You are currently viewing ‘ক্ষুদিরাম মঞ্চ’ গড়ে তোলা ছিল যাঁর শেষ ইচ্ছা > লাবণী মণ্ডল

‘ক্ষুদিরাম মঞ্চ’ গড়ে তোলা ছিল যাঁর শেষ ইচ্ছা > লাবণী মণ্ডল

‘ক্ষুদিরাম মঞ্চ’ গড়ে তোলা ছিল যাঁর শেষ ইচ্ছা

লাবণী মণ্ডল

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস–রক্তমাখা ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস। বিপ্লবীদের জীবনবাজি রাখার নির্মম কথা। ব্রিটিশদের তাড়াতে এ দেশের বীরযোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন, দ্বীপান্তর নিয়েছেন; হাজার হাজার তরুণ-যুবাকে হত্যা করা হয়েছে। দিনের পর দিন কারাগারে বন্দি রাখা, বিচারিক হত্যা ছাড়াও ঔপনিবেশিক আইনের মাত্রা ছাড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে হাজার হাজার বিপ্লবীকে। বহু বিপ্লবীর ঘরবাড়িও গুঁড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। সেসব স্মৃতিচিহ্নের অনেক কিছুই আজ বিলুপ্ত। যেটুকু টিকে আছে, তা সংরক্ষণে উদ্যোগও সামান্যই।

ইতিহাস সবসময় নির্মম। সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। পরাধীনতা, শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির ইতিহাস গড়তে হলে শত শত জীবনকে বাজি রাখতে হয়। হারাতে হয় পরিবার, ঘরবাড়ি।

নিজের ক্ষমতা, দাপট, অর্থবিত্ত যাচাইয়ের মাপকাঠি এ বিপ্লবীদের দমাতে পারে না। বিপ্লবের বীজ যার ভেতরে একবার বপন করা হয়, তাঁকে ফেরানো যায় না। লক্ষ লক্ষ জীবনবাজি রাখা বিপ্লবীদের জীবনের বিনিময়েই আজ আমাদের এ ভূখণ্ড। এ যাত্রা শুরু হয়েছিল আঠারো শতকের শেষে। যাঁরা শুধুমাত্র সাময়িক আত্মতুষ্টি অর্জনের পেছনে ছুটেনি, নিজের ভোগবিলাসিতাকে প্রাধান্য দেইনি; তারাই ইতিহাসের জায়গা দখল করে আছেন। আত্মোৎসর্গী বিপ্লবী-দেশপ্রেমিক-লড়াকুদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আজও লড়াই করছেন বিভিন্ন বিপ্লবী পার্টি।

 

বিপ্লবীদের জীবন সাহস জাগায়। পথ দেখায়। সংগ্রামী করে তোলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি জোগায়। ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে অন্যতম অনুপ্রেরণা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ সমগ্র শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন। বিপ্লবীদের উৎসর্গের জীবন করার চিত্র যতবেশি ভেতরে গেঁথে যাবে, মানুষ ততই মুক্তির মিছিলে হাঁটবে। তাঁদের জীবনসংগ্রাম-দর্শন-আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করে, সাহস জোগায়। যে কোনো সংকটে পথ দেখায়।

তাই নিজেদের ও নতুন প্রজন্মকে বিপ্লবীদের জীবনাদর্শ জানাবোঝার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে ইতিহাসের দায় বহন করতে হবে। তবেই না পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরে জানার আগ্রহ বাড়বে। ইতিহাসকে ইতিহাসের কাছে রেখে যাওয়ার দায় থেকেই লিখছি কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের কথা।

 

 

জীবনের যাত্রাপথ

‘মধবিত্তরা স্বপ্ন দেখে তাড়াতাড়ি বিপ্লব হবে। তারা সভাপতি হবে, সাধারণ সম্পাদক হবে, মালিক হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ছিলো তখন এসব বিপ্লবীদের শুধু ছেলে-মেয়ে নয়, শালাশালীরাও মস্কো গেছে–পড়াশুনা করতে। এইসব ভদ্রলোকদের দিয়ে বিপ্লব হবে না, হয়নি। এদের দিয়ে এক পার্টি থেকে আরেক পার্টিতে যাওয়ার ডিগবাজি বিপ্লব হয়েছে। মধ্যবিত্তরা জনগণকে, মানুষকে কিছু দিতে পারে না।’

বিপ্লবী, কমরেড, দেশপ্রেমিক, জনগণের নেতা জসিমউদ্দিন মণ্ডল। যিনি আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য লড়েছেন। যাঁর জীবন-যাপন শিক্ষণীয়। যিনি লড়েছেন পার্টির ভেতরে শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্নে যারা আপস করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে। যে কারণে ছিলেন অনেকের চক্ষুশূল। কিন্তু তরুণপ্রজন্মের ভেতর ছিল তাঁর গভীর গ্রহণযোগ্যতা।

২০১৫ সাল। জসিম উদ্দিন মণ্ডল তখন লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় আসেন। তখনও তিনি একা চলাফেরা করেন। যতক্ষণ প্রয়োজন না হয়, কারো সহযোগিতা নেন না। মনোবল এতই দৃঢ় ছিল যে, সিঁড়ি বেয়ে উঠার সাহস করতেন! যা তরুণদের উৎসাহ, উদ্দীপনা জোগাত।

‘বিপ্লবীদের কথা’ প্রকাশনা থেকে তাঁর জীবন-সংগ্রামের উপর একটি বই করার পরিকল্পনা করা হয়। তিনি রাজি হন। আমরা কাজ শুরু করে দেই। তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অফিসে থাকেন। সকাল সাতটায় ছাদে চলে যান। পায়চারি করেন। রোদে গা এলিয়ে দেন। ‘মরণচাঁদ’ মিষ্টির দোকান থেকে কাউকে দিয়ে একটা মিষ্টি, পরোটা এনে আটটার মধ্যে খেয়ে ফেলেন। এর পর এক কাপ চা। এভাবেই জীবনের রুটিন সাজিয়ে রাখতেন তিনি।

সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে পুরানা পল্টন সিপিবি অফিসে পৌঁছাতাম। ঘুম ঘুম চোখে। কিন্তু তিনি দিব্যি ক্লান্তিহীন কথা বলে যাচ্ছেন। কখনও যদি বলেছি, ‘জসিম ভাই একটু রেস্ট নেন…।’ একটু উচ্চস্বরে বলতেন, ‘এ শরীর কয়লা ভাঙার শরীর, এর রেস্ট লাগে না। তোমরা তো আমাদের মতো জীবন পাও নাই। জীবনের অর্থ বুঝ…!’ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। আবারও চলত কথোপকথন। কখনও ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়তাম, চোখ বন্ধ হয়ে যেত। তাঁর স্মৃতির ঝুলি যেন দিনকে দিন ভারী হতো।

এভাবেই চলছিল আমাদের আড্ডা। বিরতিহীন। ক্লান্তিহীন। এ যেন বড়ই বিস্ময়। ৯০ ঊর্ধ্ব একজন ব্যক্তির ক্লান্তিবোধ নেই, হতাশা নেই; জীবন সম্পর্কে নেই কোনো নেতিবাচক মূল্যায়ন। পুরো পৃথিবীকে জয় করার দৃঢ় মানসিকতা আছে। তখনও প্রেসক্লাবে বক্তব্য রাখেন। তরুণরা তাঁকে ঘিরে রাখেন। জানতে চান ইতিহাসের কথা। তিনি কীভাবে চালাচ্ছেন ‘জীবনের রেলগাড়ি’ সে কথা অনবরত বলে যান।

আমাদের পথ দীর্ঘ হয়। ইতিহাস লেখা বাড়তে থাকে। ডায়েরির পাতা শেষ হয়। কলমের কালি ফুরিয়ে যায়। তবুও কথা শেষ হয় না। জীবনের কথা কম কী! ৯১ বছরের জীবনে দেখেছেন কত রঙ-বেরঙ! কতজনকে হারিয়েছেন চলার পথে। কত বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পথ চলছেন। কথা চলে…। রাত ফুরোয়। আবার দিনের অপেক্ষা। তিনি সাক্ষাৎকারের ফাঁকে ফাঁকে গান ধরেন। তেমনি একটি গান প্রায়ই গাইতেন কিংবা চেষ্টা করতেন গানের কয়েকটা লাইন ছিল এ রকম–

নাকের বদলে নরুন পেলাম

নাক ডুমাডুম ডুম।

জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম

লাগল দেশে ধুম॥

আমার ছেলে বড় বোকা

বুড়ো আঙুল চোষে,

সে ক্ষিদে পেলে যখন তখন

হঠাৎ কেঁদে বসে।

সে বড় বোকা কি না?

ক্ষুধা হরণ গুলি বিনা

চোখে তাহার আসবে না ঘুম

নাকের বদলে নরুন পেলাম

নাক ডুমাডুম ডুম৷৷

মার্কিন দেশের মার্শাল মাসি (ভিক্টোরিয়া)

পাঠায় খেলনা ডলার ঝুম ঝুম,

নাকের বদলে নরুন পেলাম

তাক ডুমা ডুম ডুম।

 

আরেকটি গান ছিল এ রকম–

টাকার গরম চলবে না আর, ওরম টাকা ধরে গাছে

কুলি-মজুর, বলবে না হুজুর, তাদের দেমাক বেড়েছে।

 

জসিম উদ্দিন মণ্ডল। সাহসের প্রতিধ্বনি। বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ। বাংলাদেশের একজন বামপন্থী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। যিনি একাধারে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা। তাঁর প্রধান ভিত্তিই শ্রমিকদের মধ্যে। তিনি ভালোবাসতেন পা ফাটা-কাদামাখা শ্রমিক-কৃষকদের। যে কারণে এই শ্রেণির মধ্যে ছিল তাঁর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। জসিম উদ্দিন মণ্ডল বলতেন, ‘এ সমাজ বড়লোকের সমাজ, শোষকের সমাজ, গরিব মারার সমাজ– এই সমাজ ভাঙতে হবে এবং ভাঙিতেই হবে।’

৯৮ বছর আগের কথা। তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মেছিলেন, যেখানে জন্ম তারিখ কিংবা জন্মসন ঘটা করে লিখে রাখার কোনো রেওয়াজ ছিল না। সেসময় হিন্দু পরিবারে যেমন কুষ্টি-ঠিকুজি রাখার ব্যবস্থা ছিল, তাদের ছিল না তেমন কোনো ব্যবস্থা। গরিব ঘরের সন্তানদের এ সুযোগ আজও হয় না। তিনি এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “আমার জন্ম কখন, কবে, কত তারিখে হয়েছিল, সে কথা আজ আর মনে নেই। তবে ছোটবেলায় মায়ের মুখে আমার জন্ম-সনটার কথা শুনতাম মাঝেমধ্যে। সেটাও মা বলতেন সম্পূর্ণ আন্দাজের ওপর নির্ভর করে। মা বলতেন, ‘সেই যে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ শুরু হলো, তার ঠিক দশ বছর পর তোর জন্ম’। তার থেকেই আন্দাজ করতে পারি, ১৯১৪ সাল থেকে দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই পৃথিবীর আলোর মুখ আমি প্রথম দেখি।” কুষ্টিয়ার কালীদাশপুর গ্রামে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। তখন সেটি অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর বাবার নাম হাউসউদ্দীন মণ্ডল। দাদি আদর করে তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন হাউস অর্থাৎ শখ। তবে আসলে সে জীবনে শখ, আহ্লাদ বলতে কিছু ছিল না কি, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

অজপাড়াগাঁয়ে জন্মেছিলেন তিনি। স্কুলের সঙ্গে ছিল না কোনো পরিচয়। সে সময় তেমন স্কুল ছিল না। যা-ও ছিল, সেগুলো শহরের ভেতরে। যে কারণে তিনি যা শিখেছেন তা পৃথিবীর পাঠাশালা থেকে। জনগণের জীবনসংগ্রাম থেকে। তিনি স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “সে সময় আজকের দিনের মতো অতশত স্কুল-টিস্কুল হয়নি। গ্রাম দেশে তো প্রায় ছিল না বললেই চলে। দু-একটা মক্তব, পাঠশালা যাও-বা ছিল, সেগুলোরও প্রায় টিম-টিমে অবস্থা। তো নানাবাড়ির গ্রামের এমনি একটা পাঠশালায় শুরু হলো আমার বিদ্যার্জনের কসরত। তবে বিদ্যা অর্জনের চাইতে বিদ্যা বিসর্জনের আয়োজনই ছিল সেখানে বেশি। পাঠশালার পণ্ডিতমশাই আমাদেরকে সেদিনকার মতো পাঠ ধরিয়ে দিয়ে নড়েবড়ে টেবিলে খ্যাংরা কাঠির মতো পা দুখানা তুলে আয়েশ করে সটান হতেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই শুরু হতো তার নাকের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর গর্জন। আমরাও সেই অবসরে পিঠটান দিতাম আমবাগান মুখো কতবার যে আম পাড়তে গিয়ে পণ্ডিতমশাইয়ের বকুনি খেয়েছি, তার শুমার নেই। আমাদের পাঠশালাটি ছিল খড়ের চালা আর বাঁশের বাতা দিয়ে বেড়া দেয়া। আর তাতে সার সার বাঁশের মাচা খাড়া করে বসবার ব্যবস্থা। একেকদিন আমার ঘাড়ে ভূত চাপত। দুষ্টুমি করে ক্লাসের মেয়েদের বেণি বেঁধে রাখতাম বেড়ার বাতায়। মেয়েরা চেঁচামেচি শুরু করলে পণ্ডিতমশাই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে শুরু করতেন গালিগালাজ। মনে পড়ে, পণ্ডিতমশাই আমাদের ‘নেড়ে’ বলে গাল দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। ‘ম্লেচ্ছ’, ‘বর্বর’ এগুলো ছিল আরও একধাপ উঁচু পর্যায়ের গাল। তবে পাঠশালার হেড পণ্ডিতের কাছে কিন্তু আমি ছিলাম অসম্ভব সুবোধ বালক। কারণ যেভাবেই হোক না কেন তাঁর ক্লাসে আমি খুব বেশি একটা ফাঁকি দিতাম না।”

১৫ বছর বয়স। টগবগে তরুণ, তেজোদীপ্ত। যেদিকে তাকায় ঝলসে যায় তারুণ্যের আগুনে। ওই বয়সেই তিনি রেল ইঞ্জিনে কয়লা ফেলার শ্রমিকের খাতায় নাম লিখান। গরিব শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোরের জীবনচক্র এভাবেই শুরু হয়। যেখানে নেই কোনো দুরন্ত শৈশব। রয়েছে গ্লানি, বঞ্চনা। দায়িত্বের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়া।

১৯৩৯ সালে তাঁর এ যাত্রাপথই তাঁকে বিপ্লবী হয়ে উঠার উপাদান জোগায়। শ্রমিকের প্রতি অবিচার-নিপীড়ন-নিমর্মতা তাঁকে প্রতিবাদী করে তোলে। ব্রিটিশদের নির্যাতন বাড়ে। নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। নিশ্চুপ। নিস্পৃহ জীবনযাপন করতে থাকে যুবা, তরুণরা। প্রতিবাদ করলেই রয়েছে চাকরি হারানোর ভয়। পেটে-ভাতে মরে যাওয়ার চিন্তা। তবুও প্রতিবাদের আগুন যাঁর ভেতরে থাকে, তাঁকে ইতিহাসের কোনো শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারে না।

দারিদ্র্যতার কষাঘাত চেপে বসে। একবেলা খেতে পারলে, আরেকবেলা উপোস। খুদ ভাত খেয়ে কোনো রকমে কাটছে দিনাতিপাত। নেই কোনো স্বস্তির নিশ্বাস। চারদিকে অস্থিরতা বাড়ছে। ব্রিটিশ বেনিয়ারা গেড়ে বসছে বাংলার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। যে অত্যাচারের চিত্রই কষ্টিপাথরে গড়ে তোলে জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে। তিনি প্রতিবাদ করেন ব্রিটিশ রেল কোম্পানির বিরুদ্ধে। এ আন্দোলন ধিকে ধিকে জ্বলে ওঠে। যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন-জীবনের রেলগাড়ির অগ্রযাত্রার পথিক।

 

বিপ্লবী জীবনের যাত্রা

১৯৪২ সালের কথা। তখন তিনি ১৮ বছরের যুবক। এরই মধ্যে তিনি জেনে গিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের কথা। তাঁর ভেতরে প্রেরণা তৈরি হয়। সে বছরেরে আগস্ট মাস। ঐতিহাসিক ভারত ছাড় আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

চাকরি অনিশ্চিত। তখন তিনি সহকারী ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। মাত্র ১৭ টাকা বেতনের চাকরি হারানোর ভয় সত্ত্বেও আন্দোলনে যুক্ত হন। লড়াইয়ের প্রতিটি যাত্রায় তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ফলে এমন কোনো অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতন নেই, যা তাঁকে ভোগ করতে হয়নি।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ছেচল্লিশের দাঙ্গা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

জসিম উদ্দিন মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রতিবাদী, লড়াকু, সংগ্রামীযোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাঁধে লেখা ছিল ‘আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)’। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। যেটি তাঁর দায়িত্বের অংশ। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নানাবিধ সাহায্য করেছেন তিনি।

ছেচল্লিশের দাঙ্গা। জসিম উদ্দিন মণ্ডল সে সময়ে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট। ট্রেন চলত। সে সময় প্রায়ই ওই পথে দাঙ্গাবাজরা আক্রমণ করত। খুন, লুটপাট করত। একদিন প্রায় ৫০০ জন দাঙ্গাবাজ ট্রেন লাইনের উপর লাল কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ট্রেন থামিয়ে সব লুটপাট করবে। যাত্রীরা হয়রানির শিকার হবে। কিন্তু প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর যদি দৃঢ় হয়, তবে পৃথিবীর যে কোনো দাঙ্গাবাজদেরই পথ হটতে হয়। সে সময়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি এক অসম সাহসিকতার কাজ করেন। তিনি ট্রেনের চালককে বলেন; ট্রেনে যাত্রী ৫০০০ জন, পক্ষান্তরে দাঙ্গাবাজ ৫০০ জন, পাচঁহাজার যাত্রীকে বাচাঁনোর জন্য ওই দাঙ্গাবাজদের উপরেই ট্রেন চালিয়ে দিতে হবে। কথামত ট্রেনচালক সেই কাজ করেন। কতজন দাঙ্গাবাজ মারা গিয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ করেনি। তবে কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের দৃঢ়চিত্তের কারণে বেচেঁ গিয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের প্রাণ। এভাবেই তাঁর পদচারণা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি আস্থা রাখতেন ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত’ বাক্যটিতে।

খুদবিরোধী আন্দোলনেও ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। শ্রমিদকের দাবিদাওয়ার মুখে মন্ত্রীরা অনেক সময়ই পিছু হটেছেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। নেতৃত্ব গুণে তিনি আমৃত্যু ছিলেন শ্রমিক-মেহনতি মানুষের নেতা। তিনি বলতেন, ‘আমি তৈরি করবো কাটারিভোগ চাল। আমি সেই ধান বুনবো। সেই ধান নিড়াবো। সেই ধান কাটবো। বাড়িতে নিয়ে এসে সেই ধান মাড়াই করবো। ধান বাইর করবো। সেই ধান আমার বউ সিদ্ধ করবে, শুকাবে। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল বের করবে। গন্ধে ঘর ভরে যায়। সেই চাল আমার ছেলে খেতে পাবে না। সেই চাল আমার মেয়ে খেতে পাবে না। সেই চাল খাবে কিডা? আল্লাহ্ যার কপালে রেখেছে। কার কপালে রেখেছে? গুলশানে যে থাকে। ধানমন্ডিতে যে থাকে। বনানীতে যে থাকে। জমিদারের পুলা যে। জমিদারের মেয়ে যে। জোতদারের মেয়ে যে। তারাই খাবে কাটারিভোগ। তৈরি করবো আমি, আর খাবে সে।’

 

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

জসিম উদ্দিন মণ্ডল ও তাঁর পরিবার প্রথম থেকেই পাকিস্তানের জন্মই স্বীকার করেননি। একাত্তরে ভারতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখেন। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম, ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাজাকারদের দেওয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাই যুদ্ধের সময় তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরে গেরিলা বাহিনীতে তিনি বামপন্থী জাহিদ রুমীর অধীনে যুদ্ধ করেছেন। জসিম উদ্দিনের পুরো পরিবারের মূল কাজ ছিল দেশের ভেতরে যাওয়া ও যুদ্ধের জন্য ছেলেদের জোগাড় করা, যারা সীমান্তের ভেতরে বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আছে, তাদের দেখভাল করা। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া। গ্রামগুলোতে তাদের অনেক নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। জলপাইগুড়ি, দিনহাটাসহ সব সীমান্তে ঘুরে বেড়াতেন এই বিপ্লবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারতের অর্ধেক চষেছিলেন জসিম উদ্দিন মণ্ডল। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলা মিত্রের সঙ্গে কাজ করেছেন। তখন তাঁদের কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা। কে কোথায় ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, ক্যাম্পে জায়গা হচ্ছে কি না এসব দেখাশোনা করা। এই বিপ্লবী মানুষটার দুই মেয়েকে জ্যোতি বসু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ দিয়েছিলেন। তবুও তার মেয়েরা কেউ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি। সনদের চিন্তা করে তারা এ কাজও করেননি।

 

উদীচীর স্বপ্ন

১৯৫৪ সালে ৯২-এর ক-ধারায় কমরেড জসিম গ্রেফতার হয়েছিলেন। রাজশাহী, ঢাকা কারাগারে ছিলেন। সেসময় ঢাকা কারাগারে সত্যেন সেন, নগেন সরকার, শহীদুল্লাহ কায়সারের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সত্যেন সেন, নগেন সেনকে জসিম উদ্দিন মণ্ডল গুরু মানতেন। জসিম উদ্দিন মণ্ডলের স্মৃতিচারণে জানা যায়, “দাদা, এ দেশের মানুষ গান খুব পছন্দ করে। মুকুন্দ দাসের মতো একটি গানের দল না বানাতে পারলে এ দেশে বিপ্লব হবে না। রণেশদা (দাশগুপ্ত), সত্যেনদা বসে আলাপ করে একদিন বললেন, ‘হ্যাঁ গানের দল হবে।’ কি নাম হবে, তা নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা চলছিল। শেষে একদিন ঠিক হলো, নাম হবে উদীচী। অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে যে আলোর উদয় হয়।” ঢাকা কারাগারের ২৬ নম্বর সেলে সত্যেন সেন উদীচীর জন্ম দিলেন। কারাগার থেকে বেরোনোর পর তারা গানের দল তৈরি করেন।

জসিম মণ্ডলকে অসংখ্যবার পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামল, এরশাদের শাসনামলেও কারাবন্দি ছিলেন। পালিয়ে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন করেছিলেন, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন শ্রমিক এলাকায় বিভিন্ন আন্দোলনে।

 

বিপ্লবী নারীর অসাধারণ অবদান

জাহানারা বেগমের বাবা রেলে চাকরি করতেন। তাঁর ভাইও রেলে চাকরি করতেন। জসিম উদ্দিন মণ্ডল তখন রেলেই চাকরি করতে শুরু করেন। এভাবেই সম্পর্ক এগোয়। দু’জন সমবয়সি হওয়ার কারণে বন্ধুত্ব বাড়ে জাহানারা বেগমের ভাই আর জসিম মণ্ডলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়। তখন ট্রেড ইউনিয়নকর্মী জসিম মণ্ডল রেলের সহকারী ইঞ্জিনচালক। বয়লারে কয়লা ঠেলে দিতেন।

গনগনে আগুনের তাপ। ঝলসে যেত মুখমণ্ডল। পুড়ে অঙ্গার হওয়ার মতো। হয়তো সে কারণেই তিনি শ্রমিকদের প্রিয় নেতা। তখন তিনি এক তুখোড় ট্রেড ইউনিয়নকর্মী ছিলেন। নিজেকে তৈরি করতে থাকেন, কমিউনিস্ট হিসেবে। বয়লারের লাল আগুন যেমন ছড়িয়ে পড়লো জসিম মণ্ডলের কর্মজীবন জুড়ে, তেমনি ক্রমেই জাহানারা বেগমের মন জুড়ে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন জসিম উদ্দিন মণ্ডল। কখন যে একে অপরকে ভালবেসে ফেলেছেন, তার দিনক্ষণ মনে না থাকলেও দুজন দুজনার হয়ে গেলেন। কিন্তু জাহানারা বেগমের বাবা শুরুতে বাধ সাধলেন। তিনি এ ছেলের কাছে মেয়ের ভবিষ্যৎ তুলে দিতে রাজি নয়। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। এভাবেই বন্ধন শুরু হয়ে গেল।

মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত একে-অপরের পাশে থেকেছেন। জসিম মণ্ডল তাঁর জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে যান। যেন এক জোড়াহীন পাখি। স্মৃতিচারণ, আড্ডা সবসময় গাইতেন স্ত্রীর গুণকীর্তন। নারীরা এগিয়ে না আসলে কোনো লেখক-সাহিত্যিক এবং বিপ্লবী শেষ পর্যন্ত লড়তে পারতেন না, এ কথা তিনি বার বার বলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন নারীরা বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলবেন। যে স্বপ্নের পথেই হাঁটছে তরুণ-ছাত্র-যুবা।

বিপ্লবী জাহানরা বেগম ওরফে জাহানারা মণ্ডল, জসিম উদ্দিন মণ্ডলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন লড়াকু-দৃঢ়চিত্তের। তিনিও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আগলে রেখেছেন স্বামী-সন্তানদের। জসিম মণ্ডলের বর্ণনায় তাঁর জীবনসঙ্গিনী ছিলেন সুন্দরী। কথাবার্তায়-আচার-আচরণে ছিল মুগ্ধতা। যৌবন-কৈশোরে ইচ্ছা করলেই জসিম মণ্ডলকে পরিবারের বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারতেন। কিন্তু সেটি করেননি। বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ করেছেন সংসারের মায়ামোহ। যে কারণেই তিনি আজ ইতিহাসের অংশ।

জাহানারা বেগমের মৃত্যু হয় ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। তাঁর স্মৃতিচারণ করে জসিম উদ্দিন মণ্ডল বলেন, “স্ত্রী-সন্তানকে আমি কখনো সময় দিতে পারিনি– পার্টি, সংগঠন, রাজনীতির কারণে। রেলে চাকুরি করতাম। খুব কম মাইনে ছিলো। ওই টাকা দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতাম। আমার স্ত্রীর এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। ও ছিলো আমার বড় সমর্থক। পার্টি, রাজনীতি, সংগঠন নিয়ে কোনোদিন কোনো কটূক্তি করেনি। কোনো অভিযোগও ছিলো না। বউ-ছেলেমেয়ে একটা বাসায় রেখে রাতদিন পার্টির কাজ করে বেড়াতাম। খোঁজ-খবরও রাখতে পারতাম না। পার্টির কমরেডরাই ওদের খোঁজ-খবর রাখতো, টাকা দিতো, চাল দিতো, বাজার করে দিতো, জামা-কাপড় দিতো। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে পার্টির কমরেডরা ওদেরকে নিজের ছেলে-সন্তান ভেবে আদর-আপ্যায়ন করতো। … স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া ‘জসিম উদ্দিন মণ্ডল’ হতে পারতাম না, শ্রমিকনেতা হতে পারতাম না, কমিউনিস্ট পার্টিও করতে পারতাম না। ওতো বছর জেল খাটাও হতো না। আমার স্ত্রী যদি সঙ্গ না দিতো, তাহলে আমার হাতের মুঠি মজবুত হতো না। শুধু আমার না এ উপমহাদেশের যত বাম ও কমিউনিস্ট নেতা, তাঁদের স্ত্রীরা যেভাবে সাহায্য করেছেন, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন– তার তুলনা হয় না। যাঁরা সারাজীবন জেল খাটতেন, তাঁদের স্ত্রীরা সারাজীবন তাঁদের সবকিছু আগলে রেখেছিলেন– না রাখলে জেল খাটতে পারতেন না।”

 

কেন তিনি শ্রমিকনেতা

জসিম উদ্দিন মণ্ডল পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, শ্রমিক এলাকায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। অনেকবার তিনি কারাভোগ করেছেন। তিনি শ্রমিক-জনসভাগুলোতে সাধারণ মানুষের ভাষায় সুন্দরভাবে বক্তব্য দিতে পারতেন বলে সমাবেশগুলোতে প্রচুর মানুষের উপস্থিতি ছিল।

শ্রমিক রাজনীতি গড়ে তুলতে হলে, শ্রমিকদের জীবনযাপনকে জানতে হয়, বুঝতে হয়। তিনি সেটি পেরেছিলেন। শ্রমিকের বাড়িতে থেকে, খেয়ে শ্রমিক আন্দোলন করেছেন। কৃষকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কৃষক-শ্রমিকের পথই তাঁর পথ বলে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা, মিটিংয়ে শ্রমিকের জয়গান গাইতেন। শ্রমিকের ভাষায় কথা বলতেন। যে কারণে শ্রমিকরা উল্লসিত হতেন। ভালোবাসতেন। বিপ্লবী আন্দোলন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন। তিনি ভেতরে যেটি পোষণ করতেন, সেটিই করার চেষ্টা করতেন।

তিনি বলতেন, ‘ভদ্রলোকদের দিয়ে হবে না। দাদওয়ালা, পা-ফাটা, হাতুড়ি পেটা, শাবল চালানো, বয়লার মারা, চাষা-ভূষা, শ্রমিক-মেহনতি মানুষ যতদিন পর্যন্ত পার্টিতে না আসবে ততদিন হবে না। এরাই বিপ্লব করবে, এদেরই বিপ্লব দরকার, ভদ্রলোকের না। কৃষক জানে কিভাবে ফসল ফলাতে হয়, শ্রমিক জানে কিভাবে শাবল চালাতে হয়, হাতুড়ি চালাতে হয়, কিভাবে গড়তে হয়-ভাঙ্গতে হয়, তা তারা জানে, ভদ্রলোক জানে না। বহু হরতাল-ধর্মঘটই দেখেছি, রেললাইন উপড়ানো, রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, সবকিছু অচল করে দেওয়া– এসবই শ্রমিকরা করেছে, ভদ্রলোকরা নয়।’

কেন হাজার হাজার জসিম উদ্দিন মণ্ডল গড়ে উঠছে না, এটি খুবই প্রাসঙ্গিক আলোচনা। কারণ একটিই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি। যাঁরা ঢাকায় বসে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন করেন, তাদের পক্ষে শ্রমিক-কৃষকের ভেতরের যন্ত্রণা উপলব্ধি করা মুশকিল। তত্ত্বগান গেয়ে কিংবা মুলা ঝুলিয়ে রেখে শ্রমিক আন্দোলন করলে তো, জসিম উদ্দিন হয়ে উঠা যাবে না। তিনি সব সময় বলতেন, ‘এখনকার কমিউনিস্টরা তা পার্টি অফিসটারে বাড়িঘর বানিয়ে রাখছে। শ্রমিকের কাছে যায় না, কৃষকের মন বুঝে না—এরা করে শ্রমিক-কৃষকের পার্টি।’

তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-জ্ঞান ছিল মেহনতি মানুষের জন্য ‘কমিউনিস্ট পার্টি করি এবং বুঝেই করি। হিসেব নিকেশ করেই করি এবং জীবনে যদি সবচেয়ে ভাল কাজ করে থাকি এই কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেই, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমি দুইটা শ্রেণিতে বিশ্বাস করি। শুনে রাখেন দুইটা শ্রেণি। একটা গরীব শ্রেণি, একটা ধনিকশ্রেণি। একটা বড় লোক, একটা গরিব লোক। গরিব লোককে না ঠকালে, গরিবের বাকি না দিলে, গরিবকে পয়সা কম না দিলে কোন শালা বড়লোক হতে পারেনা। আমি এই রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। এজন্যই আমি কমিউনিস্ট পার্টি করি। বুঝেই করি।’

 

তারুণ্যের প্রতিভূ

আগুন জ্বালানোই তাঁর কাজ। আগুন জ্বললে গাড়ি চলন্ত থাকে, তা না হলে বন্ধ। সেই যে জীবনের রেলগাড়ি চালানো শুরু করেছিলেন, তা চলছে মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত। তিনি থামেননি, লড়ে গিয়েছেন। বিপ্লবের গান গেয়েছেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে। তিনি কেবিনে শুয়ে শুয়ে আমাদের বলতেন, ‘তোমরা এখানে কেন, যাও শ্রমিকের কাছে যাও, তাদের সঙ্গে একাত্ম হও। আমি তো ভালোই আছি। এই যে চালের দাম ৫০ টাকা, তাও আবার মোটা চাল; এগুলো নিয়ে আন্দোলন কর..।’

এই দৃঢ়চেতা অবস্থানের কারণে তাঁর পার্টির অনেকের কাছেও তিনি চক্ষুশূল কিংবা কিছুটা হলেও অপছন্দের ছিলেন। তাঁকে এড়িয়ে চলার মানসিকতা ছিল অনেকের। সেটি তিনি বুঝতেন এবং এ নিয়ে তাঁর ভেতরে কোনো হারানোর ভয় ছিল না। তবুও সত্যকে উপস্থাপন করতেন। তরুণদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করতেন– ‘তোমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। হাতিয়ার হাতে তুলে নিতে হবে। সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। সাম্যবাদের পথে ধাবিত হতে হবে। স্বপ্নের পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি ছিলেন স্বপ্নালু মানুষ। নিজে স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন।

বিপ্লবী-সংগ্রামী-দেশপ্রেমিকদের জীবনী পাঠে উৎসাহিত করাটা জরুরি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যদি ইতিহাসকে তুলে না ধরে, তা হলে জয়জয়কার হবে শোষকশ্রেণির। যে শ্রেণিই লুফে নেয় বিপ্লবী ইতিহাস, গড়ে তোলে শোষণের ইতিহাস। এসব বিপ্লবীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সচেতন ও সংগঠিত প্রচেষ্টা নেওয়ার মধ্য দিয়েই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।

আমরা সংগ্রাম করেছি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। ব্রিটিশবিরোধী এই সংগ্রামের ব্যাপ্তি জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে উপমহাদেশের সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে সহিংস ও অহিংস পথ বেছে নিয়েছিল। গঠিত হয় যুগান্তর ও অনুশীলনের মতো দল। এবারের আন্দোলনেও আমাদের সফলতা আসে। ব্রিটিশরা এই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়। শেষ হয় ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব ও দমন-পীড়ন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অবদানের জন্য ইতিহাসে যেসব বাঙালির নাম উঠে আসে, তারা হলেন- নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মীর নিসার আলী (তিতুমীর), মাস্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ।

কৈশোরের সাময়িক উচ্ছ্বাসে সেদিন যে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, জীবনের শেষদিন এসেও জসিম উদ্দিন মণ্ডল হেঁটেছেন সেই একই মিছিলে। মিছিল তাঁকে ছাড়েনি। তিনি ছাড়তে পারেননি মিছিলকে। এটিই ছিল তাঁর জীবনের সব চেয়ে বড় গর্ব। বড় পাওয়া। তাঁর ভেতরে অপূর্ণতা ছিল, কিন্তু সেটি বৃহত্তর স্বার্থে। পুরো পৃথিবীতে সাম্যবাদ গড়ে তোলার লড়াইয়ে তিনি শামিল হয়েছিলেন, কিন্তু সাম্যবাদ তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সাম্যবাদ একদিন আসবেই। মেহনতি জনগণের মুক্তি মিলবে। যেখানে নারীরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াবে। গরিব-ধনী ভেদাভেদ থাকবে না। কোনো ধনতন্ত্রের অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষ মানুষের জন্য পৃথিবী গড়ে তোলার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেই, এ পথকে সাবলীল করে তুলবে বলে তাঁর আস্থা ছিল। আমরা সে পথেই হাঁটছি, লড়ছি। আমাদের আকাঙ্ক্ষা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। আমরা চাই পুরো পৃথিবী একদিন শোষণমুক্ত হবে। জয়গান গাইবে মানবতার। ভালোবাসা, সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবে। যেখানে জসিম উদ্দিন মণ্ডল তারুণ্যের প্রতিভূ। তাই তাঁর অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটা জরুরি।

 

শেষ ইচ্ছা

জসিম উদ্দিন মণ্ডলের নিজস্ব কোনো বাড়ি ছিল না। বন্দোবস্ত নেওয়া সরকারি এক খণ্ড জায়গায় তিনি বসবাস করতেন। বাড়ির পাশেই নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। বিদ্যালয়ের নাম রেখেছিলেন পশ্চিম টেংরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

তিনি গড়তে চেয়েছিলেন বিপ্লবীদের নামফলক দিয়ে ‘ক্ষুদিরাম মঞ্চ’। যে ইচ্ছাটি অপূর্ণ থেকে গেছে। এ নিয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। এই বিপ্লবী জীবনে অনেক কিছু করেছেন, পুরো জীবনটাই ত্যাগ করেছেন বৃহত্তর স্বার্থে; কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছাটি রয়ে গেছে অপূর্ণ। তিনি আমাদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বার বার বলেছেন, ‘আমি একটি ক্ষুদিরাম মঞ্চ গড়ে তুলতে চাই। আমার কবরের পাশে সেটি হবে। যে কারণে আমি দেহদান করিনি। বিশাল করে একটি নামফলক দেওয়া থাকবে, যেখানে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের নাম থাকবে, তাদের জন্ম-মৃত্যু থাকবে..।’ তাঁর এ কথা অনেকেই শুনেছেন, জেনেছেন কিন্তু এখনও কেউ এগিয়ে আসেননি।

 

চিরকালের পথে

মৃত্যুর মতো ধ্রুবসত্য পৃথিবীতে আর নেই। জন্ম নেওয়ার অর্থই হলো মৃত্যুকে মেনে নেওয়া। একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া। শারীরিক ও মানসিকভাবে যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে, ততদিনই চলে মৃত্যুর প্রস্তুতি। যেটি কখনও আকস্মিক, কখনও হঠাৎ ঝড়ে হারাতে হয় প্রিয়জনদের। যে ঝড় থামে না, থামানোর নেই কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।

জসিম উদ্দিন মণ্ডল বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বেশ কয়েকদিন ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপে ভর্তি ছিলেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাশে ছিলেন তাঁর কমরেড, পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা। সঙ্গে ছিলেন আরও বহু প্রিয় মানুষ। যাঁরা ভাবতেন আর কিছুটা দিন থাক না, আর ক’টা গাক না জীবনের জয়গান। যে গানে উজ্জীবিত হোক তরুণ-নবীন। জয়গানে শামিল হোক সকল প্রাণ।

১ অক্টোবর। কেবিন ভর্তি প্রিয়জনেরা অপেক্ষা করছেন। তিনি শুয়ে আছেন আইসিইও রুমে। ডা. লেলিন চৌধুরী বার বার দেখছেন, পদচারণা বাড়াচ্ছেন; হয়ত হৃদয়ের দহনও বাড়ছে। মেডিকেল বোর্ড হয়ত তখনই বুঝে গেছেন, এ যাত্রায় থেমে যাচ্ছে কমরেডের দেহযন্ত্র। কিন্তু আমরা… তখনও আশায় বুকে বাঁধছি। কেবিনের ভেতর পায়চারি বাড়ছে। এক নজর দেখার জন্য কতজনের কাছে আকুতি-মিনতি করছি; কিন্তু সবাই নির্বিকার। হয়ত অনেকে তখন জেনে গেছেন, আর ফিরছেন না তিনি।

রাত গভীর হয়। কেবিনের বাইরে, হাসপাতালের নিচে তাঁর কমরেডরা রাত্রি পার করছে। শহরের ভেতর রাতের ঢাকা দেখছে, বুক কাঁপছে। রাত কেন এত দীর্ঘ ভেবে আকাশপানে তাকিয়ে আছে কমরেডরা। কেবিনের মেঝতে বসে আছি। তাঁর বড় মেয়ে আঁচলে চোখ মুছছেন, ভাবছেন বাবা হয়ত আর ফিরবেন না! আমাদের তখন চোখে পানি নেই, কারণ বাকশূন্যতা যখন ভর করে, তখন কি আর চোখ ভিজে?

ভোর হলো। কানাকানি বাড়ল। জানতে পারলাম, জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছে জসিম উদ্দিন মণ্ডলের। মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন ব্রিটিশ তাড়ানো মানুষটি। অনলবর্ষী বক্তা কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল ২ অক্টোবর, ২০১৭ ঢাকার হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে দৈহিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। আমরা সেদিন কাঁদিনি। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য দৌঁড়েছেন তাঁর কমরেডরা। আদদ্বীন দেয়নি, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া। কারণ তিনি বামপন্থী, তিনি ভর্তি ছিলেন বামপন্থীদের গড়া হাসপাতালে।

বিপ্লবী লাইন মত-পথ ভিন্ন হলেও, আমাদের চাওয়া এক। আমাদের উদ্দেশ্য মানবতার জয়। যে জয়কে পরাজয় করে তোলে এমন শক্তি কার! তাঁর দেহ পুরানা পল্টনে সিপিবি অফিসের সামনে রাখা হয়েছে। ফুলে ফুলে ভরে গেছে পুরো শরীর। যেন এক ফুলেল জীবন্ত সত্তা। মনে হচ্ছে হাসছেন। প্রিয়জনের মৃত্যুমুখ দেখার মতো শক্তি নেই আমার। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে এগিয়ে আসছেন। মুখ লুকাচ্ছি। ওদিকে সাংস্কৃতিক বন্ধুরা গাইছে—

‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।

এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।।

আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,

তোমার ওই দেবালয়ে প্রদীপ করো–

নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।

আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব

সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।

নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,

যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো–

ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব-পানে।।’

পুরো শহর যেন শোকে ভাসছে! আমরা এগুচ্ছি শহিদ মিনারের পথে। শোক মিছিলে সামিল হয় বাংলাদেশের সব বামপন্থী দল। গোটা মিছিল একই সুরে গাইল ‘ইন্টারন্যাশনাল’–

‘শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড…গাহি ইন্টারন্যাশনাল।’

 

লাবণী মণ্ডল : সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক

 

গ্রন্থপঞ্জি 

১. জীবনের রেলগাড়ি-জসিমউদ্দিন মণ্ডল

২. বিপ্লবী জসিমউদ্দিন মণ্ডল-সম্পা. : শেখ রফিক ও লাবণী মণ্ডল

৩. বিপ্লবী কামাখ্য রায় চৌধুরী-সম্পা. : শেখ রফিক ও লাবণী মণ্ডল

৪. আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী–অতুল সুর

৫. সূর্য সেন-অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

৬. অগ্নিপুরুষ-অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

৭. উইকিপিডিয়া

=====================