স্থির হয়ে বসে থাকে। তাঁর স্মৃতি তাঁকে তাড়িত করে বহুদিন আগের মায়ের সেই সময়ের রান্নঘরে…

সপ্তাহভর ডালভাতে দিন চলে গেলেও শনিবারে বাড়িতে একটা উৎসবের আমেজ বয়ে যেত। শনিবার হাটবার- সারাসপ্তাহে তাঁতে-বোনা লুঙ্গি বেচাবিক্রির দিন। বাবা, সাতসকালে লুঙ্গির গাটটি মাথায় বয়ে হাঁটের দিকে রওনা দিতেন। আগেভাগে বাড়ি ফেরার মতলবে। কিন্তু বাবার ফেরা হতো ভরসন্ধ্যায়, নয়তো তারও পরে; পুবহাটির মসজিদে এশার আযানেরও পরে। আমাদের হয়তো সেই সাতসকালে পেটে পান্তা আর গতকালের বেঁচে যাওয়া ডাল-ঝোলের মিশ্রন পড়েছিল। পেটে ততক্ষণে ভুভু বাঁশি বাজতে শুরু করত বৈকি! তারপরও বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষার সে সময়টা ছিলো আমাদের জন্যে পুরোটাই কঠিন আনন্দের।

সন্ধ্যা নামতে মা বাইর-বাড়ি থেকে খড়কুটো জড়ো করতেন উঠোনের ডালিমগাছটার কাছঘেঁষা মাটির দু’আকার ( চুলার) পাড়ে। বাবা ফিরতেন গালভরা হাসি নিয়ে। হাতেধরা শেষ-বাজারের চোখ বসে যাওয়া জোড়াইলিশ। লুঙ্গি বেচা হয়ে গেছে সেই ভরদুপুরে কিন্তু ইলিশ সস্তায় মিলবে শেষ বাজারে। বাবা মাছের বাজারের কাঁছঘেঁষা চায়ের দোকানটায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতেন। অপেক্ষার যেন শেষ হোত না। বগলের নীচে ভাঁজে রাখা প্লাস্টিকের আঁশটে গন্ধের মাছের ব্যাগটা বারকয়েক ভাঁজ ভেঙ্গে খুলতেন আবার যত্ন করে ভাঁজ করে বগলে আঁকড়ে ধরে রাখতেন। কান বিছিয়ে রাখতেন মাছের বাজারের দরদামের আলাপে।

শেষবেলায় হাঁট ভাঙ্গতে শুরু করলে, মাছেরবাজারে মানুষের ভিড় কমতে শুরু করত। শেষসময়ে অল্পদামে মাছ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া জেলেদের উপায়ন্ত থাকত না। বাবা ঠিক তখন ঝোপ বুঝে মাছের বাজারে ঢুকে পড়তেন। ততোক্ষণে অবশ্য সেরা এবং তরতাজা মাছগুলো চলে গেছে অন্যেদের ঝুলিতে। তারপরও বাবা নিপুণ হাতে মাছের পেট টিপেটিপে একজোড়া মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। মা চট জলদি মাছ কুটাবাছায় বসে যেতেন। বাবার ডিমওয়ালা মাছ খুব পছন্দ ছিল। মা, মাছের পেটে ডিম দেখলে গলা চড়িয়ে হাঁ হুতাশের কাব্য খুলে বসতেন। আমরা মনোযোগ দিয়ে মায়ের সেসব গল্প শুনতাম। মাছের পেটের ডিম মাছের আসল স্বাদ নষ্ট করে দেয়। মাছের মা, শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়ে ডিমে ভরে রাখে। যাতে বাচ্চাগুলো পরিপুষ্ট হতে পারে, সেজন্য মাছের গায়ে স্বাদ থাকে না। কিন্তু বাবা সে কথায় কান তুলতেন না। দু’চুলার একপাশে মোটা চালের ভাতের বলক ভুতভুত করে ফুলে ফেঁপে ওঠত আরেকপাশে লম্বা ফালি করে কাটা কচু আর মিষ্টি কুমড়োয় ইলিশ মাছের ঝোল। মা ভাতের বলকের ওপর বসিয়ে দিতেন বাবার জন্য দু’টুকরো সরষে ইলিশে- পাতুরি। বাবার ইলিশ মাছের পাতুরি বড় পছন্দ। সবগুলো ভাইবোন চুলার চারপাশে নিঃশব্দে বসে থাকতো, রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।

 

বউ’র রান্না শেষ হলে বাকি গোছগাছের কাজটা কাজের মেয়েটা করে দেয়। ছেলের বউরা যার যার বাচ্চাদের জন্যে খাবার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। এ সময়ে মেজাজমর্জি ভালো থাকলে বউটা মোহন মিয়াঁর পাশে এসে খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নেয়। এরপর বাড়ির পাশের পুকুরে গোসলে যায়। ফাঁক ফোকরে দু’চারখানা সংসারের টুকটাক জরুরি আলাপ পাড়ে মোহন মিয়াঁর কাঁছে।

বড় ছেলেটা আর বিদেশ করতে চায় না, ছোট ছেলে নিজের নামে জমি রাখতে চায়, মেয়ের জামাইদের চাওয়া-পাওয়া এসব টুকিটাকি সংসারের স্বাভাবিক আলাপ। এসব বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কোনো মতামত দিতে যান না। তার জীবন কেটেছে মধ্যপ্রাচ্যের গাধাদের সাথে। সারাদিন তপ্ত রোদের আঁচে পুড়ে ভেড়া, গাধাদের মাঠে চড়িয়েছেন। গাধাদের চড়াতে মগজের জোর লাগে নাই, গতর খেটে করেছেন। সে হিসেবে সংসার, সম্পত্তি, বিষয়আশয় এসব কূট বিষয়ে তার বুদ্ধি এ বয়সে এসে আর কাজ করার কথা নয়।

কঠোর পরিশ্রম করেছন,অঢেল টাকা দেশে বাপ-ভাইয়ের কাঁছে পাঠিয়েছেন তারও পরে বউ’য়ের কাঁছে। তারাই তাদের ইচ্ছে মতো খরচ করেছে। কখনো কেউ মোহন মিয়াঁর মতামত জানতে চায় নাই। অবশ্য এখন যে বলছেন সেটা মতামত চাইতে নয়, বউ জানে সেটা দেবার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। শুধু মানুষটার কাঁছে বলার জন্যে বলা; যেমন নিজের সাথে নিজে সারাক্ষণ কথা বলেন, তেমন বলা। বউটার অবশ্য তাতে তিনি কোনো দোষ দেন না। বউটার পাশে জীবনে কেউ ছিল না। তাঁর কথা শুনার, তাঁর জন্যে ভাবার কোনো লোক ছিল না। মোহন মিয়াঁ নিজেও কখনো তাঁর পাশে থাকতে পারেননি। তাঁর অবলম্বন হতে পারার মতো সুযোগ ছিল না। মোহন মিয়াঁর পোড়া কপাল, বউটারও। তিনি নিজেও এক সময় কতো কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ধু ধু মরুর বুকে গাধার বহর ছাড়া একটা কাকপক্ষীও ছিল না। বউটার অবশ্য আশেপাশে মানুষের অভাব ছিলো না কিন্তু নিজের কথাগুলো বলার মতো একটা মানুষও কি ছিলো ! আজও যে আছে তাও হলফ করে বলার জো নাই। মোহন মিয়াঁ  তাঁর কাঁছে এতবছর পর ফিরে এসেছে ঠিকই কিন্তু কূটকৌশলের এই সংসারের সম্পূর্ণ বেমানান হয়ে।

 

মোহন মিয়াঁ ছুটিতে দেশে ফিরতেন, তাও বেশ ফাঁরাক সময়ে। পাঁচসাত বছর পর পর। একবার হোল কী, নিজের বড়ো মেয়েকেই ঠিকঠাক চিনতে ভুল করলেন।

রেখে গেলেন হাতাকাটা ফ্রক পরা। পরের বারে এসে দেখেন গায়েগতরে বেড়েঝেরে মেয়ে লম্বায় মায়ের উপরে চলে গেছে। তারপর সে মেয়ের বিয়ে হয়, ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়। পরিবারের কোনো দরকারি আয়োজনে মোহন মিয়াঁর উপস্থিত থাকা হয় নাই। মেয়ের জামাইদের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাত হয়- মরুর দেশে। তিনি দু’জামাইকে নিজের কাঁছে নিয়ে বিয়ের প্রথম শর্ত পূরণ করেন। ছেলেদের পড়াশুনার জন্য যদ্দুর করার করেছেন। ওরা ভালো করতে পারে নাই। ভালো করতে গেলে একটা অভাব থাকতে হয় তিনি সেই অভাবটা তাদের দিতে পারেন নাই। এখন যখন ভাবনাগুলো মাথায় এসে ছটফট করে, বুঝতে পারেন,- দোষটা আসলে তার নিজের। ছেলেরা পড়ার মধ্যিখানে ঘোষণা দেয়, দেশ ছেড়ে বিদেশ যাবে। বড় বিদেশ ! বাবার মতো ছোট দেশে যেয়ে গাধা চড়ানো তাদের পোষাবে না। তারা পৃথিবীর নামকরা দেশে যাবে। অবশ্য তারা বড় দেশে যেতে পারেনি। ওসব দেশে যেতে শুধু বাবার-টাকা নয়, নিজের যোগ্যতাও যে লাগে ! যোগ্যতা বাবার- টাকা ক্ষয়ে কেনা সম্ভব হয় না।

 

বিয়ের বয়সের আগেই তারা বিয়েশাদির পাঠ চুকিয়েছে। ধুমধাম,খরচপাতি করে বিয়ে করেছে। যতটা দরকার ছিলো না তারচেয়ে বেশিই করেছে। মায়ের কথার বাইরে যেয়ে ছেলেরা খরচ করেছে। মোহন মিয়াঁকে ধারদেনা করে টাকার যোগান দিতে হয়েছে। ধারদেনা অবশ্য মোহন মিয়াঁ নতুন করেন নাই, বহুবার করেছেন। ভাইদের ব্যবসার টাকা যোগাতে, বোনদের বিয়ের সময়, ছোট বাড়িতে ভাইদের আলাদা সংসারের সংকুলান হয় না বলে নতুন বাড়ির জায়গা কিনতে…  এরকম বহুবার ধারদেনায় ডুবেছেন।

বিয়ের পরপর ছুটিতে দেশে না ফিরে বাড়তি কাজ করে গেছেন, ধারকর্জ শোধ করতে। পরিবারের সবার খুব দরকার মিটিয়েছেন নিজেকে অ-দরকারিতে রেখে। বউটা একসময় চোখের পানি ফেলত। তাকে দেশে ফিরে আসতে কতো কাতরোক্তি করেছে ! মোহন মিয়াঁ বুকে পাথর বেঁধে সেসব সয়ে গেছেন।

 

বেশ কবছর পর অল্পকদিনের ছুটিতে দেশে আসতেন। ফেরত যাওয়ার কালে বউকে কথা দিতেন- “এরপরের-বার সব হিসেবনিকেশ চুকিয়ে চিরদিনের তরে দেশে চলে আসবেন”। অবশ্য দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছরেও মোহন মিয়াঁর বিদেশ ছেড়ে দেশে স্থিতু হওয়ার সময় হয় নাই। যখন সব ছেড়েছুঁড়ে চলে আসতে প্রস্তুত হতেন, দেশে তখন বাড়তি টাকা লাগত। ভাইয়ের ব্যবসা, বোনের বিয়ে, জমি কেনা এরকম হাজারো জরুরি বিষয় তাকে আটকে দিত। “বাবা বলতেন, এখন এসে কাজ নেই” বাকিরাও একই কথা বলত। শুধু বউটা ঢুকরে কেঁদে ওঠত।

এরপর প্রয়োজনের ফর্দ দিনে দিনে বেড়েছে বৈ কমেনি। ছেলে-মেয়েরা বেড়ে ওঠে। তাদের আবদার হয় আকাশচুম্বী। এসব মিটিয়ে পেছন ফেরার সময়টুকু মিলেনি। অবশ্য সবার চাওয়াগুলো পরিপূর্ণ করতে পেরেছেন, তাও- বা কম কীসে।

তবে ইদানীং মোহন মিয়াঁর বড়ো আফসোস হয়। নিজের জন্যে যতোটুকু, বউটা’র জন্যে তারও সহস্র গুণ বেশি। বউটার সামনে মাথা সোজা করে তাকাতে লজ্জা হয়। বউটা ঢের বদলে গেছে। একসময় খুব আপন করে চাইত তাকে। প্রতি সপ্তাহে লম্বা চওড়া একটা চিঠি পেতেন বউয়ের গুটিগুটি হাতের লেখায়। যেদিন চিঠি হাতে পেতেন মনে হতো যেন মরুর বুকে সুখের অঝর ধারার বর্ষণ বয়ে গেল। চিঠিতে দুজনের স্বপ্নগুলো ঠাঁসা করে বোনা থাকত। স্বপ্ন বুনে রাখত বউটা তাঁর শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁয়ায়। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নরা ঝরে গেছে। মোহন মিয়াঁ তপ্ত বালুর নীচে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা সেসব স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন সময়ের ফেরে। বহুদিন পর সব হারিয়ে বসে বসে ভাবনাগুলোর জাবর কাটেন। মাঝে মাঝে মনে হয়- এবয়সে দেশে ফেরা মস্ত বড়ো ভুল হয়েছে। জীবনের বাকিকটা দিন ওদেশে কাটিয়ে দিলে অন্তত দেশের মানুষগুলোর কাঁছ থেকে বাঁচা যেত। বয়েস ষাটের ঘরে কিন্তু তার সময় স্থির হয়ে আছে সেই চল্লিশ বছর আগের সময়ে। সবাই যেমন তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না, তিনি নিজেও তাদের সাথে মন খুলে মিশতে পারেন না। নিজে- বউ’য়ের সাথেও মন ভাগ করা কঠিন হয়ে ওঠে। সবাই কেমন বদলে গেছে কিন্তু নিজের স্বপ্ন ভাবনাগুলো সেই প্রথম বিদেশ যাত্রার সময়ে স্থির হয়ে আছে।

মোহন মিয়াঁ ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকেন। দুপুর গড়িয়ে সময় বিকেলে ঠেকে। বউটা দু’দুবার তাগাদা দিয়ে গেছে। আর ডাকবে বলে মনে হয় না। অতিরিক্ত কাজে বউটা তাঁর শরীর- মন দুটোই ক্ষয়ে ফেলেছে। গাঁটের ব্যথায় বেচারা কাহিল। মেজাজ অতিরিক্ত খিটখিটে। ক্ষণেক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলে।

মোহন মিয়াঁর নিজের শরীরের অবস্থা আরো বেগতিক। অবশ্য সে কাহিনী কাকপক্ষীও জানতে পারেনি। প্রায় চল্লিশ বছর মরুভূমিতে একটানা একই কাজ করে গেছেন। ধীরে ধীরে শরীরে নানা রোগ ব্যামো বাসা বেঁধেছে। নিজের রোগশোকের খোঁজ করেন নাই। শরীরের ওপর জুলুম করে গতরে খেটে গেছেন। শেষের দিকে শরীর আর পেরে ওঠছিল না। বাধ্য হয়ে ডা.কাঁছে যেতে হয়। ডা.তাকে পূর্ণ বিশ্রামে পাঠান। মালিক পক্ষ তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। এবং তিনি দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হোন।

“কবে ফিরে যাবে?” এমন প্রশ্ন ঘর-বাইর দু’জায়গা থেকে প্রতিদিন বহুবার তাকে শুনতে হয়। তার যাওয়ার যোগার থাকলে আজই সে ফিরে যেত। বড়ো কষ্ট হয়। মানুষ যেন ভুলেই যায়, মোহন মিয়াঁ এগাঁয়ের ছেলে। গাঁয়ের ছেলে, গাঁয়ে ফিরবে- অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আসল সত্য তা নয়। একবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে, ঘরও তাকে আর আপন করে ফিরে পেতে চায় না। তিনি দেশে ফেরত এসেছেন, সারাজীবনের স্বপ্নগুলোকে শক্ত গিঁটে বেঁধে নিয়ে কিন্তু বাস্তবতা হোল- সময়ের ফেরে সেসব অলীক মিথ্যেয় ঠাঁই নিয়েছে।

অবশ্য এসত্য টের পেতে তার তেমন সময় ক্ষেপণ হয়নি। যেদিন দেশে ফিরেছেন, সবার অগোচরে বউটা তাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে- “ কবে ফিরে যাবেন”!

প্রশ্ন শুনে মোহন মিয়াঁ দিশেহারা হয়ে পড়েন। কার কাছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তার ফিরে আসা ! তিনি মুমূর্ষু চোখের মতো অসহায় চোখে বউ’টার দিকে তাকিয়ে থাকেন।