You are currently viewing ডাকঘর মহিষবাথান>  শিল্পী নাজনীন

ডাকঘর মহিষবাথান> শিল্পী নাজনীন

ডাকঘর মহিষবাথান

শিল্পী নাজনীন

 

ডাকবাক্সটা ক্লান্তপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, একা। সে কি প্রতীক্ষায় আছে আজও, থাকে? তারও কি বুকের ভেতর ঢেউ ভাঙে কোনো অনন্ত শূন্যতা, বাজে অগনন হাহাকার? শূন্য উদরে কি আজও সে যাঞ্চা করে সেইসব নীল-সাদা খাম, হলুদ পোস্টকার্ড, হলুদ হলুদ সেই খামের মিছিল? হয়ত। অদূরে অযত্নে, অবহেলায় ব্যাজার, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে টিনের মরচে পড়া, জীর্ণ ডাকঘর। এই তীব্র, প্রচণ্ড দাবদাহে তার শরীর থেকে ভাপ উঠছে গরম, মরীচিকা নাচছে তার মাথার ওপর রোদ্দুরের ছড়িয়ে দেয়া পেখম জুড়ে। আরো দূরে, ধোকড়াকোল স্কুলের সবুজ চত্বরে বহুকালের পুরোনো সেই কৃষ্ণচূড়াটা শরীর জুড়ে থৈ থৈ লালের ছাতা মেলে দিয়ে রোদে পুড়ছে অবিরাম, আগুন লেগেছে তার শাখায় শাখায়। কৃষ্ণচূড়ার গা ঘেঁষে ইংরেজি এল অক্ষরের আকার নিয়ে সেই কোন আদ্যিকাল থেকে রোদ-জল-বর্ষায় পুড়ছে, ভিজছে চিরচেনা সেই স্কুলটা। আহা! এই রোদে তারও শরীরে ঝিকিয়ে উঠছে মোহ-মরীচিকা, চৈত্রের ঝাঁঝ। স্মৃতিকাতর মন সেই কোন কৈশোরে নিয়ে থিতু করিয়ে দিতে চায় স্কুলটাকেও, করাতে চায় অতীত অবগাহন!

এই ডাকবাক্সটার শরীরে ছিল তখন ভরা যৌবন! প্রতিদিন তার উদর উপচে পড়ত নীল-সাদা-হলুদ অগুনতি খাম আর হলুদ-রঙা পোস্টকার্ডে। তাতে প্রেম থাকত, হাসি থাকত, আশা থাকত, স্বপ্ন থাকত, থাকত জীবন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বহুবর্ণিল, ঘোরলাগা সব গল্প। সেসব গল্পে প্রতীক্ষার হা-পিত্যেশ থাকত, বিরহের বিধূরতা থাকত, না পাওয়ার হাহাকার থাকত, থাকত বহু বঞ্চনাময় বিচিত্র কথকতা। আহা। সেইসাথে মিলনের মধুর সুর, পাওয়ার অপার্থিব সুখ আর জীবন উপচে পড়া তৃপ্তির উতল, উছল মিষ্টি সুবাসও কি থাকত না তাতে! থাকত বৈকি! জীবনের সেইসব শান্ত-শীতল, গভীর, থির অনুভূতিগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল কবে! প্রযুক্তির করাল দাবদাহে পদ্মার ঘোলা জলের সাথে সেসবও উড়ে গেল হাওয়ায়, হারিয়ে গেল কালের কালো গর্ভে। স্মৃতিগুলো আজ শুধু মরীচিকা হয়ে নাচে এই মরচে পড়া, জীর্ণ ডাকবাক্সের গায়ে, একলা দাঁড়িয়ে থাকা ডাকঘরের মাথার ওপর, রোদ্দুরের খরতাপে পুড়তে থাকা কৃষ্ণচূড়ার থৈ থৈ লালে, আর এল প্যাটার্নের ধোকড়াকোল স্কুলটার রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সওয়া বহুকালের জীর্ণ-শীর্ণ শরীর ছুঁয়ে।  পদ্মার কোল ঘেঁয়ে বেড়ে ওঠা এই জনপদের মানুষগুলোর দীর্ঘদিনের দুঃখ-সুখের নীরব অংশীদার ডাকবাক্সটা অবহেলায়, অনাদরে ধুঁকছে সেই কবে থেকে! প্রতিদিন যে বুকে জমা হত অসংখ্য নীল-সাদা-হলুদ খাম, তাতে লেখা থাকত বহু মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা, প্রেম, জীবনের লাল-নীল কথকতা, যাতে অবসান ঘটত অসংখ্য মানুষের ব্যাকুল প্রতীক্ষার, সেই বুকে সে এখন ধারণ করে অনন্ত শূন্যতা, সীমাহীন হাহাকার, সেই বুকে সে এখন প্রতীক্ষা করে স্বীয় মৃত্যুর! কিংবা আদতে সে মরে গেছে ঢের আগেই, তার অশরীরী ছায়া হয়ে শুধু সে দাঁড়িয়ে আছে আজও ডাকবাক্সের আদলে।

পোস্টমাস্টার সামছু ভাই কি আছেন এখনো এ তল্লাটে? কে জানে! একসময় এই ডাকঘর ঘিরে বেড়ে ওঠা কত জমাট নাটকের প্রধান কুশীলব যে ছিলেন তিনি! গাঁ-গেরামের লোকজন বড় অভাবি ছিল সেকালে, বেশিরভাগই নিরক্ষর। কস্মিন-কদাচিৎ গোবরে ফোটা পদ্মফুলবৎ এ অঞ্চলের দু’চারজন লেখাপড়া শিখে পাড়ি জমাত শহরে, চাকরি নিয়ে চলে যেত দূরে। অতঃপর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হত তখন এই ডাকঘর। চিঠি। কালে-ভদ্রে মানি-অর্ডার। পোস্ট-মাস্টার সামছু’র নাম তাই এ তল্লাটের ছেলে-বুড়ো সবার মুখে মুখে ফিরত। মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত কিছু গল্পও। শোনা যেত, ঘটনাচক্রে মানি অর্ডার যদি-বা সময়মত পোস্টঅফিসে পৌঁছত এসে, সময়মত সেটা বিলি করা হত কমই। সামান্য বেতনের পোস্টমাস্টার সামছু ভাই সেটা খরচ করে ফেলতেন প্রায়ই। তারপর তার পেছনে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে সেই টাকা তুলতে প্রাপকের পায়ের সুতো ছিঁড়ে যেত প্রায়। ডাকপিয়ন তার লক্করঝক্কর বাইসাইকেল চালিয়ে ভরদুপুরে রোদ-জল-বৃষ্টিতে ভিজে আসত বহুদূরের পথ পেরিয়ে এই অজপাড়াগাঁয়ের পোস্টাফিসে। এসেই কাঁধের ঝোলাটা ঝপাৎ করে ছুড়ে ফেলত সামছু ভাইয়ের সামনে পেতে রাখা এক পা ভাঙা টেবিলটায়। এ তল্লাটের চিঠি, মানি-অর্ডারসহ বয়ে আনা খবরগুলো সেখানে ছড়িয়ে রেখে সে ত্বরিৎগতিতে খুলত ডাকবাক্সের পলকা তালা, তার মধ্যে জমে থাকা চিঠিগুলো সংগ্রহ করে, তাতে সিল লাগিয়ে আবার সে মিলিয়ে যেত ধূলো ওঠা রাস্তার বাঁকে, দৃষ্টিসীমার আড়ালে,  তার বাইসাইকেলের টুংটাং ঘণ্টার আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় হারিয়ে যেত শ্রবণসীমা থেকে। টেবিলে ছড়িয়ে থাকা নীল-সাদা-হলুদ খাম আর পোস্টকার্ডগুলো উপস্থিত তরুণ-যুবাদের হাতে হাতে তুলে দিতেন সামছু ভাই, যে যার বাড়ির নিকটস্থ প্রাপকের বাড়িতে চিঠিগুলো সানন্দে পৌঁছে দিত ধীরে-সুস্থে, যে যার সুবিধামাফিক। চিঠিগুলো অধিকাংশ সময়ই অপঠিত থাকত না আর, পত্রবাহক খাম খুলে পড়ে পত্রবহনের ক্লেশটুকুর সুদাসল আদায় করে নিত অনায়াসে। সে নিয়ে অবশ্য আপত্তি উঠত খুব কমই। অধিকাংশ চিঠিই থাকত নিতান্তই কেজো চিঠি, তেল-নুন-চালের হিশেবে ভরা, কুশল জিজ্ঞাসাভারে ঠাসা। বিপত্তি বাঁধত কমবয়সী, উঠতি যুবাদের কাছে আসা চিঠি খুলে কেউ পড়ে নিলে। প্রেমপত্র হলে লহমায় তার প্রতিটি শব্দ, বাক্য মুখস্থ করে পত্রবাহক সেটা রাষ্ট্র করে দিত পুরো তল্লাটে, অতঃপর সে হাসিমুখে প্রাপকের হাতে সেই আধখোলা খাম আর পঠিত চিঠি পৌঁছে দিত কোনোরকম অপরাধবোধের বালাই না রেখেই। শেষে গ্রামের লোকের মুখে মুখে রটে যেত নানান কল্পিত সব কেচ্ছাকাহিনি, চিঠির দুয়েকটি উল্লেখযোগ্য শব্দ, বাক্য নিয়ে চলত রসালো আলাপ। তাতে বেচারা প্রাপকের জীবন জেরবার হয়ে যেত পুরো, প্রেমপত্রের প্রাপক অবিবাহিত কোনো মেয়ে  হলে ষোলোকলা পূর্ণ হত আরো। অচিরেই তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত তারই পরিচিতজনেরা ।

সরকারি ছুটির দিনগুলো বাদে এই ডাকবাক্স, ডাকঘর আর স্কুলপ্রাঙ্গনে ভিড় থাকত জমাট, থাকত প্রাণের অফুরান স্পন্দন। সামছু ভাই ডাকঘরের কোনায় তার এক ঠ্যাং ভাঙা টেবিলের সামনে ঝুঁকে রুলটানা খাতায় কী সব হিশাব-কিতাব লিখতেন আর পান খাওয়া লাল মুখে উপস্থিত যুবাদের সাথে গল্প করতেন প্রাণ খুলে। তার প্রাণখোলা হো হো হাসিতে কেঁপে উঠত ডাকঘরের পলকা ঘরটা। ভরদুপুরে, প্রায় প্রতিদিনই ডাকবাক্সের আশেপাশে জমে যেত স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের ভীড়। উটকো ঝামেলা এড়াতে তারা তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করত ডাকপিয়নের। দূরের রাস্তায় ধূলো উড়িয়ে ডাকপিয়নের লক্করঝক্কর সাইকেলের টিকিটি দেখামাত্র হৈ হৈ করে তারা ছুটে যেত তার কাছে। যে যার বহুল বাঞ্চিত চিঠিটি ডাকপিয়নের হাত থেকে বুঝে নিতে মরিয়া হয়ে থাকত সকলেই। অতঃপর কেউ কেউ পেত সেই সোনার হরিণের দেখা। আনন্দে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে তারা নিরালার দিকে ছুটত অধীর হয়ে। কেউ কেউ দীঘল দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী করে ম্লানমুখে ফিরে যেত কাঙ্খিত চিঠিটি না পেয়ে। পরদিন আবার ভিড়ত তারা একই স্থানে, আবার প্রহর গুনত প্রতীক্ষার। ডাকপিয়নের সাথে খাতির জমাতে কেউ-বা তার হাতের ফাঁকে গুঁজে দিত এক/দুটাকার নোট, যেন তার পাঠনো চিঠিটি ডাকপিয়ন সত্বর পৌঁছে দেয় প্রেরকের  প্রিয়তমজনের কাছে, যেন প্রিয়তমজনের পাঠানো চিঠিটি ডাকপিয়ন অন্য কারো হাতে না দিয়ে প্রাপকের নিজের হাতেই বুঝিয়ে দেয় নিভৃতে। এমনি কত গোপন লেনদেন, আশা-নিরাশা, প্রেম আর অপ্রেমের মোহভারে মুখর, প্রাঞ্জল হয়ে থাকত এই ডাকঘর আর ডাকবাক্সের আশপাশটা! কত হাসি, গান, অপেক্ষা, প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে সে সাজিয়ে রাখত সেইসব সোনাঝরা দিনের ডালা! আজ, এই খা খা দুপুরের তীব্র দাবদাহে একাকী পুড়তে থাকা এই জীর্ণ ডাকবাক্স আর রুগ্ন, মৃতপ্রায়, মরচে পড়া ডাকঘরটা দেখে সেই দিনের চিত্রটা ভারি অস্পষ্ট আর অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হয়, কেউ কোথাও ছিল না কোনোকালে, এমনি হাহাকার আর অনন্ত শূন্যতা বরাবর ঘিরে ছিল এই মহিষবাথান নামক ছোট্ট ডাকঘরটাকে, ছিল এমনই চৈতি খরা চিরকাল। অথচ না, ছিল, সব ছিল! বর্ষার সঘন বর্ষণ ছিল, শীতের শীতল আমেজ ছিল, হেমন্তের সোনালি স্বপ্ন ছিল, শরতের নীল-সাদা প্রেম ছিল, বসন্তের হৃদয় মাতাল করা কোকিলের কুহুতান ছিল, সব ছিল এই ডাকঘরের ছোট্ট টিনের ঘরজুড়ে। আজ কিছু নেই সেসব। শুধু হিশেবের জঞ্জাল আছে, তাতে প্রাণের স্পর্শ নেই, প্রয়োজনের কঙ্কাল আছে, তাতে হৃদয়ের স্পন্দন নেই। ধোকড়াকোল স্কুল আছে, কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে, তাতে সবুজ প্রাণ আছে, সব আছে, শুধু হারিয়ে যাওয়া সেই মুখগুলো নেই। এখন সবার মুখে লেগে গেছে ডিজিটাল হাসি, প্রযুক্তির ঝাঁ চকচকে ঝিলিক। এখন আর কেউ পোস্টমাস্টার সামছুকে চেনে না, ডাকবাক্স চেনে না, ডাকঘর, যাকপিয়ন কিচ্ছু চেনে না। তারা নীল-সাদা-হলুদ খাম চেনে না, পোস্টকার্ড চেনে না। তারা চেনে স্মার্ট ফোন, চেনে মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ আরো কত কী! ধীরে, অতি ধীরে উজানে বয়ে যায় আমাদের সেইসব হৃদয় নিংড়ানো গোপন চিঠি, নীল খাম, হলুদ পোস্টকার্ড…হারিয়ে যায় কালের অতল গর্ভে অতঃপর…

====================