You are currently viewing জাহান্নামের পাশে আমাদের একটা বাড়ি আছে- মাসুম আহমদ

জাহান্নামের পাশে আমাদের একটা বাড়ি আছে- মাসুম আহমদ

আমার জন্ম গ্রামে। কিন্তু আমার জন্মের পর পরেই বাবা মা শহরে মুভ করেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি শহর থেকে খুব একটা দুরে না। গাড়িতে করে গেলে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো সময় লাগে। গ্রামে আমাদের একটা বাড়ি আছে। বাড়িটা দো’তলা দালান করা। বাড়ির সামনে দীঘির মতো একটা পুকুর আছে। সে পুকুরে শান বাঁধানোর ঘাট আছে। কথিত আছে আমাদের ইউনিয়নে আমাদের বাড়িটাই নাকি প্রথম দালান দো’তলা বাড়ি। দুর থেকে বাড়িটা অনেকটা আগেকার আমলের জমিদার বাড়ির মতো দেখতে লাগে। তবে এখন আমরা সবাই শহরে থাকার কারণে বাড়িটা একদম খালি পড়ে থাকে। আলী নামের একটা ছেলেকে বাড়িটা টেইক কেয়ার করে রাখার জন্যই রাখা হয়েছে। সে একাই সেখানে থাকে।

যখন ছোট ছিলাম তখন সামার ভ্যাকেশনে মা বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে গ্রামে নিয়ে যেতেন। সপ্তাহ দুয়েক সময় গ্রামে থাকতাম। বাড়ির পিছনের দিকে বিভিন্ন রকমের ফলের গাছ আছে। গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতাম। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে পুকুরে সাঁতার কাটতাম। সকালে উঠানে সবাই মিলে রোদ পোহাতাম। এই সময়টা আসলেই আমাদে ভাইবোন দুজনের খুব মজায় এবং আনন্দে কাটতো। আমি বড় হওয়ার পর কেন জানি মা বাবা হঠাৎ করে গ্রামে বেড়াতে যাওয়াটা বন্ধ করে দিলেন। তবে আমরা ভাই বোন এখনও এক/দুই বছর পরপর একবার গ্রামের বাড়ি যাই। সপ্তাহখানেক গ্রামের বাড়িতে থেকে আসি।

বাড়ির দু’তলায় আমাদের থাকার জন্য দুটি ব্যাডরুম সাজানো আছে। এমনিতে সে রুম দুটি বন্ধ থাকে। আমরা বেড়াতে গেলে কেয়ার টেকার আলী রুম দুটি খুলে পরিস্কার করে রাখে। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই গ্রামে যাওয়া আসা করি, তাই গ্রামের প্রতি সব সময়ই একটা অন্যরকম টান অনুভব করি। এরকম আসা যাওয়া করতে করতে আমাদের ভাই বোন দু’জনেরই গ্রামের মানুষের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তাই আমরা গ্রামে গেলেই গ্রামের প্রায় সবাই আমাদের খুব খাতির যত্ন করে। বিভিন্ন রকম পিটা পায়েস বানিয়ে খাওয়ায়। তাদের আতিথিয়তা, তাদের এই মায়া আমরা ভাইবোন দুজনে খুবই উপভোগ করি।

আমরা গ্রামের বাড়ি গেলে স্বাভাবিকভাবে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই আমাদের দেখতে বাড়িতে আসে। আমাদের পাশের বাড়িতে দুই জমজ দুই ভাই আছে নাম জামাল আর কামাল। তারা দুজন তো আমরা যাওয়ার পর সুপার গ্লোর মতো করে আমার সাথে লেগে থাকে। এই দুইটা ছেলে একটু অদ্ভুত  টাইপের। পড়াশুনা একদমই করেনি। একদম গণ্ডমূর্খ বলা যায়। তবে তারা দুজনেই প্রচন্ডরকম একরোখা গুয়ারটাইপ, বেয়াদব এবং খবিস। তারা দুই ভাই গ্রামের সবার সাথে সব সময় মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি করে। গ্রামের মেয়েদেরকে খুবই উত্তেক্ত করে। বাচ্চা থেকে শুরু করে জুয়ান, মুরব্বি সবাইকে জ্বালাতন করে। তাই এলাকার কারো সাথেই তাদের সম্পর্ক ভালো নেই। তাই এমনিতেই তাদের দুজন’কে গ্রামের কেউই পছন্দ করে না।

তারা দুই ভাই অন্য কারো কথা শুনে না, তারা কাউকেই পরুয়াও করে না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো যেমন খুশি তেমন করে চলাফেরা করে। তারা যেটা ভালো মনে করে সেটাই তারা করে বেড়ায়। তাদেরকে শাসন করার মতো কেউ নেই। তাদের বাবা তাদের গার্ডিয়ান। সামহাউ তাদের বাবা তাদের এসব খারাপ কাজকে সাপোর্ট দিয়ে যায়। এলাকার মানুষ তাদের বাবা’র কাছে তাদের দুই ভাইয়ের ব্যাপারে নালিশ দিলে তাদের বাবা এসবে একদমই পাত্তা দেয় না, উল্টা আস্কারা দেয়। কেউ বিচার নিয়ে গেলে ছেলেদের পক্ষ নিয়ে তাকে শাসিয়ে দেয়। তাই এলাকায় কথিত আছে তাদের বাবা’ই হলো তাদের নষ্টের মুল। তাই এলাকার মানুষ তাদের বাবাকেও পছন্দ করে না।

তারা দুই ভাই সব সময়ই একে অপরের সাথে থাকে। একসাথে ঘুরে, এক সাথে খায়, এক সাথে খেলায়, এক সাথে ঘুমায়, এক সাথে মারামারি করে। তাই তাদের মধ্যে কোনজন জামাল আর কোনজন কামাল সেটা বুঝা খুব মুশকিল। কারণ একে তো তারা জমজ, তার উপর তারা কথাও বলে একিরকম সুরে, একই স্টাইলে হাঁটাচলাও করে। এমন অবস্থা যে জামাল এসে যদি বলে আমি কামাল, কামাল এসে যদি বলে আমি আমি জামাল, তাহলে বুঝার কোন উপায় নাই যে সে আসলে কোনজন। তাদের মধ্যে জামাল ষাড় পালে, তার দুইটা বিশাল ষাড় আছে। আর কামাল মোরগ পালে। কামালের কয়েকটা মোরগ আছে। এই ষাড় এবং মোরগ পালাই হলো তাদের দুইভাইয়ের একমাত্র কাজ। যখন ষাড়ের লড়াই বা মোরগের লড়াইয়ের সিজন আসে, তখন তাদের দুই ভাই খুব ব্যস্ত থাকে। তারা দু’ভাই মিলে এসব লড়াইয়ে টুনামেন্ট আয়োজন করে।

তাদের মা বছর সাতেক আগে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলেন। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। অবশেষে তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে তারা গ্রামের সবাইকে বললো- তাদের মাকে নাকে জ্বিনের বাদশা নিয়ে গেছে। তাদের বাবা মতলব মিয়া শাক সব্জিরর ব্যবসা করেন। তাদের বাবাও একটু অদ্ভুত টাইপের লোক। তিনি খুব কম কথা বলেন। আর হাঁটেন উঁকি দিয়ে দিয়ে দিয়ে। দুর থেকে তাকে মনে হয় লাঁফাতে লাঁফাতে তিনি আসছেন। তার একটা নিয়মিত অদ্ভত অভ্যাস আছে। সে প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেনো চলে যায়। এবং কিছুুদিন পর সে আবার ফিরে আসে। প্রথম প্রথম তাকে খুঁজতে গ্রামের মানুষ বের হতো। কিন্তু এখন আর কেউ খুঁজতে বেড় হয় হয় না। কারণ তার এই অভ্যাসের কথা গ্রামের  সবার জানা হয়ে গেছে।

গতবার যখন গ্রামের বাড়ি গেলাম, তখন জামাল কামালের বাবা বরাবরের মতো আমাদের দেখতে বাড়িতে আসলেন। আমরা তাকে মতলব চাচা বলে ডাকি। আমি তাকে দেখে তো একদমই চিনতে পারলাম না। কারণ সে একদম মাওলানাদের মতো হয়ে গেছে। মুখে লম্বা সাদা দাঁড়ি, পরনে লম্বা পাঞ্জাবি, মাথায় পাগড়ি। তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝলাম, তিনি তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত হয়েছেন। এখন বছরের অধিকাংশ সময়ই তাবলীগে কাটান। উনার ভাষ্যমতে উনি সারাজীবন অনেক পাপ করেছেন, এখন উনার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই আল্লাহর রাস্তায় উনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন।

মতলব চাচা যখন আমাদের বাড়িতে আসেন, তখন উনার সাথে একজন মধ্য বয়সি মহিলাও ছিলেন। পরে জানতে পারলাম উনি আরেকটা বিয়ে করেছেন। আর উনার সাথের মহিলা হলেন উনার নতুন বউ। আরও জানতে পারলাম, উনি যে বছরে একবার কাউকে না বলে নিরুদ্দেশ হন, উনি আসলে সুনামগঞ্জের শাল্লা এরিয়ায় একটা সাতদিনের মেলা হয়, উনি সেই মেলায় যান। গতবার মেলায় যাত্রা দেখতে গিয়ে এই মহিলার সাথে নাকি উনার পরিচয় হয়। এবং একটা সময় মহিলাকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন, মহিলাও রাজি হয়ে যান। তারপর তাকে বিয়ে করে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন।

আমরা যতদিন বাড়িতে ছিলাম মতলব চাচার নতুন বউ প্রতিদিনই এসে আমাদের রান্না করে দিয়েছেন। ঘর দোয়ার পরিস্কার করে দিয়েছেন। এই আসা যাওয়া করতে করতে আমার বোনের সাথে তার বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। সম্পর্ক হওয়ার কারণে সে আমার বোনের সাথে তার জীবনের অনেক গল্প করেছে। সে কিভাবে বড় হয়েছে, কিভাবে তার বাবা তাকে যাত্রা দলের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো, কিভাবে যাত্রার মালিক তাকে রেগুলার ধর্ষণ করতো, কিভাবে অবশেষে জামাল কামালের বাবার সাথে তার বিয়ে হলো। এবং কিভাবে সে এখন প্রেগন্যান্ট।

আমার বোন গ্রাম থেকে শহরে ফিরার পথে যখন এই মহিলার সবকিছু আমাকে বলছিলো, তখন মহিলার সবকিছু শুনে তার জন্য কিছুটা খারাপ লাগলো। কিন্তু অবশেষে মহিলার একটা সংসার হয়েছে,  এখন বাচ্চা হবে এসব শুনে কিছুটা ভালো লাগলো। মতলব চাচাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। লোকটা যতোই খারাপ হউক না কেন অন্তত জীবনে একটা ভালো কাজ করেছে। একটা জনমদু:খী মহিলাকে বিয়ে করে তার দু:খের ভাগটা কিছুটা কমিয়েছে। আমি যখন মতলব চাচার প্রশংসা করছিলাম সেটা শুনে আমার ছোট বোন যেটা শুনালো, সেটা শুনে তো আমি একদম বোবা বনে গেলাম। এরকম কিছু শুনবো তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। মনে হলো আমি কিছুক্ষনের জন্য বরফ হয়ে গেছি।

আমার বোন যা বললো তার সারমর্ম হলো – এই মহিলার বাচ্চার বাবা মতলব চাচা না। বাচ্চার বাবা হলো জামাল বা কামালের মধ্যে যে কোন একজন হবে। মহিলা নিজেও জানেনা তাদের দুজনের মধ্যে কে বাচ্চার বাবা। কারণ মতলব চাচা যখন তাবলিগে চলে যান, তখন প্রতিরাতে পালাক্রেমে তাদের দুজনের কেউ একজন এসে মহিলাকে ধর্ষন করে। মহিলা চিনতে বা বুঝতে পারে না দুজনের  মধ্যে কোনজন কখন আসে। তবে এটা নিশ্চিত তারা দুজনই পালাক্রমে আসে। কোন রাত দুজন মিলে সারারাত ধরে মহিলাকে যৌন নির্যাতন করে। প্রথম যেদিন ঘটনা ঘটে তখন সে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তারা দুই ভাই মিলে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে ধরে প্রায় মেরে ফেলে দিয়েছিলো। তারা তাকে খুব কড়া ভাষায় সতর্ক করে বলে দিয়েছে, যদি সে এসব ঘটনা অন্য কাউকে বলে বা তাদের এই কাজে বাঁধা দেয়, তাহলে তারা তাকে এরকম বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলে এই ঘরের মধ্যেই কবর দিয়ে দিবে! তাছাড়া এই ছেলে দুইটি নাকি প্রচন্ডরকমভাবে সেক্স এডিক্ট এবং তাদের যৌন বিকৃতি রোগ আছে। তারা নাকি তাদের মোরগ এবং ষাড়ের সাথেও সেক্স করে।

প্রথম ঘটনার পর মতলব চাচা যখন তাবলীগ থেকে বাড়িতে ফিরলেন, তখন মহিলা কিন্তু তাকে সব খুলে বলেছিলো। উনি সব শুনে একটুও অবাক হলেন না বা কোন রকম রিয়েকশন দেখালেন না। উনাকে দেখে মনে হলো এই ঘটনা তার কাছে একটা অন্য দশটা ঘটনার মতোই স্বাভাবিক। মনে হলো এই ঘটনা তার কাছে খুব এক্সপেক্টেড। কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে উল্টা মহিলাকে কাছে ডেকে নিয়ে খুব নরম সুরে শাসিয়ে বললেন, এই ঘটনা যেনো বাহিরের কেউ কোনভাবেই না জানে। যদি কোনভাবে বাহিরের কেউ এসব কিছু জানে, তাহলে কি অবস্থা হবে সেটা তো ছেলেরা বলেই দিয়েছে। তারপরেও আমি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, একদম ছেলেদের মায়ের মতো করে জ্বিনের বাদশার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

আমি সব শুনে খুব অবাক হচ্ছিলাম আর কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হয়েছে। তাহলে মতলব চাচা’র প্রথম বউয়ের কি হয়েছে? তাহলে কি তারা বাপ ছেলে তিনজন মিলে তাকে মেরে ফেলে ঘরের মধ্যেই কবর দিয়ে দিয়েছে? তাছাড়া মতলব চাচা কি জেনেশুনেই তার ছেলেদের জন্য এই মহিলাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন? এসব প্রশ্ন যখন আমার মাথায় ঘুরছিলো, তখন আমি অসুস্থ অনুভব করছিলাম। ছোটবোন’কে জিজ্ঞেস করলাম, এই মহিলা কেন পালিয়ে চলে গেলো না বা যাচ্ছে না? বোন উত্তরে বললো – মহিলা পালিয়ে যাচ্ছে না কারণ এই মহিলার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। যাত্রাদল থেকে মালিকের অমতে চলে এসেছে, তাই যাত্রাদলও তাকে আর নিবে না। সেটা শুনে আমি আমার বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এখন উপায় কী? আমার বোন আমাকে বললো, উপায় একটাই আছে। আর সেটা হলো এই মহিলাকে কাউকে না কাউকে এই সাইকো বাবা এবং তার সেক্স এডিক্ট ছেলেদের কাছ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং ওদেরকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে তাদের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি ঘুরাও……… আমরা আবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি।