You are currently viewing প্রতিকবিতার পৃথিবীতে> ঋতো আহমেদ

প্রতিকবিতার পৃথিবীতে> ঋতো আহমেদ

প্রতিকবিতার পৃথিবীতে

ঋতো আহমেদ

শিশুর মন—চলে না; কবিকে প্রাজ্ঞ হতে হয়? তবে যে কবিই আবার বলেন, প্রাজ্ঞের মতো নয়, অন্ধের ছুঁয়ে দেখার মতো করে বলো। আমার স্নায়ুতন্তুধমনি নিয়ে আমি এক অভিন্ন সমতলে আছি। অক্ষরগুলি কাগজে বন্ধ করে এসে তুমি যদি গোধূলিতে নিজেকে আচ্ছন্ন করো এবং অন্তত একটা কুড়োনো পাপড়িও আমার ত্বকমুখের অন্ধকারে রাখো তাহলে তোমাকে ঠিক শুনতে পাবো। মঞ্চে নয়, তার বাইরে মাটিতে দৃষ্টিহীনতার মধ্যে এক প্রখর সৌহার্দ্যের অবয়বে আমি জেগে আছি।…? এইরকম ভাবনা/চিন্তার ভেতর ইমদাদ মেসেঞ্জারে একটা কবিতা পাঠিয়ে বলল, এমদাদকে পাঠিয়ে বলো কবিতাটি কার লেখা অনুমান করতে। আমার লেখা বলো না ভাই। তুমি ঘৃণার পাত্র হবে। আমি তাই করলাম। কিন্তু এমদাদ ধরে ফেলল। বলল, ইমদাদের মন শিশুর মতো। তাই তার কবিতাও সরল। তোমার কী মনে হয়? কবিতার বিষয়আশয় ঘুরেফিরে একই। ইমদাদকে টেক্সটটা দিলাম, লিখলাম, এমদাদ এখন প্যারিসের অদূরে একটা লেকের পাড়ে বসে বিড়ি টানতেছে। বলল, বিড়ির দাম নাকি বেড়ে গেছে। আগে ছিল ১০ ইউরো, এখন ১১.৫। বিড়ির নাম মালবড়।–— এমন সময়ে বিপত্তির মতোই একটা মেসেজ এলো। একটা লিংক। ঢুকব না ঢুকব না করেও ঢুকলাম সেই লিংক ধরে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা কবিতাও পড়া গেল—

 

কোনো প্রার্থনা চলবে না, হাঁচিও নয়

থুতু ফেলা নয়, বাহবা দেয়া নয়, হাঁটু গেড়ে বসা নয়,

পুজো নয়, চিত্কার নয়, ডুকরানো নয়,

কেশে কেশে কফ তোলা নয়।

এ তল্লাটে ঘুমোবার অনুমতি নেই।

কোনো টিকা দেওয়া নয়, কথাবার্তা নয়, দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া নয়।

চো-চো দৌড় নয়, পাকড়ে ফেলা নয়।

ছোটা একেবারেই মানা

ধূমপান নিষেধ।

চোদা বারণ।

[হুঁশিয়ারি/ কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

আমিও ঘুরে গেলাম অন্যদিকে। চোদা বারণ—এই শেষ দুটি শব্দের মাধ্যমে প্রতিকবিতার পৃথিবীতে আমার আকস্মিক এই প্রবেশ ধীরে ধীরে সামনের দিকে মেলে ধরতে লাগল কবিতার এমনই এক প্রতিবিশ্বকে যে অবাক হয়ে পড়তে লাগলাম একটার পর একটা। কবিতালেখক নিজেই যেগুলোকে অভিহিত করছেন প্রতিকবিতা হিসেবে। নিক্যেনো পার্‌রা। হ্যাঁ, যার কবিতা পড়ে প্রতিক্রিয়া না দেখানো প্রায় অসম্ভব বলেছেন অনেকে। চলে গেছেন এই শতাব্দীর শুরুর দিকেই ২০১৮ সালে। আবার, জন্মেও ছিলেন গত শতাব্দীর শুরুতে ১৯১৪ সালের দক্ষিণ চিলির ছোট্ট এক শহরে। প্রায় একশত তিন বছরের জীবনে, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় যার প্রথম কবিতাবই ‘নামহীন গীতিমালা’। তবে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ বেরয় ১৯৫৪ সালে। আর তখন থেকেই বলতে গেলে কবিতার পৃথিবীতে প্রতিকবিতার যাত্রার শুরু। তখনই অবশ্য বইটা হাতে নিয়ে অনেকেই নাক সিটকেছিলেন। চিলির আরেক বিখ্যাত কবি পাবলো দে রোখা বইটি পড়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন, ‘এইসব স্থূল, বদখত্, গোঁয়ার, অলস ওড়গুলো, মৈথুনের পূর্বকল্পনা আর সচেতনভাবেই যাদের জীববিদ্যা আর উদ্ভিদবিদ্যা থেকে টেনে আনা হয়েছে। প্রতিকবিতাগুলো এই বিষম করুণাযোগ্য আর বমিজাগানো ভাঁড়ামোরই দ্বিতীয় সংস্করণ।’ গির্জার অধ্যক্ষ ফাদার সালভতিয়েররা বলেছিলেন, ‘নিক্যেনো পার্‌রার ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ এতোই অনৈতিক ও নোংরা যে ময়লা ফেলার ডাস্টবিনেও এটা ফেলা যাবে না, কারণ গারবেজ ক্যান অবৈধ সন্তানকে জায়গা দিলেও এতো অনৈতিক নয়।’ অন্যদিকে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘নিক্যেনো পার্‌রা আমাদের ভাষার মহত্তম নামগুলোর অন্যতম।’ হ্যাঁ, ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ বের হবার পর সত্যি হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। একদিকে যেমন তুমুল আক্রমণ অন্যদিকে বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। তাই হয়তো লিখলেন –

 

আধ শতাব্দী ধ’রে

কবিতা ছিল বেহেস্ত

গুরুগম্ভীর সব বেকুবদের জন্যে

যতক্ষণ-না আমি এসে হাজির হলাম

আর তৈরি করলাম আমার রোলারকোস্টার।

[রোলারকোস্টার/ শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

১৯৫২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় শিক্ষকতা করেন। তরুণ কবি হিসেবে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং পাবলো নেরুদা আর গেব্রিয়েলা মিস্ট্রল। লাতিন অ্যামেরিকার প্রথম নোবেল লরিয়েট হিসেবে মিস্ট্রল যখন চিলিতে বেড়াতে যান, সেখানে তাঁর সম্মানে পার্‌রা তখন মঞ্চে মিস্ট্রলকে উদ্দেশ্য করে রচিত একটা কবিতা পাঠ করেন। তখন থেকেই তিনি তাঁর নজরে চলে আসেন। পরবর্তীকালে, নেরুদাও ১৯৫৪ সালে তাঁর ‘পোয়েমাস ওয়ায় অ্যান্টিপেইমাস’ বইটি বুয়েনস আইরেসে প্রকাশিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কেন পার্‌রা তাঁর এইসব কবিতাকে প্রতিকবিতা হিসেবে উল্লেখ করলেন? সাধারণ অর্থে প্রতিকবিতা বলতে আমরা বুঝতে পারি বিপরীত কবিতা। অর্থাৎ যে কবিতার অভিমুখ প্রচলিত কবিতার অভিমুখের উল্টো। তাহলে পার্‌রা যে সময়ে কবিতা লিখছিলেন সেই সময়ের বিশ্বকবিতার অভিমুখ কেমন ছিল যে তাঁকে বিপরীত মুখের কথা ভাবতে হল? ১৯৬০ এর দশকে বাংলা কবিতায় মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরি কবিরা যেমন কবিতার দিক বদলের কথা ভেবেছিলেন, প্রসঙ্গত যদি মনে করতে চাই তাদের সেই আলোড়নের কথা, তারাও তো কবিতার বিপরীত মুখের কথাই বলেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, শিল্প নামে কোনও অলীক কাণ্ড কোথাও নেই। ওটা আর কোনও দৈবসূত্রে-পাওয়া সাজানো-গোছানো বিলাসব্যাপার নয়। জীবনযাপনেরই সত্য প্রকাশ হলো কবিতা। তাঁদের বুলেটিনে বলেছিলেন যে, কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্থ। সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়। অতিপ্রজ অন্ধ বল্মীক নয়। নিরলস যুক্তিগ্রন্থন নয়। এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতায় সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজনে এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনও অর্থ বের করার প্রয়োজন শেষ। এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি। প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী-বিরোধিতার নয়, তা মানসিক, দৈহিক, এবং শারীরিক। এ ক্ষুধার কেবলমাত্র লালনকর্তা কবিতা। কারণ, কবিতা ব্যতীত কী আছে আর জীবনে। মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়। তখন তাঁদের ওই আবির্ভাব বাংলা কবিতায় নতুন দিকবদলের ইঙ্গিত বহন করেছিল অনেকের কাছেই। অনেকেই ভাবছিলেন এঁদের এই বহিঃপ্রকাশের ধরনই মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের সামাজিক পচন কোন সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ঠিক সেই রকমভাবে পার্‌রাও কি তাঁর সময়ের পচনের শেষ সীমাকে প্রত্যক্ষ করতে পারছিলেন?

 

কাকে বলে অ্যান্টিপোয়েম?

 

চায়ের পেয়ালায় তুফান?

পাথরের গায়ে একফোঁটা তুষার?

কোনও দইসব্জির বাটি যা মানুষের মলমুত্রে ভর্তি,

যেমন বিশ্বাস করেন ফ্রান্‌সিস্‌কান বাবারা?

সত্যি-কথা বলে এমন-কোনও আয়না?

দু-ঠ্যাং ফাঁক-করা কোনও মেয়ে?

লেখক সমিতির সভাপতির নাকে এক ঘুঁষি?

(ভগবান তাঁর আত্মাকে রক্ষা করুন)

তরুণ কবিদের উদ্দেশ্যে কোনও হুঁশিয়ারি?

জেটবিমানের চাকালাগানো কোনও শবাধার?

কেরোসিনেচোবানো কোনও শবাধার?

কোনও লাশ নেই এমন কোনও সৎকার গৃহ?

[পরীক্ষা/ শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

নিজ ভাষার কবিতাকে সর্বদিক থেকে আক্রমণ করাই ছিল তাঁর কলমের কাজ? কবিতাকে সর্বাঙ্গীণ নতুন করে তুলে ভাষাকে মরণদশা থেকে বাঁচিয়ে তোলাই উদ্দেশ্য? তমিস্রাজড়িত পরিহাস, যোগসূত্রবিহীন অকাট্য যুক্তির শৃঙ্খল, স্বরের উত্থানপতন ধ্বনি—তাঁর কবিতায়—প্রস্তাবের যে প্রত্যক্ষতা, যাবতীয় ধরাবাঁধা রাজনৈতিক ফন্দিফিকির আর অলংকারশোভিত উক্তির প্রতি সন্দেহ আর চাঁছাছোলা সরাসরি কথা বলার ধরন—এই সবই কি আসলে আড়ালে লুকিয়ে রাখে ধ্বংস-হতে-থাকা এই পৃথিবী সম্পর্কে এক অনর্গল ও অবিশ্রাম দুঃখবোধ? এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “When there is humor, irony, sarcasm, when the author is making fun of himself and so of humanity, then the author is not singing but telling a story — that is an anti-poem.”

বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছেলেবেলায় তাঁর চার ভাই আর তিন বোনের সঙ্গে সারাক্ষণ খেলে বেড়াতেন কবরখানার সমাধিফলকগুলোর কাছে। সেটাই ছিল তাদের একমাত্র খেলার মাঠ। তাঁর বোন ভিওলেতা আর ভাইপো আন্‌হেল ছিলেন লাতিন অ্যামেরিকার সেরা সংগীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। সংগীত সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁরা গাইতেন রাজনৈতিক গান। কিন্তু মার্কিন সহযোগিতায় আইয়েন্দেকে হত্যার পর হেনেরাল পিনোশেত্‌ যখন চিলির এক-নায়ক শাসন কায়েম করেন, তখন আনহেল প্যারিস পালিয়ে যান। সেই সময়ে তিক্তর হারাকে সান্‌তিয়েগোর ফুটবল স্টেডিয়ামে খুন করা হয়। প্রথমে গিটার বাজানোর কারণে হাত কাটা হয়, পড়ে গুলিতে দেহ ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। এই ঘটনার পরে ভিওলেতা আত্মহত্যা করেন। পরিবার ও পরিপার্শ্বের এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন নিক্যেনো পার্‌রা। আর তাই হয়তো তাঁকে ধ্বংস-হতে-থাকা গতানুগতিক পথ পরিহার করে ভিন্ন পথই খুঁজতে হয়েছিল। যেতে হচ্ছিল বিপরীত মুখে। ‘আত্মহত্যার বদলে আত্মরতি’র পথে। নিজেকে ঘোষণা করতে হয়েছিল অ্যান্টিপোয়েট।

 

কাকে বলে অ্যান্টিপোয়েট?

 

শবাধার আর ছাইদানার কোনও ব্যাবসাদার?

এমন সেনাপতি যে নিজের ক্ষমতায় দ্বিধাগ্রস্থ?

এমন পুরুত যে কিছুতেই বিশ্বাস করে না?

এমন কোনও ভিখিরি ভবঘুরে যে সবকিছু নিয়েই

            হাসাহাসি করে, এমনকি বার্ধক্য আর মৃত্যু নিয়েও?

কোনও বদমেজাজি বাক্যবাগীশ?

খাদের পাশে নাচতে থাকা কোনও নাচিয়ে?

সারা জগতের প্রেমে পড়েছে এমন কোনও নারসিসাস?

এক রক্ত-মাখা ভাঁড় যে ইচ্ছে করেই যা-দশায় পড়েছে?

চেয়ারে বসে ঘুম লাগায় এমন কোনও কবি?

এক অত্যাধুনিক কিমিয়াবিদ?

বৈঠকখানার কোনও বিপ্লবী?

কোনও পাতিবুর্জোয়া?

কোনও ছ্যাবলা? ফিচেল? কোনও তোতা? অপাপবিদ্ধ কেউ?

 

যে বাক্যটি নির্ভুল লাগে তার নিচে দাগ টানো।

[পরীক্ষা/ শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

ছোট ছোট কবিতা। খোলামেলা, বিশৃঙ্খল, ক্ষিপ্ত আর অন্তর্ভেদী। ১৯৩৩ সালে চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান তিনি। সেখান থেকে ১৯৩৯ সালে অধ্যাপক হয়ে বের হন। ঠিক এর আগের বছরই বেরিয়ে যায় তার প্রথম বই। এরও ১৭ বছর পর ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’। ১৯৪৩ পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলে পড়াতে হয় তাঁকে। তারপর চলে যান অ্যামেরিকায়, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ এ ফিরে আসেন চিলি। যোগ দেন অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৪৯ এ আবার চিলি ছাড়েন। চলে যান কসমোলজি পড়াতে অক্সফোর্ডে। এরপর ১৯৫২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সান্তিয়েগোর চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। বলেছিলেন, “I do physics in order to earn my living, and I do poetry in order to keep alive.” অবশ্য অইয়েন্দের হত্যার পর তাকেও কিছুদিন আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। ১৯৬০ সালে পাবলো নেরুদার সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেন তার গদ্যের বই ‘দিস্‌কুর্‌সোস’। একে অপরের কবিতা নিয়ে আলোচনা, কবিতার সামাজিক রাজনৈতিক দায়, ভাষা ও শ্লেষ, চাঁছাছোলা প্রকাশভঙ্গি—এইসব নিয়ে সেখানে আছে পরস্পরের পরিপূরক মন্তব্য আর বিশ্লেষণ। কিন্তু আমরা, মানে বাঙালী পাঠকেরা তাঁকে হাতে পাই আরও অনেক পরে। ১৯৯২ সালে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রথম বাংলা ভাষী পাঠকদের হাতে তুলে দেন তার কবিতার বাংলা অনুবাদ ‘নিকানোর পার্‌রার শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা’, তখন। যে প্রতিকবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমরা স্পর্শ করতে পাই সস্তা শব্দ, এমনকি গালিগালাজও আর তার বিষয়বস্তুর প্রকাশ-মাধ্যম দেখতে পাই বর্ণনামূলক আর অভিব্যক্তিময়। মনে হতে থাকে তাঁর ভাষা মানসিক অসঙ্গতিপূর্ণ। খেয়ালী, খাপছাড়া কিংবা তুচ্ছ। তাঁর কাব্যে অতি সাধারণ বস্তু যেমন ফোন, সোডা কিংবা পার্কের বেঞ্চ পর্যন্ত ঝকমকিয়ে উঠতে পারে আশ্চর্য কোনও সত্যে। “হাসি আর অশ্রু” এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে তাঁর প্রতিকবিতা। গতানুগতিক সিরিয়াস কবিতার প্রতি এ যেন এক প্রতিবাদ। প্রচলিত পাঠকের টনক নড়াতেই যেন এর আবির্ভাব। যে পাঠক এতদিন কেবল কবিতাই পাঠ করে গেছেন, পাঠ করে গেছেন পাবলো নেরুদার মতো কবিদের কবিতা। সেই অভিজাত পাঠককে, তার জাত্যাভিমানকে নাড়া দিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষ যদি কিছু বলে সেটা হয় কথা আর কবি বললে হয় গান। মিম্বরে যাজক যেমন সুর করে কথা বলে, তিনি বলেন, আমার কবিতাও সেইরকম, পাখিদের গাইতে দাও গান। পাঠকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কৌশলটাও দারুণ। কারণ হাস্যরস খুব সহজেই মানুষকে কাছে টানে।

 

জানিনা কী ক’রে এসে পৌঁছুলাম এখানে:

 

আমি তো পরমানন্দেই ছুটে বেড়াচ্ছিলাম

টুপিটা ছিল আমার ডান হাতে

ধাওয়া করছিলাম ফসফরজ্বলা ফুরফুরে এক প্রজাপতির পেছনে

ও আমাকে আনন্দে আত্মহারা করে দিয়েছিল

 

আচমকা, দড়াম! হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম একেবারে

বাগানটার যে কী হয়েছে আমি জানি না

ভেঙে খানখান হয়ে গেল সব

নাক মুখ থেকে রক্ত পড়ছে আমার।

 

মাইরি বলছি কী-সব হয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারছি না

হয় আমাকে এসে বাঁচাও

নয়তো মাথা বরাবর ছোঁড়ো একটা বুলেট।

[বাঁচাও!/কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

লাতিন অ্যামেরিকার সাহিত্যে কবিতার শরীর থেকে পার্‌রা সমস্ত অলংকার আর অপরিমিত শব্দের ব্যবহার ঝেটে বিতাড়িত করেছেন। যা তাঁর কবিতাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। কবিদের তিনি স্বর্গ থেকে মাটিতে নামিয়েছেন। এনেছেন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি। ১৯৬৩ সালে প্রায় ৬ মাসের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কিছু সোভিয়েত কবিকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেন। তবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ১৯৭১ এর দিকে একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থিদের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন। অনেকেই তাঁর এই প্রতিকবিতার ধারণাকে সাংঘাতিক বলে উল্লেখ করেন। এতে উপস্থিত রূপকসমূহ, স্ফীত শব্দচয়ন, রোম্যান্টিক আকাঙ্ক্ষা, প্রচ্ছন্নতা আর ফাঁকা আভিজাত্য সত্যি অভিভূত করে ফ্যালে পাঠককে। কেউ বলেন, too dirty to be immoral, আবার কেউ বলেন, pity and nausea. বাংলা কবিতায় অবশ্য কিছুটা এইরকমই সাযুজ্য রয়েছে আমাদের ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতায়।   

পাবলো নেরুদা ছিলেন স্পষ্ট বামপন্থি। কিন্তু আমাদের পার্‌রা? তাঁকে কি বামপন্থি কবি বলা যায়? আরও কয়েকজন অন্য ভাষার কবির সঙ্গে একবার তাঁকে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে কবিতা পড়তে যেতে হয়েছিল। কবিতা পাঠ শেষে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় হোয়াইট হাউজের রিসেপশানে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই করমর্দন করতে চলে আসেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। আর তা ছবি আকারে পত্রপত্রিকায় বেরিয়ে যায় পরদিনই। এই ঘটনায় কবির পুরনো বন্ধুরা নাখোশ হন তাঁর উপর। এমনকি তাঁকে শেষ পর্যন্ত চিলির ফ্লাইটও কেন্সেল করতে হয়। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্য। যার রেশ অনেকদিন পর্যন্ত বহাল ছিল।  

১৯৭০ এর শুরুর দিকে চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সাল্ভাদর আইয়েন্দের থেকে মোহভঙ্গ হয় তাঁর। সামরিক অভ্যুত্থানের পর আইয়েন্দে আত্মহত্যা করেন। তখন অনেক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক পালিয়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু পার্‌রাকে তেমন গুরুতর সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। তিনি তাঁর শিক্ষকতা নিয়ে বহাল তবিয়তেই ছিলেন। তাই হয়তো তাঁকে নিন্দা করে তাঁর ভাতিজা অ্যাঞ্জেল পার্‌রা যিনি কিনা চিলির নামকরা গায়ক ও গান-রচয়িতা ছিলেন, আর তাঁর বোনের ছেলে একবার দ্য টাইমসকে বলেছিলেন, “আমরা ওই লোকটার কাছ থেকে কিছুই আশা করি না।” অবাক হতে হয়। আবার মনে হয় এমনই তো প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। কোন পন্থায় ছিলেন কবি পার্‌রা। সামরিক জান্তার কাতারের? মার্কিন স্ম্রাজ্যবাদীর বন্ধুর কাতারের? নাকি সমাজতন্ত্রের? স্পষ্ট ছিল না তাঁর অবস্থান। সবসময়ে তাঁকে মাঝামাঝি থাকতে দেখা গেছে। অনেকের মতো নেরুদার সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়, যে নেরুদা ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন এবং সন্দেহজনকভাবে অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পর, ১৯৭৩ সালেই মারা যান। নেরুদাকে বলা যায় সমাজতান্ত্রিক আর পার্‌রা স্বভাবসন্দিগ্ধ। নেরুদার কবিতায় ও বাড়িতে যে আড়ম্বর আর গতি তার কিছুই পাওয়া যায় না পার্‌রায়। তাঁর বাড়িটা একদম সাদামাটা; তাঁর কবিতার মতোই। এক গুচ্ছ পাইন গাছে ঘেরা একটা কুড়েঘর মাত্র। এর মানে হচ্ছে পার্‌রা একটু আলাদা ভঙ্গিমায় উজ্জ্বল। পার্‌রা ভেতরে ভেতরে একজন নৈরাজ্যবাদী। সমস্ত সামাজিকতা থেকে একটুখানি দূরের। এমনই তাঁর নিজ দেশের থেকেও।

 

আমি ঠাট্টা করেছিলাম সূর্য আর চাঁদকে

ঠাট্টা করেছিলাম সমুদ্র আর সৈকতশৈলকে

তবে সবচেয়ে হাঁদার ব্যাপার হয়েছিল

আমি ঠাট্টা করেছিলাম মৃত্যুকে

ছেলেমানুষি, হয়তো? না,

বুদ্ধির অভাব?

তবে আমি মৃত্যুকে নিয়ে মজা করেছিলাম।

                        [নিজের সম্বন্ধে কী বলার ছিল মৃত্যুর/শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা]

 

১৯৭৭ এ প্রকাশিত কিছু কবিতার [The Sermons and Teaching of the Christ of Elqui] প্রতিক্রিয়া হিসেবে জেন অগাস্তো পিনোচেত আর কিছু ডানপন্থি লোক তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। আবার, ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসন সমাপ্ত হয়ে চিলিতে যখন গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে তখন পার্‌রাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা যা ইচ্ছে লিখতে পারি, যতক্ষণ না সরকারযন্ত্র আমাদের মামুলী কবিতার দিকে নজর দিচ্ছে। কারণ তারা হয়তো জানে যে কেউ এসব ছাইভস্ম পড়বে না।’ ১৯৬৯ সালে নিক্যেনো পার্‌রাকে চিলির জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। আর ২০১১ সালে দেয়া হয় স্প্যানিশ ভাষার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার সেরভান্তেস পুরস্কার। সান্তিয়েগোর বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরে আসার আগে তিনি তাঁর শেষ বছরটা কাটিয়েছেন লাস ক্রুসেসে। প্রশান্ত মহাসাগরের কাছেই, উপসাগরের পাড়ে ছোট্ট এক শহর এই লাস ক্রুসেস।

********************************************************

  ঋতো আহমেদ: কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

১২.০৪.২০২৩; উত্তরা, ঢাকা।

কৃতজ্ঞতা @ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আলী সিদ্দিকী।

******************************************************