You are currently viewing ধর্ম ও রাজনীতি : মিথ ও বাস্তবতা / মজিদ মাহমুদ

ধর্ম ও রাজনীতি : মিথ ও বাস্তবতা / মজিদ মাহমুদ

ধর্ম ও রাজনীতি : মিথ ও বাস্তবতা

মজিদ মাহমুদ

ধর্ম প্রাচীন। রাজনীতি অর্বাচীন। ধর্ম ইহকাল ও পরকালের অধিশ্বর হতে চায়, রাজনীতির দাবি কেবল ইহলৌকিক। এমন যদি হতো মানুষ কেবল ইহজাগতিক বিষয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারত, তাহলে ধর্মের দাবি টিকত না। মানুষের স্বভাব এক টিকেটে দুই ছবি দেখা, সে এই জগতেও পুরোটা পেতে চায়, আবার মর-জগতেও সুখে-শান্তিতে অনন্ত জীবনের অংশ হতে চায়। কিন্তু মর-জগতের সঙ্গে জীব-জগতের রয়েছে বিস্তর ফারাক। জীবনের চাহিদা টিকে থাকা, মরণের পরিণতি বিলীন হওয়া। মানুষের টিকে থাকার লড়াই যেমন শরীরজাত, তেমন মৃত্যুর পরে কোথায় যাবে সে চিন্তাও তার জৈবিক মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত। ফলে এ কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, ধর্ম পুরোপুরি অজৈবিক শরীর চেতনার বাইরে থেকে আগত। মানুষ মুক্তি চায়, সে মুক্তি তার কিসে- সে পুরোপুরি জানে না, অনুসন্ধান করে, পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতার পথে হাঁটতে চায়; সে হাঁটার পথ মসৃণ নয়, তবে পিচ্ছিল। ঠিক মতো পা ফেলতে না পারলে অতল অন্ধকার।

আদিকাল থেকে মানুষের জীবনাচরণ-প্রণালী ধর্মের নির্দেশ আকারে মনোজগত ও অভ্যাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। যদিও সে অভ্যাস স্থান ও কাল ভেদে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু কখনো পুরো পাল্টে যায়নি, এমনকি অবলুপ্তও হয়নি। এর কারণ হয়তো হতে পারে বহুকালচালিত এই শিক্ষা এবং আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা মানুষ লাভবান হয়েছে- যা তার মনোজগতে এমন এক পবিত্র বোধের জন্ম দিয়েছে যার সঙ্গে আদিপুরুষের সম্মিলন, অমীমাংসিত পাপ-পুণ্য বোধের চ‚ড়ান্ত ফয়সালা জড়িত। তাছাড়া মানুষ মারা যাবে, এই পৃথিবীতে থাকবে না, সে নিশ্চিত করে জানে না যে, মৃত্যুর পরে আরো কোনো জগৎ আছে। এ ধারণাও তার পরিপুষ্ট নয়- কিভাবেই-বা তার জন্মের কারণ ঘটেছিল। মৃত্যু যেহেতু অজানা, অনিশ্চিত অন্ধকার গহŸর সেহেতু ধর্মের পরমেশ্বরের ইশারা অনুসরণও তার ভবিতব্য। ধর্ম যখন বলে, আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তোমাদের জমাট রক্তবিন্দু থেকে। তখন মনে হয়, কি দরকার ছিল, আমাদের মাটি থেকে বানালে ঈশ্বর থাকা না থাকার হ্যাপা পোহাতে হতো না, চাক্ষুষ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যেতো। আবার ভাবতে হয়, আমাদের রক্ত-মাংস-শূক্র সব কিছু তো মাটি থেকেই এসেছে।

বলা চলে, ধর্মই প্রথম আবিষ্কার করেছিল- মানুষ অবিনশ্বরের অংশ; মৃত্যুই মানুষের শেষ নয়, একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় মাত্র। মৃত্যুর পরে তার জন্য অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে। সে-জীবন দুঃখেরও হতে পারে সুখেরও হতে পারে। এই দুনিয়া মানুষের জন্য একটি শস্যক্ষেত্র মাত্র- বপন অনুযায়ী কর্তন। মানুষের জীবন- অর্জন সম্পদ সন্তান-সন্ততি মৃত্যুর এক ফুঁৎকারে নিভে যাবে- মানুষের উন্নত চিন্তা তা মানতে নারাজ। যুক্তির কাছে সে পরাজিত হলেও মন সায় দেয় না। যারা ধর্মের ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, এমনকি যিনি কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন- তিনিও হয়তো দ্বিধাহীন হতে পারেন না। ধর্মের ঈশ্বরবিহীন দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘মরণের পরে যদি দেখেন সত্যিই ঈশ্বর ও মরণোত্তর জীবন রয়েছে- তখন কি করবেন? তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরকে বলব, তুমি যে আছ পৃথিবীতে তার এত কম প্রমাণ রেখেছিলে কেন!’ বিশ্বাসীর কাছে ঈশ্বর থাকার যথেষ্ট প্রমাণ থাকলেও, দার্শনিকের মতে ঈশ্বর থাকার প্রমাণ হয়তো যথেষ্ট নয়। প্রমাণ যথেষ্ট হলে তো নিরপরাধ শিশু জন্মের পরে বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতো না। এত হানাহানি, লিঙ্গ-বর্ণ-বৈষম্য, ধনী গরীবের আকাশ-সম পার্থক্য, উৎপীড়িতের হাহাকার। এই জগতে দেখা যায়, একজনের দায়ে অন্যজনকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। দার্শনিকের চাওয়া হয়তো ঈশ্বরের পৃথিবী হবে সমভাবে বণ্টিত। ঈশ্বরের বায়ু, ঈশ্বরের পানি, মাতৃদুগ্ধ, পায়ের নিচে মাটি, উপরে আকাশ, নদী সমুদ্র পর্বত- সমানভাবেই তো তৈরি হওয়ার কথা। হয়তো হয়েছেও তা-ই, মানুষ এখানে নিজেদের মতো করে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। এই নেয়াই যদি ঈশ্বরের অভিপ্রায় হয়, তাহলে সব আলোচনার এখানেই অবসান। আর তা যদি না হয়, তাহলে অদৃশ্যে যিনি আছেন- তিনি তেমন করে চান না, কিংবা আমাদের মর-জগতের তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তাঁর নিজের তৈরি নিয়মের বাইরে তাঁর কোনো ইচ্ছা নেই। তাহলে ঈশ্বরের  নামে ধর্ম পালন, আর ঈশ্বরহীনতার কোনো মূল্য থাকছে না। কুরু-পান্ডবের যুদ্ধে পান্ডবগণ ভবের সকল লীলা সাঙ্গ করে যখন স্বর্গযাত্রা করলেন, তখন দেখলেন স্বর্গের দ্বার অতটা কাছে নয়। পথিমধ্যে একে একে সবাই পতিত হলেন, কারণ সবাই কোনো না কোনো লোভ ও কামনার বশবর্তী ছিলেন, কেবল যুধিষ্ঠিরকে এসব স্পর্শ করতে পারেনি। পাপ নিয়ে সরাসরি স্বর্গে প্রবেশ করা যায় না, প্রায়াশ্চিত্ত লাগে। যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গারোহন করে দেখলেন, তাঁর আগেই দুর্যোধন-দুঃশাসন সেখানে উপস্থিত তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে। তাহলে এই মহারণের কি মানে! যুদ্ধোত্তর ছত্রিশ বছর পান্ডবরা হস্তিনাপুরে দুনিয়ার রাজনীতি ও রাজ্য শাসনের সুখ-দুঃখ ভোগ করছিলেন। যুদ্ধজয়েও তাদের ছিল না সুখ। মৃত্যুর পরেও তার জ্ঞাতিরা সরাসরি স্বর্গে যেতে পারলেন না। অথচ দুর্যোধন দুঃশাসনের ভ্রাতারা নিহত হওয়ার পর থেকে স্বর্গে আরাম আয়েশে করছিল বাস। ধর্ম যুদ্ধে নিহতদের ইসলামেও মৃত বলা নিষেধ। বলা হয় তাদের রিজিক প্রভুর কাছে অব্যাহত থাকে। ধর্ম দর্শনের কি অদ্ভূত আন্ত্যমিল!

তবু এই দ্বিধা অনিশ্চিয়তা, শঙ্কা, সৃষ্টিজগতের অপার রহস্যময়তা এবং সর্বোপরি মৃত্যুভয় মানুষকে ধর্মের পথে হাজির রাখে। মাতৃভাষার পরে ধর্মই একমাত্র উপাদান- যার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ধর্মত্যাগ ধর্মগ্রহণ কিংবা অস্বীকার সকল ক্ষেত্রেই ধর্ম তাকে সংস্কৃতির অংশ হিসাবে অনুসরণ করে। মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করলেও ধর্মের গ্যারাকল থেকে বেরুতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো ধর্ম কি, ধর্ম কেন, ধর্মের এত বিভাজন কেন, ধর্মের ঈশ্বরের  রূপ কি, এক ধর্ম কি অন্য ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়? এছাড়া আন্তঃধর্মের মধ্যেও রয়েছে আত্মঘাতী বিরোধ। তবে আমার এ আলোচনার বিষয় মোটেও ধর্মের জটিল চোরাগলি নয়। বরং রাষ্ট্র বনাম ধর্ম বা রাজনীতি বনাম ধর্ম নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা। আরো খোলাসা করে বললে- রাজনীতিতে কিভাবে ধর্মে প্রয়োগ হয়ে থাকে।

আজকের দিনের রাষ্ট্র রাজনীতির ধারণার বাইরে থেকে বলা যায়, ধর্মের বিকাশের মিথগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তৎকালীন রাজনীতিই ধর্মের উৎপত্তির অন্যতম কারণ। পরাক্রমশালী অত্যাচারি রাজার বিরুদ্ধে মানুষকে সংঘবদ্ধ করারও উপায়। মিশরের ফারাও রাজাদের কবল থেকে নিজের জাতিকে উদ্ধারের লক্ষ্যে হযরত মুসা (আ.) একটি কার্যকরি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার জাতি বনি ইসরাইলকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন, একটি নতুন ভ‚মির সন্ধান দিয়েছিলেন, তাদের জন্য কিতাব বা সংবিধান দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের  কৃপা ছাড়া একজন পলাতক মেষপালক দাসপুত্রের পক্ষে মহাপরাক্রম-শালী ফারাও রাজাকে পরাস্ত করে নিজ জাতিকে উদ্ধার কি করে সম্ভব! আবার তারাই ঈশ্বরের দেয়া ভ‚মি ও তাঁর দেয়া তোরাহ বুকে নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে অন্য জাতিধর্মকে কম আশীর্বাদপুষ্ট বলে মনে করে আসছে। এখানে ধর্ম শুরুতে মূলত বিরোধী দলীয় ভ‚মিকা পালন করছে। একদিকে রাজা আরেক দিকে দৈবে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ। অসংখ্য যুদ্ধবন্দি, নারী-পুরুষ ক্রীতদাস- যারা রাজার দেবতার মন্দিরে বলি হচ্ছে, সুউচ্চ পর্বত সমান পিরামিড বানাচ্ছে, রাজার শবাগমনে জীবন্ত সমাহিত হচ্ছে, ঈশ্বরের  প্রেরিত ত্রাণকর্তা ছাড়া কে তাকে রক্ষা করতে পারে! মধ্যযুগের এই রাজ্যনীতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, ধর্ম প্রায়শ বি ত অবমানিতের মুক্তির জন্য রাজার বিরুদ্ধে জনগণের একমাত্র সংঘ হিসাবে কাজ করেছে। যতক্ষণ না রাজা ওই ধর্মের রক্ষাকর্তা হিসাবে তাদের পীড়ন করেছে।

সুতোর পুত্র যিশুকেও রোমান সম্রাট ক্রুশবিদ্ধের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। অথচ তাঁর না ছিল বাহিনি, না ছিল বিদ্রোহ করবার ক্ষমতা। গরিব, জেলে, ভিখেরি, কুষ্ঠরোগী, কামার সুতোর এসব লোক নিয়েই ছিল তাঁর কারবার। তাদের একটু ভালো করা, সেবা যত্ন করা, আর পরমপিতার কথা বলে সান্ত্বনা দেয়া। এই পৃথিবীই শেষ নয়, স্বর্গেও একজন পিতা আছেন, যিনি মানুষের যত্ন করেন। বেথেলহেমের ইহুদিদের পুঁজি পুঞ্জিভূত করার বিরুদ্ধে কথা বলা তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। তিনি হয়ে উঠলেন, কিছু অবমানিতের কণ্ঠস্বর, ভালোবাসার পাত্র। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁকে হুমকি হিসাবে দেখল। এই উদ্ভ্রান্ত তরুণ জনগণকে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে। কলিযুগে কংসের আবির্ভাবও অসুর বধের জন্য। জনগণ জেগে উঠলে রাজার বিপদ। রাজার আছে অর্থ সমরাস্ত্র, যা দিয়ে মুহূর্তে শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া যায়। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য পরম সত্তা জাগ্রত থাকে জনগণের সাথে। তাঁর কাছেই তার প্রার্থনা। জীবন এমন এক পরম-সত্তা রাজা বা রাষ্ট্র দীর্ঘকাল তা অবদমিত রাখতে পারে না। যিশুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। মৃত যিশু জীবিত যিশুর চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছিল জনগণের বিশ্বাসে, কর্মে। মাত্র বারজন দ্বিধাগ্রস্ত সঙ্গী নিয়ে যাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তার প্রতিধ্বনি রোমান রাজের সিংহাসন কেঁপে উঠল। যে সম্রাট তাঁকে হত্যা করেছে সেই সম্রাটের বংশধরগণ তাঁর ধর্মকে রাজধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছে। রাজার কাজ যেমন প্রজাপালন তেমন রাজার কাজ জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করা। রোমানদের ধর্ম দেবতা ছিল আলাদা, কিন্তু যখন তাদের অধিকৃত অঞ্চলের লোকজন রাজার ধর্ম না-মেনে এমন একজনকে মানে, যিনি বলতেন ‘বাম গালে খেলে ডান গাল পেতে দিতে।’ এই বিপুল জনতার প্রতিবাদহীনতার সংস্কৃতিও রোমান সম্রাটকে রেহাই দেয়নি। তৃতীয় শতকে রোমান কনস্টন্টাইনের খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ ছিল নিছক রাজার রাজনীতি।

সিদ্ধার্থ গৌতমের কাহিনিও এরচেয়ে ভিন্ন নয়; যদিও তিনি ছিলেন কপিলাবস্তু নামক এক ছোট জনপদের রাজপুত্র, তবু তিনি এক জরাগ্রস্থ বৃদ্ধকে দেখে, এক কুষ্টরোগীকে দেখে, একজন মৃত মানুষ ও এক সন্ন্যাসীকে দেখে জীবনের ভবিতব্য নির্ধারণ করে নিয়ে ছিলেন। উনত্রিশ বছর বয়সে সংসারের সকল মায়া ত্যাগ করে এক বৃহত্তর সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। সংখ্যা ও ক্ষমতা বিবেচনায় বোধিসত্বেও জীবদ্দশায় তা যে কোনো রাজন্যের চেয়ে বেশি ছিল। গৌতমের গৃহত্যাগের পেছনেও হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুক্কায়িত ছিল। পূর্ব ভারতের জনপদগুলো তখন পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত, গৌতম রাজপুত্র হলেও জীবিত রাজ্যভোগ তাঁর জন্য যেমন নিষ্কণ্টক ছিল না। তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল- রাজায় রাজায় লড়াইয়ের বিরুদ্ধে জনগণের সংহতি ও সংস্কৃতি নির্মাণ করা। রাজার নৃশংসতা এমন ছিল- গৌমতের ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই শত বছর পরেও স¤্রাট অশোকের কলিঙ্গযুদ্ধে মানুষের রক্তে দয়া নদীর পানি সম্পূর্ণ লাল হয়ে গিয়েছিল। ভ্রাতৃহত্যা ও কলিঙ্গযুদ্ধের জীবনহানি ক্রুর-নৃপতি অশোক শান্তির ধর্ম গ্রহণ করেন। এই কাহিনির সঙ্গে রোমান সম্রাট কনস্টন্টাইনের খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্ম ও রাজনীতি বিকাশের ধারাটি এভাবে অনুমান করা যায়। যদিও রাজাকে ঐশ্বরিক নির্বাচন হিসাবেই মনে করা হতো, তবু বাকহীন জনতার মুখপাত্র হিসাবে নতুন বার্তাবাহকের প্রয়োজন পড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের শুরু প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্য দিয়ে, অসহায় জনগণের আশ্রয় হিসাবে। তাছাড়া মধ্যযুগে রাজার কাছে সাধারণ মানুষের পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না, ধর্মের বর্ম তাদের কিছুটা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজা যতক্ষণ নব-গঠিত ধর্মকে তার ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে না করত ততক্ষণ এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না।

ইসলাম ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম। দেখা যায়, মক্কা-জীবনে মহানবী প্রত্যক্ষ করেছিলেন- মানুষের স্বেচ্ছাচার, কন্যাশিশু হত্যা, ক্রীতদাস নির্যাতন, সম্পদের বণ্টনহীনতা, বংশগরিমা ও বাহুবলের বড়াইয়ে জনজীবনের দূষণ। তিনিও মক্কার দ্বিধাবিভক্ত রক্তপাতময় সমাজে এই বাণী প্রচারে অবতীর্ণ হলেন- ‘সকল মানুষ এক মানব ও মানবী থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তাদের লিঙ্গ-বর্ণ-গোত্র-শ্রেণি জন্মস্থান যেমনই হোক না কেন, তিনি মহান আল্লাহ’র কাছে অভিন্ন। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণিত হবে তার সৎকর্মের ভিত্তিতে। একদিন সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে, কারো উপর জুলুম করলে তাঁর শাস্তি ভোগ করতে হবে।’ মহানবীর মদিনায় ধর্মজীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রজীবনের প্রত্যক্ষ সূত্রপাত ঘটে। তবে এ কথা বললে ভুল হবে যে তাঁর মক্কাজীবনও রাজনীতি মুক্ত ছিল না। অবস্থা দৃষ্টে তৎকালীন মক্কার প্রতিষ্ঠিত শক্তি তাঁর প্রচারাভিযানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, নিজেদের কালচালিত কায়েমি স্বার্থ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। আরবের ক্ষমতাসীন পক্ষই নবীর প্রধান প্রতিপক্ষরূপে দাঁড়ায়। তাঁর নবীন ধর্মসংঘে অবিরত আশ্রয় খুঁজছে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস, ভিন্নমতাবলম্বী, চিন্তাশীল, ভবঘুরে, বি ত নারী-পুরুষ ও অসহায় শিশুরা। বিদায় হজে¦র বাণীতেও দেখা যায় তাঁর লক্ষ্যে অবিচল। তিনি তখন মদিনা নামক নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রধান, তখন শতাধিক যুদ্ধ বিজেতা, অগাধ ক্ষমতা, অগণিত যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টনদাতা, একে একে আশেপাশের দেশগুলোর শাসকগণ তাঁর ধর্মরাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছেন। অথচ সে-সব গরিমার তোয়াক্কা না করে লক্ষ জনতার সামনে শেষ ভাষণে বললেন- যার সার-সংক্ষেপ- ‘আরব অনারবের চেয়ে, শাদা কালোর চেয়ে, পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। নিজেদের মতো করেই দাসদাসীদের যত্ন নিতে হবে। একজনের অপরাধে অন্যজনকে শাস্তি দেয়া যাবে না, রক্তপাত ঘটানো যাবে না। একদিন প্রত্যেককে তার স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে- সব কিছুর তিনি হিসাব নেবেন।’

বর্তমানের রাজনীতি ও ধর্ম অনুধাবনের জন্য এই আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেননা তখন রাজনীতি বলে আলাদা কোনো সংঘ ছিল না। আজকের ধাঁচের বিরোধীদল কিংবা সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল না। ধর্মই ছিল জনগণের ভরসাস্থল। যে ধর্ম শিক্ষা দেয় বিচারের চোখে রাজা প্রজা সবাই সমান। রাজা অন্যায়ভাবে কাউকে প্রহার করলে, কাজির রায়ে প্রহৃত ব্যক্তি রাজাকে সেই পরিমাণ প্রহার করতে পারবে। এমনকি বিচারের ক্ষেত্রে স্বধর্মী বিধর্মীকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না। হযরত আলী তখন বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা, তাঁর বর্ম হারিয়ে গেছে, এক ইহুদির কাছে পাওয়া গেল; ইহুদি বলল, এটি তার নিজের বর্ম, খলিফার দাবি সত্য নয়। খলিফাকে আর্জি জানাতে হলো কাজির দরবারে। কাজি বললেন, মহামান্য খলিফা আপনি আপনার দাবির পক্ষে সাক্ষীসাবুদ হাজির করুন। খলিফা বললেন, আমার পক্ষে পুত্র হাসান আর ভৃত্য কুম্বার সাক্ষী। কাজির রায় চলে গেলে ইহুদির পক্ষে। ইসলামি আইনে পুত্র ও ভৃত্যের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। খলিফা আইনের রক্ষক, নিয়ন্ত্রক নন। এভাবেই ধর্ম ও রাজনীতি সে-যুগে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকলেও ধর্ম সর্বদা সাধারণ মানুষের রক্ষাকবচ হিসাবে ছিল। ধর্মের বর্ম ছাড়া তখন সাধারণ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু শাসক যখন যুগপৎ রাষ্ট্র ও ধর্মের কর্তৃত্ব তুলে নিয়েছে তখন জনগণ একই সঙ্গে ধর্ম ও রাষ্ট্রের দ্বারা দ্বিগুণভাবে নিপীড়িত হয়েছে।

কিন্তু রাষ্ট্র রাজনীতি ধর্ম ও আইনি পদ্ধতি এ পর্যায়ে আসতে মানুষকে হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ইসলাম ধর্ম হিসাবে আবির্ভাবেরও প্রায় দুই হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্বুরাবি প্রথম আইনের কিছু ধারা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। অপরাধের বিশৃঙ্খল শাস্তিকে সুশৃঙ্খল করেছিলেন। তিনিও দাবি করেন, তাঁর প্রণিত ২৮২টি আইন তিনি সূর্যদেব শামাশের কাছ থেকে পেয়েছেন। আনুমানিক তাঁর কাছাকাছি সময়ের নবী হযরত মুসা একইভাবে সিনাই পর্বত থেকে প্রভুর দশ নির্দেশ পেয়েছিলেন। সিনাই পর্বতে হযরত মুসার প্রভুর সঙ্গে সওয়াল জওয়াব আধুনিক কালের আইন প্রণয়নের যৌক্তিক জায়গাগুলো স্মরণ করে দেয়। তোরায় লিপিবদ্ধ আইন এবং হাম্বুরাবির শামাশ দেবতার আইনের সূত্রের মধ্যে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। আইনের প্রধান লক্ষ্য প্রতিশোধ গ্রহণ, অন্যায়ের প্রতিবিধান হিসাবে আক্রান্তকে আর্থিক কিংবা মনোজাগতিক ক্ষতিপূরণ দান। আর এই কাজটি করতে পারে কেবল রাষ্ট্র; কিন্তু রাষ্ট্র আর রাজা যখন সমার্থক হয়ে পড়ে তখনই বিপত্তি। মধ্যযুগে রাজা আর রাজ্যের মধ্যে তেমন প্রভেদ ছিল না। যেমন ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলতেন, ‘আমিই রাষ্ট্র।’ এটি প্রত্যেক স্বৈরশাসকেরই মনে করেন। কিন্তু সিনাইয়ের প্রভু বা শামাশ দেবতার দূতগণ যে আইন প্রণয়ন করেছেন, সেখানে ঈশ্বরের  ন্যায়ের একটা যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হতো। রাজাকে যেহেতু দমন করতে পারতেন কেবল অদৃশ্যে অধিষ্ঠিত পরাক্রমশালী স্রষ্টা, সেহেতু জনগণকে সেই অদৃশ্য ঈশ্বরের  প্রতি আস্থা রাখতে হতো। আবার রাজা ঈশ্বরের  প্রতিনিধি বলে তার ক্ষমতা প্রয়োগের যেমন চ‚ড়ান্ত অধিকার থাকত, তেমন ঈশ্বরের  ন্যায়ের প্রতি তার সম্মান রাখতে হতো।

হাম্বুরাবির আইনের ধরন ছিল প্রতিশোধমূলক। অঙ্গহানির বদলে অঙ্গহানি, হত্যার বদলে হত্যা। আইনের এই ধরনটি হয়তো এখনো আছে। কিন্তু রাজার স্বেচ্ছাচারিতা থেকে আইন মুক্ত হতে পারেনি, আবার অপরাধের তুলনায় শাস্তি ছিল কঠোর যেমন কেউ তার বাবাকে হাত দিয়ে আঘাত করলে তার হাত কেটে নেয়া হবে। কেউ কারো গর্ভের সন্তান নষ্ট করলে তার কন্যাকে হত্যা করা হবে। মিথ্যা অভিযোগকারীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড, শ্রেণিভেদে শাস্তির পার্থক্য ছিল। ব্যাবিলন, পারস্য, গ্রিকসভ্যতা ছেড়ে দেড় হাজার বছরের প্রেক্ষাপটে ইসলাম তৎকালীন রাজ্যশাসনে কিছু অভিনবত্ব আনতে সক্ষম হয়। খলিফা হযরত আলীর ঘটনা প্রমাণ করে রাজ্যশাসন ও বিচার ব্যবস্থা এক নয়। সরকার থেকে বিচার ব্যবস্থা পৃথকীকরণের জন্য বর্তমান কালে এসেও আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না- সরকার ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কতটা ফারাক আছে। বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা তৃতীয় বিশে^র সরকারগুলোর নিয়ম-মাফিক কাজ। ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণ বিদ্রোহ করত, আবার সংগঠিত হতো ইসলাম রক্ষার তাগিদে। কারণ ইসলাম রক্ষিত হলে, তারা মুক্তি পাবে- এই বিশ্বাসও তাদের অন্তরে ছিল।

তাহলে কি বলা চলে ইসলামের নবী এবং তাঁর পরবর্তী খলিফাগণ রাষ্ট্র ও ধর্মের যে অবিচ্ছেদ্য মিথষ্ক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেটি কি পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের মুসলিম শাসকগণ মেনে চলেছেন। মোটেও না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজ্য জয় ও রাজ্য শাসনের যে চিরাচরিত কৌশল সেটিই তারা অবলম্বন করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজার ইচ্ছায় কাজির প্রকাশ হয়েছে। রাজার বিরোধিতা মানে ধর্মের বিরোধিতা হিসাবে ফতোয়া জারি হয়েছে। প্রতিবাদকারীদের নির্বিচারে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আবার ধর্মের বাহ্যিক রূপটি পরাক্রমশালী রাজন্যরাও ফেলে দিতে পারেননি। কিন্তু মুসলিম জনগণের মাঝে ইসলাম প্রবর্তক ও তার খলিফাদের শিক্ষা নানা মাত্রায় মহাপরাক্রমশালী প্রভুর ইচ্ছা হিসাবে প্রথিত হয়ে যায়। ফলে ধর্ম যুগপৎ রাজা ও প্রজার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। রাজার দমননীতি, অন্যায় ক্ষমতা দখল, টিকে থাকার ঘৃণ্য উপায় অবলম্বনে যেমন ধর্মের ফাঁকফোকড় ব্যবহার করা হয়েছে; তেমনি প্রজাসাধারণ ধর্মের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, লড়াই করেছে, কখনো জিতেছে; কিন্তু রাজা প্রজার এই দুষ্টচক্রের অবসান হয়নি।

পুরো মধ্যেযুগে ইউরোপ ও এশিয়ার রাজনীতি ও ধর্ম হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছিল। ভারতের দিকে তাকালেও দেখা যায়, রাম-রাবণের যুদ্ধ, যুধিষ্ঠির ও তার ভাইদের রাজ্যরক্ষার লড়াইও ধর্মের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। রাজা মানেই রাজ্যরক্ষা, প্রজাপালন, রাজ্যবিস্তার, আর তার সঙ্গে যুদ্ধ ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। যুদ্ধের সকল পক্ষই এক পবিত্র বোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, ন্যায়সঙ্গ দাবি করছে। না-হলে যে মহানজীবন পৃথিবীতে সে প্রাপ্ত হয়েছে তা কিভাবে যুদ্ধে হেলায় হারাতে পারে! হস্তিনাপুরের কৌরব পান্ডবের চ‚ড়ান্ত যুদ্ধে পান্ডব অর্জুনের মনে সহসা উদয় হলো- এ যুদ্ধে করে কি লাভ! শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষই তার জ্ঞাতি, এই যুদ্ধে জয়ী হলেও তিনি লোকক্ষয় ও আত্মীয় বিচ্ছেদে বিষন্ন হবেন। কিন্তু যুদ্ধ থেকে বিরতি নেবার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মনামী মহাকাল শ্রীকৃষ্ণ তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, তুমি যুদ্ধ করবার কে! তুমি নিমিত্তমাত্র। এই যে তোমার সম্মুখে যাদের দেখতে পাচ্ছ- ঠাকুর্দা, গুরু, পিতৃব্য ও ভ্রাতা- সবাইকে সময় হত্যা করে রেখেছে। সময় সবচেয়ে শক্তিশালী সে কাউকেই ক্ষমা করবে না। তোমার মতো শক্তিমান বীরও একদিন ধূলায় লুণ্ঠিত হবে।’ একটি যুদ্ধে তার আত্মীয়-স্বজন পুত্র পরিবার- বিপক্ষ শত পিতৃব্যপুত্র অসংখ্য সৈন্য নিহত হলো। পান্ডবদের রাজ্যরক্ষা হলো একই সঙ্গে ধর্মও। তাই এই যুদ্ধে মানুষের গ্লানি নেই। যদিও রবীন্দ্রনাথ মহাভারতে বর্ণিত এই কৌশলকে রাজার ছলনা হিসাবে মনে করতেন। পারস্যে যাবার কালে উড়োজাহাজে তাঁর মনে উদয় হলো এই যে আজকের দিনে উপর থেকে যুদ্ধ বিমান নিচের মানুষের উপরে বিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করছে, তার সঙ্গে মহাভারতের যুদ্ধেরও দারুণ মিল আছে। কারণ সেখানেও রথের উপর থেকে তীর নিক্ষেপ করা হতো, এখনো বায়ুযান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হচ্ছে, যে করছে সে তার কিছুই জানতে পারছে না- কারণ দূরের বস্তু তার মনোজগতে তেমন কোনো সহানুভ‚তি তৈরি করতে পারছে না। যুদ্ধের ময়দানে একই আচরণ ইসলাম ধর্মেও দেখা যায়, যেমন সুরা তওবা, সুরা আহযাব- যেখানে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, ধর্মের নামে যে যুদ্ধ-রাজনীতির কথা বলা হয়ে থাকে তার সঙ্গে নৃসংশ যুদ্ধবাজ রাজাদের গুণগত পার্থক্য রয়েছে। অবশ্য জানা সম্ভব নয় চেঙ্গিস এবং তৈমুরের নিজ নিজ ধর্ম তাদের মানুষ হত্যা থেকে কিভাবে নিরত রেখেছিল।

যে সীতার জন্য রাম যুদ্ধ করলেন। তাবড় তাবড় বীর নিহত হলেন, সীতা উদ্ধার হলো ঠিকই, কিন্তু বিজয়ী রাজ্যে তাকেই যেতে হলো চিরতরে ভূগর্ভে। রাজার কাছে জনগণের দাবি লঙ্কাপুরীতে রাজ্যের মহারানি রাবণের বলাৎকারের শিকার হয়েছিলেন কিনা তার পরীক্ষা দিতে হবে। জনগণের বিশ্বাসের মধ্যে এমনও থাকে- কেউ নিষ্পাপ হলে আগুন পানি মাটি তাকে গ্রাস করতে পারবে না। রাজনীতির কাছে ধর্ম এখানে পরাস্ত। লোকরঞ্জনের জন্য রাজাকে ন্যায়ের পথ থেকে সরে আসতে হচ্ছে, আপনজনকে দিতে হচ্ছে বলি। বলা কঠিন- এখানে রাজার কাজ ধর্মসম্মত হলো, নাকি জনগণের দাবি ধর্মসম্মত! ধর্ম আর রাজনীতি এক জটিল সম্পর্কে বাঁধা পড়ে আছে। হাম্বুরাবির কোডেও ছিল- কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে অভিযুক্তকে নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ডুবে গেলে প্রমাণিত হবে সে অপরাধী, তার সব ধন-সম্পদ অভিযোগকারী পেয়ে যাবে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে মিথ্যা অভিযোগের দায়ে অভিযোগকারীর মৃত্যুদন্ড হবে। মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেও ইউরোপে এ ধরনের বিচারের অস্তিত্ব ছিল। পঞ্চদশ শতকে চার্চেও বিচারে জোন অব আর্কে ডাইনি আখ্যা দিয়ে আগুনে মারা হয়। সেখানেও ধর্ম ছিল রাজার ইচ্ছে পূরণের সহযোগী। আবার পাঁচশ বছর পরে সেই চার্চই তাঁকে সন্ত উপাধি দেয় ঈশ্বরের প্রিয়জন হিসাবে। ঈশ্বরের কে প্রিয় আর কে নয়- কিছু মানুষই তা নির্ধারণ করছে। এই অন্যায় যে শুধু ধর্মের নামে হয়েছে তা-ই নয়। একুশ শতকে এসে গ্রিসের বিবেক আদালত সক্রেটিসের দায়মুক্তি ঘোষণা করে। ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে তখনো ছিল না কোনো আলাদা করার উপায়। রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’র মতো ‘উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে/ স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে/ নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত।’

ধর্ম যেমন রাজার সহায় হয়েছে, তেমন প্রজাকেও ব্যথা-অবমাননায় বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছে। কিন্তু কালে জ্ঞানীজনেরা উপলব্ধি করেছেন ধর্ম আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক নয়। কারণ রাষ্ট্রে কেবল এক জাতি -ধর্মের মানুষই বাস করে না, একটি রাষ্ট্রকে বহু জাতি ধর্মের মানুষকে লালন করতে হয়। অবশ্য রেনেসাঁকালে পন্ডিতদের বুঝে ওঠার আগেই রাজা নিজেই ধর্মকে রাজ্য থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টায় সদর্থ ছিল বলা যায় না, রাজার স্বৈরাচারের মনোভাবই তাতে প্রকটিত হয়েছে। রাজা যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন আকাশে অবস্থানকারী মহাপ্রভুর কাছে তুচ্ছ। কিন্তু ভূতলের রাজাকে যখন ক্ষুদ্রমানুষ কিংবা যাজক-মোল্লা-পুরোহিত অদৃশ্যের ভয় দেখান, তিনি তা মানবেন কেন! তখন রাজার কাজ থাকে পুরোহিতকে বশে আনা অথবা দমন করা। পঞ্চদশ শতকে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি- এ কাজে বিখ্যাত হয়ে আছেন। যিনি ছয়বার বিয়ে করেছিলেন, কয়েকজন স্ত্রীকে সন্দেহবশত হত্যাও করেছিলেন। গির্জার বিশপের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তিনিই হয়ে ওঠেন চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান। প্রথম স্ত্রী ক্যাথেরিনকে তালাক ও নতুন বিয়ে করার ক্ষেত্রে চার্চ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তিনি পোপ সপ্তম ক্লিমেন্টকে বহিষ্কার করে নিজেই গির্জা প্রধান হন। যদিও এটি ছিল রাজার স্বেচ্ছাচারিতার ফল, তবু এই ঘটনা ধীরে ধীরে চার্চের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ক্যাথলিক রাজা হেনরি হয়ে গেলেন প্রোটেসটেন্ট। এ কারণে তাকে ধর্ম সংস্কারের সূচনাকারীও বলা যায়। ধর্মের ক্যাচাল মারামারি হানাহানি এশিয়া আফ্রিকার চেয়ে বরং সেখানে কিছুটা বেশিই ছিল। যিশুর অহিংসানীতি ইউরোপকে হানাহানির কবল থেকে থামাতে পারেনি। গ্রিকদের ভারতমুখী অভিযান ছাড়াও তারা আফ্রিকা ও এশিয়ায় মধ্যযুগে প্রায় তিনশত বছর ধরে পবিত্র যুদ্ধ ক্রুশেডের উৎসাহ পেয়েছে পবিত্রভ‚মি রক্ষার নামে। এসব যুদ্ধ থেকে কোনটা রাজনীতি আর কোনটা ধর্ম বের করা সহজ ছিল না।

রাজা অষ্টম হেনরির দুইশ বছর আগে ইংল্যান্ডের আরেক রাজা দ্বিতীয় হেনরি গির্জার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্ধে লিপ্ত হন। তার স্বেচ্ছাচার অনুমোদনের বাধা হলে পোপকে হত্যা করে, নিজের ঘনিষ্ট বন্ধুকে চার্চ অব ইংল্যান্ডের দায়িত্ব দেন। কিন্তু তাতেও রেহাই হয় না, গির্জার দায়িত্ব পাওয়ার পরে বেকেট সম্পূর্ণ পাল্টে যান। কারণ বন্ধু দুনিয়ার রাজ্যের অধিপতি, আর তিনি পরমশ্বরের প্রতিনিধি- তিনি কেন তাকে সমঝে চলবেন। বাস্তব রাজ্যের রাজা আর ধারণার রাজ্যের রাজার মধ্যে শুরু হয় সংঘাত। রাজার আছে অস্ত্র, পোপের আছে নৈতিক বল। কিন্তু অস্ত্রের কাছে কতক্ষণ, প্রভু তাঁর পুত্রকেই অস্ত্রের নির্মমতা থেকে রক্ষা করলেন না, আর পোপ! সন্ত বেকেট খুন হলেন গির্জার মধ্যে দ্বিতীয় হেনরির চক্রান্তে। হেনরি প্রতীকি প্রায়শ্চিত্ত করলেন তার শরীরে কয়েকটি আঘাতে। থমাস বেকেটের এই হত্যাকান্ড নিয়ে ১৯৩৫ সালে ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট একটি নাটক লেখেন, মাডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল। এ নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এই ঘটনা এতটাই ইংরেজ জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল যে পরবর্তীকালে ইংরেজ কবিরা তাদের কবিতা সঙ্গীত ও ধর্ম কথায় তুলে আনেন এই করুণ গাথা। সাধু বেকেট হত্যার মাত্র দুশ বছর পরে ইংরেজি কবি জিওফ্রে চসার ‘কেন্টাবারি টেলস’ নামক বিপুল আয়তনের একটি একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এই কাব্যের পথ ধরেই ইংরেজ সাহিত্য প্রাক-আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার পোপের ‘দ্য টেম্পল অফ ফেম’সহ বহু ইংরেজ কবি এই হত্যাকান্ড এবং চসারের কাজে প্রভাবিত হন। রাজার অগাধ ক্ষমতা তবু ধর্মকে তার ভয়। ধর্মের রাজ্যে রাজা আর প্রজার আলাদা কোনো অধিকার নেই। তাই রাজা প্রজাপালন ও ধর্মরক্ষা একই সঙ্গে করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রজাপালন ব্যাহত হলে রাজা ধর্মচ্যুৎ হন।

অষ্টম হেনরির ঘটনার পরে ষোড়শ শতক থেকে শুরু হয়ে যায় ইউরোপে ধর্মের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রের কিঞ্চিৎ স্বাধীন পথ চলা শুরু। এ সময় ইতালিতেও খুলে যায় রেনেসাঁসের বাতাবরণ। চার্চ অব ইংল্যান্ড সেদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন ভ‚মিকা পালন করলেও শিল্প সাহিত্য ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ধর্মের প্রতীকের স্থলে ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার ছাপ পড়তে শুরু করে। মাইকেলেঞ্জেলো, লাভিরির শিল্পকর্মে ধর্মের মোটিফের মধ্যেও মানবীয় বেদনা প্রকটিত হতে থাকে। শুরু হয় এলিজাবেথিয়ান যুগ-শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে একটি মূল্যবোধের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন। শুরু হয় ঔপনিবেশিক কাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য জাহাজ বেরিয়ে পড়ে দিগি¦দিক, দুশো বছরের মধ্যে সারা পৃথিবীর প্রায় সত্তর শতাংশ ভ‚মির মালিক বনে যায় তারা। কিন্তু ধর্ম ব্রিটিশ রাজার সহায়ক শক্তি হিসাবে উপনিবেশিত অঞ্চলেও খ্রিষ্টান যাজকগণ কাজ করতে থাকেন নীরবে। অধিকাংশ ভ‚মি দখলের আগেই খ্রিষ্টান পাদ্রিগণ সেখানে যিশুর অহিংসা ও সুললিত বাণী নিয়ে হাজির থেকেছে। উপনিবেশিত হতভাগ্যদের আক্ষেপ ইংরেজ যখন প্রথম আসে তখন তাদের হাতে থাকে শুধু বাইবেল, আর কিছুদিন পর উপনিবেশিত মানুষের হাতে বাইবেল আর তাদের জমি-জমা সব ইংরেজের দখলে। উপনিবেশিত অ লে ইংরেজের ধর্মনীতি আর নিজের দেশের ধর্মনীতির মধ্যে সমতা তখনো সমতা ছিল না।

দ্বিতীয় হেনরির খ্রিষ্টান ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্ট হিসাবে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম এলিজাবেথ প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চকেই রাষ্ট্রীয় চার্চ হিসাবে স্বীকৃতি দেন। তিনি আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে চার্চকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এর পর থেকে চার্চ অব ইংল্যান্ড যেমন রাষ্ট্রের আনুক‚ল্য পায়, রাষ্ট্রও তেমন বিদ্রোহের হাত থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু এতে খ্রিষ্টধর্মের অন্তঃদ্বন্ধের অবসান হয় না। সপ্তদশ শতকে রাষ্ট্র যখন অ্যাংলিকান চার্চকে সমর্থন করা শুরু করে তখন তার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হয়, কিন্তু সেই সঙ্গে রোমান ক্যাথলিক ও অন্যান্য মতবাদগুলো দমন করা হয়। এই সময়কালে ইংল্যান্ডে অন্য মতের অনুসারিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ও প্রার্থনা অধিকার পর্যন্ত খর্ব করা হয়। এ সময়ে ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলী ‘নেসেসেসিটি অব অ্যাথিজম’ লেখার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। রিভোল্ট অব ইসলাম নামেও তিনি একটা গ্রন্থ লিখেছিলেন। রাজনীতি থেকে ধর্ম বাদ দেয়া শেলীর আকাক্সক্ষা ছিল। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ এসে প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও বিশেষ আইন রোধ করা হয়। এবং তখন থেকেই সর্ব ধর্মের সহ-অবস্থান ও সামজিক সহিষ্ণুতার সূচনা হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যক্রম রাষ্ট্র নিজস্ব আইন প্রণয়নের জন্য সুযোগ পায়। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে ধর্মপ্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ড বা অন্যান্য দেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নয়। যদিও সেখানে রাষ্ট্রের বহুত্ববাদি দৃষ্টিভঙ্গি বিরজমান, তবু চার্চ-রাষ্ট্র সম্পর্কেও কিছু আইনগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। চার্চের পরামর্শক্রমে বিশপ পদে রানি বা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যেমন এদেশে প্রধান মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব সরকার দ্বারা নিয়োজিত হন। ধর্ম মন্ত্রণালয় বা ধর্ম মন্ত্রীর উপস্থিতি মানে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিদ্যমান।

ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের ধর্মদ্রোহিতা-সংক্রান্ত আইন শুধুমাত্র অ্যাংলিকান এবং খ্রিষ্টধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্ম এই আইনের আওতায় সুরক্ষিত নয়। অ্যাংলিকান চার্চের আইন ইংলিশ আইন-ব্যবস্থার অংশ; এবং আদালতে সাধারণ আইন হিসাবে পরিগণিত। তবে কোনো আইন যদি চার্চের উপর প্রভাব তৈরি করে, সে আইন সম্বন্ধে মতামত দেয়ার অধিকার চার্চের এখনো আছে। প্রকৃতপক্ষে চার্চের মতামত খুব কমই অগ্রাহ্য করা হয়। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের বর্তমান অবস্থানকে পারস্পারিক সহযোগিতার সম্পর্ক হিসাবে বর্ণনা করা যায়। তবু সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় অ্যাংলিকান চার্চের মতো তাদের সুযোগ সুবিধা দাবি করলে রাষ্ট্রের আইনগত বাধ্যবাধকতা সত্তে¡ও একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত সম্প্রদায়ের প্রভাবকারি ক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক দল উপেক্ষা করতে পারে না। দার্শনিকদের ঊর্বরভ‚মি জার্মানিসহ বহু দেশে মধ্যম বা উগ্র ধর্মীয় নামে রাজনৈতিক দল সহিষ্ণুতার আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যদিও গত শতকের মাঝামাঝি নাৎসি নিধনযজ্ঞের একটি রূপ বিশ্ব দেখেছে। এমনকি সম্প্রতি হিটলারের নামে একটি এন্টি সেমেটিক মন্তব্য ভেসে বেড়াতে দেখা যায়, ‘আমি চাইলে সব ইহুদিকে মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু কিছু ইহুদিকে বাঁচিয়ে রেখেছি, যাতে ভবিষ্যতে মানুষ বুঝতে পারে ইহুদিরা কেমন!’ এই মন্তব্য যারা প্রচার করে তারা যেন বলতে চায়, হিটলারের ইহুদি নিধন যৌক্তিক ছিল, এবং সব ইহুদিকে মেরে ফেললেই ভালো হতো। জাতিগত নিধনযজ্ঞের সঙ্গে ধর্ম শ্রেণি বর্ণ ব্যবহার- এটা একটা পুরনো রীতি। অথচ এর সবকটি হলো বাহ্যিক রূপ। উল্টো এখন, ইসরাইল ইহুদি ধর্মকে ব্যবহার করছে মুসলিম ফিলিস্তিনি নিধনে। নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক গাজা হামলা এর প্রমাণ; আর এই কারণে সে-দেশের অন্যান্য রাজনীতিক দল তার প্রতি অনাস্থা এনেছে। মাত্র তিন দশক আগে পূর্ব ইউরোপে বসনীয় সার্বদের ধর্ম ও জাতিগত সংঘাত চরমে পৌঁছায়। ধর্ম কখন রাজনীতি, রাজনীতি কখন ধর্ম- সাধারণ মানুষকে বুঝে নিতে বেশ গলদঘর্ম হতে হয়। ধর্ম যেভাবে মানুষকে উদ্ধার করছে সেভাবে ধর্মের নামে মানুষ নিপতিত হয়েছে।

আঠার শতকে এসে এর কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায় ফ্রান্সে। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথকীকরণের আদর্শ দৃঢভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ ফরাসি বোঝাতে ‘লাইসিতে’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই অর্থ ব্যাপক; জাতীয় ও নাগরকি মূল্যবোধও এই শব্দের মধ্যে লুকায়িত। এই আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খ্রিষ্ট ধর্মের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৭৯৫ সালের একটি আইনে রাষ্ট্র ও চার্চকে সর্ম্পূণভাবে আলাদা করে দেয়া হয়। বলা হয়, রাষ্ট্র আর চার্চকে অর্থ সাহায্য করবে না, এবং ধর্ম মন্ত্রীর পদের বিলুপ্ত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্ম-রাষ্ট্র স্বতন্ত্র নীতি হিসাবে ব্যাখ্যা করা হলেও ধর্মকে সম্পূর্ণ অপসারণ করা সম্ভব হয়নি; কারণ সাধারণ মানুষ মনে করে, ‘জনজীবন ও জনকল্যাণের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে।’ তাই বলে ধর্মের প্রভাব মার্কিন রাজনীতিতে কম নেই। কিংবদন্তীর মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ধর্মের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল বলে জানা যায় না। কিন্তু মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়ে সেখানকার নাগরিকদের বোঝাতে চেষ্টা করেন- বাইবেলের শিক্ষা দিয়ে। তিনি বলেন, ‘ধর্ম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাহলে একজন শাদা মানুষ কিভাবে একজন কালো মানুষের প্রভু হতে পারে!’ যাদের খ্রিষ্টে বিশ্বাস আছে তারা যেন কালো শাদা বর্ণ গৌরব না করে, এবং মানুষকে দাস হিসাবে বিবেচনা না করে।

মার্কসবাদ বিকাশের পর থেকে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নতুন সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। এর আগে অন্য কোনো রাজনীতি ধর্মকে এমন নাকচ করে দেয়নি। ধর্ম এবং রাজার নীতি সহাবস্থান বা বৈপরীত্য নিয়ে উভয় বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করেছে। কার্ল মার্কস ধর্ম নিয়ে বেশি কিছু বলেননি, তবু ‘ধর্ম জনগণের জন্য আফিম স্বরূপ’- ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর সারকথা হিসাবে সদা উপস্থিত। অনেক মহারথি তাঁর এ কথার নানারূপ ব্যাখ্যা করেন। কেউ বলেন, কার্ল মার্কসের সময়ে আফিম নেশা জাতীয় দ্রব্য ছিল না, এটি ছিল ব্যথা ও চেতনা নাশক। এখনো আফিম অনেক রোগের দাওয়াই হিসাবে ব্যবহার হয়। এঙ্গেলস ধর্মের বিরুদ্ধে সব রকম যুদ্ধ ঘোষণাকে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করতেন। তাঁর মতে এরূপ কর্ম ধর্মে আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। অর্থাৎ ধর্ম না থাকলে ভালো, থাকলে আপত্তি নেই। রাজনীতি, সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার কোনো দাবি থাকতে পারবে না। আবার মার্কসবাদের দৃষ্টিতে শাসক শোষিতের দ্ব›দ্ব যেমন প্রকটিত তেমন ঈশ্বর ও নিরীশ্বরতাও গুরুত্ববহ। এখানেও ধর্ম রাজনীতির একটা প্রধান প্রতিপক্ষ। সর্ব ধর্ম, ধর্মের রাজনীতি যেমন মার্কসবাদকে আক্রমণ করে মার্কসবাদও তেমন ধর্মকে রাজা ও সামন্ত প্রভুদের সহায়ক মনে করে।

প্রগতি প্রকাশনির ভ.ই লেনিনের প্রবন্ধ সংগ্রহে ধর্ম প্রসঙ্গে বলা আছে ‘ধর্ম আধ্যাত্মিক অন্যতম প্রকার বিশেষ। চিরকাল অন্যের জন্য খাটুনি অভাব ও নিঃসঙ্গতায় পীড়িত জনগণের উপর সর্বত্রই তা চেপে বসে। শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির সংগ্রামের অক্ষমতা থেকেই অনিবার্যভাবে উদ্ভূত হয় মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রত্যয়, যেমন প্রকৃতি বিরুদ্ধে আদিম মানুষের সংগ্রামের অক্ষমতা থেকে উদ্ভুত হয় ঈশ্বর, শয়তান, অলৌকিত্ব ইত্যাদির বিশ্বাস। যারা সারাজীবন খাটে আর অভাবে নিমজ্জিত থাকে, ধর্ম এ পৃথিবীতে তাদের নশ্বরতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান করে স্বর্গীয় পুরস্কারের ধারণা দেয়। কিন্তু যারা অন্যের শ্রমশোষক, ধর্ম তাদের পার্থিব জীবনে বদান্য অনুশীলনের নির্দেশ দেয়। এ ভাবেই শোষক হিসাবে নিজেদের ন্যায্যতা সপ্রমাণের জন্য ধর্ম খুবই সস্তা সুযোগ দেয় ও পরিমিত মূল্যের টিকেটে স্বর্গবাসে তাদের স্বাচ্ছদ্য বিধানের ব্যবস্থা করে। ধর্ম জনগণের পক্ষে আফিম স্বরূপ। ধর্ম এক প্রকার আধ্যাত্মিক সুরা বিশেষ এবং একই সঙ্গে পুঁজিদাসের মনুষ্য-ভাবমূর্তি এবং অল্পবিস্তর মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার দাবি নিমজ্জিত। এর দ্বারা অবশ্য লেনিন ধর্মকে অস্বীকার করে যাননি, তার কথায় ‘রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে আমরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে বিবেচনার দাবি করছি।’ আবার এর আড়ালে ‘ধর্মীয় প্রশ্নকে বিমূর্ত, আদর্শবাদি কায়দায়, শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন, বুদ্ধিবাদী প্রসঙ্গরূপে’ উপস্থাপনেরও বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম নিষিদ্ধ নয়, তবে সমাজতন্ত্রীদের ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে পালনও বিধি সম্মত নন। লেনিন তার উপস্থাপনায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘আমাদের কর্মসূচিতে আমরা আমাদের নাস্তিক্যবাদ ঘোষণা করিনি, করা উচিতও নয়। এ কারণেই যেসব প্রোলেতারিয়েত আজো অতীত কুসংস্কারের কোনো না কোনো জের বজায় রেখেছে তাদের আমাদের পার্টিরও কাছাকাছি আসা নিষিদ্ধ করা হয়নি, হওয়া উচিতও নয়।’ তাঁর এ কথা এটিই প্রমাণ করে ধর্মের সঙ্গে পার্টির কোনো সখ্যও নেই, বৈরিতাও নেই। ধর্মের সকল ইস্যু রাজনীতি বা রাষ্ট্রের বাইরে থাকবে। ফরাসি স্যেকুলারিজমের সঙ্গে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের মিল আছে আংশিক। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রী আমলে রাষ্ট্র সকল ধর্ম থেকে বিরত থাকে এবং ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় যে নীতিই গ্রহণ করা হোক না কেন, মানুষজনকে ধর্ম থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা যায়নি। তৎকালের সাহিত্যেও তার প্রতিফলন পাওয়া যায়। বিশেষ করে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ আর ‘আমার ছেলেবেলা’র মধ্যে রুশজীবনের চর্চা এবং বিবর্তন ধরা পড়ে। ঈশ্বর সর্বদা সর্বহারাদের কাছে শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্যেও ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনে। গোর্কির মধ্যে একটি কল্যাণকামী ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল, যিনি মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো করে কথা বলেন, অসহায় মানুষের মতো তিনিও অসহায়, কিন্তু তিনি তাদের পরম আপনজন। তরুণ গোর্কি (লেক্সেই) তাঁর দিদিমার মানবিক ঈশ্বরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, যাঁকে তাদের নিজের লোক বলেই মনে হতো, কিন্তু দাদামশাইয়ের ঈশ্বরের  রূপ সামন্ততান্ত্রিক। দিদি মা তাকে শুনিয়েছিলেন, মা মেরি ও যিশুর কষ্টের কথা, ‘সেন্ট জন ওষুধি লতার কথা, ফান আর এঁটেল গোলাপজামের অদ্ভ‚ত ঐন্দ্রজালিক শক্তি প্রয়োগের কথা।’ গোর্কির ধর্ম সংগঠনের ধারণা নিয়ে লেনিনের কিছু উষ্মা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ঈশ্বর বিষয়ে এক চিঠিতে ভ.ই লেনিন গোর্কির কাছে এক পত্রে লিখেছিলেন ‘ভগবান, ভগবৎপ্রতিম সংক্রান্ত প্রশ্নে এবং সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতে আপনার মতাবস্থানে একটা স্ববিরোধ আছে আমার মনে হয় এই একই স্ববিরোধ যেটাকে আমি দেখিয়ে দিতাম কাপ্রিতে আমাদের শেষবার দেখা হবার সময়ে আলাপের মধ্যে।.. আপনি ত্যক্ত বিরক্ত – আপনি একইভাবে লিখেছেন, বুঝতে পারিনি আপাতত কথাটা ঢুকে পড়ল কিভাবে, অথচ তার সঙ্গে সঙ্গে আপনি সমর্থন করেছেন ভগবান আর ভগবান-সংক্রান্ত ধারণা। ভগবান হলো গোষ্ঠীর, জাতির, মানবজাতির গড়ে তোলা সেইসব ধ্যানধারণা সাকুল্যে জাগিয়ে তুলে সংগঠিত করে এমন সামাজিক অনুভব যার লক্ষ্য হলো সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিকে সংযুক্ত করা এবং জান্তব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রাশ টেনে ধরা।’ লেলিনের মতে এই তত্ত¡ স্পষ্টতই বাগদানভ ও লুনাচারনস্কির তত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পানি অনেক গড়িয়েছে, ধর্ম ও রাজনীতির গিঁট ছাড়ানো যায়নি খোদ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতেও। ধর্ম ও জাতিভেদে রাষ্ট্রের বিভেদনীতি বিদ্যমান। দুর্মোখদের অভিযোগ আছে- মার্কসবাদ মার্কসবাদিদের কাছে ধর্মের স্থান করে নিয়েছে। তবে মার্কসের দ্বান্দিক বস্তুবাদ ধর্ম-রাজনীতিতে যতই বিরোধ থাকুক দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির মনে আত্মমর্যদার বোধ জাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর চিন্তা পরবর্তীকালের বিশ্বের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের শ্রেণিকাঠামোকে ভাবতে বাধ্য করেছে। একই সঙ্গে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধারদের স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে টিকে থাকা, একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যবহার, প্রচ্ছন্ন পুঁজির মালিকানার নীতি অনুসরণ প্রশ্নবিদ্ধ। চীনের এক কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নীতি, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন এবং অতি মুনাফালাভের মনোভাব, মাওজেদং এর উপর অলৌকিক ক্ষমতারোপ- এসব ভাবলে মার্কসবাদ এখনো ইউটোপিয়ায় রাজত্ব করছে।

উপনিবেশিক আমলে উপমহাদেশের ধর্ম ও রাজনীতির পারস্পারিক সহযোগিতা ও অভিন্ন পথচলার ধরনটা কেমন ছিল দেখে নেয়া যেতে পারে। ইংরেজের ক্ষমতা গ্রহণের আগে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য বিদ্যমান ছিল। ১৭৫৭ সালে নানা ছলনায় নবাবকে পরাস্ত করে ঈস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের শাসন ক্ষমতার দোরগোড়ায় পা রাখে, ঠিক তার একশ বছর পর ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে শেষ মোগল বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাচিত করে অখন্ড ভারতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কোম্পানির এই একশ বছরে বাংলা ছাড়াও রাজা ও নবাব শাসিত রাজ্যগুলো তারা নানা ছুঁতোয় আক্রমণ করে দখল করে, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্থানীয় শাসনকে উৎখাত করে সা¤্রাজ্যবাদি শাসন সম্প্রসারণ করে। উপনিবেশিক দেশগুলো তাদের একান্ত মুনাফা লাভের স্থান হিসাবে পরিগণিত হয়। পরিণামে এ দেশের ব্যবসায় বাণিজ্য শিল্প-কারখানা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একই সঙ্গে এ দেশের মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সংকটের সম্মুখীন হয়। ইংরেজের আগে মোগলের প্রায় সাড়ে তিনশত বছর নিয়ে মোট প্রায় আটশ বছর ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। উপনিবেশি শাসনের রূপ আর মধ্যযুগের দিগি¦জয়ী রাজা কিংবা মুসলিম শাসনের ধরন ভিন্ন ছিল। উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মূল্য লক্ষ্য অর্থ উপার্জন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের সকল সম্রাটট ব্যতিক্রম ছাড়া এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, বেড়ে উঠেছেনন, মারা গিয়েছেন- দেশের মূলধারা ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছেন। এমনকি অন্য মুসলিম সম্রাটগণও সবংশে উৎখাত হওয়া ছাড়া এ দেশই ছিল তাদের শেষ গন্তব্য, গজনির সুলতান মাহমুদ, নাদির শাহ বাদে।

মোগল বাদশাদের জীবনাচরণ, বিয়ে, খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণ, সঙ্গীত প্রিয়তা এবং জীবন-জীবিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- শাসক বা শাসিতের মধ্যে ধর্ম খুব কমই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছ। আদিকাল থেকে দেখা যায় বিশাল ভারতবর্ষে বহুধর্ম বহুবর্ণ বহুগোত্র- অলঙ্ঘনীয় পার্থক্য শর্তেও শান্তিতে বসবাস করে আসছিল। রাজাদের কাজ ছিল, রাজ্যজয়, রাজ্যশাসন প্রজাপালন। যোগ্যতরের অধিকার হিসাবেই বিবেচিত ছিল। ধর্মের নামে যুদ্ধ রাজনীতির পৃথক কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ধর্ম আপন আচরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব গোঁড়া মুসলমান ছিল, তাই বলে হিন্দু প্রজাপালনে তার কার্পণ্য ছিল না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, স্যার যদুনাথ সরকার তার প্রমাণ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। শিবাজিকে মারাঠী হিন্দু রাজ্যের স্বপ্ন দ্রষ্টা বলা হলেও তাঁর বাহিনির দেড় লক্ষ সেনা সদস্যের ৬৬ হাজারই ছিল মুসলমান, সেনাপ্রধানসহ। ঔরঙ্গজেব সিংহাসনের লড়াইয়ে সেনাপতি যশবন্ত সিং শুরুতে দারার পক্ষে থাকলেও পরে ঔরঙ্গজেবের দলে ভিড়ে যায়। সিংহাসন আরোহন ও ক্ষমতা লড়াইয়ে টিকে থাকতে ঔরঙ্গজেবের হাতে মুসলিম নিধনের সংখ্যা কম নয়, সেখানে ধর্ম ব্যবহার হয়েছে চ‚ড়ান্তভাবে বাদশার ইচ্ছায়। শিবাজি ও তার পরবর্তীকালে মারাঠী সেনাদের লুটতরাজ হিন্দু-মুসলিম বিভেদ করেনি। কার্ল মার্কস ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জিতে বলেছেন, শিবাজির সঙ্গে ঔরঙ্গজেব সারাজীবন গর্দভের মতো আচরণ করেছেন। এই জাতশত্রুকে কয়েকবার হাতের মুঠোয় পেয়েও হত্যা না করা তাঁর জন্য চরম ভুল ছিল। অথচ নিজের ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের হত্যা করেছেন- এসবই ছিল কৌশলগত কারণ। কিন্তু নিহতভ্রাতার কন্যাদের অধিকাংশ তাঁর পুত্রদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মোগল রক্ত অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। এই কালপর্বে ধর্ম ও রাজনীতি যেমন আলাদা ছিল না, বিভেদও ছিল না। রাজার বাইরে এক বা একাধিক ধর্মীয়গোষ্ঠী সক্রিয় থাকত। দিল্লির উপকণ্ঠে দর্শনিয়া সম্প্রদায় নামে হিন্দু ব্রাহ্মণদের একটি উপদল ছিল- যারা প্রতিদিন সূর্যাস্তের পরে দূর থেকে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মুখ দর্শন না করে প্রাত্যাহার করত না। এতে গোঁড়া ধর্ম-বিশ্বাসী সম্রাটের ধর্মত্ব ক্ষুন্ন হয়নি।

কিন্তু ইংরেজের মতো যখন মহাপরাক্রশালী বৈদেশিক শাসন ভারতের উপর চেপে বসল, তখন কালক্রমে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই অনুভব করলেন- এই দানবীয় শক্তির কবল থেকে মুক্তির উপায় কি। রাজ্য হারানোর বেদনায় প্রথম প্রতিক্রিয়া মুসলমানদের মধ্যে তৈরি হলেও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। ১৮৫৭ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন প্রধানত ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, নানা সাহেব, তাতিয়া টোপি, রানি ঈশ্বরী কুমারী, কুনওয়ারসিং প্রমুখ হিন্দু রাজা ও সামন্ত গোষ্ঠী, কিন্তু তাঁরা সর্বভারতীয় নেতৃত্বের মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের আনুগত্যে সমর্পন করেন। অর্থাৎ ইংরেজ আসার আগ পর্যন্ত মুসলিম শাসনের দ্বারা অখন্ড ভারতীয় চেতনার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ শাসন তা লন্ডভন্ড করে দেয়, মানুষ ফুঁসে ওঠে। কিন্তু এত বড় ভারতে এত ভাষাভাষী ও গোষ্ঠীর লোককে তাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত করার উপায় ছিল একমাত্র ধর্মীয় চেতনা- যার দ্বারা দূরদূরান্তের নানাভাষীর মানুষ একসূত্রে গাঁথতে পারে। সেই চেতনা থেকেই মুসলিম ফকির আর হিন্দু সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত ফকির ও সন্ন্যাস বিদ্রোহ, তিতুমীর ও হাজি শরীয়তুল্লাহ’র আন্দোলনে ধর্মীয় চেতনা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে। সাঁওতালও মুন্ডা বিদ্রোহও এই বাইরে নয়। মুÐা স্বাধীনতা বীর বিরসা নিজেকে ভগবানের প্রতিনিধি ঘোষণা করেন। এই একটি মাত্র অদৃশ্য কণ্ঠ ছাড়া মাটির পৃথিবীর মানুষ কারো ডাক শুনতে যেন নারাজ। এরপরেও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখব কংগ্রেসের নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে।

সিপাহি বিদ্রোহের মাত্র সতের বছর পর এক অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ন অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম কয়েকজন বিশিষ্ট ভারতীয়কে নিয়ে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে। প্রাথমিকভাবে বলা চলে এটি একটি ধর্মসংঘ- যারা থিওসোফিক্যাল সোসাইটির সদস্য কিংবা ভাবাদর্শী ছিলেন। তাঁদের আগ্রহ ছিল খ্রিষ্টান সাধুসন্ত, মহাভারত বেদদান্ত, গৌতম বুদ্ধের জীবনাচার, ইসলামের সুফিজম ও গ্রিক দর্শনের চর্চা। এর উদ্দেশ্য সবখানের মানুষ এক সেই বার্তা প্রদান করা। ইংরেজ এদেশে শাসন করছে বলেই যে তারা সবকিছুর দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা বলে তারা যেমন মনে করতেন না তেমন রাজকাজে তাদের সহযোগিতা করাও তাদের নীতি ছিল। এর দশ বছর আগে নিউইয়র্কে থিওসোফিক্যাল সোসাইটি গঠন করা হয়। কিন্তু মাত্র অর্ধশতক বছরের কালপর্বে এই দলটিই ভারত বিভাগে কিংবা ভারত স্বাধীনে প্রধান ভ‚মিকা রাখে। এবং উনিশ-শ পনের সালের পর থেকে ধীরে ধীরে মোহনদাস করমচাঁদ দলটির সর্বময় নেতৃত্বে চলে আসেন। যিনি মহাত্মা গান্ধী হিসাবে সমাদৃত। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তাঁর ভারত ফেরতের আগেই সারা ভারত স্বাধীনতার ক্ষুধায় বুভুক্ষ হয়ে উঠেছিল। অনুশীলন-যুগান্তর গোষ্ঠীর সশস্ত্র আন্দোলন ব্রিটিশ স্থাপনা, লর্ড ও রাজকর্মচারিদের গুপ্ত হত্যা ও আঘাতের মাধ্যমে তাদের এদেশে ছেড়ে যেতে বাধ্য করা। কিশোর ক্ষুদিরাম দাস, প্রফুল্ল চাকি, বসন্তকুমার বিশ্বাস, বাঘা যতীনসহ অসংখ্য তরুণ সরাসরি প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশ রাজ কর্মচারিদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনুশীলন ও যুগান্তর গোষ্ঠীর এই আন্দোলনের সঙ্গেও ছিল মূলত হিন্দু ধর্মীয় চেতনা। এই গোষ্ঠীর প্রবর্তক বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ পরবর্তীকালে পন্ডিচেরিতে আধ্যাত্মিকগুরু অরবিন্দে পরিবর্তিত হন। ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োকে হত্যাকারী শের আলী, এবং সিপাহি বিদ্রোহ শুরুর প্রাক্কালে বীর সিপাহি মঙ্গল পান্ডে, প্রত্যেকে ছিলেন নিজ নিজ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত।

বিশ শতকের ভারতীয় রাজনীতির ঊষালগ্নে যাঁরা রাজনীতি ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম বঙ্কিম চন্দ্র, দ্বিতীয় স্বামী বিবেকানন্দ, তৃতীয়ত শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। অনেক ইতিহাস লেখকের মতে- ‘অরবিন্দের হাত ধরেই ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিল। সেই থেকেই ধর্ম ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।’ কংগ্রেসের শুরুতে বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পালের রাজনৈতিক রচনা ও কার্যকলাপে হিন্দুত্ববাদি জাতীয়তাবাদি রাজনীতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। হিন্দুমেলা, শিবাজি উৎসব ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদি আন্দোলনে কাজ করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে মহাত্মা গান্ধী সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক হলেও তার সত্যাগ্রহ ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর কথিত ঈশ্বরের সত্যের রূপ আছে। তিনি শুরুতে ঈশ্বর সত্য, পরবর্তীকালে সত্যই ঈশ্বর মতে আস্থা রেখেছিলেন। এখানে জয়ান্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি রাখতে চাই- ‘বাল গঙ্গাধর তিলক গণেশ পুজা ও ভগবতগীতার মাধ্যমে মহারাষ্ট্রে যে হিন্দু ধর্র্মীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই একই নীতি অনুসরণ করে মহাত্মা গান্ধী তুলসী রামায়ণ ও গীতার সাহায্যে উত্তর ভারতে ধর্ম কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদি আন্দোলন গড়ে তোলেন। বাল্মীকি রামায়ণের রাজকাহিনি নয়, তুলসীদাসের রামচরিতামানসের ভক্তিমার্গই রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে হিন্দু সমাজের আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে রাম সীতা ও হুনুমানকে নিয়ে মধ্যযুগ থেকে উত্তর ভারতে যে ভক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাকেই রামরাজ্যের রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে তুলে ধরে রামধনুর ভক্তিগীতির মাধ্যমে মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে হিন্দুধর্মী জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করেছিলেন।’ (হুমায়ূন কবির প্রতিষ্ঠিত ‘চতুরঙ্গ’ বর্ষ ৫৪, সংখ্যা ৪, ১৪০০)।

কংগ্রেস বৃহত্তর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে না পারায়, মুসলিমলীগ ও খেলাফত আন্দোলনের মতো ধর্মগোষ্ঠীর রাজনৈতিক উত্থান ত্বরান্বিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত-শাসনে ব্রিটিশের ডিভাইড এÐ রুল পলিসিও কম দায়ি নয়। শুরুতে গান্ধীর কংগ্রেস মুসলিমলীগ ও খেরাফত আন্দোলনের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী সহাবস্থান বজায় রাখলেও শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায় না। পরিণামে মুখ্যত হিন্দু-মুসলিম ধর্মের ভিত্তিতে মোগল ও ইংরেজ শাসনে সুশৃঙ্খলিত কয়েক হাজার বছরের একটি দেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ধর্ম নিরপেক্ষ, বামপন্থী, অখন্ডতায় বিশ্বাসী কেউ পরিণামে পাত্তা পাননি। ধর্মই এখানে প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার আড়ালে ছিল ক্ষমতা গোষ্ঠীগত চেতনা। মহাত্মা গান্ধী নিজে ধার্মিক হয়েও নিজ ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে রক্ষা পেলেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্না নিজে ধর্মের আচরণহীন একজন মানুষ হয়েও ধর্মীয় পরিচয়ের রাষ্ট্রের জাতির জনক হলেন। নেহেরু এবং জিন্নাহ দুটি ধর্মীয় পরিচয়ের রাষ্ট্রের প্রধান হলেও ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরে রেখে দেশ পরিচালনার চিন্তা করলেন। ফলে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও যোগেনমন্ডলের মতো নেতারা ধর্মীয় কারণে বিভাজিত হয়ে যাননি শুরুতে।

ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত গড়ার ক্ষেত্রে নেহেরু কিছুটা সফল হলেও জিন্নাহ’র পাকিস্তান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। প্রথম দিকে জিন্নাহ’র মৃত্যু, লিয়াকত আলীর হত্যা, সেনা-অভ্যুত্থান ও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর কবলে দেশটি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। কিন্তু নেহেরু পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতিতেও ধর্ম প্রাধান্য পেতে শুরু করে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটে, ধর্মকে ইস্যু করে একই দেশের নাগরিকদের ধর্মবোধ ও ঐতিহ্যকে রাজনৈতিকভাবে হীন করার প্রবণতা শুরু হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত একটি ধর্মপছন্দ পার্টির দ্বারা শাসিত হচ্ছে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বেশি বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু নেহেরু কি পেরেছিলেন- রাষ্ট্র ও ধর্মের সহাবস্থান থেকে বাইরে থাকতে। সোমনাথ মন্দির নির্মাণ নিয়ে জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরোধের ইতিহাস জানা আছে। নেহেরুর মতে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র; সরকারের খরচে কোনো মন্দির বা ধর্ম প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে না। রাজেন্দ্র প্রসাদের দাবি, সরকারের খরচেই করতে হবে। এই নিয়ে নেহেরু রাজেন্দ্র প্রসাদের মধ্যে বিরোধের কারণ হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি রাজেন্দ্র প্রসাদের সোমনাথ মন্দির নির্মাণের দাবি তাঁকে মেনে নিতে হয়। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মারলো জওহরলাল নেহেরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘স্বাধীনতা লাভের পর কোন জিনিসটা’ আপনাকে সবচেয়ে বেগ দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন- ‘ন্যায়ের পথে একটি ন্যায় পরায়ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।’ তারপর বলেছিলেন, ‘ধর্মপরায়ন দেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলা।’

ধর্মীয় পরিচয়ে পূর্ব-বাংলা অখন্ড পাকিস্তানের অংশ হলেও পরিণামে ধর্ম তাদের রক্ষা করতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড, ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, অন্যায় শাসন-শোষণে জর্জরিত পূর্বপাকিস্তান মাত্র চব্বিশ বছরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো সাতচল্লিশের মতো ধর্ম এবার প্রভাবকের ভুমিকা পালন করেনি; বরং ধর্মনিরপেক্ষ একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্খাই প্রাধান্য পেয়েছিল। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নৈর্ব্যক্তি, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পারিক দোষারোপ বাগাড়ম্বর মাত্র। তারা তাদের কৃত দৃশ্যমান ভালো কাজের প্রতি পুরো আস্থা রাখতে পারছেন না, ধর্মকে রাজনীতির বৈতরণী পারের উপায় দেখছেন। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মের প্রয়োগ সকল দল তাদের কৌশলের অংশ হিসাবে নিয়েছে।

যাই হোক, এ সময়ে এসে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে রাষ্ট্র শাসনের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বিশ শতকের শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক শক্তির গিঁট থেকে দেশগুলো যখন একে একে স্বশাসনে ফিরে আসছিল তখন আশা করা গিয়েছিল,- একটি ভূখন্ড কেন্দ্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সম্প্রসারণবাদি শাসনের চেয়ে নিজেদের জীবনজীবিকা ও মর্যাদা উন্নত করতে পারবে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে, পৃথিবীতে লোক সংখ্যা বেড়েছে অনেক, সম্পদও নানা মাত্রায় গুণিতক হয়েছে। মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন, গড় আয়ু, শিক্ষার হার, নারী পুরুষের বৈষম্য হ্রাস- হয়তো অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনো প্রায় ঔপনিবেশিক আইন দ্বারা চালিত। আমলাতন্ত্র, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, চিরদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার মানসিকতা। পশ্চিমাদেশগুলোতে বর্ণবাদ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কদর বাড়ছে। চীন রাশিয়া ভারত আমেরিকা- যে দেশগুলোতে পৃথিবীর শীর্ষভাগ লোক বাস করে- সেখানকার রাজনীতিও নানা গ্যারাকলে আটকানো। প্রযুক্তির সুবাদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত চলাচলে নজরদারি বেড়েছে। কোনো দেশের পক্ষেই এখন আর একা চলা সম্ভব নয়। দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক যোগাযোগ ও পারস্পারিক নির্ভরতা বেড়েছে বহুগুণ। প্রত্যেক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষকে যেমন প্রযুক্তি ও যোগাযোগের ভাষা রপ্ত করতে হচ্ছে, ধর্মের ক্ষেত্রে তার বহুরূপতা আরো প্রকট হচ্ছে। ব্যক্তির ধর্মীয় বোধ আর ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের দাবি সব সময় এক থাকছে না। কোনো ব্যক্তির পক্ষে আদি উৎস থেকে পৌঁছানোর পথেও রয়েছে বাধা, বহুযুগের ব্যাখ্যা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। বর্তমান ধমীয় সমাজ জনগোষ্ঠী কেবল একটিভূখন্ডের সীমানায় বাস করেন না, তারা স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতি ও সংস্কৃতি ধারণ করে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে যা আছে তা অনুসরণ করতে হলেও ধর্মীয় পন্ডিতদের সম্মতি লাগবে। যেমন, সূরা বাকারার ৬২ নম্বর আয়াতে বলা আছে- ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খ্রিষ্টান ও সাবিঈন- যারাই আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের নিকট আছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ সূরা কাফিরুনে অপরের ধর্মকে গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে, কেউ গালি দিলে তার দায় তাকে নিতে হবে। নিজ ধর্ম আচরির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কোরানের তাফসির কারকগণ বলছেন, এই আয়াতগুলো সরল বিশ্বাস করা যাবে না, হাদিসের সমর্থন থাকতে হবে। বলা হয় এই আয়াত কেবল ইসলাম-পূর্ব যুগের সংশ্লিষ্ট ধর্ম পালনকারীদের কথা বলা হয়েছে যারা ভালো কাজ করেছিল। অথচ জিহাদ ও রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা ছাড়াই অবশ্য করণীয় বলে রায় দেয়া হচ্ছে।

তবু ধর্ম তো শুধু অদৃশ্য ঈশ্বরের যাচ্ঞা নয়, পার্থিব অপার্থিব গূঢ়-রহস্যের দাবিদার। জীবনাচরণ, শিক্ষা, বিয়ে, বিচ্ছেদ, গর্ভপাত, সংস্কৃতি, যৌনজীবন, সঙ্গীত শিল্পকলা, সম্পত্তি বণ্টন, বিচার-শাস্তি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা; অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে সবটাই ধর্ম নির্দেশ করতে চায়। আর এই নির্দেশ ঐতিহাসিক ও নৃতাত্তি¡কভাবে মরণশীল মানুষের মনোজগতে কল্পনার রাজত্ব করে- যা থেকে তার বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব কিংবা বহুকালের অব্যাহত চর্চার প্রয়োজন। যারা বেরুতে পেরেছেন তারা হয়তো তথাকথিত সভ্যজন মুষ্টিমেয় এলিট সমাজ। প্লেটোর গোল্ডেন ক্লাসের মতো তাদের দ্বারা দার্শনিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা গেলে হয়তো ধর্ম ও রাষ্ট্র যে যার মতো বসবাস করতে পারত। কিন্তু রাজনীতির পক্ষে যেমন রাষ্ট্রশাসনই চুড়ান্ত উদ্দেশ্য ধর্মের ক্ষেত্র তার বাইরে নয়। মহাভারতের সেই কথা- ‘শাসনকার্যেই সকল প্রকার বৈরাগ্যসাধনের সার্থকতা; শাসনকার্যেই সকল যাগযজ্ঞ একত্রিত হয়; শাসনকার্যেই সকল জ্ঞান সম্মিলিত হয়; শাসনকার্যই সকল বিশ্বলোকের কেন্দ্র।’ খ্রিষ্ট ধর্মে এই পৃথিবী পিতা ও পুত্রের রাজ্যের কাহিনি। জেনেসিসে আছে, ‘সমুদ্রে মৎস্যগণের ওপরে, আকাশের পক্ষীগণের ওপরে, ভ‚মিতে বিচরণশীল যাবতীয় জীবজন্তুর ওপরে কর্তৃত্ব কর।’ ইহুদিরা প্রভুর প্রতিশ্রুত ভূমির জন্য আদিবাসীদের করছে উচ্ছেদ। ইসলাম ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা করতে নারাজ। রেঙ্গুনের বৌদ্ধভিক্ষুগণ ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠী নিধনে দেখছে বুদ্ধের রূদ্রমূর্তি। বাগদানের উপর যখন মার্কিন হামলা নেমে আসে তখন সমস্ত ইউরোপীয় দেশ তার সমর্থন করে, মুসলিম দেশগুলো বিরোধিতা করে- ধর্মের প্রচ্ছন্ন সংহতি অস্বীকার করা যায় না। যদিও অভিযোগ ভুল প্রমাণিত, যদিও ক্ষমতা ও রাজনৈতিক-অর্থনীতিই প্রধান কারণ। আসলে ধর্ম পালনের জন্য লাগে সমাজ, একা একা ধর্ম পালন করা যায় না। আর এই সমাজ এক অদৃশ্য ঐশ্বরিক বন্ধনে আবদ্ধ।

ধর্মের উৎপত্তি যেভাবেই হোক, আদিকাল থেকে ধর্ম ও রাজনীতি জড়াজড়ি করে আছে। কেউ কারো পুরোপুরি গিঁট খুলতে পারেনি। মার্কসবাদের প্রচেষ্টা কিছুটা সুনির্দিষ্ট হলেও লক্ষ্যভেদী নয়। স্কেন্ডেনেভিয়ান ও পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকে রাষ্ট্র ও ধর্মকে কিছুটা আলাদা করতে পারলেও মাঝে মাঝে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে না। সে-সব দেশেও সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও পরিচয়গত সমস্যার কারণে ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই। এসব অবশ্য রাষ্ট্রের মূল ধারার অংশ হওয়া উচিত নয়। রাজনীতির বাইরে যেহেতু কোনো মানুষ নেই, মানুষ যেহেতু ধর্ম পালন করে, সেহেতু রাজনীতির পক্ষে ধর্মের বাইরে থাকা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলিত আইনের দ্বারা প্রতিবিধান করা। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে ধর্মের ইচ্ছে প্রতিফলিত হলে সংখ্যালঘুদের ধর্ম অবহেলিত থেকে যায়। আবার ভোট ব্যাংক হিসাবে সংখ্যালঘুরাও দারুণ সুবিধায় থাকে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতি লক্ষ্যণীয়। এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরেও অসংখ্য ধর্মীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে- যারা গণতান্ত্রিক ধর্মীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত থাকে।

অবস্থাদৃষ্টে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক এতটাই জটিল- যা নিয়ে উপসংহারে আসা প্রায় অসম্ভব। তবে বিবর্তিত যে আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আমরা বাস করি তাতে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের উপর ধর্মের প্রভাব থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রের কাছে সকল নাগরিকের পরিচয় ও অধিকার সমান থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা অন্য ধর্মের একজন মানুষেরও সংক্ষুব্ধ হওয়ার ঘটনা নাগরিক অধিকারের বিপরীত। কোনো বিশেষ ধর্মের সংখ্যাধিক্যের কারণের দ্বারা তা যেন সংখ্যা লঘুর ধর্ম দমিত না হয়। ধর্ম রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার বলে বিবেচিত হওয়া শ্রেয়। নারী পুরুষ লিঙ্গ নির্বিশেষে একমুখী শিক্ষা, বণ্টন, যুক্তিশীলতা, ইতিহাস চর্চা বৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান চেষ্টা, আইনের শাসন, ন্যায়পরায়নতা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা সকল নাগরিকের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব। আবার ধর্ম আমাদের এমন কিছু শিক্ষা দেয়, যা রাজনীতি বা রাষ্ট্রের দায়ের মধ্যে পড়ে না। সভ্যতার আদিকাল থেকেই সকল লোকগাঁথা, সাহিত্য, শিল্প, জীবনদর্শন ও জীবনাচরণের উপর ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে আছে। কাব্য-সাহিত্য-নাট্য ও চিত্রকলা ধর্মের বিষয়াদি দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। ধর্ম রাজনীতির অঙ্গন থেকে যত তাড়াতাতি সংস্কৃতি ও প্রার্থনার জগতে জায়গা করে নেবে তত তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মঙ্গল। তবে শঙ্কার হলো, অনেক আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা পরস্পর ধর্মের বেড়াজাল অতিক্রম করতে পারলেও রাজনৈতিক  বৈরিত্ব অতিক্রম করতে পারে না।