You are currently viewing গল্প: সন্ধিবিচ্ছেদ >লুনা রাহনুমা

গল্প: সন্ধিবিচ্ছেদ >লুনা রাহনুমা

সন্ধিবিচ্ছেদ

লুনা রাহনুমা

একটি দীর্ঘশ্বাসের সুদীর্ঘ আওয়াজ গুমরে কাঁদছে বাতাসে। বাড়ির বাইরে থেকে গোঙানির নিনাদ ভেসে আসছে। ঝড়ের আগে দমকা হাওয়া ছুটলে এই বাড়ির শোবার ঘরের জানালার কাচে ঠিক যেন একটা প্রেতাত্মার বিলাপ ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। মোনা দাঁড়িয়ে আছে খাটের পাশে সাইড টেবিলটার সামনে। দৃষ্টি লেপ্টে আছে টেবিলের ওপর রাখা বড় ফটো ফ্রেমটার মুখে। কয়েক সেকেন্ড পর দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসটি বেরিয়ে এলো ওর বুক ঠেলে। ফ্রেমের হাসিখুশি ছবিটি তোলা হয়েছিল ওদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকীর দিন। মোনার পরনে একটা লাল তাঁতের শাড়ি আর গালিবের গায়ে একটা বাটিকের পাঞ্জাবি। মোনার মনে পড়ে যায় সেদিনও বাইরে এমন বাতাস আর ঝড়ের হুটোপুটি ছিল, তবু তখন ঘরের ভেতরে ওদের স্বামী স্ত্রীর একটি সুখী জীবন ছিল। দুই হাতে চুলে একটা আলগা খোঁপা করে নিল মোনা। ফটো ফ্রেমের কাঁচের প্রতিবিম্বে কপালের লাল টিপটিকে তর্জনী দিয়ে দুবার চেপে ধরে। মুখে কেমন একটা গারো পাহাড়ের অজানা জঙ্গলের গভীর বিষণ্ণতার ছোপ।

বসার ঘরের সোফায় সুস্থির হয়ে বসে আছে গালিব। দেয়ালে ঝোলানো ৫৪ইঞ্চি টেলিভিশনটাতে বিবিসির নিউজ চলছে। সংবাদ পাঠক দুই হাত নেড়ে সংবাদ পড়ে যাচ্ছে কিন্তু তার কথার কিছুই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ টিভির ভলিউম মিউট করা। গালিবের পরনে জিন্স আর একটা পাতলা জ্যাকেট। হাতে একটি খোলা বই। এই বাড়ির গৃহকর্তা গালিবের মুখটিও ভার। তবে মোনার চেয়ে কম। গালিব টিভির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দৃষ্টি রাখে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রাখা দুটি সুটকেসের দিকে। তারপর সে মুখ উঁচু করে ডুপ্লেক্স বাড়ির উপর তলায় শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের দৃষ্টিতে কিছু প্রকাশ না পেলেও বোঝা যায় সে কান খাড়া করে আছে উপর তলা থেকে আসা কোনো শব্দ শোনার জন্য। সোফায় বসে থাকা গালিবের অভিব্যক্তি বলে দেয় সে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। দেয়াল ঘড়িতে সকাল দশটা বাজছে। রবিবার, ছুটির দিন, বিছানা ছাড়ার তাড়া নেই। গালিবেরও যেন মোটেই তাড়া নেই, তবুও সে নিচতলার সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। একসময় হাসিশূন্য মুখে হাতের বইটি পড়তে আরম্ভ করে বেশ অনাগ্রহ নিয়েই। 

উপরতলায় শোবার ঘরের দরোজাটি সামান্য ফাঁকা হতেই রবীন্দ্র সংগীতের হালকা সুর শোনা যায়। মোনার এই এক রোগ। বাড়িতে যতক্ষণ থাকবে একটা না একটা গান শুনবেই। ব্যান্ড মিউজিক, গজল, ভাংড়া, ঠুমরি, রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি, আধুনিক বাংলা, কাওয়ালি, সব ধরণের গানই সে শোনে। এখন বাজছে শ্রাবনী সেন এর কণ্ঠে একটি রবীন্দ্রসংগীত, “যদি প্রেম দিলে না প্রাণে…” 

আরো কিছুক্ষণ পর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো মোনা। সিঁড়ির কার্পেটে নিঃশব্দে ছেচড়াতে থাকে ওর হাতের পেটমোটা ব্যাগটি। জিন্স আর হাইনেক জাম্পারের উপর একটা পাতলা শাল জড়িয়েছে। কাশ্মীরি এই শালটি ওর বান্ধবী সাবরিনার স্বামী উপহার দিয়েছিল সিমলা থেকে আসার পর। সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে মোনা। নিচের সোফায় বসে বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়ে থাকা গালিবকে দেখে কয়েক সেকেন্ড। তক্ষুনি গালিবও চোখ তুলে মোনাকে দেখে। মোনার দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতের বইটি বন্ধ করে ফেলল গালিব। দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না। ওদের দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের দিকে চোখ রেখে সরাসরি তাকানোর এই ঘটনা ঘটছে বেশ অনেকদিনের পর। বলা যায় অনেকগুলো বছর পর। 

-নাস্তা করেছ? মোনা জিজ্ঞেস করে। 

মুখে কিছু বলে না গালিব। শুধু দুই দিকে মাথা নাড়ে। মনে মনে বলল, কতদিন পর তুমি আমাকে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলে মোনা? 

-চলো দুজনে একসাথে নাস্তা করি আজ। দ্যা লাস্ট ব্রেকফাস্ট! শীতলস্বরে মোনা বলে। 

-আমি নাস্তা করব না। শুধু চাইলে এককাপ চা দিতে পারো। গালিবের কণ্ঠস্বরও ভীষণ শীতল শোনায়, শীতের বিকেলে বরফের আস্তরের মতো বিকারহীন।

পরিপাটি করে সাজানো একটি সৌখিন রান্নাঘরের কোণ। একপাশে রান্নার চুলা, থালাবাটি রাখার তাক, ফ্রিজ আর কিচেনের অন্যান্য জিনিসপত্র। অন্যপাশে বাগানে যাবার দরজার কাছাকাছি পাতা আছে ছোট্ট একটি কাঠের টেবিল আর দুটো কাঠের চেয়ার। মাঝেমাঝে বিকেলে এই টেবিলে বসে মোনা চা অথবা কফি পান করে আর পাশে প্লেয়ারে বাজতে থাকে প্রিয় কোনো গান। আজ ওরা দুজন মুখোমুখি বসেছে টেবিলের দুইপাশে। দেড় হাত চওড়া টেবিলের উপর দুই মগ চা। কেটেলের পানিতে বানানো টলটলে ইংলিশ টি। চিনি ছাড়া, আমি তো এমনিতেই মিষ্টি, খুব বলত আগে মোনা। আর গালিবের রক্তে সুগার ধরা পড়েছে অনেক বছর হলো, ওর জন্য চিনি বিষ। গাছ পাগল মোনা বাড়ির ভেতরে নানা ধরণের গাছগাছালি লাগিয়েছে। বাগানের দরজার ওপর প্লাস্টিকের বোতলে ঝুলছে মানিপ্ল্যান্টের হলুদ সবুজ লতা। গালিব তাকায় মোনার দিকে, মোনা তাকিয়ে আছে বাইরে, বাগানের বৈচিত্রহীন ঘাসগুলোর দিকে। একসময় মুখ ঘুরিয়ে মোনা তাকায় গালিবের দিকে, যেন চামড়ার দাগগুলোকে গুনছে এক এক করে। আর গালিব গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে মগের ভেতর স্থির হয়ে থাকা পানীয়ের দিকে। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময় মোনা তাকিয়ে থাকে গালিবের মুখের চামড়ায়। একসময় এই মুখটি ওর কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুপুরুষের মুখ ছিল। অথচ এরপর কত কী যে ঘটে গেছে, প্রিয় মুখের দিকে এখন জোরপূর্বক আহ্লাদ নিয়ে তাকালেও বুকের ভেতরে আর সেই পদ্মার পাড় ভাঙার মতো ছলাৎ কাঁপন টের পায় না মোনা। অন্যদিকে মোনার কমনীয় রুপ সৌন্দর্য প্রায়-অপরিবর্তিত থাকলেও গালিবও আর ফিরে তাকায় না মোনার দিকে। আহা প্রেম! ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় প্রেমও একদিন। চাঁদ তবু ফের ভরে উঠে পূর্ণ হয় পূর্ণিমার আগে, কিন্তু মানুষের অন্তরের নিখাঁদ প্রেম একবার ক্ষয় হতে আরম্ভ করলে আর কী কোনোদিন সে পূর্ণ হবার কথা ভাবে, আরবার?  

মোনা লক্ষ্য করে গালিবের কানের দুইপাশের চুলে পাক ধরেছে। ক্লিন সেইভড ফর্সা গালের পাশে সাদা চুলের ঝাড় মোনাকে কাশ ফুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। আয়ত চোখদুটি নিচের দিকে নামানো থাকলেও মোনার মনে হতে থাকে গালিবের চোখ ভর্তি জল। হয়তো চায়ের মগের মতো গালিবের চোখ দুটি বুকে আগলে রেখেছে তরল আর উষ্ণ ব্যথা। ফোলা ফোলা ঠোঁট দুটি বরাবর মোনাকে চুম্বকের মতো টেনেছে সুমেরু আর কুমেরুর অনিবার্য মিলনের সাংঘর্ষিক আকর্ষণে। কিন্তু আজ গোলাপি ঠোঁট দুটিও বিন্দুমাত্র আবেদন জাগাতে পারে না চিত্তে। শুধু এককালের ভীষণ প্রিয় মুখটির দিকে তাকিয়ে মোনার ভাবনারা উল্টো পথে উড়তে আরম্ভ করে। সে চলে যায় অতীতের একটি বিশেষ দিনে। সেটি গালিবের সঙ্গে ওর পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন ওদের প্রণয় হয় হয় অবস্থা!

লন্ডনে স্থানীয় একটি দলের আয়োজনে নজরুল জয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি চলছিল তখন। গান শোনার মতো একসময় গান করাটাও মোনার প্রচন্ড শখের কাজ ছিল একসময়। সেই অনুষ্ঠানে মোনা একটি নজরুলগীতি গাইবে। জয়ন্তীর আগে মাসখানেক ধরে ওদের রিহের্সাল হয়েছে হল ভাড়া করে। এক বন্ধুর সঙ্গে একদিন রিহের্সাল দেখতে গিয়েছিল গালিব। মোনাকে একঝলক দেখেই সে মোনার প্রেমে পড়ে যায়। শুধু মোনাকে দেখার জন্য রিহার্সালে যাবার বাহানা তৈরি করতে গালিবও নজরুল জয়ন্তীতে অংশ নেবে ঘোষণা দেয়। একদিন, দুদিন, গালিব মোনাকে কিছু না বললেও তৃতীয়দিন ক্লাস শেষে সে মোনার পথ আটকে দাঁড়ায়। হাতে নজরুলের সঞ্চিতা। গালিবকে কাচুমাচু মুখে দেখে চঞ্চলা মোনা বলেছিল, গালিব ভাই কিছু বলবেন নাকি?

যেমন বীরদর্পে গালিব পথ রোধ করেছিল মোনার, মুহূর্তে সেই পাহাড় সমান সাহস কোথায় গায়েব হয়ে গেল কে জানে! কাচুমাচু মুখে বলেছে, অনেক কথাই তো বলতে চাই। বলতে আর পারছি কই!

-কথার পরিমাণ অনেক বেশি হলে আজ থাক। অতো কথা শোনার সময় আমার নেই। আমি বাড়ি যাই। তাড়া আছে। নিষ্ঠুর উপেক্ষা দেখিয়ে বলেছে মোনা।  

কণ্ঠে ব্যাকুল মিনতি ঝরিয়ে গালিব বলে, না একটু দাঁড়াও প্লিজ। 

-আচ্ছা দাঁড়ালাম। সময় কিন্তু মাত্র দুই মিনিট বরাদ্ধ আপনার জন্য। 

-সেকি, বিদ্রোহী কবি নজরুল কী কেবল দুই মিনিটের ব্যাপার!

-মানে? আপনি কী এখন আমাকে সঞ্চিতা পুরোটা গেয়ে শোনাবেন নাকি? আঁতকে উঠেছিল মোনা।

-তোমাকে আমি গোটা সঞ্চিতা গেয়ে অথবা পাঠ করে শোনাব, তেমন ক্ষমতা আমার নেই লেডি মোনালিসা। তবে এভাবে তোমাকে দেখতে আসার জন্য আমাকে যদি এই গানের আর দুটি লাইনও গাইতে হয়, তাহলে কিন্তু আমার মুখের দাঁত ভাঙবে আর গলার কয়েকটি তারও ছিঁড়ে যাবে। এবং আমার শরীরে ভাঙা দাঁত, ছিড়া তার থাকলে আমার শেষ গতি হবে কেমন করে, তুমিই বলো? 

-বুঝলাম না। মোনা বলে।

-শিং ভাঙা, কান কাটা, লেজ কাটা, এইসব পশু কুরবানীর জন্য শরিয়া বহির্ভুত। তাই বলছি আমার অবস্থাও তেমন হলে তুমি তো আর আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। তাই না?

খুব হেসেছিল মোনা। রিহার্সালে সেদিন ওদেরকে কাজী নজরুল ইসলামের একটি কীর্তন “জাগো জাগো শঙ্খচক্র” রেওয়াজ করানো হয়েছিল। উৎসুক অংশগ্রহণকারী হিসেবে গালিবকেও গানটি গাইতে হয়েছে বাকিদের সঙ্গে। গালিবের করুণ মুখটি দেখে মাথা নাড়িয়ে খুব হেসেছে মোনা। তারপর ওর লাল ডাই করা ববকাট চুলে ঢেউ তুলে উচ্চশব্দে গেয়ে শুনিয়েছে কীর্তনের মুখ:

জাগো জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী,

জাগো শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণাতিথি তিমির-অপসারী

জাগো জাগো শঙ্খ চক্র গদাপদ্মধারী। 

 

নজরুল জয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠানের আগের সবগুলো রিহার্সালে গালিব গিয়েছে, কিন্তু গান জানার মিথ্যা অভিনয় করেনি আর। বরং সরাসরি কেবল মোনার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছে। নিয়মিত প্রেমের প্রস্তাব জানিয়ে আসা গালিবকে বিয়ে করার ব্যাপারটি নিয়ে মোনা ভেবেছে। আশেপাশের সম্ভাব্য পাত্রদের সঙ্গে দাড়িপাল্লায় মেপে দেখলে গালিবের দিকটা খুব হালকা আর আড়াআড়ি প্রায় আকাশমুখী হয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ সুপাত্র হিসেবে গুণাবলীর তালিকা প্রায় শূন্য বলা চলে। তবু, মাত্র একমাসের মাথায় মোনা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা গালিবকে হ্যাঁ জবাবটি জানিয়ে দেয়। এবং এরপর আরম্ভ হয় ওদের দুই বাড়িতে দুই পরিবারকে সম্মত করার কঠিন যুদ্ধ। আমে আর দুধে মিলমিশ হবার আপ্রাণ চেষ্টা। নিশ্চিত জানা ফলাফল, দুজনের পরিবারই এই বিয়েতে ঘোর অসম্মতি জানায়।

যতই করো বাহানা আমাকে তুমি না করতে পারবে না, গালিব জানত মোনাকেও একদিন না একদিন রাজি হতেই হবে। মোনার কাছ থেকে বিবাহের সম্মতি সূচক প্রত্যুত্তর পেয়ে যাবার পর আসে গালিবের পরিবারের মানুষদেরকে রাজি করানোর পালা। দেশে ফোন করে কথা বলেছে গালিব। স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডনে পড়তে আসা ছেলে যদি ছয়মাসের মাথায় বিয়ের জন্য বায়না ধরে বসে তাহলে সেটি পরিবারের লোকজনের জন্য খুশির সংবাদ হবার কথা নয়। গালিবের বাড়ির কেউই খুশি হয়নি। আর তাদেরকে বিয়েতে রাজি করানো চাট্টিখানি কাজ ছিল না। মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনের কথোপকথনের সংলাপগুলো এখনো পরিষ্কার মনে আছে গালিবের। টেবিলের উল্টো পাশে মোনাকে বসিয়ে রেখে চায়ের মগে চুমুক দিয়ে গালিব চলে যায় সেইসব দিনে।

-আম্মা, আমি বিয়ে করব। ফোনের একপাশে হ্যালোর জবাবে এটাই ছিল গালিবের প্রথম কথা।

-আগে লেখাপড়াটা শেষ করো বাবা। তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। বাচ্চা ছেলেকে মাথায় হাত বুলিয়ে যেভাবে বায়না থেকে ভোলায় মা, সেইভাবে বলেছে গালিবের মা, হাসিমুখে আর খুব নরম সুরে।    

-না আম্মা। আমি আগে এই মেয়েকে বিয়ে করব। তারপর লেখাপড়া করব। আপনি আব্বাকে বলেন। 

ছেলেকে পাশ কাটাতে চায় মা। বলে, তোমার আব্বাকে তুমিই বলো। ফোন দিচ্ছি আমি। 

তড়িৎ গতিতে চিৎকার করে উঠেছে গালিব, না আম্মা। আপনি আব্বাকে বলেন আমি মোনালিসাকে বিয়ে করতে চাই। আব্বাকে আপনি রাজি করাবেন। এটা আপনার দায়িত্ব।

মোবাইলের অপরপাশে গালিবের বাবার কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল এরপর। বাবার কণ্ঠস্বরে খুব রাগ আর বিরক্তি। বরাবর গালিব ওর বাবাকে ভয় পেয়ে এসেছে। ছোটকাল থেকে ওদের বাবা ও ছেলের মধ্যে কেমন অস্বস্তিকর এক দূরত্ব। তবু সেদিন গালিব বুকে সাহস সঞ্চয় করে শক্তি জুগিয়েছিল। তৈরি ছিল প্রয়োজন হলে নিজের মুখেই সে তার বাবার কাছে বলবে, মোনালিসাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে গেলেও এই মেয়েকে তার এক্ষুনি বিয়ে করতে হবে। গালিবের বাবা সেদিন ফোন হাতে নেননি। শুধু পাশ থেকে হুংকার ছেড়েছেন। বলেছেন, তোমার ছেলেকে বলো আগে এমবিএটা শেষ করতে, তারপর বিয়ে করতে। তোমার সুপুত্র কিন্তু বিয়ে করার জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে যায়নি। কথাটা ওর মগজে ভালো করে ঢুকছে না কেন সেটা আমার প্রশ্ন।  

নিজের সংকল্পে অটুট গালিব বলেছে, আম্মা আপনি আব্বাকে বলেন আমি আগে বিয়ে করব, তারপর এমবিএ। 

বাড়ির বাইরে কয়েকটি বাচ্চার খেলার হইচই কানে আসে। মোনা আর গালিব দুজনের মুখ ঘুরিয়ে জানালার ওপাশে রাস্তার কয়েকটি ইংলিশ বাচ্চাকে সাইকেল চালাতে দেখে। ছুটির দিনগুলিতে এই এলাকার আশেপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বাচ্চাগুলো। কয়েক ঘন্টার জন্য বাচ্চাগুলো বাড়ির আশেপাশে খেলে আবার ঘরে চলে যায়। চায়ের মগ হাতে গালিব যখন ওর বাবা আর মায়ের সঙ্গে ফোনের কথাগুলো নিয়ে ভাবছিল ঠিক সেই সময় মোনাও চলে গিয়েছে অতীতে। গালিবকে বিয়ে করতে চায়, এই কথাটি মোনার পরিবারের লোকজন মানতে চায়নি। বাবার আহ্লাদী মেয়ে মোনা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে, আব্বু গালিবকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে আমি শুধু ওকেই করব।

মোনার বাবা মেয়েকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়ে বড় করেছেন কিন্তু স্নেহের কন্যার জামাতা হিসেবে গালিবের ব্যাপারে তিনি আপত্তি করেছিলেন। ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছিলেন, এই ছেলের কোনো স্ট্যাটাস আছে? শেষপর্যন্ত ছেলেটি যদি লেখাপড়া শেষ করতে না পারে? সমস্তটা জীবন অড জব করে কাটাবে এই দেশে। আর তুমি হবে একটা ভ্যাগাবন্ড লোকের স্ত্রী। তখন কিন্তু তোমার আর এই ছেলেকে মোটেই ভালো লাগবে না মামনি। আমার কথা লিখে রাখতে পারো।  

স্বভাবতই মোনাও ওর বাবার কথা মানেনি। জেদ করেছে। বলেছে, গালিব লেখাপড়া শেষ করতে পারবে আব্বু। আমি ওর লেখাপড়া শেষ করার দায়িত্ব নিলাম। 

দীর্ঘশ্বাস মোনার বাবা। বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। জীবনের এক পর্যায়ে এসে বাবা মা সন্তানের কাছে মানসিকভাবে জিম্মি হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ওপর জোর জবরদস্তি করে নিজের মতামত চালানো যায় না, কথাটি তিনিও ভালো করেই জানতেন। তবু মেয়েকে সতর্ক করছেন। 

-এই ছেলের সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে হলে এখন আমাকে দেশে লোক পাঠাতে হবে। লন্ডনে ছেলের ফ্যামিলির একটিও আত্মীয়স্বজন নেই। আর খুঁজতে গিয়ে শেষে যদি বের হয় যে ছেলেটা একটা ফ্রড! প্রতারক? তখন কী করবে?

 বলাই বাহুল্য, বাবার কথা মোনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, আব্বু ও ফ্রড না। গালিবকে আমি ভালো করে অবজার্ভ করেছি। হি ইজ এ গোল্ড সোল। বিয়ে করলে আমি এই ছেলেকেই করব।

বিকট শব্দের অত্যাচারে মোনা বাবার সামনে থেকে ছিটকে এসে পড়ে গালিবের সামনে। বাগানের পাশের রাস্তায় একটা গাড়ি চলে গেল বেশ জোরে শব্দ করে। কিছু কিছু গাড়ির চালকেরা ইচ্ছে করে গাড়ির সাইলেন্সার খুলে রাখে চাঞ্চল্যকর শব্দ করার জন্য। যদিও সেসব গাড়ি আবাসিক এলাকায় চালানোর অনুমতি নেই, কিন্তু তেমন একটি শব্দযুক্ত গাড়ি কেউ চালিয়ে গেল এই মাত্র। চিন্তার জগৎ থেকে বর্তমানের বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে ফিরে এসেছে ওরা দুজন। দরজার নেটে একটুখানি মাকড়সার জাল দেখে গালিব সেটিকে আঙুলে ঝেড়ে ফেলল। 

-তোমার চা শেষ? মগ নেব? গালিব বলে। 

-হ্যাঁ, নিতে পারো। মোনা খালি মগটি গালিবের হাতে দেয়। 

মগ দুটিকে সিংকে ধুয়ে ট্রেতে উপুড় করে রাখে গালিব। কিচেন টাওয়েলে হাত মুছে বিনে ফেলল ভেজা টিস্যু পেপার। আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। মোনাও অপেক্ষা করছিল যেন গালিবের জন্য। দুজনেই চাইছে আইনগতভাবে সম্মত দাম্পত্য সম্পর্কটি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবার আগে কিছুক্ষণ সহজ আর স্বাভাবিক পরিচিতজনের মতো কিছুটা সৌজন্য আলোচনা করে নেয়া যাক না হয়। আর হয়তো কোনোদিন কথা বলা হবে না দুজনের এভাবে মুখোমুখি বসে! সংসারে কার দোষ এক আনা বেশি ছিল আর কার ছিল আধ আনা কম, চুল চেরা বিশ্লেষণের ঝড় উঠবে না আর কোনোদিন এই দুটি মানব মানবীর মাঝে। কে জানে আবার কোন জন্মে ওরা মুখোমুখি বসবে এভাবে অভিমান আর অভিযোগ জানানোর শেষ দিনের শেষ দৃশ্যে!  

-সংসারের খেলা আমাদের সত্যি ফুরিয়ে এলো এবার? বিশেষ আলাপ আরম্ভ করার ইতস্ততকর অস্বস্তি ভেঙে প্রথমে কথা বলল গালিব। সামান্য হাসির রেখাও ফুটে ওঠেছে বোধহয় তার ঠোঁটের কোণে।  

-চলার গন্তব্যকে এক পথ থেকে না ফেরালে আরেক পথের দেখা মেলে না কোনোদিন। তাছাড়া, গালিব, আলাদা পথে হাঁটার অভিযানে আমরা দুজন তো এগিয়েছি সেই কবেই! এই সিদ্ধান্তটি আমাদের আসলে আরো অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। ভালোবাসাহীন জীবনে পাশাপাশি থাকার চেয়ে সম্মানের সঙ্গে দূরত্বে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সেটি যেমন তোমার সুখের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি আমার জন্যেও। 

কিছুক্ষণ চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবে গালিব। তারপর বলে, তুমি কি সবকিছুর জন্য শুধু আমাকেই দোষারোপ করো মোনা?

-সবকিছু মানে আমাদের এই সংসার ভেঙে আলাদা হয়ে যাওয়া? আমাদের দুজনের প্রাণ ভরে একটুখানি শ্বাস নেয়ার একটি প্রচেষ্টার কথা বলছ?

গভীর দৃষ্টিতে গালিব সরাসরি তাকায় মোনার চোখের দিকে। একদিন সময় এসেছিল একটি ভালো বাসা গড়ার কথা জানবার। আজ সময় এসেছে সেই ভালো বাসাটিকে পৃথক করার আলাপে বসার। গালিব বলল, আমাদের বিবাহের বিচ্ছেদ আর আমাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসাটুকু নষ্ট হয়ে যাওয়া- এই দুটোর কথাই বলছি মোনা। বাদবাকি সব এই একটি ঘটনার ফলাফল।     

 -আমি কি তোমাকে কোনোদিন বলেছি যে সব দোষ তোমার একার? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে মোনা।

 মোনার কথার সুরে কেমন একটা বিরহী কোকিলের হাহাকার ফুটে ওঠে। প্রতারক প্রেমিকের আঘাতে জর্জরিত প্রেমিকাটি যেমন তবুও নিজের কাছে মানতে পারে না তার প্রেমিকটি চতুর ছিল, বরং এই ভেবে স্বান্তনা পায় দোষের ভাগ বেশিটা তার নিজেরই ছিল, সেইমতো একটা আহত উচ্চারণ প্রকট হয় মোনার কথায়। মোনা আর গালিব দুজনেই উদাস হয়ে ওদের সংসার জীবনের কথা ভাবে। কিছু অনাকাঙ্খিত ভুল বোঝাবুঝির কথা মনে পড়ে যায়। ছায়াছবির পর্দার মতো ওদের দুজনের মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে অনভিপ্রেত কিছু ঘটনার চিত্র। মোনা ভাবে, মাঝেমাঝে সময় আমাদেরকে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোকে ভিডিও টেপের মতো সামনে এনে উপস্থিত করে। ওরা দুজনেই কল্পনা করে ওদের সংসার জীবনের কিছু খন্ড খন্ড দাম্পত্য কলহের দৃশ্য। কিছু মানসিক বিস্বাদ আর বিরাগের তিক্ত স্বাদযুক্ত ঈর্শ্বাপরায়ণতার মুহূর্ত।

সেদিন ওপরতলার শোবার ঘরের বিছানাটি খুব এলোমেলো ছিল। সাইড টেবিলে কাত হয়ে পড়ে ছিল টেবিল ল্যাম্প। মেঝের ওপর ছড়ানো ছিল গালিবের ছুড়ে মারা নানান জিনিসপত্র। মোনা যেন চোখের সামনে কল্পনা করতে পারছে মারমুখী ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে গালিব। আর দারুণ শংকিত বুকে মেঝে থেকে কয়েকটি জিনিস তুলে গোছানোর চেষ্টা করছে মোনা। 

-আমি তোমাকে বলেছিলাম মোনা, স্ক্যাটল্যান্ডের ট্রিপটা ক্যানসেল করতে। ওদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে ভাল্লাগে না আমার। 

গালিবের গলায় উষ্মা। রাগ। মোনা তবু খুব শান্ত গলায় কথা বলে।  

-ওদের সঙ্গ আর আড্ডা আমি পছন্দ করি গালিব। ওদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে ভালো লাগে আমার। তাছাড়া সাবরিনা আর তামান্না আমার ভালো বন্ধু, তুমি জানো।

-কিন্তু ওদের হাসব্যান্ডরা তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করে, আমার একদম ভালো লাগে না। ওরা তোমার বান্ধবীর স্বামী হয়েও তোমার সঙ্গে ফ্ল্যার্ট করতে চায়, ওরা খুব অসভ্য। ঘৃণা নিয়ে বলে গালিব।

-কিন্তু তারা তো তোমারও বন্ধু। তুমি তোমার বন্ধুদেরকে নিষেধ করতে পারো না? 

-আমি ওদেরকে না করতে গেলে সেটি আবার তোমার নারীবাদী ইগোতে গিয়ে একশো মাইল স্পিডে ধাক্কা মারবে না? হাহ! দারুণ ব্যঙ্গ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে গালিব। 

মেঝে থেকে কয়েকটি জিনিস হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে মোনা। টেবিলের ওপর সেগুলোকে গোছাতে থাকে কাঁপা হাতে। বলে, তুমি একটা বাস্টার্ড, গালিব। মোনার কণ্ঠস্বর নিচু অথচ দৃঢ় শোনায়। 

মোনার কথা শেষ হতেই বিকট শব্দের হাসিতে ফেটে পড়ে গালিব। বলে, একদম ঠিক বলেছ মোনালিসা। আমি একটা রাজকেলও বটে। আর সবচেয়ে বেশি সত্যি যে আমি তোমার হ্যান্ডব্যাগে পোষা একটা মিউমিউ স্বামী। তোমার পরিবারের সবাই আমাকে কম অপমান করেছে? তোমার আব্বু তো সারাক্ষণ বলে, তার মেয়ের কারণে আমি ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়েছি। এই দেশে আমার একটা স্ট্যাটাস হয়েছে শুধু তার কন্যাটি আমাকে দয়া করে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে বলে। আহা বেশ বেশ! 

মোনা জবাব দিতে সময় নেয়। কণ্ঠস্বর ভীষণ শান্ত, যদিও এবার সে ঘুরে তাকিয়েছে গালিবের দিকে। বলে, কথাগুলো কি সম্পূর্ণ মিথ্যা?   

-স্ক্যাটল্যান্ডের ট্রিপের ব্যাপারে সবকিছু ওরা তোমার সঙ্গেই ঠিকঠাক করে ফেলল? আমাকে কেউ একটিবারও কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করল না! আমার সঙ্গে আলাপ করার কোনোই দরকার নেই? কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি তুমি চাইলে সুরসুর করে আমিও উপস্থিত হয়ে যাবো সবখানে। আমার নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই? আর বান্ধবীর বরদের সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি কেন মোনা? তোমার জন্য আমি এনাফ না? আমাকে দিয়ে হয় না তোমার?

-তুমি তোমার হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসো গালিব। এখনো সময় আছে। তোমার এইসব ছোটলোকি আচরণ আর অশ্লীল ইঙ্গিত আমি একটুও বরদাস্ত করব না বলে দিচ্ছি। রাগে কণ্ঠস্বরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎকার করে ওঠে মোনা।

-নিজেকে তুমি খুব কিছু মনে করো, তাই না? অনেক করে ফেলেছ তুমি আমার জন্য। আমাকে উপরে টেনে তুলে লোকের কাছে তুমি নিজে অনেক মহান হয়েছ! আমার জন্য তোমার আর কিচ্ছু করতে হবে না এখন থেকে। কথা শেষ করে অসহ্য যন্ত্রনায় গোঙাতে থাকে গালিব।

এবার মোনাও গলা খুলে ঝগড়া আরম্ভ করে। বচসা আর চিৎকার করে যেতে থাকে ওরা দুজনেই। শীতের দেশে বাড়ির দরজা জানালাগুলোকে এয়ারটাইট করে লাগানো হয় যাতে বাইরের ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে টেম্পারেচার নামিয়ে না দেয়। বাতাসের মতো শব্দের প্রবেশ আর নির্গমনও রোধ হয় একই কারণে। নইলে বাড়ির ভেতর চিৎকার করতে থাকা দম্পত্তির কলহ খুনোখুনি পর্যন্ত গড়িয়ে যাবার ভয়ে প্রতিবেশীরা কেউ একদিন না একদিন পুলিশকে ফোন করত নিশ্চিত।   

-একদম গলাবাজি করবে না গালিব। এতদিন তোমাকে আমি অনেক সহ্য করেছি। আর যদি একদিনও তুমি আমাকে ভার্বালী এবিউজ করার চেষ্টা করো, তাহলে আমি পুলিশ কল করব বলে দিলাম। 

পুলিশের ভয়ে হোক অথবা মোনার রেগে যাওয়া দেখেই হোক, গালিব স্তিমিত হয়ে পড়ে। তার কণ্ঠস্বর একটু শান্ত আর দুঃখী শোনায়। বলে, এই দেশে তোমাদের আছে তো ওই একটাই অস্ত্র। রানীর দেশ, রানীর কথার দাম সবার উপরে। আমিও তোমাকে সারাটি জীবন আমার রানী করেই রাখতে চেয়েছিলাম মোনালিসা। নজরুল জয়ন্তীর রিহার্সালে তোমাকে একবার দেখেই আমার মনের মধ্যে যে প্রেম তৈরি হয়েছিল, সেই প্রেম আমি এখনো অনুভব করি মোনা। একবার যদি তুমি সুস্থির হয়ে আগের মতো আমার বুকে কান রাখতে, তাহলে শুনতে পেতে আমার মনের কথাগুলো এখনো তেমনই আছে। কিন্তু তুমি সবকিছুতেই এত খুঁতখুঁতে, এত পারফেকশনিস্ট, তোমার চারপাশে এত ফ্যান- যে তোমার পাশে আমি একটা নোংরা তেলাপোকা ছাড়া আর কিচ্ছু না। 

গালিবের কথা শুনতে শুনতে নিস্পলক তাকিয়ে ছিল মোনা গালিবের মুখের দিকে। ভীষণ মায়াভরা গালদুটিতে অভিমানে ফুলে ওঠা রঙের আভা নাড়িয়ে দেয় মোনার বুকে ভাঁজ করে রাখা দূরত্বের হলদে রুমালটিকে। হঠাৎ করে যা ঘটার নয় তাই ঘটে। কেঁদে ফেলে মোনা। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। আর গালিবও যা করার নয় তাই করে। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে মোনাকে। 

-আমি তোমাকে ভালোবাসি সোনা। গালিব বলে। 

-আমিও তোমাকে ভালোবাসি বাবু। মোনালিসা বলে। 

দুজনেই একসঙ্গে একই দৃশ্যে ফিরে গিয়েছিল হয়তো, দুজনেই বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে ওরা। মোনা উঠে গিয়ে আরেক মগ চা বানিয়ে আনে নিজের জন্য আর গালিবের জন্যেও। দুজন আবার গরম চায়ের মগ সামনে নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি বসে। দুজন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। দুজনেরই মুখ বিষন্ন। কিন্তু একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পাড়ার স্বস্তি দেখা যায় ওদের মুখে।

মোনা কথা আরম্ভ করে এবার। বলে, বলতে পারবে গালিব, কতদিন হলো আমরা দুজন এই একটি বাড়িতে আলাদা আলাদা ঘরে থাকছি? 

-পাঁচ বছর? চিন্তা ছাড়াই বলে গালিব। 

-আরো বেশি। ২০১৬ সালে আমার তৃতীয়বার মিস-ক্যারেজ হবার পর থেকে আমরা আলাদা ঘরে থাকি। এরপর আর কখনো আমরা দুজন একসঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটাইনি। তিরস্কারের আভাস পাওয়া যায় মোনার কণ্ঠে। 

-তুমি আমাকে সহ্য করতে পারতে না তখন। আমি তোমাকে ছুতে গেলেই তুমি কেমন তেড়ে আসতে মোনা। তাছাড়া ডাক্তার তোমাকে রেস্ট নিতে বলেছিল। তাই তোমাকে স্পেস দিতে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম আমি। সোজাসাপ্টা জবাব আসে গালিবের মুখ থেকে। 

-ভুল কথা বললে গালিব। তুমি নিজের ইচ্ছায় আমাদের স্বামী স্ত্রীর বিছানা আলাদা করতে চেয়েছিলে আরো অনেক আগেই। আমিও তোমাকে আলাদা হতে দিয়েছি। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে যে একেকটা মিস ক্যারেজের পর আমি সবচেয়ে বেশি করে তোমাকেই কাছে পেতে চেয়েছি, যদিও ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। তুমি যখন প্রতিটি মিস ক্যারেজের জন্য প্রতিবার আমাকেই দায়ী করতে, ভীষণ কষ্ট হতো আমার। আমার গর্ভে সন্তান তৈরির জমাট রক্তটুকু ধুয়ে যাবার কষ্টের চেয়ে কম কষ্টের ছিল না তোমার সেইসব উপেক্ষা আর দায় দেয়ার প্রচেষ্টার অপমান।

-মিস-ক্যারেজেরগুলোর জন্য অবশ্যই তুমি দায়ী ছিলে মোনা। প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজেটিভ হবার পর তোমার উচিত ছিল চাকরি ছেড়ে দেয়া, সুস্থির হয়ে গর্ভের বাচ্চাটিকে বাড়তে দেয়া। ওহ, কাকে আমি কি বলছি এইসব! তুমি তো তিন মাসের প্রেগন্যান্সিতেও ড্রিংক করা ছাড়তে পারোনি। আবার বলছ তোমার দোষ না। হাহ! 

কথা বন্ধ করে গালিব। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে মোনা গালিবের মুখের দিকে। এবার বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে মোনা। 

-সাবরিনার জন্মদিনে ওরা খুব জোর করছিল বলে মাত্র এক পেগ লাইট ওয়াইন খেয়েছিলাম আমি। তাও তোমার চোখ এড়ায়নি, কারণ তুমি আমার ওপর সারাক্ষণ স্পাইং করছিলে ওখানে। 

-লায়ার! একদম বাজে কথা বলবে না। সেদিন তুমি পার্টি থেকে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিলে মোনালিসা চৌধুরী। সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে খাট পর্যন্ত যাবার শক্তি ছিল না তোমার। আমি তোমাকে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলাম। মনে করে দেখো মোনা।  

-তবু গালিব, আমার সেই দুঃসহ কষ্টের সময় তোমার কিন্তু আমার পাশে থাকা উচিত ছিল। আমার গর্ভ থেকে ঝরে যাওয়া ফুলের ব্যবচ্ছেদে আমি যখন সারাটি রাত কেঁদে কাটিয়েছি, তখন তুমি আমার একটি হাত ধরে কাছে থাকতে পারতে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ একজন স্ত্রীকে ওভাবে একা ফেলে অন্যঘরে কোল বালিশ নিয়ে ঘুমাতে যায় না কোনো স্বামী? তোমারও যাওয়া উচিত হয়নি গালিব।

-উহু। খুব উচিত হয়েছে। আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছিলাম না তখন। গত আঠারোটি বছর যে কিভাবে আমি তোমার সঙ্গে একই ছাদের নিচে ছিলাম, সেটি ভেবে আজ খুব অবাক লাগছে। আরো আগেই আমার সিদ্ধান্ত নিতে পারা উচিত ছিল। নিজেকে ধিক্কার দেই আমি এই বিলম্বের জন্য।

-আচ্ছা, সেই ভালো। এই ভালো। তুমি থাকো তোমার আত্ম অহংকার নিয়ে। আমি চলে যাচ্ছি তোমার বাড়ি থেকে। 

-না, তুমি কোথাও যাবে না মোনালিসা। তুমি এখানেই থাকবে। এই ঘর-বাড়ি একটু একটু করে তোমার পছন্দে সাজানো। আমি এখানে থাকব না। বরং আমিই চলে যাচ্ছি। দৃঢ়স্বরে আদেশের সুরে বলে গালিব। 

-দয়া দেখাচ্ছ? 

-একটু না হয় দেখলাম। তোমার কাছ থেকে তো কম নেইনি আমি এই পর্যন্ত, তাই না। অন্তত তোমার পরিবারের মানুষদের ভাষ্য অনুযায়ী। হা হা হা। তা ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? কোন বান্ধবীর বাড়ি?

-কেন, সন্দেহ করছ বান্ধবীদের স্বামীর কাছে যাচ্ছি কিনা!

-সে তোমার অভিরুচি। আমার তাতে কী? এখন থেকে আমরা কেউ আর কারো জন্য কিছু না। আমরা যার যা ইচ্ছে করতে পারি। যার কাছে ইচ্ছে তার কাছেই যেতে পারি। আজকের পর থেকে আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্কগত বন্ধন রইল না।  

বাগানের দরজাটির পাশে কয়েকটা ছোট হাউস-প্ল্যান্টের টব। একটি গাছ থেকে কিছু শুকনো পাতা ছিঁড়ে গাছটিকে পরিষ্কার করে মোনা। বাঙালি বাড়িতে কারো কাছে নতুন গাছের লতা পেলেই নিজের ঘরের জন্য চেয়ে নিয়ে আসে মোনা। লতাপাতার বাহারি এই গাছগুলো মোনার খুব শখের গাছ। শুকনো পাতা হাতে দাঁড়িয়ে গালিবের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা শ্লেষের হাসি হাসে। বলে, তুমিও দেখলাম সুটকেস গুছিয়েছ। তো, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে গালিব? তোমার সেই চেলটেনহামের মামাতো বোনের কাছে? যে মেয়েটি তোমাকে কাছে পেলেই খুব আদর করে দেয় তোমার সারা শরীরে?

-ঈর্ষা!

-না! নিজের চোখে দেখা তোমাদের ভাই বোনের চরিত্রহীনতা, আর লাম্পট্য। 

-ওসব কথা এখন বাদ দাও মোনালিসা। এসব কথা এখন অবান্তর। আমাদের সম্পর্কই যেহেতু শেষ হয়ে যাচ্ছে আজ, তাই কি লাভ ওসব নোংরা প্রসঙ্গ আবার তুলে এনে! নোংরা ঘাটলে কেবল দুর্গন্ধই ছড়াবে মোনা, তুমিও জানো।

শুকনো পাতাগুলো বিনে ফেলে হাত ঝারে মোনা। মৃদু হেসে বলে, আমাদের সম্পর্ক নতুন করে শেষ হবার কী কিছু আছে এখনো বাকি! আমাদের সব সম্পর্ক তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে গালিব, ভেতরে ভেতরে। শুধু সমাজের চোখে ধুলো দিতে এতদিন আমরা এটিকে চার দেয়ালের মধ্যে আড়াল করে রেখেছিলাম খুব যত্নে। 

রান্নাঘরের শেষ কোণে শরীরের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকেও, ওরা স্বামী ও স্ত্রী, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থেকেও দুজনেই যেন দুটি আলাদা জগতে ভাসছে। ওদের দুজনের স্বপ্ন, আশা, প্রত্যাশা, প্রতীক্ষার সাত রং এখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। ধীর গতিতে আরো কাছাকাছি হয় ওরা দুজন। নিঃশ্বাসের ছোঁয়া এসে খোলা মুখে লেগে যায় এতটা কাছাকাছি। চোখ বন্ধ করে ফেলে মোনা। মাথার ভেতর গুনগুন করে বাজে গালিবের পাঠ: যে বাতাসে নিঃশ্বাস ফেল তুমি/ সে বাতাসে আহা শ্বাস নেব আমি/ বসতি গড়েছি তাই নিঃশ্বাসের কাছাকাছি! এই কথাগুলোকে আর একসময় গালিবকে পাবার দুর্নিবার আকাংখ্যাকে মোনার কাছে গতজন্মের ভুল স্বপ্ন বলে মনে হতে থাকে আজ। মোনা আর গালিব দুজনেই এখন অতীতকে বিদায় জানিয়ে নতুন ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে প্রস্তুত। নিঃশব্দে একে অপরকে অনুসরণ করে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। গুছিয়ে রাখা সুটকেস দুটি টেনে দরজার দিকে আগায় গালিব। বেরিয়ে যাবার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় একবার, কী ভেবে! নিরুত্তাপ গলায় বলে, আজ ভাবছি মোনা, সেদিন নজরুলের কীর্তন গাইতে গাইতে আমার দাঁতগুলো সত্যি ভেঙে গেলে আর গলার সবগুলো তার সত্যি সত্যি ছিঁড়ে গেলেই বুঝি বেশি ভালো হতো!

বন্ধু যেমন বন্ধুর দুঃসময়ে হাত বাড়িয়ে স্বান্তনা দেয়, দুর্দিনে ভরসা দেয় পিঠে হাত রেখে, সেইভাবে মোনার কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি ঝরে পড়ে। নিদারুন আশ্বাসের সুরে সুদিনের সম্ভাবনার কথা বলে। মোনা বলে, এই জীবনে যেটুকু হয়েছে বৃথা, সেটুকুকে নিয়ে আমরা না হয় আর নাই ভাবি গালিব। অবশিষ্ট যা কিছু আছে সঞ্চয়ে, সেইটুকুকেই অবলম্বন করে তুমি সুখী হও তোমার জীবনে। আর আমিও কিছুটা সুখ খুঁজে নেবো নিজের মতো করে। একটা সময়ের পরে আমাদের সবার জীবনেই সুখের চেয়ে শান্তি আর স্বস্তি বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় বন্ধু। আমরা না হয় সুখী ভালোবাসার আশা ছেড়ে দিয়ে এবার একটুখানি শান্তির আশাতেই বাঁচার চেষ্টা করি বাকিটা জীবন!

মোটরওয়ের সত্তর মাইল স্পিডের রাস্তায় গালিব গাড়ি টানছে একশোর ওপরে। হাইওয়ের রাস্তায় গাড়ির জানালা খুললে ভয়ংকর শব্দে কানে তালা লেগে যায়। পাশ দিয়ে ছুটে চলা মারাত্মক গতির একেকটা গাড়ি যেন বুকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। তবু গাড়ির জানালা নামিয়ে দিয়েছে গালিব। ঠান্ডা বাতাস এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর মাথার চুল। মুক্ত পাখির মতো চার চাকার গাড়িটিকে নিয়ে বাতাসের ভারে উড়ছে যেন গালিব। দারুণ একটা প্রশান্তির হাসি ওর মুখে। যে শান্তিময় জীবনের স্বপ্ন ভাসছে ওর দুই চোখে, সেই জীবনের দেখা শেষ পর্যন্ত গালিব পাবে তো! 

গালিব চলে যাবার পর দরজায় তালা দিয়ে শোবার ঘরে এসে বসেছে মোনা। ঘরের বাতাসে একটা মিষ্টি ফুলেল সৌরভ। ম্যাগনোলিয়া এয়ারফ্রেশনারের সুরভিতে আত্মহারা হয় মোনার মন। ছিমছাম করে গোছানো ঘরটিতে একটা ল্যাপটপ কর্নার আছে ওর। মোনালিসা ল্যাপটপে বসে ইউটিউবে গান খোঁজে। গান পছন্দ করে প্লে বাটনে প্রেস করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে মোনালিসার মুখে একটি মিষ্টি পরিতৃপ্তির হাসি। কিন্তু গালিব চলে গেলে যে মহার্ঘ্য স্বস্তির জীবন সে পাবে বলে দারুণ উত্তেজনা বোধ করছে এতদিন, সেই জীবনের দেখা মোনালিসা শেষপর্যন্ত পাবে তো!

সুখের ঠিক পাশেই লেগে থাকে অ-সুখের কাঁটা। আর প্রচেষ্টার ঠিক পাশেই থাকে ব্যর্থতার ফাঁদ। তবু মানুষ অসুখী সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য একটি জীবনের স্বাদ নেবার চেষ্টা করে। সেই অন্য জীবনটি স্বপ্নের মতো সুন্দর না হলেও নিশ্চয় দুঃস্বপ্নের মতো দুর্বিসহ হয় না সব সময়। যতক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকে ততক্ষণই সে নিজের জন্য শান্তির চেষ্টা চালিয়ে যায়। মোনা আর গালিবও একসময় যত্ন করে তৈরি করার সন্ধির বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আজ নিজেদের মতো করে আলাদা পথে আলাদা শান্তির জগৎ তৈরির স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে। মোনার মনের “সুখ নাকি দুঃখ” এই দোলাচলের এমন দুরূহ মুহূর্তে ল্যাপটপের ইউটিউবে বেজে ওঠে গান। মিষ্টি কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন ভারতের শিল্পী শ্রাবনী সেন।

 

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?

কেন তারার মালা গাঁথা,

কেন ফুলের শয়ন পাতা,

কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে? 

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে?

তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন

আমার হৃদয় পাগল-হেন

তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে? 

==============