You are currently viewing পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতীক নির্মাণ / লতিফুল কবির

পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতীক নির্মাণ / লতিফুল কবির

পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতীক নির্মাণ

লতিফুল কবির

বয়ন উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বসবাসকারী তাঁতি বা জোলা নামক এক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে, নানা কারণে যারা কিনা সমাজের মূলস্রোতধারা থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন।আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বাধ্যবাধকতা ছাড়া সমাজ নির্মানের অন্যান্য উপকরণগুলো নিজেদের মতো করে গড়ে নিতে সক্ষম বিধায় নিজস্ব জীবন-যাপন, নিজস্ব ধরন, নিজস্ব পৃথিবীর বদৌলতে প্রতিবেশি সমাজ থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে খানিকটা আলাদা রাখতে তাঁতি বা জোলাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। জামদানী শাড়ি সেই শক্তিশালী অবলম্বন, যাকে কেন্দ্র করে এই জনগোষ্ঠীর মানবকুল তাদের সম্মিলিত স্মৃতিসম্পদকে আঁকড়ে ধরে আছে শত-শত বছর ধরে। এই সক্ষমতা সত্ত্বেও তাদের ভবিষ্যত ধুসর, আর পাপড়ি রহমানের লেখায় সেই ধুসরতা ধরা পড়ে গল্পের শুরুতেই:

বাবলা পাতার মতো বিছিয়ে থাকা ইটের সারির ওপর পা ফেলতে ফেলতে সবেদআলি ধুলোর গন্ধের জন্য হাঁসফাঁস করে সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে যতদূর তাকায়কোথাও বাদামি জমিন নজরে পড়ে না 

সবেদআলি একজন তাঁতি যে কিনা পরিচিত গন্ধের তালাশে ব্যস্ত, যে গন্ধে ধুলার না-সোঁদা, না-ধুলাটে, না-মাটি-মাটির খোঁজ পাওয়া যাবে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, সবেদআলি এখানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরছে না, তার গন্তব্য সম্পর্কে সে পুরোপুরি সচেতন।সবেদআলির সচেতন এই খোঁজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে উপন্যাসের মূল পাঠ, যাকে আমরা শেকড়ের খোঁজও বলতে পারি। এর বিপরীতে ইটের সারির মতো সবেদ আলির চারপাশে যে নয়া সামাজিক-রাজনীতিক ও আধ্যাত্মিক জগত গড়ে উঠছে, সেই জগতের সাথে সবেদআলির বোঝাপড়াটাই আখ্যান হিসেবে গড়ে ওঠা নয়া সেই জমিনে সবেদআলি তার নিজের পরিবর্তিত বাস্তবতা আবিষ্কারে, অথবা তার সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয় না। কেবল যে বহির্জগতের অবস্থা এমন তা না, অন্তর্জগতেও সবেদআলি যাকে খোঁজে, তাকে সে কোনদিনই খুঁজে পায় না। সেজন্য, আগের স্ত্রীর কথা গোপন করে আতিমুনি, সেখান থেকে গড়াতে গড়াতে সখিনা-জাহানারা শেষ করে মোমেনা অব্দি প্রজাতির প্রাচীনতম সামাজিক কাঠামোটি বিবর্তিত হতে থাকে।স্থির হয় কিনা বলা মুশকিল।সবেদআলি এতসব কেন করে? কারণ, সবেদআলির মতো হাজার হাজার তাঁতির সম্মিলিত স্মৃতিসম্ভারে গেঁথে আছে মসলিন নামক এক অপরূপ সময়ের গাঁথা, অমন সমৃদ্ধ অতীত মানুষকে অস্থির না করে পারে না। পুরো গল্পজুড়ে সবেদআলিকে তাই দেখা যায় অস্থির।সবেদআলি একা না, একই অস্থিরতা গল্পের আরেক তাঁতি মুল্লুকচানের মধ্যেও পুরোপুরি বিদ্যমান।সাত বছর বয়স থেকে যে জামদানী বুনে অভ্যস্থ, সেই কিনা বজ্রপাতে স্ত্রী আয়রননেছার আকস্মিক মৃত্যুর পর বয়নক্ষমতা হারিয়ে চারপাশের জগত সম্পর্কে বিভ্রান্ত।পরবর্তীতে তার জীবনে আরেক স্ত্রী এলেও মুল্লুকচান আর কোনদিনই স্বাভাবিক হতে পারেনি। বয়ন গল্পটি তাঁতিদের নিয়ে রচিত হলে কী হবে, এই গল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তো বটেই উপ-মহাদেশের যে কোন অঞ্চলের কামার, কুমার থেকে শুরু করে বহু বহু পুরোনো পেশার সাথে সংশ্লিষ্ঠ যে কোন জনগোষ্ঠীর গল্পের ইঙ্গিতটি পরিষ্কারভাবে পাওয়া সম্ভব। সমৃদ্ধশালী অতীতের স্মৃতিসম্ভার টেনে বেড়ানো যেকোন ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি যে ধরণের সংকট ও সম্ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খায়, তার সবকিছু বয়নে উপস্থিত। তবে, এসব জানতে আমাদেরকে উপন্যাসের পাঠ থেকে একটু ভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিতে হবে।সেটি মানবপ্রজাতির পরিযায়ী ঘটনা এবং জাতি গঠন, যা কিনা এযুগের যে কোন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের জন্য মূলত দায়ি।

সংস্কৃতির বৈচিত্রের খোঁজে বিজ্ঞানীরা যত ধরণের তত্ত্ব তালাশ করেছে, তার মধ্যে এযুগে সবচে জনপ্রিয় ও গ্রহনযোগ্য তত্ত্বটির নাম জিনতত্ত্ব।সেই তত্ত্ব ব্যবহার করে হার্ভার্ড অধ্যাপক ডেভিড রিচ উপ-মহাদেশে মানবপ্রজাতির পরিযায়ী ঘটনার যে ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, সেখানে বাঙালির জাতি গঠনের এক অনন্যসাধারণ বৈশিষ্টকে আমরা দেখতে পাই। সেটি নারী, মূলত: মুন্ডা নারী। এখন থেকে ৭ হাজার বছর আগে লাওস-ভিয়েতনাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে যে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে গঙ্গা অববাহিকায়, সেখানে সেই যাত্রায় ফেলে আসা ভূমির নারীদের কোন অংশগ্রহন ছিল না। অর্থাৎ, সেখানকার নারীরা বাংলাদেশে হিজরত করেনি, বা করতে পারেনি।এখানে আসার পরে পুরুষদের তাই সঙ্গী হিসেবে মুন্ডানারীকে বেছে নিতে হয়েছিল। এছাড়া হয়তো উপায় ছিল না। কারণ, ৫০ হাজার বছরের পরিযায়ী ঘটনায় বাংলাদেশ তো বটেই ভারতবর্ষের দক্ষিণাঞ্চল ইথিওপিয়া থেকে আসা ওই আদি মানবদের দখলে ছিল বহুকাল।এসংক্রান্ত জিনতত্ত্বের যে অনুমান, তাকে খাটো করে দেখা যাবে না। তামিল, মুন্ডা কিংবা সাওতালরা সে অর্থে ভারতবর্ষের সবচে আদি পরিযায়ী মানুষ।

পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন উপন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে ডেভিড রিচের জিনতত্ত্ব কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল, সেই ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে জেনে নিই ইতিহাসের আরেক ঘটনা, যা বাঙালির জাতিগঠনকে বৈচিত্রপূর্ণ করে তোলার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।  খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল নাদাগ হরপ্পা সভ্যতার পতন এবং সেখানকার অধিবাসীদের বড় একটা অংশের বাংলাদেশে হিজরত করার সময় হরপ্পা থেকে তারা বয়নের শিল্পটিকে সাথে করে এনেছিল। সুতি এবং রেশম উভয় তুলাকে ব্যবহার করে বয়নে অভ্যস্ত ছিল হরপ্পার অধিবাসীরা। তা সত্ত্বেও, মূলত: যে কারণে হরপ্পা এযুগের ইতিহাসবিদদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে, সেটি এর নগর-অবকাঠামো। হরপ্পায় উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ছিল না; অন্তত তার নগর অবকাঠামো থেকে সেটাই অনুমান করা হচ্ছে। এই অনুমান আরো বলছে যে, ভারতবর্ষে যে এত জাতপাত, এত ব্রাম্মণ-চন্ডাল, তা আসলে হরপ্পা পরবর্তী ঘটনা।তথাকথিত আর্য ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এযুগের ব্রাম্মণ্যবাদী ইতিহাসবিদরা অবশ্য এটা মানতে চায় না।তাতে কিছু যায় আসে না। তো, হরপ্পা থেকে হিজরতের সময় মানুষ যে কেবল বয়নকে সাথে করে এনেছিল তা না, একইসাথে তারা সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান সাম্য ও সমতার সংস্কৃতিকেও বয়ে এনেছিল। সংস্কৃতির এই ঝোঁকটি পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কেবল ধম্ম না, ভাষা ব্যবহারের দিক থেকেও গৌতমের পক্ষপাত ছিল প্রাকৃত ভাষার প্রতি। প্রায় হাজার বছরধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সংস্কৃত ভাষার বিশাল ভান্ডারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সহজ কথা না। গৌতম নিশ্চয় সংস্কৃত ভাষার মধ্যে অসমতার বৈশিষ্টগুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন। তা না হলে অবিকশিত প্রাকৃত ভাষাকে কেন তিনি তার দর্শন প্রচারে ব্যবহার করবেন? গৌতমের দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনকালে তারা তাদের সরকারি ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল পালি ভাষা, তা কি কোন যুক্তি বা কারণ ছাড়াই? সেখানেই শেষ না, মৌর্যদের পাশে শক্তি ও সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তৎকালীন বাংলা তথা গঙ্গাঋদ্ধির শাসকগণ। সেটি খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ সনের ঘটনা। আজকের বাংলাদেশ ওই গঙ্গাঋদ্ধিরই উত্তরাধিকার মাত্র। মাঝে বহুবছর পেরিয়ে গেলেও সমতা ও সাম্যতা তাই বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট। জাতিভেদ না মানার প্রবল এক ঝোঁক বাঙালির রক্তে খেলা করে বলেই ভারতবর্ষের বিভক্তসমাজে ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের জন্মকে সম্ভবপর করে তুলেছিল।

বয়ন উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। বাঙালি নারীদের নিয়ে প্রচলিত নারীবাদী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী এক প্রবণতা পাপড়ি রহমানের নারীসংক্রান্ত উপস্থাপনায় দেখতে পাওয়া যায়। বয়ন প্রকাশিত হওয়ার বহুবছর পরে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সে এক ভিন্ন আলোচনা এবং আমাদের বর্তমান আলোচনায় তা অপ্রাসঙ্গিক বিধায় আমরা আমাদের আলোচনাকে বয়ন ‍উপন্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

বয়ন উপন্যাসে অনেক নারী চরিত্র। তেমন একজন আতিমুনি। প্রকৃতি নিয়ে বিধাতার পক্ষপাতের মতো লেখকের পক্ষপাত আাতিমুনির দিকে ষোলআনা।  ‘এক্কেবারে পুড়িয়েকয়লাকরা কালোকিষ্টি গতরখান কাটাকাটা নাকমুখ আর কোমড়ের বাঁক ছিল নতুনকেনা কাস্তের মতো ধারালো আতিমুনির রূপের রোশনাইয়ের সঙ্গে মেজাজখানাও ছিল এক্কেবারে জাত গোখরার মতো [পৃষ্ঠা ১১]

বর্ণনায় তিনটি ঝোঁক লক্ষ করার মতো। আতিমুনির গায়ের রঙ কালো, ব্যক্তিত্ব প্রখর এবং সেই প্রখরতা প্রকাশ পায় গোখরো সাপের প্রতীকি ব্যবহারে। রঙ ও মেজাজে একজন মুন্ডা নারী তো বটেই, সাপের ব্যবহারে বাঙালি সংস্কৃতির আদি ও একমাত্র দেবি মনসার উপস্থিতি লেখকের ইতিহাস সচেতনতার প্রমান দেয়। সংসারে ভাঙাগড়া মানবপ্রজাতির কৃষিসভ্যতা পরবর্তী বিকাশের অংশ, সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি তারও বিকাশ ওই কৃষিসভ্যতাকে ঘিরেই এবং আজও সেই ভাঙাগড়া অব্যাহত আছে। আদৌ শেষ হবে কিনা, এবং হলে সেই নয়া সংসারের রূপটি কী হবে, সেটা ভবিষ্যত জানে।’বয়ন-এ আতিমুনি মুন্ডা নারীর আদি বৈশিষ্ট সমেত হাজির হয় সবেদআলির দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে।আগের স্ত্রীর কথা গোপন করেছিল সবেদআলি। উপন্যাসে সবেদআলি আসলে পরিযায়ী সেই পুরুষ চরিত্রগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র। হতে পারে সেটা হরপ্পা। কারণ, বুনন তার রক্তে মিশে আছে।কিন্তু, আতিমুনি তার স্বামী সবেদআলির আগের স্ত্রীর কথা গোপন করার যুক্তি মানবে কেন? সেজন্য সে তার সহজাত বিদ্রোহের প্রয়োজনে সংসার ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। সেই অর্থে আতিমুনি কিন্তু তার প্রতিবেশি সমাজের আর দশজন নারীর মতো না। ইতিহাসের গতিপথে নানা পরিযায়ী ঘটনার মিথষ্ক্রীয়ায় বিশেষ করে গুপ্ত-পরবর্তী ব্রাম্মণ্যবাদ, আরব-পারস্যের ভক্তিবাদ এবং পরবর্তীতৈ ইউরোপিয় আধুনিকতা নামক গল্পের প্রভাবে বিদ্রোহ অপেক্ষা মেনে নেয়ার প্রবণতা যেখানে ক্রমঃশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, সেখানে জনপদের আদি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের অবশেষরূপে বাঙালি নারীদের কারো কারো মাঝে বিদ্রোহ প্রবণতা অক্ষুন্ন থাকা ইংগিতবাহী বটে।আতিমুনির বিদ্রোহের মধ্যে ইতিহাসের দায়টি অনুভব করা যায়।সেই আতিমুনিই যখন পুরোনো স্বামীর স্মৃতিকে নকশি কাঁথার বুননের মধ্যে পুণঃস্থাপিত করে, তখন সেখানে বাঙালি চরিত্রের আরেক ঝোঁকটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।সেটি পিছুটান। তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান গ্রহন করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’’ যত সহজে বলা যায়, বাস্তবতা তার চেয়ে কঠিন; সেজন্য ত্যাগ করার পরেও ধরে রাখার এক বিপন্ন বিষ্ময় বাঙালির রক্তে খেলা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই প্রবণতাকে মহা বিরম্বনা বলেই অবিহিত করেছেন। আতিমুনির হাতে নকশি কাঁথার বুনন বাঙালির হাজার বছরের পরিযায়ী ঘটনায় যে নানা সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, তারই ইংগিত দেয়। অপরদিকে, পিছুটান সত্ত্বেও আতিমুনি কিন্তু তার নগদ লেনদেন সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। সচেতন বলেই নকশি কাঁথায় আঁকা জোড়া-পাখির ছবিটি লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে দিতে দ্বিধা করে না সে। ফলে, না আগের স্বামী সবেদআলী না পরের স্বামী আলাউদ্দীন, কারো কাছেই সে তার স্বায়ত্তশাসন বিকিয়ে দেয় না। বাঙালির যে স্বায়ত্তশাসন দরকার এবং স্বায়ত্তশাসন দরকার এ অঞ্চলের কেবল না, সারাবিশ্বের সকল জাতির। আতিমুনির জেদের মধ্যে আমরা এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান স্বায়ত্তশাসনের জেদটিকেই প্রত্যক্ষ করি।

বয়নের আরেক নারী চরিত্র ঝুম্পাড়ি।সম্পর্কে সবেদআলির প্রথম স্ত্রী পরয়নবিবির নাতনি। পরয়নবিবির মাঝে পরিযায়ী পুরুষ কর্তৃক আদি ভূমিতে ফেলে আসা নারী চরিত্রটিকে খুঁজে পাওয়া যায়, যে কিনা জীবনসংগ্রামে পরাস্ত এবং ক্ষুধায় কাতর।ক্ষুধা হচ্ছে মানুষের আদি ও প্রধানতম প্রাকৃতিক বাস্তবতা।জগতজুড়ে সমস্ত পরিযায়ী ঘটনার পেছনের মূল নিয়ামক হচ্ছে ক্ষুধা, সভ্যতার গতিপথ নির্মানের নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে ক্ষুধা।সবেদআলি যদিও এখানে সেই অর্থে পরিযায়ী না; কিন্তু, পয়রণবিবির পরিণতির ভেতরে মানবপ্রজাতির সেই আদি বাস্তবতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।বিষয়টি স্পষ্ট হয় পয়রনবিবির পাশে দাঁড়াতে তার সন্তানদের অনীহা থেকে, তারা মাসান্তে কিছু টাকা দিয়ে তাদের ঋণ শোধ করে, পয়রনবিবির কাছে তাই জীবিত সন্তানদের চেয়ে মৃত সন্তান, বিশেষ করে মেয়ে রোশনার স্মৃতি অনেক বেশি মূল্যবান।সবেদআলি-পয়রনবিবির অনেকগুলো সন্তানের এক সন্তান জজমিয়া, ঝুম্পাড়ি হচ্ছে জজমিয়ার মেয়ে। জজমিয়া যখন তার পিতৃপ্রদত্ত স্মৃতিসম্পদের ধাক্কায় জামদানীর নতুন নকশার পেছনে ব্যস্ত, তখন ঝুম্পাড়ি আঠার মতো লেগে থাকে দাদি পরয়নবিবির সাথে, সে হয়ে ওঠে পয়রনবিবির একমাত্র সহযোগী। এই দৃশ্য পথের পাঁচালি উপন্যাসের দুর্গার কথা মনে করিয়ে দেয়, সেখানেও অবাঞ্চিত পিসি (ফুফু) ‘র একমাত্র ভরসা ছিল ভাতিজি দুর্গা। গ্রামবাংলার এই দৃশ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তাঁতিদের মধ্যে যে সমভাবে বিরাজ করে, সেটা অনুমান করা যায়। এটাই মানবিকতা। তো ঝুম্পাড়ি বা দুর্গা কেন? কারণ, জেনেটিক্যালি তারা বাঙালির নারীর আদি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, যার মূল কথা মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু, ঝুম্পাড়ির অনন্যতা ধরা পড়ে ভিন্ন জায়গায়।আকাইল্যার সাথে বিবাহপূর্ব প্রণয়নের পরিণতিতে ঝুম্পাড়ির গর্ভে সন্তান চলে আসে।তরুণ-তরুণীর প্রণয়নের পুরো ঘটনা পয়রণবিবির সামনে ঘটে বিধায় রাগে-দুঃখে তার ছেলে জজমিয়া মায়ের চশমা কেনার জন্য জমানো টাকা ফিরিয়ে নেয়।একদিকে মা পয়রনবিবি এবং অপরদিকে মেয়ে ঝুম্পাড়ি দু’জনকে নিয়ে জজমিয়ার সংসারে শুরু হওয়া অন্তর্জগতের এই টানাপোড়েনের মধ্যেই উপস্থিত হয় বহির্জগতের টানাপোড়েন, যার শুরু হয় জামদানী শাড়ির নতুন নকশা নিয়ে নূর মোহাম্মাদের হাজির হওয়ার এবং শেষ হয় ঝুম্পাড়ি-আকাইল্যার সম্ভাব্য বিবাহ ভেস্তে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই উভয় জায়গায় নূর মোহাম্মদ হচ্ছে জজমিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বি।মানুষে-মানুষে আন্তসম্পর্ক বরাবর এক জটিল রসায়ণ, সেই রসায়নে কেউ জেতে কেউ হারে, তো লেখকের পক্ষপাতে এই গল্পে জয়লাভ করে জজমিয়া, আর সেজন্য ব্যবহৃত হয় প্রযুক্তি এবং মানবিক মর্যাদার মতো দুটো প্রয়োজনীয় উপাদান। বহির্জগতে জজমিয়া জয়ী হয় প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বদৌলতে, আর অন্তর্জগতে তার জয় বয়ে আনে মানবিক আবেদন, সেটি আসে ফৈজুমিয়ার কাছ থেকে। ফৈজুমিয়া অন্তস্বত্ত্বা ঝুম্পাড়িকে বিবাহ করতে রাজি হয়।সমাজসম্পর্ক বিনির্মান এবং তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে প্রযুক্তি এবং মানবিক মর্যাদার শর্ত দুটো খুব নিপুনভাবে গ্রথিত করে দিতে সক্ষম হয়েছেন পাপড়ি রহমান।

বয়ন কেবল যে মানুষে-মানুষে (অথবা লেখকের কথায় মানুতে-মানুতে) গল্প তো নয়, এক অর্থে এ হচ্ছে তাঁত শিল্পের গল্প, তার টিকে থাকার সংগ্রামের গল্প।বলা বাহুল্য, এই জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত স্মৃতিসম্ভারে মসলিন খেলা করে এবং ক্ষয়িষ্ণু হলেও বংশপরিক্রমায় তার একটা প্রভাব থেকেই যায়। তা সত্ত্বেও, তাদের সংগ্রাম কিন্তু পুরোপুরি অতীতনির্ভর নয়।সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার জন্য এযুগে যে আয়োজন, তার থেকে বয়নের মানুষগুলো খুব বেশি দূরে বসবাস করে না। সেজন্য, সবেদআলির ভাগ্নে সিদ্দিকআলিকে দেখা যায় সমিতি খুলতে এবং এ যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মূল যে অস্ত্র ঋণ, তাকে ব্যবহার করতে।একেবারে হলফ করে বলা যায়, তাঁতের শাড়ি নির্মানের সাথে যুক্ত সকল আয়োজনের গল্প হলেও ক্রমশ এই শিল্পের সাথে আধুনিক পুঁজিবাদের সংযোগটিও ঘটে।বাংলাদেশের বহু উপন্যাসে যা সাধারণ ঘাটতি, অর্থাৎ অর্থনৈতিক গতিপথের কোন উপাদান না থাকা, বয়ন সেই ঘাটতি পুরণে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়েছে।অনুমান করে নিতে পারি যে, এই কাজ করতে গিয়ে লেখককে নিবিঢ়ভাবে তাঁতিদের জীবনযাপন, তাদের আহার-নিদ্রা, তাদের ঝগড়া-বিবাদ লক্ষ করার পাশাপাশি কীভাবে সুতা আসে, কীভাবে তা তাঁতে রূপান্তরিত হয়ে শাড়ির রূপ নেয়, কীভাবে শাড়িতে রঙ চেপে বসে, সবই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশে আর কোন পেশার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে এমন মানের আখ্যান আমার নজরে পড়েনি।বয়ন এক শুভ সূচনা মাত্র।

বয়ন ‍ উপন্যাসের অসম্পূর্ণতা অন্যত্র, সেটি হচ্ছে সমাজে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুপস্থিতি।গল্পে অর্থনীতির অভিঘাত ভালোভাবেই চোখে পড়ে।তাঁত এবং জামদানীকে টিকিয়ে রাখতে ঋণ এবং সমিতি গড়ার মতো প্রয়াসগুলো উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু, যে অভিঘাত, বিশেষ করে যে ঘটনাগুলো জাতীয়জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে, তেমন ঘটনার মিথষ্ক্রীয়া না থাকাটা অসম্পূর্ণতা বটে। উদাহরণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা যায়। কেবল বাংলাদেশ না ,পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের মতো সীমান্তসংলগ্ন ভারতের অঞ্চলগুলোর এমন কোন জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত থেকে মুক্ত ছিল। বয়নের চরিত্ররা কোন কারণ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত থেকে দূরে থেকেছে। নারায়ণগঞ্জের যে বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বয়ন রচিত, সেই অঞ্চল শতাব্দির অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হলেও হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে থাকা সম্ভবপর ছিল না। হতে পারে, তাঁতিদের জীবনসংগ্রামকে উপজীব্য করতে গিয়ে ইতিহাসের এই বিশেষ জায়গাটিতে ঠিক সেভাবে আলো ফেলতে আগ্রহী হননি লেখক। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রাম খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে মিশে যেতে পারতো। বলতে দ্বিধা নেই, উপন্যাস নানা কারণে সামগ্রিক হয়ে ওঠে না, তার সেই দায়ও নাই।

তথ্য সূত্র: 

১। David Rich (2018), Who We Are and How We Got Here: Ancient DNA and the new science of the human past. Page 123-128.

২। –do-

৩।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৯), শেষের কবিতা