দিকশূণ্য পুরের বাসিন্দা
কাজী লাবণ্য
বড়বউ হাতে হাতে বেড়ার গায়ে শুকোতে দেয়া কাপড়চোপড়গুলো তোলে আর ভাঁজ করে। শাশুড়ির শাড়ী, সায়া, ব্লাউজ, শ্বশুরের লুঙ্গি তোলা হলে নয়াবউয়ের ম্যাক্সিটা হাতে নেয়। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে ম্যাক্সিটা নাকের কাছে নিয়ে শোঁকে। এরপর ওর সব কাপড় তুলে নরম হাতে, পরম যত্নে ভাঁজ করে।
গুমোট চাপধরা ভাবটা যেন বাড়ছে। গাছের পাতারা পর্যন্ত নিশ্চল, নিথর। আদ্রতাহীন শুকনো খরায় প্রকৃতি বারুদ হয়ে আছে। ভাদ্র মাসের বেলা ডুবতে চলল তাও খরতাপের কমতি নাই।
‘সাধ খাওয়ার’ দিন ছিল গতকাল। আজ গতকাল নয়। আজ আর সব দিনের মত প্রখর দিন, কাম কাজের দিন। গতকাল ছোটজায়ের বাপের বাড়ির লোকজন সাধ খাওয়াতে এসেছিল। তারা খাবার দাবার, পঞ্চা কাকার রসগোল্লা আর কল্কা পাড়ের নতুন শাড়ি নিয়ে এসেছিল। এদের পক্ষের আত্মীয়স্বজন, শ্বশুরের জুম্মার সহযোগী ভাইয়েরা সবাই এসেছিল। সবার জন্য রান্না বান্না করতে হয়েছে। বড়বউ সব সামলেছে, খুশিমনে দশহাতে সবকিছু করেছে।
কিন্তু আদতেই কি মনটা খুশি ছিল! একটা হাহাকার, একটা অপূরণীয় বাসনা মনের গহীনে নখের আঁচড় কাটেনি! হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করেনি! করেছে, হরদম করে। দিনরাত করে। মাসের পর মাস বছরের পর বছর করে। সে তার নরম হয়ে আসা শাড়ী ব্লাউজের সাথে নরমসরম একটা খুশির মুখোশও পরে থাকে সারা বছর ধরে।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। নামাজিরা যে যার মত নামাজ শেষ করেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই যাপিত জীবন আবার সজাগ হয়ে ওঠে। হাঁসমুরগি শেষবারের মত হেকেডেকে ঘরে ঢুকতে থাকে। পাখপাখালি নীড়ে ফেরে। রাস্তায় রাস্তায় হাটুরে মানুষের গলা শোনা যায়। কেউবা গানের সুর ছড়িয়ে দেয় মনের সুখে।
আশপাশের বাড়ি থেকে রাতের খাবারের আয়োজনের পোড়া গন্ধ মিশে যেতে থাকে কারো মাংস ভুনার সুগন্ধের সাথে।
নিজের ঘর থেকে সে বুঝতে পাড়ে ছোট জা ওর ঘরে আছে। শাশুড়ি মায়ের রান্নার হাড়িকড়াইয়ের শব্দ কানে এসে পড়ে। দীঘল দীর্ঘশ্বাস গিলে ফেলে সে নিজের শাড়ি সায়া ঠিকঠাক গুছিয়ে নেয় রান্নার কাজে যাবে বলে। তার আগে শাড়ির তল থেকে কি একটা যেন বের করে দুহাতে ধরে গভীর চুমু খেয়ে চৌকির তলার টিনের ট্রাংকে ঢুকিয়ে রাখে।
পাকঘরের বাইরেই পাকের ব্যবস্থা। সে রাতের ভাত বসায়। কলচেপে শ্বশুড়ের হাত পা ধোয়ার পানি ভর্তি বদনা, টুল বারান্দায় রেডি করে রাখে। ওর শ্বশুর গ্রামের ছাপড়া জুম্মার ইমাম। এশার নামাজ পড়িয়ে একবারে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নেয়।
শাশুড়ির হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিতে থাকে। শ্বশুর ফিরতে ফিরতে, বাতের ব্যাথায় কাবু শাশুড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে শ্বশুর ফিরলে সে খাবার দাবার আবার গরম করে বাবাকে খেতে দেয়। খেতে বসার আগে নিত্যদিনের মতই শ্বশুর জিজ্ঞেশ করে-
-মা, তুমি খাইছ মা? তার মা ডাকের মধ্যে আতরের খুশবু থাকে। সে ঘোমটার আড়াল থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে। অবশ্য সারাদিন সে মুখ দিয়ে কটা কথাইবা বলে! পারলে সবই উপর নিচ বা ডানে বামে মাথা নেড়েই সেরে ফেলে। খাওয়া দাওয়া শেষে, সব গুছানো হয়ে গেলে প্রতিরাতের মতই শ্বশুর ওকে কাছে ডেকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ফুঁ দেয়। এই ফুঁটা ওর মনে আস্থা আনে, শান্তি আনে। ফুঁ পেলে ঘুম ভালো হয়। তার অসহায় বোবা চোখ থেকে ঝরে অশ্রু। বর্ষার বিষন্নতা বা তুষারের অন্তর্নিহিত অশ্রু।
ওর মাথা জুড়ে চুলের চিকন বেনির সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক তাবিজ বাঁধা আছে, তাবিজ আছে বাহুতে আর আছে কোমরেও একঝোপা। পড়া তেল আছে সেটা মাখে, পড়া পানি আছে সেটা নিয়মিত খায়। এই বোবা হয়ে থাকা মেয়েটার মনের কথা ওর শাশুড়ি নয়, নিজের মা নয়, এমনকি স্বামীও নয় বোঝে এই শ্বশুর। তিনি প্রতি ওয়াক্ত নামাজে দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন মেয়েটির মনের আশা যেন পুরন হয়। শ্বশুরের নির্দেশমতো চাঁদের বিশেষ বিশেষ দিনে সে রোজাও রাখে।
একজন বুড়ি আসে প্রায় প্রতি মাসে, তার কাছ থেকে শেকড় বাকড়, পাতার রস নিয়ে সে নিয়মিত খায়। এ কাজটা সে গোপনে করে। শ্বশুর জানতে পারলে ভীষণ রাগারাগি করবে। অতি সংগোপনে সে এই বুড়ির চিকিৎসা নিয়ম মেনে করে। বুড়ি বলে-
-মাসিক শ্যাষের আরো দুইদিন বাদে এই পাতার অস খাবু। আর এই শিপাগুলা নিজের ঐ জাগাত নাগে থুবু।
বুড়ি খালার কথামত সে কাজ করে। মাস ঘুরে যখন পিরিয়ডের সময় আসে, ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করে, মনে মনে ভাবে এমাসে আর অগুলা হইবে না। এবার আল্লাহ মুখ তুলবে, দয়া করবে। পিরিয়ড হতে দিন দুয়েক দেরি হলে ওর বুকের ভেতর আশার আলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিশ্বাস দৃঢ় হয়-
-এবার প্যাটের ভেতর একজন আসপে, দিনে দিনে বড় হইবে, ওর প্যাটটাও নয়াবউয়ের মতোন অমন সোন্দর ভরাট হইবে, ও অমন করি আস্তে ধীরে হাটপে, বাড়ির সোব্বায়, পাড়ার সোব্বায় অক আদর করবে, আর স্বামী! হ তায়তো খুশিতে পাগলা হয়া যাইবে। কায়ও আর আঁটকুড়ী, বাঁজা, কুসাইত কইবে না। কায়ও আর শাশুড়িক বেটার ফির বিয়া দিবার কতা কইবে না। এ্যাকনা ছাওয়া আসপে, যার ছোট্ট ছোট্ট হাত, ছোট্ট ছোট্ট পা, টোপা টোপা মুকে ওকে মা মা করি ডাকপে।
যার কথা মনে করে সে ঘরের পেছনে একটা সৈয়দী পেয়ারার গাছ লাগিয়েছিল। সেটি বড় হতে হতে এখন ঘরের চাল ছুঁয়েছে। পেয়ারাও ধরে ঝেঁপে। পাকলে ভেতরটা সিঁদুরের মত হয়। বাবা জুম্মায় নিয়ে যায়, শাশুড়ি কোচরে নিয়ে পড়শিদেরকে দেয়, দেবরেরা হুল্লোড় করে খায়, টিয়ার ঝাঁক এসে খেয়ে যায় কিন্তু বড়বউ কোনদিন একটা পেয়ারা দাঁতে কাটে না।
আশায়, বিশ্বাসে, ভয়ভয় আনন্দে ও দু চারদিন কাটায়। কাউকে জানাতে ইচ্ছে করে। আবার ভয়ও করে। কিন্তু যথাসময়ে আশা ভঙ্গের রক্তপাত শুরু হয়। তখন ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। দক্ষিণপাড়ার মোমেনার মত গলায় ফাঁস নিয়ে কিম্বা মজিদ চাজির মেয়ে আম্বিয়ার মত এন্ড্রিন খেয়ে সব যন্ত্রণা মিটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
রাতে ঘুম হয় না। ঘুমালেই ছোট্ট একটা পরী আসে। কিন্তু সে থাকে না। দেখা দিয়েই চলে যায়। পরীটি উড়তে থাকে আর খলবল করে হাসতে থাকে…
সে উড়ে যাওয়া ছোট্ট পরীটির দিকে বড় বড় চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ সুরে বিড়বিড় করতে থাকে, তখন ঘুম ভেঙ্গে যায়।
খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। কারো সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না। নিজের পেটের উপর হাত বুলায় আর ভাবে-
-মোর প্যাটটা কোনদিন বড় হইবে খোদা! কোনদিন! কোন সময়! কায়ও কি মোক মা কবার বাদে দুনিয়াত আসপে না! এত এত ভিক্ষা চাই, রোজা করি, নামাজ পড়ি, বাবার তাবিজ, বুড়িখালার কবরাজি, কিচ্চুই কি কাম করে না!
তার ভেতরে, এইসব গল্প একত্রে মিলে তৈরি করে নানাবিধ বিচিত্র অনুভূতির ছায়াপথ।
ভাদ্র, আশ্বিন গিয়ে কার্তিকও যায় যায়। হিমেল হাওয়ারা এসে গায়ের পশমকে দাঁড় করিয়ে দেয়। চারদিকে পাতাঝড়া, ধুলাওড়া দিন। নয়াবউ আজকাল আর তেমন হাঁটতে পারে না, বসে থাকতেও পারে না। ওর তিন বেলার খাবার দাবার বড়বউ ঘরে দিয়ে আসে। সে বিছানায় বসে থালা হাতে নিয়ে খাবার খেতে খেতে মায়াভরা চোখে বড়’জায়ের দিকে তাকায়। ওর দিন ঘনিয়ে আসছে। যেকোন দিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। বড়বউ সাধ্যমত ছোট জায়ের সব রকম সেবাযত্ন, কাজকাম করে দেয় বলে, শ্বশুর শাশুড়ি সহ পাড়ার কেউ কেউ বলাবলি করে-
-এই বউটা এত ভালো! ওর দয়ার শরীল, নাইলে পাড়ার সউগ বাড়িতে জায়ে জায়ে কাজিয়া কোন্দলের বাদে চিলা কাউয়া বসপার পারে না, সে জাগাত এমার এত খাতির!
পোয়াতি নয়াবউকে সে মায়ের পেটের বোনের মতো আদর যত্ন করে। সংসারে গৃহস্থালি কাজও তো কম নয়। সেসব সমাধা করে মুখ বুজে জায়ের কাজগুলিও করে। প্রায় সময় জায়ের ঘরে গিয়ে ওর উঁচু পেটটাতে মোলায়েম করে হাত বোলায়। নয়াবউ লজ্জা পেলেও কিছু বলে না। মায়ের মত বড় জাকে সে কি বলবে! বুজানের মুখে তো কোন কথা থাকে না, কেবল নীরবে সব দায়িত্ব পালন করে। ছোটজায়ের এত বাড়তি যত্ন দায়িত্বের মধ্যে অবশ্যই পড়ে না, কিন্তু সেদিকে সে ভ্রুক্ষেপ করে না। ওর বড় মায়া লাগে এত বচ্ছর হয় বুজানের কোন ছইল পইল নাই। মনে মনে ভাবে নিজের বাচ্চাটা দুনিয়াত আইলে বড় জায়ের কোলে দিয়া কইবে- এই নেও বুজান, এ তোমার ছাওয়াল, তুমি বড় কর।
তীব্র শীত আসন্ন। নয়াবউয়ের দিনও আসন্ন। এদিকে সকলের অলক্ষ্যে বড়বউ যেন দিনকে দিন আরো বেশি দিকশূণ্য হয়ে পড়ছে।
গ্রামে সবার খলানে সোনালি ধান, ঘরের চালে, জাংলায় লাউ শিমের ফুল, নতুন আলু, নতুন শাক সকলের আনন্দময় কর্মব্যস্ততা। এরাও কিছু জমি আধিয়ারি করে আবাদ করে। সেখান থেকে কিছু ধান ভাগে পায়। বউ শাশুড়ি মিলে চলছে ধান সেদ্ধ করে চাল করা।
সকালবেলা শাশুড়ি উঠে উনুনে আগুন দিয়েছে। আনাজের ডালায় কটা শুকনো শিম, মূলা আর আলু আছে। ভাত হবে, আলু মূলা শিম চচ্চড়ি আর ডিম পানিতেলা হবে। শাশুড়ির অবাক লাগে বড়বউ এখনও ঘর থেকে বের হচ্ছে না! ওর তো এত বেলা কোনদিন হয় না। একটু পরেই সবাই খেতে চলে আসবে। ঘটনা কি! শাশুড়ির কপালে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট হতে থাকে। দুবার গলা তুলে ডাকও দেয়। কোন সাড়াশব্দ নাই! আজব তো! অভ্যস্ত হাতে বটিতে তরকারী কাটা হয়ে গেলে সে নিজে ভাতের মাড় গালিয়ে নেয়। কড়াই বসায় চুলায়। একহাতে সব করতে করতে বেলা বাড়ে, মিঠে রোদে উঠোন ভরে যায়। ছেলেরা, ওদের বাবা সবাই খেতে চলে আসে। একজন কামলা থাকে সেও খাবে। সবার চোখে মুখেই প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে থাকে- বড়বউ কই?
বড়ছেলে কপাল কুঁচকে নিজের ঘরের বন্ধ কপাটের দিকে তাকিয়ে থাকে- বউতো কখনও এ্যাংকা করে না। শইলটা খারাপ করিল নাকি? আইতোত মনটা কয় সউগ ঠিকঠাক আছিল। মনে মনে ভাবে, আইচ্ছা ঘরত যায়া দেকিতো ঘটনা কি?
এর মধ্যেই শশুড় দরদী কন্ঠে বলে ওঠে- বড়বউয়ের শরীলটা বুঝি ভালো নাই। থাউক আরও নিন পাড়ুক, কায়ও ডাকান না। একথা শুনে শাশুড়িও ভাবে- আইচ্চা, থাউক পাড়ুক নিন। সারাটাদিন খাটাখাটনি করে, একটাদিন এ্যানা দম নেউক।
সে সবার থালায় ভাত বাড়ে। স্তূপ করা ধোঁয়া ওড়া ভাতের পাশে একহাতা করে আলুবেগুনের চচ্চড়ি আর একটা করে ডিম দিয়ে দেয়।
ছেলেরা পিড়ি পেতে বসে থালা হাতে নেয়। ওদের বাবা তার জন্য বিছিয়ে রাখা পাটিতে বসে নিজের দিকে থালা টেনে নেয়। তবে তার মনটা চিন্তিত হয়ে থাকে।
শাশুড়ি গ্লাসে পানি ঢেলে দিলে ছেলেরা হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে নেয়।
এমন সময় বড় বউয়ের ঘরের দরজার হুড়কো আর কপাট খোলার আওয়াজ ওঠে। সবাই মুখে বা হাতে ভাতের লোকমা নিয়ে সেদিকে তাকায়। চালের উপর থেকে একটা কাক উড়ে যায় কা কা চিৎকারে। বাইরের কুকুরটা হঠাত করে কেমন যেন কেঁদে ওঠে।
সকলের হাত থেমে যায়।
সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। নয়াবউয়ের জন্য থালা সাজিয়ে শাশুড়িও ঘুরে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যায়।
-বড়বউয়ের ঘর থাকি নয়াবউ বেরাওচে ক্যানে! কিন্তু এটাতো নয়াবউ নোয়ায়, বড়বউই। চউকগুলাত ফির কী হইল? সে চোখ কচলে আবার তাকায় নাহ! ভুল দ্যাকেনি, বড়বউই তো! কিন্তু…
শ্বশুর কাঁসার বদনার নলে মুখ লাগিয়ে একটু পানি খেয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, তার চোয়াল ঝুলে যায়, হাতে তসবিহ নিয়ে জপতে শুরু করে…
নয়াবউয়ের মত ভরা পোয়াতির আকার পেট নিয়ে, ঠিক ওইভাবে পেছনে হেলে পড়ে বড়বউ দরজা পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে। পিঠে ছড়ানো জটাচুল, শাড়ির আঁচল অবিন্যাস্ত মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। হাসি নাকি বিকৃতি!
পুরো জায়গাজুড়ে যেন কবরের স্তব্ধতা নেমে আসে। এই স্তব্ধতা ভেঙ্গে শ্বশুড়ই প্রথম কথা বলে ওঠে
-লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা…চুপ! চুপ! একদম চুপ! কায়ও কিছু কন না। জিনের আসর হইছে, এ শয়তান জিনের কাম, তুই যা তো বাবা দৌড়ি যায়া ধর আগোত। ঘরত নিয়া যা, বিছনাত শোতে দে…
বাপের কথা শুনে বড়ছেলে হুঁশে ফেরে। ভাবে- বউয়ের শইলটা কোনসময় এত খারাপ হইল! শুকি এক্কেরে হাড্ডি হাড্ডি হইচে, চুলগুলাত কী ত্যাল চিরুনী দ্যায় না! কদ্দিন থাকি এ্যাংকা হইচে! আগত ক্যানে বউয়ের পাকে দেকি নাই! চউকগুলা কোটরের ভেতরত ঢুকি গেইচে, কিন্ত সেগলা অমন ভাটার মতন জ্বলেচে ক্যানে! তার বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে, আবার কেমন যেন একটু ভয় ভয়ও লাগে।
শ্বশুর উচ্চস্বরে দ্রুত আয়াতুল কুরসি, সুরা ইয়াসিন পড়ে বউয়ের মাথায় ফুঁ দিতে থাকে। শাশুড়ি তেল নিয়ে আসে হাতে পায়ে মালিশ করার জন্য, বড়ছেলে দিশা হারিয়ে ছটফট করতে থাকে…
শ্বশুর বাড়িতে এত ঝাড়ফুঁক, দোয়াকালাম, এমনকি পরবর্তীতে গঞ্জের ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রামের খুব কম মেয়ের ভাগ্যে জোটে।
বড়ছেলে, দৌড়ে গিয়ে বউকে ধরলে সে স্বামীর হাতের বেষ্টনীতে এলিয়ে পড়ে আর তার শাড়ীর ভেতর থেকে কাপড়ের টুকরো প্যাঁচানো ছোট একটা তুলোর পোটলা মাটিতে পরে যায়।
আর সকলের বিস্ফারিত চোখের সামনে মাটিতে পড়া তুলোর পোটলা থেকে ছোট্ট একটা পরী প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়তে শুরু করে। বাতাসে একটা অজানা সৌরভ ভাসতে থাকে।
১৯-৭-২১, শ্যামলি।