You are currently viewing বদরুজ্জামান আলমগীরের গুচ্ছ কবিতা

বদরুজ্জামান আলমগীরের গুচ্ছ কবিতা

বদরুজ্জামান আলমগীর

 

দেহগ্রাম

চোখের জলে প্রাণের পাপড়ি মিশানো থাকে, তাই কেমন ওম ওম লাগে, চোখের পানি সমুদ্রের আদিবাসী- তাই স্বাদে খানিক নোনতা- কবিতা তাদের ফুফাতো ভাই।

অন্তরালের কোন সে মরমপুরে সাত তবক আসমানের জলসাঘরে জ্বলতে থাকে ভাই-বোন ও বরফকুচি; নিমাই বাড়ির শূন্য ঘরে পিয়েপিয়ে পান করে চাকভাঙা মধু- স্মৃতির লাল নীল মাছেরা এমন।

রক্তের ফিনকি অন্ধ, শোণিত বধির আর বোবা, এখানেও ঈষদুষ্ণতার ঘ্রাণ, মায়ের বুকের কাঁচা দুধ কেমন আঁটালো, ফেরেশতারা ছিটায় বুঝি যাদুকাটা নদীর মায়াজল-দেহের বাগানে কবিতার মজমা।

ছেঁড়াখোঁড়া আমার বাবার কোমরে ব্যথা, ছানিপড়া চোখে পষ্ট দেখেও না, গমের দানায় অভিজ্ঞানের সুবাস, রাতজাগা জঙ্গনামার পুঁথি- হাওয়া হাতড়ে হাতের ইশারা : একটু বসো, আমার পাশে, খানিক চুপ করে বসে থাকো পুত্র আমার; কিছু না-বলে কেবল চুপ করে বাবার পাশে বসে থাকা- কবিতা এভাবেই লেখা ও না লেখার মাঝখানে দুর্দশা, পাহাড় বেয়ে ওঠা, কী-বা পুলসিরাত।

 

পুরাতনী বর্ষার দিক

যারা সবচেয়ে সুন্দর, সবার থেকে দয়াবান ও গুণশীল- তারা আমাদের নজরের আওতায় আসে না, তারা নীরবতায় মুখর, তাদের কথা আমাদের কানে পশে না; কোন প্রকল্প জারি করার প্রতিভা তাদের জিম্মায় নেই;  যারা অতুল বড় তারা আমাদের দৃষ্টির পরিধি থেকে এভাবেই দূরবর্তী, তারা গুমর- দৃশ্যমান ঢেউয়ের নিচে নেহায়েত লুকানো পানি খাউরি পাখি, তাদের বেদনা কখনও সম্মানিত হয়নি, তারা গাছের ভিতরে কালশিটে দাগ; উইলিয়াম শেকসপিয়ার তারা নয়, কস্মিনকালেও নয় কার্ল মার্কস বা মহাত্মা গান্ধী, নবী মোহাম্মদ নয়, নয় যিশু খ্রিস্ট, মুসা পয়গম্বর, আকিরা কুরোসাওয়া, কী গৌতম বুদ্ধ; তারা কেবলই আড়াল ও নিভৃত টিপসই । প্রকৃতি বড় চক্ষুষ্মান- তার অন্তরে ন্যায়শাস্ত্র আছে- যারা অন্তরাল, যারা সম্পূর্ণ একা ফুঁপিয়ে কাঁদে খানাখন্দ ও ফাটলের ভিতর- তাদের কাছে নিসর্গ গুমোট, মেঘে মেঘে ঘোর লাগা- দয়ার আলিঙ্গনসমূহ বৃষ্টির নামে ঝরে- মহাকবি কালিদাস তাকে মেঘের ডাকপিয়ন বলে ডাকে- আমি তার নাম জানি না, কেবল বুঝি- অনাগত পুরাণ ও প্লাবনের দিকে মুখ করে থাকা- মেঘচূর্ণ হাওয়াই বাতি।

জয়যাত্রায় ডুবি হে

যাকে তীব্র ভালোবাসি, যার লাগিয়া আমাদের মন এপার ওপার করে- তার একদম আয়ত্তের নিকটে থাকতে ইচ্ছা করে না; মন বলে, খানিক দূরে থাকি, স্মৃতির মঠ হই- একা দাঁড়িয়ে থাকি নিরলে, হাওয়ার সুইসুতার ফোঁড়ে; এভাবেই কখন যে কোন এক রঙ ও নীরবতার দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ চমকায়, পোড়াপুড়ি হয়, সুগন্ধে জড়ায়- লোবান ওড়ে অন্তর নিরিখে, জালাধান প্রাণের কর্দমে এক শিশুমুখ বাড়িয়ে ধরে- এভাবেই নিকটবর্তী দূরত্বের মূলে এক সুফিয়ানা ঘর বাঁধে বোধিবৃক্ষের নীলে- চলো যাই জয়যাত্রায় ডুবি হে।

বনগাঁ

ট্রেনে বিহার থেকে, কোলকাতা, বশিরহাট থেকে
পাগল আসে, হেঁটে হেঁটে আসে, ট্রাকে এসে নামে,
তারা বনগাঁ স্টেশনে এসে এমনি এমনি ঘোরে
পাগলেরা ট্রেন থেকে ঝরে পড়ে।

এমন নয় যে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বনগাঁ আসে
কেউ আসে বিড়বিড় করে- তাদের হাতে থাকে পুতুল-
পাটের পুতুল, লাল মাটির সরা।

ঝড়ের ঘোড়াধ্বনি কোথাকার গাছ
কোথায় উপড়ে নিয়ে ফেলে- সে খবর ডাকহরকরা
কাকেরাও কী জানে?

বনগাঁয় পাগলেরা খোলা আকাশের অবহেলার
নিচে জটলা পাকায়।
তারা পাতালে, সুরঙ্গ পথে মিঠাপানির মাছ হয়,
পদ্মা গাঙের ডিমওয়ালা ইলিশের হাটে মেশে।

তারা মনের অজানায় পুবদিকে শুঁকে দেখে-
এখনও কী সন্ধ্যা নামে লেবুঝাড়ের তলে!

আর কী-যে বান্নি, বান্নি জুড়ে গানের বৈঠকে নাচে
কৈশোর, কাটা ঘুড্ডি, গিমাই শাকের দেশে-

উজান মাটি ভাটির দেশে উজানিয়া গাঙে
কালিবাউশ পানির তলে ফজলি আমের রঙে
মরতে আসে ধরতে আসে কালো কৃষ্ণের নামে!

নাচে আর মাছ হয়- মিঠাপানির মাছ,
চরে আটকা পড়ে লাফাতে থাকে নানচিল কোরাল।

একসময় বড় বড় ট্রেনের হুইসেলের নিচে গলাকাটা ফোঁপানিগুলো
কোথায় হারায় বিদ্যুতি কৌশলে,

বনগাঁ স্টেশনে পাগল এসে নামে হাম্বা রবের ঢলে!

 

শ্যামের কায়কারবার

চাঁদ নিখোঁজ, তামাম মাঠে জ্যোৎস্নার ঢল নামে, নদী উধাও- দুনিয়া উলটপালট ঢেউয়ের সংক্রামে। হাত নাই, তবু ভাগ্যরেখায় গোণাগুণতি আছে ঠিক, অন্ধ মেয়ের আয়না মাধুরি ছোটে মৌমৌ চারদিক।

বন্ধ্যা মালতীর সন্ধ্যা জুড়ে পায়রা যে নামে ঝাঁকে, মন উপবন নাচে সেই ক্ষণ বোবা ছেলেটির ডাকে। খুলতে গেলেই ঘন হয়ে বসে একটি মেঘের সরা, নিজের দেহ প্রকৃতির নুন, ভৈরবী- মনতারা।

 

বদরুজ্জামান আলমগীর:

কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

 

প্রকাশিত বই।।

আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া।

প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।

কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।

ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।

ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।

প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।