You are currently viewing কবিতার দৃশ্যমান,কবিতার দৃশ্যাতীত> ঋতো আহমেদ

কবিতার দৃশ্যমান,কবিতার দৃশ্যাতীত> ঋতো আহমেদ

কবিতার দৃশ্যমান,কবিতার দৃশ্যাতীত
ঋতো আহমেদ
 
কবিও কি দৃশ্যমান এবং দৃশ্যাতীত দুটোকেই একই সঙ্গে ধরতে চান তাঁর কবিতায়? হ্যাঁ, কোনও কোনও কবির কবিতা পাঠ করতে গিয়ে কবিরওই আকুলতাটুকু স্পর্শ করে ফেলতে পারি আমরা, সামান্য হলেও। বুঝতে পারি কবিতায় ভাষার যে সীমা, তাকে শব্দপ্রবাহের মাধ্যমে সুর দিয়ে ছন্দ দিয়ে অতিক্রম করে যেতে চান তিনি। অধরা পরম সত্যকে ছুঁয়ে ফেলবার এক ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা তাঁকে তাড়িত কোরে জীবনবোধের এমনই এক অঞ্চলে পৌঁছে দেয়, যেখানে তিনি বারবার নিজেকে পরখ করে নিতে চান। যেতে চান স্বকীয় চর্চা-পদ্ধতিরই ভেতর দিয়ে। ‘গম্যমান শরীর, প্রবহমান ভাব, পরিবর্তমান অবস্থা তাঁহার কবিতার বিষয়।’ আপন শৈলীতে কখনও তিনি গঠন আর রঙে রাঙিয়ে দেন জগত্, আবার কখনও শব্দের ঝংকারে তোলেন সময়ের উদাত্ত উচ্চারণ।আর, প্রথম থেকেই বোধের দিগন্ত পর্যন্ত ধীরে ধীরে উন্মোচন করতে থাকেন নিজেকে। সময়ের সীমাকে ভেঙে স্থবির অতীত, গতিময় বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যৎকে জুড়ে দেন একই সুতোয়। পাঠককে ঠেলে দেন আদ্যন্তহীন এক আশ্চর্য সময়প্রবাহের মধ্যে। ভাষার অভ্যন্তরীণ কোনও বিন্যাসে। যার অতল ঘূর্ণির ভেতর ঘুরতে ঘুরতে কেবলই মনে হয় আমাদের কবিতা প্রকৃতপক্ষে অন্তহীন। যেখানে শুধুই ছুঁয়ে ফেলতে চাই আমরা অপ্রত্যাশিত সেই বাস্তবকে। যা আমাদের জীবন সম্পর্কিত জটিল সব প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু পুরোপুরি কিছুতেই তাকে ধরতে পারি না। কী এক মধুর অতৃপ্তির অনুভব এসে গ্রাস করে! আস্তে আস্তে আমাদের আত্মমুখচ্ছবির অন্বেষণ তখন গূঢ়তর হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে সমষ্টিগতও।— মাসুদ খান। আমাদের এই সময়ের একজন বড় কবি, নিঃসন্দেহে। পঠিত হতে হতেই তাঁর কবিতার ছায়া, তাঁর শিল্পপ্রতিকৃতি স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তায় মানুষেরই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে যায়।ভর করে তাঁর নিজেরই উপর। আর, অধীর এক আশা বয়ে যায় আমাদের রক্তস্রোতে। আমরা পড়তে পারি—
 
 
তোমরা কারা? কতদূর থেকে এলে?
মনোহরপুর? মধুপ্রস্থ? লীলাস্থলী? অবাকনগর?
কোন যুগেরই-বা তোমরা?
উপলীয়? তাম্র? প্রত্ন? নাকি নুহের আমল?
যে যেখান থেকে যে যুগ থেকেই আসো-না-কেন
একই জাহাজের যাত্রী আমরা এ অকূল মহাকাশে।
সহযাত্রী, এবং সমবয়সী।
তোমাদের বয়স প্রায় চৌদ্দ শ কোটি বছর, আমাদেরও তা-ই।
যে-যে কণিকায় গড়া দেহ তোমাদের, আমাদেরও তা-ই—
সব উদ্ভব ওই মহাবিস্ফোরণের ক্ষণে।
অমরতা চাও? চাও অন্তহীন পরমায়ু?
বিলাপ থামাও, শোনো, আমরা যে যখনই আসি
অমরতা নিয়েই আসি হে অমৃতের সন্তান—
অলুক অব্যয় অনশ্বর চির-আয়ুষ্মান।
জরা ব্যাধি মন্বন্তর মহামারি অনাহার অত্যাচার গুম খুন দুর্বিপাক দুর্ঘটনা
কোনো কিছুতেই হবে না কিছুই, ধস নেই, মৃত্যু নেই,
ক্ষয়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া নেই
শুধু বয়ে চলা আছে, রূপ থেকে রূপান্তরে,
রূপক থেকে ক্রমশ রূপকথায়…
জলে স্থলে মহাশূন্যে অগ্নিকুণ্ডে…কোত্থাও মরণ নাই তোর কোনোকালে…
সাড়ে চার শ কোটি বছরের পুরনো এক সজল সবুজ
কমলা আকারের মহাকাশযানে চড়ে
চলেছি সবাই এক অনন্ত সফরে।
 
[অলুক, অনশ্বর/ঊর্মিকুমার ঘাটে]
 
 
আর পড়তে পড়তেই স্থান এবং কালের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় আমাদের চেতনা।‘তোমরা কারা? কতদূর থেকে এলে?’ এই জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই প্রসারিত হয় আমাদের মন ও মনন-দৃষ্টি। মুহূর্তেই ঘুরে আসতে পারি মনোহরপুর, মধুপ্রস্থ, লীলাস্থলী আর অবাকনগর। ঘুরে আসি উপলীয়, তাম্র, প্রত্ন আর নূহের আমল। বুঝতে পারি মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কিনা একই সাথে কালে এবং মহাকালে বাস করার ক্ষমতা রাখে। ক্ষমতা রাখে বিশ্বে এবং মহাবিশ্বে বসবাসেরও। একই জাহাজের যাত্রী আমরা অকূল মহাকাশে। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ মিলে একটাই মাত্র সময় আমাদের। পৃথিবী নামক নীল এই গ্রহে, এই জাহাজে আমরা সবাই একে অপরের সহযাত্রী। আমাদের যাত্রাপথ মহাকাশ। চৌদ্দ শ কোটি বছর ধরে চলছে এই জাহাজ। অনন্তের যাত্রায়। কিন্তু কেমন এই অনন্ত? ধারণা করতে পারি কি? ক’দিন আগেইযে দেখেছি জেমস ওয়েভের কিছু ছবি। প্রকাশ করেছিল নাসা। যার সুবাদে সাড়ে তের শ কোটি বছর আগের দৃশ্য দেখতে পেলাম। এতো দূর তার অবস্থান যে এতো এতো আলোকবর্ষ সময় লেগে গেছে আলো এসে পৌঁছাতে আমাদের দ্বারে। আমাদের গ্যালাক্সি থেকে দূরে, বহু বহু দূর। আবার, আমাদের গ্যালাক্সিতেই আছে সূর্যের চেয়েও বহুগুণে বড় কোটি কোটি তারকা। নীহারিকা। মাঝখানে ভয়ংকর এক কৃষ্ণবিবর। এইরকমই কাছাকাছি অবস্থান করা অসংখ্য গ্যালাক্সি মিলে হয়ে আছে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার। অগুনিত ক্লাস্টার মিলে আমাদের ইউনিভার্স। আর অসংখ্য ইউনিভার্স নিয়ে মাল্টিভার্স। এমনই আমাদের অকূল-মহাকাশ-ধারণা! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না আমাদের। ধস নেই, মৃত্যু নেই, ক্ষয়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া নেই। আছে কেবল বয়ে চলা। রূপ থেকে রূপান্তর। রূপক থেকে ক্রমশ রূপকথায়…
আমাদের কবিতাও কি তাই?
‘কবিতা কি চিরকালীন হতে পারে? সময়ের বাঁধাকে টপকে ভবিষ্যতেও পৃথিবীর যে কোনও দেশের মাটিতে দাঁড়াতে পারে কবিতা? বলতে পারে চিরকালের মানুষের কথা?’ হ্যাঁ, পড়তে পড়তেই আমরা জেনেছি, কবিতাতে থাকতে পারে স্মৃতি, থাকতে পারে বর্তমান, আর এই স্মৃতি ও সত্তা দিয়ে তৈরি হতে পারে ভবিষ্যৎ। যদিও তা আমাদের অজানা অধরা। কবিতা কথা বলে সম্ভাব্যতার। নিশ্চিত কথা সে বলে না। দর্শনের বিমূর্ততায় নয়, কবিতাকে উত্তীর্ণ হতে হয় মূর্ততার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিতে। এইরকমই জানছিলাম সেদিন আমরা কবি ফাল্গুনী ঘোষের ‘কবিতা ভাবনা’ পড়ে। কবিতা—আমাদের এই কবিতাটির [অলুক, অনশ্বর] মতোই মহৎ জীবনবোধে উন্নীত করে। আমাদেরকে ভাবনায় জারিত করে বিজ্ঞান, কল্পনা আর অনুভূতির বোধ। জারিত হয় জরা ব্যাধি মন্বন্তর। অনাহার অত্যাচার গুম খুনের মতো প্রাত্যহিক জীবনের দুর্বিপাক দুর্ঘটনাও। কবিতা—এমনই। অলুক অব্যয় অনশ্বর একাত্মতার বোধে আচ্ছন্ন করে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারি আমরা‘যে-যে কণিকায় গড়া তোমাদের দেহ, আমাদেরও তাই।’ আমাদের আয়ু অন্তহীন পরমায়ু। অনুভব করতে পারি কবিতার মহৎ আবেদন ও বিশ্বমুখীনতা। কবিতা আমাদের আত্মিকতার কথা বলে। সংবেদনশীল বোধের বোধায়ন সেখানে অস্থিতে মজ্জাতে রক্তের প্রবাহের সাথে অনুভূত হতে থাকে।
আবার, এমনও প্রশ্ন আসে মনে, কেন লিখতে হয় তাহলে কবিতা? কবিতা রচনার মানে কি?‘ বস্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে কর্কশ একঘেঁয়েমী, অন্তহীন ক্লিন্নতা, তার থেকে, তার নিষ্ঠুর নখর থেকে মননের ভেতর যে নান্দনিক দিক, রস ও অমৃত বেঁচে আছে তা দিয়ে একটি সুন্দর পদ্মফুলের মতো সৃষ্টি ও নির্মাণকে বাঁচিয়ে রাখা?’অন্তর্গত মুক্তিবাসনার অবিশ্বাস্য আগুন উদ্বোধিত করতেই কি তবে লেখেন কোনও কবি কবিতা? ‘একজন দার্শনিক যেমন সত্য উদ্ঘাটনের জন্য খুঁজে বেড়ান পৃথিবী থেকে পৃথিবীর বাইরের বিভিন্ন ঘটনার, কিন্ত তাঁর প্রকাশভঙ্গি হয় বিমূর্ত। তেমনি একজন কবি সেই বিমূর্তকে যথাক্রমে মূর্ত করে তোলেন জাগতিক বা পরাজাগতিক, বাস্তবিক বা পরাবাস্তবিক ভাবনা ও চিন্তার বোধায়নে।’ কবিতার মানে তবে তো বিশেষ রসসৃষ্টির মাধ্যমে এক-একটি সত্যের উন্মোচন আর বৃহৎ স্বপ্নের নির্মাণও। আর, কবিতার দৃশ্যাতীত সেইসব সত্য, আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতার সত্য। আমরা যেই সত্যকে জানতে পেরে আশ্চর্য হই, অভিভূত হই।
কিন্তু কবিতার অর্থ ভেদ করতে চাওয়া কতোটা প্রয়োজনীয় কবিতার পাঠে? এলিয়ট বলেছিলেন, কবিতা অর্ধেক বোঝা গেলেই সেটি ভালো বোঝা হয়ে গেল বুঝতে হবে। বারবার পড়ে, আস্তে আস্তে কবিতাকে বুঝে নিতে হয় অনুভব দিয়ে, কিছুটা বুদ্ধি দিয়ে, বোধ দিয়ে আর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে যে অভিজ্ঞান তৈরি হয় তাই দিয়ে। সচেতনভাবে কবিতার অর্থ ভেদ করতে চাওয়াটা বোকামি। তাতে কাব্যিক স্পর্শ পাওয়া যায় না। কবিতাকে ঠিক ঠিক ধরাও যায় না। পড়তে পড়তে আপনি এসে ধরা দেবে সে; এমনই কবিতা। বিচারের কাঠগড়ায় তুলে কবিতাকে পাঠ হয় না। সেটা করেন সমালোচক। পাঠক নন। একজন পাঠক যখন কবিতা পড়েন তখন সেটা নিজের করেই পড়েন। কবিতা-লেখকের কথা ভেবে পড়েন না। আর পড়লে সেটা—সেই পাঠের পদ্ধতিটা হয়ে যায় ভুল। আবার আমরা জেনেছি, পাউল সেলান মনে করতেন কবিতা হবে অপ্রত্যাশিত, অনির্দেশ্য এবং অপূর্ব নির্ধারণযোগ্য। অনেকটা বোতলে বার্তা ভরে সমুদ্রে ছুঁড়ে দেয়ার মতো। কেউ খুঁজে পাবেনা কোনওদিন অথবা পাবে হয়তো। তাই, পাঠককে খুঁজতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে কবিতার দিকে। কবিতা অনেক সময়েই গূঢ়ার্থে দুরূহ। আবার এও ঠিক যে দুর্বোধ্যতা কখনও ভালো কবিতা বা মহৎ কবিতার দ্যোতক হতে পারে না। কবিতা যখন বোধজাত হয়ে ওঠে, তখনই তা বেঁচে থাকে পাঠকের চেতনায়। তখনই তা মহৎ হয়ে ওঠে। গভীরতম আত্ম থেকে উৎসারিত হয় বিশ্বাত্মার দিকে।
 
 
বাতাসে ভাসিয়া যায় প্রচুর ব্যঞ্জনধ্বনি, ঘ্রাণ, আর
প্রলাপবিলাপবিকিরণ, নিরুদ্ধার, যুগের যুগের।
লণ্ঠনটা তুলে ধরো হে চারণপুত্র, দ্যাখো
আজ ভাষা ভেসে যায় ঘন গাঢ় সন্ধ্যা—, অপর কালের।
ভাষা পাঠোদ্ধারহীনযায়, ব্যাসকূটসহ,
ধরো খপ করে চঞ্চুক্ষেপে একে একে
আলো ফেলে, লালা ফেলে, করো দেখি অর্থভেদ এইবার।
ও চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায় যায়…
মন্দ গাইছে লোকে দিকে দিকে পুনর্বার
চিমনি চিরে যায় আজ এ-উন্মার্গ জলের ছিটায়
লোকের সকল মন্দ সুগন্ধ চন্দনচূর্ণ করে বলো—
এ-ই মাখিলাম এই অখণ্ডমণ্ডলে।
ও চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায় যায়
চিমনি চিড় খায় আজ এ-উন্মার্গ জলের ছিটায়
চিমনি চিরে যায় আজ দিকচক্রবাল থেকে
তেড়ে আসা অভিশাপে, ভর্ৎসনায়।
 
[চেরাগজন্ম/পাখিতীর্থদিনে]
 
 
‘বাতাসে ভাসিয়া যায়’পড়তে পড়তেকবিতার দৃশ্যমান (ইন্দ্রিয় স্পর্শমান) এই চিত্রকল্পটি অদ্ভুতভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে থাকে তার দৃশ্যাতীত অনুষঙ্গে আমাদের বোধে ও বুদ্ধিতে যখন আরও পড়ি— ব্যঞ্জনধ্বনি, ঘ্রাণ, প্রলাপবিলাপবিকিরণ।যেখানে ব্যঞ্জনধ্বনি/ঘ্রাণ বাতাসে ভাসে,যেখানে প্রলাপ/বিলাপ যেন আলোকরশ্মির মতো বিকিরিত হয় আমাদের মনোশ্চোখের সামনেই। একপ্রকার উদ্দীপিত বাস্তবতার জগত্‌ খুলে যায়। ঠিক তার পরপরই ‘নিরুদ্ধার’ শব্দটি বোসে কেবল একটা শব্দ থাকে না সে আর, একটা কথা একটা চেষ্টার ব্যর্থতার গল্প বোলে ফ্যালে। একটা আকুতি। আর তারপর ‘যুগের যুগের’ কথাটি সময়প্রবাহে যুক্ত করে ঘটনাটিকে সময়চেতনায় দূর-আগত করে তোলে। একটা ছোট চিত্রকল্প মুহূর্তেই কাল প্রবাহের বড় ক্যানভাস পেয়ে যায়। কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে শুরুতেই চেতনার বিশ্বজনীন ক্ষুৎকাতরতায় আচ্ছন্ন হন পাঠক। সংবেদী হয়ে ওঠেন। একবারেই পুরোটা ধরতে না পারলেও কবিতাটি তার এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাঠকের চেতনায় নিশ্চিত জায়গা করে নেয়। গেঁথে যায় অন্তঃস্থলে। পাঠের পর পাঠে হৃদয়-রক্তের ক্ষরণে উন্মোচিতও হতে থাকে পাঠক-মনন-ঘর। লাভ করা যায় একটা বোধিয় ব্যাপ্তির অনুভব।
স্ট্যানলি ক্যুনিৎস একবার বলেছিলেন, “তোমাকে নিজের গভীরে নামতে হবে, সত্যিকারের গভীরতায়, আর তারপর সেখান থেকে তোমার নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা অন্য কারও দেখানো পথ হলে হবে না। শুধুমাত্র তোমারই হতে হবে।”একেক জন কবি সেইরকমই একেকটা পথ তৈরি করেন। পাঠক সেইসব পথে হাঁটতে থাকেন আর বুঝতে পারেন কেবলমাত্র একটি নির্মাণ বা সুন্দরভাবে গঠিত কিছু পঙ্ক্তি নয়, কবিতা বরং এমন একটাকিছু, যাকে বলা যায় নির্মিতি, কিংবা চলমান সৃষ্টি। সে নিজে এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যেখান থেকে নিজেই নিজেকে পুনঃসৃষ্টি করতে পারে। জন ব্যারিম্যান বলেছেন, ‘কেবল অলঙ্কার নয়, জীবনের সাথে, যেভাবে আমরা যাপন করি এই জীবন, তার সাথে, কবিতা গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে নিজেই।’হ্যাঁ, ‘হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন; কিন্তু সেই উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদ্ঘাটিত হল তা যে-কোনও জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্যের রূপে, আমাদের কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে।’
 
The poet has, not a ‘personality’ to express, but a particular medium, which is only a medium and not a personality, in which impressions and experiences combine in peculiar and unexpected ways.[TS Eliot]
 
কবিতায় হৃদয় ও আত্মার প্রগাঢ় অনুভূত ধ্বনি আর অনিবার্য আকুতি বৃষ্টির জলের মতোই স্বচ্ছ ও সুন্দর। সেখানে আত্মিক সত্তায় বিলীয়মান উপলব্ধির রয়েছে আশ্চর্য উন্মোচন। ‘চিমনি চিরে যায় আজ দিকচক্রবাল থেকে/তেড়ে আসা অভিশাপে, ভর্ত্সনায়।’ জাগতিক জীবনের মুহূর্তের ব্যর্থ মানুষ তার আত্মার আশ্রয় খুঁজে পায় এই কবিতায়। ‘এ-ই মাখিলাম এই অখণ্ডমণ্ডলে।’এমনই বেদনার বোধায়নে মনোজগতের অতল কম্পনটুকুও প্রলাপবিলাপ হয়ে উচ্চারিত হয়। যার অভিমুখ নঞর্থক মনে হলেও তা ক্রমশ হয়ে ওঠে চিরসময়ের সঞ্চরণশীলতায় প্রচ্ছন্ন। ‘ও চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায় যায়…’। অপারগতায় শাপগ্রস্থ দিনের ব্যর্থতার বোধে চূর্ণ হয়, চিড় খায় উন্মার্গ জলের ছিটায়।
কবিতার জগত্‌ রহস্য ও বিস্ময়-জাগানিয়া প্রপঞ্চের জগত্‌। মাসুদ খান তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বলেন, কবিতা-অরন্য হলো সেই রহস্যমেদুর রেইন ফরেস্ট, যেখান থেকে অক্সিজেন নেয় বহু-বহু বিষণ্ণ ফুসফুস আর ত্যাগ করে খেদ ও নির্বেদ, গ্লানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড, এমনকি কখনও কখনও মনোক্সাইডও। আর সেই বৃষ্টিবন ওইসব বিষ ও বিষাদকে ফের রূপান্তরিত করে ফেলে দ্রুত অম্লজানে। কবিতার রয়েছে সেই অভিনব সালোক-সংশ্লেষণী ক্ষমতা।
কীভাবে জন্ম হয় তাহলে কবিতার? বলেন, ভাষাকে চিরে-ফেড়ে, বিশৃঙ্খল করে দিয়ে, নেমে আসে কবিতা। ভাষার ভিতরে ঘটিয়ে দেওয়া এক তুমুল রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে কবিতা। ভাষার এক শুদ্ধসৎ আরতিকতার ফসল কবিতা।
 
 
ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি হয়, বিম্ব দিলে প্রতিবিম্ব।
সব মনে রেখেছে আয়নাটি।
যা কিছু সামনে দিয়ে গেছে
যত অঙ্গভঙ্গি অট্টহাসি নাচমুদ্রা দাগ দেহসাজ
দুর্বিনয় দুশ্চিন্তা ভ্রুকুটি—
স্তরে স্তরে সঞ্চয়ে রেখেছে সব
কাচ আর পারদের ঘন আসঞ্জনে
আয়ত আরশির কোটি-কোটি জীবন্ত প্রতিফলনকোষ।
প্রতিটি দাগ ও বিম্ব,
যা তুমি দিয়েছ এতকাল আয়নাকে হে খেয়ালি মানুষ,
স্মৃতি থেকে একযোগে ফিরিয়ে দেবে সে একদিন
প্রত্যেকটি ধ্বনিভঙ্গিসহ।
প্রতিবিম্ব শুধু নয়, প্রতিশোধ আর প্রত্যাঘাত আকারেও।
[প্রতিশোধ/দুঃস্বপ্নের মধ্যপর্ব]
 
 
প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষের জগত্‌, কিংবা দৃশ্যমান এবং দৃশ্যাতীত বাস্তব। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থান ও কালের অবস্থান থেকে প্রবহমান অন্তর্মুখীনতায় মাসুদ খানের কবিতা এমনই এক মহাজাগতিক ব্যাপ্তির আলো-অন্ধকার ও বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবীয় অনুভব ও বোধের অন্তঃসংযোগ ঘটায়, যা বিকশিত করে ভিন্নমাত্রিক চেতনার স্বপ্নতাড়িত বহুরৈখিকতা। যেখানে অফুরন্ত জীবনপিপাসায় আক্রান্ত হতে পারেন পাঠক। মিলিয়ে নিতে পারেন তার জীবনজিজ্ঞাসা, কবিতার একেকটি অর্থ পেরিয়ে-যাওয়া আশ্চর্য সংবেদের সঙ্গে। আবার, কবিতার গুরুত্বপূর্ণ দিক বলতে মাসুদ খান আমাদের বলেন,কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, যে-শব্দনিচয় একটি জনগোষ্ঠীর ভাষার অন্তর্গত, যে-ভাষা ফের যৌথের সম্পদ। আর কবিতা কারবার করে ভাষার সবচেয়ে সূক্ষ্‌ন, সংবেদনশীল, স্থিতিস্থাপক ও সৃষ্টিউন্মুখ দিকগুলো নিয়ে। .. ভাষার বিভিন্ন সুপ্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিচিত্র ধারায় উন্মোচন করে করে এগিয়ে চলে কবিতা।
 
 
এই বিশ্বে কোথাও কি অন্তরালে পড়ে আছে
একখণ্ড অভিমানী চুম্বক, যা থেকে
ক্রমাগত উৎসারিত অগণ্য বাৎসল্য-বলরেখা,
অপত্য স্নেহপ্রবাহ, মেরু থেকে মেরু অভিমুখে?
এই ধীর সন্ধ্যামালতীয় সন্ধ্যা, মাথার ওপরে ওই স্বতঃস্ফূর্ত জ্বলজ্বলে নক্ষত্রসিঁথি,
প্রকৃতির অবিরাম প্লাগ অ্যান্ড প্লে-র লীলা,
মানুষের অন্তর্গত মাধ্যাকর্ষ, কম্পাস-কাঁটায় তার কাঁপা-কাঁপা দিগদর্শন…
সকল বাস্তবতাই মূলত সে-চুম্বকের বাস্তবতা।
তবে
চুম্বকে যে কেবল চুম্বনটানই সত্য, তা তো নয়,
বিকর্ষণও সত্য।
তা ছাড়া দুর্ব্যবহারে যে-কোনো চুম্বক
নিমেষে হারায় তার অবাক ঈশিত্ব।
[চুম্বক]
‘পোয়েট্রি ইজ দ্য সুপ্রিম ইউজ অব ল্যাংগুয়েজ।’
 
 
ঋতো আহমেদ
০৬.০৯.২০২২; উত্তরা, ঢাকা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শঙ্খ ঘোষ, ফাল্গুনী ঘোষ।