You are currently viewing তিনটি অনুগল্প || শাহাব আহমেদ

তিনটি অনুগল্প || শাহাব আহমেদ

তিনটি অনুগল্প || শাহাব আহমেদ

প্রতিক্রিয়াশীল

বৃষ্টি থামতেই বের হয়ে পড়ি। বাতাস বেশ, ঝড় ও গাছেদের দোলন থামছে না।

পুরোটা প্রতিবেশ জনমানবহীন তবে নির্জন নয়, এক লক্ষ ব্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং করছে। ঘাসগুলো জলে ডোবা, ড্রেনগুলো টই টই।

ব্যাঙেদের ফুর্তি, উৎসব, না আশংকার কোলাহল বুঝে উঠতে পারি না কিন্তু

ওরা সোচ্চার।

বলি, রাখাল, ১৯৯১ সালে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা বিষদাঁতে কামড় দিয়ে বসেছিল, ক্ষমতা ছাড়বে না। ২০১১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাটকের কথা মনে আছে? তোমার মত কত কর্মি মার খেল, মারা গেল, শেষ পর্যন্ত ওরা ক্ষমতা ছাড়লোও। কিছু কিছু নেতা-নেত্রীর ভাগ্য বদলালো, কিছু ফুলে কলা নয়, বাওবাব গাছ হলো। কিন্তু তোমার মত যারা তাদের কিছুই হলো না। তোমার পেটে ভাত ছিলো না, আজও নেই, যে মারা গেল সে আর ফিরলো না, যে পঙ্গু হল, সে কোনো ভাতাও পেলো না।

২০২৩ সালে তোমরা আবার পথে নেমেছো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্তদের হঠাতে হবে, ২০১১ সালে যাদের টেনে নামিয়েছিলে তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই বৃত্ত, শেষ নেই, শুরু নেই। কিন্তু বদলাবে কী? হয় তুমি পঙ্গু হবে, নয় মরবে, নয় টুটিতে ক্ষমতার হাতচাপা অবস্থায় নগন্য বেঁচে থাকবে।

ব়্যাব রদ হবে?

ডিজিটাল আইন?

জিনিসের দাম কমবে?

দুর্বৃত্ত সবল থেকে দুর্বল হবে?

পুলিশ ক্ষমতার হাতে না হয়ে তোমার হবে?

“টাকা দিলে দেন, নাইলে নামাজ পড়তে যাই”- এই মানুষগুলো ঘুষ ছাড়াই কাজ করে দেবে?

মসজিদের মাইকে মাইকে নারী ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ও ১৯৭১ সালের গণহত্যার ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ হবে? নাকি সবই চলবে, অবিকল একইভাবে, আরও বিকট নগ্নতায়….?

“আপনি বর্তমানের ক্ষমতাসীনদের তোষণ করে প্রতিক্রিয়াশীলের মত কথা বলছেন।”

তোমার বয়সে আমি ঠিক এ কথাটিই বলেছিলাম অন্য একজন প্রতিক্রিয়াশীলকে, কারণ আমিও রক্ত টগবগে প্রগতিশীল ছিলাম। তিনি বলেছিলেন, মিছিলে মরে লাভ নেই, ১৯৭১ এ অনেক মরেছে, অনেক নারী সম্ভ্রম দিয়েছে…অথচ বিজয়ী হয়েছে পরাজিতরাই….তারাই ক্ষমতায়, তারাই মসজিদে….নিজে নিজে আসেনি, বিজয়ীরা এনে বসিয়েছে।

গ্যালিলিও অন্যায়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করে বেঁচে ছিলেন এবং জোয়ার্দিনো ব্রুনো কম্প্রোমাইজ না করে জ্যান্ত দগ্ধ হয়েছিলেন। লোর্কা বলেছিলেন, অত চিন্তা করার কী আছে, কবিকে কেউ হত্যা করে না।

তুমি বরং লেখো, সৃষ্টি করো, কিছু হবেই এমন কোনো কথা নেই, তবে হতেও পারে। হলে থাকবে, না হলে নেই। তোমার কোনো দল নেই, ক্ষমতায় বা ক্ষমতার বাইরে তোমার কোনো মিত্র নেই, তুমি একা, তুমি লেখক…কারুর নিশান বরদার হয়ো না, ওরা তোমার চেয়ে অনেক বেশি চালাক।

আমি থুক করে থুথু ফেলেছিলাম ঘৃণায়।

জানো রাখাল, আজ এতকাল পরে, তা-ই গায়ে এসে লাগলো।

৮/৩০/২৩

 

মা

গল্পটি কবের কেউ জানে না। ঘন আফ্রিকার জঙ্গলে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। খাদ্য নেই, প্রাণীরা না খেয়ে মরছে, অথবা বন ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলে তাবু গেড়েছে একদল মানুষ। অন্য রকম মানুষ। সারা জীবন যে কালো মানুষেরা ছিল এখানে, এরা তেমন নয়, অন্যরকম। হাতে তাদের বন্দুক এবং কী যেন খুঁজে বেড়ায় বনে বনে। একটি মা-বানর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে; হিরা, হিরা খোঁজে ওরা। খাদ্য নেই। পেটে ক্ষুধা। যেহেতু ক্ষুধা ভয়ের চেয়ে তীব্র, এগিয়ে যায় সে ওদের কাছে। মুঠো খুলে দেখায়। সেখানে চকচক করছে বিশাল হিরার টুকরো। ওরা খুশি হয়। কী যে খুশি! ফেরেশতাদের মত আদর করে, খেতে দেয় মা-বানর ও তার শিশুকে, অনেক অনেক খাদ্য। ওরা বলে, যখনই হিরা নিয়ে আসবে, খাদ্য পাবে। যদিও ওরা বানর নয়, ওদের কথা প্রত্যুষের আকাশের মতই স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য। মা-বানর তার শিশুকে নিয়ে বাঁচার পথ পায়। ওরা হিরা খুঁজে বেড়ায়। কখনও পায়, কখনও পায় না।পেলে খাদ্য জোটে, না পেলে অনাহারে থাকে। বেশ কিছুদিন ওরা কোনো হিরা খুঁজে পায়নি। বহুদিন খাদ্য নেই। মা-বানর শুয়ে আছে দুর্বল। ওঠারও বল নেই। এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে বিদুরের খুদ যেটুকু খাদ্য সে জোগাড় করতে পেরেছে শিশুকেই দিয়েছে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে রোদ উঠেছে। চিক চিক করছে দিন। জলে ভেজা বাতাস। ভেজা চোখের মত। তপ্ত দিনের নিদাঘ কমে এলেও পেটের হুতাশন ও ক্লান্তিতে নিভু নিভু চেতন। শিশু বানর ছুটে আসে, “মা, মা হিরা!” মা ওঠে, টলতে টলতে এগিয়ে যায় শিশুর পিছু পিছু। ফুল আর ফুল পথে। মৌমাছি উড়ছে, রামধনুর সাঁকো পার হচ্ছে ভাস্কর। পাখি আর ডাকে না, পালিয়ে গেছে ক্ষুধায়। ফুলেরা তবু মাথা নাড়ায়। শিশু তর্জনি উঁচিয়ে দেখায় ঘন সবুজ কচু পাতার জঙ্গল, হাতির কানের মত বড় বড় পাতা। তাদের ওপরে রোদে ঝক ঝক করছে টুকরো টুকরো হিরা। তাদের দ্যুতি এসে পড়েছে শিশুটির হাসিমুখে। মা-বানর তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ।

অক্টোবর ৩, ২০১৮

 

অভিকর্ষ

তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি যখন নারায়নগঞ্জে যাই, বাসটা চাষাঢ়ায় পৌঁছালেই বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে শুরু করে। বাপের বাড়ি তো! তোমাকে বোঝাতে পারবো না। লক্ষ্যা নদীর পূর্বপারে আমার জন্ম। সেখানে ফাঁকা ফাঁকা মাঠ। আর শরতে কাশের ফুল আর ফুল। যেন মাঠ নয়, সাদা মেঘের আকাশ। চার বছর বয়েসে নদীর এপারে চলে আসি। থানার পুকুরপাড়ে বড় হয়েছি, সেখান থেকেই মর্গ্যান স্কুলে যেতাম। স্কুল পাশ করার পরে বিয়ে হয়ে গেলো, ঢাকায় চলে গেলাম। কলেজ শেষ করে ঢাকা ভার্সিটিতে দর্শনে মাস্টার্স করেছি। স্বামী আর্মিতে। এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় বদলি হয়। সারাটা দেশ টৈ টৈ করেছি। কোথাও থিতু হতে পারি নি। কোথাও নিজেকে ঘরে মনে হয় নি। একমাত্র নারায়নগঞ্জই স্থায়ী আমার মনে। মা-বাবা সেখানেই শুয়ে আছেন তো! এখন বিদেশে থাকি। অথচ মনটা কোথায় জানো? একবার ঢাকায় বাসে চড়ে বসেছি, কোথাও যাবো। দেখি পাশেই নারায়নগঞ্জের বাস। মনটা খুশিতে নেচে ওঠে ময়নার মত। স্বামীকে বলি, “দেখো দেখো নারায়গঞ্জের বাস!” “নারায়নগঞ্জের বাস তো কী হয়েছে?”-মেজর সাহেব শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। আমি থতমত খেয়ে কুকড়ে যাই, না মানে … বাসটা… ঢোক গিলি.. কথা খুঁজে পাই না…. …..নারায়নগঞ্জ যাচ্ছে তো!

সেপ্টেম্বর ১,২০১৮

=====================