You are currently viewing নারীর জয়যাত্রার সাতকাহন> রোকসানা পারভীন সাথী

নারীর জয়যাত্রার সাতকাহন> রোকসানা পারভীন সাথী

নারীর জয়যাত্রার সাতকাহন

রোকসানা পারভীন সাথী

উত্তরবাংলা থেকে শুরু হলো জয়যাত্রা। অবতরণ ঘটলো দক্ষিণবাংলায়। ডুয়ার্সের চা-বাগান,স্বর্গছেড়া চা-বাগান বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোবাসার, ভালোলাগার সৌরভে মুখরিত। উত্তরবাংলার চিরসুশ্যামল অবারিত চা-বাগান, আঙরাভাসা নদীরঙিন মেয়েটি আবহমান বাংলার প্রথাবিরোধী, ঘুণেজর্জর কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙে আলোয় ভরা নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত করার স্পর্ধা – দুঃসাহস দেখালো। যার নামের অতলান্তে নিহিত তিমিরাভিসারের বিরুদ্ধে অরুণিমার বিজয়কেতন প্রভায় সূর্যালোকিত হবার মূলমন্ত্র! শ্বাপদসঙ্কুল সংগ্রামাচ্ছন্ন জীবনের বিপরীত স্রোতে ভেসে – ডুবসাঁতার কেটে আলোর ডাঙায় উত্তরণের প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র মিলেছে দীপাবলির।এই বিজয় সমগ্র বাঙালি নারীর।

* পঞ্চাশের কলকাতা ও শহরতলি, কো- এডুকেশন কলেজ,মেয়েদের হোস্টেল, কফি হাউস, সমকালীন ছাত্র আন্দোলন, নকশালপন্থী রাজনৈতিক পটভূমির অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ দেখেছি।আরো বিস্তৃতভাবে নজর কেড়েছে সর্বভারতীয় কর্মজীবনের অনুদার পরিস্থিতি ও প্রতিকূলতার চৌকাঠ মাড়িয়েই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে প্রথাবিরুদ্ধ চিরসবুজ চিত্রাবলির বাগ্ময় হাতছানি!

* স্বর্গছেড়া চা-বাগানে বেড়ে ওঠা মেয়ে দীপাবলির তৃণমূল সংকট, প্রতিকূলতা ও দুর্দান্ত মননে মেধার সঞ্চয়ী সান্নিধ্যে ও সাহসিকতায় উত্তরণের যে অভূতপূর্ব বিস্ময়াক্রান্ত ঘোরের প্রবাহ পাঠককুলকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে স্বপ্ন পূরণের দুরন্ত বাসনার অত্যুঙ্গ উচ্চতায়।তরতরিয়ে এগিয়ে চলে চেতনাপ্লাবিত ময়ূরপঙ্খি নাও। স্বাধীনতা – উত্তর বাঙালির জীবনে স্বাধিকার, বঞ্চনা, অপ্রাপ্তি, বেদনা, হাহাকার নিরসনের জয়যাত্রা সূচিত হলো। শুরু হলো নারীর বিজয়ের অনাস্বাদিত অঘ্রাতপূর্ব নবমাত্রার পথচলা — যা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উপহার!

* দীপাবলি বাঙালি মেয়ের নবজাগরণের পথকে বর্ণচ্ছটায় করেছে কুসুমাস্তীর্ণ। দীপার আবেগে – দ্রোহে মেধার পারঙ্গমতায় আপ্লুত আমরা।মেয়েরা। সামাজিক, আর্থ- সামাজিক বৈষম্যের শিকল ভাঙার পথ তৈরির যাদুকরী দুঃসাহসের মন্ত্রে উজ্জীবিত দীপাবলি। দীপার আঙুল ধরেই হেঁটেছি আমরাও। শিক্ষাবঞ্ছিত অনগ্রসর নারী, অসম বিয়ে, বাল্যকালে বিয়েকে না বলেছি আমরাও সমস্বরে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে ভর্তি হয়েছে দীপা স্কুলে – কলেজে। টিউশনি করে লেখাপড়ার ব্যয়ভার লাঘব করেছে নিজেই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিবর্ধন ঘটেছে — যা কালচারাল গ্রোথের নিক্তি পাল্লাতেও প্রোজ্জ্বল। চিরভাস্বর।

* দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই : ‘ নারীকে তার প্রাপ্য দিলে দেশ ও দশের সুফল মিলে ‘ স্বাবলম্বী নারী দেশ ও দশের কল্যাণ বয়ে আনে।সমাজকে ও দেশকে বদলে দেয়ার অনন্য জ্যোতিষ্ক দীপাবলি। শুরু হলো নবযাত্রা। স্বপ্ন পূরণ হলো। আলোকবর্তিকা হওয়ার, স্বাবলম্বী হবার অধীর সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ হতে শিখলাম দীপাবলির হেঁটে যাওয়া পথেই। শুরু হলো নবজাগরণ। বিজয়কেতন তূর্যনিনাদ উল্লাস।

* ১৯৭৫ সালে ‘ দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো প্রথম উপন্যাস ‘ দৌড় ‘। শুরু হলো সাহিত্য জগতের রথে চেপে ভোঁ দৌড়। খ্যাতি,যশ,জনপ্রিয়তা, পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষের ইতিহাসের সোনালি পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো। গর্ভধারিণী, সাতকাহন, তেরো পার্বণ,স্বপ্নের বাজার, অগ্নিরথ, ভিক্টোরিয়ার বাগান,আট কুঠুরি নয় দরজা,মৌষকাল, ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ। রুপোলি পর্দাতেও কিশোর গোয়েন্দা অর্জুনের তুমুল জয়জয়কার। ১৯৮২ সালেই প্রাপ্তির ঝুলিতে স্থান পায় আনন্দ পুরস্কার। ‘ কালবেলা ‘ উপন্যাসের জন্যে ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৯ সালে বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত হন ‘ কলকাতায় নবকুমার’ এর জন্যে। ‘ কালবেলা’, ‘ বুনো হাঁস’ ধ্রুপদী কালজয়ী চলচ্চিত্র।

*’ কালবেলা’ র অমর স্রষ্টা বিলীন হলেন কালপুরুষের জগতে ৮ মে, ২০২৩. উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম উত্তরাধিকার, কালবেলা,কালপুরুষ — সহ বেশ কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাসের চিরঅম্লান রূপকার সমরেশ মজুমদারের। জলপাইগুড়ির চা-বাগানেই কেটেছে দুরন্ত শৈশবের ওড়াউড়ির প্রজাপতি গল্পের মৌতাত দিনগুলো। অনিমেষ – মাধবীলতার মধুকরি অমর স্রষ্টা পৃথিবীর পথে হেঁটেছেন মাত্র ৭৯ বছর।

============================

 

রোকসানা পারভীন সাথী: কথা সাহিত্যিক

=================