You are currently viewing প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী: প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী: প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী: প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রমাপদ চৌধুরী ( জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৯২২- মৃত্যু ২৯ জুলাই ২০১৮ ) এক জন স্বনামধন্য লেখক। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের খড়গপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। দীর্ঘদিন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা শুরু করেন। তাঁর অনেক গল্প নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে। তার মধ্যে বনপলাশির পদাবলি, এখনই, খারিজ, একদিন অচানক, সুন্দরী উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৮ সালে তিনি বাড়ি বদলে যায় উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়াও পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার ও রবীন্দ্র পুরস্কার। কলকতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ও পদক। শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্যও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। যুগান্তরে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্প ‘উদয়াস্ত’৷ তার পর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় ‘বারো ঘোড়ার আস্তাবল’৷

রমাপদ চৌধুরীর প্রথম গল্পের নাম ‘ট্রাজেডি’। ১৯৪০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বয়স আঠারো বছর। কলেজ পালানো এক দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের ওয়াইএমসিএ-র নীচের রেস্তোরাঁয় বসে লেখেন গল্পটি। দুই হবু-সাহিত্যিক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে লেখা। গল্পটি ছাপা হয় ‘আজকাল’ সাপ্তাহিকে। সেই শুরু। তার পর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ ও হুমায়ুন কবীরের ‘চতুরঙ্গ’ ত্রৈমাসিকের নিয়মিত লেখক তিনি। পঁচিশ বছর বয়স থেকেই তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও শারদীয় আনন্দবাজারের স্থায়ী লেখক হয়ে যান। সময়টা তখন চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ, ১৯৪৭-’৫০। এটাই গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর উন্মেষ কাল। তখন নিজেই ‘ইদানিং’ ও পরে ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। এ সময়ের মধ্যেই লিখে ফেলেছেন বেশ কিছু সার্থক গল্প।

ইতিমধ্যে তিনি দেখছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ কঠিন দৃশ্য, যুদ্ধের পরের দাঙ্গা, দেশ বিভাগের ফলে বসতভিটা ফেলে অশ্রুসজল চোখে মানুষের চলে যাওয়া, চোখের জলে তাদের বিদায় দিতে দিতে চোখের সীমানায় উদ্বাস্তু, বাস্তুত্যাগী মানুষের আগমন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কলকাতার বুকে মন্বন্তরের বীভৎষ্যতা। স্বাধীনতার প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস আর অসারতা। এর মধ্যে দিয়ে লতিয়ে উঠছে গণবিক্ষোভ, বামপন্থী রাজনীতির উত্থান। ঘটছে মধ্যবিত্তের বিকাশ। সমাজে মধ্যবিত্তের মানসিকতার প্রভাব-দোলাচল, অনিশ্চয়তা, হতাশা, প্রতারণা ইত্যাদি দেখা যায়। এ সব কিছু গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর মানসভূমে সাহিত্যের ভাষা ও বিষয়বস্তু তৈরি করছিল নিশ্চয়ই। তার গল্প-উপন্যাসে এসব এসেছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও সরাসরি, কখনও প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তবে তার গল্পে একটি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ পায়। যে কারণে তিনি বিভিন্ন ভাবে সমাজের কপটতাতে আঘাত করেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন সে ভাবেই। গল্প দিয়েই রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্য যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে তিনি সার্থক উপন্যাসও রচনা করেছেন একাধিক। তবে উপন্যাস ও গল্পের বিষয়বস্তু আলাদা। তিনি খুব সচেতন হিসেবে এর প্রকরণ করে থাকেন। ঔপন্যাসিকের কাছে গল্পকারের দৃষ্টিভঙ্গির কৃতিত্ব কোথায় তাও তিনি নির্ণয় করেছেন। তিনি একটি মহাযুদ্ধের দৃশ্যকল্প সামনে এনে বুঝিয়ে দেন সেই কৃতিত্ব। যুদ্ধের বিশাল-বিরাট আয়োজন, পুঙ্খানুপুঙ্খু বর্ণনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা ঔপন্যাসিকের কাজ। এখানে গল্পকারের কৃতিত্ব কোথায়? রমাপদ চৌধুরী লেখেন —

‘হঠাৎ তিনি ছোটগল্প-লেখককে দেখতে পাবেন বনের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন্ উন্নাসিক লেখক?-মনে মনে ভাবলেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠলো না দেখলো না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিলো না, এ কেমন ধারা সাহিত্যিক! হয়তো এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়তো, না বন্ধু, এ সব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। বনের ওপারে কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার বিন্দু ফুটে উঠেছে — কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথাবিন্দুর, চোখের টলোমলো অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন হয়তো, বন্ধু হে, ঐ অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।’(ভূমিকা/রমাপদ চৌধুরী-গল্পসমগ্র)।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে রমাপদ চৌধুরীর গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং কয়েক বছরের মধ্যেই পৌঁছে যান খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র পঁয়তাল্লিশ, ছোটগল্প দেড়শোরও কম! এ ছাড়া কিছু প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা। বাংলা ভাষার যে সব কথাসাহিত্যিকের লেখকজীবন অর্ধশতাব্দীর বেশি, তাঁদের মধ্যে আর কেউ এত কম লিখেছেন কি না বলা শক্ত। তাই তাঁর সম্বন্ধে একটি কথা প্রচলিত ছিল, ‘না লিখে লেখক’! শুধু এ দিক থেকেই তিনি ব্যতিক্রমী নন। তিনিই সম্ভবত বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক, যিনি ‘ঘোষণা’ করে লেখা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তখনও তিনি সুস্থ, দেশ বা আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোসংখ্যায় তাঁর উপন্যাস পড়ার জন্য তখনও পাঠক মুখিয়ে। তথাপি ২০০৫-এ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রমাপদ চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সারা জীবন, আর লিখবেন না। আজকের পৃথিবী তিনি জানেন না, তাই সেই পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বলার নেই তাঁর। তাঁর সিদ্ধান্তে অনুরাগী পাঠক যতটা আহত হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার লেখকরা ‘রিটায়ার’ করেন নাকি? তিনি করেছিলেন।

রমাপদ চৌধুরীর লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন, তাঁর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের উপজীব্য শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্যক্তিগত ও সমাজজীবন। যে মধ্যবিত্ত “নিজের মানসিকতা সম্পর্কে সচেতন নয় অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্যায়-অবিচার নিয়ে সোচ্চার”, “নিজে অসহায় কিন্তু আরও অসহায়দের প্রতি তাঁর সমবেদনা কম”, সেই মধ্যবিত্তকে চিরে দেখেছেন ‘দিনকাল’, ‘বসবার ঘর’, ‘ফ্রীজ’, ‘জাল’, ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’, ‘ডাইনিং টেবিল’-এর মতো ছোটগল্পে; খারিজ, বীজ, লজ্জা, বাড়ি বদলে যায়, ছাদ, বাহিরি, দাগ-এর মতো উপন্যাসে। মধ্যবিত্তের চরিত্রের নানা অন্ধকার দিক লেখায় তুলে ধরেছেন স্পষ্ট, নির্মম ভাবে।

মধ্যবিত্ত বাঙালিজীবন যদি তাঁর লেখার একটি ‘থিম’ হয়, আর একটি ‘থিম’ অবশ্যই গত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের ভারত— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগে বিধ্বস্ত, যেখানে ক্রমে উত্থান হচ্ছে পুঁজিবাদের। তাঁর প্রথম জীবনের এই লেখাগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, সাহিত্যের ছাত্র হলেও ইতিহাস অর্থনীতি নৃতত্ত্বে তাঁর বৈদগ্ধ ছিল প্রশ্নাতীত, পেশাদার গবেষকের সমতুল। না হলে কী ভাবে তিনি লিখলেন ‘ভারতবর্ষ’-তে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পালামৌ অঞ্চলের একটি গ্রামের, পুঁজিবাদের হাতছানিতে ধীরে ধীরে ‘ভিখারি’ হয়ে ওঠার মর্মান্তিক কাহিনি, ‘গত যুদ্ধের ইতিহাস’-এ দরিদ্র মেয়ের জীবনের করুণ আখ্যানের মধ্য দিয়ে সময়ের ইতিহাস, বনপলাশীর পদাবলী-তে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের আখ্যান যখন বাংলার গ্রাম অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ছে, সরকারের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা সেই ভাঙন রোধে ব্যর্থ হচ্ছে?

এর বাইরেও নানা বিচিত্র বিষয় তাঁর লেখায়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য কালখণ্ডের ভিত্তিতে লিখেছেন লালবাঈ, কলকাতায় ঘটে যাওয়া এক ট্র্যাজিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে অভিমন্যু, সত্তরের দশকের যুব-জীবনযাত্রা নিয়ে এখনই, জনজাতি মানুষের যাপন নিয়ে রেবেকা সোরেনের কবর, ঝুমরা বিবির মেলা। নিখাদ প্রেমের গল্পও লিখেছেন একাধিক— ‘সতী ঠাকরুণের চিতা’, ‘তিতির কান্নার মাঠ’, ‘রাঙ্গাপিসিমা’। তুলনায় তাঁর প্রবন্ধ ও অন্য গদ্যলেখাগুলি কম আলোচিত। অথচ, ‘কোন বই আবিষ্কার, কোনটি কালহরণের সঙ্গী’-র মতো প্রবন্ধ, ভারতের মন্দির-বিষয়ক রচনা বা অনবদ্য স্মৃতিকথা হারানো খাতা পড়লে বোঝা যায়, সেখানেও তিনি অপ্রতিম। রমাপদ চৌধুরীর লেখনশৈলী পূর্বসূরিদের প্রভাবমুক্ত, ঋজু। অহেতুক কাব্যময়তা, আবেগের আতিশয্য নেই। মনে হয়, তিনি যখন লিখতেন, তাঁর সম্পাদক ও লেখক দুই সত্তাই সমান সক্রিয় থাকত। তাই সৃষ্টি করতে পারতেন অত্যন্ত উঁচু দরের সাহিত্য, যতটুকু না লিখলেই নয় ঠিক ততটুকুই লিখে।

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ হলো 

  • আকাশপ্রদীপ
  • অহংকার
  • আজীবন
  • অংশ
  • বাড়ি বদলে যায়
  • বাহিরি
  • বনপলাশির পদাবলি
  • বেঁচে থাকা
  • চড়াই
  • ছাঁদ
  • সুন্দরী
  • সুখ দুঃখ
  • খারিজ
  • বীজ

আজকের প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান সাহিত্যিকের রচনাবলীর সাথে পরিচিত নয়। একটি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হিসেবে আমরা অনেক অমূল্য সম্পদকে বিস্মৃতির ধুলো চাপা দিয়ে রাখছি। একই সত্যতার পুনাবৃত্তি ঘটবে যখন আগামী প্রজন্ম বর্তমান প্রজন্মের সৃষ্টিকর্মকে ভুলে যাবে।

তাঁর প্রস্থান দিবসে মনমানচিত্রের পক্ষ থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

==========================