জিজীবিষু
আলী সিদ্দিকী
গতানুগতিক সকালের ঘুম ভাঙলো অচেনা কোলাহলে। প্রথমে মনে হলো টিভির ভলিয়ম মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণত আমরা সবাই উচ্চ শব্দ এড়িয়ে চলি। এটা অলিখিত বিধান। মুঠোফোনের এই যুগে সবার কানে উঠে গেছে হেডফোন। অতএব কেউ ডিস্টার্বড হয় না। আমি আর অন্যা এখনো আধেক সেকেলে আছে। শব্দ করে কথা না বললে মনে হয় কথারা মরে গেছে। ঠিক তেমনি সহনশীল শব্দে ঠিক না শুনলে মনে হয় মৃত্যুপুরীতে আছি। তাই প্রথমেই মনে হলো বসার ঘরে অন্যা উচ্চশব্দে কোলকাতার ঝগড়াটে সিরিয়াল দেখছে। কিন্তু অন্যা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালো। মানে, উঠে গেলে যে!
উঠে গেলাম না উঠানো হলো তা টের পেয়ে সে জানালার দিকে এগিয়ে বাইরে তাকিয়ে ইশারায় ডাকলো। ঘুম এখনো এঁটে আছে চোখে। শরীরও আছে লেপ্টে বিছানায়। অন্যার পীড়ায় উঠতে হলো। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি নার্স পিটারের পেছন উঠোনে লম্বাটে এক শেতাঙ্গী নারী বিরামহীন কথা বলে যাচ্ছে। আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। সে কথা বলছে একঝাঁক মুরগী আর এক সাত কি আট বছরের ছেলের সাথে। গত বিকেলেও এখানে মুরগির খোঁয়াড় দেখিনি। মুরগির খক খক আর ছেলেটির তীক্ষ্ম স্বরে চিৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে মহিলার উচ্চকন্ঠে।
অন্যা মুখ ঘুরিয়ে বলে, জ্বালা বাড়লো!
শীতের প্রকোপ শেষ হতেই বেড়েছে রোদের তাপ।বাগানের মৃতপ্রায় ঘাসগুলো গাঝাড়া দিয়ে ছড়াচ্ছে আলো। লোকজন অগোছালো লনের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘাসকাটার মেশিনের শব্দে চারদিক মুখরিত। দীর্ঘ শীতে জুবুথুবু মানুষগুলো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে তল্লাট জুড়ে। নাস্তা শেষে পেছনের এক চিলতে লনে দেখলাম পুরো লন (Lawn) ছ্যাড়াব্যাড়া। এবার ঘাসের বীজ ছড়াতে হবে। গ্যারেজে ঢুকে দেখি ছোপ ছোপ কাদা এখানে সেখানে। শাটার খুলে ডান দিকে তাকাতেই পিটারের সাথে চোখাচোখি হলো, হাই পিটার, মর্ণিং।
গুড মর্ণিং সাধু, গাড়ি মুছতে মুছতে হাসে পিটার।
আমি ইশারায় মহিলাকে দেখালে পিটার দু’কদম এগিয়ে এসে প্রাণখোলা হাসে, আমার গার্লফ্রেন্ড কেরি। ও আর ছেলে পার্ক এখন এখানে থাকবে। কেরি একটু উচ্চকন্ঠী আর পশুপাখি পছন্দ করে। কিছু মনে করো না।
একদম নয়, আমি পিটারকে আশ্বস্ত করি, তুমি সুখি হও।
অনেক ধন্যবাদ, পিটার গাড়ির পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা মুরগি খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে লনজুড়ে ছোটাছুটি শুরু করে। ফিরে আয়, এদিকে আয়, দেখাচ্ছি মজা বলতে বলতে কেরি ছুটছে পিছু পিছু। পিটার আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে দেখি অন্যা চোখ বড়ো করে তাকিয়ে আছে। এটা তার নতুন অভিজ্ঞতা।
পিটারকে চিনি প্রায় একযুগ। আমাদের মহল্লায় আসে তিন সন্তান আর স্ত্রী তানিয়াকে নিয়ে। পিটার হ্যানিম্যান হাসপাতালের নার্স আর তানিয়া কোন এক অফিসের কর্মকর্তা। ছোটোখাটো তানিয়া বেশ হাসিখুশি মানুষ। দেখা হলেই একগাল হেসে কথা বলবে। এটা ওটা জিগ্যেস করবে। ছেলে এভনকে নিয়ে সে খুব উচ্ছ্বসিত, ও গায়ক হবে। ওর টেলেন্ট আছে। আমিও প্রেরণা যোগাই, অবশ্যই।
বেশ সুন্দর একটি পরিবার ওদের। পুরো পরিবারটি সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে নানান কাজে। প্রাণবন্ত পরিবারটিতে হঠাৎ যেনো ছন্দপতন ঘটলো। সন্ধ্যা না হতেই অন্ধকার নেমে আসে ঘরে। পিটার কিংবা তানিয়াকে খুব একটা বাইরে দেখা যায় না। ছেলেদেরও তেমন সাড়াশব্দ নেই। দুই একবার পিটার ও তানিয়া আলাদা আলাদা গাড়ি নিয়ে বেরোতে দেখেছি। কথা বলার সুযোগ হয়নি।
এক শনিবার বিকেলে সিভিএস ফার্মেসিতে দেখা হয়ে গেলো পিটারের সাথে। সেদিন জানলাম তানিয়া ছেলেদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কোর্ট অর্ডার আসলেই চলে যাবে। আমার মুখে কথা জুটলো না। এমন নয় যে এই প্রথম কোনো পরিবারকে ভেঙে যেতে দেখছি। কিন্তু পিটারের মতো এমন দিলদরিয়া পরিবার অন্ত মানুষটি পরিবার হারাচ্ছে ভাবতে খারাপ লাগছিলো। পিটারের মুখে ছাপ ফেলে যায় অব্যক্ত বেদনার রঙ।
আমাদের মধ্যে একসাথে পথচলার উত্তেজনা আর অবশিষ্ট নেই, সাধু – নিরুদ্দিষ্ট কন্ঠে জানায় পিটার। একটু অন্যমনে বলে, আমরা পরস্পরের মধ্যে যা খুঁজছি তার অস্তিত্ব নেই। এতোটি বছর নিজেদের মধ্যে কি খুঁজেছে তারা? মানুষ কি নিজের অসম্পূর্ণতা অন্যজনের মধ্যে খোঁজে? আর যখন তা পায় না তখন পথচলার দম ফুরিয়ে যায়? বোঝা খুবই দুরূহ। নিজের খেয়াল রেখো, কাঁধ ছুঁইয়ে শুধু এটুকু বলতে পেরেছি সেদিন।
মানুষের সম্পর্কগুলো খুবই পলকা। হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব ব্যতিরেকে মানুষ কখনোই দু’টি প্রাণের বন্ধন অটুট রাখতে পারে না। তিন সন্তানের বাবা-মা হওয়া সত্ত্বেও ‘উত্তেজনা অবশিষ্ট’ নেই বলে কি মাঝপথে হাত ছেড়ে দিতে হবে? আমিও কেমন বিষন্ন হয়ে গেলাম। আমাদেরও তিন সন্তান। আমরাও অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি। পিটারের বিষয়টি অন্যার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো না।
মনে পড়লো, গেলো বছর শীতের আগে এক বিকেলে দেখা হয়ে গেলো তানিয়ার সাথে। পিট পিট বৃষ্টি হচ্ছিলো। ওয়ালমার্টে ঢোকার মুখে তানিয়ার সাথে দেখা। কুশল বিনিময় শেষে একটু সরাসরিই পিটারের রেফারেন্স দিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলাম। তানিয়া দ্বিধান্বিত চোখে তাকালে কিছু মনে না করার জন্য অনুরোধ করলাম। তানিয়ার চোখের রঙ ঘোলাটে হয়ে কষ্টের ছায়া ফেললো। ধীরে ধীরে সে যা বললো তা শুনতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। পিটার অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সময় মেরিন সেনা হিসেবে ইরাকে গিয়েছিলো। ভয়াবহ যুদ্ধে সে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে। ফিরে আসার পর তাকে অনেক চিকিৎসা দেয়ার পরও পিটিএসডি (PTSD-Post-Traumatic Stress Disorder) থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে ঘুমাতে পারে না। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। ক্ষেপে যায় যখন তখন। এমনকি মাঝেমধ্যে ভীষণ অচেনা হয়ে যায়। ছেলেরা ভয় পাচ্ছে ওকে, আমিও।
এই অবস্থায় ওকে ছেড়ে দিলে তো সমস্যা বাড়বে, আমি আশংকা প্রকাশ করি।
আমাকে তো ছেলেদের বাঁচাতে হবে সাধু, করুণ কন্ঠে বলে তানিয়া।
আমি কোনো ভাষা খুঁজে পাই না।
এরপর কখন তানিয়া চলে গেছে খেয়াল করিনি। ব্যস্ততার জন্য পিটারের সাথেও গত ক’মাস কথা হয় নি। দূর থেকে হাত নেড়েছি। গতানুগতিক জীবনে যার যার মতো ভেসে চলি।
অনভ্যস্ত কোলাহলে ঘুম ভাঙার পর আজ যে খবর পেলাম তাতে আমি খুশি হয়েছি। জীবন মানুষের একটাই এবং কোনো কিছুই কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেরির কথা বলার সময় পিটারের চোখেমুখে যে উচ্ছ্বল আলো ফুটে উঠেছিলো তাতে ওকে বেশ সুখি মনে হচ্ছিলো। তানিয়া কেমন আছে জানতে চেয়ে ওকে বিব্রত করতে ইচ্ছে হলো না। প্রত্যেকেরই যার যার মতো করে জীবন যাপনের অধিকার আছে। তানিয়া ভালো মানুষ। ও নিশ্চয় নিজেকে ঘুচিয়ে নিয়েছে।
অন্যা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ঘরে ঢুকতেই জিগ্যেস করলো কেরির কথা। সব শোনার পর বললো, এটাও কদিন ঠেকে দেখো। যে ক’দিনই টিকুক আমাকে কানে এয়ার প্লাগ লাগিয়ে বাঁচতে হবে। তানিয়ার জন্য খারাপ লাগছে।
ওর কথায় আমার হাসি পেলো। কেরিও তো তার স্বামীকে ছেড়ে অনেকদিন পরে পিটারকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে নিয়েছে। ওর ট্র্যাজেডিও কম বেদনাদায়ক নয়।
একদিন দুপুরে দেখি একদল পুলিশ আর প্যারামেডিক পিটারকে নিয়ে গাড়িতে তুলছে। প্রথমেই মনে হলো কেরি নিশ্চয় মামলা করেছে কোনো ইস্যুতে। শীত শেষে রোদের আভা দেখা দিয়েছে ঈষৎ হলুদাভ অবয়বে। হাতকড়া পরা পিটার আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হেসে পুলিশের কারে গিয়ে উঠলো। মাথা ঘুরিয়ে এমন সকরুণ চোখে তাকালো যে আমার ভেতরটা জলমগ্ন হয়ে গেলো। কেনো তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিতে হলো? বড়ো মাপের অপরাধীকে হাতকড়া পরাতে দেখেছি। পিটার কি বড়ো কোনো অপরাধ করেছে? পুলিশকে কিছুই জিগ্যেস করা যায় না। প্রতিবেশী কাউকেও দেখছি না। বেশ অস্বস্তি বোধ করছি।
পিটারের পাশের ঘরে থাকে দুই স্কুল শিক্ষক বোন জুডি আর ডায়ানা। সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠার সময় জুডিকে মেইলবক্স থেকে মেইল নিতে দেখলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে পিটারের ব্যাপারটা তাকে বললাম। জুডি- ছোটোখাটো গড়নের সজ্জন স্বভাবের মানুষ- যা বললো তার জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। জুডি জানালো, পিটারকে রিহ্যাবে নেয়া হয়েছে। কেরি চলে যাবার পর পিটার অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত নেশায় ডুবে যায়, কাজকর্মে একেবারে উদাসীন হয়ে পড়ে এবং সে ক্রমে সুসাইডাল হয়ে ওঠে। গত দুইদিন সে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক ট্রমায় চলে গেছে। ওর প্রাক্তন স্ত্রী তানিয়াই উদ্যোগ নিয়ে ওকে রিহ্যাবে পাঠিয়েছে। নইলে সে অপঘাতে মারা যাবে।
তাই বলে হাতকড়া পরাবে?
ও হঠাৎ কিছু করে বসতে পারে তাই পরিয়েছে, আফসোস করে জুডি, হয়তো মাসখানেক কিংবা বেশি সময় ওকে রিহ্যাবে কাটাতে হবে।
এতো স্বাস্থ্যবান ও সজ্জন মানুষটার এমন পরিণতি দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো।
দিন তিনেক আগে দেখলাম পিটারের গাড়ি পার্কিংএ দাঁড়িয়ে আছে। উপরতলার জানালা দিয়ে দেখলাম ছেলে এভনকে নিয়ে তানিয়া বেরিয়ে গেলো। অন্যাকে খবরটা দিলে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ওর মঙ্গল হোক।
আশ্বস্ত হলাম।
ছুটির দিন রাতে আমি আর অন্যা মুভি দেখি। দক্ষিণ ভারতী, কোলকাতার বাংলা মুভি, মাঝেমধ্যে ঢাকার দুয়েকটা ভালো মুভি। তখন রাত কোনদিকে ভোর হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। আজো আমরা মুভিতে মগ্ন ছিলাম। হ্ঠাৎ বাইরে গুঞ্জন আর পুলিশের গাড়ির তীব্র আলোর ঝলকানিতে লাফিয়ে উঠে দরোজা খুলতে গেলাম। অন্যা বাধা দিলো, আগে জানালা দিয়ে দেখো।
অনেক পুলিশের গাড়ি ঘরের সামনে এবং প্রতিবেশী মিচ আর স্টিভের গলাও শুনতে পেলাম। নিশ্চয় বিপজ্জনক কিছু হয়েছে। মিচ এখানকার স্পোর্টস ক্লাবের সেক্রেটারি এবং পাঁড় ডেমোক্রেট। আমার সাথে হৃদ্যতা আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, স্টিভ হার্ট এন্ড সোল রিপাবলিকান। দু’জনেই এক ঘরে থাকে। মিচের পেয়িংগেস্ট স্টিভ। কিন্তু কখনোই দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হতে দেখি নি। অসম চিন্তার দু’জন মানুষ কি করে বছরের পর বছর একঘরে থাকে? প্রয়োজনে। মিচের প্রয়োজন এক্সট্রা ইনকাম আর স্টিভের দরকার সস্তার বাসা। মানুষে মানুষে সম্পর্কটাই প্রয়োজনের। এই যে তানিয়ার প্রয়োজন ছিলো পিটারের কাটিয়েছে সুসময়। দুঃসময়ে প্রয়োজন ফুরালো তো চলে গেলো। কেরিও তাই করেছে। আর পিটার হয়ে গেছে এবনরম্যাল। দুইটি সম্পর্ক থেকে এটাই বুঝি পিটারের বড় প্রাপ্তি।
আচ্ছা, পিটারের কিছু হয়নিতো?
দ্রুত দরোজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি পাঁচ-ছয় জন পুলিশ পিটারের ঘরের দরোজা ধাক্কাচ্ছে। নাম ধরে ডাকছে, পিটার, দরোজা খোলো। কিন্তু কোনো সাড়া মিলছে না। দুইজন পুলিশ মিচের ঘরের ভেতর দিয়ে দোতলার জানালা বেয়ে পিটারের জানালা খোলার চেষ্টা করে, ডাকাডাকি করে। সাড়া মেলে না। মিচ জানালো পিটার একঘন্টা যাবত আর্তনাদ করছিলো তাই পুলিশকে জানিয়েছে। কিন্তু রাতের বেলা দরোজা ভেঙে ঢুকবে না।
প্রতিবেশীদের মধ্যে লরা-রবার্ট, মিচ আর স্টিভ ছাড়া কেউই বাইরে আসেনি। স্টিভ আশংকা করছে পিটার হয়তো আত্মহত্যা করেছে। তানিয়াকে মিচ কল করে জানিয়েছে। পিটারের আত্মহত্যা প্রবণতার কথা সবারই জানা। আজ হয়তো সে সমাপ্তি টেনেছে অতৃপ্ত জীবনের।
প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও পিটারের সাড়া না পেয়ে চলে গেলো। মিচ বললো, বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশ দরোজা ভাঙতে পারেনা।
যদি সে আত্মহত্যা করে থাকে?
পরিবারের কেউ যদি অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ এ্যাকশন নিতে পারে, মিচ বলে, কিন্তু পিটারের পরিবারের কেউই কিছু বলে নি। তানিয়া এখন পিটারের কেউ না।
আশ্চর্য মানুষের জীবন! পিটার তানিয়ার দুই ছেলের জন্মদাতা এবং জীবনের বড়ো একটি অধ্যায় তাদের জন্য ব্যয় করেছে অথচ তারা ওর কেউ নয়? কি মূল্য আছে মানুষের জীবনের? পিটারের এই জীবন বাস্তবতা যেন পালিশ করা জীবনের উল্টো পিঠের দগদগে ঘা উন্মোচিত করে দিলো।
বাকী রাতটুকু ঘুমাতে পারলাম না। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে পাখিদের কলরব বাড়ে। আমি পাখিদের দানাপানি দিই, কাঠবিড়ালির জন্য ছড়িয়ে রাখি কিছু বাদাম এবং পথের বিড়ালদের জন্য জলখাবার। এরপর ইতিউতি হাঁটাহাঁটি করে পেছনের পার্কিং লটে আসতেই দেখি পিটার গেট খুলে বেরিয়ে আসছে। আমি দ্রুত ওর কাছে এগিয়ে গেলাম।
গুড মর্ণিং, ম্লান হেসে বলে পিটার।
কেমন আছো পিটার?
বেঁচে আছি, গাড়ির দরোজা খুলে আমার দিকে তাকালো।
কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই, কেন নয়, সায় দেয় পিটার।
রাতে কি হয়েছিলো?
নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলাম, নিরুদ্দিষ্ট কন্ঠ পিটারের, কিন্তু পারিনি।
কেন? আমি জানতে চাই।
একটাই তো জীবন আমার, উঠে আসা সূর্যের আলো থেকে চোখ সরিয়ে বলে, খুব ভালোবাসি।
এখন তাহলে কি করবে? আমি গলায় আনন্দ মেখে জানতে চাই। পিটারের সাহস বুঝি আমাকে নাড়া দেয়।
চলে যাবো নতুন জায়গায়, নতুন মানুষের কাছে, প্রত্যয়ের দীপ্তি পিটারের চোখেমুখে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জানালার গ্লাস নামিয়ে বলে, নতুনভাবে কাটিয়ে দেবো বাকী সময়। তুমি ভালো মনের মানুষ। ভালো থেকো।
গাড়ি ঘুরিয়ে পিটার চলে গেলো প্রধান সড়কের দিকে। দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে মনে পিটারের জন্য শুভকামনা করলাম। দেখি অন্যা পেছনের বারান্দায় এসে আমার অপেক্ষা করছে। নয়টায় দু’জনের বাৎসরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা। দেরি করা চলবে না। আমি পা বাড়ালাম।
জুন ২০, ২০২৩
====================