You are currently viewing ঘোরগ্রস্ত স্বপ্ন আর পেরেকের ঘর/ শাখাওয়াত বকুল 

ঘোরগ্রস্ত স্বপ্ন আর পেরেকের ঘর/ শাখাওয়াত বকুল 

ঘোরগ্রস্ত স্বপ্ন আর পেরেকের ঘর

শাখাওয়াত বকুল

একজন ঘোরগ্রস্থ মানুষের স্বপ্ন, হতাশা আর পীড়ন নিয়ে জামিল যখন বাজারের মাঝখানের গলিটা দিয়ে শাহজাদপুরের মোড়টায় এসে দাঁড়ায়, তখন আযানের মিহি সুর তার কানে এসে লাগে। আযানের  আহবানকে প্রায় উপেক্ষা করেই সে কাঁধের ব্যগটা নিয়ে এগুতে থাকে। তখনো চারদিক রাতের অন্ধকারকে পুরোপুরি বিসর্জন দেয়নি। সূর্য অপেক্ষায় আছে একটি বিষন্ন দিন উপহারের আশায়। চারদিকে করোনাকালের বিধিনিষেধ মানা আর  না মানা নানান আয়োজন।জামিল জনপ্রশাসন মন্ত্রীর মুখ আর মোবাইল ফোনে কাজে যোগদান বিষয়ক কথাটাকে স্মরণে আনতে চাইছে। বুঝতে চাইছে কোনটা বেশি গুরুতর। জীবিকা যখন প্রাণের সংশয়কে  উড়িয়ে দেয়, বাচ্চাদের আদরমাখানো মুখ আর স্ত্রীর পরম ভালোবাসা যখন গৌন হয়ে ওঠে,তখন  তার কাছে নতুন ভোরের আলোর কোন মানে দাঁড় করায় না। আরও আরও কত পথ গেলে একটা সোনালী দিন তাকে আদরমাখানো স্বপ্নের ভেতর থেকে ঢেকে তুলবে সেই ভাবনার পাথর চেপে বসে!

জামিলকে যেতে হবে আশুলিয়া,যেখানে তার গার্মেন্টসে জয়েন করে তার জীবিকাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।মনের মধ্যে এমন বিরক্তি আর হতাশা জন্ম নেয় যে বারবার কার কার মুখে যেন থুতু ছিটিয়ে দিতে  ইচ্ছে করে। তবুও নিরন্তর হেটে হেটেই  হয়ত তাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে।প্রডাকশনের কাপড়ে তার জীবন বিলিন হয়ে যায়,অর্ডার ক্যানসেল হলে তার দায়ভার কে নেবে? চাকুরিচ্যুতির মাধ্যমে তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, যেখানে তার ভোর হবে তামাটে বর্ণের।

অনেকক্ষণ হাটার পর জামিল টের পায়, তার শরীরের ঘাম  তাকে জানান দেয়, শরীরের অক্ষমতার কথা। নিজের উপর রাগ তীব্র হতে থাকে।বাড়ির পাশের পাওয়ার প্লান্টে তার কাজের অক্ষমতার জন্য ,নিজেকে কষে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে। এমনি হাটার পরে একবার থামে, দেখে ছোট খালটার পাশ দিয়ে সূর্য উঠি উঠি করছে। সে তখন চারপাশে তাকালে একটা শোরগোলের মত শব্দ শোনতে পায়। গাড়ীর শব্দের বদলে অটোরিকশার আসার শব্দ।অনিচ্ছায় তাকালে দেখতে পায়, সেখানে নারী আর পুরুষের সহবস্থান। আর সকলের মুখেই ঊঠকণ্ঠা। তাদের কোথায় গন্তব্য , তা বোঝে ওঠবার আগেই তার ঠিক সামনেই এসে অটোটি তার গতির কমিয়ে কক করে একটা নিঃস্বাস নেয়, বোঝাই যায় যন্ত্রটির উপর মানুষের অতি অত্যাচারে সে ক্লান্ত। অটোটি থামতেই বেশ কিছু হতাশাভরা মুখ তার সামনে নামতে থাকে, এর মধ্যে নারীদের কারো কারো উড়না এত অনিচ্ছায় ঝুলে থাকে যে, ওটা তার দায়িত্বে অবহেলা করে কিন্তু এতেও মহিলাদের দলের কারোর মুখেই সেই হতাশা কাটিয়ে এর সযত্ন ব্যবহারে উদ্যেগী হতে দেখা যায়না।

একদল মানুষ হেটে যায় অথচ কারো মুখেই কোন কথা নেই। সবাই যেন কারে কি কথা বলে শান্তি পাবে,  সেই ভাবনাই ভাবে। এত চাপা ক্ষোভ, অথচ কোন কথা কেউ বলছেনা , তাই কি করে হয়? দলের মধ্যে একটা মেয়েলি স্বভাবের এক পুরুষের সন্ধানও মেলে। এক দীর্ঘ করোনাকাল, এই যে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে এত সব লকডাউন, শাটডাউন এসবে তার কিছুই আসে যায়না, এমনকি পথের ক্লান্তিও তাকে খুব  পীড়িত করে বলে মনে হয়না। সে আছে পাশের  আরেকটা মেয়ে তার সাথে রঙ ঢঙের কথায়। যদিও পাশের মেয়েটির বিরক্তি অত্যন্ত স্পষ্ট, তারপরেও তার আগ্রহের ঘাটতি নাই।

হাটতে হাটতে শাহজাদপুরের স্টেশনে পৌঁছালে দেখে সারি সারি গাড়ি  দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, এরা দীর্ঘবিশ্রামে আছে। এই যে অনাত্মীয় কিছু মানুষের হেটে চলায় এক ধরনের বন্ধন আর হ্নদ্যতা তৈরী করে, একে অপরের সামান্য খবরেই জেনে যায়, তাদের গন্তব্য প্রায় একমুখি। কেউ গাজীপুর,  কেউ টঙ্গী, কেউ জয়দেবপুর আর অন্যরা মীরপুর ও আশুলিয়ার দিকেই যাবে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, ঢাকার আশপাশে যাওয়াই তাদের লক্ষ্য।

তারা হাটতে হাটতে ক্লান্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ করেনা কারন প্রকাশের উপযুক্ত পাত্রই সম্ভবত কারো সাথেই নাই। তাদের সার্বক্ষনিক সঙ্গী হিসেবে আছে হতাশা আর উৎকণ্ঠা। এভাবেই চলতে চলতে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে তাদের যাত্রা কোথায়? প্রত্যেকেই জেনে যায় ঢাকা ও আশেপাশেই  তাদের গন্তব্য। অন্তত জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পৌছানো গেলে,যারা গাজিপুর যাবে তারাও যেতে পারবে আর যারা আশুলিয়া বা মীরপুর যাবে, তারাও সেখানে যেতে পারবে।

জামিল ও তাদের অনাত্মীয় বন্ধুরা কাকতালীয়ভাবে সামনে পেয়ে যায় একটি মলম গাড়ী এবং তা দেখে তারা কিছুটা উচ্ছাস নিয়ে ছোট্ট এই  ট্রাকের দিকে এগুতে থাকে। ট্রাকের নিকটবর্তী হলে হেলপারের চোখে জামিলের দৃষ্টি পড়ে। উদভ্রান্ত চেহারার এক যুবক, সারারাত ঘুম আর অঘুমের ভেতর দিয়ে গেছে তাকে  দেখেই বোঝা যায়। যুবকের সাথে ফয়সালা করতে যায়, তার ঢাকা যাবে কিনা? কিন্তু হেলপার জানায় তারা এলেঙা পর্যন্ত যাবে, তারপর কালিহাতিতে পন্য বোঝাই করে যেতে হবে মানিকগঞ্জ। হেলপারকে বলে, ‘আমাদেরকে এলেঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে?’  হেলপার তার ড্রাইভারকে নিয়ে আসে। ড্রাইভার আগ্রহ আর অনাগ্রহের দোলাচলের মধ্যেই স্বীকার করে, সে নিয়ে যাবে। এলেঙ্গা যাবার পূর্বেই ড্রাইভার ঘোষনা  দেয়,আপনারা ট্রাকের পিছনে শুয়ে থাকবেন, আপনাদের নিতে হবে মালের মত করে অর্থাৎ পুলিশ  দেখলেই আপনারা ত্রিপালের নিচে শুয়ে পড়বেন,আর আমি দ্রুত চালিয়ে যাব। ভাড়া ২৭০ টাকা করে প্রতিজন। আর বাচ্চা থাকলে ১৫০ টাকা। কেউ কোন উপায়ান্তর না দেখে, ড্রাইভারের সাথে দর কষাকষি করবার সাহস করেনা।

সবাই ট্রাকে উঠে পড়ে। ট্রাক চলতে থাকে আর প্রচণ্ড  ঝাকুনিতেও সামান্য শব্দ করবার ফুসরত নাই। যখন এলেঙ্গা এসে পৌঁছায় তখন বেলা ৩ টা বেজে যায়। সবাইকে এলেঙ্গা মোড়ের অনেকখানি দূরে নামিয়ে দেয়। আবার শুরু হয় হাটার পালা। হাটতে হাটতে তাদের এই দলটি মোড়ের কাছে অনেক পুলিশ দেখতে পায়, অদুরেই আর্মিদের একটা গাড়ি তাদের নজরে আসলে তারা কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। সবার মধ্যে একটা শলাপরামর্শ হয়। সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, একা একা যাবে এবং গার্মেন্টের কার্ডটি সযত্নে হাতের কাছে রাখে। দলটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হবার পথে, প্রত্যেকেই প্রত্যকের দিকে তাকিয়ে যেন চিনে নেয়। তারা এর মধ্যেই যেন আত্মীয় হয়ে উঠে, সেখানে স্বজন হবার বেড়াজাল থাকেনা, থাকেনা সম্পর্কের টানাপোড়েন। জামিলের কাধের ব্যাগটি ভালো করে কাঁধের উপর নিয়ে হাটতে থাকে। প্রায় ৩০/৩৫ মিনিট হাটার পর এলেঙ্গা মোড়ে এসে পৌছালে একজন কনস্টেবল তার চোখেমুখে ক্রোধ আর বিরক্তি নিয়ে জামিলের সামনে দাঁড়ায়। নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে জামিলকে। অবশেষে সেখান থেকে ছাড়া পায় ,তার গার্মেন্টসের কার্ড দেখিয়ে।পুলিশ অফিসার মানবিক হয়ে উঠে এবং জামিলের চোখে হতাশা চিহ্ন দেখে সে ক্ষান্ত হয় ও তাকে যেতে বলে। এলেঙা মোড়ের কাছে এসে আবার তারা সামনের দিকে হাটতে থাকে আর চোখ অজান্তেই খুজতে থাকে একটি ট্রাক, যেখানে তাদের ভরসার জায়গা বিরাজ করে। কোনভাবেই অনেকক্ষণ হাটার পরেও তারা কিছুই খুঁজে পায়না। মাঝে মাঝে দু একটা অটো রিকশা হুশ করে তাদের পাশ ঘেষে চলে যায়।

জামিল যে সেই মধ্যরাতে কিছু খেয়েছিল, তা তার মস্তিস্ক জানান না দিলেও, পেট মোচড় দিয়ে জানান দেয়। সহসা জামিল কোন দোকান খুঁজে পায়না। পথের মাঝখানে একটি চালের আড়ত দেখতে পায়। তার পাশেই একটা টঙ দোকান। জামিল সেখান থেকে পাউরুটি আর কলা কিনে গ্রোগ্রাসে গিলে।  সেই রাত্রি থেকে অভুক্ত থাকায় পেটের ভেতর পাচক রস দু গাল ভেঙে জিহবায় এসে আশ্র‍য় নেয়। অতএব দ্রুত খাওয়া যেন তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আরও কিচ্ছুক্ষন হাটার পর টের পায় তার সাথের ট্রাকে উঠা লোকগুলো কিভাবে যেন, তার নিকটবর্তী হয়। তাদের ভেতর চাপা টেনশানের সাথে যুক্ত হয়েছে  পথের এহেন বিরক্তি। দলের ভেতর থাকা সবচেয়ে চুপচাপ লোকটাই বলে ওঠে ” একটাবারও! একবারও আমগো মতো গরীবের কথা  ভাবলোনা! গাড়ীঘোড়া বন্ধ। করোনার ভয় ঢড়। মালিকদের চাপে খুইল্যা দিছে গার্মেন্টস, তো বালা কতা,খুলছস খুলছসই, তগোর একবারও মনে হয় নাই, এই মানুষগুলা ১ তারিখে কিভাবে কাজে যোগ দিব? এরা কি তোগর কাল্লায় চইড়্যা ঢাকায় যাব?”

জামিল বুঝে পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের পৃথিবীতে শ্রম আর শ্রমিকের মূল্য শুধু উৎপাদনের টুলস হিসেবে। তাই সে লোকটিকে বলে, ‘ শাসন যখন ব্যবসায়ী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন দেশিয় উৎপাদন, রাষ্ট্রের ক্ষমতার চর্চা তখন এরাই করে অথবা বাধ্য করে সব করাতে, সেখানে মানুষের কথা ভাবা তুচ্ছরে,  ভাই”

হাটতে হাটতে আরও একটা স্টেশনের একটু আগে বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়ানো। এরা আবার চৌরাস্তা পর্যন্ত লোক তুলতাছে।

জামিলদের দলটি একটা খালি ট্রাকের নিকটবর্তী হয়। ট্রাকের ড্রাইভার আর হেলপারের সাথে কথা বলাটা এখন যেন দামী ব্যাপার স্যাপার।  এরা কথাই বলতে চাচ্ছেনা। জামিলদের দলের একজন এগিয়ে গিয়ে হেলপারের সাথে কথা বলে।  তিনি জানান ৫০০ টাকা লাগব প্রতিজন। অনেক দামাদামির পর মীমাংসিত হয়, ৩০০ টাকা করে পৌঁছে দেবে তারা। কিন্তু জুড়ে দিয়েছে নানান শর্ত।

যেমন কেউ দাঁড়াইয়া যাইতে পারতো না, অযথা কথা বলতে পারবেনা, একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়াবিবাদ করতে পারবেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। সকল শর্ত নিয়ে জামিলদের মুখোমুখি হলে সবাই নিমরাজি হলেও,শেষ ভরসার জায়গা না পেয়ে উনার দাম ও শর্তের ফয়সালা মেনে নেয়।

সবাই ট্রাকে ওঠছে। ট্রাকে ওঠে বসবার সময়,তারা লক্ষ্য করে তাদের প্রত্যেকেরই শরীরের শিথিলতা আর বিরক্তি চরম মাত্রা। এরই মধ্যে জামিল আগেও যাদের সাথে ছিল, এমন একটি মেয়ের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে। আসলে এর আগে সেই সুযোগই হয়না যে কাউকে ভালো করে দেখবার অথবা সেই ইচ্ছাও ছিলনা। হঠাৎই আবিস্কার করে, গার্মেন্টসে কাজ করা এই মেয়েটির ভেতর একটা দুরন্ত হরিণ আর বাঘের একটা অপূর্ব মিশ্রণ রয়েছে। একটা বন্য উদ্দামতার সাথেও আবার চোখের চাহনিতে পরম মায়া।

ট্রাকটি এগুতে থাকে, সাথে সাথে ঝাকুনি।এই ঝাকুনির এক পর্যায়ে সবার মধ্যেই একটা ঝিমুনি চলে আসে। সবাই আস্তে আস্তে শোবার মত প্রস্তুতি নেয়। ট্রাকের পাটাতন, একটা স্বপময় বিছানা হয়ে ওঠে কারো  কারোর জন্য। এ এক নিরন্তর যাত্রার মতো। এই সময় জামিল লক্ষ্য করে, মেয়েটি যে কোন কারনেই হোক জামিলের খুব কাছাকাছি চলে আসে। কাছাকাছি কিন্তু পাশাপাশি নয়, অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানের মত। দুজনের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক বোঝাপড়া হয় কোনরকম কথা না বলেই। জামিলের এই বিষয়টি বড্ড ভালো লাগে। তাহলে পৃথিবীতে এমন করেও তো যোগাযোগ করা যায়, তাহলে তার স্ত্রী ফাহিমার সাথেও যদি এমন যোগাযোগ সম্ভব হতো!

ট্রাকের মতন ট্রাক চলে, হঠাৎ হেলপার সবাইকে সতর্ক করার জন্য, পিছনে চলে আসে আর সাবাইকে বলে ‘ আপনারা হুইয়া যান, সামনে পুলিশ গাড়ি থামাইতে পারে, তাই তিরপালটা টাইন্যা দিতাছি। যহন পার হইয়া পড়মু আমনেরা তিরপাল সরাই দিয়েন।’

এই কথাগুলো সবার উদ্দ্যেশে  বলে হেলপার ড্রাইভারের পাশে চলে যায়। ত্রিপল টেনে দেয়ার ফলে একটা অন্ধকার নেমে আসে, নিঃস্বাস বন্ধ হবার অবস্থা।  সবাই শুয়ে পড়ে কিন্তু আতংক আর বিরক্তিতে হাসফাস করতে থাকে কেউ কেউ।

অন্ধকার গলে ত্রিপলের ফুটো দিয়ে একখন্ড আলো মুখে এসে পড়ে মেয়েটির পাশে। জামিল এখন খেয়াল করে মেয়েটি ঠিক তার পাশেই শুয়েছে, হাত বাড়ালেই অসীম সমুদ্র, সেখানে উত্তাল ঢেউয়ের শংকা নেই, আছে ঢেউয়ের মাধুর্য আর লবনাক্ততার স্বাদ। জামিল আলোর প্রতিসরণের সেই জায়গাটায় দৃষ্টি রাখে, সেখানে একটা চোখ আর চোখের পাপড়ি দেখা যায়। আশ্চর্য সুন্দর সেই চোখ, কাজল দেয়ায় সেই চোখের  মায়া একটা বিপ্রতীপ রেখা টানে।জামিল তাকিয়ে আছে। এমন সময় ত্রিপালটি সরে গিয়ে তীব্র আলোয় চারপাশ ভরে ওঠে এবং একই সাথে মেয়েটির সম্পূর্ণ মুখ প্রতিভাত হয়। জামিলের তখন ফাহিমার মুখের  সাথে মেলাতে ইচ্ছে করে। কি বিভৎস এক পুজিতান্ত্রিক দুনিয়ায় তার বাস, যেখানে ক্ষুধা আর সামাজিক সম্মানের জন্য জলাঞ্জলি দিতে হয় প্রেম, ঘুম আর আনন্দকে।মেয়েটির মুখ সূর্যের আলোমিশ্রিত ফাহিমার মুখ হয়ে ওঠে।

এইভাবেই তারা জয়দেবপুর চৌরাস্তা পৌঁছে যায় এবং আবার যার যার গন্তব্য ইশারা দেয়, সেখানে পৌঁছাবার। মেয়েটির উল্টোদিকের হাটা প্রমাণ করে, সে ঢাকা নয় গাজীপুরে যাবে। দুজন নিরবে বিদায় নিতে গিয়ে, কিছুটা থেমে যায়। মেয়েটি আবার ফিরে এসে বলে, আমার নাম শীলু। আমার ফোন নম্বরটা  রাইখ্যা দেন। ফোন নাম্বারটা দিয়ে বিপরীত দিকে হাটতে থাকে। জামিলের পথের ক্লান্তি, ক্ষুধা আর ফাহমিদার পৃথিবী কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়।

জামিল যখন আশুলিয়াতে পৌঁছায় তখন নিকশ কালো অন্ধকার চারদিকে থিকথিক করছে। কোনরকমে বিরুলিয়ার ব্রিজ পেরিয়ে তার বাসার সামনে আসে।ক্লান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে দেয় গুমোট হয়ে থাকা ঘরে। হুস করে একটি ইদুরের চলে যাওয়া তার কাছে খুব  স্বাভাবিকই লাগে।

ভোরের সূর্য উঠার অনেক আগেই তাকে উঠতে হয়। চুলা জ্বালিয়ে সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করে সে। তারপর তার খাবার নিয়ে দ্রুত গার্মেন্টসের দিকে রওনা হন। অনেকখানি পথ জামিলকে হেটে যেতে হয়।  পথের ক্লান্তি আজ তাকে ক্লান্ত করছেনা, ভেতরে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা।

সেই উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতে জামিল তার গার্মেন্টসের প্রধান ফটকে গিয়ে পৌঁছছ। সেখানে পৌঁছেই দেখেন বেশ কিছু কর্মিকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা।জামিল গেলে তাকে ভেতরে ডুকতে দেয়। সে রিসিপশনে গেলে তাকে জানানো হয়, তাকে জি এম সাহেব  দেখা করতে বলেছেন।

জামিল সংশয় আর তীব্র আতংক নিয়ে জি এম সাহেবের দরজার দিকে যাচ্ছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখছেন, দরজার কারুকাজ কারন তার মাথায় স্থির হয়ে আছে।প্রত্যেকটি কারুকার্যে আলাদা আলাদাভাবে ভাসছে ফাহিমার মুখ, তার কন্যা নোভা আর ডায়াবেটিস আর রিএকটিভ আর্থারাইটেসে আক্রান্ত তার মার মুখ। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।  জামিলের ভেতরের আতংক ঢুকে পড়েছে তার নিউরোন সেলে, যেখান থেকে বিপদ সংকেত জানান দিচ্ছে, সামনের অন্ধকার পথের কথা।

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জামিল কেন নেগেটিভ চিন্তাই করছে!  তারও কোন যুক্তিসঙ্গত কারন নেই। আশা আর নিরাশার নৌকাকে  দু দিকে ভাসিয়ে দিয়ে,দরজা ঠেলে সে জি এম সাহেবকে সালাম দিলে, জি এম সাহেব তাকে বসতে বলেন। জি এম সাহেবরা সাধারনত বসতে বলেন না।সাধারণত যা ঘটেনা, সেটা ঘটলে মানুষ আনন্দ এবং ভীতির মাঝখানে একটা সুক্ষ্ম সূতার মধ্যে দুলতে থাকে। আজ  জি এম সাহেবের বসার কথা বলায়  তার অনাগত বিপদসংকুল একটা তীব্র ক্রাইসিসের ইঙ্গিত দেয়।

জি এম সাহেব তার কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর, যখন প্যাণ্ডেমিক সিচুয়েশনে গার্মেন্টস সেকটরের যখন অর্থনৈতিক দৈন্যতার বয়ান দিচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কোন শান্তনার ভাষা নেই। তিনি এসব না বলেও বিদায় দিতে পারতেন। তবু ফিরে তাকিয়ে তার এইটুকু স্বস্থি হয়, পৃথিবীর তাবৎ চাকরদের কষ্টের প্রকাশ ভিন্ন হলেও, অনুভুতি প্রায় একই। তাই জামিল ঘুরে গিয়ে বলে, ‘ আমার মার জন্য, আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন স্যার’।

কোন কারনে জামিল দরজার কাছাকাছি পৌঁছে, আবার  জি এম সাহেবের দিকে তাকান, যখন তার ঘোলাটে চোখে স্যারের চোখের কোনের  দিকে তাকালে একটা পাড়ভাঙা নদী দেখতে পান।

ক্লান্ত অবসন্ন আর উপায়হীন পৃথিবীকে, তখন তার খুব আপন মনে হয়। রাস্তার পাশে লাগানো অপূর্ব সুন্দর গাছগুলোর পাশ দিয়ে সে প্রতিদিন হেটে গেছে, কোনদিন দেখবার সুযোগ হয়নি। আজ দেখে বড়ই অবাক লাগে। যাপিত জীবন তার ভেতরে থাকা নীল তৃণভুমিকে স্পর্শ করার সুযোগ দেয়নি, আজ হতাশায় তাদের বড্ড ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। নরম, আদুরে কৃষ্ণচূড়ার পাতা আলতু করে ধরে রাখে। পাশের থাকা বেশকিছু গাছে সে হাত বুলায় পরম মমতায়। পকেটে থাকা টাকা থেকে একটা ভনরুটি কিনে দেয়, তার বাসায় ঢুকার রাস্তার মোড়ে বসে থাকা কুকুরকে। তার কেবলি মনে হয় কুকুরের জীবনকে ভালোভাবে দেখা হয়নি তার, কুকুরের ক্ষুধাও যে তার মতোই তীব্র, তা কখনো ভাবেনি বরং ঘোড়ার মত একটা নিরন্তর ছুটে চলা জীবনকে নিয়ে যাপনের পাশে আরাম আর অনারামে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল।

আশুলিয়ার যে ঘরটি তার ভাড়া নেয়া, সেটা বস্তি নয়। খালের উপর সেই ঘরটায় জামিলের দিনে খুব একটা থাকবার প্রয়োজন পড়েনি। খালের পানিতে কারখানার বর্জ্যের সাথে মলমুত্রের বহুমাত্রিক দুর্গন্ধ,ঘরটির ভাড়া জামিলের আয়-ব্যায়ের সঙ্গতির ভেতরে নিয়ে আসে। জামিল আজ অনিচ্ছাবশত খালের পানির  দিকে তাকায়, থিকথিক করছে পঁচা দুর্গন্ধময় পানি। সেখানে তাকিয়ে তার বিরক্তি লাগেনা। কোথাও তো এই পানির সাথেই তার জীবনের যুথবদ্ধতা আছে। হঠাৎ তার মেয়েটির দেয়া অকারন নেয়া ফোন নাম্বারটি  তোলে নেয়। একটা দমকা বাতাস এসে তার হাত থেকে ফোন নাম্বারটি উড়িয়ে দিয়ে  খালের মধ্যে ফেলে দেয়। জামিল তাকিয়ে দেখে, পচা দূর্গন্ধ ময়লার উপর ভেসে যাচ্ছে এক টোকরা কাগজ, যেখানে ছোট্ট কাগজে ফাহিমা আর মেয়েটি ব্যাকুল হয়ে  দেখছে জামিলকে।