You are currently viewing তিনটি মুক্তগদ্য > অমিতা মজুমদার

তিনটি মুক্তগদ্য > অমিতা মজুমদার

তিনটি মুক্তগদ্য
অমিতা মজুমদার
ছায়াসূর্য হয়েই যাদের হারিয়ে যেতে হয়
আজ সকালে বন্ধু লতা দেখা করালো পিপুল শাকের সাথে। সেই থেকে কতজনের কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরুলি, থানকুনি, ভৃঙ্গরাজ, গন্ধভাদুলি(গাদাল), তেঁতুলপাতা, ঘৃতকুমারী, কালোমেঘ, পাথরকুচি, তুলসী,বাবুই তুলসী,পাইলতা মাদার,হেলেঞ্চা, পিপুল সহ আরো অনেক নাম না জানা লতাগুল্ম। (অঞ্চল ভেদে এদের নাম ভিন্ন ভিন্ন), এরা কেউ অভিজাত বৃক্ষ বা সবজি নয়। অনেকটা জন্মনিয়ন্ত্রনবিহীন সময়ে অপরিকল্পিত সংসারের দুচারগন্ডা ছেলেমেয়ের মধ্যে বাবা মায়ের সযত্ন  নজর এড়ানো  ছেলেমেয়ের  মতো। যারা সংসারে অপ্রয়োজনীয় সদস্যের হয়েই বেড়ে ওঠে। হঠাৎ হঠাৎ সংসারের বিপদে আপদে কাজে লাগে। ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ এ সকল বুনো ঘাস লতা পাতার  রান্নাঘরে জামাই আদর মিলত সর্দি কাশি,পেটের পীড়া,গায়ে ব্যথা,শ্বাসকষ্ট সহ নানা সমস্যায়। জানি না লতার মায়ের আদরের পিপুল শাক বাস্তবে টিকে আছে কি-না। না-কি শুধু  লতার  হৃদয়ের গোপন কুঠুরীতেই  তার  অস্তিত্ব  টিকে  আছে। এখন গ্রামের  চেহারাটা  অন্যরকম। কারো ঘরে  একটি বা দুটি  সন্তানের বেশি ছেলেমেয়ে নেই। বাড়ির আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়, বনজঙ্গল নেই। তাই তেলাকচু, পিপুল এরা লোকচক্ষুর অগোচরে  বেড়ে উঠতে পারে না। বিদ্যুতায়িত গ্রামের বাড়ির  চারপাশে আছে  পরিপাটি  করে সাজানো  সব  বনেদি বৃক্ষরাজি।  যাদের গালভরা পরিচয় এবং অর্থমূল্য আছে।
মান মর্যাদাহীন এসব নিরীহ ভেষজ গুণের  লতা গুল্মরা বড়ো বড়ো বৃক্ষের আধিপত্যে অপ্রয়োজনীয় আগাছা ভ্রমে মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেই সমূলে উচ্ছেদ  হয়, বাড়ির শ্রী নষ্ট হবার আশংকায়।
কল্পনাপ্রবণ স্বাধীন মন বাঁচিয়ে রাখে প্রাণ
সকালের আকাশটা কেমন বিষণ্ণ মেঘের চাদরে মুখ ঢেকে রইল, এক সময় তার বুকের জমাট বাঁধা কান্না নেমে এলো জলের ধারা হয়ে। বর্ষা বলে সবাই তাকে। সে জলের ধারা নাইয়ে দিল আদুল গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিরীষ গাছটাকে।ধুয়ে দিল পৃথিবীর বুকে জমে থাকা সব ধুলা ময়লা। মেঘের চাদরটা সরে যেতেই বেরিয়ে এলো সোনালী দুপুর,মুঠো মুঠো রোদ্দুরের ছোঁয়ায় ঝলমল করে উঠল শিরীষের ফুলগুলো। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় সূর্যের লাল আভার রেশ ধরে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। সন্ধ্যার আলোছায়ার পরশ যেই মুখে লাগলো মুখ নামালো মাঠ জুড়ে ফুটে থাকা সূর্যমুখী। নামে রাতের আঁধার যখন আলো জ্বালে জোনাকি। মধ্যরাতের তারার ফুলে ভরা আকাশ আবার ঢাকা পরে মেঘের চাদরে। এই সব কিছুই কল্পনা করে মহানগরের ইট,পাথরে ঘেরা দশটা পাঁচটার রিক্সা বাসে জ্যাম ঠেলে পথ চলা মধ্যবিত্ত নাগরিক নামের প্রাণহীন প্রাণীরা।
সম্পর্কের সমীকরণ
সম্পর্কগুলো যেন যাদব বাবুর পাটীগণিতের সরল অঙ্ক। রেখাবন্ধনী, ফার্স্টব্রাকেট, সেকেন্ডব্রাকেট, থার্ডব্রাকেট, ভগ্নাংশ, যোগ,
বিয়োগ, গুণ ভাগ—– সব শেষে ফলাফল এক (১ ) বা শূন্য। নিয়ম মেনে কষে সমাধান করো। একটুও অনিয়ম করা যাবে না। ভাগের আগে গুণ নয়, আবার রেখাবন্ধনীর আগে ব্রাকেটের কাজ নয়। একটু গরমিল হলে সব তালগোল পাকিয়ে মাকড়শার জাল হয়ে ঝুলে থাকবে। যতই ছাড়াতে চাও ততই জড়াবে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এমনই সরল অঙ্কের ধাঁধায় প্রতিটা সম্পর্ক জড়ানো। প্রতিটা বাঁকে বাঁকে সম্পর্কের বদল হতে হতে জীবনের শেষ বাঁকে যখন পৌঁছায় তখন চারপাশে ঘিরে থাকা শূন্যতার মাঝে সে একা দাঁড়িয়ে থাকে। এক জটিল আর রসালো উপাদানের সংমিশ্রণের রূপ যেন সম্পর্ক। যার ধর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় সময়ের হাতে। কখনো সে সম্পর্কগুলো জড়িয়ে থাকে স্বর্ণলতার মতো, আবার কখনো হয়ে যায় জলবিছুটি।সময়ের কাটাছেঁড়ায় একই সম্পর্ক হয়ে যায় আনন্দ-বেদনার,অভিমানের কারণ। একসময়ের গায়ে গা  লাগিয়ে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কগুলোই কেমন দলছুট হয়ে ছিটকে পড়ে এদিক সেদিক। আপন আপন বলয়ে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।সেখানে পুরনো সম্পর্কগুলো মরে যায়। এক সময় হারিয়ে যায় সময়ের চোরা স্রোতে।
তবুও মানুষ সেই শূন্যতার আহ্বান উপেক্ষা করে মাকড়শার জাল বিস্তার করে নিজের চারপাশে স্বেচ্ছায়। ভালোবাসে সেই বন্ধন। যা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। এরই নাম হয়ত ভালোবাসা,মায়ামমতা।যা শাশ্বত ,চির সুন্দর।