You are currently viewing তিন কাঠায় বৃষ্টি > মেহনাজ মুস্তারিন 

তিন কাঠায় বৃষ্টি > মেহনাজ মুস্তারিন 

তিন কাঠায় বৃষ্টি

মেহনাজ মুস্তারিন 

 

জ্যৈষ্ঠের খরতাপ বিমাতাবেশে বেশ জ্বালাচ্ছে। গ্রীষ্ম শুরু হলে কি হবে, এখন পর্যন্ত  ঝড়ের দেখা পাওয়া যায়নি। মাঝেমধ্যে গুড়ুম গাড়ুম করছে বটে, তবে একটু ধুলোবালি উড়িয়ে উপস্থিতির জানান দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি; ভাবখানা এমন—এখনও বেঁচে আছি! তো এভাবে দুয়েকদিন ছিটেফোটা বৃষ্টি হলেও ঝড় কিন্তু বেশ মুখ ভার করে রেখেছে। জানি না, বাছাধন এবার এত রাগ করেছে কেন! একদিক থেকে বরং ভালোই হয়েছে, তান্ডবের ক্ষয়ক্ষতি থেকে অন্তত রক্ষা পাওয়া গেছে। সেটাই বা কম কী! যাদের ঘর, জানালা-দরজা কিংবা ছাদ দূর্বল, এখনও ঠিক করাতে পারেনি বলে যাদের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুঠে উঠেছে, তাদের জন্য ঝড় না হওয়া আশীর্বাদই বলতে হবে। মনে হয়, প্রকৃতি এবারের তাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে। 

 

কয়েক দিন আগে আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ভাবলাম, গ্রীষ্ম বুঝি দেখিয়ে দেবে তার কেরামতি। তাকে স্বাগত জানাতে অফিস থেকে দ্রুত ফিরে এলাম, তারপর জানালা, দরজা লাগিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম—বাছাধন এলো বুঝি! কিন্তু, কোথায় কী? আচ্ছা, আমি একে অপেক্ষা বলছি বলে রাগ করছেন না তো? জানি, শব্দটা আশঙ্কা হলে কেউ আপত্তি করতেন না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, ঝড়ের রূপটি ভয়ঙ্কর হবে না। সেজন্যই অপেক্ষা শব্দটি বলা। থাকে না কিছু মানুষ, সুখের জ্বালাতন করে। আমার কাছে বিধ্বংসী হওয়া পর্যন্ত ঝড় হোক কি মানুষ, কারও আগমনই আশঙ্কার না। 

 

তো সেদিন ঝড় এসে যেন বাঁচিয়ে দিল আমাদের। শুধু টুপটাপ দু’ফোঁটা ঝরিয়ে নিরবে চলে গেল। আজ জ্যৈষ্ঠের শেষ দিন, তাপদহের মালাকে বরণ করবে বলে আষাঢ় মশাই সারাদিনধরে নিজেকে সাজাচ্ছে। বৃষ্টির কবিতাগুলো এপাশ ওপাশ করছে! কিন্তু, কোথায় বৃষ্টি? কবিতাগুলো কেমন শুকনো পানসে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে এঘর-ওঘর। ওদের মলিন মুখ দেখে আমার এতো মায়া হলো, ইচ্ছে করছিল দু’লাইন লিখে ফেলি। কিন্তু, কলম গালের একপাশে চেপে বসে টোল সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেও কবিতার জন্ম দিতে পারলো না। ওদিকে, গরমে মাথার যে অবস্থা, তাতে ভেজা ভেজা লেখা আসবেই বা কোথা থেকে!  কী আর করা যাবে, এমনটা ভাবতে ভাবতে হতাশ না হয়ে বরং গান শুনতে থাকি। ইউটিউবের বদৌলতে রুনা লায়লা গাইছে:

 

অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে,

যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দু’চোখ ভরে

তুমি এলে

কত বেদনার বিষন্ন মেঘ ভেসে ভেসে

এলে তুমি অবশেষে……….

 

এই গান বহুবার শুনেছি। ছোটবেলা সন্ধ্যায় সৈনিক ভাইদের অনুরোধের আসরে কিংবা দুপুরে গানের ডালিতে এই গান এত শুনেছি, গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু, কখনোই যা হয়নি, সেদিন তাই হলো। গানের শব্দগুলো আমাকে টেনে নিয়ে গেল শৈশবে ফেলে আসার তিন কাঠার ছোট্ট টিনের ঘরে, যেখানে আমি ফেলে এসেছি আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের আদর, সোহাগ, ভালোলাগা আর ভালোবাসার স্পর্শগুলো। আমার মনে হলো, এখনও তারা হাত বাড়িয়ে আছে, এখনও তারা পিছু ডাকছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, চেয়ে থাকি ওদের মুখের দিকে, তারপর আবার সামনে ছুটে চলি। শেষ হয় না আমার চলা, আমি চলতে থাকি, চলতিই থাকি! ওদিকে মনটা পড়ে থাকে ফেলে আসা স্মৃতিজড়ানো সেই তিনকাঠার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা টিনের চালের ঘরে, আর আমার শরীরটা এগিয়ে চলে ব্যস্ততার নানা রঙ মেখে।

 

বাড়িটা ছিল ছায়াঘেরা নিরিবিলি। নানা প্রজাতির গাছ গাছালিতে ভরা । ওরা আমার তারুণ্যের সাথে খেলা করত, আমাকে সঙ্গ দিত। মা যখন স্কুলে যেতেন, আমার ভাই বর্ণ হয়তো বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডারত, তখন অনেক সময় আমি একা হয়ে পড়তাম, সকাল, দুপুর কিংবা কখনো সন্ধ্যেবেলা—আমি একা সেই বাড়িতে। তখন থেকেই একাকিত্ব বড্ড প্রিয় আমার কাছে। নিজের সাথে, প্রকৃতির সাথে, কখনো-বা কিচির মিচির করে ডাকতে থাকা পাখিগুলোর সাথে কথা বলতাম। আমার ভালো লাগতো। সেই স্বভাব এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। নিজের মতো করে কাটানোর সুখটা নিতে অভ্যস্ত আমি সেসময় থেকেই।

 

অনেক ভোরে পাখিদের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে পেয়ারা গাছের ফাঁকে যখন সূর্য উঁকি দিতো, আমি হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলতাম, “আসছি!”

 

“এক্ষুনি!” বলে তাড়া দিলে আমি বলতাম, “মা স্কুলে যাক তারপরে তোদের কাছে আসবো।” 

 

ওদের অপেক্ষার তর সইতো না। ভালোলাগার আবেশে শরীর মন ছুঁয়ে দিতে চাইতো। ওদের আহ্লাদী চাহনি মনের কোনে জমা হতো মিষ্টি পরশ নিয়ে। আমি স্নিগ্ধ রোদে লুকোচুরি খেলতাম, মুগ্ধতার আদর মেখে নিতাম, আন্দোলিত হতো আমার প্রাণশক্তি!  আমি হারিয়ে যেতাম, হারিয়ে যেতাম নতুন কোন  অনুভবের কাছে!

 

প্রতিদিন তো এমন হয় না। হঠাৎ কোনদিন আকাশ কালোমেঘে ছেয়ে যেত। আমার ভয় লাগতো। কারন টিনের চালের ঘরটা বড্ড বেশি শব্দ করতো। মনে হতো, কোন দানব এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাচ্ছে। ভয় পেতাম যদি টিনের চালটা উড়ে যায়! মা বাসায় থাকলে এমনটা হতো না, তখন অসীম ভরসা কোথাও থেকে আসতো। মা বিশ্বস্ত সিপাহশালাদের মতো ঠায় দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো যতক্ষণ ঝড় না থামছে। কিন্তু, যখন একা থাকতাম, মনে হতো এই বুঝি পেয়ারা, আতা, সজনে ডাটাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে এদিক সেদিক। একা লাগতো, বড্ড একা লাগতো। মেঘেদের বলতাম, যদি নেমে আসিস, যদি অঝোরে উথাল পাথাল করে গাছেদের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে ঝর ঝর করে নেমে আসিস তবুও ভালো! তোদের সাথে আমি বৃষ্টির গান গাইবো, নাচবো, ভিজে যাব। জানি, তা সত্ত্বেও একা লাগবে! কারণ, বৃষ্টির একটা  নীরবতা আছে, উদাস চাহনি আছে, আর আছে টুপটাপ ঝরে পড়ার ছন্দ। আছে আদুরে অনুভূতি, যেখানে স্মৃতিগুলো ধূসর পিলসুজের আলো হয়ে চেয়ে থাকে, চেয়ে থাকে নিষ্পলক! সেই নিরবতার ভাষা আমার জানা। 

 

ছোট্ট জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির অবিরাম ঝরে পড়া দেখতাম। কাগজ বা ময়লা কোন ঠোঙার উপর বৃষ্টি পড়লে অন্যরকম শব্দ হয় সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। কখনো আবার মাটির বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম। বৃষ্টির ছাট এসে ততক্ষণে বারান্দা ভিজে দিয়ে গেছে, সেখানে কেঁচো, তেলাপোকার  ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে, আমি নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে আছি। কখনো আবার একচিমটি লবন এনে কেঁচোর গায়ে দিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ করি, কীভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে পালাবার পথ খোঁজে—বেঁচে থাকার গভীর তাগিদ তাদের মধ্যে, সে কারণে তারা তাদের গতি বাড়িয়ে দেয়। কখনো আবার খোলা-পায়ে নেমে যাই। আমার দূরন্তপনা দেখে গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা জুবুথুবু কাকগুলো মজা পায়। বোধহয় সাহসও, দেখি বেসুরো সুরে ডাকাডাকি শুরু করেছে। বৃষ্টিতে ভিজে আমার লম্বা চুল ততক্ষণে কবিতার ছন্দ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, আমাকে কবি না বানিয়ে তাদের যেন শান্তি নাই। আমি বিভোর হয়ে সজনে পাতায় আটকে থাকা বৃষ্টির ফোটার দিকে চেয়ে থাকি! দেখি, পেঁপে গাছের পাতায় বৃষ্টির কনাগুলো কী সুন্দর চুপটি করে বসে আছে। আমি হারিয়ে যাই একাকিত্বের বিন্দু-কণার মাঝে, হারিয়ে যাই মাধবীলতার আঁচলে, গাছের নিস্তব্ধতায় আর শিশুর শুভ্রতার মাঝে!

 

বৃষ্টির আকুলতায় এতটাই নিজেকে হারিয়ে ফেলি, এতটাই নিমগ্ন হই, কোথায় কী হচ্ছে কোনোদিকে খেয়াল করার অবসর নাই। ঠিক তখন হয়তো টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় বালিশ, তোষক, চাদর সবকিছু! চকিতে, সব আনন্দ কোথায় মিলিয়ে যায়। আমার আবেগগুলো হৃদয়ের কোনে ব্যথা হয়ে অঝোরে ঝরে পড়ে। আমি তখন অপেক্ষা করি রৌদ্রময়ী পৃথিবীর। সূর্যের প্রখরতার কাছে সবকিছু ম্নান হয়ে যাবে বলে বিধাতার কাছে প্রার্থনার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘ছুঁয়ে দাও, ছুঁয়ে দাও তোমার স্নেহের ছোঁয়া, শুষ্ক করে দাও আমার পৃথিবী।’ ঠিক তখন আরেক মন অন্য প্রার্থনায় ব্যস্ত, সে চাইছে, বৃষ্টির স্মৃতিগুলো স্নেহের পরশে আটকে থাক। আমার মন তাতেও খুশি না, কেবল বৃষ্টির স্মৃতি আটকে থাকাটা তার কাছে তখন যথেষ্ট না, সে তখন মনেপ্রাণে চাইছে—নতুনভাবে নতুন নতুন স্মৃতির জন্ম দিতে আবারো বৃষ্টি নামুক।

*****************************