একনায়করা সাহিত্যকে ভয় পায় || মলয় রায়চৌধুরী
মারিও ভার্গাস য়োসা ঠিকই বলেছেন যে, “একনায়করা সাহিত্যকে ভয় পায়।”
.
সাদ্দাম হোসেনের রূপক ‘জাবিবাহ এবং রাজা’ থেকে শুরু করে তুর্কমেনিস্তানের একনায়ক সাপারমুরাত নিয়াজভের ‘রুহনামা’ পর্যন্ত, স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্বের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই সর্বগ্রাসী শাসনের ক্ষুদে কর্মীরা কেউ কেউ পাণ্ডুলিপিগুলোকে কাঠবিড়ালির মতন গর্তে লুকিয়ে রাখে। লেখকদের প্রতি অত্যাচারীদের ঘৃণার একটা অনুমান হল যে ব্যাপারটা কেবল ব্যবহারিক উদ্বেগ হিসাবে নয়, বরং প্রচণ্ড ঈর্ষার ক্রোধ থেকে আংশিকভাবে আসে। বিরক্তি, নিরাপত্তাহীনতা, ক্ষুদ্রতা এবং হিংসা অনেক একনায়কের লেখার মূলে রয়েছে, তবে সমস্ত ক্ষেত্রেই শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সম্ভবত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যা স্বীকার করতে হবে তা হল শব্দের তীব্র এবং বিপজ্জনক শক্তি। জীবনে ভালো বা মন্দ সবকিছুই ভাষার মাধ্যমে শুরু হয় । প্রতিটি গণ-অত্যাচারের সূচনা করা হয়েছে বাক-বিতণ্ডার মাধ্যমে। স্পষ্টতই সাহিত্য বিপজ্জনক হতে পারে, স্পষ্টতই ভাষা মস্তিষ্ককে পুনর্নির্মাণ করতে পারে, স্পষ্টতই শব্দ “শুধুই শব্দ” নয়। ব্যাপারটা কবি-লেখকদের প্রতি অত্যাচারী শাসকদের শত্রুতার মূলে রয়েছে। তারা সকলেই জাদুকর, যারা নতুন বিশ্বের নির্মাণে শব্দ এবং বর্ণনা ব্যবহার করে।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/823556_4-300x222.jpg)
যেখানে অত্যাচারী একনায়ক এই দক্ষতাগুলো ক্ষতিকারক শক্তির সেবায় ব্যবহার করে, কবি-লেখক সেই একই সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করে প্রতিরোধ করেন। আমরা গণতন্ত্র, অত্যাচারী, স্বৈরশাসক এবং স্বৈরাচারী নেতাদের কেবল তাদের কাজ নয়, তাদের কথার মাধ্যমেও হাড়ে-হাড়ে জানতে পারি।
.
এডমাণ্ড স্পেনসার দাবি করেছিলেন যে মানুষের বেঁচে থাকা উচিত “প্রেমের জন্য, অন্য কোনো পুরস্কারের জন্য নয়”। স্পেনসার একজন সৈনিক ছিলেন যিনি আর্থার গ্রে, ১৪ তম ব্যারন গ্রে ডি উইল্টন, আয়ারল্যান্ডের এলিজাবেথের লর্ড ডেপুটির অধীনে কাজ করতেন। যখন ছন্দ আর কবিতা নিয়ে ভাবতেন না ,তখন তিনি ১৫৮০ সালে, স্মারউইক অবরোধে, আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের গণহত্যা করিয়েছিলেন। ছয়শো সেনাকে তাঁর সামনে কচুকাটা করা হয়েছিল। স্পেনসারকে কিলকলম্যানে জমি “উপহার দেওয়া” হয়েছিল, যে নীতি পরবর্তী শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকাকে ধ্বংস করেছিল।১৫৯৬ সালে কবি এডমাণ্ড স্পেনসার ‘আয়ারল্যান্ডের বর্তমান রাজ্যের একটি দৃশ্য’ শিরোনামে একটা পুস্তিকা লেখেন। স্পেন্সার লিখেছিলেন “আয়ারল্যান্ড হলো ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের একটি রোগাক্রান্ত অংশ, এটিকে প্রথমে নিরাময় এবং সংস্কার করা উচিত,” আর তার জন্য আইরিশ সংস্কৃতি এবং গ্যালিক ভাষা নির্মূল করা দরকার, স্থানীয়দের প্রোটেস্ট্যান্টবাদে ধর্মান্তন্তরিত হতে বাধ্য করা উচিত। কবি স্পেনসারের ভুত আজও আয়ারল্যাণ্ডের রক্তক্ষয় করে চলেছে।
,
স্বৈরশাসকরা তাদের শৈল্পিক হতাশাকে রাজনীতিতে প্রয়োগ করে। হিটলার, ‘কথ্য শব্দের জাদু শক্তি’-র বিরুদ্ধে ‘নন্দনতাত্ত্বিক সাহিত্যিকদের তরল স্ফীতি’-র জন্য অগ্রাধিকার ঘোষণা করা সত্ত্বেও, একবার নিজেকে ভিয়েনিজ বোহেমিয়ান কল্পনা করেছিলেন।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/images-27.jpeg)
,
কবিতা হল পরিমার্জিত শিল্প, সূক্ষ্মতা এবং সংবেদনশীলতার সমার্থক। অদ্ভুত মনে হয় যে কবিতা বর্বরতার উদযাপনও হতে পারে, এবং অত্যাচারীদের প্রিয় জনার। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে আধুনিকতা পর্যন্ত, আধুনিকতার পরও, স্বৈরশাসকরা কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছে – সান্ত্বনা, ঘনিষ্ঠতা বা গৌরবের খোঁজে, দুর্নাম মেটাতে হয়তোবা। তাদের কবিতা লেখার প্রয়াস, ক্ষমতার প্রকৃতি, কবিতার স্থায়ী আবেদন এবং শৈল্পিক ব্যাখ্যার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। অত্যাচারী-কবির নমুনা হল রোমান সম্রাট নিরো একজন বোকা, আত্ম-করুণাময় প্রদর্শনবাদী, যার অবমাননাকর শাসন তার কবিতা লেখার ঘাটতিকে প্রতিফলিত করতো। নিরোর ইতিহাসবিদ, ট্যাসিটাস আর সুয়েটোনিয়াস লিখেছেন যে রোম নিরোর কবিতার কারণে যেমন যন্ত্রণায় ভুগতো তেমনই তার উল্টোপাল্টা নীতির দ্বারা । নিরো হয়তো ভেতরে-ভেতরে ভাবতো যে তার অত্যাচারের অপরাধগুলোকে জনসাধারণ মাফ করে দেবে তাকে একজন বড়ো কবি মনে করে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি একজন অত্যাচারীর কবিতার গুণগত মান বিচার করতে পারি? একনায়করা তাদের মতাদর্শ ঢুকিয়ে দেয় স্কুল কলেজের সিলেবাসে পছন্দের উপন্যাস, কবিতা এবং প্রবন্ধগুলো মাধ্যমে।
.
লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর মুখে পাঠানোর আগে, জোসেফ স্তালিন ছিলেন একজন সেমিনারি ছাত্র যাঁকে ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা প্রভাবিত করেছিল । সম্ভবত হুইটম্যানের প্রতি ঋণের কারণে, ১৮৯৫ সালে আইভেরিয়া জার্নালে “সোসেলো” ছদ্মনামে প্রকাশিত স্তালিনের কবিতাগুলোতে ছিল দেশপ্রেম এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য। একটিতে তিনি চাঁদকে “কাজবেক পর্বতে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে” আর “মাতাসমিন্দার পাহাড়েরউচ্চতা মাপতে” অনুরোধ করেন।তরুণ স্তালিন জর্জিয়ান ভাষায় কবিতা লিখতেন – এমন এক ভাষা যা, যেখানে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, অর্থোডক্স সেমিনারিতে, নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর কবিতায় হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগের জন্য রোমান্টিক হাহুতাশ পাওয়া যায়।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/Stalin.jpg)
বেনামে প্রকাশিত, স্তালিনের কবিতা তখনকার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হতো আর জর্জিয়ান ধ্রুপদী সাহিত্যের উদাহরণ হিসাবে সংকলিত হয়েছিল। স্তালিনের কবিতাগুলো জর্জিয়ান সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বমূলক উদাহরণ হিসাবে “ব্রেজনেভের দিন পর্যন্ত” সংকলনগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল । অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম দিকের দিনগুলো ছিল নান্দনিক নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ। কিন্তু স্তালিনের ওপরে ওঠার সাথে-সাথে, সেই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা , প্রচারমূলক সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ প্রচারের জন্য পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। তবুও গ্রেট পার্জের সময়, যখন লক্ষাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছিল তখন তিনি জর্জিয়ান জাতীয় মহাকাব্য, শোটা রুস্তাভেলির ‘দ্য নাইট ইন দ্য প্যান্থারস স্কিন’ অনুবাদ করার জন্য গুলাগ থেকে একজন ভাষাতাত্বিককে মুক্তি দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। অনুবাদের কাজ হয়ে গেলে স্তালিন অনুবাদককে কারাগারে ফেরত পাঠানোর আগে জিগ্যেস করেছিলেন অনুবাদটা ঠিক হয়েছে কিনা।
স্তালিনের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী, ইউরি আন্দ্রোপভ, আমলাতান্ত্রিকতার সঙ্গে রোমান্টিসিজম মিশিয়ে কবিতা লিখতেন। কেজিবি প্রধান হিসাবে, তিনি ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন করায় বেশ নাম করেছিলেন আর হাঙ্গেরির বিদ্রোহকে ভাঙতে পেরেছিলেন।একই সময়ে আন্দ্রোপভ স্ত্রীকে প্রেমের কবিতা লিখে পাঠাতেন।
.মাও জে দঙ, একজন শাসকের কলম-এবং-তলোয়ার আদর্শকে মূর্ত করেছিলেন, অর্থাৎ সামরিক ক্ষমতার (উ) এর সাথে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার (ওয়েন) কে মিশিয়ে একতার ভিত্তি তৈরির তত্ব । মাও সাম্রাজ্যিক ঐতিহ্যকে অতিক্রম করার জন্য এই মিশেলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন, আর ১৯৩৬ সালের একটি কবিতায় উল্লেখ করেছেন যে সম্রাটরা সাহিত্যিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তিনি তাদের একজন। মাও সহস্রাব্দের ধ্রুপদী চীনা কবিতায় পারদর্শী ছিলেন, বিশেষ করে লি বাও-এর মতো তাং রাজবংশের মহান ব্যক্তিরা, লং মার্চ এবং রেড আর্মির নানজিং দখলের মতো ঘটনাগুলির সময় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জুড়ে গানগুলো লেখা হয়েছিল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা, “তুষার” ১৯৩৬ সালে জাপানি আক্রমণ এবং চিয়াং কাই-শেকের জাতীয়তাবাদীদের সাথে গৃহযুদ্ধের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। মাও তাঁর জীবন জুড়ে কবিতা লিখে গেছেন , এমন এক জীবন যা ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ থেকে’ সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে পাত্তা দেয়নি।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/Mao.jpg)
মাও-এর কবিতা আঙ্গিকের দিক থেকে গোঁড়া আর থিমের দিক থেকে ধ্রুপদী, যে ঐতিহ্যকে তিনি নিজেই ঘৃণা করতেন । ‘চারটি পুরাতন’ (সংস্কৃতি, রীতিনীতি, অভ্যাস, ধারণা) ধ্বংস করার জন্য তাঁর নিজস্ব হুকুম সত্ত্বেও, মাও পুরানো শৈলীতে লিখতেন, এমনকি যখন একে অভিজাত এবং সেকেলে বলে নিন্দা করা হচ্ছিল তখনও ।মাওয়ের কবিতার প্রতি আগ্রহ প্রমাণ করে যে শৈল্পিক চেতনা মোটেই জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার রাজনীতির গ্যারান্টি নয়। ১৯৬৬ সালে, রেড গার্ডস তাদের ‘লিটল রেড বুকের’ পরিপূরক হিসেবে ২৫টি কবিতার একটি সংকলন নিজেদের সঙ্গে রাখতো ; কবিতাগুলো মাও জে দঙের লেখা।
.
জোসেফ গোয়েবলস একবার তাঁর একটা উপন্যাস প্রকাশের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন আর নিজের লেখা নাটকগুলো মঞ্চস্হ করার ব্যবস্হা করেছিলেন, কিন্তু হিটলারের প্রচার মন্ত্রী হওয়ার পরে সমস্ত শিল্প ও সাহিত্যিকম কাজের জন্য তাঁকে হিটলারের অনুমোদন নিতে হতো। নাৎসি আন্দোলনে যোগদানের আগে, গোয়েবলসের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট প্রার্থী ছিলেন,। ১৯২১ সালে ‘মাইকেল’ শিরোনামে একটি তিন-পর্বের আত্মজীবনীমূলক ‘বিল্ডুংসরোমান লিখেছিলেন। নায়ক যখন বিশ্বযুদ্ধ থেকে মিউনিখে ফিরে আসে, একজন সুন্দরী তরুণীর প্রেমে পড়ে । উপন্যাসে নায়ক রুশ বলশেভিক, গ্যেটে আর দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে দীর্ঘ, বিক্ষিপ্ত বিভ্রান্তিকর তর্কাতর্কি চালিয়ে যায়।
.
‘বসনিয়ার কসাই’ নামে খ্যাত কবি রাডোভান কারাদজিচ ৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে যুদ্ধের সময় নিজেকে এমন ভয়ঙ্কর শক্তিধর হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন যে স্লাভোয় জিজেক বলেছিলেন যে যুদ্ধাপরাধী লোকটা “কাব্যিক-সামরিক কমপ্লেক্স” এর অংশ । হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে, “বসনিয়ার কসাই”কে স্রেব্রেনিকার গণহত্যায় তার ভূমিকার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছিল। তার আদেশে “প্রতিটি সক্ষম দেহের পুরুষদের” খুন করা হয়েছিল। ক্রোয়াট এবং বসনিয়ানদের উপর তার গণহত্যার আগে, কারাদজিচ প্রাথমিকভাবে একজন কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন, একটি কবিতায় লিখেছিলেন যে “আমার বিশ্বাসে কিছুই নিষিদ্ধ নয়” ।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/RadovanKaradzic-217x300.jpg)
তিনি তার সন্ত্রাসের রাজত্বের সময় এবং তার পরবর্তী বছরগুলো লুকিয়ে বেড়াতেন। রাশিয়ান জাতীয়তাবাদী লেখক এডুয়ার্ড লিমোনভের সাথে সেই শহরের অবরোধের সময় সারাজেভোকে উপেক্ষা করে একটি পাহাড়ে একটি কবিতা পাঠের পর কারাদজিচ বেসামরিক এলাকাগুলোতে বোমা ফেলেছিলেন। রুশ জাতীয়তাবাদী কবি এডুয়ার্ড লিমোনভকে নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন যাতে তিনি খুনোখুনির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । কারাদজিচের কবিতার বেশিরভাগ অংশ জাতীয়তাবাদী কিংবদন্তি গড়ার প্রয়াস।বসনিয়ার কবি সেমেজদিন মেহমেডিনোভিচ, যিনি কারাদজিচকে সারায়েভোর সাহিত্যিক আড্ডার সময় থেকে জানতেন, বলেছেন যে কারাদজিচের কর্মকাণ্ডের ফলে লোকটা নিজের জীবন আর সাহিত্য দুটোকেই ধ্বংস করেছেন, কারণ নব্বইয়ের দশকের সারায়েভোতে একটা লাইব্রেরি “আর বইয়ে ভরা বাড়ি ছিল না। ছিল পোড়া বইয়ের ধ্বংসাবশেষ।”
..
ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনিও কবিতা লিখেছেন। তাঁর ফার্সি কবিতা সুফি দ্রষ্টা রুমি আর হাফেজের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, যদিও রাষ্ট্রের শাসনের ব্যাপারে রুমি আর হাফেজ সম্পূর্ণ অনুপস্হিত।কবিতাগুলো আয়াতুল্লাহকে একজন রহস্যবাদী হিসাবে প্রকাশ করে।বিপ্লবী তেহরানে ফিরে আসার আগে আয়াতুল্লাহ প্যারিসীয় শহরতলির একজন সুশিক্ষিত বাসিন্দা ছিলেন, যখন কিনা তেহরান শহরটা মহাজাগতিকতায় ইউরোপের রাজধানীগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। প্রকৃতপক্ষে, আয়াতুল্লাহর এই শহুরে হাবভাবই ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতো পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/images-28.jpeg)
ভাবতে প্ররোচিত করেছিল যে অত্যাচারী শাহের বিরুদ্ধে ইরানের বিপ্লব একটি সত্যিকারের জনগণের বিদ্রোহ হবে।
তিনি যে ফিরে ফতোয়া জারি করবেন, অন্য কবিদের সেন্সর করবেন, মহিলাদের জেলে পুরবেন তা আঁচ করেননি প্যারিসের দার্শনিকরা। লোকটির মধ্যে কবি এবং অত্যাচারী উভয়ই মাঝে মাঝে সেই দৃষ্টিকোণে একীভূত হন যাকে কীটস বলেছেন “নেতিবাচক ক্ষমতা”, একই মনের মধ্যে অসংলগ্ন দ্বন্দ্বগুলিকে সামলাতে সক্ষম। এটি এমন একটি দক্ষতা যা শিল্প সৃষ্টির জন্য মগজকে উৎসাহ যোগায় কিন্তু সেইসাথে বিরোধিদের গুমখুন করতে আর জেলে পুরতে কোনো অনুশোচনা যোগায় না।
.
অনেক খামখেয়ালি স্বৈরশাসকের মতোই, মুয়াম্মার গাদ্দাফির আচরণ তার সংঘটিত নৃশংসতাকে ঢেকে দিতে পারে, যেমন ব্যক্তিগতভাবে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, জাতিদের লোপাট আর সন্ত্রাসবাদ। গাদ্দাফির পরীক্ষামূলক পরাবাস্তববাদী ছোটগল্প সংকলন ‘এসকেপ টু হেল’ তাঁর সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক জানালা খুলে দেয় – মহাজাগতিকতার ঘৃণা। শহুরে স্থান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, গাদ্দাফি বলেছেন যে শহরটিকে বর্জন করতে হবে কারণ এটি “আপনাকে আপনার চেহারা পরিবর্তন করতে এবং আপনার মূল্যবোধগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে বাধ্য করে, আপনাকে অন্যের শব্দ শুনতে বাধ্য করে। আপনি তাদের নোংরা নিঃশ্বাস নিতে বাধ্য হন।”
২৪ মার্চ ১৯৮২। সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন এক জেনারেল- নাম তার হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি কবিখ্যাতি পাওয়ার জন্য শুরু থেকেই ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। তার কবিতার প্রতি অনুরাগের কথা জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশিত হয় ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক পর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। যেখানে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণের শেষ মুহূর্তে হঠাৎ করে বলে বসলেন ‘কাল রাতে আমি একটি কবিতা লিখেছি, যা আমি আপনাদের পড়িয়ে শোনাতে চাই’ এবং পড়লেন। সেই তার কবি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। এর আগে কেউ তার কবিতা দেখেছে বা পড়েছে এমন খবর কারোই জানা নেই। এর পরের কথা সবার জানা। দেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় কিছু দিন পর পর বেরুতে থাকে তার কবিতা। বঙ্গভবনে নিয়মিত বসত কবিতার আসর। এতে দেশের নামকরা কবিরা ঘিরে থাকতেন তাকে। তিনি নিজেও কবিতা পড়তেন। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ‘কনক প্রদীপ জ¦ালো’। প্রকাশক তার সহধর্মিণী বেগম রওশন এরশাদ। ৩২ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য ছিল ২৫ টাকা। এতে মোট ২৮টি কবিতা ছিল। বলা হয়ে থাকে, তিনি হয়তো কাঁচা হাতে কিছু লেখেন; তবে প্রকাশিত এসব কবিতা তার লেখা নয়। দেশের নামিদামি রাজকবিরা এসব কবিতার নেপথ্য কারিগর। কিন্তু কেউ ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ খোলেন না। অবশ্য তার কবিতা পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশের ব্যাপারে এক সাংবাদিক মুখ খুলেছিলেন। ১৯৮৩ সালের অক্টোবরের এক দিন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. এইচ. এম. এরশাদ সবেমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। রীতি অনুযায়ী তিনি সংসদ ভবনে একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। এতে ‘বাসস’-এর তৎকালীন কূটনীতিক রিপোর্টার জাহাঙ্গীর হোসেন তাকে প্রচণ্ড সাহসী প্রশ্ন করে বসেন, যার জন্য এরশাদ আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। জাহাঙ্গীর প্রশ্নবান ছুড়ে মারেন, ‘আপনি ক্ষমতায় আসার আগে কেউ জানতই না আপনি একজন কবি। এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকার প্রথম পাতা তো খবরের জন্য, কবিতার জন্য নয়।
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/10/ershad-300x156.jpg)
বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানেরও তো এই ভাগ্য হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কী কোনো নির্দেশ জারি করা হয়েছে?’ বিব্রতকর প্রশ্ন করায় সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে এরশাদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। তাকে চট্টগ্রাম বদলি করা হয় এবং দুবছরের মাথায় তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। অবশ্য তার এই সাহসী উচ্চারণে কাজ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তার কবিতা পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছাপানো হতে থাকে। স্বৈরাচারী এরশাদের কবিতা নিয়ে যখন সারাদেশে ফিসফাস, তখনই কলম হাতে এগিয়ে এলেন ষাটের দশকে জেনারেল আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মাঠের তুখোড় ছাত্রকর্মী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক কবি মোহাম্মদ রফিক। জেদের বশে জুন মাসের এক রাতে তিনি এক বসাতেই লিখে ফেলেন আলোচিত দীর্ঘকাব্য ‘খোলা কবিতা’, যার দুটো পঙক্তি প্রবাদে পরিণত হয়ে আজো লোকমুখে দেদীপ্যমান- ‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই; বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই’। কোনো পত্রিকা তা প্রকাশ করতে সাহসী না হওয়ায় তার দুর্বিনীত ছাত্রছাত্রীরা গোপনে কবিতাটি ছাপায়।নিউজপ্রিন্টে ছাপানো এক ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠার) এ কবিতাপত্রটি গোপনেই বিলি করা হয় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। পরবর্তী সময়ে তা কপি হয়ে হাতে হাতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ কবিতা লেখার নেপথ্যে কাজ করেছিল তার ভেতরের এক বিশেষ ধরনের আত্মমর্যাদাবোধ, যা তার বক্তব্যেই স্পষ্ট- ‘এটা শুধু এরশাদকে নিয়ে লেখা কবিতা নয়। এরশাদের মার্শাল ল’ জারি আমার কাছে একটা ঘটনা। কিন্তু একজন লোক, যে কোনোদিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না, ভুঁইফোঁড়- সে আজ সামরিক শাসন জারির বদৌলতে কবিখ্যাতি অর্জন করবে, এটা তো মেনে নেয়া যায় না।… আমার মনে হচ্ছিল, একজন ভুঁইফোঁড় জেনারেল আমাদের কবিতার অপমান করছে।’ কবিতাটি প্রকাশের পর এটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাকে সেনানিবাসে তলব করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিবেচনায় তাকে তখন তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেয়া হলেও পরে তার নামে হুলিয়া জারি করা হয়। তিনি কিছুসময় আত্মগোপনেও ছিলেন। মূলত তার এ দীর্ঘ কবিতাটি ছিল, এরশাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের দিকনির্দেশক, মাইলফলক। এ কবিতা গণমানুষের চেতনাকে শানিত, অনাচার-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখী ও স্বদেশলগ্ন করেছিল। এরশাদের সময়কালটা ছিল প্রকৃতই বাংলাদেশের কবিদের জন্য এক অভূতপূর্ব সময়। এ সময় কবিতা ঘিরেই চলছিল রাজনীতির লড়াই। একদিকে ছিলেন কবিযশ প্রত্যাশী অবৈধ সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ এবং তার পাছাটা কবিকুল। এ দলে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ইমরান নূর (মনজুরুল করিম)সহ অনেকেই। তাদের সংগঠনের নাম ছিল ‘কবিকণ্ঠ’। জেনারেল এরশাদ ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ফজল শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে প্রতি মাসে এ সংগঠনের কবিতার আসর বসত। এরশাদ প্রতিটি আসরেই উপস্থিত থেকে কবিতা পড়তেন। অন্যদিকে তারুণ্য উদ্দীপ্ত বিদ্রোহী তূর্যবাদক কবিগোষ্ঠী, যারা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে কবিতাকে করেন শানিত হাতিয়ার। তারা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই কবিতাঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকায় কবি শামসুর রাহমান ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মিলে গড়ে তোলেন ‘পদাবলী’। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’। ১৯৮৭ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বড় রাজনৈতিক দলগুলো যখন নানা টানাপড়নে, তখন ঢাকায় কবিরা এক অবাক করা কাণ্ড করে বসলেন। এরা জাতীয়ভিত্তিতে সারাদেশের কবিদের জড়ো করে ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্বরে আয়োজন করলেন প্রথম ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’। এ উৎসবের স্লোগান ছিল ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’। এ পুরো আয়োজনের নেপথ্যে কাজ করেছেন ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ সভাপতি কবি শামসুর রাহমান ও সাধারণ সম্পাদক সদ্য প্রয়াত কবি মোহাম্মদ রফিকসহ একদল উদ্যমী তরুণ কবি। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। এবার উৎসবের সেøাগান নির্ধারিত হয় ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’। এতে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। উৎসব মঞ্চে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে শিল্পী কামরুল হাসান হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বক্ষণেই তিনি একটা স্কেচ আঁকেন, যার শিরোনাম দেন তিনি, ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’। উৎসব কর্মীরা দ্রুতই স্কেচটা দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে তা বিলির ব্যবস্থা করেন। অবশ্য পুলিশ হানা দিয়ে তার কিছুটা জব্দ করে। ঘটনা পরম্পরায় কবিতায়-রাজপথে ছড়িয়ে পড়া উত্তাপে ১৯৯০ এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অনেক কবিই স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা লিখেছেন, আন্দোলনের চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কবি মোহাম্মদ রফিক ও তার ‘খোলা কবিতা’ ছিল আন্দোলনের তূর্যবাদক- দিনশেষে তা স্বীকার করতেই হয়।
************************************
![](https://monmanchitra.com/wp-content/uploads/2023/09/MonmanchitraSloganLogoBLK-01-300x132.png)