You are currently viewing দ্রোহী চিন্তা নির্মাণ করে দ্রোহী সামাজিক মনন/  নূরুল কবীর

দ্রোহী চিন্তা নির্মাণ করে দ্রোহী সামাজিক মনন/ নূরুল কবীর

দ্রোহী চিন্তা নির্মাণ করে দ্রোহী সামাজিক মনন

নূরুল কবীর

‘কথা’ গুরুত্বপূর্ণ। ‘কথকতা’ আরাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কথা মানুষের চিন্তার সশব্দ বাহন, কথকতা সে সশব্দ চিন্তাকে অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করতে পারে, উসকে দিতে পারে অপরাপর মানুষের চিন্তা, ঘটাতে পারে একের চিন্তার সাথে অপরের চিন্তার মিথস্ক্রিয়া। চিন্তা-ভাবনার এই যোগাযোগ, এই মিথস্ক্রিয়া, সমাজে জীবনঘনিষ্ঠ নানা বিষয়ে জনমত তৈরি করে। জিজ্ঞাসু চিন্তা নিরন্তর কথকতার মাধ্যমে সমাজকে জিজ্ঞাসু করে তোলে, দ্রোহী চিন্তা নির্মাণ করে দ্রোহী সামাজিক মনন।

জিজ্ঞাসু সমাজ ও দ্রোহী সামাজিক মননই কেবল স্বৈরতন্ত্র কবলিত ও বৈষম্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আপন দেশে জনস্বার্থপরায়ণ রাজনীতি ও বৈষম্যহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারে । আমাদের জনমনে এই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রণোদনা সৃষ্টি করা আমাদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কেননা, আমাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ অন্তর্গতভাবে অগণতান্ত্রিক এক শাসকশ্রেণীর একাধিক রাজনৈতিক দলের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি, নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও চরম বৈষম্যমূলক অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে অপমান-সহিষ্ণু এক উত্থানরহিত জনগোষ্ঠীতে পর্যবসিত হতে চলেছে—যেন বা অন্যায়, অবিচার আর শোষণ-নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তার ইতিহাস-নির্দিষ্ট নিয়তি। এমতাবস্থায়, আমাদের ইতিহাসের গণতান্ত্রিক মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের জনগণের ভেতর জিজ্ঞাসু সমাজ চেতনা জাগ্রত করার, দ্রোহী সামাজিক মনন তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। ফলে, গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবিতার সামনে অনেক ‘কথা’ বলারও কোন বিকল্প নেই।

আমি অতএব ‘কথা’ বলি। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে, এমনকি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে নিয়মিত কথা বলার চেষ্টা করি। গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত ভাব ও তাৎপর্য; গণতান্ত্রিক দর্শনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নানান স্বরূপ; জনজীবনে তার প্রতিফলনের অপরিহার্যতা; গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণাগুলো কথকতার মাধ্যমে মানুষের ভেতর সংক্রমিত করাই আমার এই কথা বলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমি মনে করি, গণতন্ত্রপরায়ণ সকল চিন্তাশীল মানুষেরও সমাজে অনেক ‘কথা’ বলা প্রয়োজন। কারণ, জনস্বার্থপরায়ণ গণতন্ত্রের শত্রুপক্ষ, অর্থাৎ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর প্রতি অনুগত অসংখ্য বুদ্ধিজীবী পত্র-পত্রিকায়, রেডিও-টেলিভিশনে, সভা-সমিতিতে, এমনকি মাঠে-ময়দানের জনসমাবেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে নিরন্তর বিভ্রান্তিমূলক ‘কথা’ বলে চলেছেন, বুনে চলেছেন কথার ইন্দ্রজাল — যার প্রধান লক্ষ্যই হলো গণতন্ত্রের দর্শনকে ভোটের মাধ্যমে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দলের ভেতর নিছক ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ফলে, জনস্বার্থের পক্ষাবলম্বী বুদ্ধিজীবিতার আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো শাসকশ্রেণীর শঠতাপূর্ণ কথকতার অন্তঃসারশূন্যতা জনসাধারণের সামনে উন্মোচিত করা, আর জনস্বার্থের প্রতি গণতন্ত্রের নানামুখী অঙ্গীকার পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা। শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিজীবিতার সাথে আমাদের এই ‘কথার লড়াই’ চালিয়ে যাওয়ার অতএব কোন বিকল্প নেই—কেননা, প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজনীয় সফল রাজনৈতিক সংগ্রামের ভাবাদর্শগত জমিন তৈরি করতে হলে জনস্বার্থপরায়ণ গণতন্ত্রের কথকতা জনসমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে সংক্রমিত হওয়া অপরিহার্য।

সংযুক্তি: লেখক-সাংবাদিক নূরুল কবীর-এর সংহতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কথকতা গ্রন্থটির মুখবন্ধ থেকে ঈষৎ কর্তন করে নিবন্ধটি পাঠকদের পাঠের জন্য লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।