You are currently viewing পিপুফিশু – ২০ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু – ২০ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু || আলী সিদ্দিকী

কিস্তি- ২০

বসন্তের বিবাগী হাওয়া

বিশাল চাঁদটা বুঝি হুমড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। আলো নিভিয়ে আমি সোফায় শুয়ে জোছনায় অবগাহন করতে লাগলাম। যেন শুয়ে আছি দখিণ বিলের পাড়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটার নীচে। একাকী। খোলা বিলের বুকে দস্যিপনা করে ছুটে আসছে প্রাণ জুড়ানো বাতাস। তারা এসে কাতুকুতু দিচ্ছে ঝিম মেরে থাকা আমার প্রিয় সঙ্গী আম গাছটায়। দুষ্টুরা ওর মগ্নতায় তুলছে নিশি ডাকা শিস্। মাথার নীচে হাত রেখে দূর চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি চলে গেছি অচেনা কোন প্রান্তরে। বাতাসেরা আমায় ফিরিয়ে আনে তাদের কাছে। বলছে, আয় হুটোপুটি করি। আমি তাদের জড়াজড়ি করে একবার ঢালুতে নামি, আবার গাছের গোড়ালীতে উঠে বসি। এমন করতে করতে চাঁদটা উঠে আসে মাঝ আকাশে।
কি করছিস্ তুই এখানে? বাবা এসে পাশে বসে।
বসে আছি।
তোর এখানে ভয় করে না?
না।
পাশে যে শ্বশান আছে জানিস?
হ্যাঁ।
ওখানে যে পেত্মীরা আসে জানিস?
কখনো দেখি নি তো।
ওখানে মরা মানুষের মাথার খুলিরা দৌড়াদৌড়ি করে, তুই দেখিস নি?
না বাবা।
এমন আঁধার রাতে একলা তোর ভয় করে না?
আঁধার কোথায় বাবা, দেখো না চাঁদের কতো আলো। আর আমি তো একলা নই। এই আম গাছ আছে। মাঝে মধ্যে কাদের, অরুণ, বাবুল থাকে। আজ ওরা আসে নি।
তোরও আর এখানে আসার দরকার নেই। বাবা হাত ধরে হেঁচকা টানে আমাকে দাঁড় করায়, আর কখনো আসবি তো তোকে আমি হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবো।
আমাদের মধ্যে মিলিটারী স্কুলের একটা ভয় ছিলো। সেখানে সবাইকে রাত আটটার মধ্যে ঘুমুতে হয় আর সকাল পাঁচটায় উঠে ড্রিল করতে হয়। না উঠলে বেত মারা হয়। আমরা সবাই অই স্কুলকে ঘৃণা করতাম। ভয়ও পেতাম। বাবা আমাকে সেই ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করতো। আমিও ক’দিন সুবোধ বালক হয়ে থাকতাম। পরে যে কে সে-ই।
আমার সেই নিঃসঙ্গ বন্ধু আম গাছটির কথা ভীষণ মনে পড়লো। তার গায়ে খোদাই করে লেখা আমার নামটি এ মুহূর্তে জ্বল জ্বল করে উঠলো। এরশাদের আমলে বাবরি মসজিদ দাঙ্গার সময় এলাকার সন্ত্রাসীরা হিন্দু বাড়ী দখল করে সেখানে কলোনী বানানোর সময় গাছটি কেটে ফেলেছিলো। পরে আমি গিয়ে সেখানে কোন গাছের চিহৃ দেখতে পাই নি। আমার পরম বন্ধুর প্রতি কোন শ্রদ্ধা জানাতে পারি নি, পারিনি তার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে।
আমার সেই হারানো বন্ধুর কথা মনে করে একটা হাহাকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরুলো।
এসময় সশব্দে ফোনটা চিৎকার করে উঠে আমার নিঃসঙ্গতাকে খান খান করে দিলো।
হ্যালো -।
প্রিয় তুমি কি করছো?
ভাঙা ভাঙা বাংলায় লিনোরার গলা শুনে মনটা সতেজ হয়ে উঠতে চাইলো। লিনোরার জেদ আর বিশাখা ভাবীর তিন মাসের অক্লান্ত চেষ্টায় সে বাংলা বলতে শিখেছে। বর্ণমালা আয়ত্ত্ব করতে পারলেও ঠিকমতো লিখতে এখনো পারে না। তবে অত্যন্ত শার্প বলে সহজেই উচ্চারণ করা শুরু করেছে। তার একটাই কথা, যেদিন ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলতে পারবো সেদিন আমি সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত নেব। গত সপ্তাহে লিনোরা সলজ্জ ভঙ্গীতে ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” কথাটি আমাকে বলে ফেলেছে। বলতে পেরে সাথে সাথে সিদ্ধান্ত, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
মি. কার্লের সাথে কথা হয়েছে ? তোমার মা ?
ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও।
তড়িঘড়ি করা কি ঠিক হচ্ছে ?
বুড়ো বয়েসে বিয়ে করতে চাও ?
না তা নয়।
তাহলে দিস্ উইকএন্ডে, বাঙালী স্টাইলে।
বাঙালী স্টাইলে ? এখানে তো আমার কেউ নেই -।
বিশু আছে। উচ্ছল ভঙ্গীতে বলে সে, ও সব ব্যবস্থা করবে।
তাই হলো। গত এক সপ্তাহ বিশু ভাবী আর আফসার ভাইয়ের সহায়তায় বিয়ের পুরো আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। হ্যাটফিল্ড ফায়ার সার্ভিসের অডিটোরিয়াম ভাড়া নেয়া হলো। একশ’ মানুষের খাবারের জন্যে মেনু ঠিক করে সুলতানকে অর্ডার দেয়া হলো। বিয়ের সেরোয়ানী, শাড়ী গহনা সবকিছু নিউজার্সির এডিশন থেকে কেনা হলো। ফিলাডেলফিয়া থেকে একজন মুসলিম কাজীকে আসতে বলা হয়েছে। কনে মুসলিম না হলে ইসলামী আইন মোতাবেক বিয়ে পড়ানো নাজায়েজ-এমন একটা কথা মসজিদের ইমাম বলার পর আফসার ভাই ফিলাডেলফিয়ার এক আফ্রিকান আমেরিকান কাজী ঠিক করেছেন। তাছাড়া নরিসটাউনে গিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রিও করতে হবে।
আমি বড় আপাকে সব জানালাম। বাঙালী মুসলমান কোন মেয়ে না হওয়ায় প্রথমে একটু কান্না কাটি করলো সে। পরে বললো, আল্লাহ তোকে সুখী করুক খোকন। মা থাকলে আজ কতো খুশী হতো।
সে আমার দুর্ভাগ্য বড়ো আপা।
মন ছোট করবি না, অন্যপ্রান্তে কান্না চাপে বড়ো আপা, আল্লাহ তোর ক্ষতি করবে না।
পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটি ওয়েভ ক্যামেরার মাধ্যমে দেশে সবাইকে দেখানোর জন্যে লিপু সব ব্যŸস্থা করেছে। রুবেল এখানে তার ল্যাপটপ দিয়ে যোগাযোগ স্থাপনের আয়োজন করেছে।
এদিকে আজ বিশু ভাবীর বাসায় লিনোরার গায়ে হলুদ হলো। আমাকে একবারও লিনোরার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। দিনভর সে একবার ফোনও করেনি। নিজের ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। আমি বার কয়েক ভাবীদের বাসার আশপাশে ঘুর ঘুর করেছি। অর্পিতা তার দলবল নিয়ে হই হই করে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার সাড়া পেয়ে বিশু ভাবী একবার বেরিয়ে এলো।
কি গো জামাইবাবু, একদম তর সইছে না দেখছি।
একটু কথা ছিলো ওর সাথে- আমি ধরা গলায় বললাম।
কাল থেকে সারাজীবন কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে, আজ হলো বিরহকাল।
বড্ড পাষাণ হৃদয় আপনার-।
আহারে! একেবারে যে মুচড়ে পড়েছে দেখছি।
ভাবীর খুনসুটি থেকে বাঁচার জন্যে পালিয়ে এসেছি।
এখন লিনোরার ফোন পেয়ে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
তোমার কথা ভাবছি। আমি সায় দিলাম।
মিথ্যা বলছো না তো ? অনুযোগের ভঙ্গী ফোটে ওর গলায়।
তোমার কি মনে হয় ?
সত্য বলছো।
তুমি কি একটু বেরোতে পারবে ?
কেন ?
তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
বিশু আমাকে বেরোতে দেবে না, এটা বাঙালী কনের রুল। কালকে সার্প এগারোটায় দেখা হবে। ড্যাডি মমকে নিয়ে বারোটায় চলে আসবে। এখন আমি ঘুমাবো।
তোমার ঘুম আসবে ?
আমি খুব টায়ার্ড।
আজ কি কি হলো বলো না শুনি-।
শুনতে হবে না, ভিডিও দেখো পরে।
তোমার কেমন লেগেছে ?
পাগল পাগল-।
মানে ?
মানে নিজেকে কেমন যেন মনে হচ্ছিল। এতো এনজয় করেছি সবার সাথে, আমি জীবনে ভুলবো না।
তোমার কোন ভুল হচ্ছে না তো লিনো ?
এটা বলছো কেন প্রিয় ?
যদি কখনো মনে হয় তুমি ভুল করেছো ?
আই হ্যাভ অনলি ওয়ান লাইফ ফর য়্যু আতিক, মাই হার্ট। এখন ঘুমাতে যাই ?
যাবে ? ঠিক আছে, গুডনাইট।
গুডনাইট ডার্লিং।

ফোনটা রেখে একটা বিয়ার বের করলাম। রাত সাড়ে দশটা বাজে, জন এখনো এলো না। সে আজ রাতে আমার কাছে থাকার কথা। হয়তো এসে পড়বে এখুনি। কাল আমার বিয়ে এটা ভাবতে কেমন যেন লাগছে। ছন্নছাড়া জীবনটা ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে কোথায় চলে এলো। বত্রিশ বছর পেরিয়ে সংসারী হতে হবে তাও আবার বিদেশিনী, কল্পনাও করিনি। এতো আর এদেশে লিগ্যাল হবার জন্যে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ নয়। হৃদয় দেয়া-নেয়া করে প্রকৃত বিয়ে। হৃদয় দেয়া-নেয়া কথাটা মনে হতেই হাসি পেলো। এসব হৃদয়ের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কতো যে বালখিল্যতা করেছি জীবনে ভাবতে অবাক লাগে। প্রথম যৌবনের উদ্দামতায় ভালোবাসা-বাসিটা এতো বেশী উন্মত্ততায় পৌঁছেছিলো যে, দৈহিক সম্পর্কের পর তা শুধু কক্ষ বদল করে ফিরেছে। কোথাও থিতু হবার সুযোগ মেলেনি। সেই সোনালী যৌবনের সে সব প্রিয়মুখগুলো আজ সময়ের সংঘাতে ঝাপসা হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে স্মৃতির বিচ্ছুরনে কিছু কিছু আন্দোলিত দৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে সেলুলয়েডের পর্দার মতো। বিস্মৃতির ঢেউ বুঝি আছড়ে পড়লো ফোনের শব্দে।
হ্যালো-।
আতিক, ইটস্ জন-।
এনিথিং রং ?
নাথিং রং, গলায় আবেগ ভাসে জনের, সিন্ডি আমার ঘরে-।
নেশা কি বেশী করে ফেলেছো ?
না বন্ধু, জন কিছুটা উচ্ছল ভাবে বললো, ওর গলা শোনো।
আমি অবাক হলাম সিন্ডির এই অদ্ভূত আচরণে। অহেতুক কিছুদিন সে কষ্ট দিলো জনকে। ওর সেনসেটিভ মনটাকে দুমড়ে মুচড়ে এক প্রকার ফতুর করে দিয়েছে সে। আর এখন আবার ফিরে এসেছে কি মনে করে কে জানে। এখানকার মানুষের মন বড় বিচিত্র। এদের মনের রং এত দ্রুত বদলায় যে বোঝা বড্ড মুশকিল।
হ্যালো আতিক কনগ্রাচ্যুলেশন, অন্যপ্রান্ত থেকে সিন্ডির নরম সুর শুনতে পেলাম। তার গলায় দ্বিধার প্রকাশ।
থ্যাঙ্কস্ সিন্ডি। আমি ভদ্রতা করলাম, তোমার ফিরে আসায় অত্যন্ত খুশী হয়েছি। তুমি তো আমার বন্ধুটাকে জানে মারতে বসেছিলে-।
আই য়্যাম সো সরি আতিক, করুণ শোনালো সিন্ডির কন্ঠস্বর, আর কখনো এমন হবে না, মরে গেলোও না।
তা কাল আসছো তো ?
অফকোর্স, উচ্ছ্বাস ফুটলো সিন্ডির গলায়, উই উইল বি ইউর হোম ইন দ্য মর্ণিং।
ইটস্ মাই প্লেজার সিন্ডি, আই উইল বি হ্যাপী টু সী ইউ।
ওকে, গুডনাইট নাউ-।
গুডনাইট।
বাতি নেভাতে হাত বাড়িয়ে থমকে গেলাম। টেবিলের ওপর লিনোরার জন্যে কেনা ডায়মন্ড রিংয়ের বক্সটা পড়ে আছে। অনেক চেষ্টা করে খাঁটি ডায়মন্ডের এ রিংটি কিনেছি। নজরকাড়া বক্সটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। মা’র কথা মনে পড়লো। মা শখ করে ছেলের বৌয়ের জন্যে গয়না করে রেখেছে। কয়েক হাজার মাইল দূরের একটি গ্রামের আলমিরাতে তা এখনো রক্ষিত আছে। নিজের হাতে বধু বরন করে ঘরে তোলার প্রিয় স্বপ্ন বুকে নিয়ে সে মা শুয়ে আছে অন্ধকার কবরে। মা’র করা সে সব গয়না লিনোরাকে বুঝিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমার মনটা শান্ত হবে না বুঝতে পারছি। এ মুহূর্তে দেশে যাবার জন্যে আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছে। চিরচেনা মেঠো পথে হাঁটার জন্যে, গলা ছেড়ে গাওয়ার জন্যে, মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে মাটি সোঁদা গন্ধ শোঁকার জন্যে আমার মনটা আনচান করে উঠলো। কতটি বছর প্রিয় প্রান্তরে আমার পদচ্ছাপ পড়েনি, আমার কন্ঠস্বর ধ্বনিত হয়নি জোছনাপ্লাবিত রাতের মধুপুরে। এখুনি আমি দেখতে পাচ্ছি ছেলে বেলার সাথীদের অনেকে ছুটে এসেছে আমাকে আলিঙ্গন করতে, দু’টো কথা বলতে। তাদের ছেড়ে কেমন ছিলাম, কোথায় ছিলাম, মনে রেখেছিলাম কিনা জানতে। আত্মহারা আমি সময়ের গন্ডী পেরিয়ে ছুটে বেরিয়ে পড়েছি হারানো সময়ের খোঁজে। হইহই করে ছুটে চলেছি সদলবলে। আমি বুঝি ফিরে পেয়েছি আমার আমিকে। আর অবাক লিনোরা আমার উদ্দমতায় অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলো।
এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে হয়ে এলো। বাতিটা নিভিয়ে বিছানায় কাত হয়ে মাকে বুঝি বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আবেগে আপ্লুত হয়ে এতদিনের কষ্টরা বুঝি মুক্ত হয়ে গেলো অশ্রুধারায়। ’মাগো, আমি আসছি মা, তোমার কাছে আসছি, তোমার বৌকে নিয়ে। কতদিন তোমাকে স্পর্শ করিনি মা, দেখিনি তোমার মুখ। বছরের পর বছর এদেশ সে দেশ ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি মা। আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি মা।’ রাত আমাকে তার কোমল বুকে ঢুকিয়ে নিলো পরম মমতায়।

*********************************