You are currently viewing গাঁজা টানি ভোন ভোন, গাঁজা অইছে আড়াই মন || নুসরাত সুলতানা

গাঁজা টানি ভোন ভোন, গাঁজা অইছে আড়াই মন || নুসরাত সুলতানা

গাঁজা টানি ভোন ভোন

গাঁজা অইছে আড়াই মন

নুসরাত সুলতানা

চৈত্রের খরতাপের দুপুর। যখন  শ্যামলা বরন পুরো গ্রামটা ঘুমিয়ে পড়েছে আলস্যে। কীর্তনখোলার বুক চিড়ে যাচ্ছে একটা দুটো নৌকা কিংবা ছোট লঞ্চ। আর ছোট ছোট কিছু ঢেউ তীরের বুকে আছড়ে পড়ার আগেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন কয়েকটি দুরন্ত দস্যি ছেলেমেয়ে মানে আমরা কয়েকজন কাজিন একত্রিত হতাম বাড়ির দক্ষিণ ধারের বড় কৃষ্ণচুড়া গাছটার নীচে।

দক্ষিণ ধারে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানখেতে, যদিও তখন পুরো জমিগুলো খা খা করত। কখনো কখনো  কৃষ্ণচুড়া গাছের নীচে নামাজের খাট বানানো থাকত।

দুজন দুটো খেজুর পাতা চিরল করে ছিদ্র করে, একটার ভেতর আরেকটা প্রবেশ করিয়ে অনবরত টেনে চলতাম আর বলতাম-

গাঁজা টানি ভোন ভোন

গাঁজা অইছে আড়াই মন

সাইবের আট যামু না

পচা গাঁজা খামু না।

তারপর দেখতাম পাতাগুলো থেকে কিছু নির্যাস তৈরি হয়েছে। অইগুলো ছিল আমাদের খাসা গাঁজা। ক্ষেতের অইপাশে স্কুল বন্ধের দিনে দুপুর বেলা  দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিজের নাম ধরে হাঁক দিতাম আর সেই প্রতিশব্দ ফিরে আসত। অমনি কী ভীষণ আনন্দে নেচে উঠত মন! সে আজকাল এই ডিজিটাল প্রযুক্তির ছেলেমেয়েকে কেমন করে বোঝাব! যাহোক এমনই ছিল  শৈশবের একেকটা দুপুর। আবার ছোট ছোট বোনদের দূরে আঙুল ইশারা করে বলতাম- উই যে দূরে দেখ! উইই সাদা সাদা ওভা( পেত্নী) যায়! ওভা তোরে ধরবে! কোনো কোনো দিন দুপুর বেলা উঠানের বড় তালগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে মেজ চাচার মেয়ে মুন্নি আর আমি নাচতাম – দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি

এনে দেব হাট থেকে মান তুমি করো না। কিংবা দোলানো দোলা, মাটিরও খেলা…

গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত  পুকুরে সাঁতার কেটে। কলাগাছের ভেলায় চড়ে। ভাই-বোন  কিংবা বোনরা মিলে প্রায়শই হেলেঞ্চা শাকের ডাটি ভেঙে খেলতাম পোলা- পোলা। বোনরাই বেশি খেলতাম। একটা ডাটি নিয়ে সবাই পুকুরের ভেতর গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে থাবড়াতে হবে তারপর যে খুঁজে পাবে তার একপোলা। এইভাবে আমরা সেই শৈশবেই একেকজন চার-পাঁচ পোলার মা হয়ে যেতাম…।  আমার চোখ একটু বড় সেজ চাচার মেয়ে তারনা ছিল ভীষণ ভীরু প্রকৃতির। প্রায় দিন ওকে বলতাম তারানা চল- পুকুরের মাঝখানে যাই। ও বলত না আমনে ডর দেহাইবেন। আমি বলতাম -বিদ্যা  পুড়ি ছাই। দেহামু না। পুকুরের মাঝখানে গিয়েই চোখ বড় করে বলতাম- আমার লগে জ্বীন আছে। তর ঘাড় মটকামু! তর আইজগো শ্যাষ!  তারানা বলত- ও পাপড়ি আফা মোরে মাপ কইররা দ্যান। আমনের পায়ে ধরি। কাঁদতে কাঁদতে বলত..। পরেরদিন যথারীতি ও যেতে চাইবে না আর আমি কীরাকাটা করে নিয়ে যাব এবং একইরকম ভয় দেখাব। এক অদ্ভুত পাষবিক আনন্দ পেতাম এতে। বড় হয়ে ভেবেছি প্রতিশোধ স্পৃহা, পাশবিকতা সাথে নিয়েই মানুষ জন্মায়। নইলে আঘাত করে এক ধরনের পাশবিক আনন্দ কেন পাওয়া যায়! আবার এখন ভাবি – মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সেই প্রাগৈতিহাসিক গল্পের মতো অন্ধকার মানুষ তার কোষে করেই নিয়ে এসেছে। বড় চাচার লাগানো একটা পেয়ারা গাছ ছিল- অইটাতে উঠে সব ভাইবোনরা পুকুরে লাফ দিয়ে পড়তাম। আহ! কী যে অনির্বচনীয় আনন্দ হত! তা এখন আর কাকে বোঝাব!

অই যে বাড়ির দক্ষিণ ধারের কথা বললাম। অইখানে  কৃষ্ণচুড়া গাছের সাথেই ছিল একটা নধরকান্তি জামরুল গাছ। থোকা থোকা একটু সবুজাভ সাদা জামরুল হত। আমাদের স্বয়ংক্রিয় তৎপরতায় কোনোদিনই জামরুল গুলো তেমন বড় হতে পারেনি। ছিল উস পয়গাম্বরের মতো লম্বা দুটো রূপসী নারকেল গাছ।

পুকুরের পাড়ে ছিল অনেকগুলো আমগাছ। বীথি আপা ছিল বেশি ভদ্র আর লাজুক। তাকে চাটানোর জন্য আমি আর চাঁদনি আপা জামা ওপরে তুলে পাছা টাইট করে ধরে বলতাম- বীথি আপা, বীথি আপা এই হোগা দ্যাহেন! চাঁদনি আপা বীথি আপাকে ডাকত কালী বলে।

বীথি আপা শ্যামলা ছিল তাই। চাঁদনি আপা বলত- এই কালী, কালী দ্যাক! বীথি আপা চোখ বন্ধ করে বলত- ছি ছি মনি(চাঁদনি আপা)! বীথি আপাকে এতটুকু ক্ষেপিয়ে মজা নাই, তাই.. জামার নিজের আঙুল প্রবেশ করিয়ে  ছেলেদের শিস্ন বানিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিসু করার অভিনয় করতাম। আর চাঁদনি আপা বলত- এই কালী, কালী দ্যাক কী করি! বীথি আপা চোখ বন্ধ করে থাকত আর আমি আর চাঁদনি আপা চোখে চোখে মজা নিতাম! সেই বীথি আপার যখন বিয়ে হল- চাঁদনি আপা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল- ও কালী তুই এ কী কললি? মুই একলা ক্যাম্মে থাকমু!

অই দক্ষিন দিকের ক্ষেতেই একদিন একটা অজগর মরে পড়ে আছে। আমি আর মেজ চাচার সেজ মেয়ে সুখী আপা গিয়েছি- কাঁথা নেড়ে দিতে। তো সুখী আপা বলে- পাপড়ি দ্যাক, একটা হাপ মইররা পইড়রা রইছে। সাথে সাথে বললাম – সুখী আফা লন, মোরা যাইয়া কই, মোরা এই হাপ মারছি। সুখী আপা সেই সুন্দরী, গায়ের রঙ সবরি কলার মতো ।  হাসলে গালে টোল পড়ে। হাসতে হাসতে বললেন- ল, ল ভালো অইবে আনে। গিয়ে আব্বুকে বললাম – আব্বো, আব্বো মুই আর সুখী আফায় একটা হাপ মারছি। আব্বু বলে কই ল তো দেহি। আব্বু জিজ্ঞেস করে – এতবড় অজগর তোরা কেমনে মারলি? অমনি আব্বুকে বললাম মোরা প্রথমে ইট উডাইয়া হাপের মাজায় মারছি। হেরপর দুইজনে পিডাইয়া মারছি। বাড়ির সবাই দুজনের সাহসের ব্যপক প্রশংসা করল। আমি আর সুখী আপা তাকাই আর মিটিমিটি হাসি। ক্ষমা করে দিও আব্বু। আজ তো সত্যি বললাম!

প্রাইমারি স্কুলে যখন ছিলাম – স্কুল ছুটি হলেই বলতাম- ছুটি, ছুটি, ছুটি। গরম, গরম রুটি, এককাপ চা, সবেমিলে খা! বাড়িতে এসেই আগে হাঁস মুরগীকে খাবার দিতে হত। তারপর খেয়ে দেয়ে বিকেলে আবার আম্মু প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াতে বসাত। সব জানালা আটকে দিত- তখন বাইরে শুনতাম কাজিনরা খেলছে- হট্টিটি, ছিবুড়ি, কানাফুসফুসি। কোনো কোনোদিন আম্মু খেলতে দিত। ছিবুড়ি খেলার সময় ছি দিতাম- ছিয়াত্মা ছিয়ারানী, ভাত দিয়া যা চুতমারানি,  একখানা, দুখান তালের গ্যারা তোর বাফে মোর জোতা চোরা। আর দাদা ছিবুড়ি খেলার সময় জোরে থাপ্পড় কষে আউট করত। একদিন সুমা আপা এসে বল্ল। খোকন তোমার এনসাফে এডা লইলে! এত জোরে থাবড় দেলা! আর সবাই হো হো করে হেসে দিল। সুমা আপা ভ্যা য়্যা করে কেঁদে দিল। হাইস্কুলে উঠে কোনো কোনোদিন স্কুল থেকে এসে আগে তালের আঁটি কেটে খেতাম।

শীতকালে বড় চাচা বাড়ি আসতেন। তিনি নলছিটি থাকতেন। তখন বাড়িতে পঁচিশ – ত্রিশ কেজি চালের রুটি, হাঁসের মাংস রান্না হত একেকদিন একেকদিন ঘরে। আরও রান্না হত রসে ভেজানো চিতই, চুই পিঠা। পুকুর থেকে বড় বড় রুই কাতলা মাছ ধরা হত। বাবা-চাচাদের খাওয়া শেষে আমরা বোনরা ঝুটার থালা নিয়ে বসতাম হাড্ডি চিবাবো তাই। শীতকালের দুপুর আর বিকেল হরিণের লেজের মতো ছোট। সেই দুপুরেই দাগ হট্টিটি খেলতাম। পাতা, মাটি, কাগজ, বোর্ড যাতে যতটা দাগ কাটা যায়। তারপর দুইপক্ষ দুইপক্ষের দাগ খুঁজে বের করবে। যাদের লুকানো দাগ বেশি তারা জিতবে।

তখন দাদা, সেজ চাচার ছেলে মেনন দাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলে এসেছে। বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে। বাড়ির বাবা-চাচারা আর্জেন্টিনা সমর্থক। আমরা ইয়াংরা ব্রাজিল। মেনন দাদা বললেন- চল আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ম্যাচ খেলি। ভাইবোনর ভাগ হয়ে গেলাম। সুমা আপা আমাদের পক্ষের গোলরক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন। হঠাৎ বৃষ্টি নামল। আবার বৃষ্টি থেমেও গেছে। হঠাৎ দেখা গেল- সুমা আপার সেলোয়ারের নীচ থেকে পানি পড়ছে। মামুন দাদা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে- সবাই দেখ, সুমা কী করে! সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে! সুমা আপা কাঁদতে কাঁদতে বলে- মুই কতখুন আইটকা রাকমু? মুই কী গোল খামু!

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে বর্ধিত -৭২ কক্ষে এক গ্রীষ্মের দুপুরে রুমমেট বন্যার ক্যাসেট প্লেয়ারে আমি,  বন্যা  আর সায়নীশুনছিলাম আইয়ুব বাচ্চুর গান- ফেরারি এই মনটা আমার মানে না কোনা বাঁধা তোমাকে পাবারই আশায়… আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি তখন, বন্যা কাজিনকে পছন্দ করে,  সায়নীও কাজিনের জন্য পাগল!  আমাদের তিনজনেরই চেহারায় চুড়ান্ত দুখী ছাপ স্পষ্ট। যেন আমাদের প্রেমিক চিরতরে হারিয়ে গেছে। তারপর বেজে উঠল – এই রুপালি গিটার ছেড়ে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে। আমার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল… ভাবলাম আইয়ুব বাচ্চু মরে গেলে আমি বাঁচব কেমন করে! আহারে কাঁচা আবেগ! আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর, বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন, পেটের ছেলে  পেটেই মারা গেছে।  আমি দিব্যি বেঁচে আছি। জীবন নিজেই স্বয়ম্ভু। ক্ষুধা,কাম,ঘুম,অন্বেষণ সেই জীবনের চার দেবতা।

এই চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে ছুটির দিনে দুপুরে রান্না করতে ছেলেকে সাথে নিয়ে বাচ্চুর গান শুনি-

আমি বারোমাস তোমায় ভালাবাসি, তুমি সুযোগ পাইলে

বন্ধু বাসিও।

এখন অনেক রাত…  তাই আমি বসে আছি দরোজার ওপাশে…

===========================