You are currently viewing গুচ্ছকবিতা> অমিতরূপ চক্রবর্তী

গুচ্ছকবিতা> অমিতরূপ চক্রবর্তী

গুচ্ছকবিতা> অমিতরূপ চক্রবর্তী

 

শঙ্খমালা

এসো, আমার সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে এসো। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। অনেকে হাতের গোছে এভাবে মাথা নিরস্ত করে অপেক্ষা করে। অনেকে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে নরম, স্নিগ্ধ আকাশের নীচে। এসো, আমার সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে এসো। দেখো, ওখানে কৃষ্ণকায় জল আছে, এবড়ো-খেবড়ো পিচ্ছিল পাথর আছে। অকালমৃত জাহাজের ভগ্নাবশেষ, নোঙর-সালতি সব আছে। ঊজ্জ্বল অপাচ্য হাড়গোড়ও আছে। তোমার নির্দোষ চটিটি কীভাবে যে তোমাকে বয়! অত দেহভার, অত যৌবনের শিখা! সুড়ঙ্গের শেষে যেন তৃতীয় নয়ন জ্বালিয়ে সুদূরব্যপ্ত একটি ছন্দোময় ট্রেন ঢুকল। এই যে সর্বস্বান্ত একটি দিন তার ছোটবড়ো মূল নিয়ে প্যারাট্রুপারের মতো ঝুলে আছে, এই যে আবার ঠাণ্ডা আততায়ীর মতো রাত হল, এই যে ভীষণ ক্ষয়াটে একটি কী পাখি খাই-খরচের ভাষা মুখে নিয়ে উড়ে যাবার জন্য কোনো অজ্ঞাত গাছের ডালে পাখা থামিয়ে নামল- এইসব গুটিয়ে রাখা একটি ভারী শেকলের মতো। পড়শি বাড়ির মিষ্টতার মতো। একসময় রক্তমাংস ত্যাগ করে করোটি- পাঁজর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিদ্রুপ করে, হাসে। হাওয়ায় সারি সারি বন্দী মোমের চুল একপাশে এলো হয়ে তখন অবাধে উড়তে থাকে

আহ, কী অতুলনীয় একটি বূষ্টি এলো বাইরে। জল পড়ার শব্দ যেন বিরাট জনসমুদ্রের হাততালির মতো। ভাবো, এই করতালি, এমন উছ্ছ্বসিত মনে এ অন্যকে অভিনন্দিত করার রীতি কোথায়, কীভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অথচ দ্যাখো পশমের মতো আকাশ মাথার এখনো ওপরে আছে। কী অতিকায় এক সরীসৃপ গায়ে নক্ষত্র লাগিয়ে সেখানে আলস্যযাপন করছে। আঙুলে এখনো অন্য আঙুলের গন্ধ। এখনো কোথাও জড়োয়া শাড়ি লোহার বর্মের মতো সব আক্রমণ, সব কৌশলকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। আহ, অতুলনীয় সেই বৃষ্টি দূরে গিয়ে আবার সহর্ষে ফিরে এল। তুমি যতক্ষণ না আসছ, আমি এই বৃষ্টি, এই বিরাট জনসমুদ্রের হাততালির মতো জল পড়ার শব্দ পিঠে নিয়ে ভাবব, পথবাতির নীচে সংসার করা জীর্ণ কুকুরগুলি কোথায়। যে ছাদে অপরূপ সব ফুল এসেছে, তাদের কর্তব্য কী অথবা এঁদো নালা দিয়ে যে সুরধুনী বয়ে চলেছে তারা তিলমাত্র কি বুঝতে পারছে প্রায় গা-লাগোয়া দেওয়ালের ওপাশে দুটি শুঁড়-তোলা প্রকাণ্ড প্রাণী যুদ্ধে মেতেছে? বিরাট এক জনসমুদ্র শুধু এই ভাবনাগুলির জন্যেই থেকে থেকে আমার উদ্দ্যেশ্যে করতালি দিতে দিতে ঘেমে যাবে, হাঁফিয়ে যাবে

 

গাছের পাতার অলংকারে

‘কীজন্য দাঁড়িয়ে আছি?’ তুমি একপশলা হাওয়ার মতো বললে। ঠাণ্ডা কবরের মতো একটি দিন আমাদের সম্মুখে। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নীলিম ছড়ানো আকাশের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। কাঠকুটোর মতো রোদ। কাঠকুটোর মতো জীবন, বসতির চিহ্ন। কোনো উদ্দ্যেশ্যে আমরা আজ ছাই ছাই সংজ্ঞাহীনতা থেকে পাশাপাশি হেঁটে এখানে পৌঁছেছি। কোনো উদ্দ্যেশ্যে অবশ্যই। বহুদিহ পর আবার আমরা পাশাপাশি হাঁটলাম। বহুদিন পর আমাদের কাঁধদুটি পাশাপাশি এলো। বহুদিন পর তোমার হাতের চুড়িতে ঠোক্কর খেল আমার শিরা-উপশিরাময় হাত। বহুদিন আবার আমার আঙুলের ডগা ঘন বীর্যে ভারী হয়ে এল। তোমার উড়ন্ত চুল তোমাকে আহত করছে। আমিও আহত হচ্ছি পাশাপাশি। তোমার মুখে, ঠোঁটের মধ্যে অজস্র পাখির মতো চুল। তাদের শব্দ, কলরব। ‘তোমার কি মনে পড়ছে কিছু? কীজন্য আমরা এখানে? কীজন্য দাঁড়িয়ে আছি?’ তুমি চুলের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে বলো। তোমার কথা, প্রশ্নের তীর সেই উচাটন হাওয়ার মধ্যে বাঁক খেয়ে হারিয়ে যায়। আমিও মুখ ছুঁয়ে দেখি আমার মুখে শস্যদানার মতো ঘাম। তোমার বিস্রস্ত শাড়ির কিছুটায় যে- আগুনকে শহরে নগরে মেরে ফেলা হয়, জলের চাদরে চাপা দেওয়া হয়- তারই খানিকটা আক্রোশ লেগে জ্বলছে। কাঠকুটোর মতো রোদ, কাঠকুটোর মতো জীবন, বসতি এইখানে। পেটৈ আম নিয়ে পাথরের দিকে, গনগনে শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষ। অদ্ভুত প্রাণির মতো তাদের স্ত্রী-সন্তান এবং অপরাজেয় সংসার

‘সত্যিই তো, কীজন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছি বল তো? কেনই- বা এখানে এলাম?’ আমি স্বপ্নাহতের মতো বললাম। আরও যে খানিকটা বললাম তা অবশ্য তোমাকে শুনিয়ে নয়, বললাম কাছাকাছি থাকা একটি প্রাচীন গাছের বাকল ও তার গায়ে বাসা-করা লাল দেহের অসংখ্য পিঁপড়েকে শুনিয়ে। বললাম যে ‘তুমি আবার কবে ফিরে এলে? কখন? কই, তোমার সঙ্গে তো সেপাই-সান্ত্রীরা এল না? তাহলে পৃথিবী কি বদলে গেল? পৃথিবী ফাটিয়ে তার গর্ভ থেকে আরেকটি তুলতুলে, নিষ্পাপ পৃথিবী বেরিয়ে এল? এ কোন সাল? তোমার এই শাড়িটি আমার অচেনা। হয়তো নতুন কিনেছ তবে তোমাকে খুব মানিয়েছে। কেমন বিষণ্ণ, করুণ আর অন্তর- হারানো লাগছে তোমায়! তুমি কি আজ কোথাও নিঃস্ব? সমস্ত শেকল কি তোমাকে মুক্ত করে ফিরে গিয়েছে?’ তোমাকে দেখলাম সারা শরীরে শাড়ি সাঁপটে নিয়ে সমুদ্রের তীরে একটি একাকী মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ। সমুদ্রে ঘন কলরোলে জল। সপ্রচুর ফেনা সেখানে বহু বিনষ্ট বীর্যের মতো, বিপ্লবের মতো বা কতকটা বহু মানুষের যুগপৎ দেখা ব্যর্থ টিলার মতো ভাসছে। আবারও আমি সেই প্রাচীন গাছটির বাকল ও তার গায়ে বাসা-করা লাল দেহের অসংখ্য পিঁপড়েকে শুনিয়ে বললাম ‘কী হাস্যকরভাবে পেটে আম নিয়ে মানুষের শাখা-প্রশাখারা বাদশাহো সাজে, উড়ন্ত ঈশ্বর সাজে! কী হাস্যকরভাবে, কী করুণভাবেও।‘ গাছের পিঁপড়েগুলি যেখানে যাবার সেদিকে যেতে লাগল। গাছের পাতার অলংকারে কী একটা শব্দ হল

 

পাখি

এ যেন প্রায় পাখির সংসার। খড়কুটোর ফাঁক দিয়ে সকালের লজ্জিত রাঙা রোদটি এসে পড়েছে বিছানার কোণে। শিশু পাখিটি সবে স্নান করে এল। মা-পাখি, যার পিঠে বড়ো বড়ো ডানাগুলি এখন নিঃশব্দ হয়ে আছে, পিঠের সঙ্গে মিশে আছে, সেই মা-পাখি শিশু পাখিকে মাথার চুল আচড়ে দিচ্ছে, গালে ক্রিম ঘসে দিচ্ছে আর শিশু পাখিটি তার মধ্যেই লাফাচ্ছে,  এদিক- ওদিক মাথা দুলিয়ে দুষ্টুমি করছে। মা- পাখির মুখ ঈষৎ কঠিন। থুতনির যে বর্তুল তাতে কোনো বৈকল্য নেই। শিশু পাখিকে যতটুকু প্রস্তুত করার করে মা- পাখি আবার খাদ্যের সন্ধানে উড়ে যাবে। গাছের ডালে, শূন্যের দয়ায় টিকে থাকে পাখির সংসার। যদি মানুষের কড়ি-বরগায় হয় তবে মানুষের দয়ায়। এমন মানুষেরা কাজের মানুষ, মৌলিক মানুষ। মস্তিষ্কের ভেতরে আছে কালো জমাট কার্বন, খিদে তৃষ্ণা আর ক্লান্তির অনুভব। আছে দাঁতে চিবোনো চশমার ডাঁটি অথবা লাল কালির খাগ। এরা পাখিদের মতো নয়। এরা সভ্যতার পত্তন করে, সভ্যতা গুঁড়িয়ে দেয়, আবার পত্তন করে, আবার গুঁড়িয়ে দেয়। এই কঠিন পরিশ্রমের জন্যে তাদের জন্য ঘন দুধ আর পেস্তার টুকরো আসে। এসব অন্য আরেকদল মানুষেরা আনে

পাখির সংসার এইসব পরিশ্রমী মানুষের দয়ায় টিকে থাকে। যদি সে গাছের ডালেও হয়- তাও। শূন্যের যে দয়া, তার পেছনে কি এইসব পরিশ্রমী মানুষের পরোক্ষ সায় নেই? এই যে খড়কুটোর ফাঁক দিয়ে সকালের লজ্জিত রাঙা রোদটি এসে পড়েছে, পরিচ্ছন্ন হবার পর শিশু পাখিটি কোথাও খেলতে যাবে, ইত্যাবসরে মা- পাখি তার পেশল দুই ডানা মেলে খাদ্যের সন্ধানে উড়ে যাবে আর আরেকটি স্থাণুবৎ পাখি তার অকর্মণ্য, কুৎসিৎ ঠ্যাঙদুটো আড়াআড়ি করে মেলে দিয়ে নির্নিমেষ নয়নে ভাববে এইসবের মধ্যে তার ভূমিকা ঠিক কী, ব্যাধের শর সে অন্তরে কি আদৌ ধারণ করতে পারে- এইসব বাতাসে-ওড়া শুকনো পাতার মতো সব কথা। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখবে কোমরের নীচে ঝুলে থাকা তার একটুকরো সলজ্জ লিঙ্গ, হাতের আবরণে অত্যন্ত দুর্বল পেশী, চোখের মণিতে সাদা হতাশা। তাকিয়ে দেখবে তার মুখময় কত প্রাচীন, প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া কী সব গাছের ঝুরি, সাপের গর্ত। দেখবে আর দেখবে। সকালের লজ্জিত রাঙা রোদটি একটু একটু করে বিছানার কোণ ছেড়ে খসে পড়বে মেঝেয় তারপর কী এক ক্রুদ্ধ কারণে যেন হারিয়ে যাবে। কান পাতলে তখন শোনা যাবে বাইরে কোথাও

শিশু পাখিটি সহর্ষে চিৎকার করছে। তাতে যোগ দিয়েছে আরও আরও পাখি

 

বিজয়োৎসব

আহ, কী মিষ্টি রোদ! আমাদের মিষ্টি অসম্ভাব্যের মতো। সেই রোদ ঘাড়ে-পিঠে মেখে একটা প্রস্তরমূর্তির মতো বসে আছি জানালার কাছে। এমনও কিছু দিন থাকে, যখন সেরকম করার কিছুই থাকে না। নিজের হাত, নিজের পাগুলোকে মনে হয় আলস্যে শুয়ে থাকা বহুদিনের অভূক্ত কুকুর। অথচ ভাবো, কোথায় কত কী ঘটে যাচ্ছে! কোথাও বরফে ছিটকে পড়া উষ্ণ তাজা রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও একদল বুনো শুয়োর তাড়া করেছে সভ্যতাকে। কোথাও পাতাপল্লবের আড়ালে ঝিলিক দিয়ে উঠছে স্তনযুগল। কোথাও কেউ একদল কঙ্কালের মধ্যে ধীর পায়ে কোথাও হেঁটে যাচ্ছে। কারও মস্তিষ্কে লাল পিঁপড়ে হয়ে হামাগুড়ি কাটছে কবেকার শোনা একটা ভাঙা, ধারালো কথা। আমাদের মিষ্টি অসম্ভাব্য আজ আমাদের জন্য কী এনেছে কে জানে! এখনও অবধি সবকিছু রাষ্ট্রীয় মর্যাদার মতোই সুন্দর, গম্ভীর সুন্দর। রাষ্ট্রীয় নির্দেশে রোদ গমগম করছে চারদিকে। গাছের পাতা ততটুকুই দুলছে, যতোটুকু দোলার। জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে একটা কী ঝকমকে নীল আকাশে উঠে আছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো বিজয়োৎসব

আহ, আমাদের মিষ্টি অসম্ভাব্য, এইমাত্র তোমার দাক্ষিণ্যে সেই পরিচিত মুখাবয়ব দরজার পাশেই দেখলাম। এখন সে নিমগ্ন হয়ে ঘর ঝাড় দিচ্ছে। ঘর না একটা গোটা দেশ? দ্যাখো, কোথাও সার সার পর্বতমালা, দ্যাখো কোথাও ছুঁচোর মতো মুখ করে এসে সমুদ্র মাটিকে চুম্বন করছে অথবা দ্যাখো কী দূরদূরান্ত অবধি টাঁড়, তার গায়ে কী ভয়াবহ জঙ্গল! দু-জঙ্ঘার ভাঁজে কৃপণ যোনির মতো নদীও আছে কোথাও কোথাও। দেশ নয়? দেশে এমন একটি বিজয়োৎসবের দিন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আজ সব অভূক্ত কুকুরেরা ভাত পাবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এরপর তারা একটিবার সুযোগ পাবে অভীষ্ট সঙ্গমের। আহ, আমাদের মিষ্টি অসম্ভাব্য, বিজয়োৎসবের দিনগুলোর বিকেল কেমন লোমশ গরিলার মতো ঝোপঝাড় টপকে কত দ্রুত এসে পড়ে। বিছানায় পড়ে থাকা দু-দুটো মৃতদেহের ওপরে ভনভন করে ওড়ে সন্ধ্যের মশা। তখন দেশের যে অংশ দৃশ্যমানতার বাইরে, সেখানে কিছু লোকজনেরা আসে। তারা টেনে নিয়ে আসে ভারী ভারী শেকল। দরজার বাইরে সিঁড়িতে তারা নিঃশব্দে অপেক্ষা করে, সিগারেট খায়, টকিতে নির্দেশ পাওয়ামাত্রই আমাদের গ্রেপ্তার করে