কবি ফজলুল হকের কবিতা ভাবনা
মুজিব রাহমান
দিনশেষে আলোর কাছে আমাদের অন্তহীন ঋণ
আত্মার সংবেদে শ্রুত হোক জ্যোতিষ্মান জন্মদিন।
পঞ্চখণ্ডের হয়েও যিনি প্রিয় স্বদেশের কবি, ভুবনগাঁয়ের কবি, সারস্বত বাঙালি সমাজের কবি নিভৃতে যিনি রবীন্দ্র-চিন্তার পরম্পরাকে কাব্যকথায় বুনে চলেছেন, নীরব চিন্তার অনুবাদে যাঁর কবিতার কথা রোদেলা সকালের তাজা ঘ্রাণ নিয়ে শব্দিত, স্পন্দিত তিনি কবি ফজলুল হক। তাঁর চিন্তন শুদ্ধতার মোহন প্রকাশ তাঁর মহিমান্বিত কবিতা। স্বল্পপ্রজ এ লেখকের অর্ধযুগ আগে প্রকাশিত নন্দিত কাব্য “শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে নির্বাসনের দিনে”। এ-কাব্যের আটত্রিশটি কবিতার পাঠ-সঞ্জাত আনন্দ-অভিজ্ঞান কবিকে তাঁর অন্তর্গত পরিচয়ে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট।
এটি আমাদের দুর্ভাগ্য, আজকের পল্লবগ্রাহীতার যুগে মিডিয়া-প্লাবিত অকবিতার সফেন জোয়ারে প্রকৃত কবিতার নন্দন আর বোধের চন্দন-সুরভি অনেকটাই থেকে যাচ্ছে অনাঘ্রাত! উল্লিখিত কাব্যের ‘পাখি’ শিরোনামের কবিতায় কবির শুরুর জিজ্ঞাসায় আমরা উৎকর্ণ হয়ে উঠি, শেষের জিজ্ঞাসায় আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকি: পাখি আর ডাকে নাকি? বরং নিজেই আজকাল ডেকে ডেকে বলি, থামাও এইসব ডাকাডাকি। এই ঘরহীন-ছায়াহীন শব্দের সংসারে এখন গান ঢেকে যায় ছবির আড়ালে যেরকম ঘাসফুলে ছায়া পড়ে জলডুমুরের। লক্ষণীয়, কী অমোঘ উচ্চারণে শেষ হচ্ছে কবিতাটি: দূরে সরে যাওয়া ভালো। পাখি তাই উড়ে উড়ে দূরে সরে যায় অবাক দাঁড়িয়ে থাকি, দু-চোখ পাথর করে তৃষ্ণার জল-জংলায় দেখি, আবারও কি ক্লান্ত কোনো ডাক শুনি নাকি? বাংলাদেশী হিংস্রতার কথা, মেঘের নিয়তির কথা, জন্ম ও মৃত্যুর কথা, ঝড়ের মতো নেমে আসা প্রত্যাখানের কথা, সূর্যাস্তের শেষদৃশ্যকল্প না দেখা পর্যন্ত দৌড় জারি রাখার কথা, হাওয়ার অশেষ শুশ্রুষায় চারাগাছ বেড়ে উঠার কথা, সমস্ত বিপত্তি সত্ত্বেও দারিদ্র্য উজিয়ে কণ্ঠভরা গান নিয়ে পরাণ মাঝির মৃত্যু অতিক্রম করে ছেলের খেয়া পারাপারের কথা, সর্বোপরি ধর্মাধর্মের কথা কী অসামান্য শৈল্পিক সুষমায় বাঙ্ময় হয়ে আছে তাঁর কবিতার আত্মায়, অবয়বে – সমস্ত সত্তাজুড়ে। ধর্মাধর্ম কবিতার শেষের স্তবক পড়ে নেয়া যাক: “পথের দু’পাশে ধর্মের ভীড় ডাকিনীর চোখে কার একটু দূরেই অপমৃত্যু ধর্মহীন শুধুই অন্ধকার।” সমস্ত প্রতিকূলতা প্রতিহত করে কবির কবিতা আজ সংকেতে স্বয়ংপ্রভ: “জাতকের পদচিহ্ন মায়ারেখা আজও সত্য মহাকালমন্দিরের আঙিনায় হয়তো নৃত্যগীত হবে আসন্ন বসন্তে।” কবি ফজলুল হকের “আত্মদীপ” কবিতার প্রথম ও শেষাংশ পড়া যেতে পারে: এমনিতেই গা-খোলা হাঁটতে-হাঁটতে এতদূর আসা গা-খোলার অনেক সুবিধা, গা-ভাসানো যায় বরং গায়ে যে ময়লা নেই, তা চেঁচিয়ে বলে ফেলা যায়।
গ্রহণলাগা চোখগুলো চেনা যায় খুব সহজেই আগুনে-পোড়া মুখ, বুকের ধুকপুুক্ ধরা যায় খালি হাতে … কোনো দূরকল্প, চেনা ইচ্ছা, কোনো ক্ষতির কথা মনে থাকে না গা-খোলার সুবিধাই আলাদা। এই যে এখনও অবশ আঙুলে অবশিষ্ট বল্কলের গিঁট ধরে অগোচর ধ্যান ভেজা দুপুরের ডানা গলায় জড়িয়ে ছ-ফোঁটা বৃষ্টির ধারে কাছে বসে। এই তো কবি ফজলুল হক। মানবিকতার জয় আজও কতো কতো ক্ষতে ভরা।তাঁর কবিতার বহুকৌণিক উজ্জ্বলতা ধরে আছে এই ভাঙা-গড়া আর হার-জিতের কাব্যিক উপাখ্যান।
হীরকপ্রতিম অজস্র পঙ্ ক্তিতে ভরা তাঁর কাব্যের আপাদমস্তক। তাঁর ‘এই অগ্নি জেগে থাক’ কবিতা থেকে চকিতে পড়ে নেয়া যায়: টানাপড়েনের মাঝখানে তাই, এটুকুই সংসার দেশগাঁয়ে আজ তোমার বার্তা নিতান্ত প্রাঞ্জল সব তৃষ্ণার শুষে নিয়ে এই অগ্নি জেগে থাক্ অনন্তর প্রজন্ম চত্বর যে নীরব, তাকে কোন্ মূল্যবোধ দিয়ে মুখরতা দান করি? ভাষার পালক থেকে ক্রমশ আকাশ ঝরে যায় তুমি বলেছিলে জয় হবে জয় হবে… ইতিহাস আর আশাবাদ তাঁর কবিতায় হাত ধরাধরি করে চলে। ব্যক্তি জীবনে যেমন জাতীয় জীবনেও ঘটবে কাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয়। তাঁর ‘পথরেখা’ শীর্ষক কবিতায়উচ্চারণে ধ্বনিত : “ঠিক সময়েই ঋতুর চাকা ঘুরে যাবে অর্জিত ভোরের আলোয়।” কবির কবিতা আজ বিশ্বপরিভ্রমণরত। অনূদিত হচ্ছে নানান ভাষায়। বাংলা ভাষার কবিতার এ পরিভ্রমণ নন্দিত হোক সর্বত্র।
মুজিব রাহমান কবি, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ