You are currently viewing জুজুবুড়ি সংক্রাম > বদরুজ্জামান আলমগীর

জুজুবুড়ি সংক্রাম > বদরুজ্জামান আলমগীর

জুজুবুড়ি সংক্রাম

বদরুজ্জামান আলমগীর

বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন ধরে ভেবেছি আমি। একটানা ভাবার স্বভাব আমার। গভীরভাবে কিছু ভাবতে গেলে সাধারণত আমি দরজা বন্ধ করে দিই- হয়তো রুমের বাইরে থেকে ভেসে আসা শব্দগুলোকে ভয় পাই- কিন্তু এগুলো তেমন কোন বিধ্বংসী আওয়াজ নয়, এগুলো সেই আওয়াজ- যেগুলো সচরাচর আমি পছন্দ করি; আমার মনে হয়, কথাটাকে আরেকটু খুলে ভাঁজকরে বলা দরকার- তাতে সত্যিকার চিত্রটা পাওয়া যাবে।

আমার মেয়েটা বাড়ি থাকে না, একই শহরে থাকি আমরা- কিন্তু ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলে শহরের ভরা অঞ্চলে হলে থাকে; সপ্তাহের এই সময়টায় মেয়েটা বাড়ি আসে- ধপধপ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে, আমি এই শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকি, কিন্তু আজ ভয় পাচ্ছি, ভেবে নিচ্ছি ওই শব্দ কোনভাবেই যেন আমার কানে না আসে।

আমার পরিবারে নানা দিগ্বলয়ের গানের ভিতর অজপাড়া গাঁয়ের গান শোনার খাঁটি রেওয়াজ আছে- যেমন ধরুন গাইবান্ধার শিকল বাউল, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মান্দার ফকির- এমন সব লোকগান, আমি মোটামুটি ওইসব গানের দিওয়ানা; কিন্তু আজ কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছি- ভাবছি, ভয় পাচ্ছি- আমার চেনা গানে কোনভাবেই আমার বুঁদ হওয়া যাবে না আজ।

মনে পড়ে, আমার বয়স যখন পনেরোর দিক- গ্রামের বাড়িতে প্রায় প্রতিরাতেই একটি গল্প শুনতাম৷ কী বলা ভালো- একটি গল্পের দুটি পিঠ শুনতাম- একটি শিশু ও একজন মা- যারা একটি খাটের উপর শুয়েছে, তাদের গল্পটি এমন- আম্মি, আমার ঘুম আসে না, ইলিশ মাছের পেটি পেটের ভিতর ঘুরঘুর করে। আম্মি বলছেন- আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি, আর ছড়া বলছি- ঘুমিয়ে যাও লক্ষ্মী সোনা : ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি আসো, খাট নাই পালঙ নাই চোখ পেতে বসো। শিশুটি অতঃপর আস্তেধীরে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

আরেকদিকে মা আর শিশু মাটিতে চাটাই পেতে শোয়। বাচ্চাটি বলে- পেডে ভুখ লাগচে মায়া, ঘুম আইয়ে না। মা কয়- ঘুমাইয়া যাও বাপধন, কাইল সহালে খাওন দিমু বাপ। শিশুটি তা-ও উতালপাতাল করে- ঘুম আইয়ে না, ঘুম আইয়ে না, আমি কি করুম?  মা বলে- ঘুমা, ঘুমা কইতেচি, না ঘুমাইলে কী অইবো জানোস- ঘরের বাইরে গোপাটের মাথায় রাক্ষস- ইয়া লম্বা লম্বা শিং, তার পিছেপিছে এক বুড়ি- বুড়ির দাঁত নাই, মুখের ভিত্রে লম্বালম্বা কাঁটা- এককামড়ে খাইয়া ফেলবে, তহন কি করবে? ঘুমা, জলদি ঘুমা- শিশুটি অতঃপর মায়ের বুকে সেঁটিয়ে কাঁপতে থাকে।

আমার অবশ্য বিশেষভাবে মন দুমড়েমুচড়ে যায়- যখনই শুনি যে ভয় দেখায়, মায়ের কোল থেকে এক হেঁচকা টানে বাচ্চা তুলে নিয়ে যায়- হাড়হাড্ডি কুড়মুড় করে চিবিয়ে খায়- সে বুড়ো ও কুঁজো, সাধারণভাবে সে একজন নারী। এটা কীভাবে হয়? কঞ্চির দাদী কনকনে বুড়ি, ইল্লাস কাহুর বাড়ির উত্তর দিকে ভাঙ্গা পুষ্কুনির পুবপাড়ে দ্বীপের মত আলাদা উঁচু টিলার উপর জঙলায় ভরা একটি ছনের ঘরে একাএকা থাকে : সে ময়লা শাড়ির- এটিকে ময়লা তেনা ডুমা বলা-ই সঙ্গত হবে- ভিতর থেকে আমাদের জন্য বান্নির মুড়ি মুড়কি বের করে দিয়ে বলেন- খাও, তোমরা পোলাপাইন কাইমের বাউলি মেলার মিঠা মুড়ি খাও। এতো আদর করে, এমন মায়া মাখিয়ে যে মেলার লাড়ু নাড়ু খেতে দেয় সে কীভাবে, কেন এমন রাক্ষসী হবে- এ হয়তো দশচক্রে ভগবান ভুত।

এ গল্প আমরা সকলেই জানি- বেচারা ভগবান দিলখোলা মানুষ, গ্রামের বাড়ি সবার সাথে মিলমিশ করে সুখে-দুঃখে দিন গুজরান করে। তার নিজের ছেলেপুলে নাই, নিজের ভাতিজাকেই নিজছেলে জ্ঞান করে। বয়সের একটা মাজেজায় পড়ে ভগবান ভাবে- বয়স থা হলো, এবার একটু গয়া কাশী করি; যে-ই ভাবা সে-ই কাজ : বছরের ছয়মাস অতঃপর তীর্থে তীর্থে ঘোরে ভগবান। কয়েক বছর কোন ঝুট-ঝামেলা হয়নি- ছয়মাস বাড়ি থাকে তো বাকি ছয়মাস হরির পায়ে-পায়ে। কয়েক বছরের মাথায় ভাতিজার মনে শকুনি ডোকে, ইবলিশের খপ্পরে পড়ে সে; কয়েকজন উঠতি বুদ্ধিবাজের সঙ্গে শলা করে ভাতিজা একটি সিদ্ধান্ত পাকা করে; গ্রাম, পাড়াপড়শি, নগরবাসী সবাইকে ভাতিজা বলে তার কাকা তীর্থে গিয়ে মারা গ্যাছে, সে নিজে লোক পাঠিয়ে দাহ করিয়েছে, একফাঁকে সবাইকে দেখিয়ে একপশলা কুম্ভিরাশ্রুও বর্ষণ করে। কিন্তু ছয়মাস ঘুরতেই ভগবান বাড়ি এসে হাঁক দেয়, কিন্তু ভাতিজা তারস্বরে চিৎকার করে বলে- এ হতেই পারে না, এ আমার চাচা নয়- তার সাক্ষাৎ প্রেতাত্মা। ফলে সবাই পিটিয়ে ভগবানকে গ্রামছাড়া করে, এভাবেই ভগবান দশচক্রে ভুত।

এই পুরো বিষয়টিকে একটি বড় পাত্রে গুছিয়ে রাখলে আরেকটি বড় পরিপ্রেক্ষিতের ট্যাপিস্ট্রি তৈরি হয় :  আমাদের বাপদাদাদের মুখে শুনে এসেছি- রাতবিরাতে হালটের উপর দিয়া চলো, কী জঙ্গলের ভিতর দিয়া যাওয়ার পথে তোমারে ভুতে ধরবে- ভুতে ধরলে সম্প্রদায় বুঝে জোরেশোরে মা কালির নাম নিবা, না হয় কুলহু আল্লার সুরা পড়বা- তাহলে ভুত তোমার কাছে আসতে পারবে না; যদি দেখো তাতেও কাজ হয় না, তাহলে একদৌড়ে ইংরাজদের পাকা সিএন্ডবি সড়কে উইঠা পড়ো- জিনভুতের বাপের সাধ্য নাই তোমারে ঘায়েল করে, পাকা সড়কে ভুত নাই।

আমার মন বলে, এডওয়ার্ড সাঈদের কল্যাণে যাকে আমরা ওরিয়েন্টালইজম বলে চিনি এখানে এর একটা খেলা আছে। বায়োস্কোপের ফিতার পরম্পরায় আমার চোখে কেন যে একের পর এক ছবি ভাসতে থাকে তার কিনারা করে উঠতে পারি না : কাজেকর্মে, পরিশ্রমে আমাদের সবারই শরীরে বিষ ব্যথা হয়, সন্ধ্যার পরেই শুয়ে পড়ি আমরা- আর আমাদের মায়েরা, খালারা, স্ত্রীরা মাটির পাত্রে- আমাদের অঞ্চলে যারে বলে আইল্লা- আইল্লার উপরে আকনমেন্দির পাতা গরম করে ব্যথার জায়গায় সেঁক দিচ্ছেন; অথবা রসুন আর সরিষার তেল গরম করে শরীর মালিশ করে দিচ্ছেন- রসুন, সরিষার তেল, আকনমেন্দির পাতার ভেষজগুণ, সেইসাথে মা-খালা, বোন ও স্ত্রীদের মায়া, ভালোবাসা আর উৎকন্ঠার মর্মে ব্যথা সরে, সত্যিই সরে যায়।

হেরে গ্যাছে, আপসে আপ সরে গ্যাছে আকনমেন্দির পাতা, মুছে গ্যাছে গরম রসুন ও সরিষার তেল; টেবিলে উঠে এসেছে কাচের গ্লাস, ও তার পাশে এসিট্রাম বা ডেক্সিবুফ্রেন টেবলেট অথবা এনাডল ক্যাপসুল। ধান্ধা লাগে, ধন্দ লাগে বৈকি- কে কার জুজুবুড়ি,  কে কারে বানায় দশচক্রের ভুত!

আসল ভুত কিন্তু সরিষার ভিতরে, ম্যাক্সিম গোর্কি নিউইয়র্কে পালিয়ে থাকার সময় নিউইয়র্ক সম্পর্কে লিখেছিলেন সিটি অব ডেভিল- যার বাংলা হয়েছিল পীত দানবের পুরী; ওখানে গোর্কি বলেছিলেন- এ এমন এক শহর যেখানে আছে নিদারুণ মসৃণতা আর একইসাথে গহবর, এখানে এতো চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে কতো অন্ধকার। ওই ভয়, ওই জুজু কিন্তু এখনও যায়নি- তুল্যমূল্যে এর প্রমাণ তুলতে গেলে আমরা এবারকার ২০২২ সনে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের দিকে একবার ফিরে তাকালেই বোঝা যাবে। অর্থনীতিতে মৌলিক অবদানের জন্য এবার নোবেল পেয়েছেন ৩ মার্কিন অর্থনীতিবিদ : বেন বার্নানকে,ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডিবভিগ। তাঁদের গবেষণা- মহামন্দা, জুজুর ভয় ও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা।

এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার আসলে জুজুর ভয়কে সামলানোর তৎপরতায় আধুনিক ধনবাদী দুনিয়ার এক আত্মরক্ষাকারী পুরস্কার। মহামন্দার সময় ১৯৩২-৩৩ সনে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল- তার কারণ ছিল একটি জুজুর ভয়। আমানতকারীদের একটা ভয় থাকে যে মহামন্দার সময় ব্যাঙ্ক তাদের অর্থ গ্রাহকদের জন্য সবসময় এভেইলেবল রাখতে পারবে না- সেই ভয়ে গ্রাহকরা হুড়মুড় করে তাদের টাকা তুলে ফেলতে যায়, কিন্তু ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের যে টাকা আমানত রেখেছে তা তো দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে খাটানো। মহামন্দা কেন, সব গ্রাহক টাকা তুলে ফেলতে চাইলে জিডিপির চরম বিকাশের সময়ও ব্যাঙ্কের পক্ষে সবার টাকা তৎক্ষণাৎ ফেরত দেয়া সম্ভব নয়- এটিই তিন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ বেন বার্নানকে, ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডিবভিগ-এর গবেষণার অভয় বাণী: গ্রাহকগণ যেন দুঃসময়ে ব্যাঙ্কের উপর আস্থা না হারান। এ তো প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের জুজুর ভয় নিরাময়ের এক অগ্রিম দোয়াখায়ের। তাদের আসল জুজু আছে ওখানে- তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে- আমরা ৯৯ভাগ আন্দোলনের অন্দরমহলে।

জুজুবুড়ির জন্মবিত্তান্ত মোটামুটি আমরা সকলে জানি। দূর অতীত কালে দয়ার শরীর এক রাজা ছিলেন যার নাম বেসান্ত- একেবারে আদ্দিকালের হাজি মুহসিন আর কি- চোরের দুরবস্থা দেখে নিজের জামাকাপড় খুলে চোরকে দিয়ে নিজেই দিগম্বর। রাজা বেসান্তও সেই ঘরানা- সবকিছু দান করে করে একদিন নিজে সর্বস্বান্ত হয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত এক বনের পর্ণকুটিরে বাস করতে থাকে। বনের ধারেই এক ছিল লোভী ব্রাহ্মণ নাম জুজুক- যার ছিল এক স্বল্পবয়সী ভার্যা- সে পায়ের উপর ঠ্যাং তুলে রাখে, কোন কাজই করতে চায় না; তার ব্রাহ্মণ স্বামীকে কাজের লোক এনে দিতে ফরমায়েশ করে। জুজুক জানতো রাজা বেসান্ত ছিন্নমূল হয়ে বনের মধ্যেই বাস করে। ব্রাহ্মণ বেসান্তের ভাঙা কুটিরের সামনে কিছু সাহায্যের জন্য হাঁক দেয়, কিন্তু রাজা বলেন- দেবার মত তাঁর আর কিছু বাকি নাই- তিনি সর্বহারা; ব্রাহ্মণ এই সুযোগে বলে- তার স্ত্রী অসুস্থ, তাই তার দুটি কাজের লোক দরকার। রাজা বলে- আমার একটি ছেলে আর একটি মেয়ে আছে- তাদের নিতে পারো, এ-কথা শোনামাত্র জুজুক একলাফে হুঙ্কার ছোঁড়ে- ছেলে মেয়ে, কোথায় তোমরা! জুজুকের হুঙ্কার শুনে ছেলেমেয়ে বেড়ার পিছনে লুকায়, ব্রাহ্মণ জুজুক আবার হুঙ্কার কষলে রাজা বেসান্তের ছেলে-মেয়ে দুটি লাফিয়ে পুকুরে পড়ে, আবার জুজুক খুঁজতে এলে পদ্মপাতার আড়ালে লুকায়। এই জুজুক ব্রাহ্মণই কালান্তরে জুজুবুড়ি নামে ভয় দেখায়।

এখানে একটি বিষয় একান্ত লক্ষণীয়- জুজুক ক্ষত্রিয় নয়, নয় বৈশ্য, বা শূদ্র; এখানেই জনপ্রজ্ঞার এক অসামান্য ভরকেন্দ্র- জুজুকের ব্রাহ্মণই হতে হবে, এবং সে ব্রাহ্মণ।

যে কাহিনী পরম্পরা থেকেই আসুক, জুজুবুড়ির আগের নাব্যতায় যে তারতম্য এসেছে- তা মানতেই হবে। আধুনিকতাবাদী সাম্প্রতিক দুনিয়ায় নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেমন আগের মত আর এলায়িত নেই, অনেকটাই টানটান, প্রতিমুহূর্তে তা প্রমাণ সাপেক্ষ- তেমনি জুজুবুড়ি এখন আতঙ্কের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ব্যাপৃত। জুজুবুড়ি, কিংবা জুজুর ভয় ব্যাপারটাই অনেকটা সংশয়বাদী, উইলিয়াম শেকসপিয়ারের হ্যামলেটের সংলাপ বুঝি- টু বি অর নট টুবি; কিন্তু এর বিপরীতে আতঙ্ক বা সন্ত্রাস অনেকটাই মার্চেন্ট অব ভেনিসের স্থির নির্দিষ্ট সংলাপ-
যদি আমাদের চোখা কিছু দিয়ে ঘাই দাও, তাহলে রক্ত বেরুবে না? কাতুকুতু দিলে হাসি পাবে না? যদি বিষ খাওয়াও, তাহলে আমরা মারা যাবো না?  আমাদের আহাম্মক বানালে মনে হবে না তোরে পিষে ফেলি?

একটা সহজ উদাহরণের ভিতর দিয়ে যাই- এক মা তার বাচ্চাটিকে সাগু, দুধ বা ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন; কিন্তু বাচ্চা আইডাই করে, গড়িমসি পাকায়, খাবার খেতে চায় না- অতএব মা ভয় দেখাচ্ছেন- তাড়াতাড়ি খা বলছি, এক্ষুণি খেয়ে নে- নইলে জুজুর হাতে দিয়ে দিলাম- জুজুবুড়ি টুক করে তোকে নিয়ে নেবে। শিশুটি এবার ডগরমগর করে হাসে, আর বলে- মিছা কথা, আমি জানি জুজুবুড়ি মিছা কথা, জুজু বলে কিছু নাই। এবার রেগেমেগে মা বলছেন- দাঁড়া বলছি, কলেজ থেকে ছাত্রদের এক ডাকসাইটে দল আসছে- তোকে পিটিয়ে সোজা করবে, খাবে না আবার! বাচ্চাটি এবার ডগডগ করে সবটুকু খাবার খেয়ে নেয়।

তাহলে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি- আমরা এমন একটি সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি- যেখানে জুজুবুড়ির মর্যাদা কমেছে, বেড়েছে আতঙ্ক ও ত্রাসের মহিমা। ভাবে ঘরে যা আছে তা শখের ঘোড়া, বাস্তবে যা গড়িয়ে আসে, তা দিনশেষে মানতেই হয়। এ-বেলায় কার্ল সাগানের কথাটি মনে পড়ে: লোকদের বলো- এমন একজন আছেন- যাকে তোমরা দেখো না, কিন্তু সত্যিই আছে সে, চোখের আবডালে রয়েছে- যে তামাম দুনিয়া সৃষ্টি করেছে, মেলা মানুষ তা আমলে নেবে। এবার বলো- মাত্র রঙ করা হয়েছে- এখনও তা কাঁচা আর ভেজা- চোখের সামনে বলেই সে আর তা সহজে বিশ্বাস করবে না, হাত দিয়ে দেখবে- হাচাহাচাই তা ভেজা কী-না।

হাত দিয়ে দেখার পর সত্যিই যখন দেখবে হাত ভিজে যায়, বা হাঁটতে গেলে পা হড়কে যায়- তাকেই মান্য করবে। বাস্তবে যা জায়মান তাকেই যে মানুষ ভজনা করে, তা-ই কিন্তু আধুনিকতার সোনাফল ও সঙ্কট।

সাকুল্যে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, অথবা উদ্বেগের কোন চিহ্নই আর নাই- সবকিছু একদম স্থির নির্দিষ্ট, দোলাচলের কোন অবকাশ নাই। পশ্চিম নিদারুণভাবে বিজ্ঞানের একটি সাফসাফ হালখাতা নিয়ে বাজারে হাজির। যে সংস্কার বা বিশ্বাস বিজ্ঞানের ভাইবা বোর্ডে পাশ করে আসতে পারেনি- তা মিথ্যা, তা কুসংস্কার। ঠিকাছে, এখানে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার একটি গল্পের বরাত দিই। বইটির নাম হ্যান্ড পাম স্টোরিজ- আমাদের কল্যাণী রমা হাতের পাতায় গল্পগুলো নামে এর ভাষান্তর করেছেন; ওখানে মৃত মুখের ঘটনাখানি নামে একটি গল্প আছে :

একজন মহিলা- স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে বহুদিন হয়, তারা দুজন এখন পরষ্পর অনেকটাই দূরে থাকে। মহিলা এভাবেই একদিন মারা যায়, মারা যাবার পর কয়েকঘন্টা পর শরীরের সবকিছুই নেতিয়ে পড়ে, কিন্তু মুখের শিরা-উপশিরাগুলো তখনও ফুলে ফুলে আছে। প্রাক্তন স্বামীর কাছে তার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছানো হয়- প্রাক্তন স্বামীটি আসে, সে দ্যাখে তখনও তার স্ত্রীর মুখের শিরারেখাগুলো ফুলে আছে, ভদ্রলোক তার শ্বাশুড়ির কাছে শোনে- স্ত্রীর তীব্র ইচ্ছা ছিল তার স্বামীকে আরেকবার দেখার। জাপানিজ লোকজ্ঞান বিশ্বাস করে- কেউ তীব্র বাঞ্ছা নিয়ে মারা গ্যালে তার আত্মা শরীর থেকে সম্পূর্ণ বের হয় না; তাই ওই মহিলার আত্মাও তার স্বামীর সঙ্গে দেখা হবার বাসনার সাথে মিশে মুখমণ্ডলে দৃশ্যমান ফুটে থাকে। মহিলার স্বামীটি পরম মমতায় মৃতজনের মুখে হাত বুলিয়ে দিলে মুখটি এবার নেতিয়ে আসে, মহিলা সম্পূর্ণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

আমাদের সমাজে রাতের বেলায় এঁটোপানি বাইরে ফেলা হয় না; কোন পরিবারে কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত এঁটোজল ফেলা এক ভীষণ নির্দয়তার মধ্যে পড়ে, কেননা আমাদের লোকবিশ্বাস এরকম যে, মৃতজনের আত্মা স্বজনদের মায়া ভুলতে পারে না- ফলে ঘুরেঘুরে তাদের আত্মা দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহালয়া তো এমনই এক পৌরাণিক গল্প : রাম সীতাকে উদ্ধার করার যাত্রাযজ্ঞকালে তার মনে হলো এ-যাত্রায় সফল হবার জন্য পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ ও সমর্থন দরকার, ফলে তিনি পূর্বপুরুষদের বিদেহী আত্মার জন্য প্রার্থনা করলেন আর করলেন, ফলে পূর্বপুরুষের আগমনে পুরো আলয় ভরে উঠলো- তা থেকেই চালু হয়েছে মহালয়া।

ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার ছোটগল্প বা আমাদের লোকভাবনায় যে বয়ান দেখতে পাই তা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, বা তাদের পবিত্র পুস্তকের বিবেচনায় অসত্য, পরিত্যাজ্য ; তা অসত্য প্রথাগত বিজ্ঞান- যাকে বলা ভালো কাঠবিজ্ঞান- তার চোখেও। যে-অর্থে আমরা কাঠমোল্লা কথাটি বলি, একইভাবে কাঠবিজ্ঞান কথাটি বলাও যুক্তিগ্রাহ্য হবে।

আমাদের যে ধরতাই বোঝ আর বিজ্ঞানমনস্ক ধারণা তার উপর দাঁড়িয়ে বিবেচনা করলে মানতে হবে উপরের দুটি, বা তিনটি গল্পের উল্লেখ করা হলো সেগুলো অসম্ভব ও অসত্য। আমরা জানি, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্পের মহিলার মুখমণ্ডলে তার আয়ু আটকে শিরা-উপশিরা ফুলে থাকেনি, মৃত্যুগ্রহণের পর মৃতদের আত্মা দরজার বাইরে আত্মারা এসে ভিড় করে না, কী রামের আর্তিতে সারা দিয়ে পূর্বপুরুষের আত্মা জমায়েত হয়ে মহালয়া গড়ে তোলেনি, কিন্তু এই প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে মানবমনের যে অসামান্য অসহায় বাসনা ঘনীভুত হয়ে ওঠে তার সৌন্দর্য তুলনারহিত। তাই এদের মিথ্যা বললেও এই মিথ্যার সত্যতা সত্যের অধিক।

কেননা এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, কর্তৃত্ব, হিংস্রতা- তারসঙ্গে যুক্ত হওয়া হাইব্রিড বিজ্ঞান যা তৈরি করে তা-ই তালেবান। আবার পুরোপুরি লোকবিশ্বাসের উপর হেলে পড়া আমদানি করে এক বিপজ্জনক পশ্চাৎপদতা। এ-কথা সত্য, বনের বাঘে খায় না- মনের বাঘে খায়।

আধুনিক মানুষ এই সঙ্কট মোকাবেলা করে, কিন্তু তার ফলাফল নিজে নির্ধারণ করে না। ফ্রানৎস কাফকার দোকানী গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে উঠে দ্যাখে এক আচানক আরশোলায় রূপান্তরিত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে- নিজেকে চিনতে পারে না, তার নিজের কন্ঠস্বর ঠাউরে উঠতে পারে না গ্রেগর। কিন্তু এর হাত থেকে মুক্তির উপায়ও তার জানা নাই। নিজেকে শত্রুর ব্যুহ থেকে মুক্ত করতে চাইলে শত্রুর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব থাকতে হয়, কিন্তু সেই শত্রুর বেড় থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়- যে শত্রুর সঙ্গে কোন দূরত্বই নাই। এখন ঘরে ঘরে জুজুর ভয়- অতি নিকটজন সেল ফোনের পাসওয়ার্ড জেনে ফেলে কী-না!

বাংলা লোকজ্ঞান ও পরম্পরায় জুজুবুড়ি এক বেদের মেয়ে জোসনা যে আসি আসি বলে, কিন্তু আসে না- এখানেই তার মহত্ত্ব- সে ভয় দেখায় কিন্তু আতঙ্কিত করে না। যারা সবকিছু ভোগদখল করে তাদের একটি জুজুবুড়ি লাগে- কী বলা চলে এই জুজুই তাদের মুশকিল আসান ও অপার ভরসা; তাদের দিক থেকে এই জুজুবুড়ি পাকা ধানক্ষেতের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা কাকতাড়ুয়া- যে কাকদের, বাবুইপাখিদের ভয় দেখায়।

কোন পরিপ্রেক্ষিতে কে যে কার জুজুবুড়ি তা বলা প্রায়শই বেশ শক্ত : ঈমাম খোমেনি চ্যাপিটার ও ইব্রাহিম রাইসির ভিতর দিয়ে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো মাশা আমিনির জুজুবুড়ি; আবার এর উল্টোটাকেই অধিকতর খাঁটি বলে বিবেচনায় রাখা ঠিক হবে যে, মাশা আমিনিই আসলে ইরানি ক্ষমতা কাঠামোর জুজুবুড়ি।

প্রবল পরিতাপ এমনই- সংস্কারে, কুসংস্কারে জুজুর ভয় থাকার জন্য প্রশ্রয় লাগে, থাকতে হয় অনুভবের মেহনত, আর লাগে নিজের সঙ্গে দুশমনের ফারাক- যাতে হাতিয়ারটুকু ঘোরানো যায়- কিন্তু সেই দূরত্ব আর নাই। আমরা হয়তো ভাবি- দিনেদিনে আরও আধুনিক হয়ে উঠবো- জুজুর ত্রাহি ঝেঁটিয়ে দূর করবো; কিন্তু জুজুবুড়ি কই- এ যে আতঙ্ক, এ মারণাস্ত্র; বারবার জহির রায়হানের তৃষ্ণা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায়- মার্থা গ্রাহামের বদলে শওকত নাচনেওয়ালি সেলিনাকে নিয়ে পালায়, একসময় ওরা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে- তারা জানেও না আঠারো জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে ওদের চারপাশ ঘিরে ফেলে।।

**************************************