You are currently viewing পাঠপর্যালোচনা: “জীবন আমার বোন” || নুসরাত সুলতানা

পাঠপর্যালোচনা: “জীবন আমার বোন” || নুসরাত সুলতানা

পাঠপর্যালোচনা: “জীবন আমার বোন”

নুসরাত সুলতানা

মাহমুদুল হক বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। ভাষার অলংকরণ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তার সাহিত্য কর্মের উজ্জ্বল, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। “জীবন আমার বোন” উপন্যাসের সময়কাল ১লা মার্চ -২৭ মার্চ ১৯৭১। উপন্যাসের আখ্যানভাগ এগিয়েছে খোকা এবং রঞ্জু দুই ভাইবোন এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির জীবন ও তৎকালীন  সমাজ- রাজনৈতিক মমনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে।
আখ্যানভাগ: উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় খোকা এবং রঞ্জু দুই ভাইবোনের খুনসুটি। যাদের পিতা রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত। তাদের মা সদ্য প্রয়াত। খুব ছোটবেলায়  পুকুরে ডুবে গত হয়েছে তাদের দুইবোন অঞ্জু এবং মঞ্জু। খোকা যেমন ছোটবোন রঞ্জুকে খুব স্নেহ করে, শিশুর মতো কোমল ভাবে। তেমনি রঞ্জুও ছোট হয়েও খোকাকে শাসন করে আগলে রাখে। 
খোকার বেশ কয়েকজন বন্ধুর ভেতর উল্লেখযোগ্য মুরাদ,ইয়াসিন এবং রহমান। খোকার বন্ধুরা সবাই যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ভাবে তখন খোকা তাকে দেখে অন্যদৃষ্টিভঙ্গিতে। খোকার বুকে শহীদ  আসাদের জন্য দহন হয়। খোকা বলে- দেশ আগে নাকি মানুষ আগে? মুরাদ বলে- আসাদের মৃত্যুকে সামগ্রিকস্বার্থে দেখতে তখন আর ব্যক্তি আবেগ মুখ্য হয়ে ওঠে না।
খোকা জীবন এবং সম্পর্ককে উপভোগ করতে চায় কোমল, স্বাধীন এবং স্বাকীয় ভাবে। জীবনকে বিপন্ন করে খোকার কাছে প্রেম এবং স্বাধীনতা সবকিছুই অর্থহীন।
নীলাভাবী যিনি খোকার খুব প্রিয় রাজীব ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। নীলাভাবীর ব্যক্তিত্ব এবং অন্তর্গত সৌন্দর্য খোকাকে আকৃষ্ট করেছিল। তারা ডুবে গিয়ে লছিল কোন মাহেন্দ্রক্ষণে একে অপরের ভেতর। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ভীষণ নাজুক। ঢাকার সব মানুষ যখন পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। নীলাভাবী তার স্বামীকে রাজি করিয়েই বের হতে চায় সংসার থেকে। কিন্তু খোকার নিজের ওপর আস্থা জিরো। সেরাতে খোকা নীলাভাবীকে কটু কথা বলে নিজেকে মুক্ত করে বিপদের হাত থেকে। বিনিময়ে নীলাভাবী খোকার গালে দিয়েছিল কষে এক চড়। খোকা ভাবে যাক একটা গালের ওপর দিয়ে গেলেও জীবন বেঁচেছে। সেই রাতে খোকা বেরিয়ে যেতে নিলে রাজীব আটকে দেয় দাবা খেলার কথা বলে। বিপর্যস্ত এবং বিধ্বস্ত রাজীব ভাইয়ের কাছে ইচ্ছে করে হেরে যখন বাসায় যেতে নেয় ততক্ষণে শহরে শুরু হয়ে অপারেশন সার্চ লাইট। ইয়াহিয়া তখন মানুষ নিধন করে মাটি দখলে তার নেকড়ে এবং হায়েনা পাক আর্মি নামিয়ে দিয়েছে। দুইদিন পর অর্থাৎ ২৭ মার্চ  খোকা বাসায় গিয়ে রঞ্জুকে পায় বাকহারা। রাজীব জানালা দিয়ে আসা গুলিতে মরে ততক্ষণে পচে গেছে।
সবশেষে খোকার মনে পড়ে-  জ্বরাক্রান্ত রঞ্জুকে গাছতলায়  একা ফেলে প্রাণভয়ে ছুটে চলা নরনারীর সাথে সেও যোগ দিয়েছিল। খোকার মনে হয়- দেশ আসলে একটা পুকুর যার নিস্তরঙ্গ তলদেশ অঞ্জু এবং মঞ্জুর মতো রঞ্জুও হারিয়ে গেছে চিরতরে। এইরকম একটা নির্জন পুকুর পাড়ে খোকাকে কাটাতে হবে অনাদিকাল। কারণ রঞ্জু তার বুকে থুথু ছিটিয়ে বিপদ তাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
উপন্যাসের শিল্পরূপ এবং ভাষায় অলংকরণ: “জীবন আমার বোন ” উপন্যাসে পরষ্পর বিরোধী দুটি চিত্রকল্প বিদ্যমান। একটা নির্জনতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা অন্যটি কোলাহল রাজনৈতিক হল্লা। এই কোলাহল আর নির্জনতা যেন জমজ দুই বোন। নির্জনতা দূরে বৃক্ষের ছায়ায় বসে যেন পর্যবেক্ষণ করছে কোলাহলের অর্থহীন আস্ফালন। যেমন মুরাদ, ইয়াসিন রাজনৈতিক আড্ডায় মেতে থাকে, খোকা এসবে খুব বিরক্ত এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। খোকার খালাতো বোন বেলী রঞ্জুর সমবয়সী হলেও বেলী পুরুষ নাচিয়ে, ওষ্ঠরঞ্জক পরে ঠোঁট বেকিয়ে দিব্যি তার যৌবনের ঘোষণা দিচ্ছে। আর রঞ্জু যেন অঞ্জু এবং মঞ্জুর ডুবে যাওয়া পুকুরেই নিবিড় বাস করে। 
মুরাদের বড়বোন লুলু চৌধুরী কর্পোরেট জগতের প্রসিদ্ধ কর্মকর্তা। ব্যবসার জন্য কারো হাত ধরতে হয়, আবার কারো গলা। লুলু চৌধুরীকে খোকা অপছন্দই করে কিন্তু খোকার সাথে যখন দেখা করতে আসে খোকা মুগ্ধ হয় লুলু চৌধুরীর নিটোল মসৃণ পায়ে। খোকার আত্ম স্বীকারোক্তি – দেহের যাবতীয় কোমলতা গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের পাতায় এসে জমেছে; নীলঝর্ণার কোলে একজোড়া অলৌকিক রাজহংসী  যে যার নিজের শুভ্রতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। খোকা তাকিয়ে দেখে আর ভাবে-” প্রতিটি আঙুল যেন নিস্তব্ধতার এক একটি ঠোঁট, মনে হয় একদিন এদের ভাষা ছিল; প্রতিটি নখ যেন এক একটি মিজরাব, অসংখ্য অদৃশ্য তারে বিলোল আলস্যে মৃদু মৃদু সুর তুলে চলেছে, নৈরাকার স্মৃতির মতো অবিরল শিথিল অবসাদে এক একটি দিব্য মূর্ছনা অর্ঘ্য হয়ে ঝরে পড়েছে নাস্তিগর্ভে।” এভাবেই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে সুন্দরের প্রতি চিরকালীন সমর্পণ।
ভাইয়ের স্নেহাদ্র মনন বোনের শরীরকে কখনো যুবতীর দেহ ভাবতে সক্ষম নয়। সে যেন শিশুর নিষ্পাপ দেহবায়ব। ঘুমন্ত- রঞ্জুকে দেখে খোকা ভাবে- মনে হয় রাশি রাশি পাতার ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে জোছনার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন আলো, যেন লতা গুল্মের স্নিগ্ধ নিশ্বাস ;রাত্রিরানীর স্খলিত বসনের একটি চিকন সোনালী সুতো। 
উপন্যাসের পুরো শরীর জুড়ে রয়েছে মনস্তত্বের এমন শৈল্পিক, বিমূর্ত চিত্রায়ণ। 
যে সব বিষয়  বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ব্যক্তি জীবন এবং সামাজিক জীবনের চিত্রকল্পে সামাজিক অবক্ষয়, পুঁজিবাদের আধিপত্য এবং পশ্চিমা প্রভাব স্পষ্ট। তার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত লুলু চৌধুরী, বেলী এবং নীলাভাবী। খোকার সাথে নীলাভাবীর বিশেষ সম্পর্ক জেনেও রাজীব ভাই খোকাকে প্রশ্রয় দেয় এবং দুর্যোগে নিজেই খোকাকে অনুরোধ করে নীলাকে সাথে নিয়ে ঢাকা ছাড়তে। এ যেন স্বেচ্ছায় হাসিমুখে বিষিপান করা। এই ব্যাধি স্বাধীনতা উত্তর সমাজ ব্যবস্থায় আরও সুতীব্র হতে দেখেছি আমরা যার শুরু হয়েছিল প্রাক স্বাধীন সমাজেই। 
আরও একটি শক্তিশালী দিক এই উপন্যাস উন্মোচন করেছে, সেটা হল স্বাধীনতার পক্ষে জনজোয়ার তৈরি হলেও বিল্পবের ব্যাপারে জনসাধারণের কোনো গভীর ভাবনা ছিল না। তেমনি বিপ্লবী বা রাজনৈতিক দলগুলোর ও খুব শক্তিশালী পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি ছিল না। খোকার বয়ানে আমরা পাই- মাথায় বেঁড়ে, চিন্তায় বেঁড়ে,  নিজেদের সম্পর্কে কতগুলো আজগুবি গালগপ্পো সৃষ্টি করে বুক ফুলিয়ে রেখেছে —
খোকা যখন রাজীব ভাইকে জিজ্ঞেস করে – শেষ পরিণতিটা কি, বুঝতে পারছেন কিছু? রাজীব ভাইয়ের উত্তর -আমি কেন নেতারাও সেকথা স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। আর সাধারণ মানুষ সম্পর্কে রাজী ভাই বলছেন- “যে অর্থে তারা স্টেডিয়ামে চীনা একরোব্যাটদের শো দেখতে যায়, ঠিক সেই অর্থেই কিংবা সেই উদ্দীপনা নিয়েই পল্টনের মাঠে নেতাদের লেকচার শুনতে জড়ো হয়। যদি একদিকে স্বাধীকার আর অপরদিকে সস্তায় দুগজ লংক্লথ দেয়া হয়, তাহলে আগে লংক্লথের লাইনেই তারা মারপিট করবে।”
২৫ শে মার্চ কালরাত্রির গনহত্যার এক জীবন্ত দলিল জীবন আমার বোন উপন্যাস। খোকা রাজীব ভাইয়ের সাথে দাবা খেলা শেষ করে যখন বেরিয়ে যাবে তখনই শুরু হয় বজ্রপাতের মতো গুলির শব্দ। এমনই নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়েছিল পাকিস্তানি হায়েনার দল। লেখকের ন্যারেশনে খোকার আত্মকথন-
এই প্রথম জীবনের চেয়েও বড় মনে হয়েছিল এক একটি রাত্রিকে; বিষ্ফোরনের শব্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছিল প্রতিটি পল অনুপলকে। জীবনের অর্থ তখন একটাই, প্রাণের ভার; নারকীয়তার এমন রুদ্রমূর্তি আর কখনো দেখেনি খোকা।
ছন্দপতন: সুন্দরী নারীর অতি সাজ যেমন সহজাত সৌন্দর্যকে ঢেকে দেয়। কফিতে অতিরিক্ত ফেনা থাকলে যেমন মূল পানীয়তে চুমুক দিতে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি। বাঁধাপ্রাপ্ত হন তেমনি ভাষার অতি অলংকরণ কখনো বুদবুদের মতো উপন্যাসের মূল স্রোতধারায় সংযুক্ত হতে নিবিড় পাঠককে বাঁধা দিয়েছে এবং সহজাত গভীরতায় ছন্দপতন ঘটিয়েছে। 
শেষ কথা: “জীবন আমার বোন” উপন্যাস নিবিষ্ট ঘন বেদনার বিমূর্ত চিত্রকল্প। লেখক নিবিড় সাধনায় প্রতিটি শব্দে সেই বেদনাকে এঁকেছেন। সেই বেদনা সময়ের মনস্তত্ত্বের,  জীবন এবং সম্পর্কের মনস্তত্ত্বের, সেই বেদনা একটা রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার প্রাক্কালে এক আগুন জনপদের। যে বেদনার এক একটা বিমূর্ত নাম রঞ্জু,  রাজীব ভাই, খোকা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ।
মাহমুদুল হককে বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক আরও মনযোগী হয়ে পড়বেন বাংলা ভাষার একজন লেখক এবং নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে এ আমার আত্মিক প্রত্যাশা। 
বইটির প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ এবং প্রচ্ছদ করেছেন কাজী হাসান হাবীব। 
*****************************
   নুসরাত সুলতানা 
কবি ও কথাসাহিত্যিক
====================