You are currently viewing ছোটবেলার স্কুল/ মহুয়া বৈদ্য

ছোটবেলার স্কুল/ মহুয়া বৈদ্য

ছোটবেলার স্কুল / মহুয়া বৈদ্য

****************************

রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়। এই নাম মনে পড়লেই বুকের মধ্যে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় এখনো। তেতাল্লিশ বছর বয়স হল, মানে, স্কুল ছেড়ে এসেছি আজ পঁচিশ বছর। অথচ এত উজ্জ্বল স্মৃতি…  চোখ বুজলে দশ মিনিটে স্কুল বাড়ির প্রতিটি কোণ ঘুরে চলে আসতে পারি, এত চেনা। ক্লাস টু থেকে ক্লাস টুয়েলভ সুদীর্ঘ দশ বছর প্রতিদিনের চলাচল।সত্যি সত্যিই আমার দ্বিতীয় বাড়ি… আমাদের রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়। তবে, এই লেখায় শুধুমাত্র প্রাথমিক স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করছি।

স্কুল  সম্বন্ধে ভয়ের জায়গা আমার ছোট থেকেই ছিল না। আমার মা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার বহু আগে থেকেই আমি মায়ের সাথে মাঝেমধ্যেই স্কুলে যেতাম এবং দাদাদিদিদের আদরে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাড়ি ফিরতাম। স্কুলের সব গল্প বাবার কাছে সন্ধ্যে বেলা বেশ ঘটা করে করতাম। কে লজেন্স দিল, কোন দাদা লিচু খাওয়ালো, কোন দিদি জামরুলের ভাগ দিল… এসবে তখন স্কুল মানেই আনন্দঘন জায়গা। স্কুলজীবনের প্রথম তিনটে বছর আমার এমন আহ্লাদেই কেটে গেছে। তবে শুধু আহ্লাদ নয়, আমি এই স্কুলে প্রথম হতাম। মায়ের এই স্কুলের নাম ছিল বিশালাক্ষ্মী বিদ্যামন্দির। সরকারী বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এটি। আমার প্রথম স্কুল। ক্লাস ওয়ান পাস করার পর মা আমাকে আর নিজের স্কুলে রাখতে চাইলেন না, আমার আহ্লাদের দিন শেষ হল।

ক্লাস টু তে আমি রাসমণি বালিকা বিদ্যালয় এ ভর্তি হই,১৯৮৩-৮৪ র শিক্ষাবর্ষে। তখন প্রাথমিকে কোনো পরীক্ষা দিতে হয় নি। আমার রেজাল্ট দেখিয়ে সরাসরি ভর্তি হতে পেরেছিলাম। রাসমণি বালিকা বিদ্যালয় তখন বারুইপুর অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ মেয়েদের স্কুল। বিশাল তিনতলা বিল্ডিং। অসংখ্য ক্লাস রুম। এর প্রাথমিক বিভাগ হত সকাল বেলায়, সকাল ৬ঃ৪৫ থেকে ১০ঃ০০। প্রাথমিক বিভাগটি কো-এড ছিল। ছাত্রছাত্রী একসাথে পড়াশুনা করত, আর এর উচ্চ বিদ্যালয়টি ছিল শুধুমাত্র ছাত্রীদের জন্য। সেটি শুরু হত সকাল ১০ঃ৪৫। দুটি স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

ক্লাস টু তে ভর্তির প্রথম দিনে অতবড় স্কুলবাড়ির কোথায় কি কিছুই না বুঝলেও তেমন সমস্যা হয় নি। বাবার সাথে সাইকেলে  চেপে স্কুল গেলাম, বাবা ক্লাসঘর কোনটি জেনে বসিয়ে দিলেন। ছুটির সময় চেনা রিক্সাকাকুর রিক্সায় চেপে বাড়ি এলাম। পরের দিন ভোর ভোর উঠে রিক্সা চেপে স্কুলে গিয়ে আগের দিনের ঘরেই বসেছি। দেখি আগের দিনের সহপাঠীরা একজন ও নেই…তবু বসে আছি। অন্যরা আমাকে জ্বালাচ্ছে, “এটা তোর ঘর না” বলে…আমি তবু বসে আছি। এমন সময় দিদিমণি এসে নাম ডাকার আগে নতুন মুখ দেখে কোন ক্লাস জিগ্যেস করেই বললেন, “এই ঘর নয়, তুমি ঘর খুঁজে নাও”। আমি পড়লাম অকুল পাথারে। অতবড় বাড়ির কোথায় আমার ক্লাসঘর! তখন অত রুমাল ব্যবহারের ব্যাপার ছিল না, একহাতে সুটকেস আর একহাতে স্কুল ড্রেসের টিউনিক তুলে চোখ মুছতে মুছতে দোতলার সমস্ত ঘরে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারতে থাকলাম চেনা সহপাঠীদের খোঁজে। কেউ  নেই সেখানে। এত অসহায় লেগেছিল যে, সেই  অনুভূতি এখনো মনে রয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে নীচে নেমে আসতে একজন দিদি খুব আদর করে চোখের জলটল মুছিয়ে আমার ক্লাসঘরে আমাকে পৌঁছে দিলেন। আমিও চেনা  বন্ধুদের মুখ দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নতুন স্কুলে আসার পর আমার নতুন রুটিন তৈরি হল। ভোর বেলা, কত ভোর তা জানি না, মা আমায় ডেকে তুলেই মুখে ব্রাশ ঘষে দিত, আর তারপরেই জলের ঝাপ্টা। তবু যেন ঘুম কাটতে চাইত না। আগের দিন সন্ধ্যায় পড়ার শেষে রুটিন দেখে বই সুটকেসে গুছিয়ে রাখতাম। ঘুম চোখেই মা বাসি জামা ছাড়িয়ে  স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিত। সাদা শার্ট আর কমলা টিউনিক, কোমরে কমলা বেল্ট, পায়ে সাদা মোজা, কালো ব্যালেরিনা বাটার জুতো– এই ছিল স্কুল ড্রেস। এর সাথে মা চুল বেঁধে দিত, দুদিকে দুটো ঝুঁটি। এসব করতে করতেই প্রায় দিন রিক্সাকাকু এসে যেতেন। রিক্সাকাকুর নাম ছিল ব্যাচা। আমরা ব্যাচাকাকু বলে ডাকতাম। মা তখন তাড়াহুড়ো করে দুটো পাউরুটিতে আঙুলে করেই মাখন লাগাচ্ছে, হাতের কাছে চামচ খুঁজে না পেয়ে… যাহোক করে চিনি ছড়িয়ে আমার অ্যালুমিনিয়াম টিফিনবক্সে ভরে সুটকেসে দিয়ে দিচ্ছে। অথবা মুড়ি চানাচুর, বিস্কুট…যখন যা থাকত। আমি ঢকঢক করে এককাপ হরলিক্স আর আধখানা বিস্কুট খেয়ে রিক্সায় উঠে পড়ছি। রিক্সায় একবার উঠে পড়লাম মানে আমার অপার আনন্দ। তখন বারুইপুর এত ঘিঞ্জি ছিল না, রাস্তার দুপাশে জারুল অমলতাস কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছের সারি ছিল। তার মাঝ দিয়ে  পাকা রাস্তায় রিক্সা করে যাচ্ছি। ভোরের মৃদু হাওয়ায় কী অপার্থিব শান্তি! শীতকালে একটু কষ্ট হত, ঠান্ডায় গুটিসুটি হয়ে রিক্সার এককোণে বসে থাকতাম। কুয়াশা কেটে রিক্সা এগিয়ে যেত! শীতের পরে বসন্ত এলেই রাস্তার দুই ধারে রঙের উৎসব যেন। হলুদ লাল বেগুনি কমলা রঙের  তুফান ছুটত। বেগনে রঙের জারুল ফুলে আমি এত মুগ্ধ ছিলাম যে প্রায়ই ব্যাচাকাকুকে বলতাম ফুল পেড়ে দিতে। এক দুবার দিয়েছেও কাকু। এত রঙ আর এত মৃদু হাওয়ার মধ্যে স্কুলে যেতাম, স্বপ্নের মতো মনে হয় এখন। শহুরে নাগরিকতা বারুইপুরের সেই সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে।

নতুন স্কুলে যে বিষয়টি সবচেয়ে ভালো ছিল, তা হল অনেক ধরণের নতুন বই। মায়ের সাথে এগুলি মলাট করতে বসা আমার খুব আনন্দের কাজ ছিল। প্রত্যেক বিষয়ের জন্য ছিল দুটো করে খাতা। একটা ক্লাস ওয়ার্ক, আরেকটা হোম ওয়ার্ক। সেগুলিতেও মলাট দিয়ে নেমপ্লেট সাঁটতাম। এই প্রথম নেমপ্লেট নামক ব্যাপারটির সাথে পরিচিত হলাম। বইগুলির মধ্যে,সহজ পাঠ, কিশলয়, নব গণিত মুকুলে পড়াশুনা শেষ হত না আগের স্কুলের মতো। এর সাথে ছিল দারুণ একটা গল্পের বইয়ের মতো বই, ব্যাকরণের বই, মণিষীদের জীবনী এইসব। প্রথম যে বইটি পেয়েছিলাম, “দেশবিদেশের ছেলেমেয়ে” তার নাম। সারা পৃথিবীর সব ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল কেমন সেই নিয়ে দারুণ লেখা। চীন দেশের ছেলেমেয়েরা স্কুলেই যা পড়ার পড়ে ফেলে, আর রাতের বেলা জোছনার আলোয় লুকোচুরি খেলে বেড়ায় শুনে কি আফসোসই না হয়েছিল। জাপানের ছেলে মেয়েরা পেনের বদলে তুলি দিয়ে লেখে এই বই থেকেই জেনেছিলাম। আর ছিল হাতের লেখা সুন্দর করার বই। ড্রইং বই। খুব প্রিয় ছিল আঁকার বিষয়টি। এই স্কুলে এসে আমি প্রথম দেখলাম রঙের বাক্স ২৪ রঙের হয়! আর ক্যামেলের রঙ সবচে ভালো। আর একটা বিদঘুটে জিনিস ছিল,পেপার কাটিং এর বই। বিভিন্ন রঙের মার্বেল পেপার বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারে কেটে গঁদের আঠা দিয়ে জুড়ে বইয়ের অদ্ভুত জ্যামিতিক ছবিগুলি কোলাজ করতে হত। এই ব্যাপারটায় আমি মোটেই পটু ছিলাম না, আর মা গুছিয়ে কেটে করে দেবে,এমন কথা আমার মা ও স্বপ্নে ভাবতে পারতেন না। ফলে সবচেয়ে এবড়ো খেবড়ো করে কাটা কাগজ অনেক গঁদের আঠা দিয়ে জুড়ে যাহোক একটা কিছু তৈরি হত। এছাড়া প্রতি মাসে আমাদের একটা হাতের কাজ জমা দিতে হত। ক্লাস টু তে প্রথম করেছিলাম মাটির ফলের ঝুড়ি, তার নারকোলটি ভারি সুদৃশ্য হয়েছিল মনে আছে। তবে সবচে সুন্দর হয়েছিল সুধন্যার নারকোল,ও আসল নারকোলের মালা থেকে ছোবড়ার গুঁড়ো আঠা দিয়ে মাটির নারকোলের গায়ে লাগিয়ে নারকোল তৈরি করায় খুব প্রশংসিত হয়েছিল। তারপর দেশলাই বাক্স দিয়ে সোফাসেট, কাগজের বাক্স দিয়ে বাস, কাগজের জিরাফ এসব ও বানিয়েছি। এখানে এসে সব নতুন বন্ধু হল…  মৌপিয়া, সুধন্যা, তপতী, দেয়ালী খান, তিয়া… যে বিষয়টা খুব অদ্ভুত লেগেছিল, মোটামুটি ১০/১২ জনের একটা দল ছিলাম আমরা, আর সেই দলের রাজা হত মৌপিয়া এবং সুধন্যা পালা করে! এবং ওদের অর্ডার রীতিমতো মানতে হত, নাহলে দল থেকে বাদ, তুমি একঘরে। বিশালাক্ষ্মী স্কুলের আদুরে আহ্লাদী মেয়েটার বড্ড কষ্ট হয়েছিল এই রাজাগিরি মেনে নিতে। পুজোর সময় বিভিন্ন বন্ধুরা পরস্পরকে উপহার দেবে। কে কি দেবে সেটাও রাজামশাই ঠিক করতেন। আর,সবচেয়ে পাকামোর  বিষয়টি হল, এখানে এসে ক্লাস টু তেই প্রেম বিষয়ক জ্ঞান আমি অর্জন করে ফেললাম। ক্লাসের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা অল্প ছিল, ওরা দুটি বা তিনটি বেঞ্চ নিয়ে আলাদা বসত। এদের নিয়ে তুমুল আলোচনা করত রাজা উজীরের দল এবং নামের সাথে নাম মিলিয়ে কে কার সাথে প্রেম করবে দেগে দিত, যেমন সুধন্যা-সৌমাভ, দেয়ালী- দেবব্রত…এইরকম। আমার নামের সাথেও মানস নামে একটা বেড়াল চোখো ছেলের নাম জুড়ে দেওয়া হল, যাকে আমার একটুও পছন্দ হল না! এইসব চাপে আমার পড়াশুনার রেজাল্ট তেমন ভালো হল না ক্লাস টু তে, থ্রী ও সেভাবেই গেল। প্রাথমিক স্কুলে দিদিমণিরা ছিলেন খুবই প্রথাগত। শুধু সমস্ত চুল সাদা হয়ে যাওয়া আশ্চর্য লাবণ্যময়ী রেখাদি কে খুব মনে আছে। তিনি আমাদের বড়দি ছিলেন। খুব নরম স্বরে কথা বলতেন। তাঁর ক্লাস আমার বড়ো ভালো লাগতো।

এবার একটু স্কুলের খাবারদাবারের কথায় আসি। ক্লাস ফোরে বা থ্রী তে  আমাদের টিফিনের সময় পাউরুটি দেওয়া শুরু হল। সে এক বিশাল প্রাপ্তির ব্যাপার ছিল আমার কাছে। এই ছোট্ট একটা টুকরো! তাই পেতে কি উন্মুখ থাকতাম! তবে অনেকেই খেতো না, ফেলে দিত। অমুক স্কুলে পাউরুটির মধ্যে মোরব্বার মতো আরশোলা ছিল, এসব খবরও হাওয়ায় উড়ত। আর ততবেশি পাউরুটি ফেলা যেত। এসব কথায় আমি কান দিতাম না। স্কুলের পাউরুটির স্বাদ আমার দারুণ লাগতো। টিফিনের সময় পান্ডেকাকুর দোকানে দড়ি ছেঁড়া ভিড় হত।পান্ডেকাকু আমাদের স্কুলের দ্বার-রক্ষক ছিলেন আর টিফিনে দোকান দিতেন। বিটনুন,কাঠি চাটনী,আঙুল পাঁপড় এই তিনটে জিনিস খুব কিনতাম। মনে আছে আঙুল পাঁপড়ের দাম ছিল পাঁচ পয়সা, একটাকায় কুড়িটার প্যাকেট পাওয়া যেত। পাঁপড়গুলি ছিল হলুদ রঙের গোল বাঁশের লাঠির মতো মোটা, আর মাঝখানটায় ফাঁপা। এক বিঘৎ এর মতো লম্বা।মাঝের ফাঁপা জায়গায় আমাদের কচি আঙুল বেশ ফিট করে যেত। ২৫ পয়সায় পাঁচটা পাঁপড় কিনে পাঁচটা আঙুলে গুঁজে খাওয়াটা একটা শ্লাঘার বিষয় ছিল। কাঠি-চাটনী আর বিটনুন ছিল দশ পয়সা করে। বিটনুন কে কতক্ষণ জিভের ডগায় নিয়ে থাকতে পারে সে নিয়ে কম্পিটিশন হত রীতিমতো। আর, কাঠি- চাটনী বিটনুনে ডুবিয়ে খাওয়ার মতো স্বর্গীয় ব্যাপার স্যাপার স্কুলজীবনেই ঘটে থাকে। বাকি রইল ক্রীমরোল, সে তো রাজকীয় খাবার। একটা ক্রীমরোলের দামই ৫০ পয়সা। যেদিন জুটত, আমরা চারপাশের বিস্কুট গুলো কুরকুরে দাঁতে খেয়ে নিয়ে ক্রীমটা বাঁচিয়ে রাখতাম,শেষে খাবো বলে।পান্ডেকাকুর বউ হাসিদির মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত। হাসিদি দিদিমণিদের চা বানিয়ে দিতেন। পান্ডেকাকু ছাড়া আরেকজন দিদা বসতেন আলু মাখন মরিচ মাখা নিয়ে। ২৫ পয়সায় একটা প্যাঁচানো হাতে তৈরি কাগজের কোণের মতো মোড়ক ভরে আলু-মাখা দিতেন… অসামান্য স্বাদ! আহা!

এসব খাওয়া দাওয়ার পয়সা যেদিন কারো কাছেই থাকত না, সেদিন যাহোক করে বাড়ির টিফিন খেয়েই আমাদের শুরু হত ধরাধরি খেলা। দশ- কুড়ি গুনে কেউ একজন চোর সাব্যস্ত হত, এবার সে যতক্ষণ না কাউকে ধরতে পারছে, তার নিস্তার নেই। যাকে ধরবে সে তখন চোর হয়ে অন্যজনকে ধরতে ছুটবে… উফ! কি খেলা যে খেলেছি! একতলা থেকে তিনতলা অন্তত  পাঁচবার ওঠা-নামা হত! টিফিনের ঘন্টা শেষ হলে, ক্লাসঘরে ফিরে হ্যা হ্যা করে হাঁফাতে হাঁফাতে সে কি জল খাওয়া চলতো রে বাবা! অনেক সময় দিদিমণি এসে যেতেন, আমরা তখনো হাঁফাচ্ছি! বকাও খেয়েছি এজন্য।

এইভাবে ক্লাস টুতে একতলার ঘর, থ্রীতে দুই তলার ঘরে ক্লাস করে আমরা ক্লাস ফোরে তিনলার সর্বোচ্চ ঘরে বসলাম। ওখান থেকে ট্রেন যাচ্ছে দেখতে পেতাম। ক্লাস থ্রী পর্যন্ত হাজার খানেক ছেলে মেয়েদের আমরা দিদি, এ ভাবতেই কলার উঁচু হয়ে যেত। একদিন দিদিমণিরা পিটির ক্লাসে আমাদের ছাদে নিয়ে গেলেন। তখন শীতকাল। হালকা রোদ উঠছে। কি অসামান্য লেগেছিল অত উপর থেকে চারপাশ দেখতে! সেই প্রথমবার অত উপর থেকে  পৃথিবী দেখলাম! আশ্চর্য!  সুন্দর! অবর্ণনীয়!

ক্লাস ফোরে আমাদের পড়াশুনার চাপ বেশ বেড়ে গেছিল। এর কারণ ছিল তখনকার অ্যাডমিশন টেস্ট। যথেষ্ট যোগ্যতামান পার না করলে আর কোনো স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে পারব না, এই ভয় সবাইকে তাড়া করতো। ক্লাস ফাইভের অঙ্ক ইংরেজি বই এবং ” দেখব এবার জগৎটাকে” নামক জি.কে বই চষে ফেলা গেল এবং সে বছর বার্ষিক পরীক্ষার পরও রেহাই মিলল না। বার্ষিক পরীক্ষার প্রায় তিন সপ্তাহ পরে রাসমণির উচ্চমাধ্যমিক স্কুলেই অ্যাডমিশনের পরীক্ষা দিলাম, বেশ ভালোই দিলাম মনে হল। এর পরে পরেই বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো। এই প্রথম, সববিষয়ে “ক” পেলাম। তখন নাম্বারের বদলে গ্রেড দেওয়া হত। এরপর একদিন সকালে রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় ভর্তির রেজাল্ট বেরোবে জানা গেল। গেলাম। বোর্ডের সামনে প্রচুর ভিড় ঠেলে মা আমার নাম উদ্ধার করতে পারলেন।হাসিমুখে বলল, “যাক পেরে গেছিস”। তারপর, ওধারে একটা বোর্ড-স্ট্যান্ডের উপর বেশ উঁচু করে একটা বোর্ড রাখা দেখে আগ্রহবশতঃ মা এগিয়ে গেল। ওটা যারা পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছে,তাদের নামের বোর্ড। ওমা! কি আশ্চর্য!  অই বোর্ডে পঞ্চম স্থানে আমার নাম রয়েছে! সত্যি রয়েছে! এতদিন গোটা প্রাইমারিতে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে আসা কারো নাম সেই বোর্ডে ছিল না।

প্রাথমিক স্কুলের পর্ব এইভাবে শেষ হল, আমি উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুনা শুরু করলাম। রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্বের এখানেই সমাপ্তি ঘটল ।