You are currently viewing পিপুফিশু- ১৯ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু- ১৯ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু || আলী সিদ্দিকী

 

কিস্তি- ১৯

গন্ডী ছাড়িয়ে যায় ভাবনা 

সেলফোনটা চার্জে দেয়ার সাথে সাথে রিং বেজে উঠলো। হিউস্টন থেকে সব্যসাচী। প্রায়ই রাত সাড়ে এগারোটা অথবা উইকেন্ডে আমাদের সাথে কথা হয়। কথা কখনোই ব্যক্তিগত গন্ডীতে আবদ্ধ থাকে না। আমাদের দু’জনের চেতনাগত মিলটা এতো বেশী যে, দেশ রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতিই হয়ে ওঠে আমাদের আলোচনার মুখ্য। তার বাঙালী হয়ে ওঠা জার্মান আমেরিকান বউ জেনিফারও এসব নিয়ে আলোচনা করতে আনন্দ পায়। জেনিফারের উৎসাহেই সব্যসাচী এমবিএ আর ডক্টরেট করার পরও আইন নিয়ে বিস্তর কাজ করে যাচ্ছে। সারা আমেরিকা তো বটেই, এখন সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে জাঁদরেল আইনবিদদের সমাবেশে আইন বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে চলেছে। জীবিকার জন্যে কাজ একটা করছে বটে, মূল আগ্রহটা আইনের বিভিন্ন ফাঁক ফোকর বের করে যুক্তিতর্কের জাল বিস্তার করে পেপার তৈরী ও তা উপস্থাপন করায়। তাই আমাদের আলোচনায় এসব বিষয় অবধারিত উঠে আসে। আর আসে আমার লেখার প্রসঙ্গ। যদিও আমি তা নিয়ে আলোচনা করতে সংশয়বোধ করি। কারণ লেখার মতো করে লেখা হয়ে উঠছে না আমার। সংসার সামাল দিতে গিয়ে সবকিছুই চাপা পড়ে যায়। সময়াভাবে মৌলিক লেখা তেমন লিখতে পারি না। হাতটা চালু রাখার জন্যে পত্রিকার পাতায় নিয়মিত কিছু কলাম লেখার চেষ্টা করি। সব্যসাচী তাতেও উৎফুল্ল। বলে, কিছু একটা তো করতে পারছেন দাদা, রেগুলার পিপলদের মতো তো শুধুই ডলারের পেছনে ছুটছেন না। এটা ক’জনেই বা পারে? তাই কথা হলেই সে নতুন কিছু লিখছি কি না জানতে চায়। আজও জানতে চাইলো।
কিছু কি লিখছেন দাদা?
এখনো শুরু করিনি, ভাবছি- আমি মৃদু গলায় বললাম।
নিউজ দেখেছেন?
সাদ্দামের ফাঁসির কথা বলছেন? দেখলাম, মর্মান্তিক।
একতরফা বিচার আর কাকে বলে? ক্ষুব্ধ গলায় বললো সে ওপাশ থেকে, জেনি তো রক্তাক্ত লাশ দেখে কেঁদে ফেলেছে।
কেঁদে কি হবে দাদা? গ্লোবাল রাজনীতির সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে যাবার সাহস কারো নেই।
কিন্তু যারা মানবতার কথা বলে মুখে ফেনা তোলে, অন্যদেশে নাক গলায় সেই দেশের মানুষদের কোন অভিব্যক্তিই দেখতে পেলাম না মশায়, এটাই অবাক হয়ে ভাবছি। সব্যসাচী ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
আপনার তো উপরতলার মানুষদের সাথে মিশবার সুযোগ আছে, তাদের সাথে কথা বলে দেখেছেন ?
কি যে বলেন দাদা ? সব্যসাচীর হাসির শব্দ শুনতে পেলাম, পুঁজির কাছে আত্মবিক্রীত জ্ঞানপাপীদের কাছ থেকে মানবতার জন্যে কিছুই আশা করা যায় না। ওরা যা বলে তা ফাঁকা বুলি মাত্র। এদেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের সকল প্রয়াস নিবদ্ধ রেখেছে পুঁজির শোষণকে বিশ্বব্যাপী বলবৎ করার নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কারের কাজে। লড়াইটা শক্ত হলেও তাই তা করতে হবে পুঁজির শেকল থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া দেশগুলোর মানুষদের। এর কোন বিকল্প নেই।
তা কি সম্ভব হবে দাদা ? যেখানে আমাদের মতো দেশগুলোতে গ্লোবাল রাজনীতির বশংবদ ব্যক্তিবর্গ ক্ষমতাসীন, সেখানে লড়াই করবে কারা ? এসব চিন্তার বাস্তবায়ন কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না দাদা। আমি পষ্ট ভাষায় নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলাম।
নিরাশ হবার কিছু নেই দাদা। অলরেডি লাতিন আমেরিকাতে শুরু হয়ে গেছে। তা ধীরে ধীরে ছড়াবে অন্যান্য দেশে। হয়তো সময় নেবে, ঝরবে অনেক রক্ত। আশাবাদী গলায় বললো সব্যসাচী।
কিন্তু দাদা, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি আর সম্পদের বিশাল পাহাড় এবং অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসী শক্তির সামনে দাঁড়ানো অতো সহজ নয়।
তা জানি, তা জানি- একটু থামলো সব্যসাচী, কিন্তু দেখুন ইরাকের দিকে, আফগানিস্থানের দিকে- আত্মবলি দিয়ে সেখানকার মানুষ শত্রুকে মোকাবেলা করছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সবকিছু বিসর্জন দিতে পারে। আজকের এই পদ্ধতি আগামীতে আরো বহুল ব্যবহৃত হবে আমি আপনাকে তা আগাম বলে দিতে পারি।
কিন্তু এভাবে কি পরাশক্তিকে ঘায়েল করা সম্ভব ?
ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণের মানে কি বোঝেন তো দাদা ?
ধীরে ধীরে মৃত্যু।
বিশ্বের বিলুপ্ত সব সাম্রাজ্যের মতো আজকের পরাশক্তিও আপন শক্তিমত্তার উন্নাসিকতার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এটা অবধারিত এবং ইতিহাস নির্ধারিত।
আপনার ভবিষ্যত বাণী সত্যি হোক দাদা।
ঠিক আছে, আপনি লিখুন, পরে কথা হবে।
ঠিক আছে, ভালো থাকবেন।
সব্যসাচী ফোন রেখে দিলো।
লেখায় আমার মন বসছে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে চলে এলাম। এক টুকরো খোলা চত্বর পেরিয়ে বসন্তের বাতাস আমার শরীরে বুলিয়ে দিলো প্রশান্তির পরশ। রাতের আকাশ বিক্ষিপ্ত কিছু তারা বুকে নিয়ে ঝিম মেরে আছে। ছুটে যাওয়া গাড়ীর শব্দ, দূরান্তের কুকুরের ঘেউ শব্দ, আকাশে ধাবমান বিমান, ভেসে আসা সাকিরার যৌনোমত্ত সুর নীরব রাতের অখন্ডতাকে আবৃত করে রেখেছে।
কি হলো ঘুমুবে না? বিশু পেছনে এসে দাঁড়ালো।
ঘুম আসছে না বিশু–।
এতো কি ভাবছো তুমি ?
ছেলে দু’টো খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত আছে, মেয়েটাকে নিয়ে যে আমি কি করি ?
সেটা একটা ভাবনার বিষয় হয়ে গেছে আফসার, বিশু উদ্বিগ্ন গলায় বললো, এক সাদা ছেলে ওর পিছু নিয়েছে।
কথাটা ঠিক বললে না, আমি বিশুর চোখের দিকে তাকাই, অর্পিও ছেলেটার দিকে কিছুটা ঝুঁকেছে বলতে পারো।
শেষ-মেষ কি মেয়েটাকে হারাবো? একটা আর্তি ফুটে উঠলো বিশুর কন্ঠে।
হারানোর প্রশ্ন আসছে কেন বিশু? আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম, আমরাও তো দুই প্রান্তের মানুষ ছিলাম, আমরা কি হারিয়ে গেছি ? যাইনি। প্রশ্নটা হলো সময়ের। মেয়েটা মাত্র এইট থেকে নাইনে যাবে, কচি বয়েস- টিনএজ। আমেরিকার টিনএজাররা হলো এ সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের সমাজেও তাই। আমাদের রাখঢাকের কারণে সবকিছু প্রকাশ পায় না। অথচ এমন কোন টিনএজার কি তুমি পাবে যারা এদেশের টিনএজারদের মতো ভেসে বেড়ায় না ? এটাই বয়েসের ধর্ম।
কিন্তু একবার পিছলে পড়লে কি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে তোমার মেয়ে ?
সে তো জানি, আমি চিন্তিত গলায় বললাম। আমাদের সহায়তা ওর দরকার। ওকে বোঝাতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। একমাত্র স্বপ্নই অর্পিকে রক্ষা করতে পারে।
তুমি ভুল বললে, বিশু ক্ষুন্ন গলায় বলে, আমাদের সহকর্মী ন্যান্সী বলে কি জানো ?
আমি উৎস্যুক হলাম।
বলে, কোন স্বপ্ন নেই বলে টিনরা সব বখে গিয়ে খুন খারাবি আর মাদক নিয়ে মেতে আছে। এ জন্যেই নাকি ফিলাডেলফিয়াতে এতো হোমোসাইড হচ্ছে।
কথাটা মিথ্যা নয়, আমি সায় দিলাম, ব্যাপারটা হলো পরিবার থেকে কোন এটেনশান বাচ্চারা পাচ্ছে না। তারা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন। পেরেন্টরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাদের পারিবারিক জীবন আমাদের মতো নয়। আমাদের মতো কম্প্রোমাইজ এদেশের পেরেন্টরা করে না। তাই স্পিøটেড ফ্যামিলি এখানে খুব বেশী। আর এসব ফ্যামিলির বাচ্চারা বেড়ে ওঠে নিজেদের মতো করে। ফ্যামিলির স্নেহ মমতা থেকে পিয়ার প্রেসারটা ওদের কাছে বেশী আকর্ষনীয়। তাই ওরা স্বপ্ন দেখার পরিবেশ পায় না। কিন্তু অর্পিও তো সে সুযোগ আছে। আমরা চেষ্টা করলে ওকে ঠিক পথে রাখতে পারবো। তাছাড়া আমাদের তো অন্যদের মতো কোন সুচিবায়ু নেই। মেয়ে পছন্দ করলে তো আমাদের আপত্তি নেই।
কিন্তু শুধু একটা সার্টেন সময়ের পরে করুক এটাই চাই- বিশু আমার কথাটার সমাপ্তি টানলো।
তাই আমি ভাবছি- আমি আরেকটা সিগারেট বের করলাম।
প্লিজ এখন আর খেয়ো না- বিশু হাত ধরে ফেললো।
ওকে।
সিগারেটটা প্যাকেটে রেখে দূর আকাশে ছুটে যাওয়া প্লেনের দিকে তাকালাম, অর্পিকে সময় নিয়ে বোঝাতে হবে।
আমেরিকার টিনএজদের আমি বুঝতে পারি না আফসার, বিশু বিষন্ন গলায় বললো।
আমাদের টিন টাইম তো এখানে কাটেনি, আমি কৌতুক মাখলাম গলায়, তাহলে অনেক ফান হতো। এদের উদ্দামতা এখন যেমন খটকা লাগায় চোখে, মনের ভেতর কেমন যেন সংকীর্ণ ভাব জাগায়, তার বদলে উঠতি বয়েসের বাচ্চাদের আনন্দটুকু আমরাও এনজয় করতে পারতাম।
মাঝে মধ্যে তুমিও এমন করে কথা বলো না! আমার সবকিছু আউল বাউল হয়ে যায়, বিশুর গলায় ক্ষুন্নতা ফুটে ওঠে, তুমিও এদেশের অনেককিছু খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করে ফেলেছো। তোমার এডাপ্টিভ পাওয়ার আমার থেকে অনেক বেশী।
তাই? আমি হাসলাম শব্দ করে, কতোগুলো সাধারণ বিষয়ে আমাদের অনেক মিল থাকলেও অনেক বিষয়ে অমিলও আছে বিশু। অনেক বিষয়ে তুমি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারলেও অনেক বিষয়ে পারো না। এটা তোমার দোষ বা আমার গুণ নয়। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা অর্জন। এই যে একটি এককেন্দ্রিক সমাজ সংস্কৃতি থেকে আমরা বহুজাতিক সংস্কৃতির দেশে এসেছি তাতে একটি গুণগত পরিবর্তন তো হয়েছে, নাকি ?
তাতো বটে, একটু চিন্তিত শোনালো বিশুর গলা, তাই বলে নিজস্বতা বিসর্জন দিতে হবে?
মোটেও না। আমি জোর দিয়ে বললাম, যেমন পারসিক কিংবা ভারতবর্ষীয়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলেও তাদের আবহমানকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কিন্তু বিসর্জন দেয় নি। বরং ইসলামের সাথে অবগাহিত আরবীয় সংস্কৃতির অনেককিছু তারা গ্রহন করেছে ঠিকই কিন্তু তার সাথে মিশেল দিয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য-কৃষ্টিকে। এদেশেও দেখো, সারা বিশ্বের নানা বর্ণ ও ধর্মের লোক একই স্রোতধারায় মিশে গিয়েও নিজস্বতাকে বিসর্জন দেয় নি। সংমিশ্রণ ঘটছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে। যদি কেউ বলে আমরা আমাদের নিজস্বতাকে বিসর্জন দেবো না, সংমিশ্রণ ঘটাবো না কিন্তু স্রোতধারায় মিশে যাবো। তা অপরিপক্ক ও সংকীর্ণ ভাবনা। এটি হলো আত্মরক্ষার নামে স্রোতধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার সংকীর্ণ প্রয়াস। এভাবে হয়তো ফার্স্ট জেনারেশন নিজেদের রক্ষা করতে পারবে কিন্তু এখানে বেড়ে ওঠা জেনারেশন পড়বে নানান সমস্যায়। হয় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে মূল স্রোত থেকে, নয়তো প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে পশ্চাপদ অবস্থান বেছে নেবে। তাই শিশুদের ডুয়েল ক্যারেক্টারের চক্করে না ফেলে দুইয়ের মিশেল ঘটিয়ে দিলে আখেরে ওদেরই মঙ্গল হবে। লেকচারটা খুব লম্বা হয়ে গেলো না ?
শুনতে ভালোই লাগছে, হাসলো বিশু, কিন্তু অনেক কথা বেশ শক্তই মনে হলো। মানুষ তোমার কথা শুনলে এদেশের দালাল বলে অভিহিত করবে।
সেতো স্বাভাবিক। এদেশে থাকবে, খাবে, বাচ্চা জন্ম দেবে, ছেলে মেয়ে মানুষ করবে অথচ এদেশকে ঘৃণা করবে- এটাই হলো কৃতঘœতার মানসিকতা। ধর্মীয় সংকীর্ণতায় মোড়ানো বাঙালী চরিত্রের এটি এক সহজাত উপাদান। দেশের রাজাকার-আলবদরদের ভুমিকা বিচার করলে তুমি এর ভালো উদাহরণ পাবে। ওদের ভাবনা নিয়ে আমি ভাবি না।
উত্তেজিত হয়ো না, কাঁধে বিশুর হাতের স্পর্শ পেলাম।
আমি উত্তেজিত নই, ক্ষুব্ধ।
এতে কারো বোধোদয় হবে না।
জানি, আমি সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম, সবচেয়ে কঠিন হলো মানুষের অন্ধ ধারণার পরিবর্তন ঘটানো।
এতোটি বছর তোমার সাথে আছি, আমার সব ধারণার কি পরিবর্তন হয়েছে? হয় নি।
গতানুগতিকতায় ভেসে যাওয়া জীবনে চিন্তাগত পরিবর্তন সহজ নয় বিশু। তবে হচ্ছে অতি ধীরে-।
সেটা কেমন করে?
শব্দ সময়ের সংঘাতে।
কঠিন লাগছে।
যেমন ধরো, তোমার ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন যে সব শব্দ ব্যবহার করছে তাতে তুমি চমকে উঠছো। যেমন ওরা অহরহ সেক্স কথাটা বলছে, বলছে ফাক য়্যু, বলছে ফ্যাগ ইট, গে জাতীয় শব্দ। যা তুমি শুনতে অভ্যস্ত নও। কিন্তু তা ওদের ভাবের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। ওরা এসব শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে তোমার মতো ভিরমি খাচ্ছে না। সেক্স বলতে ওরা লিঙ্গ যেমন বোঝায়, তেমনি দৈহিক সম্পর্কের ব্যাপারটাও বোঝায়। প্রথম প্রথম তুমি জিভে কামড় দিলেও এখন তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাও না। অর্থ্যাৎ শব্দের সাথে পরিচিত হতে গিয়ে তুমিও ভাবের সাথে পরিচিত হয়ে যাচ্ছো। এবং তোমার চিন্তাগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
তুমি এতো ভাবো কখন ? অবাক কন্ঠে বলে বিশু।
ভাবনা যখন আসে তখন, আমি হাসি।
কিন্তু ওরা তো অনেক খারাপ শব্দ শেখার মধ্য দিয়ে খারাপ মনোভাব অর্জন করছে-।
খারাপ শব্দ? আমি শব্দ করেই হাসলাম, পুরি বলতে সবাই ডালপুরি বোঝালেও সিলেটীরা কিন্তু মেয়ে বোঝায়, জানো তো নাকি?
তা জানি।
তেমনি সেক্স শব্দটি কিন্তু লিঙ্গ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমাদের সংকীর্ণ ভাবনায় তা শুধু নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্কতেই সীমাবদ্ধ আছে। যা একটি গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে শব্দ তার রং বদলায়, বদলায় অর্থ।
আসলে তোমার চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক বেশী। আমি যদি জেনিফারের মতো সংসারের হাল ধরতে পারতাম তাহলে তুমি এখানে পড়াশোনা করে ভালো করতে পারতে, বিরস কন্ঠে আক্ষেপের সুরে বললো বিশু।
দূর পাগলী! আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম, তুমি সংসারের জন্যে এখন যা করছো তার কি তুলনা হয়? তোমার সহযোগিতা না পেলে এখন যা করতে পারছি সাধারণ মেয়ে হলে তো তাও পারতাম না।
তুমি এটা বুঝ দেবার জন্যে বলছো-।
মোটেও না, ওর মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলাম, তুমি আমার তিন সন্তানের মা। ওদের মানুষ করার জন্যে তুমি যে কষ্টটুকু করছো তার কোন মূল্য দেয়া যায় না বিশু।
তবুও, তার চোখে জল উপচে ওঠে, আমি যদি আরো স্মার্ট হতাম তাহলে তোমার অনেক কাজে আসতাম। তুমি নিজেকে আরো বিকশিত করার সুযোগ পেতে।
এখন আমি যে শান্তিটুকু, যে সুখটুকু সংসার থেকে পাচ্ছি সবই তোমার অবদান বিশু। এর মধ্য থেকে যতটুকু সম্ভব আমি আমার কাজ করে যাবো। তাছাড়া ছেলে মেয়েগুলো আরেকটু বড়ো হলে তো আমি অনেক সুযোগ পাবো, তখন দেখা যাবে।
এ সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ী ছুটে গেলো মেইন স্ট্রীটে। প্রতিবেশী স্টিভের কুকুর বাউন্সার ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। বাতাসের শব্দে কেঁপে উঠলো বাগানের গোলাপ ঝাঁড়।
উইড-এ বাগান ভরে গেছে, একটু হাত লাগানোর সময় পাই না- আপন মনে বলে বিশু।
আদিব-আবিরের টুর্নামেন্ট শেষ হলে হাত লাগাবো।
এদিকে সামার শেষ হয়ে আসছে, কোথাও যাওয়া হলো না।
দেখি কি করা যায়।
এখন ঘুমুতে চলো, সেই তো ছয়টায় উঠতে হবে।
ঘুম আসছে না বিশু।
গোসল করবে?
না।
চলো মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
চুলে বিলি কেটে, খালি পিটে হাত বুলিয়ে বিশু আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। আমি যেন এক শিশু। বুড়ী বিরান্ডা যেমন তার বয়ফ্রেন্ডকে বলে, মাই বেবী। তেমনি আমি যেন এক বেবী, বিশুর বেবী। ওর হাতের স্পর্শ আমার চেতনাকে ধীরে ধীরে ঘুম পাড়াতে থাকে। মা যেমন পাড়াতো দস্যি বেলায়।
মনে হলো, মা-ই।
আমি মুখ গুঁজতে লাগলাম, মা, মা-রে-।

*********************************