You are currently viewing নতুন থিয়েটারের চেষ্টাঃ আমার ভাবনা/ সাইফ সুমন

নতুন থিয়েটারের চেষ্টাঃ আমার ভাবনা/ সাইফ সুমন

নতুন থিয়েটারের চেষ্টাঃ আমার ভাবনা

সাইফ সুমন

হুজুগ এবং আবেগ, মানুষকে- বিশেষ করে এই বঙ্গের মানুষদের খুব বেশি প্রভাবিত করে। এই দুটো ব্যাপারেই যুক্তি এবং বাস্তবতা অনেকাংশেই মানে না। নেশা- তা যে প্রকারেরই হোক- এর ক্ষেত্রেও এই দুই ব্যাপার জড়িত। নেশা- কেউ হুজুগে, কেউ আবেগে, কেউবা আবার এমনি এমনি ধরে বা করে। বলতে বা শুনতে খারাপ লাগলেও, বোধ করি এটা সত্যি- ‘থিয়েটার’ একটি নেশা, বিশেষত এই দেশে। সেই নেশাটাকে পেশা হিসেবে দাঁড় করাতে চাই আমরা। এখন কথা হলো, নেশাকে পেশা হিসেবে দাঁড় করানো যায় কি?

কোন বিষয় কে পেশা হিসেবে দাঁড় করাতে গেলে- তার কিছু উপাদান ও বৈশিষ্ট্য লাগে। সমাজে এর চাহিদা লাগে। গুণ বা দক্ষতা সম্পন্ন জনবল লাগে। গুণ ও দক্ষতাসম্পন্ন জনবল তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান লাগে। একটি চৌকুশ টিম লাগে। থিয়েটারকে পেশা হিসেবে দাঁড় করাতে গেলে এই এই ব্যাপারগুলো তো লাগবেই, সেই সাথে নিজস্ব একটা জায়গা লাগবে- যেটাকে স্টুডিও বলা যায়, সেটা লাগবেই। দেখে বাহ্ বলার মতো, উফ-আহ্ করার মতো প্রযোজনা লাগে। থিয়েটারকে পেশাদার করতে এর কিছুই নেই আমাদের।  এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রতি বছর বেশকিছু ছেলে-মেয়ে বের হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কিন্তু ক্ষেত্র না থাকায় তারা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। তার উপর আমাদের দূর্ভাগ্য- আমাদের দেশের গড়ে ওঠা ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত বর্তমান সংস্কৃতি, শিল্পকলা-বান্ধব নয়। চলমান রব ‘সংস্কৃতি বান্ধব’- একটা ধারণা মাত্র। সরকার, জনগণ- কেউই প্রগতির পথে নেই। গায়ের জোরে কতটুকুই আর এগুনো যায়! এখন থিয়েটারকে পেশা হিসেবে সবাই চায়। ঐ চাওয়াটুকু পর্যন্তই- এর জন্য কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উদ্যোগটা সরকারকে দিয়ে নেওয়াতে হবে প্রথমে।  রেপাটরি হয়েই এসেছে সরকার,  বিত্তশালী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আনুকুল্যে। সরকার, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা সঠিকভাবে যেতে পেরেছি বলে মনে হয় না। যারা যেতে পারেন তারা যান ঠিকই কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কাজে।

এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে রেপাটরির নামে যে থিয়েটার দলগুলো হয়েছে- সেগুলো বোধ করি সাময়িক উত্তেজনার ফসল। নিজ দলে কাজ করার সুযোগ না পেয়েই অন্য একটি দল করা- সেটাই রেপাটরি । এতে চলমান গ্রæপ থিয়েটার গুলোর থেকে খুব যে আলাদা কিছু দাঁড় করনো গেলো- সেটা বলা যাবে না। ভিতর-বাহির এক রেখে শুধু নাম রেপাটরি ধারণ ছাড়া কিছুই হচ্ছেনা। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে বলেও মনে হয় না এই রেপাটরি গুলোর। অবশ্য কিইবা করার আছে- অন্যের দিকে চেয়ে চেয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে শুধু। আমি মনে করি, সরকার শিল্পকলা একাডেমির অধীন একটা ন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি বা জাতীয় রেপাটরি দল পরিচালনার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। শুরু বোধ হয় হয়েছে- কিন্তু সেটা অপরিকল্পিতভাবে। সময় কিন্তু কম যায়নি। রেপাটরির একটা নমুনা এতদিনে দাঁড় করাতে পারিনি আমরা। বাঙলা থিয়েটার ১৯৯১ সালে প্রথম শুরু করলো, কিন্তু সেটাও আবেগনির্ভরই ছিল বোধ করি। না হলে সঠিক পথে এগুতে পারেনি কেন? সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) একটা নমুনা হতে পারতো কিন্তু সেটাও ব্যক্তি-সীমাবদ্ধতার জন্য মুখ থুবরে পড়লো। রতন থিয়ামের কোরাস থিয়েটার- একটা নমুনা হতে পারে আমাদের জন্য। হতে পারে এই জন্যই বলছি, সব ফরমুলা তো সব জায়গায় খাটে না। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

পার্ট-টাইম থিয়েটারচর্চা দিয়ে রেপাটরি হবে না। রেপাটরির টিম তৈরি করার জন্য প্রতিনিয়ত চর্চার ব্যবস্থা থাকতে হবে- যেটা হতে হবে আবাসিক। একটা রেপাটরির মাসে দশটা শো করার সুযোগ ও সামর্থ থাকতে হবে। এই ‘সুযোগ’  মানে শো করা। মাসে দশটা শো করবে আর বাকিদিন মহড়া। এই করতে চাইলে তো শিল্পকলা কেন্দ্রিক ভাবনা দিয়ে হবে না। আবার এতো শো দেখাার মতো দর্শকশ্রেণীও আমাদের নেই। আমরা থিয়েটারের দর্শকশ্রেণী গড়ে তুলতে পারিনি। পারিনি তার অনেক কারণের অন্যতম- আমাদের চলমান সমাজব্যবস্থা শিল্পকলা-বান্ধব নয়। বৃহৎজনগোষ্ঠি শিল্পকলা বিরোধী। নগরে বসবাসকারীগণও মানসিকভাবে নাগরিক বা শিল্পমনস্ক  নন। তাই আপাতদৃষ্টিতে এর কোন সম্ভাবনা দেখছি না।

ঢাকায় ১৬টি রেপাটরি দল হয়েছে এখন পর্যন্ত- যদিও এক্টিভ আছে ৪/৫টি। বোধ করি কোনটির মধ্যেই রেপাটরির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নেই বা থাকার কথাও না। বলা যায় এখন পর্যন্ত, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি)- এর মধ্যে রেপাটরির একটা মেজাজ ছিল। দলটির প্রযোজনা গুলোর মধ্যেও সেটার ছাপ পাওয়া যেতো। নিজেদের দর্শক-শ্রেণী তৈরী করতে পেরেছিল একটা- আর কোন দলই সেটা পারেনি। পারেনি কারণ তারা নাম-সর্বস্ব রেপাটরি গঠন করেছে। তবে দু-একটা দল ছাড়া, সবাই নান্দনিক ও দর্শকনন্দিত প্রযোজনা দিতে পেরেছে, কিন্তু চলমান থাকতে পারেনি। ভিত্তি ছাড়া তো অবকাঠামো দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব নয়। গ্রæপ থিয়েটারের বাইরে এসে নতুন কিছু করছি- এটাই যদি সান্তনা হয়, তাহলে আর কি! আমার জানামতে, ‘থিয়েটাওয়ালা রেপাটরি’ প্রতিটি শোতে সকল কলা-কুশলীগণকে একটা নির্দিষ্ট পরিমানের সম্মানী দিয়ে থাকে- টিকিট বিক্রি যাই হোক। এটা টোকেন মানি ছাড়া কিছু নয়। অধিকাংশ রেপাটরি এইটুকুও করেন না বা পারেন না। তাহলে কী দাঁড়ালো?

গ্রæপ থিয়েটার চর্চা- যে সময়ে যে বাস্তবতায় শুরু হয়েছিল, তার কিছুই এখনকার সাথে মেলানো যাবে না। আমরা- থিয়েটার চর্চাকারীগণ, নিজেদের জীবন-যাত্রায় বদলে গেছি, কিন্তু বদলাইনি থিয়েটার চর্চার ধরণ। স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া  থিয়েটার একটা শিল্প মাধ্যম হিসেবে যতটা না বিবেচিত হয়েছে- তারচেয়ে বেশি বিবেচিত হয়েছে একটা আন্দোলন হিসেবে। তৃতীয় প্রজন্ম এসে গেছে- তাও ঐ এক বলয় থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা বা চেতনার পিঠ চুলকানো আর কতোকাল! বিষয় বৈচিত্রতা নেই, অভিনয় নেই, উপস্থাপনায় নতুনত্ব নেই- তো কী দেখতে আসবে দর্শক! নিধিরাম সর্দার সেজে বসে আছে অধিকাংশ দলগুলো।

একই ভাবধারার গন্ডির ভেতর পরে গেছে আমাদের নাট্যচর্চা। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যারা অগ্রসর, তাদের বুদ্ধি বৃদ্ধির চেষ্টাই করে যাচ্ছেন সবাই। কিন্তু আমোদপ্রিয় সাধারণ মানুষ-  যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের ফাঁকে একটু যে সস্তি চায়- সেটা ভাবলেই জাত যায়। অথচ বিশ্বময় এইসব আমোদপ্রিয় দর্শকের জন্যই মূলত প্রযোজনা করে রেপাটরি গুলো। দর্শক মূখ্য একটা ব্যাপার- রেপাটরির ক্ষেত্রে। দর্শক চায় মুগ্ধ হতে- একটা ভালো লাগা নিয়ে বাসায় ফিরতে। আমারা কী সীমাবদ্ধতা নিয়ে নাট্যচর্চা করছি- সেটা দেখার জন্য টিকিট কেটে একজন দর্শক কেন আসবে। যেটুকু ছিল দর্শক- তাও বি ত হতে হতে আজ তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কোন চেষ্টা নেই- খালি দর্শক নাই-দর্শক নাই রব। দর্শক কী দেখতে আসবে- সেটা কখনোই ভাবি না আমরা। আসবে দেখতে এমন প্রযোজনা মে  আনতে হবে। ঢাকা শহরে ৬২টি দল আছে নাটকের। ভাবা যায়! কী করে এই দল গুলো! ৬২ টা দলের মধ্যে ৫টার বেশি নাটকের নাম বলা যাবে না- যেগুলো দেখার যোগ্য।

“নাট্যকর্মীরা জায়গা ছেড়ে দেন, শিল্পীদের বসতে দেন।” নারায়ানগঞ্জে কল শোতে গিয়ে হলে আমরা বসে আছি এমন সময় নাচের একটা  দল হলে ঢুকলে উপস্থাপক মাইকে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটাই থিয়েটার চর্চাকারীদের প্রকৃত অবস্থান সমাজে এখনো। বোধকরি থিয়েটারের দৈন্য-দশা ঘুচুক- সেটা আমরা  চাইনি কখনোই। এখনো শুধু দুবেলা খাবার আর যাওয়া-আসার খরচ দেবে- শুনলেই ২৫-৩০ জনের বহর নিয়ে দেই দৌড়। নিজেরা নিজেদের অবস্থান পরির্বতনের কোন চেষ্টাই করিনি আমরা। গ্রæপ থিয়েটার চর্চাকারীগণের মানসিকতা পরিবর্তন আবশ্যক। মন্দের ভালকে আমরা মেনে নেই সবক্ষেত্রেই। এখানেও তাই। ছা-পোষা ভাবটা আমাদের থিয়েটারের সাথে মনে হয় চিরস্থায়ীভাবে লেগে গেছে।

নেশার ঘোর থেকে বের হয়ে যৌক্তিক ভাবে  কার্যকর পথে হাঁটার সময় এখনো আছে । আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রেপাটরির ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়নি- সুযোগ এবং সম্ভাবনাও কতটুকু আছে… দেখা যাক!

 

ঢাকায় রেপার্টরি নামে নাট্যচর্চাকারী দলসমূহ:

বাঙলা থিয়েটার (১৯৯১)

প্রযোজনা সংখ্যা ৬টি।

মানুষ, আদিম, লেবেদেফ, চে’র সাইকেল, ডিস্টেন্ট লেয়ার, অমানুষ।

থিয়েটার আর্ট রেপার্টরি (১৯৯২)

প্রযোজনা সংখ্যা ২টি।

কীর্তিনাশা, ল²ীর পালা।

নন্দন (১৯৯৩)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

কন্যাদান।

সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) (১৯৯৪)

প্রযোজনা সংখ্যা ১৮টি।

কৃষ্ণবিবর, সত্যপীর, বোনহাঁস, বিক্রমর্বশীয়, রাজা, পীরচান, পুতুলের ইতিকথা, ভেলুয়া সুন্দরী, রেজারেকশন, বুকটুর কুয়া, লোডি ফ্রম দ্যা সি, উরুভঙ্গম, সুনাইবিবির পালা, এম্পুটেশান, মেটামোরফসিস, কমিউনিকেটর, মিশন, মেকাব্রে।

জন্মসূত্র (২০০৫)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

অহরকন্ডল।

কারিগর (২০০৬)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

বাইচাল।

থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি (২০০৯)

প্রযোজনা সংখ্যা ২টি।

শাইলক এ্যন্ড সিকোফ্যান্টস, জবর আজব ভালোবাসা।

নাট্যম রেপাটরি (২০১০)

প্রযোজনা সংখ্যা ৬টি।

দমের মাদার, সাইকেলওয়ালা, প্রলম্বিত প্রহর, মানুষ, চারিদিকে যুদ্ধ, ডিয়ার লায়ার।

দশরূপক (২০১০)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

বিসর্জন।

শুণ্যন (২০১১)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

লাল জমিন।

আগন্তুক (২০১৩)

প্রযোজনা সংখ্যা ২টি।

অন্ধকারে মিথেন, ধলেশ্বরী অপেরা।

বঙ্গলোক (২০১৪)

প্রযোজনা সংখ্যা ৩টি।

রূপচাঁন সুন্দরীর পালা, মর্তের অরসিক, শনিতের হাত।

ম্যাড থেটার (২০১৫)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

নদ্দিউ নতিম।

যাত্রিক (২০১৬)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

এন ইন্সপেক্টর কল।

নাটবাঙলা (২০১৭)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

রিজওয়ান

হৃদম  (২০১৮)

প্রযোজনা সংখ্যা ১টি।

রূধিররঙ্গিনী।

আপস্টেজ (২০১৯)

প্রযোজনা সংখ্যা ২টি

রাত ভ’রে বৃষ্টি, স্বপ্নভুক।