You are currently viewing বরফ নিঃসঙ্গতা – আশরাফ আহমেদ

বরফ নিঃসঙ্গতা – আশরাফ আহমেদ

কিয়োতোয় এসে সে বেশ অসুবিধায় পড়লো। বাঙালি তো নয়ই, বিদেশি ছাত্রের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কয়েকটি জাপানি শব্দ ও বাক্য শিখে নিয়েছে। ইকুরা দেসকা? – দাম কত? কুঁজো হয়ে যাওয়া পিঠ থেকে কাছিমের মত মাথাটি তুলে অশিতিপর বুড়ি বারোটি ডিমের দাম হাতে নিয়ে নানান শব্দে ‘ধন্যবাদ’ প্রকাশ করতে করতে শরীরটি ঝুঁকায়। ওর ভয় হয় কখন না বুড়ি উবুড় হয়ে পড়ে যায়। আরো শিখেছিলো ‘অমুক যায়গায় যেতে হলে কীভাবে গেলে ভালো হবে’? ল্যাবের লোকজনের সাথে ছোটখাট ইংরেজিতে কিছু ভাববিনিময় হয়, কিন্তু বিদেশিদের সাথে কথা বলতে ওরা সবাই বেশ লাজুক। তাই শিক্ষা বা গবেষণা-বিষয়ক প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া আর কোনো কথা হয় না। তারপর থেকে সারাদিন ও রাতের জন্য সে বোবা হয়ে থাকে। এভাবে থেকে থেকে ব্যথা না হলেও জিভ, গাল ও মুখের পেশীতে আড়ষ্টতা এসে ভর করে।

রাতের খাবার শেষ হয়েছে সেই কোন সন্ধ্যায়, বিকাল পাঁচটায়, এখন রাত দশটা। তার ওপর মুখমণ্ডলের জড়তা সারা দেহটিকে অবসন্ন করে রেখেছে। শেষ ট্রেনটি ছেড়ে যাবে আর আধাঘণ্টা পর। কাজেই ল্যাব বন্ধ করে হিগাশি-ওজি দোরি রাস্তা ধরে স্থানে স্থানে জমাট বরফ থেকে পা বাঁচিয়ে হাঁটা শুরু করে মোতো-তানাকা স্টেশনের দিকে। দিনের বেলায় রাস্তার ওপারে রেস্টুরেন্টের মাইক থেকে গান ভেসে আসে। ভাষা না বুঝলেও সুর থেকেই শ্রোতা ভাবটি অনুধাবন করতে পারে। ‘সুগারু কাইকিও’ নামে প্রাচীন এংকা গানটি গাইছে শিল্পী সায়ুরি ইশিকাওয়া। ‘এখন আমি একাই খেয়াযাত্রী, ভীষণ একা, প্রচণ্ড শীত, উড়তে থাকা গাংচিল দেখি; আমি কাঁদি, হে শান্ত সুগারু কাইকিও সাগর’!  গানটি শেষ করতে গিয়ে শিল্পী শরীর-মনের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে কণ্ঠে নিদারুণ আর্তনাদ তুলে গেয়ে চলে ‘বিদায় প্রিয়তম, আমার এখন যেতে হবে, আজকের এই হিমেল হাওয়া আমার বুকে কাঁপন ধরায়, চোখে পানি এনে দেয়’। হাঁটার সময় ঠক ঠক করে কাঁপতে কাপতে বাঙালি যুবকটি বুঝতে পারে না ওর চোখ থেকে ঝরতে থাকা পানির উৎপত্তি কোথায়!

আরেক সময় শোনা যায় তরুণ শিল্পী তাকাশি হোসোকাওয়া-র গাওয়া ‘কিতা সাকাবা’ নামে একটি জনপ্রিয় গান। ‘উত্তরের পানশালা-রাস্তায় লম্বা চুলের রমনী আছে…’।  তারপর সেই রমনীরা কীভাবে সঙ্গীহীন, দুঃখে নিমজ্জিত পুরুষের মর্মব্যথা বুঝতে পেরে ক্ষণিকের তরে হলেও আনন্দ দান করে, তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা। আচ্ছা জাপানী গীতিকার কি ভারতীয় মহাকবি কালীদাশের মেঘদূত কাব্যগাথাটি পড়েছিলো? অথবা জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন কবিতাটি? গানটি শিশুকাল থেকে দেখা শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রতিটি নারী চরিত্র প্রবাসী বাঙালি যুবকের সামনে একে একে এনে হাজির করে। ওর একাকীত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

কেইফুকু লাইনের দুই বা তিন বগীর ট্রেন, এতো রাতে যাত্রী সংখ্যা দশ পনেরো জনের বেশি থাকে না। মোটামুটি অন্ধকার লাইনের ওপর দিয়ে একই লয়ে বেজে চলেছে ঝকর ঝক, ঝকর ঝক শব্দ। মাঝে মাঝে রাস্তার বা উঁচু দালান থেকে উঁকি দেয়া উজ্জ্বল আলো কামরার ভেতরে ঝিমোতে থাকা যাত্রীর চোখকে অনিচ্ছায় খুলতে বাধ্য করে। চৌকোণা ফসলের ক্ষেতগুলো ধবধবে সাদা তুলোর মত বরফ দিয়ে ঢাকা, কিন্তু কালচে মাটির আইলগুলো ঠিকই দেখা যায়। মনে হয় একান্ত মনযোগের সাথে কোনো ধুনকর সাদা তুলো দিয়ে একই সাথে অনেকগুলো লেপ বা তোষক বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাঁধে চামড়ার ব্যগ ঝুলিয়ে একজন রোগামত কন্ডাক্টার ট্রেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাতায়ত করে। কিছুক্ষণ পরপর হাতে কাঁচির মত দেখতে ধাতব পাঞ্চকলটি দিয়ে ক্যাটক্যাট শব্দ করতে করতে উচ্চস্বরে ‘দয়া করে আপনার টিকেটটি একটু দেখান’ বলে বলে ট্রেনের একঘেয়েয়েমির গর্জনে বৈচিত্র্য আনে। ছায়ামা, ইচি-জোজি, শ্যুগাকুইন, তাকারাগাইকে, মিয়াকেহাচিমান এর পর শেষ স্টশনটি হচ্ছে ইয়াসে-ইউয়েন।

জংশন স্টেশন তাকারাগাইকে-র পর রাতের এই সময় প্রায়ই আর কোনো যাত্রী থাকে না। কণ্ডাক্টার সেই সুজোগে এসে ওর পাশে বসে। ওপর থেকে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘একাকী, তাই না?’

‘ইশ কী একাকী, তাই না?’

‘আত্মীয়বন্ধুদের জন্য মন খারাপ লাগে, তাই না?’

প্রথমদিকে জাপানী ভাষায় বলা কথাগুলোর অর্থ সে বুঝতো না। শুধু সোনায় বাঁধানো দুটি দাঁত থেকে ছড়ানো দ্যুতি যে হৃদ্যতা প্রকাশ করতো তা সে বুঝতে পারতো ঠিকই। বেশ ক’দিন লাগিয়ে এই অঞ্চলের ভাষাতে অভ্যস্ত হয়ে, অভিধান দেখে কথাগুলোর অর্থ বুঝেছিলো। উত্তরে সে কৃতজ্ঞতার হাসি উপহার দেয়। প্রতিবার ট্রেন থেকে নেমে যাবার সময় হাসিমুখে মাথা ও শরীর ঝাঁকিয়ে ‘শুভ রাত্রি’, ভালো থেকো কেমন?’ বলতে ভোলে না। রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুটি লাইন ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়, আধোখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়’ মনে পড়ার সাথে সাথে চোখের পাতা ভিজে আসে।

উচ্ছ্বল পাহাড়ি কামি-তাকানো নদীর গা ছুঁয়ে হিয়ে পর্বতের পাদদেশে ইয়াসে-ইউয়েন স্টেশনটি একটি গ্রীষ্মকালীন পর্যটন আকর্ষণ। কিন্তু শীতকালে বাংলাদেশ থেকে আসা ওর মত একমাত্র বিদেশি ছাত্রটি ছাড়া কোনো কাকপক্ষী ভুলেও এদিকে পা বাড়ায় না। ও আসে কারণ ওর মেসবাড়িটি এখানেই যে!  স্টেশন থেকে বেরোলেই খাড়া নদীটির অনেক ওপরে একটি ঝুলন্ত সেতু। সেটি পেরোলেই ডানের বাড়িটির নাম রিনসেংকিও। চারিদিকের নৈসর্গিক দৃশ্য অত্যন্ত মায়াবী! এই বাড়ি থেকেই পাহাড়, নদী, ও জলপ্রপাতের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকা যায়। ঝর্ণাটি সুউচ্চ পর্বতের গা বেয়ে নেমে আসার সময় অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষলতার বুনো গন্ধ ছড়িয়ে দেয় বাতাসে।

লম্বাটে কাঠ-সিমেন্টের তৈরী দোচালা বাড়ি, দুপাশে সারিবদ্ধ তিনটি তিনটি ছয়টি ঘর। একটি রান্নাঘর, খরস্রোতা নদীর ঠিক লাগোয়া। মেঝেতে খড়-জাতীয় তন্তুর তাতামি, দেয়ালে স্লাইড করে খোলা-বন্ধ করার কাঠের খাঁচে পাতলা কাগজের দরজা। ঘরে ঢুকেই সে টেপরেরকর্ডারের সুইচে টিপ দেয়। জাপানে পৌঁছার পর থেকে বাংলায় কথা বলতে সে মরে যাচ্ছিল। কে খবর দিল দূরের অমুক ছাত্রাবাসে একজন বাঙালি আছে। ছুটে গিয়েছিলো দেখা করতে। প্রাণখোলা মানুষ মতিন সাহেব ওর চেয়ে কয়েক বছরের বড়, অংকশাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণা করছেন, জাপানী বলতে ও পড়তে পারেন ভালোই। তিনিই নিজের কাছে থাকা কয়েকটি গান ও সুরের কপি করে দিয়েছিলেন। সুইচ অন করতে আজ বাজছে রবিশংকরের সিতার ও ইয়াহুদি ম্যানুহিন এর বেহালা যোগে ‘ইস্ট মিট ইস্ট’। কোতাতসুর নিচে পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সে শুনে যায় সেই সুরলহরি। ধ্যান করার মত বুঁদ হয়ে শোনে। ধীরে ধীরে সুরটি তুঙ্গে ওঠার সাথে সাথে সেতারের ঝংকার দমকে দমকে উঠে আসা বেহালার কান্নাকে উসকে দিতে থাকে। ওর চোখ থেকে পানি ঝরে। একাকীত্ব পেয়ে বসে ভীষণ ভাবে। ইশ মতিন সাহেব যদি কাছাকাছি থাকতো!

আবার এই একাকীত্বকে সে উপভোগও করে দারুণভাবে! এই শহরে আসার আগে সে সর্বদা আত্মীয়-বন্ধু-সহপাঠী-ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতো। নিজের জীবনের সাথে সবার কথা, সবার গল্প, সবার ইচ্ছা অনিচ্ছা মিশে একাকার হয়ে ওকে পূর্ণতা এনে দিত। সবাইকে হারিয়ে এখন সে নিজেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে। সংস্পর্শে আসা প্রতিটি চরিত্রকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখার চেষ্টা করে। গাছ পালা আকাশ নদী ও জীবনকে বোঝার চেষ্টা করে। লাইব্রেরি বা দোকান, যেখানে যে ইংরেজি বই পায় নিয়ে আসে। বিজ্ঞান ও দর্শনের সংঘাত, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-শিল্প ও সহজিয়া জীবনের সম্পর্ক, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ম পালনের উপকারিতা ও অপকারিতার ছোটবড় জট একটু একটু করে খুলতে শুরু করে। আগে ইগো বা আমিত্বকে জানার ও বোঝার কোনো সুযোগই পেতো না। কে কে ওর কথায় বা আচরণে আঘাত পেয়েছে তা চিন্তা করে আমিত্ব কে পরিহার করার প্রতিজ্ঞা করে। তাই সে নিজেকে এবং নিজের এই একাকীত্বকে ভীষণ ভালোও বাসে। এখানে ওর চিন্তার ভুবনে প্রতিবন্ধকতা বা প্রভাব বিস্তার করার কেউ নেই।

ল্যাবে একনাগাড়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটানোর পর হাত ও চোখমুখ জ্বালা করছিলো। রাতের শেষ ট্রেনটি ধরে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে হাঁটা শুরু করলে ঝুলন্ত সেতুটি ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দুলে দুলে আর্তনাদ করে উঠলো। আচ্ছা সেতুটিও কি আজ ওর মতোই ক্লান্ত? চোখের দুপাতা খুলে রাখা যাচ্ছে না, ঘরে ফিরেই লম্বা ঘুম দিতে হবে। কিন্তু এ কী? সে চোখ বন্ধ করতে পারছে না কেন? বন্ধ করলেই চোখ জ্বালা করে আসছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, কিন্তু কোনোমতেই চোখ বন্ধ করতে পারছে না।

বিছানা ছেড়ে কোতাতসু-র নিচে পা ছড়িয়ে বসলো। সারা জাপানে এই কোতাৎসুটিই ওর সবচেয়ে আপন! নিচু টেবিলের উল্টোপিঠে তাপ ছড়াতে ছড়াতে কোমল আলোটি ওপরের আদুরে বিভিন্ন রঙের স্ফীত লেপটিকে ভেদ করে যখন বেরিয়ে আসে তখন ঘরটিতে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন রঙের ছটার সেই আলো নিজ থেকেই বাড়ে আবার কমে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে তা উপভোগ করে। তখন সে তার একাকীত্বের কথা ভুলে যায়। ঘরের প্রতিটি বস্তু জীবন্ত হয়ে ওঠে, ওর সাথী হয়, কথা বলে। বইয়ের পাতার আচ্ছাদন আপনাতেই খুলে যায়, নিজেকে উজাড় করে দেয়! কিন্তু আজ বইয়ের পাতা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না, লুকোচুরি খেলছে।

চোখ দিয়ে জল পড়ছে অবিরত। দেশে মায়ের কথা মনে পড়ছে, বাবার কথা, ভাইবোনের কথা, ছাত্রছাত্রীর কথা। মাত্র এক বছর পড়ানো ক্লাশের প্রায় চল্লিশ জন ছাত্রছাত্রীর সবার সই সহ হাতে লেখা সুন্দর একটি কার্ড পাঠিয়েছে শুভকামনা করে, ওর ফেরার অপেক্ষা করছে জানিয়ে। মনে পড়ছে মেঝমামীর কথা। চলে আসার দিন টিফিনক্যারিয়ার ভর্তি রান্না করা মাছ ও মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন ও সাথে নিয়ে আসবে এই আশায়! অনেক পীড়াপীড়িতে শুকনা মিষ্টিটি শুধু সাথে এনেছিলো। বাক্স খুলে প্রতিদিন একটু একটু করে সেই স্নেহের আস্বাদন করে, শেষ করে না। আচ্ছা ওর কী প্রয়োজন ছিলো তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসার সাহচর্য ছেড়ে একাকী এই ভিন দেশে চলে আসার? হাত মোছার ছোট্ট তোয়ালেটি চোখের জলে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেলে বারবার চিপে চিপে পানি ফেলতে হয়।

মুখ-হাত জ্বালা, একাকীত্ব ও অশ্রুপাতের সাথে এলো জ্বর। পরদিন রোববার বলে কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো না। বাড়িওয়ালী থেকে খবর পেয়ে লক্ষী এসেছিলো বিকেলে। রমালক্ষী দিল্লীর মেয়ে, ভালো জাপানী জানে। মাসের তিন সপ্তাহ কাটায় টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক সপ্তাহ কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাঙালি যুবকটি কিয়োতোয় এসে কথা বলার লোক খুঁজছিলো। বিদেশি ছাত্র-অপিসের মিস ওহাসি লক্ষীর নম্বরটি দিয়েছিলো।  ইংরেজিতে এবং টেলিফোনে হলেও প্রায় কুড়িদিন পর কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরে কী যে খুশি হয়েছিলো! শ্যুগাকুইন স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই দেখতে পেয়েছিলো ফ্রক পড়া ভারতীয় চেহারার চশমা চোখে ছোটখাট এই মেয়েটিকে। লক্ষী ইংরেজদের প্রাচীন স্টাইলে দুহাতে ফ্রকটি কিছুটা ওপরে তুলে, একটি পা মাটি থেকে তুলে পেছন দিকে খানিক উঠিয়ে, কোমর থেকে শরীরটি কিঞ্চিত সামনে ঝুঁকিয়ে অভ্যর্থনা করার সময় চেহারায় যে লাগামহীন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলো, তা ওর উচ্ছ্বাস থেকে তো কোনো অংশে কম ছিলো না। জাপানী ভালো জানলেও বোঝা গেলো এই বিদেশ বিভুঁয়ে নিজের সংস্কৃতির কাছাকাছি আরেকজনকে পেয়ে সেও আত্মহারা হয়েছিলো। ডাউনটাউনের বেশ দামী এক ফরাসী রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিলো। একের পর এক মির্জা গালিব এবং হাফিজের উর্দূ শায়ের আবৃত্তি করে সেগুলোর অনুবাদ শুনিয়েছিলো। আজ শেষবারের মতো সে এলো গরম সুপ সাথে নিয়ে। বসে রইলো ওর সাথে কোতাৎসুর নিচে পা ছড়িয়ে। শোনালো গালিবের কবিতা। কিন্তু একাকীত্ব ওকে ছেড়ে গেলো না! চোখ জ্বালা করে ঠিকই।

সোমবার কে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। চোখের ডাক্তার। ব্যবহার ও চেহারা এতোই সুন্দর যে রোগীর চোখ এমনিতেই সুস্থ হয়ে ওঠার কথা! তার ওপর খুব কাছ থেকে চোখ পরীক্ষা করতে গেলে সুন্দরীর প্রতিটি নিঃশ্বাস ওর গালে ও ঠোঁটে এসে লাগলো; দুজনের নাক ও ঠোট পরস্পরকে স্পর্শই করলো যেন। কিন্তু হায়, কেউ কারো কোনো কথা বোঝে না! নিঃশব্দে ওর কপাল, নাক, চোখের পাতা ও থুতনিতে, এবং হাতের কনুই পর্যন্ত একটি মলম লাগিয়ে দিল। কাগজে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে লিখে বোঝালো, তুমি যে ল্যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউ-ভি লাইট নিয়ে গবেষণা করো তাতে তোমার চোখ, মুখমণ্ডল ও হাতে অসংখ্য যখম হয়েছে। কয়েকদিন এসব বন্ধ রাখার পর মুখোস ও দস্তানা পরে কাজ করো।

এমনিতেই কথা বলার কেউ নেই, ল্যাবে যাওয়া বন্ধ রাখলে সে তো মরেই যাবে!

সে একা। দরজা বা স্লাইডের ওপর কাচের জানালা ঠেলে খোলার সাথে সাথে পাহাড়ি নদীর বিরামহীন গর্জন ওর একাকীত্বকে আরো বিষন্ন করে তোলে। ধীর লয়ে পেজা তুলার মত বরফ পড়ে চলেছে দুদিন থেকে। চারিদিকে শুধু সাদা তুলতুলে আস্তরণ। প্রচণ্ড শীতে বাড়ির ছাদে জমা হওয়া সেই নরম আচ্ছাদন জমে গিয়ে শক্ত বরফ হয়েছে। সে দরজাটি আবার স্লাইড ঠেলে লাগিয়ে দিল। আবার সেই নিঃশব্দতা। সে বাইরে তাকিয়ে রইলো পাহাড়ি নদীর নাচন দেখতে। ভেতরে জ্বলতে থাকা কোতাতসুর কোমল তাপ কীভাবে ছাদের ওপর জমাট বাধা শক্ত বরফের গায়ে কোমল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আর তাতেই সেই পাষণ্ডের হৃদয় গলে গলে টুপ টুপ করে ছাদ থেকে পড়ছে সাদা বরফের মাঝে সৃষ্ট হওয়া কালো এক ছোট্ট কুয়ার মাঝে। সে মাঝে মাঝেই দরজাটি খুলে ফোঁটা ফোঁটা পানির শব্দটি শুনতে চেষ্টা করে। বরফ ও ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সে সাথে সাথেই দরজাটি আবার লাগিয়ে দেয়।

টেপ রেকর্ডারে দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে’ গানটি বেজে চলেছে। কে এসেছিলো? কখন এসেছেল? লক্ষী? বরফের গুচ্ছ? চোখের ডাক্তার? চঞ্চলা নদীর উচ্ছ্বলা স্রোত? মতিন সাহেব? ওর ছত্রছাত্রীদের কেউ? বন্ধু? মা? বাবা? মেঝমামী? ভাইবোনদের কেউ? নির্মলেন্দু গুণের মতে এটি কবিগুরুর একটি ‘ধুম্রজালিক উক্তি’। পরের একটি পংক্তি ‘তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল’…। গানের এই শব্দ কটির মাঝে সে ছাদ থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়া বরফ-গলা পানির শব্দটি অনুভবের চেষ্টা করে। প্রচণ্ড ও নিবিড় সেই অনুভুতি!

একদিকে খরশ্রোতা নদীর বিরতিহীন ঝরঝর গর্জন ও দৃশ্য, অন্যদিকে কোতাতসুর কোমল তাপে গলে যাওয়া বরফের টুপ টাপ শব্দ তুলে তুলে মাটিতে ফিরে আসা। তার সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দ ক’টি ওর একাকীত্বের সাথে মিলিয়ে গেলো সারা জীবনের মত। গানটি শুনলে এখনো ওর প্রতিটি দেহকোষে কামি-তাকানো নদীর গর্জন, হিয়ে পর্বত থেকে নেমে আসা শীর্ণ ঝর্ণাধারার নিক্কণ, বরফ গলা জলবিন্দুর শব্দ আছাড় খায়, নাকে প্রবেশ করে পাহাড়ের বৃক্ষরাজির বুনো গন্ধ।