You are currently viewing করুণা খাতুন মঞ্জিল > মোস্তফা অভি

করুণা খাতুন মঞ্জিল > মোস্তফা অভি

করুণা খাতুন মঞ্জিল

মোস্তফা অভি

 

শহরের দুপ্রান্তে দুজন মানুষ থাকে। একজন ওষুধ কোম্পানির রি-প্রেজেন্টিটিভ আর অন্যজন সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করা এক নারী। তাদের মধ্যে ভার্চুয়াল আলাপ হয়, একসময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আর একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, বন্ধুত্ব জীবনের সেরা সময়টি পার করে তারা।

সন্ধ্যায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো ছিল মেহেরুন্নেছার জীবন। সে সতেরো বছর আগে বিধবা হয়েছে। তার কোনো মেয়ে ছিল না, আর তিনছেলে যে-যার মতো নিজেদের কর্মস্থলে চলে গেছে। মেহেরুন্নেছা করুণা খাতুন মঞ্জিলের একমাত্র পাহারাদার। তার সবসময় মনে হত, মানুষের জীবনে আরো একটি আলাদা জগৎ আছে। যেখানে অদৃশ্য আত্মার মতো তাকে একাকী বসবাস করতে হয় আর সেখানে দিন-রাত্রির আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য থাকে না। সে সববসময় এমন বিষণ্নতায় ডুবে থাকে, তার বিচিত্র কল্পজগতে এক অনন্ত জগৎ ভর করে থাকে। তার ভার্চুয়াল জীবনের সঙ্গী হল পিনাক নামে ছাব্বিশ বছরের এক ওষুধ কোম্পানীর রি-প্রেজেন্টিটিভ।

শহরের প্রতিটি হাসপাতালে পিনাকের যাতায়াত। প্রতিদিন সকালে সে বাসা থেকে বের হয়। দুপুর থেকে বিকেল, তার পুরোটা সময় কাটে ওষুধের ডিসপেনসারি আর হাসপোতাল-ক্লিনিকে। পুরুষ ডাক্তারগুলো তাকে যথেষ্ট সময় দেয়। মন দিয়ে প্রোডাক্টের গুণাগুণ শোনে আর গিফট পেলে অভ্যাসবশত মুচকি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানায়। তবে সুন্দরী লেডি ডাক্তারগুলো পিনাককে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। পিনাকের মনে হয় লেডি ডাক্তারগুলো সবসময় বিমূর্তভাবনায় ডুবে থাকে। ওদের স্মিত হাসি রোগীর মন ভুলানো ছলনা আর গুনগুন করে গান গাওয়ার মানে নিজেকে ফুরফুরে রাখার ভেলকি। পিনাক নতুন কোনো প্রোডাক্টের গুণাগুণ নিয়ে লেডি ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে তারা যে কোনো অজুহাত দেখিয়ে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে বলে। অথচ পিনাকের মনে হয়, ডাক্তারনি যখন বাম হাতটা চিবুকে রেখে ব্যবস্থাপত্রের ওপর ঘচঘচ করে ওষুধের নাম লেখে সেটা আর যে-কোনো অভূতপূর্বদৃশ্যগুলির একটি। দুর্বোধ্য অক্ষরগুলোর নিচে স্বাক্ষর করে যখন কাগজটা রোগীর দিকে এগিয়ে ধরে, পিনাকের মনে হয় ডাক্তারনি এইমাত্র কারো স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। পিনাকের ধারণা, প্রত্যেক সৃজনশীল সুন্দরী নারী নির্ধারিত পুরুষটির জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তবে সে ডাক্তারনি যদি অসুন্দরী হয়, তাতে পিনাকের তেমনকিছু যায় আসে না।

পিনাক দেখতে সুদর্শন আর তার বাচনভঙ্গি সুন্দর। কথার জাদুতে যে-কাউকে মুগ্ধ করতে পারদর্শী অথচ তার জানা নেই, কোন্ অদৃশ্য কারণে সুন্দরী লেডি ডাক্তারগুলো তাকে দিনের পর দিন এড়িয়ে যায়!

পিনাক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে একাকিত্বতাকে চরমভাবে জাপটে ধরে। তার মনে হয় সিংকহোলের গভীর তলদেশে সে নিশ্চুপ পড়ে আছে। যেন হাজার ফুট গভীরে ক্ষয় হতে হতে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে তার শরীর। সে মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালে এক চিলতে আলোর রেখাও দেখতে পায় না।

পিনাকের এমন কোনো প্রেমিকাও নেই যে, তার সঙ্গে দু’দণ্ড আলাপ করে সময় কাটাতে পারে। ভার্চুয়াল আলাপের মেয়েগুলো প্রথমে চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে আসে, তারপর সময় গড়াতে গড়াতে সম্পর্কটা ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। ফুরিয়ে যেতে থাকে ওদের ভেতরকার কথার ভাণ্ডার। পিনাক ধীরে ধীরে যুবতী মেয়েদের থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, তারপর সম্পর্ক স্থাপন করল মেহেরুন্নেছার সঙ্গে। পিনাক বিদেশি সিনেমা দেখত আর সেসব সিনেমার চুম্বক-দৃশ্যগুলি মেহেরুন্নেছার কাছে আকর্ষণীয় করে বলত। দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে মেহরুন্নেছার মনে হত, মহাজাগতিক কোনো একটা পর্দা তার চোখের সামনে ঝুলে আছে আর মেহেরুন্নেছা সিনেমার দৃশ্যগুলি বিস্ময় নিয়ে দেখছে।

 

পিনাক একদিন মেহেরুন্নেছাকে আশ্চর্য এক সিনেমার কথা বলল। জনাকীর্ণ শহরের এক মাছ-বিক্রেতা নারী তীব্র ঘ্রাণশক্তিওয়ালা এক অদ্ভুত শিশুর জন্ম দেয়। শিশুটি যখন কিশোর হয়ে ওঠে, সে শহরের বিভিন্ন পেশার শ্রমিকের সাথে কাজ করে। প্রকৃতির অলৌকিক ক্ষমতাবলে শিশুটি বহুদূরের যে-কোনো ঘ্রাণ শুষে নিতে পারে। তবে তাকে ইন্দ্রজালের মতো মোহাবিষ্ট করে নারী-শরীরের গোপন ঘ্রাণ। সে একদিন কোনো এক কিশোরীর জামাকাপড় ছিন্ন করে। তার ময়লায় গিদগিদ করা নখ দিয়ে মেয়েটির নগ্ন স্তনে আঁচড় কাটে। সে মেয়েটির শরীরের প্রতিটি স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে নাক ডুবিয়ে নেশাতুরের মতো আদিম ঘ্রাণ শুষে নেয়। যখন সে যুবক হয়ে ওঠে, শহরের প্রসিদ্ধ সুন্দরী মেয়েদের হত্যা করে। তারপর মেয়েগুলোর মুণ্ডুছেঁচে নগ্নদেহগুলি ইলেক্ট্রিক কাচের বয়ামে সিদ্ধ করে নেয়। সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজটা সম্পন্ন করে। মেয়েগুলোর শরীর থেকে বের করে আনে অপাথির্ব সৌরভময় আতর।

একদিন শহরের রাজ-এলানকারী তার ঐতিহ্যবাহী বাদ্যটি বাজিয়ে ছেলেটির মৃত্যুদণ্ডের কথা ঘোষণা করল। সেই বিচারটি ছিল ঐতিহাসিক আর সিদ্ধান্ত হয় স্পষ্ট দিবালকে ছেলেটির মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হবে। ছেলেটির বীভৎস কর্মকাণ্ড শহরবাসীকে এতটাই বিচলিত করেছিল, তারা বিচার দেখতে দলে দলে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে জড়ো হয়। ছেলেটি একটা সরু কাচের শিশি থেকে দুফোঁটা তরল রুমালে লাগিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। এক অভূতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। উপস্থিত নারী-পুরুষ উন্মুক্ত প্রান্তরে অদ্ভুত চেতনায় ঢলে পড়ে আর তারা জোড়ায় জোড়ায় সঙ্গমে মিলিত হয়।

মেহেরুন্নেছার কাছে এসব গল্প যেন পৌরাণিক কোনো আখ্যান। সে পিনাকের প্রতিটি গল্পের দৃশ্যান্তরে নিজেকে সাক্ষী হিসেবে কল্পনা করে। তার প্রায়মৃত মনে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়। সে নিজেকে খোলসমুক্ত করে আর ধীরে ধীরে একাকিত্বের কথা ভুলে যায়। একদিন পিনাক বলল- আচ্ছা মেহের, ঢাকা শহরের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে কোনো টানে তুমি এই মফস্বলে পড়ে আছ?

মেহেরুন্নেছা বলল, তোমার হয়তো জানা নেই পিনাক, পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকতার্থে কখনোই সুখি নয়। যদি তুমি সেই অসুখি মানুষের তালিকা কর তাহলে গুনে শেষ করতে পারবে না। মনে করো আমি সেই তালিকারই একজন। তবে আমি জীবনে যেটুকু পেয়েছি সেটা অবলম্বন করে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারব। আমার ছেলের বউগুলো উচ্চশিক্ষিত আর অবুঝ। ওরা খেয়ে আর ঘুমিয়ে সময় পার করে। নিজেদের যা কিছু প্রয়োজন সেসব চাহিদা মেটানোর জন্য সবসময় মরিয়া হয়ে থাকে। ওরা এতটাই ফুর্তিবিলাসি যে, আমার কখনোই মনে হয়নি ওরা নিজ নিজ স্বামীকে ভালোবাসে। তোমার হয়তো জানা নেই, ছেলেদের এসব অসহায়ত্ব একজন মা-কে কতটা যন্ত্রণা দিতে পারে! বলা যেতে পারে এজন্যই আমি ঢাকা শহরের চাকচিক্যময় জীবনযাপন ছেড়ে এই মফস্বল শহরে নিভৃতচারী হয়েছি। তুমি কি বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছ?

 তুমি কোনো সামাজিক কাজের সাথে জড়িত হতে পারতে, পিনাক বলল। এমন কোনো মহৎ কাজ, যার জন্য মৃত্যুর পরও মানুষ তোমাকে স্মরণ করতে পারে। মেহের, আমি তোমাকে যা কিছুবলি, সেটাকে তুমি জ্ঞান বিতরণ মনে কোরো না। কারণ তোমাকে উপদেশ দেওয়ার মতো আমি কোনো বিজ্ঞ মানুষ নই।

আমি সত্যিই কিছু একটা করতে চাইতাম। আমার মনে হত, এমন কোনো একটা কাজ করি যার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। তবে কোনো কাজে হাত দিয়ে আমি বুঝতে পারতাম, জগতের সকল কাজ সবার জন্য উপযুক্ত নয়। প্রকৃতি সেসব কাজের জন্য নির্দিষ্ট কিছু মানুষ তৈরি করে রাখে। উপযুক্ত সময় মনে করে প্রকৃতি তাকে সেখানে বসিয়ে দেয়। পিনাক তুমি জানো না, আমি বহুদিন ধরে একটা দগদগে ঘা বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি এমন একজন মা, যে নিজ পেটের সন্তানের থেকে চরিত্রহীনতার পেরেক নিয়ে ঘুরছি। সেই অপরাধের ক্ষতটা এমন, যেন একটা আধুলি পয়সা আগুনে ঝলসে আমার হৃৎপিণ্ডের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ঠিক জানি না কতদিন পর্যন্ত এই দুঃসহনীয় ব্যথাটা বয়ে বেড়াতে হবে! আমি যতটা দ্রুত সম্ভব এর থেকে মুক্তি চাই।

পিনাক বলল, আমি তোমার সেই ব্যথাটার কথা জানতে চাই। মেহেরুন্নেছা খুব শান্ত আর ধীরকণ্ঠে বলল, তোমাকে এখনই সেসব বলে ইলেক্ট্রিক শকের মতো ধাক্কা দিতে চাইনা। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, আমার একান্ত বেদনাগুলো প্রকাশ করার মতো তুমি ছাড়া আর দ্বিতীয়জন নেই। একদিন সত্যিই আমি তোমাকে সবকিছু খুলে বলব।

বহুদিন ধরে করুণা খাতুন মঞ্জিলে আমি আমার বোনের মেয়েটিকে নিয়ে থাকতাম। ওর যখন বিয়ে হয়ে গেল আমি অথৈ সমুদ্র্রে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। তখন আমার হাতে এমন কোনো কাজও ছিল না। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বলার মতো বহু কথা আমার মনের ভেতর জমা হয়ে থাকত। আমি সেসব কথার ভার বইতে পারতাম না।

 

আমার ঠিক দিন-তারিখ মনে নেই, কবে, কখন এসব অব্যক্ত কথাগুলো ছোট ছোট করে ফেইসবুকে পোস্ট দিতে থাকলাম। ধীরে ধীরে আমার বন্ধুতালিকা বড় হতে লাগল আর আমি বন্ধুদের থেকে প্রচুর লাইক, কমেন্টস পেতে লাগলাম। তখনো আমার কাছে তোমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একদিন হঠাৎ কোথা থেকে এসে তুমি আমাকে কবি সম্বোধনে ‘হাই, হ্যালো’ করলে।

 পিনাক বলল, সম্ভবত আমার সেই দিনের সম্বোধন মোটেও মিথ্যা ছিল না। হতে পারে ছন্দের ভাষায় তোমার লেখাগুলো জীবনের কোনো অতীত। আমি এটাও বিশ্বাস করি, একজন দক্ষ সুরকার তোমার রচিত প্রতিটি ছন্দে যদি সুর তুলে দিতেন, তবে সেটা পৃথিবীর সেরা শোকগীতি হতে পারত। আমি যা কিছু বলেছি সেটা একান্তই আমার কথা। তুমি হয়তো সেটা বিশ্বাস করতে পারছ না। মেহেরুন্নেছা চোখেমুখে দ্বিধা নিয়ে বলল, লেখাগুলো এতটাই অগোছালো ছিল, ঠিক যেন জঞ্জালে ভরা কোনো ডোবার মতন। আমি শুধু আমার বক্তব্যটাই বলতে চাইতাম। তবে আমার এটাই সৌভাগ্য যে, কথোপকথনের সূত্র ধরে তোমার মতো সুদর্শন একজন বন্ধু পেয়ে গেলাম।

আচ্ছা মেহের, তুমি কি জানো, মাঝেমধ্যে আমার কাছে তুমি অচেনা হয়ে যাও? তখন আমার কাছে মনে হয়, যেন তুমি দূরদেশের অচেনা কোনো মানুষ। তুমি বিজ্ঞদের মতো এত যৌক্তিক আর গুরুত্বপূর্ণ কথা বলো, মাঝেমাঝে ভাবি- এ আমি কার সঙ্গে কথা বলছি! আমি তোমার অতীতে বলা সরল সাধারণ কথাবার্তাগুলো ভুলে যাই।

এক অর্থে তুমি এটাকে বয়সের অভিজ্ঞতা মনে করতে পারো, মেহেরুন্নেছা বলল। একজন নিরক্ষর মানুষও জীবনের শেষপ্রান্তে অভিজ্ঞতার কারণে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। তবে তার শিক্ষার উপকরণ কোনো প্রসিদ্ধ বইপত্র নয়, বরং তাকে দীর্ঘজীবনের উত্থান-পতন এমনভাবে অভিজ্ঞ করে তোলে, কোনোভাবেই তাকে আর অশিক্ষিত বলা চলে না। তবে একথাও সত্য, দিনশেষে যখন আমি সত্যিকারের ভাবনার অতলে ডুবে যাই, মনে হয় বিরতিহীনভাবে জীবনের অন্তিম মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার সেই চলার পথটা এতটাই নিঃসঙ্গ আর বেদনাময়, মনে হয় জগতে আমার মতো অপাঙ্ক্তেয় আর কেউ নাই।

মেহের, আমি তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা করতে চাই। পিনাক অনুরোধ করল। ভিডিও কলে তোমাকে দেখে মনে হয়েছে, আর যে কোনো যুবতী মেয়ের চেয়ে তুমি কম কিছু নও। তোমার শৈল্পিক হাসির সাথে ঠোঁটের কোণে যে অভূতপূর্ণ রেখাটা ফুটে ওঠে, আমি সেটা মুখোমুখি বসে দেখতে চাই।

-পিনাক, মধ্যবয়সের চেয়েও আরো বেশি বিধ্বস্ত মহিলা আমি, যে তোমাকে ভালোবেসে যা কিছু করতে পারে। জীবনের ফেলে আসা সময়গুলোতে দু’তিনবার ধ্বংস হয়েছি আমি। নিশ্চয়ই একইরকমভাবে আর তুমি আমাকে ধ্বংস করতে চাও না। না-কি চাও? আমি চাই না সামনাসামনি দেখে তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। আমি তোমার সঙ্গে বহুদিন ধরে সম্পর্কটা বজায় রাখতে চাই।

 -দেখা হওয়ার পর যদি আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই তবে আর যা-ই হোক সেটা ভালোবাসা নয়। তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো, পিনাক বলল।

 

জ্যৈষ্ঠের এক বিকেলে পিনাক মেহেরুন্নেছার সঙ্গে দেখা করল। মফস্বল শহরটিতে এমন কোনো রেস্টুরেন্টও নেই, যেখানে কফি খেতে খেতে জীবনের পূর্বাপর কথাগুলো বলা যেতে পারে। তবে শহরের পুবপ্রান্তে তুলাতলী নদীর পাড়টা অন্য যে-কোনো জায়গার চেয়ে সুন্দর। উঁচুভেড়ির পর দীর্ঘচর, গলাডোবা জলের ভেতর ইরিধানের বিছানা। দূরে দু’নদীর সঙ্গমস্থলের দিকে তাকালে মনে হয় অচেনা কোনো বন্দর। মেহেরুন্নেছা পিনাককে নিয়ে নদীপাড়ের সেই নির্জন জায়গাটিতে বসল। চারিদিক আঁধারে ঢেকে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্ত তারা নীরব সময় কাটাল। মেহেরুন্নেছার মনের ভেতর বাতাসের ঝটকার মতো এমন এক শূন্যতা খেলা করল, সেই শূন্যতার প্রান্ত ছুঁয়ে পিনাক হেঁটে যেতে লাগল। পিনাক মেহেরুন্নেছাকে ভদ্রোচিতভাবে যতটুকু দেখা সম্ভব সেটুকু দেখে নিশ্চিত হল, মহিলা তার ভাবনার চেয়ে আরো বেশি সতেজ। তার নৃত্যের গতির মতো চলনভঙ্গি আর শরীরের কাঠামো দেখে বোঝার উপায় নেই কতটা বয়স পার করেছে সে। তার হাসিটা এত অপূর্ব, কোনো কিশোরীর পক্ষেও ওরকম হাসি আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। মেহেরুন্নেছা একসময় কণ্ঠের জড়তা কাটিয়ে কথা বলতে শুরু করল। পুরো সময়টুকুতে একবারের জন্যও চোখতুলে তাকালো না পিনাকের দিকে। সন্ধ্যায় মফস্বল শহরটিকে স্বাগত ভেঁপু বাজিয়ে ঘাটে যাত্রীবোঝাই লঞ্চ ভিড়ল। মানুষের সমাগমে ভেঙে গেল যৌথশান্তির নীরবতা। পিনাক আর মেহেরুন্নেছার প্রথমদিনের কথাবার্তা অসমাপ্তই রয়ে যায়।

তারপর যে যার বাসায় ফিরে পরস্পরকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকে। সেদিনের পর পিনাক মেহেরুন্নেছার সঙ্গে দেখা হয়েছে বহুবার। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দেখা না হলে মেহেরুন্নেছার সবকিছুখালি খালি লাগে। তার স্নায়ুতন্ত্রে পিনাকের অস্তিত্ব এমনভাবে গেঁথে যেতে লাগল তাতে করে পিনাকের কাছে বইয়ের পৃষ্ঠার মতো নিজেকে মেলে ধরতে লাগল মেহেরুন্নেছা। তারা একে অপরের না-বলা কথাগুলো সহজেই পড়ে ফেলতে পারল। তাদের ভেতরকার কোনো কথাই আর গোপন থাকল না। একদিন পিনাক বলল- আচ্ছা মেহের, আমি কি তোমার বাসায় একরাতের অতিথি হতে পারি?

 তুমি এভাবে কেন বলছ পিনাক? মেহেরুন্নেছা বলল। তুমি আমাকে এতটা বৃদ্ধাও ভেব না যে আমি তোমার মনের ইচ্ছেগুলো বুঝতে পারি না। কথাটা এমন প্রশ্নবোধক করে বললে, সত্যিই আমি খুব ব্যথিত হয়েছি। আমি তোমার যে কোনো আগ্রহ কিংবা প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিতে পারি না।

প্রবাহমান সরু খালের ধারে মেহেরুন্নেছার বাড়ি। দেয়ালের চুনকাম ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝরে পড়েছে। দরজার পাশে একটা ছোট্ট জায়গায় প্রায় রঙজ্বলা অক্ষরে লেখা ‘করুণা খাতুন মঞ্জিল’। পিনাক যখন করুণা খাতুন মঞ্জিলের দরজায় আসে, ভেতর থেকে দরজার খিল খুলে বাইরের দিক মুখ করে দাঁড়াল মেহেরুন্নেছা। তাকে দেখে মনে হল, সান্ধ্যকালীন প্রাথর্না সেরে এইমাত্র সে আসন ছেড়ে উঠে এসেছে। তার কপোলে জ্বলজ্বল করছে একান্তবিশ্বাসের পবিত্র আলো। পিনাক ফলের ব্যাগ, এক কৌটো মধু আর একটা ডায়রি তুলে দিল মেহেরুন্নেছার হাতে। মেহেরুন্নেছা পিনাকের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন কোনো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা পিনাকের কপালের ভাঁজ গুনে গড়গড় করে তার ছায়েতনামা বলে দেবে।

পিনাক কিছুটা অপ্রকৃতস্থ। হাজার হোক, নিজের থেকে দ্বিগুণ বয়সি এক মহিলার সঙ্গে সে একান্তে রাত কাটাতে এসেছে। আর সে ভালো করেই জানে নির্ঝঞ্ঝাট রাত্রিকালে কী কী ঘটতে পারে। সে খাটে বসে একটা পুরনো পত্রিকার পাতা উল্টাতে লাগল। মেহেরুন্নেছা ফল কেটে একটা প্লেটের ওপর সুদৃশ্যভাবে সাজিয়ে আনল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিনাকের খাওয়ার দৃশ্যের দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল।

মেহেরুন্নেছা বলল, আমি তোমার পরিবারের কথা শুনতে চাই। যদিও বহুবার আমি তাদের কথা শুনেছি আর বারবার মনে হয়েছে তারা আমার কাছে তোমার মতোই পরমাত্মীয়। আমি তোমার ছোটভাইটার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চাই। পিনাক পারিবারিক আলাপের প্রসঙ্গ দ্রুত ইতি টানল, নতুন করে বলবার মতোও কিছু খুঁজেও পেল না। কারণ একজন মানুষের ভেতর কত আর কথা জমা থাকতে পারে! বিবিধ ভাণ্ডারে যা কিছু জমা ছিল ইতোমধ্যে তা একাধিকবার বলা হয়েছে। সে মেহেরুন্নেছার আড়ালের মানুষটিকে দেখতে চায়। সে তাকিয়ে দেখল, মেহেরুন্নেছার পাতলা শরীর, ভারী নিতম্ব আর বড় বড় দুটো চোখ। গলায় আর গালে বয়সের সামান্য ভাঁজ, কয়েকগাছি চুল দুপাশ থেকে ঝুলে পড়ছে। তবে একজন নিঃসঙ্গ নারীর চারদেয়ালের আড়ালের দৃষ্টি যে এত করুণ আর মায়াময় হয়, আগে তার জানা ছিল না। পিনাক অস্থির ভাবলুতায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার কাছে মেহেরুন্নেছাকে মনে হল কোনো এক নির্বাসিত দ্বীপের মানুষ।

 

মেহেরুন্নেছার ভেতর এমন এক আশ্চর্য ক্ষমতা, সে যে-কোনো বয়সি পুরুষের চোখের ভাষা সহজে অনুমান করতে পারে। দূর থেকে বলে দিতে পারে পুরুষলোকটির ভেতরে কী চলছে। এমনকি নিজ পেটে ধারণ করা পুরুষসন্তানটি, এমনকি নিজ পিতার কথাও। সে পিনাকের যতটা সম্ভব কাছাকাছি বসে বলল, তোমার বয়সি ছেলেদের নিয়ে চলাটা খুব কঠিন। কেননা, যৌবনে পুরুষগুলো অসভ্য, অমার্জিত আর স্বার্থপর। তারা মেয়েদের শরীর ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারে না। তুমি ভেবো না আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করেই এসব বলছি। আমি পুরুষের স্বভাবজাত আদিম কামনাকে কখনো অসম্মান করিনি। তবে হরিণ যেভাবে বাঘের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে, মেয়েদেরও সেভাবে রেসের যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে বাঁচতে হয়। আমার মনে হয় নারী সরল আর বোকা একথা যেমন সত্য, পুরুষকে ভুলিয়ে একজনম পার করানোর মতো পরিপক্বতাও তাদের থাকে। নারী পুরুষের খাঁচায় স্বেচ্ছায় বন্দি না হলে কেউ তাকে পোষ মানাবার ক্ষমতা রাখে না। পিনাক, তুমি চলতে চলতে যখন এতটা পথ এসেছ, আমি তোমাকে কোনোভাবেই নিরাশ করে ফিরিয়ে দেব না।

তারা পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে পড়ল। কাউকে মুখফুটে কিছু বলতে হল না। পিনাকের প্রথম স্পর্শে মেহেরুন্নেছার মনে হল, এই বুঝি চলে এসেছে সুখের মৃত্যু। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, স্রেফ একটা আনন্দের ফুঁ। যেন বাতাসের এক ঝটকায় আলোর শিখাটা জ্বলে উঠল। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দাগ পেরুনোর আগেই দুজনের সঙ্গম হয়ে যায়।

পিনাক চুপ করে শুয়ে রইল। মেহেরুন্নেছা নিজেকে ঠিকঠাক করে বলল, আজ যা কিছুহল, কাল তা অতীত। তবে অতীতের স্মৃতি নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। শোনো পিনাক, আমি যে-কোনো মূল্যে তোমার সাথে সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যেতে চাই।

যখন আমি বিয়ে করব, তখন? পিনাক বলল।

শোনো, কোনো কিছু যখন চলতে শুরু করে, সেটা বস্তু হোক কিংবা মানুষ। একটা গতি তাকে পেছন থেকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। সেটাকে সহজে আর গতিরোধ করা যায় না। আমার মনে হয় তোমাকে আর কিছু খুলে বলতে হবে না।

পিনাক তারপরও চুপ করে রইল।

আমি কি তোমার নীরবতার কারণ জানতে পারি? মেহেরুন্নেছা বলল। হতে পারে, আমার অনুমান সত্যি নয় তবুও বলব, সুখটুকু ফুরিয়ে যাবার পর তুমি অনুতপ্ত হচ্ছ। আর বারবার তুমি নিজেকে এই বলে ধিক্কার দিচ্ছ যে, একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে তুমি সঙ্গম করে ফেললে! তবে সত্যি বলতে কী, সমাজে যা কিছু অস্বাভাবিক আমরা সেটাকে আড়াল করতে পছন্দ করি। আর আমাদের সমাজে এটাও প্রচলিত সত্য, প্রতিটি অনভ্যস্ত প্রাথা ভাঙাকে মানুষ পাপের চোখে দেখে। হয়তো যে-কোনো পাপাচারকে তুমি ঘৃণা করতে পারো তবে সেই পাপের মাঝের প্রাপ্তিকে অস্বীকার করার মতো নির্লোভও তুমি নও। যে-কারণে এই মুহূর্তে তুমি অনুতপ্ত, আগামীকাল সেটা পাওয়ার জন্য আবার তুমি মরিয়া হয়ে উঠবে। তারচেয়ে বরং সবকিছু ভুলে যাও। যে সুখটুকু তুমি যাপন করেছ সেটাকে আনন্দে রূপান্তরিত করো। আমি তোমাকে আমার জীবনের একটা ঘটনা শোনাতে চাই।

পিনাক মাথাটা ওপরে তুলে বলল, এ মুহূর্তে আমার জন্য সেটা শোনাই উপযুক্ত।

 

তখন আমি ছিলাম যৌবনের বসন্তদিনে। তুমি বললে বিশ্বাস করবে কি-না জানি না, আয়নার সামনে নিজেকে নিজে অনেকক্ষণ ধরে দেখতাম। শুধু আমার বাহ্যিক অবয়ব নয়, মাঝেমধ্যে নিজের অঙ্গপ্রতঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজেই নিজের প্রেমে পড়তাম। তখন সমাজ এতটাই রক্ষণশীল ছিল, ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে কথা বলাকে পাপ মনে করা হত। প্রতিটি মেয়ের একমাত্র বিনোদন ছিল অপরিণত বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া আর মনে লাগুক কিংবা না লাগুক, স্বামীর কাঁধ ছুঁয়ে শুয়ে থাকা। তবে সংসারজীবন ছিল ভিন্ন এক জগৎ। নিজের চিন্তা থেকে বলছি, হয়তো অল্পবয়সে কোনো মেয়েই স্বামীর সঙ্গে থেকেও কোনোদিন প্রকৃত সুখের নাগাল পেত না। তবে মনে মনে আমি সব সময়ই একজন প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য কামনা করতাম।

তখন মধ্যবয়সি এক যুবক আমাদের ঘরগেরস্থের কাজ করত। লোকটি ছিল বদমেজাজি আর বেটে। তবে তার চোখদুটো ছিল ঈর্ষা করার মতো সুন্দর। দুরমুজের মতো শরীর নিয়ে লোকটি ক্লান্তিহীন কাজ করে যেত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। যখনই সে আমাকে একা পেত, কিছু একটা বলতে চাইত। আমি নিরাবরণ থাকলে লোকটি আড়াল থেকে ঘাপটি মেরে আমাকে দেখার চেষ্টা করত। আমিও লুকিয়ে দেখতাম, সে বারবার আমাকে দেখে ঢোক গিলছে। মনে হত, না জানি লোকটি আমাকে নিয়ে কতকিছু ভাবছে।

তখন বাইরের দু-একটা ছেলের সঙ্গে যে আমার আলাপ ছিল না এমনটাও নয়। মনে মনে আমি পরিচিত কোনো ছেলেকে পছন্দ করতাম অথচ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বাড়ির সেই কাজের লোকটিকেই কল্পনা করতাম। এমনও হত, মাঝরাতে লোকটিকে ভাবতে ভাবতে খুব নিজের ভেতর অপার্থিব কামনা অনুভব করতাম। আমি ঠিক জানি না, এতগুলো পরিচিত মানুষের ভিড়ে লোকটি কী করে আমার কল্পনারাজ্য দখল করত! রাত ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতাম তবু আমি তাকে মন থেকে তাড়াতে পারতাম না। লোকটি বাহ্যিকভাবে অতটা সুদর্শনও ছিল না, তবু কেন জানি না তাকে ভাবতে গেলেই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হত আমার মনের ভেতর। হয়তো আমার পরিচিত ছেলেগুলো সবসময় চোখের সামনে থাকত না, হয়তো সেই লোকটিই ছিল পরিবারের বাইরের কোনো পুরুষ, যে আমাকে লুঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করত। আমি রাতের-পর-রাত অস্থির যাতনায় ক্ষত-বিক্ষত হতাম তবুও তাকে বলার মতো নির্লজ্জ হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

একদিনের কথা মনে পড়ছে আমার। সেদিন সন্ধ্যার পর ঘরদুয়ার, উঠান, ফসলের মাঠ আর দূরের বিস্তৃত বিল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। মনে হল প্রকৃতি বিশাল এক নৈঃশব্দের জাল বিছিয়ে রেখেছে চরাচরে। যেন আমি শুনতে পাচ্ছি অদৃশ্য মানুষদের ফিসফাস আর মৃতদের দীর্ঘশ্বাস। সেটা আমার চিন্তার ভ্রম ছিল কিনা জানি না, দেখলাম মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক পায়রা পাখায় শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। যেন আমি চোখের সামনের বিলটা ছাড়িয়ে, বহু প্রান্তর পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে চলে এসেছি। তখন ওই অস্বাভাবিক মুহূর্তে কেন আমি সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। তখন কোথা থেকে এসে লোকটি আমাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। সে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, সামান্য চ্যাঁচালেই আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আমি ঠিক জানতাম না, লোকটি কতদিন ধরে সেই উপযুক্ত সময়টির জন্য অপেক্ষা করেছিল। তবে একথা সত্যি যে, তার পরিকল্পনা ছিল বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা। লোকটি আমাকে পেছন থেকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাতের আঙুলগুলো টুসটুস করে ফুটাতে লাগল। তারপর আমার বুকের ভেতর নাক ডুবিয়ে শুষে নিল আমার ভেতরকার সবটুকু ঔশর্য।

 

সেই রাতের পর থেকে মাঝেমধ্যেই আমি লোকটির কাছে ধরা দিতাম। সবসময় সে চুপ করে থাকত আর চোরের মতো নিঃশব্দে আমার সবকিছু নিয়ে উধাও হয়ে যেত। লোকটি ধনুকের বাঁকানো ছিলার মতো যখন খুব কাছে এসে আরো ঘনিষ্ট হত, তার খসখসে খড়িওঠা মুখটা অসহ্য লাগত আমার। সে আমাকে খরের গাদা, রান্নাঘরের পেছনে কিংবা বাড়ির সীমানা ভেড়ির আড়ালে নিয়ে যেত, কিন্তু আমি তাকে কখনো না করতে পারতাম না। একসময় আমিও তার মতো বোবা হতে শিখে গেলাম। তার সান্নিধ্য আমাকে মুগ্ধ করত না, তার স্পর্শ আমাকে উতলা করত না একথা সত্য, তবে আমি তাকে কখনো উপেক্ষাও করতে পারতাম না।

 

তাহলে শেষ পর্যন্ত লোকটিকে তুমি বিয়ে করেছিলে? পিনাক মেহেরুন্নেছার কাছে জানতে চাইল।

-না।

-কেন?

 

আমি বহুবার তোমাকে বলেছি, লোকটিকে কখনোই আমি ভালোবাসতাম না। 

-তুমি পরিবারের অবাধ্য হতে পারতে, পালিয়ে যেতে পারতে লোকটির সঙ্গে। আর চাইলে গোপনে বিয়েও করে ফেলতে পারতে। একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যেত নিশ্চয়ই।

মেহেরুন্নেছা শাড়িটা পাল্টে আরেকটা নতুন শাড়ি পরতে পরতে বলল, বলতে পারো সেটা ছিল আমার তারুণ্যের কৌতূহল। সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে রহস্য উন্মোচনে তাড়িয়ে বেড়াত। এমন এক অদৃশ্য মোহে আমি ঘোরগ্রস্ত ছিলাম, তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারতাম না। তবে মাঝেমধ্যে মনে হত, রাতের বোবা লোকটি আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাক। হয়তো একদিন অভ্যাস্ত হয়ে যাবে সে। কারণ সেই সময় লোকটিই ছিল একমাত্র পুরুষ যার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করেছিলাম।

আমি তাকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম, লোকটি রাজিও হয়েছিল তবে শেষ পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে যাইনি।

-তোমার ইচ্ছায় নিশ্চয়ই শততা ছিল না।

সে আমি জানি না। তবে আমার কাছে তখন ওটাই ভালো লাগত, লোকটি মাঝেমাঝে নিঃশব্দে আমার কাছে চোরের মতো আসবে। আমার যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যাবে সে। আমি আবার নতুন করে সঞ্চিত করব তার চুরি করার সম্পদ। কিন্তু তাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো কোনোভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

 পিনাক একটু রহস্য করে বলল- তুমি কি জানো, আমার জীবনের একটি অধ্যায় তোমার সঙ্গে উল্টোভাবে মিলে গেছে। হতে পারে এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার। আমিও একটি মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম।

মেহেরুন্নেছা রান্নাঘর থেকে নুডুলস রেঁধে আনল। সে মাথার চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে পিনাকের মুখোমুখি বসল। চোখে-মুখে বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে বলল, এবার আমি তোমার সেই প্রেমিকার কথা শুনতে চাই।

 

শহরের পশ্চিমপ্রান্তে আলী বাকের লেনের এক বাড়ির দোতলায় আমি ভাড়া থাকতাম। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকত মা-মেয়ের ছোট্ট একটা পরিবার। সংসারের পুরুষ লোকটি বহুদিন ধরে বিদেশে থাকে। কীভাবে আমি যেন পরিবারটির সাথে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট হয়ে পড়লাম। আমি প্রায় প্রতিদিনই পেশাগত কাজে বাইরে থাকতাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে মেয়েটির মা তাদের ঘরে টেনে নিয়ে যেত। যখন ধীরে ধীরে বাইরের লোকগুলোর আনাগোনা কমে যেতে লাগল তখন আমি মা আর মেয়ের সঙ্গে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম। আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করতাম, মেয়েটি কয়েকদিন পর পর বাসা থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। আমি সেই সময়টুকুতে খুব ভয়ের ভেতর কাটাতাম। আমার মনে হত, মেয়েটির মা মধ্যরাতে আমার দরজার কড়া নাড়বে। কারণ আমি তার চোখেমুখে নানান রকমের ইশারা দেখতাম। তবে শেষ পর্যন্ত সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। মেয়েটি চার-পাঁচদিন পর বাসায় ফিরত। একদিন মেয়েটির মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে বলল, একরত্তি মেয়েটি আমার, চার-পাঁচদিন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রসৈকতের হোটেলে থেকে এসেছে।

সেজন্য মেয়েটির মা আশঙ্কা করত যে-কোনো সময় তার মেয়েটি ছেলেদের পৈশাচিক লালসার সূত্রে প্রাণ হারাতে পারে। আমি এসব শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম!

মেয়েটি ছিল কাঠির মতো চিকন। ওর চুলগুলো ছিল মেঘের মতো কালো আর পুরো পিঠজুড়ে চুলগুলো ছড়িয়ে সুন্দরভাবে খেলা করত। তবে আমার সামনে মেয়েটি কখনোই অমার্জিত ছিল না। একদিন মেয়েটির মা আমাকে বিনীতভাবে বলল, আমি যেন তার মেয়েটির সয্যাসঙ্গী হই। আর এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা সে করে রাখবে।

আমি জানি তুমি মেয়েটির মাকে নিয়েই সন্দেহ করেছ। কিন্তুসমাজে লোকচক্ষুর আড়ালে এমন কতকিছুই তো ঘটে, যা আমাদের জানা থাকে না। আমি মেয়েটির মায়ের সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। মেয়েটি ছিল কিশোরীর মতো ছোট আর ওকে দেখলে যে-কেউ বলবে হয়তো ও এখনো হাইস্কুলে পড়ছে। তবে ও ছিল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ওর মন ছিল ফ্যান্টাসিতে ভরা আর প্রতিনিয়ত জামাকাপড়ের মতো বন্ধু বদল করত। কারো জন্য ওর কোনো ভালোবাসা ছিল না। মেয়েটি যাতে দূরদূরান্তে গিয়ে ছেলেদের সাথে কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মৃত্যুর মতো অঘটন না ঘটায়, হয়তো সেজন্যই ওর মা আমাকে এমন অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিল। একমাত্র মেয়ে বলে ওকে ওর মা কোনোভাবেই হারাতে চাইত না।

তারপর থেকে কি নিয়মিত মেয়েটির সঙ্গে বিছানায় যেতে? মেহেরুন্নেছা বলল।

যদি এককথায় বলি, তবে মাঝেমধ্যে একটু বেশি রাত হলেই আমি পেছনের চোরা দরজা দিয়ে মেয়েটির রুমে ঢুকে যেতাম। আমরা কোনো কথা বলতাম না, কোনো উচ্চহাসি বিস্ফোরিত হত না। শুধু যা কিছু হত পুরোটাই পিনপতন নীরবতায়। আমি প্রত্যেক রাতে মেয়েটির মানসিক জোর আর যৌনানুভূতি দেখে আশ্চর্য হতাম।

আমার সংস্পর্শের কারণে কি-না জানি না, অল্পদিনেই মেয়েটির মুখ আর শরীরে নারীত্ব ফুটে উঠল। বর্ষাকালের কলাগাছের মতো মোচড় দিয়ে উঠল ওর শরীর। আমি হয়তো অভ্যাসবশেই ওকে বিয়ে করতে চাইলাম। কিন্তু আমি আশ্চর্য হলাম, দিনের পর দিন এক বিছানায় আমার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থেকেও কী করে ওর মন এত দৃঢ় হতে পারে! ওর বাবা দেশে ফেরার পরপরই পূর্বনির্ধারিত ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেল। আমি অল্প কয়েকদিন পর সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে এসেছিলাম।

কী অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম চোখের সামনে! মেহেরুন্নেছা বলল। আমার ঠিক জানা নেই, কী করে একজন মা তার মেয়েকে কোনো সম্পর্ক ছাড়া একটা ছেলের সঙ্গে বিছানায় যেতে দিতে পারে! মেয়েকে শুদ্ধ করার বা তাকে ঘরবন্দি করে রাখার জন্য নিশ্চয়ই এটা কোনো সঠিক পন্থা হতে পারে না। তবে আফ্রিকার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের ভেতর এমন ঘটনার কথা শুনেছিলাম। আজ তোমার কাছে শুনে মনে হল, পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষের সাথে অন্যপ্রান্তের মানুষের একটা গভীর যোগসূত্র আছে। আর মানুষ তাদের আচরণগুলো কেমন করে যেন হাজার হাজার মাইল দূরের সম্প্রদায়ের কাছে চালান করে দেয়।

 পিনাক মেহেরুন্নেছার জীবনের পরের ঘটনা শুনতে চাইল। মেহেরুন্নেছা হাসতে হাসতে বলল, রাতের খুব একটা বাকি নেই। পিনাক জানালার পর্দা খুলে দেখল, পুলের ওপর মাছ-ব্যাপারীদের সরল যাতায়াত। সে বাসা থেকে বের হয়ে শহরের পথ ধরল। লোহার পুলের হাঁটুর কাছে ছড়ছড় করে জল নামার শব্দে সে শুনতে পেল মেহেরুন্নেছার বর্ণিত সেই পায়রাগুলোর পাখা ঝাপটানির শব্দ।

 

পিনাক প্রথমদিকে শুধু শুক্রবার রাতে মেহেরুন্নেছার সাথে দেখা করতে আসত। তারপর নির্দিষ্ট কোনো দিন ছিল না। যে বয়সেরই হোক না কেন, একজন নারীর সান্নিধ্য তাকে চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছিল। প্রতিরাতেই তারা একসঙ্গে শুত কিন্তু কোনোদিন যে-কোনো জটিলতা দেখিয়ে মিলিত হতে চাইত না মেহেরুন্নেছা। পিনাক পরিস্থিতি সামাল দিতে জানত আর সে শুনতে চাইত মেহেরুন্নেছার গল্পের পরবর্তী অংশ। কিন্তু যেদিন তাদের শরীরে প্রচণ্ড ঝড় উঠত, খুব গল্পে জমে উঠত তারা। মেহেরুন্নেছা একদিন ফুরফুরে মেজাজে বলল-যখন আমার বিয়ে হয়ে গেল, লোকটি সারাদিন কাজকর্ম করল। আমি বেড়ার ফুটো দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো দুঃখবোধের আলামত দেখিনি। সন্ধ্যার পর বরের বাড়ি যাবার সমস্ত প্রস্তুতি শেষে আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ খুঁজলাম। সেই মুহূর্তে লোকটিকে একান্তে পেলে আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো তাকে ছুঁয়ে দিতে বলতাম। কিন্তু এত ব্যস্ততা ছিল আমার, চোখের সামনে তাকে একবারের জন্যও দেখিনি, কারো কাছে জানতেও চাইনি তার কথা। বরযাত্রীর তাড়া থাকায় আমরা দ্রুতই বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সড়কে উঠলাম। আমার পেছনে ফেলে গেলাম একজন চোরকে, যে আমাকে নিত্য চুরি করে আবার ফিরিয়ে দিত। তুমি তাকে নিশিরাতের অদৃশ্য আত্মা বলেও কল্পনা করতে পারো। যেমন অদৃশ্য পুরুষ জিনেরা ঘুমন্ত নারীর সঙ্গে সঙ্গম করে চলে যায়।

সে যা-ই হোক, শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে জানলাম, আমি চলে যাওয়ার পর তাকে আর কেউ দেখেনি। আমি গোপনে তার পরিচিত লোক, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের থেকে খবর নিলাম, কিন্তু কেউ তার কোনো সন্ধান দিতে পারল না। তারপর নতুন জীবনের সমস্ত ব্যস্ততার কারণে সে আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেল। হয়তো লোকটিকে আমি কখনোই ভালোবাসতাম না।

একদিন সন্ধ্যায় আমার স্বামী বলল, এই পৃথিবীটা সবচেয়ে শুদ্ধ আর সুন্দর। যদি এমন হয়, আমাকে তুমি ভালোবাসো না, যদি তুমি অন্য কারো কাছে চলে যেতে চাও তবে বলতে পারো আমাকে। তবে শুদ্ধ আর সুন্দর সম্পর্ককে কদার্য করার কোনো অধিকার তোমার নেই।

আমি তাকে কোনো উত্তর দিলাম না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমার স্বামী লোকটির সম্পর্কে যে-কোনো ইঙ্গিত পেয়েছে। আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এর কিছুদিন পর আমি সন্তানসম্ভবা হলাম, তারপর এসব নিয়ে আমাদের ভেতর কোনো কথা হয়নি।

তাহলে লোকটির সঙ্গে কি তোমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি? পিনাক বলল।

-হুম। হয়েছিল।

মেহেরুন্নেছা জানালার পর্দা খুলে বাইরে তাকিয়ে বলল, চলে যাও এখন। সব কৌতূহল মিটে গেলে তুমি আমার কাছে আবার কেন আসবে? আমি জানি তুমি এখন বলবে, ভালোবাসো আমাকে। তবে সত্যি বলতে কী পিনাক, ভাঁজ পড়া চামড়ায় আর ঢলে পড়া মেয়েলোকের স্তনে সুখের কিছু নেই। এটাই সত্য যে, তোমার মতো যুবকের কাছে এটা শুধুমাত্র না-পাওয়ার ভেতর পাওয়া।

পিনাক দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর  ‍ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। মেহেরুন্নেছার ঘরের পেছনে খালের জলে টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে। অল্প সময় পরই মেহেরুন্নেছার মনে ভিড় করল একাকিত্বের কালো ছায়া। তার শরীরটা নেতিয়ে পড়ল, ঠিক যেমন প্রচণ্ড রোদের সময় রাস্তার পিচগুলো গলে যায়। তার বুক আর পেটে অনুভব করল কাঁকড়ার হাতলের মতো একটা স্পর্শের অনুভূতি। পেটের নিচটা খুব ভারী মনে হতে লাগল আর প্রচণ্ড ক্লান্তি গ্রাস করল তাকে। যেন সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে এইমাত্র সে তীরে এসে পৌঁছেছে। সে বহুদিন পর পরম তৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

চতুর্থ অথবা পঞ্চম সাক্ষাতের রাতে মেহেরুন্নেছা বলল-আসলে অচেনা কারো কাছে প্রয়োজনের বাইরে কোনোকিছু বলার অভ্যাস আমার নেই। তবে এখন আর তুমি দূরের কেউ নও, হয়তো সেই কারণেই তোমাকে ফেলে আসা অতীতের কথা বলছি। পিনাকের হাতের ওপর মেহেরুন্নেছা হাত রেখে বলল- পিনাক, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

-আসলে আমিও তোমাকে হারাতে চাই না যতদিন-না অন্তিম পথে যাত্রা করি।

 -যখন তুমি বিয়ে করবে আর অন্য শহরে চলে যাবে তখন? অথহীর্ন রসিকতা করবে না তুমি। আমি সিরিয়াসলি জানতে চাই।

পিনাক মুখটা বিপন্নভঙ্গি করে বলল, সে আমি এসে পড়ব, লুকিয়ে-চুরিয়ে, মিথ্যে বলে, ছল-চাতুরি করে।

-আমার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়েছে সত্যি কিন্তু আমার শরীরের যা যা কিছু তুমি জানো পুরোটাই সংবেদনশীল। আমি বিশ্বাস করি, তুমি যত দূরেই যাও না কেন আমার কাছে আবার ফিরে আসবে।

পিনাক মেহেরুন্নেছার দিকে সামান্য ঝুঁকে জানতে চাইল-সেই লোকটির সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল কবে?

 

১০

সে এসেছিল প্রায় উনিশ বছর পর, মেহেরুন্নেছা বলল। এক মধ্যদুপুরে আমাদের উঠানে এসে দাঁড়িয়ে সে আমার নাম ধরে ডেকেছিল। তার ঠোঁটদুটো ছিল পানের রসে রক্তিম। সাদা জামায় ছোপ ছোপ লালচে দাগ আর মাথাভরা ঝাকরা চুল। প্রথম দেখায় আমি তাকে চিনতে পারিনি। তার খর্বাকায় শরীর, গোঁফের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া একটা কাটা দাগ তাকে চিনতে সাহায্য করেছিল। তবে তার চাহনিটা ছিল পরিষ্কার, বহুবছর আগের সেই চোরের মতো পিটপিট করে নয়।

আচ্ছা, তাহলে সে চলে গিয়েছিল কেন? পিনাক বলল।

তুমি এটাকে যৌনঈর্ষা বলতে পারো, মেহেরুন্নেছা বলল। কারণ আমার আকস্মিক বিয়ে হওয়াতে লোকটি বিচলিত হয়ে পড়েছিল। বিয়েবাড়ির সমস্ত ব্যস্ততা কমে গেলে মানুষগুলো যখন ঘুমে ঢলে পড়ল, লোকটি তখন হয়তো ভেবেছিল তার ছুঁয়ে-দেখা শরীরটা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সে আফসোস করতে করতে বিলের সেই প্রসারিত পথ ধরে সারারাত হাঁটতে থাকল। তারপর ভোরের লঞ্চ ধরে গিয়েছিল ভোলা জেলার শশীভূষণ। সেখানে বিয়ে’থা করল, মাছ ধরার দল গঠন করল আর দ্রুতই ভাগ্য ফিরল তার। এদিকে আমারও স্বামী মারা গেল। দিনের-পর-দিন আমি একরঙের শাড়ি পরে কাটাতে লাগলাম। ছেলেগুলো স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠল। আর এক নিমিষেই আমার সমস্ত ব্যস্তটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গতা চেপে ধরল আমাকে। শরীরটায় চকচকে মেদ জমা হতে থাকল আর সারাক্ষণ কী সব অদ্ভুত চিন্তায় ডুবে যেতে লাগলাম। আমার কেন যেন বারবার সেই নির্বাক চোর লোকটির কথা মনে পড়ত। স্বামী-মৃত্যুর শোক বহু আগেই পুরনো হয়ে গেছে। আর আমার স্বামী থাকতেও প্রায়ই আমি তার সঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। ছেলেদের প্রতিদিনের রুটিনে এত ব্যস্ত হয়ে পড়তাম, আমার কখনো মনেই হত না আমার কোনো জৈবিক চাহিদা আছে। হয়তো তখন আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না, হয়তো জীবনে একজন পুরুষ ছিল বলেই এমন শূন্যতাবোধ আগে অনুভব করিনি। কিন্তু একথা বলতে দ্বিধা নেই, ওই ব্যস্ততাহীন সময়ে প্রতিরাতে আমি একজন পুরুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতাম। আমার মনে হত, সেই বহুবছর আগেকার রাতগুলোর কথা। একজন নির্বাক চোরের পুরুষোচিত আচরণগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াত। আমার সমস্ত শরীরজুড়ে পুরুষ প্রাপ্তির অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা। আর আমি টের পেতাম সহস্রবছরের জমানো ক্ষুধা। ধীরে ধীরে আমি যুবতী মেয়েদের মতো অস্থির হতে থাকলাম। আমার নির্ঘুম রাতগুলো অনির্ধারিত অপেক্ষায় পার হতে লাগল।

সৃষ্টিকর্তার কী অপার কৃপা আমি জানি না, একদিন বেলা করে ঘুম থেকে জেগে দেখলাম, সেই লোকটি উঠানে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে। যখন আমি তাকে চিনতে পারলাম, স্বপ্নের মতো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুবছর আগের স্মৃতিগুলো। তার চলে যাওয়ার গল্পটা যদিও সময়ের দূরত্বে পুরনো হয়ে গেছে তবুও মন দিয়ে কথাগুলো শুনলাম। আমার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগল, লোকটি কোন্ অদৃশ্য টানে আবার ফিরে এল!

পিনাক জানতে চাইল- আচ্ছা মেহের, বারবার আমার মনের ভেতর এমন এক কৌতূহল তাড়া করে, উত্তরটা তোমার কাছে না জানতে পেরে থাকতে পারছি না। এই বয়সে কেন তুমি আমার সঙ্গে বিছানায় গেলে?

সহজ কথায় বলতে গেলে, কতগুলো দুর্বিষহ রাতের ভয়াবহ নির্জনতা ঘোচানোর জন্য। যে-কোনো একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে সময়টা পার করে দেওয়া আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, কৈশোর পেরুনো একজন যুবকের জান্তব জিঘাংসা আমি উপেভোগ করতে ভালোবাসি। একথা চিরসত্য যে, মানুষ তার জীবনের সুন্দরকে বারবার ফিরে পেতে ভালোবাসে। আমার কাছে যৌনতাই সবচেয়ে সুন্দর। যখন আমি তোমার জীবনে অতীত হয়ে যাব, আমার কবরের মাটি থেকে কচি ঘাস গজিয়ে উঠবে, আমি বিশ্বাস করি, তখন আমার থেকে শুষে নেওয়া সুখটুকু তুমি নস্টালজিকে মনে রাখবে। এটা স্পষ্ট সত্য যে, মানুষ কখনো মৃত্যুর চেয়ে প্রেমকেই বেশি ভালোবাসে। আর আমি বিশ্বাস করি, শরীরই হল প্রেমের সীমাহীন তপ্তি। আমি এটাও জানি, একদিন আমাদের এই বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। যতদিন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনটা না আসে আমি তোমার সঙ্গে এভাবেই থাকতে চাই।

তাহলে তুমি কি লোকটির সঙ্গে আবার বিছানায় গেলে? পিনাক বলল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সে আমার মাথার ভেতর বিষ্ফোরণের মতো ছড়িয়ে ছিল। আমার ছিল প্রচণ্ড কামনার ক্ষুধা। আমার যৌবনটা হয়ে উঠেছিল তীক্ষ্ম ছুরির ফলার মতো ধারালো আর গহীন অন্ধকার। শুধু প্রয়োজন ছিল একজন দক্ষ কারিগরের। যে কি-না আমার ভেতরের গোপন সুতাগুলো কেটে সেখানে প্রবেশ করতে পারে। আমি চাইতাম, কেউ এসে একটা শলাকায় আগুন ধরিয়ে আমার ভেতরের অন্ধকার দূর করে দিক। আমি তাকে পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দারুণ দুর্ভাগ্য আমার, সেই যাত্রায় আমার বড়ছেলের কাছে চাক্ষুষ ধরা পড়লাম। আমি জানি না, এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমার ছেলে কতটা আহত হয়েছিল! দীর্ঘদিন আমি আর আমার ছেলে পরস্পরের মুখোমুখি হওয়া থেকে এড়িয়ে চলতাম। একই ছাদের নিচে থেকেও আমাদের চলাফেরায় ছিল চরম সাবধানতা। ছেলেটা প্রায় সারাদিনই বাইরে কাটাত আর আমি যথাসাধ্য ওকে এড়িয়ে চলতাম।

অনেকদিন পর টেবিলের ওপর আমি একটা চিরকুট পেলাম। আমার ছেলে লিখেছে, যদি তুমি ওই লোকটিকে বিয়ে করতে চাও, তবে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।

কিন্তু আমি তো লোকটিকে একদমই বিয়ে করতে চাইতাম না। আর কেন চাইতাম না, বিষয়টি ছেলের সঙ্গে ব্যাখ্যা করাও সম্ভব ছিল না। আমি ফিরতি চিরকুটে ছেলেকে লিখলাম, আমি একা এবং নিভৃতে থাকতে চাই।

 

১১ 

সেই থেকে আমি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে মায়ের থেকে পাওয়া ওয়ারিশি বাড়িতে উঠলাম। প্রায় মুছে যাওয়া নামফলকে লেখা ‘করুণা খাতুন’ আমার মা। আমি ছেলেদের বাবার ভিটায় আমৃত্যু আর কখনো ফিরে যেতে চাই না।

পিনাক বলল, আমি তোমার নিঃসঙ্গ জীবনের একঘেয়েমিতা কাটনোর রসদ হয়ে গেলাম।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেরুন্নেছা বলল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমার ঘূর্ণায়মান সেই জীবনটা এখন বহু অতীত। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি পিনাক। একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে দিনের-পর-দিন তুমি কোন্ আশায় কথা বলবে! আর যাতে তুমি আশাহত না হও, সেজন্য যতটুকু সুখি করা যায় চেষ্টা করেছি। অনন্ত নিঃসঙ্গ আমি। দোহাই তোমার, আমাকে ছেড়ে যেও না। যদি আমার ঋতুক্রিয়া অব্যাহত থাকত তবে তোমার দেওয়া সন্তান আমার পেটে ধারণ করে সমাজের কাছে নিজেকে কলঙ্কিত করতাম। এ কথা সত্য যে, শুধু ভালোবাসার জন্যই একজন মানুষ সারা পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা উপেক্ষা করতে পারে। আমি জানি না, একথা শোনার পর আমাকে নিয়ে কী ভাবছ তুমি। তবে জেনে রেখো, পৃথিবীতে আমি তোমার সবচেয়ে ভালো শুভাকাঙ্ক্ষী।

পিনাক পেছনে ফিরে জানালার পর্দা খুলে তাকিয়ে দেখল, বাইরের ধূসর আভা জানালার দিকে উঁকি দিচ্ছে। একটু পরেই কাঠের পুলের ওপর শুরু হবে মাছ-ব্যাপারীদের পদযাত্রা। সে যত দ্রুত সম্ভব দরজা খুলে একগলির শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।