You are currently viewing পিপুফিশু-১১ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু-১১ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

কিস্তি – ১১

সংকীর্ণতায় দমবন্ধ 

রাতের নির্জনতা খান খান করে দিয়ে টেলিফোনটা তারস্বরে চিৎকার করছে। চোখ খুলে দেখি, রাত তিনটা। এ সময় আবার কে ফোন করলো। ভাবলাম, বিশাখা নয় তো ? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে রাতের শিফটে কাজ করছে। না হলে লে
অফ হয়ে যেতো। অন্ততঃ হেলথ ইন্স্যুরেন্সের জন্যে হলেও তাকে কাজ করতে হবে। মাস কয়েক ধরে তার শরীরে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ইন্স্যুরেন্স ছাড়া আমেরিকায় বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য। পুঁজির শাসনে মানুষ এখানে একেবারে যন্ত্র। আমরাও এই যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই বাধ্য হয়ে বিশাখাকে রাতের শিফটে কাজ নিতে হয়েছে। ও ঘরে ফেরার আগেই আমাকে চলে যেতে হয়। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে, রান্নার কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিতে না নিতে দূপুর গড়িয়ে যায়। আমি বিকেলে যখন ফিরি তখন সে থাকে ক্লান্ত। রাতের শিফটের কাজ প্রাণশক্তি নিংড়ে নেয়। ওর দিকে তাকালে আমার বুক ফেটে যায়। তাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছি কোন ব্যবসা যোগাড় করতে। তাহলে যদি ওর কষ্ট একটু লাঘব হয়। কিন্তু স্বল্প পুঁজিতে কোন ব্যবসাই সম্ভব নয়। কোন রকম রিস্ক নিতেও ভয় করে। সংসার চালিয়ে দেশে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে সঞ্চয় করা অসম্ভব ব্যাপার। কি যে করি ! বড্ড অস্থির লাগছে।
এখন বিশাখার ব্রেক টাইম। কোন জরুরী দরকারে সে ফোন করলো কি না ভেবে লাফ দিয়ে উঠে টেলিফোন ধরলাম।
হ্যালো -।
ভাই আমি জয়নাল -।
কোন জয়নাল ? অপর প্রান্তে অপ্রত্যাশিত কন্ঠ শুনে বিরক্ত হলাম।
গ্রীন স্ট্রীটে আমার বাসা -।
তা এতো রাতে কেন ফোন করেছেন, চিনতে পারলাম। জয়নালের বউ মুক্তি বিশাখার সাথে কাজ করে। হঠাৎ মনে হলো বিশাখার কিছু হয় নি তো ?
মুক্তি কি আপনাদের বাসায় গেছে ?
আমাদের বাসায় ? এতো রাতে ? আমার ভেতরটা হঠাৎ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো, কি বলছেন পাগলের মতো ?
সে কাজেও যায় নি, বাসায়ও ফেরে নি, অপর প্রান্তে জয়নালের হতাশ গলা, আপনাদের তো সে খুব পছন্দ করে তাই ভাবলাম আপনাদের কাছে গেলো কি না।
আপনি কি জানেন আপনার ভাবী কাজে ?
জানি।
তাহলে কি করে ভাবলেন সে আমাদের এখানে আসবে ? তাও এ রাতের বেলা ? মেজাজটা খিঁচে উঠলো।
সে আপনাকে খুব লাইক করে, তাই – ।
হোয়াট ? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, আপনি জানেন আপনি কি মীন করছেন ? আপনি এতো ইতর, নিজের বউকে সন্দেহ করছেন আবার আমাকে অপবাদ দিচ্ছেন ?
না, মানে – জয়নাল আমতা আমতা করতে লাগলো।
আপনি একটা স্টুপিড। ধপাস করে ফোনটা রেখে দিলাম।
মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি মধ্যরাতে এমন একটা সংবাদ আমাকে শুনতে হবে। এটা তো এক ধরণের কলঙ্কারোপ। লোকটার কি স্পর্ধা, সে কি না নিজের বউকে জড়িয়ে আমার সম্পর্কে এমন ধারণা করতে পারে। আমার ঘুম ছুটে গেলো চোখ থেকে। বুকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একগ্লাস পানি খেলাম ঢক ঢক করে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের দরোজায় এসে বসলাম। রাতের নিঝুম প্রকৃতি মুড়ে আছে অন্ধকারের চাদরে। বাতাসে হিমেল পরশ। আমার ভাবনাগুলো অবিন্যস্ত হয়ে গেলো।
মুক্তি নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর মেয়ে। যেমন দীর্ঘাঙ্গী তেমনি সুন্দর। চলা ফেরা, কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা মার্জিত রুচির ছাপ আছে। কমবয়েসী একটা যুবতীর যেমন প্রাণ চাঞ্চল্য শোভনীয় তার সবটাই মুক্তির মধ্যে আছে। অল্পদিনেরই পরিচয় ওদের সাথে। কিন্তু এই স্বল্প সময়েই বিশাখার মাধ্যমে জেনেছি, মুক্তিকে পারিবারিকভাবে সারাক্ষণ নানা রকম নির্যাতনের ভেতর দিয়ে দিন কাটাতে হয়। শ্বাশুড়ী আর ভাসুরের বউয়ের অত্যাচারে সে অতিষ্ট। স্বামী জয়নালও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে তাকে নানাভাবে নির্যাতন করে। এমনকি নিজের আয়ের সব টাকাই জয়নাল নিয়ে নেয়। মুক্তিকে নাকি ওর নামে কোন একাউন্টও করতে দেয় নি। সবারই তো নিজের বাপ-মা, ভাইবোনদের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হয়। আমেরিকায় মেয়ে থাকে, দেশে সবার ধারণা মেয়ে কি আর বাবা- মাকে কিছু না কিছু সাহায্য করে না ? অথচ গত পাঁচ বছরে মুক্তি নাকি বাবা মা’র জন্যে পাঁচশ’ ডলারও পাঠাতে পারে নি। নিজে ইনকাম করলে কেউ কি আর সারাক্ষণ স্বামীর কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে খরচ করতে চায় ? ইনকাম মানুষের স্বাধীনতাকে জাগ্রত করে দেয়। এটা অনেকেই বুঝতে চায় না। বিশেষতঃ আমাদের সমাজের মানুষেরা। আমরা দেখি, অভিভাবকরাও ছেলে মেয়েদের ইনকামের বিষয়ে সন্দিহান থাকে। বহির্মুখী মানুষের রাশ টেনে ধরা যায় না। আর সারাক্ষণ হিসেবও চাওয়া যায় না।
মুক্তিকে, না শুধু মুক্তি কেন, অনেক বাঙালী নারীকে এই আমেরিকাতেও সারাক্ষণ নানা বিড়ম্বনা সইতে হয়। এমনও শোনা যায়, পে চেক আসলে স্বামী ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে নিজের একাউন্টে জমা করে দেয়। বউয়ের নামে কোন একাউন্ট করতে দেয় না বেশীর ভাগ বাঙালী স্বামী। এমনকি কাজে যাবার জন্যে সুযোগ থাকলেও অনেকে বউকে রাইড দেয় না। বলে, বাসে যাও।
এসব এলাকায় ঘন্টায় একটা বাস আসে। হাঁটু পরিমাণ বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যে কি দুঃসহ তা ভূক্তভোগীরাই জানে। অথচ পে চেক কেড়ে নিতে ওসব স্বামীদের বিবেকে আটকায় না। মুক্তির স্বামী জয়নালও এমন। ওকে তো কাজ করতে কোন সহায়তা করে না, বরং সারাক্ষণ জ্বালাতন করে। একটা তরুণী কেন এমন উপেক্ষা সহ্য করবে ? তাই সে প্রতিবাদ করে অন্যায়ের। ফলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে। কতো ভাবে যে অত্যাচার করে বিশাখার মুখে শুনে আমি অবাক হয়েছি।
বলো কি ?
কি আর বলছি, বিশাখা বেদনার্ত গলায় বলে, ওর স্বামী নাকি প্রায় ওকে রেপ করে। ওর সারা শরীরে কামড়ের দাগ দেখে তো আমি আঁতকে উঠেছি।
কি বলছো তুমি ?
সত্যি আফসার তুমি যদি দেখতে তাহলে ক্ষেপে যেতে-।
মুক্তির তো ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত।
তা হলে তো আর সংসার করা হয়ে উঠবে না- বিশাখা ম্লান কন্ঠে বললো।
হুম ! আমি গুম হয়ে গেলাম।
আসলে আমাদের গরীব দেশের মানুষ মেয়েদের জন্যে আমেরিকান পাত্র পেলে আর কোন কিছু বিবেচনা করে না। মেয়ের সুখ আর সুন্দর ভবিষ্যতের কামনা সকল বাপ মা করে থাকে। এখন সুখের সংজ্ঞা কার কাছে কেমন তার ওপর নির্ভর করে বিচার বিবেচনা। আর্থিক স্বচ্ছলতা সুখের প্রধান মাপকাঠি বিবেচিত হয় বলে বাবা মা মেয়েদের স্বচ্ছল পাত্রের কাছে পাত্রস্থ করতে চায়। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু দেশে সেটা এক ধরণের আর বিদেশে আরেক ধরণের। দেশে তো মেয়ের খোঁজখবর নেয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয় কিন্তু বিদেশে ? সে তো মুক্তির মতো মেয়েদের অবস্থা দেখে সহজেই বোঝা যায়। মুক্তিকে বাবা মা’র সাথে ফোনে কথা বলার সময় ’আমি ভালো আছি, সুখে আছি’ ভাব ফোটাতে হয়। আর ফোন রেখে বাথরুমে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে হয়। কারণ বাঙালী মেয়ে স্বামীর সংসারে যতোই অত্যাচারিত হোক, নিগৃহীত হোক, সে বাপ-মাকে বলে, আমি সুখে আছি। ভালো আছি।
ভাবে, ওদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি ?
বিশাখার মুখে আরো শুনেছি, মুক্তির শ্বাশুড়ী নাকি ওকে রাতে কাজ করে আসার পর দিনে ঘুমাতেই দেয় না।
কেন ?
বলে নাকি, সে কি কথা ! মেয়েদের জন্ম তো ছেলেদের সুখের জন্যে। তুমি যখন রাতে কাজ নিয়েছো তখন তা দিনেই পুষিয়ে দিতে হবে।
কি জঘন্য কথা ! আমি ধিক্কার দিয়ে উঠি, এমন অসভ্যদের সংসারে মুক্তির বাবারা কি করে বিয়ে দিলো মেয়েটাকে ?
ও বলে, বিশাখা বললো, ওর বাবা রাজী ছিলো না। ওর মা একপ্রকার জোর করে বিয়ে দিয়েছে। বেচারা সবেমাত্র ইন্টার পাশ করেছে তখুনি বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন মেয়েটা হাবুডুবু খাচ্ছে।
পরিবারে যখন এমন অবস্থা তখনতো অঘটন ঘটতেই পারে। একজন তরুণী, যার বয়েস মাত্র একুশ বাইশ তার তো অনেক স্বপ্ন বাসনা থাকতে পারে। এ বয়েসে সকলে ভালোবাসার কথা শুনতে ভালোবাসে। সবাই চায়, তাকে কেউ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসুক, তার আকাঙ্খাগুলোকে শ্রদ্ধা করুক। প্রত্যেকের মনেই থাকে একটা নিজস্ব ভূবন। একমাত্র ভালোবাসার মানুষটাই সে ভূবনে প্রবেশাধিকার পায়। মুক্তি তো কোন কিছুই পায় নি। কঠোর বেষ্টনীর মধ্যে মানুষ কখনো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। মুক্তিও অনেকদিন হাঁসফাঁস করছিলো। এখন হয়তো কেউ তার হৃদয়ে ঝড় তুলেছে, কোন নতুন বাঁশী হয়তো তার ভেতরে জাগিয়ে তুলেছে নতুন কামনা। তাই কাজে যাবার ছল করে সে ছুটে বেরিয়ে গেছে আপন পথে, রাতের আঁধারে।
এমন অনেক ঘটনা আমেরিকার বাঙালী কমিউনিটিতে অহরহ ঘটছে। বাঙালী পত্রপত্রিকায় এসব নিয়ে মুখরোচক বহু কাহিনী ছাপা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ, বিচ্ছেদ আর পরকীয়ার মত ঘটনা বলতে গেলে লেগেই আছে। সবাই জানে এর পেছনে পারিবারিক অনেক ঘটনা যুক্ত থাকে। কিন্তু আখেরে মেয়েদের দোষই সবাই দিয়ে থাকে।
যা এখন মুক্তির ক্ষেত্রেও ঘটছে।
কিন্তু সেখানে আমাকে জড়িয়ে সন্দেহ পোষণ করার কারণ কি ? আমি তো ওর সাথে এমন কোন অসংলগ্ন বিহেভ করিনি। তাছাড়া ওকে আমরা ছোট বোনের মতই দেখেছি। আর আমার সাথে ওর দেখাই হয়েছে মাত্র দুয়েকবার। তাহলে জয়নালের মুখ দিয়ে এমন কথা বেরুলো কি করে ? মুক্তি নাকি আমাকে খুব ’লাইক’ করে। এর অর্থ কি ? কিছুদিন আগে বিশাখা এ প্রসঙ্গে বলছিলো।
জানো, মুক্তি তোমার খুব প্রশংসা করলো -।
তাই নাকি ? আমি হাসি, তা কি নিয়ে এতো গুণগান ?
তুমি খুব অমায়িক, সজ্জন, উদারমনস্ক আর প্রচন্ড ব্যক্তিত্বশালী – বেশ রসিয়ে বললো বিশাখা।
তা সে কি করে এসব আবিষ্কার করলো ?
কি জানি !
কেমন যেন কন্ঠে শীতলতা ফোটায় বিশাখা।
এর মানেও বা কি ? মানুষের মনটা বড়ো কুটিলতায় ভরা। বিশাখার মনে যদি শীতলতা ফোটে তাহলে মুক্তির স্বামীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধাটা অসম্ভব কিছু নয়।
এটা ভেবে মনটা আমার বিষিয়ে গেলো। মনে হচ্ছে আমাকে অপমান করা হচ্ছে। এমন অপবাদ নিয়ে তো নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। বুকের ভেতর কাঁটার দংশন সয়ে নির্বিকার থাকা সম্ভব নয়। বিশাখা আসলে মুক্তিদের বাসায় গিয়ে ওদের ভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করতে হবে। ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে, অন্যায়ভাবে কাউকে অপমান করার কোন অধিকার তাদের নেই।
ভাবতে ভাবতে আমি একের পর এক সিগারেট টেনে যেতে লাগলাম। মাথার ভেতর কেমন এক শূন্যতা খাঁ খাঁ করছে। দেখতে দেখতে কম্পাউন্ডের খোলা মাঠে দিনের আলো ক্রমশঃ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে লাগলো। লোকজন কাজে যাবার জন্যে গাড়ী স্টার্ট দিচ্ছে। আমারও এখন কাজে যাবার সময়। কিন্তু বিষয়টা নিস্পত্তি না করে আজ কোথাও যাবো না। আমার কাজ থাক আর যাক। আমি কাজের ওখানে ফোন করলাম।
হ্যালো স্টিভ ?
ইয়েস আফসার, স্টিভ চমকে উঠলো যেন, কারন এখন তো আমার কাজে পৌঁছে ওকে রিলিফ দেবার কথা, এ্যানি থিং রং আফসার ?
ইয়েস, একটু ভাণ করলাম, আই ক্যান নট কাম টু ডে, আই অ্যাম ফিলিং ভেরি সিক -।
ওকে, উই উইল ম্যানেজ টু ডে, সহৃদয় গলায় বললো সে, টেক কেয়ার ইউরস্যালফ -।
থ্যাঙ্ক ইউ মাই ফ্রেন্ড।
দ্যাটস ওকে।
এরপর দু’কাপ চা বানালাম। বিশাখা এসে এক কাপ চা পেলে খুশী হবে। তাছাড়া কোন দিন সকালে তো আমাকে পায় না। আজ দেখে হয়তো চমৎকৃত হবে। তারপর যখন জয়নালের কথা বলবো তখন রেগে একেবারে আগুন হয়ে যাবে। তখুনি হয়তো মুক্তিদের বাসায় যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠবে। কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলে না পাঠিয়ে বেরুনো যাবে না। আসুক সে।
টিভি অন করে আমি সিএনএন দিলাম।
আরে একি !
দেখা যাচ্ছে বাগদাদের মিউজিয়াম লুট করে নিচ্ছে একদল লোক। সবার হাতে অস্ত্র। সমস্ত দলিল দস্তাবেজ, পান্ডুলিপি, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে দিয়ে যাচ্ছে। ওদের কেউ বাধা দিচ্ছে না। ঘোষক বলছে, বাগদাদের এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে মেসোপটোমীয় সভ্যতার সব দলিলপত্র। মার্কিন সৈন্যদের উচিত ছিলো এই গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটা ওদেরই দায়িত্ব ছিলো।
অপরদিকে দেখালো, রাতের আকাশে তীব্র সাইরেন বাজিয়ে মার্কিন জঙ্গী বিমানগুলো টন টন বোমা ফেলছে বাগদাদের ওপর। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশে উড়ছে কুন্ডলী পাকিয়ে। আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ) মাজার চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে বুক চাপড়ে এক বৃদ্ধকে মাতম করতে দেখা গেলো। সম্মুখযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত ইরাকী সৈন্যদের লাশের সারি পড়ে থাকতে দেখালো টিভি ক্যামেরা।
আমি হতবাক হয়ে সেই ধ্বংসযজ্ঞের বীভৎস চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, মানুষ যে এখনো অসভ্য রয়ে গেছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে আমেরিকার এই একপেশে বলপ্রয়োগ আর নিরীহ জনপদের ধ্বংসলীলা। ধিক ! সভ্যতার গর্বকারী উন্নত দেশগুলোকে। তারা সবাই যদি আজ জার্মানী, ফ্রান্স আর রাশিয়ার সাথে একমত হয়ে আমেরিকাকে বাধা দিতো তাহলে আমেরিকার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। আসলে পৃথিবীর শক্তিকেন্দ্র বর্তমানে এককেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকায় কেউ জোরালোভাবে প্রতিবাদ করে নি। তাছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর একজোটে মধ্যপ্রাচ্যকে শোষণের স্বার্থেও কেউ আমেরিকাকে বাধা দেয়ার চিন্তা করে নি। সব তোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি তোড়।
কি ব্যাপার, তুমি কাজে যাও নি ? ঘরে ঢুকে লাঞ্চ ব্যাগটা টেবিলে রেখে পাশে এসে দাঁড়ালো বিশাখা। তার চোখেমুখে উদ্বেগ।
দেখো না কি হচ্ছে – আমি হাত ধরে টেনে বসালাম।
ইরাকে হামলা ? গলায় তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে বিশাখা, সে তো হবেই জানতাম।
দেখো না বাগদাদ মিউজিয়াম লুট হয়ে গেছে – আমি ওকে জাগিয়ে রাখার জন্যে বললাম। সকালে বাসায় ফিরে ক্লান্তিতে হাত পা অবশ হয়ে আসে। হঠাৎ চায়ের কথা মনে পড়লো। এক লাফে উঠে মাইক্রোওয়েভে চাপিয়ে দিলাম। পিরিচে কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট নিয়ে চা-সহ ওর সামনে রাখলাম।
নাও চা-টা খেয়ে নাও।
তা তুমি যাওনি কেন ? একটা টোস্ট চা-তে ভিজিয়ে মুখে তুলতে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো আমার দিকে।
শরীরটা হঠাৎ কেমন যেন লাগলো, তাই – আমি মুখের কথা গিলে ফেললাম।
কেমন লাগছে ? উৎকন্ঠিত হলো সে।
না, তেমন কিছু না – ওকে আশ্বস্ত করতে হাত ধরলাম, মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিলো -।
বললাম ইন্ডিয়ান ডাক্তারের কাছে গিযে একটু চেক আপ করাও, আমার কথা তো কোন দিন শুনবে না – অভিমানে মুখ ফোলালো সে। জানতাম এমনই হবে। কিন্তু সরাসরি সত্য কথাটা বলে ফেললে যদি ওর টেনশন বেড়ে যায়, সে ভয়ে বলতে পারছি না। আমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলাম।
তা কাজের খবর কি ?
নতুন আর কি ? সে মুখ মোচড়ালো, খালি ফাস্টার, ফাস্টার, খালি পুশ আর পুশ। তবে মজার এক ঘটনা ঘটেছে -।
কি হয়েছে ? আমি উৎস্যুক হলাম (তবে ঘটনা তো আমার জানা )।
মুক্তি রাতে কাজে আসে নি। রাত আড়াইটায় ওর হাজবেন্ড ফোন করেছে সুপারভাইজারকে। সুপারভাইজার তো কিছু জানে না। জানি আমরা ক’জনে।
কি জানো ?
ও কেন কাজে আসে নি, কোথায় গেছে – রহস্য করলো বিশাখা।
কেন আসে নি ? কোথায় গেছে সে ?
আসলে তোমাকে বলা হয়ে ওঠে নি, বিশাখা একটু মলিন হয়ে বলতে লাগলো, কিছুদিন ধরে মুক্তি এক ইন্ডিয়ান ছেলের সাথে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের শিফটের সবাই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। আমি ওকে সতর্ক করেছি। কিন্তু সে শোনেনি। অই ছেলের সাথে সে বাইরে রাত কাটিয়েছে। আজ প্রথম না, আগেও করেছে কয়েকবার।
ওর হাজবেন্ড কি তোমার সাথে কথা বলেছে ?
বলেছে, বলে কিচেনের দিকে গেলো সে, কিন্তু আমি বলেছি কোথায় গেছে আমরা কেউ জানি না।
সত্যটা বললে বোধ হয় ভালো করতে -।
এ কথা বলছো কেন ? বিশাখা ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালো।
মুক্তির স্বামী রাত তিনটায় বাসায় ফোন করেছিলো।
কেন ? অবাক হলো বিশাখা।
ওর ধারণা মুক্তি কাজ ফাঁকি দিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে।
এর মানে কি ? বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠ বিশাখার।
তুমি কাজে, আমি বাসায় আর মুক্তি এসেছে এখানে – এই সাদা কথার অর্থ কি তুমি বুঝতে পারছো না ?
এটা তো মিথ্যা অপবাদ – ক্ষুব্ধ গলায় বললো সে।
আর সেই অপবাদের যন্ত্রণায় রাত তিনটা থেকে আমি ছটফট করছি, একটুও ঘুমুতে পারি নি।
এটা মেনে নেয়া যায় না, বলে সে ফোন হাতে নিলো।
কি করছো ? আমি বাধা দেবার চেষ্টা করলাম না।
একটু দাঁড়াও- বিশাখা মুক্তিদের বাসায় কল করলো।
হ্যালো, কে জয়নাল ? হ্যাঁ আমি বিশাখা আপা। মুক্তি কি ঘরে এসেছে ? কি বলছেন ? সে ড্রইংরুমে ছিলো ? আপনি দেখেন নি ? ঢং করার বুঝি জায়গা পান না ? শুনুন, মুক্তি কাল সারারাত ইন্ডিয়ান ছেলে জুনুর সাথে ওর এক বন্ধুর বাসায় ছিলো। কাল শুধু নয় এর আগেও ওরা আরো কয়েকবার রাত কাটিয়েছে। আমাদের অফিসের সবাই তা জানে। আপনার এতো বড়ো স্পর্ধা আমার স্বামীকে এ ব্যাপারে অপবাদ দিয়েছেন ঘুম ভাঙিয়ে ? আগে নিজের ঘর সামলান। যত্তসব স্টুপিড পিপল ! ধপাস করে সে ফোনটা রেখে দিয়ে হাঁফাতে লাগলো।
মাই গড ! তুমি এভাবে বলতে পারলে ? আমি ওর প্রচন্ড আক্রোশে বলার ভঙ্গী দেখে সত্যিই অবাক হলাম।
কেন পারবো না শুনি ? তোমাকে এভাবে কেউ মিথ্যা অপবাদ দেবে আর আমি বুঝি মুখ বুঁজে সহ্য করবো ? তা কখখনো হবে না – বলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো।
এ্যাই বিশু, এমন করে না পাগলী, আমি ওর মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম, আমি জানি তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো।
প্রমিস করো,তুমি আর কখনো কাউকে দরদ দেখাতে যাবে না।
প্রমিস, আমি ওর গালে আলতো চুমু দিলাম, পাগলী।
এটা তো পরিষ্কার যে, পুরুষ হয়ে কোন নারীর প্রতি আন্তরিকতা দেখানো মানেই দরদ দেখানো আর দরদ দেখানো মানেই হলো কুৎসিত ইঙ্গিতের ভাগীদার হওয়া!
উফ!

**********************************