You are currently viewing নীল রং বেনারসি /  কিযী তাহনিন

নীল রং বেনারসি / কিযী তাহনিন

নীল রং বেনারসি 

কিযী তাহনিন

আমি না ছোটবেলায় খুব চাইতাম, আমার নানী মরে যাক। কারণ আছে। একবার পাড়ার হরি জ্যোতিষি এসেছিলো আমাদের বাড়িতে শুটিং দেখতে। আমার নানী তো বুদ্ধির সাগর। এমনি এমনি ফ্রিতে আমাদের বাড়িতে এসে শুটিং দেখবে তা কী হয়? ফাঁকতালে হাত দেখিয়ে নিয়েছিলো। আমার বয়স তখন ৭। আর আমার ভাই মানিকের ৫। আমরা উঠোনে বসে ছিলাম, নানীর পাশে। মনে আছে আমার। মা আমার মাথার উঁকুন বেছে দিচ্ছিলো। মানিক খেলছিলো, আর নানী তখন হাত দেখাচ্ছিলো। হরি জ্যোতিষি, এক চোখে শুটিংয়ে চলা নাচের দৃশ্যে, আরেক চোখে নানীর হাতের রেখায় তাকিয়ে ছিলো। আমার নানীকে বলেছিলো, “মেলা আয়ু আপনার আঙ্গুর আপা। আপনার কন্যাও দেখি আপনার আগে মরবে।  কিন্তু আপনার মরণ নাই।  বাপরে অনেক দিন বাঁচবেন।”  আমার নানী কি সেই বাণী শুনে খুশি হয়েছিলো? তার হালকা ঘোমটার আড়ালে আমি তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু মা কেমন চমকে উঠেছিলো। আর আমি? সেদিন থেকে মনে প্রাণে চাইতাম, বুড়ি মরুক, আমার মায়ের আগে মরুক। খুব চাইতাম।

বুড়িগঙ্গার পাশঘেঁষা আলমগঞ্জের একটি পুরোনো বাড়ি আমাদের। একদম বাতাসার মতন। বাইরে দেখতে জমিদার বাড়ি যেনো। কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা। সরু একটি গলি ধরে এর দোতলায় উঠতে হয়। পাশাপাশি দুজন ওই গলি দিয়ে যেতে পারে না। দোতলায় উঠতেই একটা বড়সড় বারান্দা । বারান্দার ওপাশেই বুড়িগঙ্গা নদী। একটু এগোতেই বাম দিকে বড় একটি রান্নাঘর, আর ডানে একটি দরজা। সেখানে থাকার ঘর। আর বারান্দা ধরে এগোলে আরো দুইটি বড় থাকার ঘর। সেটি প্রায় ফাঁকাই পরে আছে। আমার নানীর বাড়ি এটি। আমারও। জন্ম থেকে আছি। এই বাড়ি ছাড়া তো ‘আমার’ বলার মতন আর কোনো বাড়ি নেই।

এটা এখন শুটিং বাড়ি। আমাদেরও বাড়ি । কেমন করে আমাদের থাকার বাড়ি এমন মিলমিশ করে  শুটিং বাড়ি হয়ে উঠলো, তার রংচটা এক অতীত আছে।  এ বাড়ির মালিক সৈয়দা আঙ্গুর লতা। আমার নানী। বাগেরহাটের অনাথ মেয়ে আমার নানী, তার মামার বাড়ি থাকতো। ঘটনাচক্রে বিয়ে হলো সম্ভ্রান্ত কিন্তু ঝুরঝুরে অসচ্ছল এক মুসলিম পরিবারে, এই পুরান ঢাকায়।  স্বামীখানাও খুনখুনে। যাই যাই করছিলো বিয়ের পর থেকেই। অতঃপর বিয়ের ৫ বছরের মাথায়, আমার নানীর ২৭ বছর বয়সে, তিনি গেলেন, আর নানী বিধবা হলেন।  সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের নিঃসন্তান বিধবা। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, এমন এক বিধবা।  যার জীবন সম্পর্কে শিক্ষা যথেষ্ট পরিপক্ক, কিন্তু বাহ্যিক শিক্ষা ওই ঠনঠনে।

সেটি ১৯৬৯ সাল। দেশ জুড়ে তখন গণঅভ্যুত্থান। আমি জানি, সেই  সময় মানুষ নিজের দেশ বুঝে নেবার সংগ্রাম করছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন জমে উঠছে। আমার নানীর সাথে সেই গণঅভ্যুথানের কোনো সরাসরি সংযোগ না থাকলেও, আমি নানীর গল্পে শুনে বুঝি যে,  সেও দেশ চেয়েছিলো আর সবার মতন। একটা বাড়িও। সেই সময় সে পথে নামে একটা বাড়ির খোঁজে। এলাকার এক মুরুব্বি সেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যায় নিয়ে আসেন এই বাড়িতে। যেটি এখন শুটিং বাড়ি। এই বাড়ির দেয়াল আর দরজার রং এখন নীল রংয়ের।  পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ঢাকতেই এ চকককে রং। তখন এ বাড়ি নিজ গুনেই রঙিন ছিলো।  আলাদা রং মাখতে হতোনা।

সেই বাড়ির মালিক তখন ছিলেন অক্ষয় সেন।  বিপত্নীক। বনেদি হিন্দু বাড়ি। অক্ষয় সেন আর তাঁর বুড়ো মা থাকে এই বাড়িতে তখন। আমার নানী এলো।  মোটা দাগে যাকে কাজের মানুষ বলে সে হিসেবে এলো তা বলা যাবেনা।  বরং গরিব সম্ভ্রান্ত বিধবা, অক্ষয় সেনের বুড়ো মাকে দেখাশোনা করবে, তার বদলে, পেটে ভাতে ছাদে রয়ে যাওয়া। এটুকুই। কিন্তু এটুকুতে রয়ে গেলে তো এ বাড়ির সেই রংচটা গল্প তৈরী হতোনা।  আর তাই ১৯৭১ দেশ যখন যুদ্ধে জেগে উঠেছে, অক্ষয় সেনের বুড়ো মা নিউমোনিয়ায় মরে গেলো।  এই যুদ্ধের দিনে, অক্ষয় সেনের বাড়ি হল আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতার বাড়ি।  শুনেছি, আমার নানী অমন যুদ্ধের দিনে, শাক লতা পাতা বাগানে ফলিয়ে, মুরগি পেলে সেই ডিম দিয়ে, সবজি আমিষের ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলতো অক্ষয় বাবুর জন্য। অক্ষয় বাবুর ও বয়স ছিল তখন প্রায় ৬০ ছুঁই ছুঁই, নানা অসুখে ভোগা।  যুদ্ধে শেষে, ঠিক করলো তাই কলকাতা চলে যাবে।  আতত্মীয় স্বজন সব সেখানেই। তাঁর মা ছিল এখানে, সে যখন নেই থেকে কী লাভ? অক্ষয় বাবুর সেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে লাভ হয়েছিলো আমার নানী আঙ্গুর লতার।  আপাতদৃষ্টিতে।  অক্ষয় সেন চলে যাওয়ার আগে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, কিংবা যুদ্ধের দিনে তৈরী হওয়া কোন এক অযথা প্রেম এবং কৃতজ্ঞতার কারণে, বাড়িটি আঙ্গুর লতাকে লিখে দিয়ে যায়। আমার নানী আঙ্গুর লতা অক্ষয়বাবুর হাত খামচে বলেছিলো, “আমাকে বিয়ে করেন। বিয়ে ছাড়া এ বাড়ি রাখলে, মানুষ আমাকে নোংরা কথা বলবে।” সব গুছিয়ে ৭২-এ অক্ষয় সেন চলে যায় কলকাতায়। শোনা যায়  চলে যাওয়ার আগে অক্ষয় সেন আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতাকে বিয়ে করেছিলো।  সেটি হিন্দু না মুসলমান মতে সেটি অনেকেরই প্রশ্ন। চলে যাওয়ার  আগে অক্ষয় সেন রেখে যায় এই বাড়িটি, সদ্য বিবাহিত স্ত্রী আঙ্গুর লতা এবং তার গর্ভে একটি সন্তান । সেই সন্তানই আমার মা।  আঙ্গুর লতার একমাত্র সন্তান, কন্যা।  অক্ষয় সেন আর আঙ্গুরলতার শেষ কথা হয়েছিলো, কেউ আর কারো সাথে যোগাযোগ করবেনা।  করেও নি।  আমার নানী আঙ্গুর লতা একবার খোঁজ নিয়ে জেনেছিলো, ওখানে আবারও সুখের সংসার হয়েছে অক্ষয় সেনের। তার কয়েক বছর পর কী এক অসুখে মরেও গেলো অক্ষয় সেন।  অক্ষয় সেন, মানে সম্পর্কমতে,  আমার নানা, তাঁর কোনো ছবিও আমি দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে আমার জানা এইটুকুই।

স্বাধীন দেশে আমার নানী রয়ে গেলো এ বাড়ি জুড়ে। স্বাধীনতা যেমন আছে, আমার নানী ও রয়ে গেছে এ দেশের প্রতিদিনের মানুষ হয়ে।  সাথে জুড়লো আমার মা। মানে আঙুর লতার সন্তান।  আমার মায়ের বিয়ের পর আমি আর মানিক। আমার মা খুব সুন্দর দেখতে। নানী বলে, নানার চেহারা পেয়েছে। আমার নানা অক্ষয় সেনের চেহারাও নাকি অমন সুন্দর ছিলো।  খাড়া নাক।  আমার নাক আর কপাল নাকি ঠিক নানার মতন। আমার মায়ের সম্মন্ধ করে বিয়ে হয়, আমার আব্বার সাথে।  আব্বা বাগেরহাটে মাছের ব্যবসা করতো।  গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, পার্শে মাছ। দুই মাসে একবার আব্বা ঢাকায় এসে থাকতো এ বাড়িতে।  অনেক মাছ নিয়ে আসতো।  মাখনের মতন স্বাদ সেই মাছের।  মা খুব সুন্দর দেখতে, আব্বা অতোটা না, এই কারণেই কিনা জানিনা, আব্বা মাকে খুব সমীহ করে চলতো। আর মা সেই ভালোবাসায় ঝুঁকে যাওয়া আব্বাকে অনেক কম ভালোবাসতো। কিংবা আদৌ বাসতোও কিনা কে জানে। তার নিলিপ্ত দাম্পত্য সম্পর্ক আমি ছোটবয়সে ও বেশ বুঝতে পারতাম।  সেখানে প্রেম ছিলোনা, কোলাহলও না।  এই যে আব্বা বাগেরহাট থাকতো, মা সেখানে যেয়ে থাকতোনা।  আমাদের স্কুলের অজুহাতে।  দুয়েকবার গিয়েছি।  আর যাওয়া হয়নি।  কারণ আমার যখন ১২ আর ভাইয়ের ১০, আমার আব্বা মরে গেলো।  বাগেরহাট থেকে খবর হলো হার্ট এটাক করে আব্বা রাতে ঘুমের মধ্যে মরে গেছে।  আমাদের আব্বাকে শেষ দেখা হয়নি।  আর তার কয়েকমাস পর, প্রায় ৬ মাস পর, আমার মা আমাদের রেখে চলে গেলো।  না মরে যায়নি। পালিয়ে গেলো।  কোন এক ফিল্ম প্রোডাকশনের ম্যানেজারের সাথে।  ছবির শুটিংয়ের কাজ চলছিল আমাদের বাড়িতে, সেই সময়ে পরিচয় হয়তো।  ওই শুটিং চলতে চলতেই চলে গেলো মা, আমাদের জানিয়ে যায়নি। তাই পালিয়ে গেছে বলাই ভালো, সাথে নানীর একজোড়া সোনার ছোট্ট ঝুমকা, আর দুটো পুরান সিল্কের শাড়ি নিয়ে গেছে। নানীর ট্রাঙ্কটা তালা মারা থাকে ভাগ্যিস, সেখান থেকে কিছু নিতে পারেনি।  আর কোনো দিন মা আমাদের খোঁজেনি, নানী কিংবা আমরা ও মাকে খুঁজিনি।  আর সেই যে মা আমাদের ফেলে চলে গেলো, আসলে পালিয়ে গেলো, সেদিন থেকে আমি আর কোনোদিন চাইনি, আমার নানী মরে যাক।

এই বাড়ি শুটিং বাড়ি অনেক বছর আগে থেকে।  সেই যুদ্ধের পর, আমার নানা যখন নানীকে বাড়ি দিয়ে চলে গেলো। তা শুধু  বাড়ি দিয়ে তো আর পেট ভরেনা। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলো নানীকে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে।  আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতার ওই যে বাহ্যিক শিক্ষা না থাকলে ও জীবন তাকে গড়েপিটে নিয়েছে।  বাড়ি সম্পদ, বিক্রি করা যাবেনা।  সেটা সে বুঝেছিলো। সে তার এক দূরসম্পর্কের খালাতো বোনের পরামর্শ আর যোগাযোগে, এ বাড়িটিকে শুটিংয়ে ভাড়া দেয়।  আরো একটি কারণ অবশ্য ছিলো, এই বাড়িটিকে শুটিং বাড়ি করার পেছনে।  সেটা পরে বলছি।

সেই ১৯৭৪ সাল থেকে এই বাড়ি শুটিংয়ের কাজে চলছে, এখনো।  আমার মায়ের ছোটবেলা, আমাদের ছোটবেলা।  আর এইযে এখন আমি ২০ বছরের আর মানিক ১৮ তে, এখনো শুটিং চলছে এ বাড়িতে।  মা যখন ভেগে গিয়েছিলো কয়েক বছর আগে, নানী একবার ভেবেছিলো আর কোনো শুটিং কোম্পানিকে ঢুকতে দিবেনা এই বাড়িতে।  কিন্তু পেটের টান বলে একটা কথা আছে তো।  এই টাকায়  আমাদের সংসার চলে, আমাদের দুই ভাই বোনের পড়াশোনা।  আমি এইচ এস সি পর্যন্ত পড়েছি। তারপর আর পড়িনি।  আর আমার ছোট ভাই এইচ এস সি পাশ করে এবার বি এ তে ভর্তি হলো।  এই শুটিংয়ে ভাড়ার টাকাতেই তো চলে আমাদের। শুটিং থাকলে রান্না প্রায় দিনেই করতে হয়না আমাদের। শুটিং ইউনিটের বাড়তি খাবার পাই আমরা । আগে অনেক বেশি শুটিং হতো। এখন আগের চেয়ে কম হয় । অনেক শুটিং হাউস তৈরী হয়েছে নতুন নতুন। পুরনো বাড়ি, কিংবা জমিদার বাড়ির কাহিনী হলে, রং টং  লাগিয়ে এ বাড়ি ব্যবহার করে । কিছু কোম্পানির সাথে আমাদের পরিচয় বহু বছরের। তারাই বারবার আসে। নতুনরাও আসে।  ওই যে গেলো বছর মনমাঝি সিনেমা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলো, সেটা ও তো আমাদের বাড়িতেই শুটিং করা।

আমার নানীর নিয়ম তৈরী করা।  সকাল ৯ টা থেকে শুরু, রাত ১১ টার মধ্যে শেষ করতে হবে শুটিং।  নাটক আর বিজ্ঞাপনের শুটিং হলে ভাড়ার ধরণ আলাদা। শুটিংয়ের সময়টা আমরা জরুরি কাজের জিনিসপত্র, হাড়িপাতিল নিয়ে কোণার ঘরে চলে যাই।  বাকি বাড়িতে শুটিং হয়।  শুটিং শেষ হলে, আমরা আবার আগের মতন, ঝুরঝুরে বাড়ি জুড়ে সংসার পাতি। ছোট থেকেই এমন অদল  বদলের সংসার খেলাই শিখেছি আমরা।  আগে নানী দেখতো এসব শুটিংয়ের হিসাব কিতাব।  আজকাল ভাই মানিকই দেখে।  মায়ের ভেগে যাওয়ার ঘটনার পর, নানী খুব একটা আমাকে সিনেমার লোকজেনর সামনে ঘেঁষতে দেয়না।  তবুও ফাঁকতালে দুয়েকজনের সাথে যে আমার খাতির হয়নি তাতো না।  ওই যে ক্যামেরার অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে খাইরুল ভাই, উনার এখানে শুটিং থাকলেই আলাদা করে এসে আমার সাথে কথা বলে।  ছাদে উঠে বুড়িগঙ্গা দেখতে দেখতে বলে, “তোমার সাথে যদি এই বাড়িতে থাকতে পারতাম ঝর্ণা।” মাঝে সাঝে ফোনও দেয়, আমার মোবাইলে।  নানী সারাক্ষন তক্কে তক্কে থাকে।  তাই খুব একটা কথা হয়না, সুযোগ পেলে কথা বলি খাইরুল ভাইয়ের সাথে। আর কত যে নায়ক নায়িকা দেখেছি এ জীবনে। ভিলেনও।  কাকে দেখিনি? নানী আমাকে এই মোবাইল কিনে দেয়ার পর খুব সুবিধা হয়েছে।  পছন্দের কেউ আসলে ছবি তুলতে পারি। দুই বছর আগে জয়া আহসান আসলো শুটিংয়ে।  ওমা, কি সুন্দর সোনার মতন গায়ের রং। মাখনের মতন গলে গলে হাসে। দুইদিন শুটিংয়ে আমি ছায়ার মতন তার পিছে ঘুরে বেড়াতাম। উনি রাগ করতোনা একটুও।  বরং শুটিংয়ের শেষ দিন পরিচালককে বলে, “শুটিং তো শেষ, এগুলো তো আর লাগবেনা, এই মেয়েটাকে দিয়ে যাই? কী মিষ্টি মেয়ে।” বলে তার হাতের নীল কাচের চুড়িগুলো আমাকে দিয়েছিলো। আমি যে কী যত্ন করে তুলে রেখেছি চুড়িগুলো। এমন করেই চলছে। আমাদের শুটিং শুটিং দিন।

আমাদের বাড়িতে আজ থেকে নতুন শুটিং শুরু।  একটা সিনেমার জন্য চারদিন শুটিং চলবে এ বাড়িতে। জমিদার বাড়ির গল্প।  শুটিংয়ে ফিসফাস শুনে মানিক নানীকে এসে জানালো, আগামীকাল  এ বাড়িতে রঞ্জনা আসছেন।  ম্যাডাম রঞ্জনা।  এক সময়ের সেই মন কাঁপিয়ে চুরমার করে দেয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা রঞ্জনা।  নানী কেমন আলসি করে সারাদিন তোষকে শুয়ে ছিলো।  ওই কোণার ঘরে।  শুটিং থাকলে আমরা যে ঘরে জড়োসড়ো হয়ে থাকি সে ঘরে।  রঞ্জনার কথা শুনে, নানী দেখি নড়ে  চড়ে। থমকে যাওয়া রোদের দিনের পর বিকেলে একটু বাতাস পেলে, বটগাছের পাতা যেমন করে দুলে, তেমন।  নানী দুলে দুলে বিছানা থেকে উঠে বসে।  “রঞ্জনা!”

আমার নানী আঙ্গুর লতার প্রিয় নায়িকা রঞ্জনা। নানীর আমলের নায়িকা।  এখনো অভিনয় করে মা নানীর চরিত্রে। ছোটখাট চরিত্রেও। শোনা যায় টাকা পয়সার বড্ড অভাব। একসময় দুহাতে টাকা উড়িয়েছে।  এখন নাকি কিছুই নেই।  না জৌলস না টাকাপয়সা।  সেই একবার এসেছিল এ বাড়িতে। শুটিং করতে। তখন আমরা জন্মাইনি । আমার মা নাকি তখন অনেক ছোট। ওই যে নানীর এ বাড়িকে শুটিং বাড়ি বানিয়ে ফেলার পেছনে একটা লুকানো কারণ আছে। সেটা নানী নিজেই বলে, এই রঞ্জনাকে দেখবার জন্যই সে নাকি এ বাড়ি শুটিংয়ে দিয়েছিল। নিজের ও খুব ইচ্ছা ছিল অভিনয় করার। নানীর কাটাকাটা চেহারা। কিন্তু দাঁত প্রয়োজনের চেয়ে একটু উঁচু হওয়ায় কোনদিন সে নায়িকা হওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু নায়িকা দেখতে আমার নানী আঙ্গুর লতার ভারী ভাল লাগে। এই ৭৫ বছর বয়সে এসেও। আর রঞ্জনা তো নানীর কাছে ভালোবাসার মতন প্রিয়।

তো সেই আগামীকাল আসলো। আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতা নিয়ম ভেঙে আজ শুটিংয়ের আশপাশ খুব ঘুরছে। সকালে স্নান করে শীর্ন চুলে পরিপাটি খোঁপা করে, গেল ঈদের খয়েরি সুতির পাটভাঙা শাড়ি পরে ঘুরছে।  রঞ্জনাকে এক ঝলক দেখবে বলে। দিন বাড়তে থাকে। শুটিং চলতে থাকে।  রঞ্জনা তো আসেনা। শুটিংয়ে হুট্টগোল শুরু হয়। খবর পাওয়া যায়, শ্বাসকষ্ট, নিমোনিয়াতে আংক্রান্ত হয়ে রঞ্জনা এক হাসপাতালের আইসিউতে। শুটিং প্যাকআপ হয়ে যায়।

তার পরদিন আবার শুটিং শুরু হয়। রঞ্জনার ছোট্ট অংশ বাদ দিয়েই। সবাই বিচলিত। কালকে রঞ্জনার পার্টটুকু শেষ করতেই হবে। শুটিং এর শেষ দিন কাল। যাদের বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছে, তারা  এতো অল্প সময় আসতে পারবেনা। এখন শুটিংয়ের ভরা মৌসুম। যাদের পাওয়া যাচ্ছে পরিচালকের পছন্দ হচ্ছেনা। আমি আর মানিক কান পেতে এসব আলোচনা শুনি। শুটিংএর ম্যানেজারের বুদ্ধিতে নানীকে ডেকে পাঠায় পরিচালক। আজ আর সেজেগুজে নেই নানী।  পরিচালক ডেকেছে শুনে, মাথায় আলতো ঘোমটা দিয়ে সামনে আসে।  সারাজীবনের না মেলা হিসাব, কোন উনিশ বিশে মিলে সরল অংকের মতন প্রমাণিত হয়ে যাবে, কে আগে থেকে বলতে পারে?  নানীকে দেখে পরিচালক এই বলে ওঠে,  “আররে আপনার বয়স, চেহারা  একদম মিলে যায় চরিত্রের সাথে। ছোট্ট চরিত্র। প্লিজ অভিনয়টা করে দিন খালাম্মা। বিপদে পড়েছি।” পরিচালক নিশ্চয়ই ভাবে, এ বাড়িরই মানুষ এই মহিলা। আর অল্প কিছু টাকা গছিয়ে দিলে হবে। রঞ্জনার জন্য বরাদ্দ প্রায় পুরো টাকা বেঁচে যাবে। তেমন কিছু করতে হবেনা নানীকে,  শুধু উঠোনে বসে পান চিবুবে, আর তার জমিদার ছেলে উঠোন দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে, “বাবু কই যাস?”

কত সিনেমার মতন দিন এসেছে আমার নানীর জীবনে। তার সবগুলোর শেষেই ছিলো বিয়োগ আর বিরহ।  এমন দিন তো আসেনি। নানী দেখি ভাবছে।  নিশ্চয়ই ভাবছে, সৈয়দা আঙ্গুর লতা অভিনয় করবে  রঞ্জনার বদলে? আচ্ছা, রঞ্জনা কেনো  এত ছোট চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন?  নিশ্চয়ই অনেক অভাব।  হ্যাঁ না বলার তেমন সুযোগ পায়না নানী ।  পেলেও সে হয়তো না বলতোনা। আমি নিশ্চিত।  আর আমার আর মানিকের উৎসাহে সেই না  ধোপে টিকতোও না। কথা হলো, কাল সকালে শুটিং ইউনিট চলে আসবে।  শাড়ি কাপড় তারাই আনবে।  জমিদারের মা, একটা দামি শাড়ি পরতে হবে। ইউনিট সব জিনিস নিয়ে আসবে।

কাল সকালে শুটিং ইউনিট আসবে।  আজ সন্ধ্যা থেকে নানীর বুকে ব্যথা।  বড্ড কষ্ট শুরু হলো হাঁপানির। পুরোনো ব্যামো। ইনহেলার ওষুধ দেই, সর্ষের তেল গরম করে বুকে ঘষি আমি আর মানিক।   গরুর মাংস খাওয়া একদম বারণ নানীর। আজ শুটিংয়ের খাবার থেকে একটু খেয়ে ফেলেছে গরুর মাংসের তরকারি। চোখ ভিজে যায়।  মানিক ও ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকে। মন খারাপ হয় আমাদের , কাল হয়তো আর শুটিং করা হলোনা নানীর। আরো গভীরে ভয় জন্মে, মরে যাবেনা তো নানী? আমি সেই বহু বছর ধরে চাইনা আর, চাইনা, আমার নানী মরে যাক।

সারারাত নানীর শ্বাস নিয়ে টানাটানি। কখন যে চোখ বুজে এলো।  ঘুম ভাঙে টুকটুক শব্দে। নানীর তোষকের পাশে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম।  আর মেঝেতে মানিক এখনো মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে।  নানী তো নেই ঘরে।  ওমা, সৈয়দা আঙ্গুর লতা, আমার নানী, দেখি স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে চুলে টিকটিকির লেজের মতন বেণী ঝুলিয়ে দিব্যি উঠোনে ঘুরছে। কে বলবে, শ্বাস কাল বিদায় নিচ্ছিলো প্রায়?

শুটিং ইউনিট চলে এসেছে সময় মতন। শুটিং শুরু হবে। যে শাড়িটি নানীর পরবার কথা, এসে পৌঁছায়নি। জানা যায়, শাড়ি শুটিংয়ের আগে দেয়া হয়েছিল নায়িকা রঞ্জনার কাছে। এরপর উনি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর, সে শাড়ি তো আর ফেরত আনা হয়নি। রঞ্জনার অবস্থা আশঙ্কাজনক, এখনো আইসিউতে।  এ অবস্থায়,  উনার বাড়ির কেউ  বলতে পারছেন না শাড়ি কোথায়।  শুটিং আটকে যায়।  আরেকটা শাড়ি জোগাড় করতে হবে আগে।

নানী গুটিগুটি পায়ে উঠে যায় তার ঘরে।  সেই যে পুরোনো ট্রাঙ্ক তালাবন্ধ, তার ঘরের কোণে রাখা, জং পড়া, যা কখনো খোলা হয়না – খোলে।  ভেতর থেকে সেই নীল আর রুপালি সুতার কাজ করা নরম বেনারসি শাড়ী বের করে।  ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিনের গন্ধ।  কুঁচকে আছে।  নিয়ে আসে পরিচালকের কাছে।  “এ শাড়ি চলবে?”

বার চক্ষু চড়ক গাছ।  এ শাড়ি কই পেলেন? এ তো মাস্টারপিস।  আমার নানী কিছু বলেনা।  হাসে। শুটিং ইউনিট ভাবে নিশ্চয়ই, সৈয়দা আঙ্গুর লতা যিনি এ গোটা বাড়ির মালিক, ভঙ্গুর ঝুরঝুরে হোক, বাড়ি তো, তার এমন একটা শাড়ি তো থাকতেই পারে। শাড়ি এ হাত থেকে ও হাত যায়।  সবাই মুগ্ধ।  সিনেমার নায়িকা, নাকের কাছে নিয়ে, মুখের কাছে  চেপে ধরে শাড়ি, “এমন শাড়ি যদি পেতাম।” আমার নানীর চোখে কেমন চনমনে ঝিলিক খেলা করে। পরিচালক, ইউনিটকে দেয় শাড়ি ইস্ত্রি করে দিতে।  শুটিং শুরু করতে হবে।

নীল নরম বেনারশির জমিনে, রুপোর জরির জমাট কাজ। আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতা সেই শাড়ি পরে সামনে আসে সবার, জীবনে প্রথম বার। এই ৭৫ এ।  তার জীবনে প্রথম চুরি করা সেই শাড়ি। সেই য বার রঞ্জনা বহু বছর আগে এ বাড়িতে শুটিং করতে এসেছিলেন, তার এই বহুমূল্য শাড়িটা এনেছিলেন, শুটিংয়ে পরবে বলে।  ব্যাগে গুছিয়ে এনেছিলেন।  কিন্তু রঞ্জনা আর বাড়ি গিয়ে খুঁজে পাইনি সেই শাড়ি। তাঁর পরা হয়নি সেই শাড়ি।  এই নিয়ে পত্রপত্রিকায় সেই আমলে লেখা হল, “মন খারাপ নায়িকা রঞ্জনার।  হারিয়ে গেছে, হাতে বোনা বহুমূল্যের নীল বেনারসি।”

আমি ভাবি, কোনদিন পরবে বলে শাড়িটা চুরি  করেনি হয়তো আঙ্গুর লতা, আমার নানী।  রঞ্জনা কে ভালবেসে, রঞ্জনার মতন হতে চেয়েছিল? নাকি আজকের দিনটির জন্যই? কে জানে?

রঞ্জনার হারিয়ে যাওয়া নীল শাড়ি পরে, রঞ্জনার চরিত্রে – আমার নানী সৈয়দা আঙ্গুর লতা।

শুটিং শুরু হবে।  এক্ষুনি পরিচালক অ্যাকশন বলবে।