You are currently viewing বসনিয়ার কবি গোরান সিমিক এর কবিতা || বাঙলায়ন: মঈনুস সুলতান

বসনিয়ার কবি গোরান সিমিক এর কবিতা || বাঙলায়ন: মঈনুস সুলতান

বসনিয়ার কবি গোরান সিমিক এর কবিতা

বাঙলায়ন: মঈনুস সুলতান

কবি পরিচিতি: কবি গোরান সিমিক এর জন্ম ১৯৫২ সালে তৎকালীন যুগশ্লাভিয়ায়। কবিতা ও ছোটগল্প মিলিয়ে মোট বিশটি গ্রন্থের প্রণেতা এ কবি হালফিল বিবেচিত হচ্ছেন বসনিয়া ও হার্জেগোবিনার প্রধান সাহিত্যজন হিসাবে। ১৯৯২-১৯৯৫ জুড়ে ওই ভূখন্ডের যুদ্ধবিগ্রহে, সারায়েবো নগরী অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে পরিবার পরিজনের সঙ্গে কবিও শিকার হন প্রতিকূল পরিস্থিতির। এক পর্যায়ে কানাডায় অভিবাসী হলে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পান। পরবাসে ছয় বছর কাটিয়ে কবি ফিরে আসেন যুদ্ধোত্তর স্বদেশে। উপস্থাপিত কবিতা দুটি চয়ন করা হয়েছে তাঁর ‘ নিউ এন্ড সিলেক্টেড সোরোজ’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থ থেকে।

 

পিতা ও মৌমাছি

ইদানিং নিশ্চিত হয়েছি যে— যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে আমার পিতা শিখেননি কিছুই।
এমনি কী মৌমাছি বিষয়েও তাঁর তেমন কোন ধারনা ছিল না,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে—
ঘরসংসার পরিবার পরিজন ও তাঁর স্বাদের মৌচাক তাবৎ কিছু ছেড়েছুড়ে
সামরিক উর্দি গায়ে চাপিয়ে তিনি চলে যান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।
অযত্নে মৌমাছিগুলো যখন খেপে গিয়ে পাড়ার শিশুদের আক্রমণ করতে শুরু করে,
স্থানীয় মানুষজন পাড়াপড়শীরা ধোঁয়ার ধুনি জ্বালিয়ে বাধ্য হয় তাদের শ্বাসরুদ্ধ করতে।

যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন
এমন কী সংবাদপত্র পড়াটুকুও বাদ দেন,
আজকাল কতৃপক্ষকে গালিগালাজও করেন না তেমন—
কেউ রাজনীতি নিয়ে কিছু বলতে শুরু করলে
তিনি দ্রুত ত্যাগ করেন সে স্থান।
তবে আমাকে এক শিশি মধু পাঠিয়েছিলেন
যা আমি এখন অব্দি খুলেও দেখিনি ।

আমাদের পুরানো বসতবাড়ি থেকে মা্ত্র ১০ কিলোমিটার দূরে
কবর দেয়া হয়েছে ৪০০০ হাজার নিহত মানুষকে।
শুনেছি — পঁচাগলা লাশের গন্ধে বাতাস এতো ভারী হয়ে থাকে যে,
হালফিল কেউ আর প্রান্তরের তরুবরে ফুটে থাকা ফুলের গন্ধ শোঁকার সুযোগ পায় না।
গ্রীষ্মের দাবদাহে বিষ্ফোরিত হয় লাশের শূন্য পাকস্থলি
তুমুল শব্দে কেউ আর ঘুমাতে পারে না।

এসবের কিছুই জানেন না আমার পিতা
জানতেও চান না তিনি,
তাঁর আগ্রহ শুধু মৌমাছি পালনে
আর মাঝেমধ্যে শিশিভর্তি মধু পাঠানোতে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ঘেঁটে আমি জেনেছি
কত দূরে উড়ে যেতে সক্ষম মৌমাছি—
তারা কী দুর্গন্ধ এড়াতে উড়ে যায় দূর থেকে সুদূরে?

ভাবতে ভাবতে আমি কেঁদে ফেলি অবশেষে
কেন বাবার পাঠানো মধুভর্তি শিশিগুলো খুলতে আমি নিষেধ করি,
এ বিষয়টা আমি আমার ছেলেমেয়েদের ব্যাখ্যা করেও বলতে পারি না।
তিনি যুগপৎ যোদ্ধা ও মৌমাছি পালক,
কিন্তু কখনো শিখেননি লড়াই এর কলাকৌশল
এবং মৌমাছির লালনপালনও থেকে গেছে তাঁর অজ্ঞাত।

 

অভিবাসনের নীল দংশন

দুঃখিত, মা-জননী— সত্যি দুঃখিত আমি
পায়ে হেঁটে যেদিন পৌঁচেছিলাম সীমান্তে—
ঠিক ওই দিন মৃত্যু হয়েছে আমার,
কিন্তু এ বিষয়টা তোমাকে বলার মতো বুকের পাটা আমার ছিলো না।

আমার যথাসর্বস্ব—
এমন কী যে পতাকায় মোড়া হয়ে অমি জন্মেছিলাম,
তাও কেড়ে নিয়েছিল তারা।
শুক্লবিভাগের ঘোষাণাপত্রে লিখতে হয়নি যে সব বিষয়
যেমন কষ্ট, স্মৃতি ও বেদনা— এ সব ছাড়া
আমার থলেতে সহায়সম্পত্তি যা ছিলো সব কেড়ে নিয়েছিল তারা।
আমার অভ্যন্তরে বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র স্বত্ত্বার মৃত্যুর পর
তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারো— মা— ইঁদুর হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট।

আমি নিঃসঙ্গ, দারুণভাবে নিঃসঙ্গ আমি— মা,
বড়দিনের বাজারে বন্ধ হওয়া খেলনার দোকানে
ভুলক্রমে জানালার পাশে আটকে পড়া বালকটির মতো আমি একাকী,
আয়নায় আচেনা মুখের ছায়ার মতো মতো একাকী।
শুধু প্রতিবেশীর বিড়ালটি শান্ত চোখে নজর করে
কী রকম নীরবে দরোজা বন্ধ করে আমি চলে যাই পাড়ার পানশালায়
খানিকটা সময় হাসিমুখে সামান্য হইহুল্লোড়ের জন্য
আর যখন ফিরে আসি—
বিড়ালটি নিশ্চয়ই জানে কি রকম জোরে বন্ধ করি কপাট।

*********************************

 মঈনুস সুলতান

    কবি ও অনুবাদক

*************************************