You are currently viewing পিপুফিশু, কিস্তি-৫ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু, কিস্তি-৫ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

জনস্রােতে সমস্বরে

সেন্টার সিটিতে পৌঁছে পার্কিং লটে গাড়ীটা রেখে যখন রাস্তায় পা দিয়েছি তখন আকাশে রোদে মেঘে লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেছে। কয়েক ব্লক পার হয়ে মার্কেট স্ট্রীটে এসে দেখি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে পুরো রাস্তাঘাট। নানা রকম প্লেকার্ড, ফেস্টুন আর ব্যানার নিয়ে নানা বর্ণের মানুষ কলরোলে মেতে আছে। প্লেকার্ড ফেস্টুনে লেখা হয়েছে নানান শ্লোগান। কোনটাতে লেখা, ’ওয়ার ইজ নট আনসার,’ কোনটাতে ’ নো ওয়ার ফর ওয়েল’, ’পীস, পীস, অনলি পীস” ইত্যাদি। ড্রাম বাজিয়ে একদল তরুণ তরুণী সুর করে ইন্টারন্যাশনাল গাচ্ছে, হাঁড়িমুখো ভিয়েতনাম ভেটের্ন এক বুড়ো সামরিক পোষাক পরে গাল ফুলিয়ে হুঁইসেল বাজাচ্ছে, কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে সমতালে তালি বাজিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে পুরো সেন্টার সিটিতে। জন বলেছিলো সে এক ডানকিন ডোনাটের দোকানের সামনে থাকবে সদলবলে। আমি মানুষের গা বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডানকিন ডোনাটের দোকান খুঁজতে লাগলাম।
আঙ্কেল, এই আঙ্কেল – ।
ডাকটা শুনে এদিক ওদিক থাকালাম। দেখি রাস্তার ওপর ফুটপাত ঘেঁষে আফসার ভাই আর বিশাখা ভাবী সপরিবারে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার হাতে সাদা পতাকা আর বেলুন। আবির আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে। অবাক হলাম। সাদা আর কালোদের এই জনারণ্যে বাংলাভাষী একটা মুসলিম পরিবার সকল সংশয় উপেক্ষা করে কোন সাহসে এসেছে এই যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে ? বুশ প্রশাসনের তোপের মুখে পড়লে এই পরিবারটিকে কে সাহায্য করবে ? আবার মনে হলো, সত্যিই আফসার ভাই আর বিশাখা ভাবীর প্রশংসা করতে হয়। উনারা মুখে যা বলেন তা যে শুধু মুখের কথা নয়, আজকে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। একটা বাঙালী পরিবার যে আজকের এই বৈরী সময়েও সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারছে সেজন্য গর্ববোধ করলাম। আমি ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম তাদের। আমি হেসে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কেমন আছেন আফসার ভাই, ভাবী ?
ভালো, বেশ ভালো- ঝরঝরে গলায় বললেন আফসার ভাই, তা কখন এলেন ?
এক্ষুনি। তবে আফসার ভাই আমাকে তুমি বললে খুশী হবো – ।
খুশী হবে ? অমায়িক ভঙ্গীতে হাসলেন তিনি, তা ভাই কাউকে খুশী করতে পারার মতো আনন্দ আর কিছু নেই, আমিও বা নিজেকে বঞ্চিত করবো কেন ? নাও চিপস্ খাও –
ধন্যবাদ। আমি একমুঠো চিপস্ নিয়ে আবিরকে কাছে টেনে নিলাম।
তা তুমি এখানে কেন এসেছো ?
’ওয়ার ইজ নট আনসার’ এটা বলতে – ।
কাকে বলতে ?
সবাইকে, আবির হাত নাড়িয়ে সড়কে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দেখায়, বুশকে এন্ড রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে।
বাহ ! দারুণ বলেছো তো ! আমি মুগ্ধ হলাম ওর কথা শুনে, তা বুশ কি তোমার কথা শুনবে ?
মে বি নট, বিকাউজ হি ইজ দ্য ওয়ার মঙ্গার, বাট আই ওয়ান্ট টু টেল ট্রুথ – আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আদিব পরিস্কার গলায় কথাগুলো বললো ।
ওয়ান্ডারফুল কিডস্ ! এক মধ্যবয়েসী শেতাঙ্গ ভদ্রলোক বলে উঠলেন পাশ থেকে। মনে মনে আমি একটু আশঙ্কিত হলাম। এদের বিশ্বাস নেই। এখন এই সমাবেশের ভেতর সাদা পোষাকে শত শত আন্ডার কভারের লোকজন মিশে আছে। বিভিন্ন বেশে। এ লোক তাদের কেউ কিনা কে জানে। লোকটার গলায় বেশ বড়োসড়ো অলিম্পাস ক্যামেরা ঝোলানো। দেখতে মনে হয় সাংবাদিক।
মে আই টক টু ইউ ? ভদ্রলোক আদিবের দিকে তাকালেন। আমি তাকালাম আফসার ভাইয়ের দিকে। উনার মুখে স্মিত হাসি।
ইয়েস । আদিব স্বাচ্ছন্দ্যে জবাব দিলো।
আই এ্যাম মাইক স্মিথ, ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট এন্ড কলামিস্ট- বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
আদিব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো।
নাইস টু মিট ইউ – মাইক এবার আফসার ভাইয়ের দিকে তাকালেন। একটা ছোট্ট পরিচিতি অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। মাইক আদিব, আবির আর অর্পিতার সাদা পতাকা ধরা ছবি তুলে নিলো। তারপর আফসার ভাইয়ের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলো।
ভাবী, আমার এক বন্ধুকে খুঁজতে হবে- আমি পা বাড়ালাম।
আবার দেখা হবে আঙ্কেল – অর্পিতা আমায় বিদায় জানালো। আবির আর আদিব মাইকের সাথে কথায় মশগুল। জনের খোঁজে আমি ডানকিন ডোনাটের দিকে এগিয়ে এলাম।
বিকাল বাড়ার সাথে সাথে যেন মানুষের সমাগমও বেড়ে গেছে। ডানকিন ডোনাটের সামনে বিরাট জটলা। উচ্ছ্বসিত, উদ্ভাসিত আর উত্তেজিত মানুষগুলোর ভেতর আমি জনকে খুঁজতে লাগলাম। সে নিশ্চয় কোন এক দলের সাথেই আছে। যেমন কথা পাগল মানুষ, নিশ্চয় ডুবে আছে তর্কে। খুঁজতে খুঁজতে তাকে পেলাম ডানকিন ডোনাটের ভেতরে। সাথে সিন্ডি আর অন্য এক হিস্পানিক তরুণী। সিন্ডিকে দেখে একটু অবাক হলাম। তা প্রথম সাক্ষাতে তার মুখে শোনা গল্পের কারনে যতটুকু নয় বরং জনের সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে বসার কারনে। ওরা কি দু’জন কাছাকাছি চলে আসছে ? হতেও পারে। তবে পাশে বসা হিস্পানিক মেয়েটাকে বেশ চেনা চেনা মনে হলো। হিস্পানিক হলেও ওর চেহারায় একধরনের ধারালো ভাব আছে। মুখের একপাশে ঝুলে থাকা কার্ল করা একগোছা চুল। ওতে তাকে বেশ আকর্ষনীয় মনে হচ্ছে। আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
হেই আতিক, নাইস টু সি ইউ এগেন – সিন্ডি আলতো করে হাসলো।
মি টু । আমি পাশের খালি চেয়ারটায় বসে জনের দিকে তাকালাম, কি খবর ?
তুমি লেট করেছো, দ্যাটস্ ওকে, র‌্যালী এখনো শুরু হয়নি – জন প্লেটের ডোনাটটায় কামড় বসালো, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই , ও হচ্ছে লিনোরা, তোমারই প্রতিবেশী।
নাইস টু মিট ইউ – লিনোরা হাত বাড়িয়ে দিলো।
হাই, আই এ্যাম আতিক।
সম্ভবতঃ আমি তোমাকে কয়েকবার মল-এ ( Mall) দেখেছি – লিনোরা বেশ সুন্দর করে হাসলো। একটু বাদামী ধাঁচের চোখ দু’টো কেমন যেন ভাবালুতায় আচ্ছন্ন। গোলাপী লিপগ্লসের আভায় ঠোঁট জোড়া একেবারে টসটসে। হালকা পাতলা শরীরে টিয়ারঙয়ের টিশার্টে খুব সুন্দর লাগছে তাকে। আমি মেয়েদেরকে খুঁটিয়ে দেখতে অভ্যস্ত নই। আমি যে খুব লাজুক তা নয়। কিন্তু অন্তরঙ্গতা না হওয়া পর্যন্ত কারো দিকে ভালো করে তাকানো হয়ে ওঠে না। লিনোরাকে প্রথম দেখাতে চেনা মনে হওয়ায় একটু পূর্ণচোখেই তাকালাম নির্দ্বিধায়।
ইয়েস, ইউ লুকস ফ্যামিলিয়র- আমি বললাম, তা তুমি তো মনে হয় আমার কাছেই থাকো ?
হ্যাঁ, ব্রডস্ট্রীটে।
এজন্যে প্রায়ই তোমাকে দেখি, আমি বললাম, তোমার ওরিজিন –
হাওয়াই, তোমার ?
বাংলাদেশ -।
বাংলাদেশ ? একটু যেন অবাক চোখে তাকালো লিনোরা, আই নেভার হার্ড এবাউট দ্যাট। হোয়ার ইজ দিস কান্ট্রি ?
ইন এশিয়া, জন বললো, সাউথ ইস্ট এশিয়া, ক্লোজ টু ইন্ডিয়া।
ওয়াও ! আশ্চর্যধ্বনি করে উঠলো লিনোরা। এতে ওকে আরো সুন্দর লাগলো।
এরপর আমরা এক টেবিলে বসে দু’দলে ভাগ হয়ে গেলাম। জন সিন্ডির সাথে নানা বিষয়ে মেতে উঠলো। আমরা দু’জনেও বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেলাম। আমি যতটুকু না উৎস্যুক হাওয়াইয়ের ব্যাপারে জানতে তার চেয়ে লিনোরা বেশী কৌতুহলী বাংলাদেশ সম্পর্কে। বাংলাদেশ কবে কিভাবে হলো, বাঙালীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি কেমন, মেয়েদের লাইফ স্টাইল কেমন, কি ধরণের খাদ্যাভ্যাস আমাদের, ফ্যামিলি লাইফটা কেমন, বর্তমান তরুণ সমাজের অবস্থা কেমন ইত্যাদি বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সে যেন আমাকে তার তথ্য সংগ্রহের একটা একটা বড়ো সোর্স পেয়ে গেছে।
দেখো, তোমার যদি আগ্রহ থাকে তাহলে তোমাকে আমি কিছু বই কালেক্ট করে দিতে পারি- ।
দেবে ? সপ্রশ্ন তাকালো লিনোরা, কিন্তু আমার জন্যে কেন কষ্ট করবে তুমি ?
বন্ধু হয়ে গেলে তো সমস্যা নেই, নাকি ?
না। ক্ষণিক ভাবান্তরকে সরিয়ে বেশ জোরালো গলায় বললো লিনোরা, আমি এনথ্রপলজির ওপর ডক্টরেট করতে চাই, তুমি আমাকে হেল্প করলে সত্যি খুবই খুশী হবো -।
খুশী হবে ? আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। সেখানে একরাশ প্রত্যাশার আলো। কিছুক্ষণ আগে আফসার ভাইয়ের কাছে শোনা কথাটার পুনরুক্তি করলাম, কাউকে খুশী করতে পারার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই, আমি নিজেকে বঞ্চিত করবো কেন ? নাও ডোনাট খাও।
থ্যাঙ্ক ইউ আতিক, একটু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লিনোরা, ইউ আর গ্রেট।
ইটস মাই প্লেজার।
সময় হলো, এখন যে উঠতে হবে – অনেকক্ষণ পর জনের গলা কানে এলো। বলা যায়, আমার কান জনের কথা শুনতে পেলো। তাকিয়ে দেখি ওরা দু’জন আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে হাসছে মিট মিট করে। লিনোরা একটু লাজুক দৃষ্টি ছুঁড়ে তার অসমাপ্ত ডোনাটটা শেষ করতে মনযোগ দিলো।
মনে হচ্ছে, প্রথম শটেই কুপোকাত- জন মজা করার স্বরে বললো।
বলতে পারো আমরা এখন থেকে বন্ধু – লিনোরা ন্যাপকিনে হাত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো।
ভেরি গুড, সিন্ডি তাকালো আমার দিকে, আমি যতটুকু শুনেছি আতিক ইজ এ গুড ম্যান।
সার্টিফিকেট ? হাসিমুখে তাকায় লিনোরা, ও আমি বুঝে নেবো। চলো বেরুই।
হ্যাঁ চলো।
আমরা সবাই নেমে এলাম ফুটপাতে।
মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে যুদ্ধবিরোধী মানবতার মিছিল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে চতুর্দিক। মিছিল চলতে শুরু করলো। জন আর সিন্ডি হাত ধরাধরি করে হারিয়ে গেলো মানুষের স্রোতে। লিনোরা মিছিলে ঢুকে দেখলো আমি পাশে নেই। আমি হাঁটছি ফুটপাত ধরে। কিছুদূর ভেসে গিয়ে সে উঠে এলো ফুটপাতে। আমি দেখতে পাচ্ছি লিনোরা হেঁটে আমার দিকে আসছে স্রোতের বিপরীত দিক থেকে। আমি যাচ্ছি ওর দিকে। হাসছে লিনোরা। হাসি ছড়াচ্ছে আমার ভেতরেও।

=========================