তিন কাঠায় বৃষ্টি
মেহনাজ মুস্তারিন
শহরের এক কোনে তিন কাঠা জমিন
তারই উপর ছোট্ট টিনের ঘর,
বহুবছর আগে সেখানে বসবাস করতাম;
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে
আদর, সোহাগ আর ভালোলাগার স্পর্শগুলো
এখনও পিছু ডাকে,
পেছনে তাকাই, তাকিয়ে থাকি
তারপর তাকে ফেলে আবারও ছুটে চলি
ছুটে চলি
সম্মুখ পানে।
ছুটতে ছুটতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি
স্মৃতির দোলনায় আমার সেই তিনকাঠা জমিনে দাঁড়িয়ে থাকা
সবকিছু দুলছে,
ওরা দুলছে, ওরা দুলছে, আর দুলছি আমি
হৃদয়ের আঙিনায় হঠাৎ হাজির হওয়া রঙধনুর মতো
অথবা মায়াময় ছায়াঘেরা নির্জনতায় জোনাকির আলো দেখে
যেভাবে অবাক হওয়ার ভান করি,
তেমনি করে আমার তিনকাঠার স্মৃতিকে সাদরে স্মরণ করি:
পেয়ারা গাছের ফাঁকে উঁকি দেয় সূর্য, খুব ভোরে
আমার ঘুম ভেঙে দিতে পাখিরা সেই সূর্যের রঙ সাথে করে
আমার কপালে চুমু দিয়ে বলতো, কোথায় তুই?
আমি আড়মোরা ভেঙে বলতাম, এই তো, আসছি।
ওদের যেন তর সইতো না,
অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত প্রেমিকের মতো
কিংবা অভিমানী শিশুর মতো
মুখ ফিরিয়ে নিতো।
ঠিক তখন আমি আমার শরীরটাকে যতটা সম্ভব
দুলিয়ে দুলিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম—;
আহ! সম্মুখে শান্তি পারাবার;
মুহূর্তে পাখিদের কলরব থেমে যায়,
আমার চোখ গাছের পাতায় আটকে থাকে,
দেখি পাতাগুলোর মাঝে নতুন পাতা
দেখি গোলাপ কি হাস্নাহেনার কোলে নতুন কুড়ি
সবাই কেমন অবাক হয়ে আমাকে দেখছে, আর
স্নিগ্ধ রোদের সাথে লুকোচুরি খেলছে—;
মুগ্ধ আমি তাদের আদরগুলো গায়ে মেখে নিতে নিতে
রূপসাগরে ডুব দেই, অথবা জেগে উঠি রূপসাগরের কোলে,
আমার শরীর, আমার মন অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে
নতুন প্রাণশক্তিতে বলবান হব বলে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেই
সেই ভোরে, সেই তিন কাঠা জমিনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির
ছোট্ট উঠানে।
হঠাৎ করে কখনো হয়তো আকাশ ঘন হয়ে আসতো,
ভালুকের থাবার মতো মেঘ দেখে ভয় লাগতো,
এই বুঝি লন্ডভন্ড করে দেবে—
এই বুঝি আমার পেয়ারা আতা আর সজনে ডাটা বাস্তুচ্যুত হবে
শরনার্থীদের মতো হারাবে ঠিকানা।
আমি মেঘেদের পানে তাকিয়ে মনে মনে বলতাম,
যদি নেমে আসিস অঝোরে, আর উথাল পাথাল করে দিয়ে চলে যাস,
তবে, চলে যাবার পরে নিস্তবদ্ধা নেমে এলে বড্ড একা লাগবে!
এই পাতার মাঝে রোদের খেলা, এই পাখিদের কলরব,
এদের তোরা মিথ্যে করে দিস না!
দিস না!
আমার মনে হতো, মেঘ ঝর অথবা বৃষ্টি আমার কথা শুনতে পেতো,
দেখতাম, তারা নিরব হয়ে গেছে, তারপর মনে হতো,
যেন অনন্তকালধরে তারা ঠিক সেভাবেই নিরব হয়ে আছে
আমার তিনকাঠার জমিনে দাঁড়ানো উঠোনের বুকে।
এই নিরবতার ভাষা আমার জানা,
আমার তিন কাঠা জমিনে এমন অনেক নিরবতার সাক্ষী আমি নিজে,
সাক্ষী আমার মা,
সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়ে গেলে আমার নানাকে দেখেছি
ইতিহাসের সবচে গভীর নিরবতায় ডুবে যেতে—;
আহা! মুর্শিদাবাদ, আমার নানার মুর্শিদাবাদ
এই তিন কাঠা জমিনে এসে নিরব হয়ে আছে।
একদিনের কথা, ভোর তখন দুপুরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে,
আমি দাঁড়িয়েছিলাম জানালার পাশে,
দেখি আমার উঠোনে কেঁচো আর তেলাপোকার ছুটোছুটি;
হঠাৎ দেখি শিলাবৃষ্টি!
কোত্থেকে এত মেঘ, কোত্থেকে এত বৃষ্টি, আর কোত্থেকেই বা এত ঝড়!
আমার হাতে তখন কোত্থেকে একটা গামলাও চলে আসে,
আমি বৃষ্টির ফোটায় নিজেকে ভেজাবো বলে শিলাবৃষ্টিকে উপেক্ষা করি,
আমার জামা, আমার পাজামা ভিজে যায়
ভিজে যায়,
আমার নানাকে দেখি বারান্দায়,
একটা লাঠিতে নিজেকে সমর্পন করে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন,
চোখে তার সতর্কবার্তা, আর মুখে একদলা নিরবতা নিয়ে
তিনি আমাকে ডাকছেন,
তাঁর স্মৃতিতে তখন হয়তো মুর্শিদাবাদে ফেলে আসা বৃষ্টি
অথবা, আমকুড়ানো শৈশব জেগে উঠেছে।
আমি নানাকে অতিক্রম করে ছুটতে থাকি,
আমার লক্ষ্য তখন বাড়ির পেছনের পুকুর
সেখানে বৃষ্টিগুলো ফোটায় ফোটায় পড়ছে,
নতুন গানের জন্ম দেবে বলে তারা তানপুরা হাতে বসেছে;
আমাকে তখন পেছন থেকে কেউ ডাকে, দেখি,
সজনে পেয়ারা গাছের পাতায় আটকে থাকা বৃষ্টির ফোটাগুলো
হাতছানি দিয়ে ডাকছে,
আমি থমকে দাঁড়াই!
আমি চেয়ে থাকি, আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়,
বৃষ্টির ফোটায়—;
মাধবীলতার আঁচলে বৃষ্টির কনাগুলো তখন
একাকিত্বের যন্ত্রণালাঘবে ব্যস্ত,
আমি নিগম্ন হই, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মতো আমার নয়ন
নতুনকরে জগতের দিকে তাকায়,
বৃষ্টির যন্ত্রণা আমাকে বিহ্ববল করে তোলে
তমশার ছিদ্র দিয়ে নিরবতা তখন টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে
ঝরে পড়ে
ঝরে পড়ে;
আমার বালিশ ভিজে যায়,
আমার তোষক,
আমার নানার বহুলব্যবহৃত কাশ্মিরিশাল
আর আমাদের চৌদ্দপুরুষের হাহাকার
এক মোহনায় মিশে বৃষ্টির সাথে খেলা করে।
আমি তখন রৌদ্দময়ী পৃথিবীর অপেক্ষায়
পাশ ফিরে শুই,
আমার দৃষ্টি তখন সম্মুখে প্রসারিত,
আমার হৃদয় তখন ইশ্বরের কাছে প্রার্থনারত—
সূর্যের প্রখরতায় বৃষ্টির দাগগুলো মুছে যাবে
এই ইচ্ছে তখন প্রবল হয়ে উঠেছে,
তখন বৃষ্টির স্মৃতিগুলোকে শেষবারের মতো স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে
আমি জেগে উঠি,
জেগে উঠি সেই ভোরে, যেভাবে বহুদিন আগে
পেয়ারা গাছের ফাঁকে উঁকি দিতো সূর্য, খুব ভোরে
আমার ঘুম ভেঙে দিতে পাখিরা সেই সূর্যের রঙ সাথে করে
আমার কপালে চুমু দিয়ে বলতো, কোথায় তুই?
আমি আড়মোরা ভেঙে বলতাম, এই তো, আসছি।
(রাজশাহী, ১২ জুন, ২০২২)