You are currently viewing এক অলোকরঙা বিকেল- মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের সাথে কিছুক্ষণ> লিপি নাসরিন 

এক অলোকরঙা বিকেল- মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের সাথে কিছুক্ষণ> লিপি নাসরিন 

এক অলোকরঙা বিকেল

মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের সাথে কিছুক্ষণ।

লিপি নাসরিন 

  বাইশ ডিসেম্বর তামবারাম এয়ারপোর্ট থেকে যখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এয়ারপোর্টে নামলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। মনের মধ্যে দোলা দিচ্ছে ভাবনা দেখা হবে তো যদিও আগের দিন ফোন করেছি তবুও। কিন্তু দেখা না করে ফিরবো না তাতে যদি আমাকে আরো দুদিন কোলকাতা থাকতে হয় তো হবে। মাত্র আড়াই ঘণ্টার আকাশ ভ্রমণে মাথা কেমন ঝিমঝিম করছিল। আমাদের সফরসঙ্গী সুরাইয়ার অবস্থাও তদ্রূপ। সুরাইয়াকে বলে রেখেছিলাম কোলকাতা ফিরে আমাকে সঙ্গ দিতে হবে। চেন্নাই থেকে ফিরে কোলকাতায় আরো একদিন থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের দুজনকে দেখা। কারণ চেন্নাই যাবার  আগে কোলকাতা দুদিন ছিলাম কিন্তু সময় করতে পারিনি। যা হোক দমদম থেকে হোটেলে ফিরে স্নানাহার সেরে দুই বোনঝিসহ নিউমার্কেট এলাকায় ঘোরাঘুরি করলাম। বিকেল সাড়ে চারটেয় আমার যাবার কথা আমি বলেছিলাম ও বাড়ির কেয়ার টেকারের সাথে আলাপে, বস্তুত তাঁর সাথেই আমার কথা হয়েছিল ফোনে বেশি কারণ মীনাক্ষীদির নম্বরে কল দিলে তিনি রিসিভ করেছিলেন এবং দিদিকে দিয়েছিলেন। মীনাক্ষীদির সাথে কথা বলে কেবল সময়টা ঠিক করে নিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে আড়াইটা বাজলো। গুগল করে দেখে নিলাম যেখানে আছি সেখান থেকে যোধপুর পার্ক কতোদূর। আমি আর সুরাইয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্যভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলাম। আশেপাশের দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করলাম কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে। আমাদের গন্তব্য যোধপুর পার্ক ৩৮৭। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালাম কিন্তু সে যা ভাড়া চাইলো তাতে আমার পোষালো না। দাঁড়িয়ে যখন অপেক্ষা করছি অন্য একটা ট্যাক্সির জন্য ঠিক তখন এক অটো চালক  অটো থামিয়ে জানতে চাইলো কোথায় যাবো। আমাদের গন্তব্য বলতেই বললো, অটোতে উঠুন আমি আপনাদের পার্ক স্ট্রিট নামিয়ে গড়িয়াহাটের অটোতে তুলে দেবো। গড়িয়াহাট থেকে সরাসরি যোধপুর চলে যাবেন। সেই ভালো। অটোতে আরেকজন যাত্রী ছিলেন তিনি মোটামুটি আমাদের পথ নির্দেশ করে দিলেন এবং অটো চালককে বলে দিলেন যেন আমাদের আরেক অটোতে তুলে দেয়। অটো চালক বললো, ট্যাক্সিতে অনেক ভাড়া নেবে কিন্তু অটোতে কম খরচায় যেতে পারবেন। তার কথাই ঠিক যাবার সময় যে অল্প পয়সায় দুজন গেলাম, ফেরার সময় ট্যাক্সিতে তার চারগুণ  পয়সা গুনলাম। সেদিন কুয়াশামাখা ঝাপসা আলো ছিলো তাই তিনটা বাজতে না বাজতে  কোলকাতার রাস্তাঘাট যেন অস্তগামী সূর্যের বিদায় অভিবাদন নিতে তৎপর হলো।  আমি আর সুরাইয়া দুপাশে সবকিছু দেখতে দেখতে এক অচেনা ঠিকানায় চলছিলাম তবে, মনের মধ্যে একটা ফুরফুরে আমেজ কাজ করছিল। আবার একটু ভাবনাও যে হচ্ছিল না তা নয়। তাঁদের দুজনকে দেখে কী বলবো, কীভাবে বলবো এসব ভাবতে ভাবতেই অটো চালক গড়িয়াহাট গড়িয়ে রাস্তার পাশে আমাদের নামিয়ে দিল। যোধপুর পার্কের অটোতে চড়তে হলে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে যেতে হবে। সুরাইয়া আমার আগে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি রাস্তা পার হয়ে আসতেই ফুটপাত ধরে দুজন হাঁটতে হাঁটতে যোধপুর পার্কের অটোস্ট্যান্ডে এসে অটোতে চড়ে বসলাম। যোধপুর পৌঁছে  ড্রাইভার জানতে চাইলে আমরা কোথায় নামবো। তা তো জানি না। তাই একটু এগিয়ে নামিয়ে দিতে বললাম। কোলকাতায় এই জিনিসটা খুব ভালো লাগলো। অটো রিজার্ভে চলে না। পরিবহনের মতো সাধারণ যাত্রী বহন করে। নির্দিষ্ট স্টপেজে যাত্রী উঠছে- নামছে কিন্তু ঢাকাতে আমি এইটা দেখি না। সব অটো বা সিএনজি রিজার্ভে চলে। 

মধ্যে ডিসেম্বর কিন্তু একদম শীত না থাকায়  আমাদের দুজনের গায়ে কোন গরম কাপড় ছিলো না।  আমরা অটো থেকে নেমে মীনাক্ষীদির মোবাইলে কল দিলাম। এবারও সেই পরিচিত গলা( জ্যোতিদার মুখে শুনেছিলাম তার নাম পারুল)। বললাম, আমরা কারমেল হাইস্কুলের সাইনবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কাছেই যোধপুর থানা। তিনি আমাদের পথ বাতলে দিলে আমরা রাস্তা পার হয়ে ওপারে পৌঁছে  থানার সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গন্তব্য অশোক ল্যাবরেটরির পাশে ৩৮৭ নম্বর বাড়ি। আমার পা যতো না জোরে চলছে তার চেয়ে জোরে চলছে আমার মন। কোলকাতা পরিচিত শহর হলেও সবকিছু চেনা নয় বিশেষত এ দিকটায় তো কখনো আসিনি। তাই সুরাইয়ার আর আমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বেশ রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল। তবে ভাবখানা যতো না রোমাঞ্চের তারচেয়ে বেশি সফলতার, মুক্তির। মীনাক্ষী দত্ত এবং জ্যোতির্ময় দত্তের সাথে দেখা করার বাসনা আমার সেদিন থেকে যেদিন আমার শ্রদ্ধেয় প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ড.আবেদীন কাদেরের মুখে তাঁদের গল্প শুনেছি এবং তাদের ছবি দেখেছি।  এবার কোলকাতা যাবার প্ল্যান করতেই সেই ইচ্ছাটাকে অগ্রগণ্য ধরেছিলাম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা কারণ এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা তিনি নিউইয়র্কে বসে করে দিয়েছিলেন। মীনাক্ষীদিকে ফোন করে আমার কথা বলেছিলেন এবং মীনাক্ষীদির ফোন নম্বরও দিয়েছিলেন আমাকে। অল্প একটু পথ হাঁটতেই আমরা ৩৮৭ নম্বর বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। লোহার পকেট গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বাড়ির নিচে দারোয়ান। কোথায় যাবো জিজ্ঞেস করতেই বললাম মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের ফ্ল্যাটে যাবো। দারোয়ান আমাদের লিফট দেখিয়ে বলে দিলো পাঁচতলা। পাঁচতলায়  তাঁদের ঘরের দরজা থেকে পাঁচ গজ দূরে লিফট আমাদের নামিয়ে দিলো। দরজা হাঁ করে খোলা । আমরা ইতস্তত করছিলাম ঢুকতে কারণ জানি না এটাই সেই ঘর কিনা। আমি মীনাক্ষীদিকে ফোনে বলেছিলেন সাড়ে চারটায় যাবো কিন্তু একটু আগেই আমরা এসে পড়েছিলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে ‘কেউ আছেন’ বলতে যাবো এমন সময় ছোট্ট ব্যালকনির সাথে দরজার মুখোমুখি  খোলা ছাদ থেকে দু জন ভদ্রমহিলা ছুটে এসে বললেন ,আসুন, আসুন। আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। অপর পক্ষের জবাব এলো, আমিই আপনার সাথে ফোনে কথা বলেছি বেশি। মাসিমা তো বেশি কথা বলতে পারেন না। আমিই ওঁদের দেখাশোনা করি। এরই ফাঁকে আমি চট করে বললাম, দিদির মেয়ে এখানে থাকেন না? ছিলেন, দুদিন হলো শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন বলে আমাদের বসার জায়গা দেখিয়ে দুজন ভিতরের ঘরে চলে গেলো। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে সোফায় বসতে বসতে ছোট্ট বসার ঘরটির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সোফার সামনে সরু একফালি কাঠের লম্বা টেবিল ঠিক যেন ঢেঁকি, তার চারিধারে কাঠ কেটে নান্দনিক কারুকাজ( এটা জ্যোতিদার করা কিনা কারণ জেনেছিলাম উনি কাঠের বিভিন্ন নান্দনিক কাজে পারদর্শী ছিলেন)।  ছোট্ট বইয়ের আলমারিটার ভিতরে, উপরে বই ঠাসা। পশ্চিমি জানালার ধারে একটা ছোট খাট পাতা। এটা নাকি মীনাক্ষীদির প্রিয় খাট যা জ্যোতিদা পরে বলেছিলেন। উপরে রাখা বইগুলোর মধ্যে একটাতে চোখ আটকে গেলো। বড় বড় অক্ষরে লেখা Forward bloc. সেটি কি সুভাষ বোসের  সাপ্তাহিক ফরওয়ার্ড ব্লকের সংকলন ছিলো? হয়তো লেখা ছিলো SUBHAS CHANDRA BOSE AND HIS POLITICAL WEEKLY ‘FORWARD BLOC’। তবে পুরো লেখাটা দেখবার মন ছিলো না কারণ আমি তখন দুজনকে দেখার জন্য ব্যাকুল। সামনে দেয়ালে সাঁটানো ছবিতে বাঙালির সাহিত্য পুরুষ রবীন্দ্রনাথকে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসা বুদ্ধদেব বসুকে চিনতে পারলাম কিন্তু ছোট বাচ্চাদের চিনতে পারলাম না, হয়তো এদের একজন ছোট্ট মীনাক্ষীদি।  ছবিটা দেখে সোফায় বসতেই জ্যোতিদা এলেন এ ঘরে। আমি উঠে গিয়ে আবেগে পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিলাম। ছবিতে দেখা আর গল্পে শোনা মানুষটিকে চোখের সামনে দেখে আমার আনন্দ যেন রুদ্ধ হয়ে পড়লো, পাখা মেলতে পারছে না। তিনি মুখে দীপ্তিময় হাসি ছড়িয়ে বললেন, বসো বসো। এখন বয়স হয়েছে, দুপুরে আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে হয়, হাসিমুখে বলে জ্যোতিদা দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার সামনে তখন ছয়- সাত দশকের জ্যোতির্ময় দত্ত এসে হাজির। তারুণ্যের দীপ্তি তাঁর চোখে মুখে ঝলমল করছে। কোন কিছুতেই যার কোন পরোয়া নেই। গুগল খুঁজে খুঁজে আগেই দেখে নেওয়া তাঁদের  তরুণ বয়সের ছবি এবং  দাম্পত্যের যুগল ছবি তখন যেন জ্যোতিদার চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছে। জ্যোতিদা দাঁড়িয়ে রইলেন , আমি কয়েকবার বলার পর বসলেন। কোথা থেকে এলাম,  কী নাম এসব প্রাথমিক জিজ্ঞাস্যের জবাব দিতে দিতে সোফায় বসে জ্যোতিদার ছবি তুললাম মোবাইল ক্যামেরায় যেন তিনি এখনই অদৃশ্য হয়ে যাবেন আমার সামনে থেকে এমন একটা তাড়না কাজ করছিল মনে। কতো কিছুর সাক্ষী হয়ে আছেন তাঁরা দুজন। বাঙলা সাহিত্যে যখন পঞ্চপাণ্ডবের যুগ চলছে সেই বিশেষ সময়কে তারা ধারণ করে আছেন। সেই পঞ্চ পাণ্ডবদের একজন বুদ্ধদেব বসুর কন্যা কতো ঘটনার মধ্যে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন সেসব ভাবতেই আমি অন্য রকম পুলক অনুভব করছিলাম নিজের মধ্যে। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি মীনাক্ষীদি শোবার ঘর থেকে উঠে বসার ঘরের প্রবেশ মুখে। শীর্ণকায় শরীর, সুুরাইয়া  দুহাতে জড়িয়ে ছুঁয়ে আছে দিদিকে। আমি তাড়াতাড়ি  উঠে গিয়ে পা ছুঁতেই জ্যোতিদা বললেন, আলিঙ্গন করো, আলিঙ্গন করো। আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম দিদিকে। এই সেই মীনাক্ষী দত্ত  বুদ্ধদেব বসুর বড় আদরের কন্যা। মনে হলো যেন বুদ্ধদেব বসু এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের মধ্যে। জ্যোতিদা ততক্ষণে উঠে গিয়ে বাইরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। মীনাক্ষীদিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে আমিও বসলাম পাশে। ঘরের কমলা রঙের আলোটা জ্বলে উঠলো। জানালার লাল পর্দায় সে আলো এক অপূর্ব রঙের ব্যঞ্জনা তৈরি করে ছড়িয়ে পড়লো আমাদের সবার চোখে মুখে। এবার শুধু কথা বলার পালা। কতো কথা যে আমি বলে চলেছি আর দিদি চুপ থেকে শুনছিলেন। কী করি, কোথায় থাকি কার মাধ্যমে জেনেছি তাঁদের কথা এইসব প্রসঙ্গান্তরে জানালাম। জ্যোতিদাকে এই বয়সেও ভীষণ দুরন্ত মনে হলো যেমনটি ছিলেন তাঁর যৌবনে। তুলনায় মীনাক্ষীদি অনেকটা চুপচাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা দুজন আর আমাদের অচেনা রইলো না। মাঝে মাঝে আমার কথায় জ্যোতিদা হা হা করে তার প্রাণখোলা হাসি হাসছেন আর মীনাক্ষীদির পাতলা ঠোঁটে খেলছিল লাজুক হাসি। বললাম দিদি ,এবার পণ করেছিলাম আপনাদের না দেখে বাংলাদেশে ফিরবো না। মীনাক্ষীদি বললেন, এতো জেনেছো আমাদের সম্পর্কে কার কাছে? আমি আবেদীন কাদেরের নাম বলতেই জ্যোতিদা বললেন, আমরা নিউইয়র্কে থাকতে আবেদীনই আমাদের সবার সাথে সংযোগ ঘটিয়েছিল। আমি ফেসবুকে আবেদীন কাদেরের প্রোফাইল বের করে ছবি দেখালাম কয়েকটা। দুজনে দেখলেন। মীনাক্ষীদি বললেন ,হ্যাঁ এইতো  আবেদীন। একটু বোধহয় স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেছে। ওকে বলো আর যেন স্বাস্থ্য না বাড়ে। জ্যোতিদা হঠাৎ বললেন ,বাংলাদেশের মেয়েরা তো অনেকদূর এগিয়েছে। চেন্নাই ঘুরে কোলকাতায় এসে বাড়ির ঠিকানা খুঁজে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। খুব হাসছিলেন জ্যোতিদা সাথে আমরাও। আমি মীনাক্ষীদিকে বললাম তাঁর  অনুবাদ করা  ‘মাওয়ের শেষ নর্তক’ বইটি আমি পড়েছি সে কথা। দিদি বোধহয় ভালো শুনলেন না কারণ আনন্দোত্তেজনা থাকলে আমি কথা আরো দ্রুত বলি। জ্যোতিদা মীনাক্ষীদিকে আমার বলা কথাটা পুনরায় বললেন। আমি মীনাক্ষীদির দিকে তাকিয়ে  সেই ছবির মীনাক্ষীকে খুঁজছিলাম। মীনাক্ষীদি বসে আছে, একপাশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অন্যপাশে তারাপদ রায় আর সোফার পিছনে দাঁড়ানো আবেদীন কাদের। তাদের যুবা বয়সের ছবির মধ্যে ঝলমলে এক রোদেলা সময় দেখতে চাইছিলাম তাঁর চোখে মুখে। প্রতিভা বসু আর বুদ্ধদেব বসুর কন্যা বিয়ের পর হলেন মীনাক্ষী দত্ত। তার মা-বাবা দুজনেই বাংলাদেশের। মীনাক্ষীদি মুখের আদল একেবারে তাঁর বাবার মতো। (বুদ্ধদেব বসু ছিলেন এক মহা প্রতিভাবান সাহিত্যশিল্পী। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুর মতো সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় এতো বেশি উৎকর্ষ সাধন  আর কেউ করেননি। সেই বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত।) আমি যখন কথা বলছিলাম তখন মীনাক্ষীদি বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন ,মনে হলো যেন একেবারে ভিতরটা পড়ে ফেলছেন। ছবি তোলার জন্য আমি জ্যোতিদাকে বললাম আমার আর মীনাক্ষীর মাঝখানে বসতে। আবার সেই প্রাণখোলা হাসি। বললেন, দুই ফুলের মাঝখানে আমি কাঁটা হয়ে বসতে চাই না। আমরা সবাই সমস্বরে হেসে উঠলাম। এবার জ্যোতিদা একটু স্থির হয়ে বসে কিছু কথা বললেন । বললেন তার ‘কোলকাতা’ পত্রিকা এবং ‘বঙ্গোপসাগর’ নামে আরেকটি পত্রিকার কথা। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে একটা লেখার জন্য তাঁর গ্রেফতার হবার কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সেসব জানি কিনা। বললাম, দাদা আমি শুনেছি আবেদীন কাদেরের কাছে। সুরাইয়ার বাড়ি খুলনা শুনে বললেন, আরে আমার বাড়িও তো খুলনায়, খুলনায় সেই আদি গ্রামের নাম জানো? আমরা তাঁর দিকে কৌতূহল  ভরে  তাকাতেই দুহাত উঁচুতে তুলে জোরে  বলে উঠলেন, গ্রামের নাম সাহস। ঠিকই তো যার বাবার গ্রামের নাম ‘সাহস’ সেই বাবার সন্তান তো হবে দুরন্ত সাহসী, না হলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজেদের বানানো  ডিঙি নৌকা করে  কেউ শ্রীলঙ্কা যাবার সাহস করে! শোনালেন তাঁর সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কিয়দংশ। সেই নৌকার নাম দিয়েছিলেন সিংহলি পৌরাণিক সমুদ্রদেবীর নামে ‘মণিমেখলা’। নৌকা চালানোর কোন অভিজ্ঞতা তাঁর এবং দুজন সঙ্গীর ছিলো না, শেষে একজন নাবিক যিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন তার কাছ থেকে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে তার বেরিয়ে পড়েছিলেন যদিও খারাপ আবহাওয়ার কারণে সে অভিযাত্রায় তাঁরা শেষ অবধি পৌঁছাতে পারেননি এবং সেই সমুদ্রযাত্রা ছিলো ভীষণ বিপদসঙ্কুল  কিন্তু এক ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার সম্ভারে তাঁদের ডিঙি নৌকা ভরে গিয়েছিল। একদিন একপাল হাঙরের দেখা পেয়েছিলেন আর একদিন দুমিটার দূরে ছিলো এক বিশালাকার তিমি। তাঁর সেই রোমাঞ্চকর যাত্রার গল্প  শেষ হতে না হতেই চলে গেলেন আরেক প্রসঙ্গে। সবকিছুই যেন বাকি রেখে শুনছিলাম কারণ সন্ধ্যে  হয়ে আসছিল তাছাড়া মীনাক্ষীদির বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল আমি বুঝতে পারছিলাম। জ্যোতিদা খুব বর্ণাঢ্য আর বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী। যেন বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন সেইসব দিনগুলোতে। কতো বিখ্যাত মানুষদের সাথে তাঁর এ জীবনে পরিচয় হলো, কতো সমৃদ্ধ হয়েছেন তাঁদের সংস্পর্শে। বললেন, জানো সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির দরজা আমার জন্য সবসময় খোলা থাকতো, ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আমার কখনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগতো না। একবার লন্ডন থেকে  সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে লোক এলো অস্কার পাবার পর। আমাকে ডাকলো  সত্যজিৎ। সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়েছিলাম। এভাবে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। এক স্মৃতি  থেকে আরেক স্মৃতিতে, মাঝে মধ্যে কথা ধরিয়ে দিচ্ছিলেন মীনাক্ষীদি। তবে জ্যোতিদার চেয়ে মীনাক্ষীদি ভুলো মনা বেশি হয়েছে দেখলাম। মাঝে মাঝে স্মৃতি থেকে তুলে আনতে ব্যর্থ হয়ে মীনাক্ষীদি বলছিলেন, ঐটে কী যেন জ্যোতি? আমি অবাক হয়ে মীনাক্ষীদির এই বয়সে এসে জ্যোতিদার নাম ধরে ডাকতে দেখে ভাবছিলাম কতোটা অগ্রগর ছিলেন তাঁরা তাঁদের সময় থেকে! আমি যে বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের একনিষ্ঠ ভক্ত সে কথা মীনাক্ষীদিকে বলতেই জ্যোতিদা বললেন, অনেক শিখেছি তাঁর (বুদ্ধদেব বসু) কাছে, অনেক জেনেছি। কথা যখন অনেকখানি হয়ে এসেছে তখন আমি  তাঁদের বিয়ের প্রসঙ্গ তুললাম। মীনাক্ষীদির জন্য সেসময়ের উঠতি কবি ,সাহিত্যিক যারা বুদ্ধদেব বসুর প্রশ্রয়ে ছিলেন তারা শুনেছি পাগল ছিলেন। জ্যোতিদাকে বললাম, আপনি মীনাক্ষীদিকে  বিয়ে করতে চাইলে বুদ্ধদেব বসু কী বলেছিলেন আপনাকে? বলেছিলেন না যে, তোমার এতো বড় সাহস যে তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও!! জ্যোতিদা ভীষণ লজ্জা পেলেন মনে হলো। বললেন, না না এমন কোন কথা হয়নি। সাথে সাথে মীনাক্ষীদি বললেন, না বলেছিল। আমরা হেসে উঠলাম। তারপর আপনি কী বলেছিলেন  দাদা? আমার এ প্রশ্নে জ্যোতিদা বেশ সহজ হয়ে বললেন, যদিও সে কথাও আমার জানা আছে, আমি বলেছিলাম, আপনি মীনাক্ষীকে জন্ম দিয়েই তো আমার জীবন স্বর্গ করে দিয়েছেন। মীনাক্ষীদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম চকিত হরিণ শাবকের মতো চুপ করে বসে উপভোগ করছেন আমাদের এই কথোপকথন। কথায় কথায় আবেদীন কাদেরের কথা জানতে চান জ্যোতিদা। বললাম তিনি নিউইয়র্কে আছেন এখনো। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট প্রফেসর হিসাবে পড়াচ্ছেন আর লেখালেখিতে আবার মন দিয়েছেন। উনার সাম্প্রতিক প্রকাশিত বইগুলোর কথা বললাম। খুব উদ্দীপ্ত হলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। বললেন আবেদীনের পথ অনুসরণ করে আমাকেও তো তাহলে লেখা শুরু করতে হবে আবার। অবশ্যই লিখবেন দাদা এই কথা বলতেই  বাংলাদেশের লেখালেখি খবর, রাজনীতির খবর নিতে শুরু করলেন। অবধারিতভাবে  উঠে আসলো বাংলাদেশের মৌলবাদের উত্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি এবং হুমায়ূন আজাদকে হত্যা প্রচেষ্টা ও তাঁর  অস্বাভাবিক মৃত্যু  প্রসঙ্গ। আমি রাজধানী থেকে দূরে এক প্রান্তিক জেলা শহরে বাস করে যতটুকু খবর রাখি তাই তাঁকে জানালাম।  ধর্ম, মৌলবাদ এসব প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগে উঠলো। বললাম, আচ্ছা দাদা আপনি কি মনে করেন একজন লেখক ধার্মিক হলে তাঁর লেখা সার্বজনীন হয়ে ওঠে না কিংবা ধর্মীয় প্রভাব লেখার শিল্পমান বা শৈল্পিক সৌন্দর্যকে  ক্ষতিগ্রস্ত করে? দেখো, এটা বলা যায় না যে, আস্তিক হলে তার লেখা সার্বজনীন হয়ে উঠবে না। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক কবি, সাহিত্যিক ধার্মিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করো, তিনি তো ছিলেন উপাসক,ঋষি। আসল কথা হলো তুমি প্রকৃতিকে কতোটা বুঝতে পারছো তার উপর নির্ভর করে। তুমি যদি প্রকৃতিকে বুঝতে পারো তাহলে ধর্ম সেখানে কোন বাধা হয়ে উঠে না, বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করলেন(যদিও লাইনগুলো আমার মনে নেই)। আমি চুপ থেকে তাঁর কথা শুনলাম। কবি আল মাহমুদের খবর নিতেই বুঝলাম তিনি যে মারা গেছেন জ্যোতিদা বা মীনাক্ষীদি দুজনের কেউ জানেন না বা শুনলেও হয়তো ভুলে গেছেন। কবি বেলাল চৌধুরীর সাথে তাঁদের খুব ভাব ছিলো সেকথা মীনাক্ষীদি আমাদের জানালেন। আমাদের এতো সব হাসি আর গল্পের মধ্যে চা এলো, সাথে বিস্কিট, চপ আর মিষ্টি। মীনাক্ষীদি নিজ হাতে তুলে দিলেন। এতো বিনয়ী, নম্র আর উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ মনে হয়েছে তাঁকে  সেটি বলার নয়। মোটে ঘন্টা দেড়েকের পরিচয়ে একবারও মনে হয়নি এই প্রথম তাঁদের দেখছি। বাইরে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে, এবার না উঠলেই নয়। ফিরতে হবে কিন্তু কতো কিছু তখনো বাকি রয়ে গেছে। তাঁদের কাছ থেকে সরতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু আঁধার ঘনিয়ে আসছে। আমি সাথে করে আমার দুটো কবিতার বই ‘নিলম্বন মাদকতা’ ও ‘নিস্তল মেলানকলি’ এবং একটা গল্পগ্রন্থ ‘রাতের বৃষ্টি’ নিয়ে গিয়েছিলাম ওঁদের জন্য যদিও তাঁদের মতো মহীরূহের পাশে এ এক নিরস খড়কুটোর মতো। মীনাক্ষীদির হাতে বইগুলো দিতেই বললেন, তুমি লেখো? আমি যেন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিলাম। চেষ্টা করি দিদি, এ কথা বলে নিজের মধ্যে আড়ষ্ট হয়ে রইলাম। কাব্যগ্রন্থের নাম উচ্চারণ করে পড়ে দিদি বই দুটির পৃষ্ঠা উল্টালেন।আমার ‘নিলম্বন মাদকতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রিয় প্রাবন্ধিক, অনুবাদক আবেদীন কাদেরকে উৎসর্গ করে লেখা আছে, ‘আমার চোখে যিনি বুদ্ধদেব বসু।’ লেখাটা পড়ে দিদি হয়তো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু তার আগেই আমি বললাম, হ্যাঁ দিদি আবেদীন কাদেরের গদ্যে আমি বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের ছায়া দেখি। কথাটা তাঁর অন্য বন্ধুরাও তাঁকে বলেছিলেন আমার বলারও ত্রিশ বছর আগে। বললাম আমি বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের ভীষণ ভক্ত। তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আত্মজৈবনিক, বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ আমার ভীষণ প্রিয় । দিদির মুখেতো সারাক্ষণ হাসি লেগেছিল,এবার আরো হাসির পরিধি একটু বাড়িয়ে বললেন,  ভিতরে লিখে দাও। এখন ভাবছি কী ছাই লিখলাম! যদি আর একটু সময় করে লিখতাম তাহলে আরো ভালো লাগতো আমার। আমি লেখার পর বললেন,  তারিখ লিখে দাও। এতো সাবলীল আর স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দুজনের। মনে হচ্ছিল ওঁরা আমার কতো জনমের যেন পরিচিত অথচ এই প্রথম। ততক্ষণে  জ্যোতিদার হাতে পৌঁছে গেছে গল্পগ্রন্থ ‘রাতের বৃষ্টি ‘। জ্যোতিদা বইটা উঁচু করে ধরে মীনাক্ষীদিকে দেখিয়ে বললেন,  কোন শব্দের প্রতিধ্বনি পাও? দিদি তাকিয়ে দেখলেন। আমি বুঝতে পারলাম বুদ্ধদেব বসুর বহুল আলোচিত উপন্যাস রাত ভরে বৃষ্টি-র ইঙ্গিত করছেন তিনি। আমি এবার তাঁদের সাথে দেখা করতে পারি এ কথা জানতে পেরে ঢাকা থেকে শ্রদ্ধেয় কবি, অনুবাদক গৌরাঙ্গ মোহান্ত তাঁর চল্লিশটি গদ্য কবিতার ইংরেজি অনুবাদ  ‘ A green dove in silence’ পাঠিয়ে তাঁদের জন্য নিয়ে গিয়ে  তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে বলেছিলেন। দিদি বইটা হাতে নিয়ে বললেন, গৌরাঙ্গ মোহান্ত নামটা খুব সুন্দর।  কিন্তু আমি তো একটা ভুল করে বসেছি। কোন বাড়তি বই নিয়ে যাইনি সাথে যে তাদের অটোগ্রাফ নেবো। তখন হঠাৎ আমার নজর পড়লো পাশে টেবিলের নিচে রাখা একটা ডায়েরির দিকে। অনুমতি না নিয়েই সুরাইয়াকে ডায়েরিটা আনতে বললাম। মীনাক্ষীদি আর জ্যোতিদাকে বললাম ,লিখে দিন। মীনাক্ষীদির লিখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অক্ষর জড়িয়ে যাচ্ছিল,বেঁকে যাচ্ছিল সেভাবেই লিখলেন একটা লাইন । সে তুলনায় জ্যোতিদার  হাত ততোটা কাঁপছিল না। ভালোবাসার স্পর্শ ছড়িয়ে দিলেন লাইন দুটিতে। আমি পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে নিয়ে  যক্ষের ধনের মতো নিরাপদে ব্যাগের ভিতর গলিয়ে দিলাম।  মীনাক্ষীদির কথামতো ডায়েরির অন্য একটি পৃষ্ঠায় আমার ঠিকানা লিখে দিলাম। কতো কিছুই শোনা হলো না আমার। শোনা হলো না তাঁর বাবার কথা, রানু সোম মানে তাঁর মা প্রতিভা বসুর কথা, বাবার সাথে তার সব থেকে মধুর স্মৃতির কথা। এ জীবনে বাকীর ঘরগুলো হয়তো সারাজীবন শূন্য রয়ে যায়।  আমি যখন মীনাক্ষীদির সাথে নানান কথা নিয়ে মজা করছি তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে জ্যোতিদা বললেন, আহা! দেখো তো কী সুন্দর করে কথা বলছে। আমার ভেতরটা খলবলিয়ে উঠছে কিন্তু  আমাদের ওঠার সময় তখন  হয়ে এলো। তাঁদের দুজনের বয়স এখন সাতাশি। শিকাগো- আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের গবেষক প্রভাষক জ্যোতির্ময় দত্ত আর মীনাক্ষী দত্তের সকাল সন্ধ্যা এখন এই ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের মাঝখানে অনেকটা বন্দি। কথার মাঝে জ্যোতিদা বারদুয়েক বললেন, আমরা আবার ঢাকা যাবো বেড়াতে। জানি না তাঁরা আবার ঢাকা আসতে পারবেন কিনা কারণ তাদের শারীরিক অবস্থা সে ধকল সইতে পারবে কিনা ঠিক নেই। বিদায়ের আগ মুহূর্তে মীনাক্ষীদিকে আরেকবার ছুঁয়ে রইলাম । আমার চোখ তাঁর আঙুলগুলোর উপর পড়তে দেখলাম নখগুলো বড় এবং বেশ শার্প হয়ে আছে। আমি বললাম, দিদি আমি আপনার নখগুলো ছেঁটে দিয়ে যাই। কোথাও যদি লাগে তাহলে কিন্তু কেটে যাবে। দিদি আবারও লাজুক হেসে বললেন, না না তোমাকে কেটে দিতে হবে না। জ্যোতিদার কাছে জানতে চাইলাম তাঁর আত্মচরিত ‘আমার নাইবা হল পারে যাওয়া ‘ কোথায় পাবো। এও জানালাম আমি সতের ডিসেম্বর কোলকাতা পৌঁছেই কলেজস্ট্রিটে গিয়েছিলাম। যে দোকানগুলো খোলা ছিলো ( কারণ সেদিন রবিবার ছিলো,)সেখানে পাইনি। পরে তিনি প্রকাশকের নাম ও কোন দোকানে পাবো তার ঠিকানা দিলেন। সেদিন অবশ্য আমি কফি হাউসের তিন তলায় রেনেসাঁ পাবলিকেশন থেকে শিবনারায়ণ রায়ের সম্পাদনায় প্রবন্ধ সংকলন  ‘অনিঃশেষ রবীন্দ্রনাথ ‘ কিনে হোটেলে ফিরেছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষীদির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। জ্যোতিদা দাঁড়িয়ে ছিলেন, কাছে যেতেই আমার আর সুরাইয়া হাত ধরে বাবার মতো স্নেহের চুমু দিলেন হাতে। আমাকে বললেন, লিখে ফেলো আমাদের আজকের এই সাক্ষাতের কথা। বললাম, অবশ্যই লিখবো দাদা। জ্যোতিদাকে দেওয়া সেই কথা রাখতেই এই লেখার অবতারণা। তেইশ ডিসেম্বরের সেই স্মরণীয় বিকেলটুকু তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের গভীরে নিমগ্ন হতে আকুল। আমরা লিফট বেয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের সঙ্গী হলো মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্ত যুগলের ত্রিশ বছরের সঙ্গী সেই পারুল। আমরা গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় নামলাম। কোলকাতার রাস্তায় তখন সব স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। একটু এগিয়ে যেতেই একটা ট্যাক্সির দেখা পেলাম। এবার আর অটো নয়। হাঁক দিলাম, ট্যাক্সি…। =======================   লিপি নাসরিন কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক =======================