You are currently viewing গুটি, মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন || ইসরাত জাহান 

গুটি, মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন || ইসরাত জাহান 

গুটি, মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন || ইসরাত জাহান

সময়টা মধ্যরাত…

সন্ধ্যারাতের নিবু নিবু তারাগুলো যখন মধ্যরাতে সারা আকাশে জুড়ে জ্বল জ্বল করছিল, আছিয়া তখন ঘর থেকে বের হয় আসে বিশেষ কাজের তাড়ায়। ঘরের পিছনের বাগে আলোর ফুলগুলো ঘন অন্ধকারে দুরন্ত শিশুর মতো লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত ছিল, আর থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিল ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন, ওটাও কানে সওয়া। নিম্নবেগের প্রবল তাড়ায় আছিয়া সামনে আর এগিয়ে যেতে পারে না, ঘন অন্ধকারে শাড়িটা কোনরকমে কোমরের উপরে তুলে মেন্দি গাছের তলায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই, হঠাৎ ঝিঁঝি পোকার ঝিনঝিনে শব্দকে পাশ কাটিয়ে প্রবল কিছু শব্দ ওর বেগের গতিকে কমিয়ে দেয়, শব্দগুলো ভয়ংকর কিছুর আভাস দেয়, শব্দের তরঙ্গের হিসেব কষে বলা যায়, দূরের কোন গ্রাম থেকে ভেসে আসছে, জল ও ডাঙার টানাপোড়নে বসবাসরত আছিয়া জানে উৎসবের আগে ও পরে অনিয়মনের ঘটনাগুলো।  কিন্তু কোথায় আবার অনিয়ম ঘটলো!  জেলেপাড়ায় নয়তো? একটু খোঁচা লাগে বুকের ভেতরে।  সেহেতু কাছেপিঠের গ্রাম বলতে পশ্চিমের জেলেপাড়াই আছে। ওই পাড়ায় একটা সময় বেশ আসা যাওয়া ছিল ওর। ভয়টা, মনের ভেতরে ভাবনা হয়ে তিনদিনের আচঁবিহীন চুলের মতো জট পাকাতে থাকে। পশ্চিমের আকাশের দিকে  তাকায়, আকাশটা লাল লেলিহান, কিছুসময় পরে আরো কিছু  শব্দ ভেসে আসে বিমূর্ত চিৎকার হয়ে!

 আছিয়া হাতের বদনাটা ফেলে দৌড়ে যায় ঘরে।  অন্ধকার ঘরের ভেতরে তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গিয়ে শাড়িতে পা জড়িয়ে উষ্টা খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় । নাক ডাকার শব্দ শুনে বোঝে সুখুনের বাপটা  গভীর ঘুমে কাতর, আতংকিত আছিয়া গায়ের সব শক্তি দিয়ে সুখনের বাপকে একটা ঝাঁকি দেয় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝারি বড়ুই গাছটার মতো করে।  ঘুমে কাদা আজগর হঠাৎ ওমন ঝাঁকির তোড়ে লাফিয়ে ওঠে। অন্ধকারে স্ত্রীর আতংকিত  মুখখানি স্পষ্ট দেখা যায় না, হুমড়ি খেয়ে উঠে কপট রাগে গজগজ করে উল্টো পাশ ফিরে আবারও শুয়ে পড়ে, একটি বাক্যব্যয় করে, 

‘ মাগীর কামড়ি উঠছে’। 

এই ‘মাগী’ গালিটা আজগরের প্রেমময় ডাক, যা আছিয়া হরহামেশাই শুনে থাকে।

আজগরের নির্লিপ্ততা ওর আতংকটাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তাইতো স্বামীর গায়ে পরবর্তী ঝাঁকিটা ধাক্কায় পরিনত হয়। চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে উঠে বসে আজগর, বিরক্তকর চাহনিতে স্ত্রীর দিকে তাকায়।  আতংক ও বিরক্তি নামক দুটো বিশেষন অবছায়া অন্ধকারের মুখোমুখি বসে থাকে। দুটো মুখাবয়বের অভিব্যক্তির দর্শন হয় না। এরই মাঝে ভর্য়াত আরো কিছু প্রতিধ্বনি স্পষ্ট শোনা যায় ঘর থেকে। বেরিয়ে আসে ওরা দুজন।  দূর থেকে মনে হয়, লেলিহান শিখা  আকাশ ছোঁয়ার পাঁয়তারা করছে। এমন একটা অঘটনের আশংকা আগেই করেছিল ওরা। 

 পশ্চিমের আকাশ, লাল! কপালে ভাঁজ আজগরের। পৃথিবীর পুরোনো ক্যারিক্যাচাল, বিষবাষ্প আজ এই আকাশটাকে কুলষিত করল। এখনই লোক দেখানো কাজগুলো করা দরকার। মেম্বার তো জনগনের, জনগনের কথাই ভাবতে হয়। তাছাড়া সন্ধ্যারাতে প্রতি বছর গগনবিহারীর মতো কিছু লাল আলো  আকাশটাকে ছেয়ে ফেলে, উৎসবের সময় আতশবাজিসহ আরো অনেককিছুর জোগাড়যন্ত্র করতে হয়। পুরোটাই আনন্দের জন্য।  অকস্মাৎ এই লেলিহান শিখা দেখে কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায় আজগর। তাহলে কি আজই গিয়েছিল এমদাদ, পরিমেলের ছেলে কি তাহলে আজই  কাজটা সেরে ফেলেছে? 

 লুঙ্গির কাছায় গিট্টু দিতে দিতে কপালের ভাঁজগুলো আরো প্রকট হয়। 

‘হঠাৎ এমন আলোর ঝলক কি খোদাই  দিল!’ 

গল্পের শুরুটা যেভাবে শুরু হয়…

দুই দুইবার হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে কোটর থেকে বের করে ভালো করে ঘরটাকে পরোক্ষ করে আছিয়া। চোখটা জুড়িয়ে যায় । ভরা সংসার ওর, ফুলেফেঁপে একাকার। পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে, বুকভরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়, দুইবছর আগেও আছিয়ার আবাস ছিলো বাঁশ ও তারপিন তেলে ভালোবাসা মাখানো বেড়া দেয়া দোচালা ঘর। হাঁস মুরগীর পিছনে তিতি করে আর গরুর লেজের দুই চারটা বাড়ি খেয়ে দিন কাটাত। এখন মেম্বারের বউ হবার সুবাদে বাটার সেন্ডেল পরে এপাড়া ওপাড়া দাঁপিয়ে বেড়ায়। 

 কার কি হলো?
কে কি করছে? 

 সবার হাড়ির খবর শুনে মুখে পান গুঁজা এখন আছিয়ার প্রধান কাজ। গালে  চুন দেয়ার ছলে জেনে নেয় ভাগি শরিকদের সাথে সম্পর্কের দুবর্লতাগুলো। তারপরের কর্ম ওর স্বামী আজগর চেয়ারম্যানের সাহায্য সহযোগিতা করে ফেলে। আজগরের মতো লোক পাশে থাকায় চেয়ারম্যান এখন কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকেন। তাই তো খুশী হয়ে নতুন টিনের ঘর তুলে দিয়েছেন। তাও প্রায় অনেকদিন। 

আছিয়াদের পুরোনো ঘরটা এখন ত্রানের বেঁচে যাওয়া চাল, আটার গুদাম। চেয়ারম্যানের আমানত যত্নে গুছিয়ে রাখতে হয়। নিজেদের পাকসাফ রাখার জন্যই  সব পণ্য মাটির নিচে পুঁতে রাখে গভীর রাতে। কিছুদিন আগে টিভিতে দেখেছে পাশের গ্রামে ত্রানের সয়াবিন তেল চুরি করে মামলা খেয়েছে এক মেম্বার । গলায় উঠেছে জুতার মালা। সাবধানের মার নাই, আজগর নিজেকে পাকসাফ রাখার চেষ্টা করে।  

মাঝেমধ্যে দুই চারজন মুখ ফসকে উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে আজগরের আড়ালে। সাথে সাথে জিহবা কেটে তওবা করে। কেননা চেয়ারম্যানের কাছে আর্জি পৌঁছতে হলে আজগরই যে একমাত্র ভরসা। 

কিছুদিন ধরে শান্ত এই জনপথ যেন আরো শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। এলাকাবাসীর আপোষ, সবকিছু মাথা নুইয়ে সহ্য করা, সবকিছু মিলিয়ে যেন শান্ত হ্রদ।  ওদিকে মসনদের গুটি চালানো চালকগন তুলতুলে চেয়ারে বসে আয়েশি দিনাতিপাত করে। এই দিনপাত চেয়ারম্যানকে অস্থির করে তুলছিল, ভুলতে বসা এই জনপথকে একটু দেশবাসীর স্মরণে আনার জন্য  মনটা আকুপাকু করে তার, তাছাড়া গ্রামগঞ্জের কাজকর্ম চক্ষুগোচর করার জন্য নানারকম ফন্দি ও জিকিরও করতে হয়।  বড় রকম কোন ঘটনা না ঘটলে কেউ জানতেও পারে না এখানেও যে কিছু  মানুষ আছে। সামনের এমপি ইলেকশনেে দাঁড়াতে চান তিনি।
শিরোনাম না হলে শিরোনামের জন্য আবেদন করবেন কিভাবে। তার আশায়  মাঝেমধ্যে ছন্দপতন করে তারই ছেলে এমদাদ, দুইবারে স্কুল ফেল ছেলে শেষে পর্যন্ত কলেজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অবশ্য এতে তিনি খুশী, ছেলের বিদ্যাটা পোক্ত হয়েছে। কিন্তু  কলেজে যাবার পর থেকে বাবার সাথে সম্পর্ক দা-কুমড়া।  মাঝেমধ্যে বিপাকে পড়েন চেয়ারম্যান । এই গৃহযুদ্ধে তাকে উদ্ধার করেন মেম্বার। এমদাদ আবার আজগরের কথা শোনেন। না শোনার কোন কারন নাই, আজগর যে সবার কথায় মাথা ডান-বামে না ঘুরিয়ে উপর নিচ করেন বিনাবাক্য ব্যায়ে। আর কথায় আছে মৌনতা সম্মতির লক্ষন।  এমদাদের রক্ত গরম, হুটহাট নানা রকম কু-কাজ করে ফেলে বাবার দাপটে।  ইদানীং পুত্রের কারনে চেয়ারম্যানের ঘুম হারাম। অল্প বয়সী ছেলে তার, কখন কোথায় কি করে বসে, প্রায় সময় নদীর ওইপাড়ে জেলে পাড়ায় যায়। অতুল মাঝির বাড়িতে বসে নাড়ু মোয়া খায়, সেই আসা- যাওয়ার  কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার চোখের ছানা বড় হয়ে যায়।  এতো বড় অনাচার কিভাবে সহ্য করবেন তিনি । ওদিকে নামের আগে আলহাজ্ব জুটানো চেয়ারম্যান, একবার যদিও টিন বিক্রির টাকায় হজ্বটা সেরে এসেছেন, তারপরও কোনভাবে পুত্রের এই অনৈতিক সম্পর্ক মেনে নেবেন না তিনি।  হজ্ব ও উমরাহ্নতে তো  নিয়তটাই আসল, টাকা না। ছেলের এহেন আচরণে মন কষ্ট পেয়েছেন তিনি। 

ঠিক করেছে, এই অনাচারের গোঁড়া মূল উপরিয়ে ফেলতে হবে। এই নীল আকাশে পেঁজা তুলোর  সময়টায় একটা অনিয়ম করে যদি জেলেপাড়া থেকে অতুল মাঝিকে বের করা দেয়া যায়, তাহলে তারই লাভ। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বুদ্ধিটা।  পাশে আছে আস্থাশীল আজগর। 

রাখঢাকে ঘটন অঘটন 

এমদাদের মন ইদানীং উড়ুক্কু।  কোন কাজে মন বসে না, বসবে কিভাবে! সেটা যে নদীর ওই পাড়ে পশ্চিমে হেলে আছে। জেলেপাড়ার অতুল মাঝির মেয়ে মোহিনীর গজদন্তী হাসিতে উতলা ওর মন । মোহিনী এমদাদের সহপাঠী, তার উপর মাথা ভালো, টেনেটুনে পাশ করা এমদাদ জেলের মেয়ের চোখে মাঝে ডুবে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে। ভাইসম আজগরও ভরসা দিয়েছে, মোহিনীকে নিজের ঘরে তুলে আনার জন্য সব রকম সাহায্য করবে, আজগরের উপর এমদাদের অনেক আস্থা। 

ইদানিং এমদাদ রাতে ঘুমতে পারে না, প্রেমিকার গায়ের আঁশটে গন্ধটা  রজনীগন্ধার কোমল সুবাস মনে হয়, রাতজাগা পাখির মতো এপাশ ওপাশ করে, বুকের উপরে দ্বিধার মেঘ সরিয়ে ধবধবে চাঁদ বদনের নির্যাস পান করে দিবানিশি । দীর্ঘ চুলে নাক গুঁজে আদর করে আড়ালে। মৈথুনে ভেঙে আসে শরীর।  

মধুর বান বিষ পান 

নড়বড়ে খুঁটির উপরে ঝুঁকে পড়া চালাটা তিনটা বাশঁ ঠেকিয়ে কোনরকম আকাশ দেখা বন্ধ
করেছেন অতুল মাঝি, তারপরেও বৃষ্টি এলে খালা, ঘটি নিয়ে বৃষ্টি সাথে আপোষ করতে হয়,ওর বউ মালতির হাঁসগুলো উঠানের কাদার সাথে খাবার ঘুঁটে খাওয়ার জেরে উঠান সবসময় গুয়ের আড়ত হয়ে থাকে, একদিকে মাছের কারবার অন্যদিকে হাঁসের খোয়াড়, দিন কোনমতে টেনেটুনে পার করছে আতুল মাঝি । এই টেনেটুনে দিন পার  করা যে শুধু ওর একার নয়, এই জেলেপাড়ার সবারই এমন নুন আনতে পান্তা ফুঁড়ানো মতো দশা, তারপরও ওরা বেঁচে থাকে, ওদের বেঁচে থাকতে হয় দেশের কারণে, ভোটের কারণে, ভোট এলেই অতুল, নিমাই, হরি, পরিমলসহ আরো অনেকের মাথার প্রতি দাম বাড়ে যায়। ওদের এক একটা মাথা তখন একএকটা সংখ্যা।  বাকি সময় ওদের দরকার হয়  এনজিওর লোকজনের, সাদা চামড়ার কয়জন এসে মাথা নাড়িয়ে, ইয়েস ইয়েস বলে হাসিখুশি  হয়ে ওদের দেখে যায়। যার বিনিময়ে এনজিও গুলো বড় অংকের অনুদান পায়।

 দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরাঙ্গর তীরবর্তী গ্রামগুলোর জেলেরা হতদরিদ্র। এখানে এনজিও আছে, আছে দাদনও। এনজিওর লোকজন সহজ শর্তে টাকা দেয় আর মাস শেষে কঠিন স্বরে টাকা আদায় করে নিয়ে যায়, মাঝেমধ্যে ঘরের টিন, টিভিও নিয়ে যায়, তাই ওরা ওদের আপন মানুষজনের কাছ থেকে টাকা নেয়, তারা দাদন। সেখানেও একই সমস্যা। জীবিকার প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ীদের লাল খাতায় নাম লিখিয়ে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় । জেলেদের কষ্টের আয়ের টাকাগুলো সুদের চক্রে পড়ে প্রায় সবটাই চলে যায় দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে না হয় এনজিওর সুদে। অতুল নিমাই অপেক্ষা করে এক বর্ষার পরের বর্ষায় টিনের চালের ঘর, নতুন জাল, নিজেস্ব নৌকা, স্বপ্নের উপরে কর বসানো হয়নি বলে ওরা এখন স্বপ্নটা দেখে, কিন্তু  পূরণ হয় না।

এতো কিছুর মাঝে ওদের কাছে ভরসার জায়গা আজগর, সেও দাদন ব্যাবসায়ী। একটা সময় নিয়ামত উল্লাহর ঘরের কামলা আজগর আজ কিছুটা টাকার মুখ দেখেছেন। তাই তো খেটে খাওয়া অতুল নিমাইদের কষ্ট ও বোঝে। ওদের সুখ দুঃখের সাথী হয়। দুঃখকষ্টে কথা শুনে মিঠাবুলির আওড়ায়, সুদ দেয়, আদায়ের সময়  বাড়িয়ে, কিন্তু পেটে লাথি দিয়ে অন্নহীন ও আশ্রয়হীন করে না। ওর এই দাদন ব্যাবসার পিছনের মানুষটা যে  নিয়ামত উল্লাহ সেটা অনেকেই জানে না,  আর যারা জানে তারা মুখ বন্ধ রাখে, এই নিয়ামত উল্লাহই এলাকার  চেয়ারম্যান,  নিজের সুবিধার জন্য আজগরকে ইলেকশনে পাশ করিয়ে মেম্বার বানায়েছেন। অজগর তার বিশ্বস্ত মানুষ। আজগরকে কোটে ফেলে গুটির মতো চালায় চেয়ারম্যান । আজগর পৃথিবীর নামক কোটে একবার মই বেয়ে ওঠে আবার সাপের কামড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আবারও উঠে দাড়ায়, এই বারবার উঠানামা মাঝে একটা মানুষ আজগরের সবসময় পাশে এসে দাড়ায়, সে হলো আমিনুল,এই  গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক। ছোটবেলার খেলার সাথী, শান্ত সৌম্য এই লোক মেম্বারের অনেক ভয়ংকর কর্মের সাক্ষী। আমিনুলের ধারনা, আজগরের উপর মাদারগাছের কালি ভুতটা ভর করে। মাঝেমধ্যে তা ঘাড়ের উঠে নৃত্যরাগ করে, তখন রগের অসুরের রক্তধারা প্রবাহিত হয়।  সেই অসুর বধের মাস তো এখনই। নদীর পাড়ে খোলা মাঠে কাশফুলগুলো উড়ে উড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। জানায় শরতের আগমনী বার্তা। নদীর ওপারে জেলেপাড়াটা এখন বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। চারপাশে উৎসবের আমেজ, সেই জেলেপাড়ার আকাশটাই আজ এই মধ্যরাতে হঠাৎ কেন লাল হয়ে উঠলো! আছিয়ার মতো  আমিনুলও বিষয়টা নিয়ে ভাবে। হঠাৎ এমন রাহুরদশা!  এর পিছনে কি চেয়ারম্যান নাকি তার গুটি মেম্বারের কোন চাল আছে! আমিনুল উত্তর খোঁজে। ছুটে যায় পশ্চিমের জেলেপাড়ায়।

পিছনে ফিরে যাই আমরা…

কয়দিন ধরে এমদাদের মনমেজাজ চড়া, মোহিনী আর আগের মতো ওর কথা শুনে হাসে না, বইপত্র,নোট গুছিয়ে দেয় না, কেমন যেন এড়িয়ে যায়। এক সপ্তাহ  আগে অতুল মাঝির মেয়ে জানায়, চাকরি করতে শহরে চলে যাবে, বাবাকে ঋন মুক্ত করবে। ধর্মে আলাদা হলেও মনেপ্রানে ও যে ভালোবাসে ফেলেছে মোহিনীকে। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে গজদন্তী মেয়েটাকে ঘরে তুলবে। কিন্তু সে আশা এখন গুড়েবালি,পরিমলের ছেলে মোহিনীর উপর মোহগ্রস্ত, অতুল মাঝি ও পরিমল বন্ধু মানুষ, এতোদিনের জানাশোনা, সবকিছু ঠিকঠাক। মোহিনীকে কপালে সিঁদুর দেবার অপেক্ষা মাত্র। পূজার পরেই ছাঁদনাতলা যাবে পরিমলের ছেলের সাথে।  এই কথা শোনার পর থেকে এমদাদের মাথা নষ্ট, ওদিকে বাবার সাথেও সম্পর্ক তলানীতে।  আজগরের উপর যেটুকু আশা ছিল, সেখানেও আশাহত। আজগর ইদানীং এড়িয়ে চলে, পরিমলের ছেলের সাথে আজগরের হৃদ্যতা ওর চোখ এড়ায় না। এমদাদ জানে আজগর একটা গুটি মাত্র, চেয়ারম্যানের কথার বাহিরে মেম্বার কিছুই করে না। এমদাদ ঠিক করে, মোহিনীকে নিয়ে দূরে পালিয়ে যাবে, উৎসবের আগে।  

যত আলাপ তত প্রলাপ

আছিয়ার ইদানীং মনটা ভালো নাই, আজগর মেম্বার হবার পর থেকে ঘরের প্রতি উদাসীন,  সারাক্ষন বাহিরে বাহিরে থাকে।  নানা আয়োজনে গ্রামে মেলা হয় কয়দিন পর পরই, সিনেমার নায়িকাদের মতো মেয়ে মানুষ আসে, আজগর কাজের কথা বলে পড়ে থাকে সেখানে, কিন্তু আছিয়া জানে, আজগরের নেশা এখন জমি আর নারীতে , শুধুমাত্র ছেলের কারণে যে আজগর আছিয়াকে এখনও এই ঘরে রেখেছে তা ও জানে। তাছাড়া বিভিন্ন ঘরের অন্দরের খবর এনে দেয়ার জন্য ওর স্বামী  যে ওকে ব্যাবহার করে, তা পাঁচ ক্লাস পাশ আছিয়া বোঝে, তাই তো কিছু বোঝাপড়াটা এখন আমিনুল মাস্টারের সাথে সেরে ফেলে।  টুকটুক করে সোনার গয়না গুছিয়ে নিচ্ছে মাস্টার সাহায্য, আজগর যখন বাড়িতে থাকে না, মাস্টার আসে আছিয়ার হাতের পান খেতে, বন্ধুপত্নীর পান ও  সঙ্গ দারুণ উপভোগ করে নিঃসঙ্গ আমিনুল। এক দুইবার আছিয়ার অন্দরমলে প্রবেশের সুযোগ হয়েছিল, সেই থেকে বিমোহিত সে। তাই তো আজগরের সাথে উপরে উপরে সদ্ভাব দেখায়।  আমিনুল জানে  আজগরের আসলে রূপ। চেয়ারম্যানের পিছনে ঘুরলেও শেষ উদ্দেশ্য  যে ওই চেয়ারম্যানের গদি। ইদানীং আজগরের আচরণ একটু এলোমেলো। এমদাদকে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়া করতে চায় মেম্বার, নানারকম কান পাড়ানি দেয়, আর তা শুনে চেয়ারম্যান পুত্র রাগে ফুঁসে ওঠে। আজগরের হাতের শক্ত গুটি এমদাদ, অপেক্ষা করে সুযোগ মতো চালের।

গল্পের শুরু ও শেষের অন্তঃমিল। 

মাঝরাতে হঠাৎ আলোকিত জেলেপাড়া আগুন বশে আনতে পারে না। তখন অতুল, পরিমলসহ আরো কয়েকজন নিজেদের ভেতরে নানারকম আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত  ছিল উঠানে, কয়দিন পরে আবার বড় এক উৎসব, সবাই এখন এই সেই আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। তার উপর বিয়ের আয়োজন আছে, অতুল ও পরিমলের ছেলে ও মেয়ের কুষ্টির মেলানোর কাজ আরো আগেই শেষ করেছে।  অতুল মেয়েকে তাড়াতাড়ি পরিমলের ছেলের হাতে তুলে দিতে চায়, না হলে যে বড়  অনাচার হয়ে যাবে। অনেক মায়াকান্না করে রাজি করিয়েছেন তিনি মেয়েকে। আজগর মেম্বারও এই বুদ্ধি দিয়েছে তাকে। সাথে বিয়ের জন্য  অর্থ।  

‘ও আতুল তোর পাজ দুয়ারে  দেহি আগুন লাগজে। ‘

ওরে আগুন আগুন, ক্যাডা কোম্যাে আছো, তত্তিরি আও… এই কথা বলে, পরিমল চিৎকার করে নিজের ঘরে দিকে ছুটে যায়, অতুল দাঁড়িয়ে  যায়, নড়ার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেন হাড়জিরজিরে লোকটা। 

কিভাবে আগুন লাগলো  ওদের কাঠ বাঁশের ঘরে, চারপাশে চিৎকার, আর্তনাদ , সবাই নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত, শুরু হয় ছোটাছুটি। অতুলের মাথায় কিছুই আসে না, ঘরে ওর টাকা, জমির দলিল, কাগজের টাকা পুড়ে গেলে তো ছাই, অতুল ছুটে যায় ঘরের ভেতরে।  

ঢুকেই অতুল থমকে দাঁড়ায়, ঘরের ভেতরে এমদাদ ও মোহিনী, চারপাশে আগুন, কিন্তু ওরা  নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোনকিছুর প্রতি যেন  ওদের টনক নড়াতে পারে না।  ঠাকুরকে স্মরন করে অতুল,আগের জন্মের পাপ ঠাকুর গরীর করে শোধ নিলো এতোদিন, এটা তাহলে ওর কোন পাপের ফল। মেয়ের গোপন কর্ম চোখের সামনে চলে এলো। রাগে দুঃখে অতুল দরজার খিল টেনে বেরিয়ে যায়,
পুড়ে ভষ্ম হউক আজ পাপীগুলো…

সংবাদপত্রের পাতায়, খবর এই জনপদের

‘দশমিনা  উপজেলায় তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরাঙ্গায় আগুন, আগুনে পুড়ে গেছে জেলেপাড়ার অধিকাংশ   ঘর ও কিছু দোকান । আজ মঙ্গলবার মধ্যরাতে এই  ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে স্থানীয় জনগন ছুটে গেছেন আগুন নেভাতে। ঘন্টা দুই পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় স্থানীয় জনগন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, চুলার আগুনে থেকে এর সূত্রপাত হয়েছে। এ ছাড়া আগুনে দুজন নিহত ও বেশ কিছু  আহত হয়েছেন। তদন্তের পর কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে।’

সংবাদপত্রের পাতায় বড় হেডলাইনে প্রকাশিত হয় খবরটি… 

সংবাদপত্রের পাতা থেকে চোখ তুলে সবাই আসল কারণ অনুসন্ধানে বের হয়, তারা কোনভাবেই মেলাতে পারে না, অতুল মাঝির ঘরে এমদাদের কেন মৃত্যু হবে। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া এমদাদকে সনাক্ত করা হয় না, ছাইভষ্মের মাঝে পড়ে থাকা সোনায় বাঁধানো আকিক পাথরের আংটি থেকে বোঝা যায় ওটা এমদাদ ছিল। বাকিজন কে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। 

আগুনের ধোঁয়া মিলিয়ে যায়, জনপথ শান্ত হয়, ছুটে আসে ত্রান ও ঋন নিয়ে নানান এনজিও,  স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো। অতুল মাঝিরা আবার স্বপ্ন দেখে,
কিন্তু এমদাদ ও মোহিনীর মায়ের চোখের পানি শুকায় না। আছিয়া মাঝেমধ্যে  এমদাদের মাকে সান্তনা দিতে যায়। 

নেতা আসে,নেতা  যায়,

এমদাদের মৃত্যুর পরে চেয়ারম্যানের স্বপ্নপূরণ হয়, শান্ত জনপথকে সারাদেশের মানুষজন চেনা শুরু করে। কিন্তু ছেলেকে হারিয়ে  পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজনীতি ছেড়ে দেন তিনি। ছেলের জন্য বুকের ভেতরে আহাজারি নিয়ে ছোটেন বিভিন্ন তাবলিকে জামাতে। চিল্লায় চলে যায় মনের শান্তির খোঁজে। 

নতুন গুটির আগমন…

মাঝেমাঝে আমিনুল আসে চেয়ারম্যানের কাছে, আজগরের গতিবিধি, কিছু গোপন তথ্য দেয়ার জন্য।  তার এতোদিনের বিশ্বস্ত আজগর যে আগুনের মূলহোতা তা এতোদিনের রাজনৈতিক পালাবদল, কুটকাচালি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু হাতে প্রমাণ নেই। ওদিকে  আজগরের হাতে বিশাল জনগোষ্ঠী, তাই নিরবতাই তার একমাত্র বেঁচে থাকার কৌশল। আজগরকে তিনি চেয়েছিেলন গুটি হিসেবে চাল দিতে দিতে, কিন্তু  তিনি যে কখন আজগরের হাতের গুটি হয়ে গেছেন, বুঝতেও পারেননি।

নিয়ামত উল্লাহ হাতে এখন নতুন গুটি আমিনুল।  কৌশলে চাল দেয়ার অপেক্ষায় থাকেন নিয়ামত উল্লাহ। 

*******************************