You are currently viewing দ্বিজেন শর্মা’র জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি  -একটি নিকট পাঠপর্যালোচনা || লাবণী মণ্ডল

দ্বিজেন শর্মা’র জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি -একটি নিকট পাঠপর্যালোচনা || লাবণী মণ্ডল

দ্বিজেন শর্মা’র জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি

-একটি নিকট পাঠপর্যালোচনা

লাবণী মণ্ডল

‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ।’—দ্বিজেন শর্মা

বিপ্লবের পদধ্বনি থেকে ব্যক্তিজীবনের নিদারুণ বাস্তবতা

নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা। আমৃত্যু প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণের সংমিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ করার মধ্যে আনন্দ পেতেন। তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন, প্রকৃতিকে জয় করা নয়, তাকে ভালোবেসে তার অংশ হয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর জীবনযাপন করে, মানুষকে এতে উদ্বুদ্ধ করাটা জরুরি। তাঁর খুব প্রিয় একটি বই ছিল ফরাসি লেখক অতোয়ান দো সাঁৎ একঝুপেরির ছোট রাজকুমার। এ বইয়ের মূল বাণী ভালোবাসা। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই দ্বিজেন শর্মা হয়ে উঠেছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী একজন অসাধারণ মানুষ। শ্যামলী নিসর্গ, চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস, ফুলগুলি যেন কথা, গহন কোন বনের ধারে, সমাজতন্ত্রে বসবাস এগুলো দ্বিজেন শর্মার উল্লেখযোগ্য বই।

দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি : মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বইটি অনেকের মতে আত্মজীবনী। তবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারা যায়, এ বই শুধু তাঁর আত্মজীবনী নয়, তাঁর দেখা দেশ-কাল-মানুষের এক অন্তর্নিহিত আখ্যানও বটে। বইটির সূচিক্রম যেভাবে সাজানো হয়েছে—ভূমিকা, পটভূমির যৎকিঞ্চিৎ, কিশোর কালের কথা, ফুল তুলিতে ভুল, উড়নচণ্ডে পুত্রের প্রত্যাবর্তন, পণ্ডিতম্মন্যের বিশ্ববিদ্যালয় দৰ্শন, বরিশাল নিয়তিনির্বন্ধ, পুনশ্চ ঢাকা: সুবর্ণের সন্ধানে, ক্রান্তিকালের কথকতা, আমার দেশের মাটি, এলাম নতুন দেশে, পরিশেষ, সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি, সম্মাননা এবং গ্রন্থসমূহ।

বইটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে—আত্মজীবনী বা জীবনী আমরা কেন পড়ি? মানুষ মাত্রই অপরজীবনকে জানতে চান, বুঝতে চান; নিজের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুঁজতে ভালোবাসে। আর মানুষটি যদি হয় দ্বিজেন শর্মা কিংবা এরকম কোনো মহৎপ্রাণ। তা হলে তো বিষয়টি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আত্মজীবনীতে লেখক মানুষটি সারাজীবন ধরে যা যাপন করেন, তা তুলে ধরেন পাঠকের কাছে। এ বইটিও বেশ প্রাণোচ্ছ্বলে ভরপুর। বইটিতে দ্বিজেন শর্মা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্যাপক দেশান্তর, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের জলোচ্ছ্বাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকা ও সমাজতন্ত্রের পতন এবং একুশ শতকের বাংলাদেশের প্রথম দেড় দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির মনোযোগী ও সংবেদনশীলতার কথা তুলে ধরছেন। যা পাঠ করলে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। যে জীবন প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে আচ্ছন্ন, সে জীবনে এত অধ্যায়; যা পাঠ না করলে বোঝা সম্ভব নয়।

মানুষ মাত্রই বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেই মানুষকে জানতে-বুঝতে পারা খুব সহজ বিষয় নয়। তা জানতে হলে তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হয়। একজন প্রকৃতিবিদের জীবন আরও বেশি বৈচিত্র্যে ভরপুর—এর প্রমাণ ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ গ্রন্থটি। তিনি শান্ত, সমাহিত জীবনযাপন করেছেন। বৃক্ষকে সঙ্গী করে, বৃক্ষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে; নিজের ধ্যানমগ্ন জীবনকে কাটিয়ে দিতে পারা সহজ কাজ নয়। যেখানেই তার উপস্থিতি ঘটেছে, চলে গেছেন বৃক্ষের কাছে। নির্বিকার। হয়তো সবুজ ঘন কচিপাতার দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন, পাতাগুলো গাঢ় বর্ণ নিবে, বড় হবে; এরপর ঝরে যাবে। ঠিক যেমনভাবে মানুষ মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।

বারবার ভেঙে-গড়ার যে প্রেরণা তা তিনি প্রকৃতি থেকেই নিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় কাটানো তার অনুবাদক জীবনের আনন্দ-হতাশা, স্মৃতি ও পরবর্তীকালের নস্টালজিয়া। তিনটি দেশ ভেঙে পড়ার সাক্ষী এই মানুষটি এবং মনে হয় যে তাঁর বেদনার অধিক জায়গা দখল করে নিয়েছিল শেষোক্ত ভাঙন—সোভিয়েত রাশিয়ার পতন।

‘জীবনস্মৃতি’ বইটি দ্বিজেন শর্মার চিন্তা কাঠামো দিয়েই সাজানো। জীবনের যত পাওয়া না পাওয়ার গান রয়েছে, সেগুলো মনখুলে যেন গেয়েছেন। শুধু ব্যক্তিজীবনই যে ভরপুর থাকে আত্মজীবনীতে, তাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। যে কারণে বইটিকে তাঁর আন্তরিত আখ্যান বলা যায়।

সমাজতন্ত্র, কমিউনিজমের প্রতি ছিল তাঁর আনুগত্য। কিন্তু তিনি যে সময়ে সোভিয়েতের ভেঙে পড়া কাঠামো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন, তা মোটেও কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করতো না। কার্যত জোসেফ স্তালিন পরবর্তী সময়কাল ছিল রাশিয়ায় পুঁজিবাদের পুনরুত্থানের সময়। তবে কোনো ব্যবস্থাই রাতারাতি ভেঙে পড়ে না। সেখানে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার রেশ থেকে যায় একটা বড় সময় ধরে। ষাট-সত্তর বা আশির দশকে সে সময়টাই চলছিল। এ সময়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার রেশ রয়ে গেছে। কিন্তু পুঁজিবাদ মাথা মোটা করেছে খোদ কমিউনিস্ট পার্টির কুলিনদের মধ্যে। আর সে অনুযায়ী নীতিগত পরিবর্তনগুলো সামনে এসেছে। দ্বিজেন শর্মার মতো অনেক স্বজ্জন ও দায়িত্বশীল মানুষ এ সময়ে সোভিয়েত নেতৃত্বের সমাজতান্ত্রিক ভণ্ড লেবাসে বিভ্রান্ত হয়েছেন। এটিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। অথচ সেটি ছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষে পুঁজিবাদের বিষবৃক্ষের ফলন। তার ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত ভেঙেছে। রাশিয়ায় উগ্র-জাতীয়তাবাদের ফলন হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্থান এরই ধারাবাহিকতা।

২.

দ্বিজেন শর্মার বাবা মারা যান ১৯৪৫ সালে। এরপর তিনি দিদির বাড়িতে কাটান কিছুকাল। বাল্যকালের সেই বন্ধুত্ব, দুরন্তপনা দ্বিজেন শর্মা ভোলেননি। তাই তো তা আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন—“দিদিদের বাড়িটি বিশাল। পুরান জমিদারবাড়ি। সামনে চণ্ডীমণ্ডপ, তারপর লম্বা এক টিনের ঘর, ভেতরে আরেকটি, তাতে নানা হিস্যার বসবাস। মাঝখানে উঠান। টিনের ঘরগুলি আধাপাকা। কিছু পাকা দালানও আছে। বাড়ির সামনে বড় একটা মাঠ, তারপর প্রকাণ্ড দিঘি। দক্ষিণে ধানখেত, কুশিয়ারা নদী এবং বহুদূরে খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়, গাঢ়-নীল, বিশাল। সর্বত্র জারুলগাছ। অপূর্ব নিসর্গ শোভা। সামনের ঘরের এক কামরায় বাড়ির স্কুলপড়ুয়া দুটি ছেলে স্বদেশ ও চিত্তর সঙ্গে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। কিছুদিন পর রবি এসে জুটল। তারও ঠাঁই এই ঘরে। দুপাশে শোবার দুটি খাট, মাঝখানে লম্বা টেবিল। কোনো চেয়ার নেই। বিছানায় বসেই টেবিলে বই রেখে পড়াশোনা। স্বদেশ হল বাড়ির এক হিস্যার মালিক শৈলেন বাবুর ছেলে আর চিত্ত তাঁর ভাগনে। সব মিলিয়ে চারজন একই ঘরে। আমি ও রবি করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। স্বদেশ ও চিত্ত আগ থেকেই ছিল। জামাইবাবু মনোরঞ্জন শর্মাচৌধুরী ছিলেন সেই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। আমার বইপড়ার নেশা জামাইবাবু জানতেন। সেকথা তিনি লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা শিক্ষককে জানিয়েছিলেন, তাতে যদৃচ্ছা বই নেওয়ার সুযোগ পাই। বই বলতে সবই গল্প-উপন্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিন্দী, পঞ্চগ্রাম, গণদেবতা, ধাত্রীদেবতার কথা আজও মনে পড়ে। ইতিমধ্যে আমাদের চারজনের দলে এসে জুটল পাশের গ্রাম বটরশির আব্দুর রউফ। সে করিমগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলের ছাত্র, পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য, তাই ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ এবং আমার সঙ্গে সর্বক্ষণ ওঠা-বসা।”

এরপর শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন। নতুন স্কুল। বিস্তর অভিজ্ঞতা। দুরন্ত সব ঘটনা। স্কুলের স্মৃতিগুলো যেন তার কাছে জ্বাজল্যমান। তিনি যখন জীবনের বর্ণনা তুলে ধরছেন, মনে হবে এ তো আমাদেরই গ্রাম্যজীবন, অথবা অতিপরিচিত এক সমাজজীবন। যে জীবনকে মাড়িয়ে আজ আমরা এক যান্ত্রিক জীবনকে যাপন করছি। হয়তো এটাকেই ‘জীবিত’ থাকা বলে, বেঁচে থাকা বলতে যা বোঝায় তা নয়।

১৯৪৬ সাল। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজিত হওয়ার ইতিহাস। পত্রিকার পাতাভর্তি অজস্র কাহিনিতে। সুভাষ বসুর উপর প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন দ্বিজেন শর্মা। তখনও তিনি মেট্রিক পাস করেননি। কিন্তু ভেতরে যার তেজ থাকে, তা কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ হবেই।

বন্ধুদের বৈকালিক আড্ডা। পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার ক্ষোভ। কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বইপত্র ছুঁড়ে ফেলা। সিনেমাহলে গিয়ে কিসমৎ সিনেমা দেখা। এসব চিত্র তিনি যে বর্ণনাভঙ্গিতে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা সত্যিই অভাবনীয়। তাঁর সহজ, সাবলীল ভাষা ও তীক্ষ্ণ বর্ণনাশৈলীর কারণে দীর্ঘ পটভূমিও থেমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেনি।

৩.

যাঁরা তাঁর সম্পর্কে ভেবেছেন বা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের পরিচয় ঘটিয়েছেন তাঁদের মূল্যায়ন খুবই দৃঢ় ছিল। এ মানুষটির চিন্তাজগতে যেভাবে নিসর্গশোভা শেকড় গেঁড়েছিল, তা সত্যিই অভাবনীয়। তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বইয়ের ভূমিকায় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছেন—‘ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর খন্দকার গলির এক বাসার দোতলার চৌকাঠটি পার হতেই তাঁর কন্ঠ। পরিচয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, কতদিনের সুহৃদের সঙ্গে কথা বলছি। একবারও, একটুও আড়ষ্টতা আসেনি আমার মধ্যে। মনে হয়নি, এই প্রথম তাঁর সঙ্গে, তাঁর পরিবারের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। এমনি করেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। যেমন অনেককেই নেন। শুধু মানুষ নয়, তিনি বুকে টেনে নেন সমগ্র বিশ্বকে। তাঁর মধ্যে গভীর মায়া। গাছপালা, নদী, পুকুর, পাখি, সবুজ বনানী—সবই তাঁকে চিরকাল মুগ্ধ করে এসেছে। নিসর্গই তাঁর এক রকম নেশা হয়ে উঠেছিল, পরে তো উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে তা পেশা ও হয়ে গেল।’

‘…সেই সময়টায় তিনি কাজ করছিলেন বাংলাদেশে বৃক্ষ, লতা, গুল্ম কত রকম আছে, কোথায় আছে, সেসব নিয়ে। গিয়েছিলেন একবার খুলনাতে। সকালবেলা উঠে আমরা দুজনে চলে যেতাম রূপসা নদীর ওপারে, বিলের ধারে। কাদা, জল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তিনি নেমে পড়তেন জলে। কী সব সংগ্রহ করতেন সেটা আমি জানি না । এসব সংগ্রহ করতে করতে কত কথা! প্রকৃতি, আগেকার বাংলাদেশ।’

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন লিখেছেন—‘উদ্ভিদবিজ্ঞানের একাডেমিক পাঠের বাইরে যে আরেকটি বিশাল জগৎ আছে, তা আমরা কেবল দ্বিজেন শর্মার লেখা থেকেই জানতে পেরেছি। তাঁর এই ভাবনা সত্যিকার অর্থেই বিচিত্র ও বহুমুখী। তিনি ছিলেন অনুসন্ধানী লেখক। অন্তর্দৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও ভাবনার গভীরতার দিক থেকে তিনি দার্শনিক পর্যায়ের। এ কারণেই তাঁর লেখায় আমরা খুঁজে পাই উপমহাদেশের ঐতিহাসিক উদ্যানচর্চার সূত্র। একই সঙ্গে ব্রিটিশ-ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানীদের অজানা অধ্যায়ও। রমনা নিসর্গের স্থপতি বিস্মৃতপ্রায় রবার্ট লুইস প্রাউডলক তাঁর লেখাতেই আবার নতুন করে ফিরে আসেন। ১৯০৮ সালের দিকে রমনাসহ ঢাকা শহরের নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছিলেন লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের অন্যতম এই কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক। তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে রমনাকেন্দ্রিক নিসর্গশোভা, রমনাগ্রিন। তিনি বিশ্বের অন্যান্য উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের সুদর্শন বৃক্ষগুলো ঢাকায় এনে রোপণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমান রমনা পার্ক অবশ্য অনেক পরের সৃষ্টি।’

৪.

১৯৯৩ সাল। প্রগতি প্রকাশন বন্ধ হয়ে যায়। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সুবিধাবাদী নেতৃত্বে এটি ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। সেখানে কাজ করা লোকজন বেকার হয়ে যান। অনুবাদ করে দ্বিজেন শর্মার যে আয় হতো, তা বন্ধ। যেন মাথার উপর বজ্রপাত। বয়স ষাট পেরিয়েছে! মাথা গোঁজার নেই কোনো ঠাঁই। এ প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ে তিনি লিখেন—‘আকাশ থেকে পড়লাম। এখন কী হবে। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। ঢাকায় মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। ছেলেমেয়ে রুশ ভাষায় পড়াশোনা করেছে, ভালো ইংরেজি জানে না। বাংলায় আরও খারাপ। কোথায় চাকরি পাবে তারা? আমরাই-বা কোথায় কী পাব! মনে পড়ল, গতবার ইংল্যান্ড বেড়াতে গেলে সেখানকার একাধিক রেস্টুরেন্টের মালিক, জনৈক দেশিভাই বলেছিলেন, আপনারা শিক্ষিত মানুষ, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানেন, বোঝেন। কিন্তু যে দেশে বাড়িঘর কেনা যায় না, ব্যবসা করা যায় না, ছেলেমেয়েরা চাকরি পায় না, নাগরিকত্ব পায় না, সে দেশে কেউ থাকে? তাঁকে অনেক কথা তখন শুনিয়েছিলাম, এখন সেই প্রশ্ন আমার কাছেই বারবার ফিরে আসতে লাগল। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় যতদিন কর্মশক্তি থাকে ততদিন কাজ করা যায়। ভেবেছিলাম এদেশেই থেকে যাব। কে ভেবেছিল পরাশক্তির এমন পতন হবে! ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর দেশান্তরী হওয়ার পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম, ভাগ্যিস বেঁচে যাই মায়ের সাহস ও দূরদর্শিতায়। এবার দ্বিতীয় আবাসটি হারানোর মুখোমুখি। ঐতিহাসিক সব বিপর্যয়ের দুর্ভোগ পোহানো কি তাহলে আমার নিয়তি! মায়ের সাহস ও দূরদর্শিতার কণাও তো আমার নেই।’

১৯৯৪ সাল। নতুন পথের সঙ্গী হন দ্বিজেন শর্মা। রাশিয়া থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপরও প্রায় প্রতি বছরই মস্কো বেড়াতে যেতেন। প্রথমবারই গিয়ে দেখেন, তাঁর ভালো ভালো সবগুলো ফুলগাছ এবং বাগানে সাজানো পাথরগুলো তুলে নিয়ে গেছে কেউ। এটি প্রকৃতিবিনাশী ও মানবিকবোধের বিরোধী পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই এক নজির।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হুট করে আসেনি রাশিয়ায়। পঞ্চাশের দশক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে তা শেকড় গাড়তে শুরু করে। তার প্রতিফলন আসে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে, পরিবার থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত লোভের সঞ্চার ক্রমের বেড়েছে। যে কারণে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলটিও বিতাড়িত হয়। এ পার্টির বেশিরভাগ নেতা-কর্মী পশ্চিমা কথিত গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদের পক্ষে জাতীয়তাবাদী পার্টিতে নাম লেখান। এরপর উগ্র-জাতীয়তাবাদ জন্ম দেয় গণহত্যাকারী স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের।

রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক সীমাবদ্ধতা সহকারে দ্বিজেন শর্মা রচিত ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বইটি এক ঐতিহাসিক দলিল। যেখানে বিপ্লবের পদধ্বনি থেকে ব্যক্তিজীবনের বাস্তবতা সবকিছু স্বল্পভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি বাক্যের ভেতর লুকিয়ে আছে ব্যক্তির জীবনদর্শন ও দৃঢ়তার ছাপ। প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় গড়া ব্যক্তিগত এ আত্মজীবনী ২০১৮ সালে প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়।

 

জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি

লেখক: দ্বিজেন শর্মা

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ

মূল্য: ৩০০ টাকা

*********************************