You are currently viewing তারকাঁটায় জীবন > মেহনাজ মুস্তারিন

তারকাঁটায় জীবন > মেহনাজ মুস্তারিন

তারকাঁটায় জীবন

মেহনাজ মুস্তারিন

 

তিন দিন পরে ময়েজের খোঁজ পাওয়া গেল। লাশ হয়ে পড়ে ছিল সীমান্তের ওপারে। বিএসএফের লোকেরা ভারতীয় মনে করে নিয়ে গিয়েছিল তাদের ক্যাম্পে। বহু দেনদরবার করে সেই লাশ আনা হয়েছে গ্রামে। কাদামাখা লাশ, এখানে ওখানে পচন ধরে গেছে, তবু তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামের মানুষ। ছোট্ট উঠোনে তিলঠাঁই জায়গা নাই। গিজগিজ করছে মাথা। এতো মানুষ এ গ্রাম ও গ্রাম থেকে এসেছে। সবার চোখ মুখ কুচিয়ে আছে ব্যাথায়। যে যেমন করে পেরেছে নাক মুখ ঢেকে রেখেছে। উৎকট গন্ধ বাড়িজুড়ে। এই এত যত্নের শরীরটায় যখন প্রাণ থাকে না, তখন কেমন অকেজো অচেনা লাগে। সময়মত কবরস্ত করতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

ছোট সংসার ছিল ময়েজের, তবু চালাতে হিমশিম খেতে হতো। সংসারে খাটনেদার বলতে একমাত্র সেই। বছর দুই আগে স্ত্রী মনোয়ারার পিঠে ফোড়া হলো। সেটা নিয়ে কম নাতিজা হয়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটাছুটি। শেষে মেডিকেলে গিয়ে অপারেশন করতে হলো। কষ্ট করে যেটুকু জমাতে পারা যায় একটা বিপদ এলে মুহূর্তেই শেষ। দিন দিন চিকিৎসার খরচ বেড়েই চলেছে। ডাক্তারের কাছে ধনী-গরীব বলে কিছু নাই। কথাতো কিছু শোনেই না, কাগজে গজ গজ করে কী সব লিখে দেয়। সেগুলো কিনতে গাদা গাদা টাকা চলে যায়। মনোয়ারা কয়েকটা ছাগল পালতো, বিপদের সময় সেগুলো বিক্রি করে দিতে হলো। সেখানেই কি আসল দাম পাওয়া গেল! ওরাও জানে এই মোক্ষম সময় ব্যাটা বিপদে পড়েছে, কাজেই তাকে ঠকাতে হবে। পদে পদে বিপদ গরিব মানুষদের। যাই হোক, শেষতক ফোঁড়া অপারেশন করা হলেও ঠিকমতো ভালো আর হলো না, সেলাইয়ের দাগ থেকে এখনও মাঝে মধ্যে রক্ত পড়ে।

ঘরে দুটো ছানা পোনা। অন্যের জমিতে কাজ করে কতটুকুই-বা আয় হয়, তবু তা দিয়েই কোন রকমে চলে সংসার। তো এই হিমশিম অবস্থা ময়েজ আর টানতে পারছিল না। দিন দিন জিনিস পত্রের দাম যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, নাগালের বাইরে সবকিছু, গরিব মানুষজন কীভাবে দিন কাটাচ্ছে দেখবার যেন কেউ নাই। কে শোনে কার কথা, কে কার পাশে এসে দাঁড়ায়!

তো ময়েজ একদিন মনোয়ারাকে বোঝালো বিয়ের সময় তাকে যে দু-আনি সোনা  দেয়া হয়েছিল, সেটা বিক্রি করে এবং তার সাথে হাওলাত করে কিছু টাকা যোগ করলে এই বাজারে একটা গরু কেনা সম্ভব। সেটা যদি  সম্ভব হয়, তাহলে জমির কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে ওদের পালতে পারবে, এমাঠে ওমাঠে ঘুরেই বড় হয়ে যাবে গরুর বাচ্চা। তারপর যদি পাল বাড়ানো যায় ভালো, নইলে ওটাকে বিক্রি করলেও দুটো ছোট বাচ্চা কেনার টাকা হয়ে যাবে। সংসারের রোজগার না বাড়াতে পারলে হিমশিম অবস্থা আর সামলানো যাচ্ছে না। তো স্বামী স্ত্রী বুদ্ধি করে সেই কাজটাই করলো। ময়েজ সারাদিন মাঠে কাজ করে, ফাঁকে ফুকে গরুকেও আগলে রাখে, তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঘরে ফিরে আসে। বড় স্বপ্ন ওদের গরুটাকে ঘিরে। সিঁদুরের মত তার রং; অনেক ভেবে ভেবে ময়েজের নয় বছরের মেয়ে পারুল বাপের গলা ধরে ঝুলে পড়ে কানের কাছে মুখ এনে বলল, ”বাবা, গরুর নাম লালুই রাখ্যব, না করতে প্যরবা না!”

সেই নামই টিকে গেল। কান দুটো বেশ লম্বা, সুঠাম তার দেহ। বেশ চোখে পড়ার মতো। ময়েজের ছেলে মেয়ে দুজনেই বেশ যত্নআত্তি করে। তাতে করে লালুইকে নিয়ে খাটুনি কিছুটা কম হল ময়েজের। কয়েক মাস যেতে না যেতেই গায়ে-গতরে সেয়ানা হয়ে উঠলে ময়েজ ঠিক করলো, লালুইকে কোরবানির সময় বিক্রি করে দেয়া হবে। ঈদের সময়, ভালোই দাম পাওয়া যাবে। সেটা শুনে ময়েজের ছেলে মেয়ের সেকি মন খারাপ। বাড়িতে পোষা জীবজন্তুর প্রতি যে মায়া পড়ে যায়। এরা রীতিমতো বাড়ির সদস্য বনে যায়, সেটা ময়েজকে কে বুঝাবে?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পশ্চিমের আকাশ কেমন যেন ঘোলাটে। বৃষ্টি হবে কি? ’এখনো ক্যান ফিরছে না রে ?’- ভাবতে ভাবতে এবং আকাশের রঙ দেখে অস্থির হয়ে ওঠে মনোয়ারা। ছেলেটাকে ডেকে বলল, ”অ মতিন, লাটিম খেলা বন্ধ কর তো! তোর বাপ আসে না ক্যানরে ! কুনঠে গেল? এমন তো করে নারে । এতক্ষণে কক্ষন  ফির‍্যা আসে।” বলতে বলতে মতিনকে তাগাদা দিতে থাকে, ”যা না দ্যাখ নারে , একটু আগিয়ে যা । এখনো আসল্যো না ক্যান?”

আজ কালকার ছেলেপুলেদের কোন কিছুতে ভাবান্তর নাই। মনোয়ারা শুনতে পায় ছেলে মতিনের গলা,  ”আরে  এত আকুবাকু করো নাতো মা। দ্যাখ চায়ের দোকানে ঠিক আড্ডায় মইজ্যা গেলছে।” আকাশ না, তার দৃষ্টিপথ আটকে আছে ঘুরন্ত লাটিমের দিকে।

”কী বুলছিস কোনদিন দ্যাখ্যাছিস দোকানে ব্যসা ঘন্টা ধইর‍্যা আড্ডা দিতে? পাগল হয়াছিস বাছা  যা এক্ষুণি।” বলে তাগাদা দেয় মনোয়ারা।

মার কথা ফেলতে না পেরে মতিন বের হলো বাপের খোঁজে। মাঠ ময়দান চায়ের দোকান সব জায়গায় গেল বাপের খোঁজে। ”এড্যাতো দেখি মহা বিপদের কথা।” মতিন প্রথমবারের মতো বিভ্রান্তবোধ করে। খানিকটা চিন্তায় পড়ে যায় সে। কেউ বলছে, সকালে দেখেছি, তো কেও আবার বলছে, দেখলাম তো মাঠে কাজ করতে।  উপায়ন্তর না দেখে সে ছুটে গেল পাশের গ্রামে।

ময়েজকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ততক্ষণে সেটা চাওর হয়ে গেছে। মতিনের চোখে মুখে চিন্তার রেখা। এতক্ষণে সে ভয় পেয়েছে। পাশের গ্রামেও কোন খবর পাওয়া গেল না। উপায়ান্তর না দেখে চেয়ারম্যানের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিল সে। সরাসরি তো যাওয়া যায় না, প্রথমে তাই সে গেল তার শিক্ষকের কাছে। বেলাল স্যার। তার মনে হলো, সাদামাটা এই মানুষটা একটা ভালো পরামর্শ দিতে পারবে। তো কাছে যেতেই বেলাল স্যার মতিনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ”আরে আমি কিছুক্ষণ আগেই শুনলাম তর ব্যাপে নাকী গরু লিয়া উধাও। তো মোটেও চিন্তা করবি  না, কাছে পিঠে কোথাও আছে দ্যাখগা ”

”না, স্যার, অনেক খুজল্যাম কুনঠেও  পাছি না।” বলে বেলাল স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মতিন।

”ভালো কইরা খুঁইজা দেখেছিস তো?” বলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে বেলাল স্যার।

রাত তখন প্রায় সাড়ে নয়। এত রাতে তার বাপ কাছে পিঠে কোথায় থাকবে? আর উধাও শব্দটাও পছন্দ হলো না মতিনের। এই প্রথম শিক্ষকের কথা তার মনে ধরলো না; কিন্তু উপায় কী। মতিন ছোট হলেও বুদ্ধিসুদ্ধিতে খাটো না। সে জানে, এসময় গুরুজনদের কথা শুনতে হবে। মতিন বলল, ”স্যার! চেয়ারম্যানকে বলতে হবে না? যদি থানায় য্যাইতে হয়? স্যার! আপনি আমার সাথে থ্যকবেন, না হলে কেউ পাত্তা দিবে না।”

বেলাল স্যার গভীরদৃষ্টিতে মতিনের দিকে তাকালো। এই বয়সেই কত বুদ্ধি! নিজের কথায় ফিরে গেলেন তিনি। বললেন, “তা অবশ্য বুদ্ধিমানের কথা বুলাছিস।” বলে ঘরের দিকে রওনা দিতে দিতে আগের কথার সাথে যুক্ত করলেন, ”দাঁড়া, জামাডা পইর‍্যা আসি।”

প্রথমে চেয়ারম্যানের কাছে, তারপর এলাকার বেশকিছু লোকজন সহ বিজিবি সীমান্ত ফাঁড়ি ও পরশুরাম থানায় পুলিশকে জানানো হল। ওরা দায়িত্ব নিল, যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে ময়েজকে। কিন্তু, কোন সাধারণ ডায়েরি লিখতে রাজি হলো না।

রাতটা বেশ থমথমে। কারো মুখে কথা নাই। ঘুম নাই কারো চোখে। আশপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। গোয়াল ঘর আজ শূন্য। বাড়ির মানুষটা আজ ঘরে ফিরেনি। একটা মানুষ আর তাকে ঘিরে অসীম শূন্যতা। ময়েজের ছোট মেয়ে পারুল, কীই-বা বোঝে, তবু ছটপট করছে। চোখজুড়ে ঘুম যেন ভেঙে আসছে তার। কিন্তু, কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না। ছোট্ট হৃদয়ে কষ্টের সময়গুলো যেন জায়গা করে নিচ্ছে। ভাবছে, কী হতে পারে? আব্বা কী হারিয়ে গেল! যে ভাবে হারিয়ে যায় গরু-ছাগল। কেউ ধরে নিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। মাকে বলেনি, ভাইকেও বলেনি সেকথা। আচ্ছা আব্বা যদি ফিরে না আসে তাহলে? আমরা কি তিনবেলা ভাত পাবো না? ইশকুলে যাওয়া হবে না আর? এমন নানান এলোমেলো ভাবনা একসময় পারুলকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। জেগে থাকে তখনো মা -ছেলে।

মনোয়ারার মাথায় কিছুই আসছে না। ছেলে বারবার বলে যাচ্ছে মা ঘুমাও। দেখ কাল সকালেই একটা খোঁজ পাওয়া যাবে। থানায় তো বলা হলো দেখ ওরা ঠিক খুঁজে বের করবে।

মাকে সান্ত্বনা দিলে কী হবে, মতিন নিজে কিন্তু গভীর চিন্তায় আটকে গেছে। কী ঘটেছে আব্বার সাথে? খারাপ কিছু না তো? সীমান্তে অহরহ নানা ঘটনা ঘটছে। বিএসএফ-এর গুলিতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো ছারপোকার মতো মারা যাচ্ছে। আচ্ছা গুলি করে মানুষ মেরে কী লাভ হয় তাদের? ওরা কি ভয় দেখাতে চায়! না কি ক্ষমতা? ছোট মাথায় এত বিশাল চিন্তা কীভাবে এলো, বুঝতে পারে না মতিন। মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। ভোর হলো বোধহয়। মতিন পাশের ঘরের দরজাটা আস্তে করে খুলে মাকে দেখার চেষ্টা করলো। মা ঘুমিয়ে আছে। ঘুমাক। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মতিন অবাক হলো। মাকে কোনদিন এভাবে দেখেনি সে। শরীরটা অনেক ভেঙে গেছে। শ্যামলা মিষ্টি চেহারায় কত মায়া লুকানো। মতিনের মনে প্রশ্ন জাগে, কষ্টের কি রঙ থাকে? বাংলার শিক্ষক ক্লাসে তাই বলেন। সেই রঙের মধ্যে হাসি লুকিয়ে থাকে। মতিন একটু হাসলো।

সকাল হতেই ময়েজের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। কত রকম কথা। চায়ের স্টলে গল্পের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো ময়েজ। সাথে গরু। দুজনেই লাপাত্তা। আলোচনা গরু থেকে বারবার ময়েজে ফিরে আসে। সেখানে, শোক করছে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ মানুষের মুখে চিন্তার ছাপ। উত্তর মথুরা গ্রামের ময়েজ ছিল ধীর স্থির শান্ত স্বভাবের মানুষ। কাওকে বড় করে কথা বলেনি কোনদিন। বরং বিনা স্বার্থে যে যা বলেছে, নিজের কাজ ফেলে রেখে হলেও, সেটা করে দিতো। গ্রামের মেয়েরাও বেশ ভালো মানুষ বলেই জানতো ময়েজকে। মুখের ডাকটাও ছিল খুব মিষ্টি। এইসব নানা বিষয় চায়ের দোকানের খরিদ্দারদের ব্যস্ত করে রাখে দিনভর।

এর মধ্যে দুই দিন কেটে গেছে। এখনো খোঁজ মেলেনি ময়েজের। বাড়ির মানুষগুলো কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। যে মানুষটা রোজগারের একমাত্র অবলম্বন তাকে ছাড়া সংসারে সবাই কেমন থাকবে, খুব সহজেই অনুমান করা যায়। ভয়াবহ সময়গুলো নিয়ে তিনদিনেও থানার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের কোন মাথাব্যথা নাই। কী অসহায় সাধারণ মানুষ। কে আছে তাদের পাশে? আইন রাষ্ট্র সরকার সমাজ– কে আছে? অসহায় এই পরিবারের জন্য ভাববে কে?

তৃতীয় দিনের সকাল বেলা। বাড়ির মানুষগুলোর চোখে এখন  হতাশার ভোর। চোখ খুলেই ভাবতে হয় দিনটা কীভাবে কাটবে। একদিকে পেটের চিন্তা অপর দিকে মানুষটার একটা খোঁজ পাওয়া। মনোয়ারা দিশেহারা। শারীরিকভাবে সুস্থ হলে ঠিকই কাজে বেরিয়ে পড়তো। এখন ছেলেটাই ভরসা। গতকাল থেকে কাজের সন্ধানে বের হচ্ছে মতিন। কারো জমিতে কাজ পাওয়া গেলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে! কিসের লেখাপড়া, কীসের কী? কাজের খোঁজে বের হবে, এমন সময় পাশের গ্রামের মতলুব চাচা এসে হাজির। ধীরে স্থির হয়ে মতিনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “কাঁটাতারের ওপাশে পইড়্যা ছিল তিন দিন ধইর‍্যা একটা লাশ। আজ বিএসএফ আস্যা লিয়া  গেল । বয়স শুনলাম চল্লিশ হবে । গ্রামের মানুষ বুলছে  ওডা নাকী  তোর  বাপের লাশ।”

মতিন চমকে ওঠে। বাবার লাশ! মতিনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে মতলুব বলে ওঠে, “ওপারে কীভাবে গেল, এড়াই জানত্যে  ইচ্ছা করছে তোর তাই না ?” মতিন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে মতলুব বলে যায় সেদিনের কথা। “শোন বাপ , আমি নিজে দেখি নাই, গ্রামের কয়েকজন লোক বুলা  বেড়াচ্ছে, তোদের গরুড়া নাকি ঘাস খ্যাতে খ্যাতে চ্যালা  গেলছিল ওপারে।”

“গরু! ওইপারে!” বিস্ময় মতিনের চোখে। “কাঁটাতারের বেড়া পার হলো ক্যামন  ক্যোরা?”

“চোরাচালান  যারা করে  শুনাছি যে দল, রাতের বেলা নাকি কাঁটাতারের বড় একটা অংশ ক্যাটা ফেলে ।” জবাব দেয় মতলুব। “তো সেই ফাঁক ফিয়া গরু নাকি চল্যা  গেলছিল অনেক ভেতরে। তোর আব্বা যখন দ্যেখাছে গরু ওপারে, সাথে সাথে  মারাছে দৌড়।”

মতলুব চাচার গল্প বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না মতিনের। তবু তো খোঁজ পাওয়া গেল। সাথে সাথেই সে দৌড়ে গেল বেলাল স্যারের কাছে, সেখান থেকে চেয়ারম্যান হয়ে সোজা থানায়। ওপারে লাশ পড়ে থাকার খবরটা থানায় এসেছিল আরো আগে, বেলাল মাস্টার তারই খোঁজ নিতে এসেছে।

“তা মাস্টার মশাই! বলছেন লাশ ওপারে?” বলে ওসি সাহেব সিগারেটে লম্বা করে টান দিলেন। “এখানে এক থানার লাশ আরেক থানার পুলিশ টাচ করতে পারে না। আর এটা তো বাংলাদেশের বাইরে। আমরা কী করব? লাশ আনতে চাইলে বিজিবির কাছে যান।”

“পরিচয়?” বলে গেটেই ওদের আটকে দেয় বিজিবির এক জওয়ান।

মতিন জবাব দিতে যাচ্ছিল, চেয়ারম্যান তাকে থামিয়ে দেয়। বাচ্চা ছেলে, কী বলতে কী বলে! বিজিবির ক্যাম্পে আসা তার কাছে নতুন না। মাঝেমধ্যেই আসতে হয়। সীমান্ত এলাকার মানুষজনের হুস কম। আরে বাবা, ঘুরবি ফিরবি বাজার না ফুর্তি করবি, নিজ দেশেই কর, ওদিকে যাওয়ার এত হাউস কেন? এই শালাদের পাছায় কষে লাত্থি মারতে পারলে ঠিক হয়। মনে মনে ভাবলেও সেটা করতে পারেন না তিনি। ভোটের সময় শালাদের পাছায় তেল জমে যাবে, একটাকে মারলে চৌদ্দশালা রাগ করবে। মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখে চেয়ারম্যান তার পরিচয় দেয়। সাথে এই তথ্য দিতে ভুল করে না যে, এই দেশের এক নাগরিকের লাশ তুলে নিয়ে গেছে ইন্ডিয়ান বর্ডার গার্ডের লোকেরা।

লে. কর্ণেল জামিল। বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার। সীমান্তে চোরাচালান পরিস্থিতি নিয়ে তৈরী করা একটা প্রতিবেদনে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। আজই পাঠাতে হবে। আগামীকাল ঢাকায় বড় কর্তাদের মিটিং, ভারত থেকে বিএসএফের চীফ এসেছেন, সবাই আশা করছে সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ করার ঘোষণা আসবে সেই মিটিং থেকে। বিজিবির পক্ষ থেকে গুলি হয় না তেমন, কিন্তু বিএসএফ? মাঝে মধ্যেই গুলি না করলে তাদের হাত যেন নিশপিশ করে! আরে বাবা! বিজিবির ট্রেনিং হলো মিলিটারি পর্যায়ের, গুলি ব্যর্থ হলে সৈনিকরা মন খারাপ করে। তো বিএসএফ? তোদেরকে তো মানুষ মারার ট্রেনিং দেয়া হয় না, তারপরও এত মানুষ মারিস কেন? তুলশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে চিনতে অসুবিধা হয়নি কর্ণেল জামিলের। যদিও জানেন, ঝামেলা ছাড়া এই মানুষগুলো আসে না। তা, আজ কী ঝামেলা?

“স্যার! শুন্যাছেন!” বলে চেয়ারম্যান। দাঁড়িয়ে কথা বলছিল চেয়ারম্যান, কর্ণেল জামিল তাকে বসে কথা বলার ইংগিত দিলে একটা চেয়ার টেনে মুখটাকে টেবিলের কাছে এনে বলতে থাকে, “আবার গুলি কর‍্যাছে  শুয়োরের বাচ্চারা। চোর টোর না, একবারে অসহায় একটা মানুষকে ম্যারা ফ্যলেছে!”

”নিরীহ!” বলে চেয়ারম্যানকে থামিয়ে দেন কর্ণেল জামিল। “নিরীহ মানুষ বর্ডারের ওপারে গেছে কেন? আর, আমার সামনে কাওকে গালি দেবেন না কথাটা কতবার বলতে হবে?”

”তুই বুল!” বলে মতিনকে ইংগিত করে চেয়ারম্যান। “তোর বাপ কি চোর  না ডাকাত?” মতিন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, যার অর্থ, না। মতিনের সমর্থন পেয়ে চেয়ারম্যানের গলার আওয়াজ বেড়ে যায়। “শোনেন স্যার! আপনারা মিলিটারি ট্রেনিং নিয়াছেন যুদ্ধ করব্যেন, মানুষ ম্যারবেন, ভালো কথা, তাই ব্যুলা  একটা গরু ঘাস খ্যাতে খ্যাতে ওপারডাই  চল্যা  গেলে আর তাকে ফির‍্যা আনা যাবে না? ঠিক আছে ভুল করে গেলছে। তাই বলে বলা নাই কওয়া নাই, গুলি করে ম্যারা ফেলতে হবে? এটা কেমন কথা বুলেন ?”

”থামেন! থামেন!” বলেন কর্নেল জামিল। “লেকচার দেয়ার সুযোগ পেলে সবাই বড় বড় লেকচার দেয়। কাজের কথায় আসেন। যে মারা গেছে তার আইডি এনেছেন?” মতিন তার পকেট থেকে বাপের ছবিযুক্ত আইডি বের করলে ছোঁ মেরে সেটাকে নিয়ে কর্ণেল জামিলের দিকে ঠেলে দেয় চেয়ারম্যান। উল্টেপাল্টে আইডিটাকে দেখে কর্ণেল জামিল বলেন, “ঠিক আছে, বিকালের দিকে একবার খোঁজ নিয়েন, দেখা যাক।” বলে ফিরে যাওয়ার পথ দেখালে মতিনকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যান চলে আসে গ্রামে। এসেই ঘোষণা দিয়ে বসে, “আজ রাতের মধ্যেই লাশ আসবে।”

রাতের মধ্যে লাশ আসবে, কথাটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় না। সবাই চেয়ারম্যানের কেরামতিতে অবাক। তবে, গ্রামের সকলেই যে সেই কথা বিশ্বাস করেছে, সেটা বলা শক্ত। চায়ের স্টলে আড্ডা দেয়া মানুষগুলো দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মনোয়ারা বেগমের সমস্যাটা অন্যখানে, তার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে তার স্বামী মারা গেছে। জলজ্যান্ত মানুষ সকালবেলা জমিতে গেল, তারপর নিখোঁজ না হয় মানা যায়, তাই বলে লাশ! সংসারের অভাব দূর করতে কত কষ্ট করেছে লোকটা। স্ত্রী হয়ে সে তো কিছুই করতে পারে নাই। আহারে! সব বিক্রি করে গরুটা কেনা হলো।  ভাগ্য কোথায় নিয়ে গেলো? “ও মতিনের বাপ! কুন্ঠে  গ্যালা? এই বাচ্চাকাচ্চাদের আমার কাছে র‍্যাখা কোথায় গ্যালা? ও মতিনের বাপ!” বলতে বলতে মুর্চ্ছা যায় মনোয়ারা।

মনোয়ারার বিলাপে ভারি হয়ে আসছে প্রকৃতি। সন্ধ্যার কিছু আগে লাশ আসে গ্রামে। কর্ণেল জামিল নিজেই এসেছে লাশের সাথে। লাশের দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। বাড়ি ভর্তি মানুষ! কেউ লাশের দিকে কেউ-বা কর্ণেল জামিল আর তার বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স্ক কে একজন মন্তব্য করেছে, এই লাশ দাফনের দরকার নাই। শহীদ হয়েছে ময়েজ। তাই নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে। কেউ বলছে শহীদ, কেউ বলছে, না হয়নি; ময়েজ তো যুদ্ধ করতে গিয়ে মরেনি। শেষে ইমাম সাহেব এসে বলেছে, যাকে তাকে শহীদ বানানো ইসলাম-সম্মত না। তখন লাশ গোসল দেয়ার কাজ শুরু হয়ে যায় কলপাড়ে, কয়েকটা শাড়ি দিয়ে একটা কোনা ঘিরে সেখানেই ময়েজকে শেষ গোসল করানোর কাজ চলতে থাকে।

শহীদ-সংক্রান্ত বিতর্ক কর্ণেল জামিলের কানেও পৌঁছে। চোখ কান খোলা, না পৌঁছে উপায় আছে? লাশের সাথে সাধারণত তিনি আসেন না। আজ এসেছেন, কেননা ঢাকায় বড় কর্তাদের মিটিং বসছে আগামীকাল। আসার আগে দু-একটা পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিদের খবর দিতে ভুল করেননি। নিশ্চয় তাঁর এই গ্রামে আসার খবর সংবাদপত্র মারফৎ উপর মহলে পৌঁছে যাবে। ডিজি সাহেবের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেটা নিয়ে মনে মনে হিসেব করছেন তিনি। সীমান্তে লাশ দেখলে কর্ণেল জামিলের কেন জানি ঘুরেফিরে ভ্যাটিয়ারিতে ট্রেনিংএর সময় শোনা কথাগুলো মনে পড়ে। ”মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছেন মরার জন্য, যুদ্ধ করতে গিয়ে জানের ভয়ে পালাতে চাইলে এখনও সময় আছে, বাড়ি ফিরে যান।” কর্ণেল জামিল বাড়ি ফিরে যায়নি। মৃত্যুর প্রস্তুতি তার জীবনভর। দেশের জন্য মৃত্যু, তার চেয়ে বড় কোন কর্ম হতেই পারে না। ফিরে যাবে, হঠাৎ কী মনে করে কলপাড়ে গেলেন কর্ণেল জামিল, তাঁর দৃষ্টি চৌকির উপর চিৎ করে শোয়ানো ময়েজের দিকে, তার নাকের ভেতর থেকে তখন একটা পোকা বের হয়ে আসছিল। কর্ণেল জামিলের মনে হলো ময়েজের গলিত লাশ যেন বলছে, “যুদ্ধ নয়, ছারপোকার মত খুব সহজ ছিল আমার মৃত্যু।

ডিসেম্বর ১১, ২০২২।

***************************