You are currently viewing কর্পোরেট-সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ও ভাষার রঙ/ হোসাইন কবির

কর্পোরেট-সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ও ভাষার রঙ/ হোসাইন কবির

কর্পোরেট-সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ও ভাষার রঙ

হোসাইন কবির

একুশ এলে মায়ে ভাষার প্রতি আমাদের দায় যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনুভূত হয় নানান আনুষ্ঠানিকতায়। তবে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত মাটি ও মানুষের যে ভাষা তাকে যদি অঞ্চলভেদে মানুষের  মায়ের ভাষা বলি, তাহলে তার রঙ আর যে আনুষ্ঠানিক প্রমিত বাংলার কথা বলি তার রঙ কি এক? না, এক নয়। যখন আমরা রাষ্ট্রের ভাষা বাংলার কথা বলি, সেটি মুখ্যত ভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলি, এ বলার পেছনে যে ইচ্ছা কর্মপ্রয়াস তা আসলে কার? কোন জনসম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে? তাও একটি মৌলিক প্রশ্ন।

মানুষ তার মনের ভাব, ভাবনা-চিন্তা মূলত ধ্বনির মাধ্যমে বহুবিধ রঙ মিশিয়ে প্রকাশ করে, এ যে প্রকাশে রঙের খেলা রঙের মেলা; তাতে আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, আগ্রহ-অনাগ্রহ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মমতা-ভালোবাসা, প্রেম-অপ্রেম, আদর-সোহাগ, তিরস্কার, পুরস্কার ইত্যাদি বহুবিধ রঙের মিশেল থাকে, থাকে অঞ্চলভেদে বৈচিত্রময় প্রকাশভঙ্গি। তবে এ রঙের খেলা সব সময় ব্যাকরণ-বিধি শৃঙ্খল মেনে চলে কি? উত্তর নিশ্চয়ই, না। একইভাবে নানা অঞ্চলের ভাষার রঙও কিন্তু বৈচিত্রময়। অন্য দিকে বাংলাদেশে রয়েছে নানা নৃগোষ্ঠীর প্রায় ১৬ লক্ষ আদিবাসী। তাঁদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে আরও অধিক রঙিন। আসলে পৃথিবী জুড়ে চলছে ভাষার রঙের খেলা, এ রঙের খেলা তো ভাষা-সংস্কৃতির প্রবাহমান এক নদী, এ নদীতে মানুষ মাতৃজঠরের মতই উষ্ণতা অনুভব করে, এ রঙের নদীতে হামাগুড়ি দিয়ে সাঁতার কেটে চিনে নেয় নিজের আপন ভুবন৷ তাই তো, মানুষকে চেনা যায় বুঝা যায় তাঁর ভাষা-সংস্কৃতির আলোকে তিনি কোন        অঞ্চলের কোন ভাষা নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ! এ চেনায় এ পরিচয় চিহ্ন ভাষার রঙের চিহ্ন। যেমন আমরা যখন উচ্চারণ করি, ‘তোঁয়ার লাই অ্যাঁর পেট পোড়ে’; ‘তুঁই অ্যাঁর কইলজার বঠু পরানঅর আধখান’; মধু হই হই বিষ হাওইলা কিংবা ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই..’ তখন ভাষা ভঙ্গিমায় যে রঙ খেলা করে তাতে অঞ্চল, ভাষা-সংস্কৃতির নৃগোষ্ঠীকেও একই সঙ্গে উপস্থাপন করে। এ রঙ, এ  বৈচিত্রময়রূপ হাজার বছরের পথচলায় মানুষ ও মানব সভ্যতার মূল্যবান মানবিক সম্পদ। আমরা যখন গান শুনি, তখন তো আসলে সুর-ছন্দে ভাষার রঙেই মন রাঙাই। আর এ গানে ভাষার রঙের সাথে জড়িয়ে থাকে স্থানিক অঞ্চলের মানুষের সুদীর্ঘ সময়ের সাংস্কৃতিক সামাজিক নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সমূহ উপাদান; আর সেই রঙ আর উপাদানে অবগাহন করেই আমরা মনকে রাঙাই। আমরা যখন লালনের, হাসন রাজার কিংবা শাহ আব্দুল করিমের গান শুনি; তখন তো শুধু গানের বানীই শুনি না। আসলে আমরা গানের ভেতরে যে ভাষা-সংস্কৃতির বহুমাত্রিক রঙ, তা দিয়েই নিজেদের ভরিয়ে নেই। তাই অঞ্চলভেদে- ভাষা-নৃগোষ্ঠিভেদে কোন ভাষার রঙের প্রতি, রূপের প্রতি আগ্রাসন আধিপত্য তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা অশ্রদ্ধার বিষয়টি মানবিকতার প্রতি মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান প্রদর্শনের সামিল মনে করি। আমাদের চেনা দুনিয়ায় কিন্তু এ অসম্মানের বিষয়টি  ঘটছে হরহামেশাই। ভাষার মত মানবিক বিষয়টিও সবলের দ্বারা উপেক্ষিত অনাদৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু তাই নয়; সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিবেচনায় দুর্বল ভাষা-নৃগোষ্ঠীর মানুষ ক্ষমতাবান কর্তৃক নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন হচ্ছেন আজও তাবৎ দুনিয়ায়।

ভাষার কোন কোন শব্দের রঙ কখনো কখনো সমরাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী রূপ নেয়- প্রতিরোধ লড়াই সংগ্রামে, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ। এ ভাষণ নিছক কোন ভাষণ নয়, এ ভাষণ আপামরসাধারণের বোধগম্য ভাষার রঙে, গণমানুষের হৃদয়-নদীর কল্লোলিত সুর-ছন্দে রচিত উচ্চারিত অনন্য অসাধারণ এক কাব্যভাষ্য, যা রচিত হয়েছিল লাখো জনতার উপস্থিতিতে জনপরিসরে, যার সমকক্ষ কাব্যভাষ্য এ বাংলায় আজও রচিত হয়নি। উল্লেখ্য, এ ভাষণে কিছু শব্দে ভাষার রঙের মিশেল এত উদ্দীপিত যে, যা একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, এমনকি আজও আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়, সেই এক অনিবার্য অমোঘ নির্ঘোষ। যেমন, সে ভাষণে জাতির জনকের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত কিছু শব্দরঙ আমাদের সবিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে- ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা ‘গদিতে’ বসতে পারি নাই;—– আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে ‘দিবার’ চাই;—- আমি যদি হুকুম ‘দিবার’ নাও পারি;—– সাত কোটি মানুষকে ‘দাবায়ে’ রাখতে পারবা না;—–  আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের ‘দমাইয়া’ রাখতে পারবা না। বঙ্গবন্ধু তাঁর এ ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র জাতিকে আসলে ভাষার রঙে রাঙিয়ে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেদিন শত্রুর মোকাবিলা করবার অমোঘ নির্ঘোষই জারি করেছিলেন। বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে সে নির্দেশ পালন করেছিল অকুতোভয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ভঙ্গিমায় অসামান্য উচ্চারণে- দিবার, দাবায়ে-এর মধ্যে যে অপূর্ব রঙের বিচ্ছুরণ তা দেবার কিংবা দমিয়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ভাষার রঙ যে মানুষকে আপন করে, তার সাক্ষাত প্রমাণ পেলাম সম্প্রতি নিঝুমদ্বীপে বেড়াতে গিয়ে। নিঝুমদ্বীপের বেলাভূমির অর্থাৎ বাল্লার চরের নিঃসঙ্গ খেজুর বৃক্ষকে বিদায় জানিয়ে সেদিন যখন চর সংলগ্ন পল্লীর আলপথ ধরে ফিরছিলাম নামার বাজারে দুপুরের খাবার খেতে; ফিরবার পথে বাড়ি আঙ্গিনায় ছোটবড় চাটাইয়ে ছোট ছোট টুকরায় চেওয়া/চেউয়া শুঁটকি শুকাতে দেখে ইচ্ছে জাগলো রোদে শুকানো শতভাগ খাঁটি এবং বিষমুক্ত এ  শুঁটকি কীভাবে সংগ্রহ করা যায়! একটা বাড়ির আঙ্গিনায় ১০/১১ বছরের এক বালিকাকে যখন বললাম- মা এ শুঁটকি কি বিক্রি করা হবে? প্রতি উত্তরে বালিকার সোজাসাপ্টা জবাব- ‘না, এগুন তো আঙ্গো নিজেগো খাওনের শুঁটকি’; বালিকা কি যেন ভেবে- খাড়ান (দাঁড়ান) বলে বাড়ির অভ্যন্তরে গেলো। বাড়ি থেকে সম্ভবত তার বাবাকে ডেকে আনলো। তার বাবা বললো, ছোট টুকরার শুঁটকি বিক্রি করবে না, ওটা তারা সারা বছর খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করছে; কিনলে গোটা মাথাওয়ালা চেওয়া শুঁটকি কিনতে পারবো। এরূপ কথোপকথনের এক পর্যায়ে আমি যখন তাঁদের মুখের কথ্যভাষার কাছাকাছি ভাষায় বললাম- আন্নেরা বেগগুন খাইবেন, আঙ্গরে দুগা খাইতে দিতেন ন; এ কথা উচ্চারণ মাত্র গৃহের অভ্যন্তরে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো- ‘ওম্মা হেতেনে তো আঁঙ্গোলাইন কতা কয়’;  বুঝতে দেরি হলো না, ভাষার রঙ বীজমন্ত্রের মত কাজ করেছে। একে একে প্রায় বাড়ির সব গৃহস্থ ঘর থেকে বয়াম, ছোট ছোট বস্তায় সারা বছরের জন্য সংরক্ষিত শুঁটকি থেকে একটা অংশ হাজির হতে থাকলো। তাঁরা আমাকে একেবারে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে এ শুঁটকি দিয়েছে, এমন আন্তরিকতার মূল্য পরিশোধ আসলে করা সম্ভব নয়। ভাবছি, মাত্র ক’টা শব্দ আর তাঁদের মুখের কথ্য ভাষার কাছাকাছি উচ্চারিত ভাষায় মুহূর্তে পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে যাওয়া আর তাদের নৈকট্য লাভ- এ যে, ভাষার রঙের যাদুকরী সক্ষমতার এক বাস্তব নজির; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কর্পোরেট-সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের এ কালপর্বে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিচারে কতিপয় ভাষার আধিপত্য ও সর্বগ্রাসী আগ্রাসন যেভাবে বৈশ্বিক ও দৈশিক প্রেক্ষাপটে চলছে, তাতে অঞ্চলভেদে, জাতি ও নৃগোষ্ঠীভেদে ভাষার যে  বৈচিত্রময় রূপ-রঙ, তা কতটা টিকে থাকবে, তা ভাবার বিষয়। কেননা ভাষার রঙ, ভাষা-সংস্কৃতি প্রবাহমান নদীর মতই এক প্রাণবন্ত সবল শরীর; এর প্রবাহমানতা প্রাণোচ্ছলতা বজায় থাকে সেই ভাষা নৃগোষ্ঠীর প্রতিদিনের যাপিত জীবনে এর স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার ও প্রকাশ ভঙ্গিমায়। আমারা ইতিহাসের পাঠ থেকে অবগত যে, এক সময় উপনিবেশের দখলদার ঔপনিবেশিক প্রভুগণ ভূমির আদিবাসীদের পশ্চাদপদ অনগ্রসর অখ্যায়িত করে আদিবাসীদের বাধ্য করতো  দখলদারদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখতে,  এমনকি অতীতে দেশে দেশে এ দখলদার শক্তি ভূমিজ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশু সন্তানদের মা-বাবা, পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে শেখানো হতো দখলদারদের ভাষা-সংস্কৃতি; আর এর মাধ্যমে শিশুদের ভুলিয়ে দেয়া হতো তাদের নিজস্ব শেকড়ের ভাষা-সংস্কৃতির রঙ, আত্ম-পরিচয়ের মৌল উপদান ও চিহ্ন; যা যেকোন বিবেচনায় ছিল বড় অপরাধ, এ অপরাধ অতীতে এক সময়ে উপনিবেশের দখলদার ইউরোপীদের দ্বারা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা মহাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে সংঘটিত হয়েছিল। আজ স্বীকার করা হয় অতীতের সে পাপের কথা, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের আওয়াজও তোলা হচ্ছে। মানবজাতির টিকে থাকার জন্য শুধু জীবজগতের জেনেটিক বৈচিত্র্যই নয় তার সাথে আদি জ্ঞানের উৎসসহ বহু রঙের ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় বিষয়কে চলমান এবং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করি।  পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারের মত ভাষা থাকলেও পৃথিবী থেকে দিনকে দিন অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ রঙ অপার সম্পদ- আমাদের দখলদারি মনোভাবের কারণে। এসব ভাষা-সংস্কৃতির রূপ রঙ সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ যদি এখনি না নেয়া হয়, তাহলে মানবসভ্যতা  ভাষা-সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ হারানোর পাশাপাশি হারাবে গুরুত্বপূর্ণ লোকায়ত জ্ঞান ও প্রথাগত জ্ঞানসম্পদের বিশাল ভান্ডার। কেননা প্রকৃতি জগত আর পরিবেশের সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ নিবিড় সম্পর্ক-পাঠের জ্ঞান তো জড়িয়ে থাকে ভাষা-সংস্কৃতির রঙেরই সাথে।

যে ভাষা সর্বসাধারণ তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনাচারে ব্যবহার করে না, সে ভাষার রঙ বিবর্ণ হতে হতে সে ভাষা-সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, মরে যায়। তবে চলমান বিশ্বে কতিপয় ভাষার আধিপত্য আর আগ্রাসনে কেন যেন সমগ্র পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার রঙ ভাষার বৈচিত্রময় রূপ আজ হুমকির মুখোমুখি। চলমান কর্পোরেট সংস্কৃতি, বিশ্বায়ন যে কেবলমাত্র পণ্য নির্ভর তা কিন্তু নয়; বরং এসব ভাষানির্ভরও। যে বা যাঁরা বড় পুঁজির কারবারি, পৃষ্ঠপোষক- তাঁদের ইচ্ছায় অভিপ্রায়ে কর্তৃত্বে তাঁদের পছন্দের অর্থাৎ তাঁদের ভাষাই আধিপত্য বিস্তার করবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই পুঁজির ধর্ম। এ পণ্যায়নে, একটা সময়ব্যাপ্তিতে- এক বিশ্ব, একই মেরু , একই কাতারে দাঁড় করাবার চাতুর্যপূর্ণ বয়ানে মূলত বৈচিত্রময় ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক নৃগোষ্ঠীকে পণ্যগ্রাহী ভোক্তায় পরিণত করারই প্রয়াস। এতে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ডামাডোলে কেন যেন মনে হয় মানবসভ্যতার নানা জাতি ভাষা-সংস্কৃতির নৃগোষ্ঠি তাঁদের স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতির রূপ-রঙ হারিয়ে একদিন হয়ে পড়বে উন্মূল শেকড়হীন সংস্কৃতিহীন আত্মপরিচয়হীন দৈশিক ও বৈশ্বিক উদ্বাস্তুতে।

উল্লেখ্য, আমাদের আলোচনায় সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সমরাস্ত্র কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গ যতটা গুরুত্ব পায় ক্ষমতা বিস্তারে ভাষা ও সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদ অনুষঙ্গ ততটা গুরুত্ব পায় না, বরং তা নিয়ে চলে একপ্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে, তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে কর্পোরেট পুঁজি তাঁদের  সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের স্বরূপকে আড়াল করতে সামাজিক দায়-দায়িত্বের নামে যে নতুন তত্ত্বের হাজির করেছে; কার্যত এর মাধ্যমে তারা প্রচার, প্রকাশনা, মিডিয়া, শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কণ্ঠসহ আমাদের সুস্থ এবং কোমল অনুভূতির সব বিষয়াদি সুকৌশলে দখলে করে নিচ্ছে; অত্যন্ত দাপটের সাথে এসবের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলছে এবং  এসবকে একচেটিয়া মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত করেছে; এমনকি আমাদের নানা ভাষা-নৃগোষ্ঠির বহু  বৈচিত্রময় ভাষার রঙও তা থেকে মুক্ত নয়।  অনেক ক্ষেত্রে এরা বদলে দেয়ার মত চটকদার শ্লোগানে উৎপন্ন করে চলছে উদ্ভট রঙের ভাষা-সংস্কৃতি, বিকৃত ঢঙের বাংলা আর ইংরেজি মিশেলে বাংরেজি; যার প্রমাণ এফ এম রেডিওসহ কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলসমূহের অনেক অনুষ্ঠানমালা কিংবা  কর্পোরেট পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্ভট কনসার্ট সংস্কৃতি।

বিশ্বপুঁজির অনৈতিক মুনাফালাভের লোভ-লালসায় যেভাবে মানবসভ্যতা আজ পরিবেশগত মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি; সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, মানবসভ্যতা প্রত্যক্ষ করবে পুঁজির এককেন্দ্রিক বৈশ্বিক ভাষার এলগরিদম সাজাতে গিয়ে  বৈচিত্রময় ভাষার রূপ রঙের মহাবিপর্যয়ের সমাধি। তাই পরিশেষে বলবো, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির বর্ণিল রঙের বীজতলা হলো এখনো বিস্তৃত গ্রামবাংলা; তা এ দানবীয় ছোবল থেকে রক্ষা করতে আমাদের সচেতন উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।

কবি ও লেখক, অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।