You are currently viewing জন্মদিনের হার্দিক শুভেচ্ছাঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্মদিনের হার্দিক শুভেচ্ছাঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্মদিনের হার্দিক শুভেচ্ছাঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাসাহিত্যে বিপ্লবী সমাজচেতনায় উজ্জীবিত কথাসাহিত্যিক যিনি মাত্র ৪৮ বৎসর বয়েসে একটা ঝড় তুলে অনন্য অবস্থান তৈরি করে গেছেন। “কলম পেষা মজুর” মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রেখে গেছেন ৩৬টি উপন্যাস, ২৫০টি গল্পের সম্ভার। তাঁর আসল নাম ছিল, প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।  আমরা জানি যে, বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যের প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণের সাহিত্যে এসেছে প্রকৃতি ও মানুষ। তারাশঙ্কর রচনা করেছেন রাঢ় বাংলার জনজীবনকে নিয়ে। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যে ফুটে উঠেছে বিজ্ঞান মনস্কতা আর মার্ক্সীয় ভাবনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মূহুর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শ্রমজীবী মানুষের জীবনযন্ত্রনা, ফ্রয়েডীয় দর্শন ও মার্কসীয় দর্শনে মিশ্রিত ছিল তাঁর সাহিত্য সম্ভার। তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনায় মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোলোক বিশ্লেষণে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় নিপুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এ পর্যায়ের রচনায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে চরম দারিদ্রে্যর সম্মুখীন হয়েছেন, তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরেছেন। এক সময় তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর জন্য সাহিত্যিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। এসব কারণে দারিদ্র্য মানুষের স্বভাবে কী পরিবর্তন আনে, বিশেষত যৌনাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উদরপূর্তি কী সমস্যার সৃষ্টি করে তার একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গন্থ: উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি; আর ছোটগল্প অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি। পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা  উপন্যাস দুটি তাঁর বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মানদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে যোগ দেন ১৯৪৩ সালে । তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন ১৯৪৪ সালের শেষদিকে । এ বছর শুরুতেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ থেকে ‘কেন লিখি’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে প্রমুখ পনেরোজন লেখকের মধ্যে সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন। তিনি লিখেছে: ‘লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যে সব কথা বলা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি।’ এবং শেষ করছেন: কলম-পেষার পেশা বেছে নিয়ে প্রশংসায় আনন্দ পাই বলে দুঃখ নেই, এখনো মাঝে মাঝে অন্যমনষ্কতার দুর্বল মুহূর্তে অহংকার বোধ করি বলে আপসোস জাগে যে, খাঁটি লেখক কবে হব।’

আমরা জানি যে, এই কথা বলার আগেই তিনি ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘চতুষ্কোণ’ (১৯৪২) প্রভৃতি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। খাঁটি লেখক না হতে পারার আফসোসের জবাবে মানিক বললেন, ‘দুটো দল হয়ে গেছে, উপায় কি? ব্যক্তিগতভাবে ব্যক্তিপ্রীতির দল এবং জনসাধারণের নৈর্ব্যক্তিক স্বজাতি প্রীতির দল। দ্বিতীয় দলে গত না হলে প্রগতি হয় না।’ তিনি শুধু ভালো লেখা না, তাঁর সাহিত্যের গন্তব্য সম্পর্কেও পরিস্কার হয়ে গেলেন।  মার্কসবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে তাঁর লেখার মান কি আমূল বদলে গেল?  মানিকের সাহিত্যকর্মকে সরলীকরণ করা হয় দুই পর্বে ভাগ করে—কমিউনিস্টপূর্ব পর্ব এবং কমিউনিস্ট পর্ব; অর্থাৎ ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫) থেকে ‘প্রতিবিম্ব’ (১৯৪৩) এবং ‘দর্পণ (১৯৪৫) থেকে ‘মৃত্যুকাল’ (১৯৫৬) পর্যন্ত একটি বিভক্ত রেখা টেনে বলা হয় যে, তাঁর দ্বিতীয় পর্বের রচনায় ‘অপকর্ষ ঘটেছিল।’ এই সরলীকরণ কতোটুকু যৌক্তিক? মানিকের প্রথম জীবনের লেখাগুলো বেশি উৎকৃষ্ট- সেটা অনস্বীকার্য। আমাদের এটা স্বীকার করতে হবে যে,  রাজনীতিতে জড়িত হবার আগে থেকেই মানিকের শ্রেণিচেতনা তার রচনায় শুরু থেকেই ছিল। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫) থেকেই মানুষ আর সমাজকে তিনি তীর্জক দৃষ্টিতে দেখতে চাইছিলেন। তার চরিত্ররা নানাভাবে শ্রেণিগত অবস্থানের শিকার। মধ্যবিত্তের জীবনে প্রেম, শরীর, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বিদ্বেষকে তিনি যেভাবে দেখেছেন সেভাবে তাঁর সমকালে আর কেউ দেখেননি। মধ্যবিত্তের কথাকার ছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যের অন্য দুই দিকপাল বিভূতিভূষণ এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু মানিক তাঁদের মতো রোম্যান্টিক বাস্তববাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্যক্তির মনোবিকারের নিষ্ঠুর কথাকার। ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে—এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ (পদ্মানদীর মাঝি, ১৯৩৬) এই উপলব্ধি তাঁর আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কসবাদী হয়ে ওঠার প্রায় এক দশক আগেই হয়ে গেছে। তাই মানিক শুরু থেকেই সমাজ বদলের রাজনীতিটা করেছেন তার লেখার মধ্য দিয়ে। মানিকের সাহিত্যের শিল্পগুণকে খন্দিত করার জন্য যারা মনে করেন যে, কমিউনিস্ট দলে নাম না লেখালে মানিক আরেকটা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ লিখতে পারতেন, তাদের জানা উচিত, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ একবারই লেখা সম্ভব। পাশাপাশি এটা যৌক্তিকভাবে স্বীকার করতে হবে যে, প্রত্যেক সৃজনশীল প্রতিভারও স্বাভাবিক ক্ষয় আছে। এটা কোনোভাবেই ‘অপকর্ষ’ হতে পারে না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এর যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। দুবার তিনি এ সঙ্ঘের সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে ঐক্য ও মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের গণসাহিত্য শাখায় এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ আয়োজিত জোসেফ স্টালিনের শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু।

তার মৃত্যুর পর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা “পাথরের ফুল”।
“ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে পছন্দ আগুনের ফুলকি,
যা দিয়ে কোনদিন কারো
মুখোশ হয় না।”

===============