You are currently viewing বর্ষশেষের কবিতা

বর্ষশেষের কবিতা

বর্ষশেষের কবিতা

দালান জাহান-এর কবিতা

বাজারি সন্ন্যাস

কতগুলো কালো দাঁত
হেঁটে বেড়াচ্ছে গ্রাম-শহরে
বন্যার জলে ভেসে-ভেসে ঘরে আসছে
উৎপ্রেক্ষা-অপেক্ষারা।
বাতাস বাড়ছে কেবলই বাতাস
সবুজ আপেল উড়ন্ত মানুষ
না ফেরার দেশে নামহারা পাখি।

চারদিকে দৌড় কেবলই দৌড়
বৃষ্টির রক্ত মাছেদের মা গাছের উৎসব
মৌলানা, পুরোহিত ঘাটের মাঝি
টংয়ের চা-অলা সুদখোর সন্তোষ!
শেষে করে শেষ পুনজন্মের নতুন গণিত।

বাতাস বাড়ছে কেবলই বাতাস
চার খণ্ড আকাশ মাথায় নিয়ে
তবুও কার আশায় বসে আছে
ভাগফলে ভাগশেষ করা বাজারি সন্ন্যাস।

কয়েনের কুকুর 

ধ্বংসস্তুপের এক হাত উপরে

ভেসে বেড়ায় কালো কালো আত্মারা

রোজ রাতে তারা জেগে উঠে সকালে

এবং পাপের গন্ধ বিলিয়ে

মিলিয়ে যায় ছায়াতলে।

 

অতীতের ক্রোধ থেকে কয়েনের কুকুর

কানে-কানে পাঠ করে যায়

প্রাক্তন মুদ্রার মরিচা পড়া মুখ।

 

সবকিছু দিয়ে মৃত্যু নিয়ে ঘরে ফিরে

শতাব্দীর ঠোঁটে বিষ দেওয়া বেড়াল

প্রশ্নের বাঁকা জাহাজ যাত্রা করে

প্রতিশোধ প্রবণ ভবিষ্যতে।

 

পুনশ্চঃ অনুসরণবিদ্যায় মগ্ন মোমবাতি

কারও কারও ভাগ্যরেখায় লেখা থাকে

পুনর্জন্মের নব ইতিহাস।

 

কো উন-এর কবিতা

ভাষান্তরঃ রফিক জিবরান

পথ জিজ্ঞাসা

তোমার মত বোকারা প্রশ্ন করে ঈশ্বর কী,

এর চেয়ে বরং জানতে পারো জীবন কী।

একটা আশ্রয় খুঁজে নাও যেখানে লেবু গাছ জন্মে,

খুঁজে দেখো পান করার উপযুক্ত স্থান,

খুঁজে দেখো পানাহারী বন্ধুদের।

জেনে নাও লেবু গাছটিকেও—

আর চালিয়ে যাও এই জানা—  যতক্ষণ না কিছু অবশিষ্ট থাকে।

Asking the way থেকে ভাষান্তর।

তাকলামাকান মরুভূমি

আমি কেন চলেছি তাকলামাকান মরুভূমির পথে: সেখানে রয়েছে শূন্যতা।

আমি কেন চলেছি পৃথিবী পেছনে ফেলে এই পঁচাশি বছর বয়সে তাকলামাকান মরুভূমিতে:

সেখানে রয়েছে নির্জনতার কান্না।

 

আমি কেন চলেছি তাকলামাকান মরুভূমির দিকে:

কেননা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা

পৃথিবীর লোভ এবং আমারও।

 

ওখানে, তাকলামাকান মরুতে রয়েছে

সহস্র বছরের করোটির নিরবতা।

Taklamakan Desert থেকে ভাষান্তর।

কান

 

কেউ একজন আসছে

অন্য দুনিয়া থেকে।

 

রাতের বৃষ্টির ধ্বনি।

কেউ সেখানে যাচ্ছে এখন,

দুজনে মিলবে দুজনার সাথেই;  নিশ্চিত।

 

ইংরেজি Ear থেকে ভাষান্তর।

হীরক গুহা

এ এক মস্ত স্বস্তি,

তোমাকে একসাথে সর্বত্র থাকতে হয় না।

আজ এখানের হীরক গুহায়

বাস করার কোনো কারণই নেই।

এখানে থাকো এক বা দুদিন

এই দুনিয়ায়,

দেখো অন্য জগতেও  আলাদা মাধুরী ঝরে।

 

বাতাস বয়ে যায়,

মুক্তারা যেমন সমুদ্রের বুকে জন্মে বেদনাদহনে

শামুকেরা বুকে পুষে রাখে তীব্র অন্ধকারে—

সেখানেও অনেক গভীরে বাতাস বয়ে যায়।

 

আমি যেতে চাই বহুদূরে আর ফিরে আসতেও চাই।

বাতাস বইছে যেন আমার পঁচাশি বছর বয়সে,

সম্ভবত সাতাশি হবে।

Diamond Cave থেকে ভাষান্তর।

শিরোনামহীন

মৃত্যুর পরে আমি কাঁদতে পারবো না হেতু

আমি কাঁদি যখন বেঁচে আছি।

 

আমি কাঁদি জোৎস্না রাতে,

আমার কান্নারা অরুদ্ধ ঝরে

ভোর না অবধি।

আমি কাঁদি যতক্ষণ না

প্রথম মোরগের আওয়াজ, দ্বিতীয় মোরগের আওয়াজ ভেসে আসে।

 

আমি কাঁদি ঘৃণ্য আনন্দে

অনুভব করি দীর্ঘসময় কান্নার পরে।

আমি কাঁদি

সূদুর ভবিষ্যতে বিপ্লব না হওয়া অবধি।

 

অল্প কিছু কবিতা পড়েই কবি কো উন এর কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ ও ভালবাসা। বর্তমান কবিতার দুনিয়া, বিশেষত কোরিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ ও  লড়াকু কবি। জন্ম পহেলা আগস্ট ১৯৩৩ সালে। একজন যাযাবর ও কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত কবি হান হা-উন  এর লেখা পড়ে তিনি কবিতার অনুরাগী হয়ে উঠেন। কোরিয়ার ভয়াবহ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এক পর্যায়ে বৌদ্ধ মঠে যোগ দেন  ও  আবার সেখান সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। গত শতকের সত্তুর  ও আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসকদের  বিরুদ্ধাচারণের ফলে একাধিকবার গ্রেফতার, নির্যাতন ও কারাভোগ। তাঁর কবিতাগুলি তীব্র ব্যঞ্জনাপূর্ণ, কখনো ছন্দোবদ্ধ আবার কখনো মুক্ত  ও কথ্যভঙ্গির ব্যবহার রয়েছে। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে কোরিয়া যুদ্ধে নিহতদের স্মরণ করে তিনি  বলেন, “আমি মৃতদের এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি এবং তাঁরা আমার মুখ দিয়ে কথা বলে”। বাংলা ভাষার তাঁর নির্বাচিত কবিতার সংকলন “খুলির নীরবতা” শীরোনামে প্রকাশিত হয়েছে, অনুবাদ করেছেন কবি ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ।

মূল কোরিয়া ভাষা কবিতাগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে সুজি কক কিম ও সুঞ্জা কক কিম,  চতুর্থটি  সানি ইয়ুং এবং শেষেরটি ব্রাদার এ্যান্থনি লি সাং-হা। —অনুবাদক।

আসমা সুলতানা শাপলা-এর কবিতা

নোঙর

 

রৈদের রঙ মরে

পাতিলের গরম ভাত পান্তা হয়

এমনে রুমালের বাঁসও হারায় একদিন

পাতা ঝইরা যাওনের দিন আইলে

গাছের কি সাধ্য সবুজের অঞ্চলে গিঁট দেয়!!

এইভাবে দিন যায় মন মরে

মন জাগে মন খোঁজে

অত সহজে কি মিলে নোঙর দেখা!!

 

কারো পাশ ফিরা শুইতে শুইতেই সূর্য ডুবনের কাল

কারো মোহর বিছরাইতে বেলা যায়

কারো বা সোনার মোহর অনচিনা হয় পাওনের পর

এমনে ফুরায়া যায় পহর পহর….

সামনেই সইন্ধ্যার অনচিনা ‍মুখের বয়ান

 

কিছু জাহির থাক কিছু বাতিনে

দাঁড়াইছিলাম শক্ত একগাছ

গাছের ছায়ায় দেখি অনচিনা পথিক

যারে চিনি কইয়া জানি মনে মনে

পথিক ছায়া নিছে অন্য গাছের

আমি নিজের ছায়াভাঙ্গি

কাজেই বলা যায় এইখানে একটা যুদ্ধ শুরু হইছিল

ছায়া ভাঙার যুদ্ধ।

 

বিষয়ের গাছ আমার আছিলোনা, এখনও নাই

তবু বাঁচি আর বাঁচাই নিজের আত্মা

আমার আছে – হারানো পরাণ, নদীর ইলিশ

রাই সরিষার ক্ষেত, পদ্মার ভাঙন কিবা যমুনার চর

আছে বান, বানের পানিতে পলি

তাতে ধানের সবুজ চারা কিষাণেরা রোয় নরোম মাটিত

চর দখলেও বাজে লাঠিয়ালের তাগত

আছে পুরানা পাপ, সকল কিছুতেই আছে

দুইশ বছরের গোলামীর চিন্।

 

কতবার তো ভাঙছি আর গড়ছি

ভাবতেছি, এইবেলা নয়া গড়ণের রোখে

নিজেরে ভাঙন যায় আর একবার

তাতে উইড়া যাবে কিছু উলুখাগড়া, যাক

কিছু বাসনার ভুলেভালে আসা মানুষ অথবা

কিছু মানুষী আসুক বা যাক কি আর তাতে।

 

গোলামির চিন্ মোছার বাসনায়

এইখানে আবার একটা যুদ্ধ শুরু হইতেই পারে

আইজ তার কিছু জাহির থাকুক

কিছুটা বাতিনে..

 

ফয়েজ আলম-এর কবিতা

সিনেমা দেখার আগে

সিনেমা দেখার আগে আমরা স্ক্রিপ্ট দেখি

পথে শাহবাগের মোড়ে একটু বসি চায়ের দোকানে

উঠতি বয়সের ছেলে ও মেয়েরা কে কারে চোখ মারে

আমরা মজা পাই

মৌসুমের আগেই আমরার ছেলেমেয়েরা সাবালক হইতেছে!

 

চাঅলারে কই ‘মামা’ তাতে কিছুটা সাম্যবাদ হইল

পায়ে পড়ে না তার মাথার ঘাম

শার্ট ভিজতেছে বলে ভাবা যায়

আহা এই শট কি দারুণ,

যত দূর যাইতে পারি মধ্যবিত্তের শিল্প কলা

ততদূর দাঁড়ায়া কই, ঠিক পথের প্যাঁচালের মত, দারুন দারুন!

নিদারুণ হইলো না কি!

রিক্সাঅলারে জিগান যাইতে পারে নিদারুণ তার জীবন

প্যাডেলের পাশ দিয়া অতঅত দামি গাড়ি

আসমান ছোঁয়া বিল্ডিংগুলার নিচ দিয়া

স্ক্রিপ্ট দেখা চলতেছে

 

মধুমালা নার্গিস সাবানের বাঁসে আমরা শেষে

উত্তেজিতই হয়া পড়তাছি মনে হয়

কাজেই এই সময় গুলির শব্দ মোড়ে মোড়ে,

বেশ যায়, যাইতেই পারে

সিনেমার শেষের দিকে কিছু কিছু মারামারি

কিছু গলাবাজি

যদিও এইখানে স্ক্রিপ্টের ভিতর কেমন সুনসান বোবা মানুষেরা।

 

আমরা সিনেমা দেখতেছি কিছু লাশ পড়তাছে

তাতে তলে পড়তেছে সাবানের বাঁস

সহবাসের বদলে হাতমারা শেষ।

কাইল সকালে অফিসের কামের ফাঁকে এইখানে

মধ্যবিত্তের একটা বিপ্লবই হয়া যাবে হয়তো।

 

রাইতের আগে আমি একটা গান

সন্ধ্যার তারাদের নিচে একটা গান বান্ধনের আগে ভাবি

দূরের তারার আভাস এইখানে থাকতে পারে

গতহওয়া রৈদের টকটকা রঙের মধ্যে

যাওয়া আসা করুক আগামী কাইল ও

তাহার পরের আরো যত দিন

 

হাতের কাছে জঙলার ঘাসফুল, কয়গোছা উজাউড়ির মৌজ

কিছুটা লাগলে ভালো

তোমার জানালায় আমরার না-ফোটা জোছনা

কতক উঠতেই পারে এইখানে রক্তিপুন্যির চানে

তাতে মোটামুটি একটা গড়পড়তা জীবন আঁকা যায়।

 

শেষে দেখি লেখছি নিজেরই ছায়া কিছু

তাতে আসরের ওয়াক্তের বিলাপই মূল রঙ

যেন লেখা হইছি আমি একটা দু:খের গান

সন্ধ্যার নিরাবেলি মনে।

 

 

শাইনি শিফা-এর কবিতা

চোরাবালি

পোড়াবালি

 

একটি নাম আর আমায় ডাকে না

হাঁকে না,

সকালে নয়, সন্ধ্যায়ও।

আত্মজার হাতকে তার হাত ভেবে

কেঁপে উঠি না।

গন্ধ পাই না সেই চুলের, গ্রীবার বা কপোলের।

 

সরীসৃপ ছিল সে।

এখন শুধুই খোলস।

 

দুজনের বসার গল্প শুনি আজকাল

তিনজনের নয়।

আড্ডায় তার নাম আসে না

সন্দেহতেও।

পেন্সিল

বা

বইপোকাতেও না।

 

ল্যাম্পপোষ্ট একা থাকে

একা ঘর

একা চেয়ার

একা ল্যাপটপ

ল্যাপটপের স্ক্রিন।

 

রাতজাগা নেই

অপেক্ষা নেই

প্রেম বা

দীর্ঘশ্বাস,

নেই রক্তচাপ

অথবা

ঢলে পরে যাওয়ার কোন খবর।

 

তার পায়ের নীচে মাটি ছিল, বালি ছিল

এখন অন্ধকার চোরাবালিতে ডুবে গেছে হয়তো।

 

পহেলা আষাঢ়

বাইরে রিনিঝিনি বৃষ্টির শব্দ

কখনো টুপটাপ,

মাতাল করা কদম, দোলনচাঁপা কিংবা স্পাইডারলিলি।

আমার  ডাইনিং এ ইলিশ আর খিচুরীর ঘ্রাণ….

এমনই তো কথা ছিল আজ।

 

কিন্তু

আমার শার্শিতে শুনি গুমড়ানো কান্নার শব্দ।

বেত্রাঘাত খাওয়া নিশ্চুপ ছাত্রের মত

ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি মাটির দিকে।

সেথা বৃষ্টির ফোঁটার সাথে দু’ফোঁটা নোনাজলও গিয়ে মেশে।

 

কদমফুলের শাড়িটা এবার আর পড়া হলো না।

শাড়িটার কথা মাথায় আসতেই একটা গোলাপি গাউনের কথা মনে পড়ে যায়।

গাউনের ঘ্রাণটাকে বড় নোংড়া মনেহয়।

দূরে কোথাও মেঘ গর্জন করে শাষিয়ে ওঠে।

জানালার কাঁচ ঝাপসা হয় ভারী নিঃশ্বাসে।

 

এমন দিনে —

তুমি হয়তো বসে আঁকছো

বৃষ্টিস্নাত কোন রমনীর কোমড়ের বাঁক

অথবা

সদ্য ঘোমটাখোলা কোনো তরুনীর বুকের তিল।

 

আজ আর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে ইচ্ছে করে না আমার

আমি নিজেই বৃষ্টি হয়ে গলে গলে পড়ি মাটির বুকে।