You are currently viewing একটি শৈল্পিক ধর্ষণ – সুবক্তগীন সাকী

একটি শৈল্পিক ধর্ষণ – সুবক্তগীন সাকী

মহামান্য পুলিশমন্ত্রী খাবার ঘরে বসে স্ত্রীর সাথে রাতের খাবার খাচ্ছেন, এবং স্ত্রীকে বলছেন, ‘ফুলেশ্বরীকে ডাকো, একসাথে খাই। শুনলাম মেয়েটি চলে যাচ্ছে।’

গুলশান আরা পুলিশমন্ত্রীর স্ত্রী। তাঁর চোখে মুখে সার্বক্ষণিক বিরক্তির ছাপ লেগেই থাকে। তিনি গম্ভীর ক্ষুধার্ত মুখে চিকেন ওরফে মুরগির ঠ্যাংয়ের টিকা কামড়াচ্ছেন। চিবোতে চিবোতে চাপা কণ্ঠে স্বামীকে বলেন, ‘তোমাকে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। ওদের লাই দিতে নেই।’ লে ঠ্যালা, সে বা ওরা কি কুকুর যে লাই দেওয়ার কথা উঠছে।

পুলিশমন্ত্রীর মুখে কিঞ্চিত ভীতি প্রকাশিত। স্ত্রী না আবার ভেবে বসেন তিনি মেয়েটিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এমনিতেই স্ত্রী সন্দেহ বাতিক। সুন্দরী মেয়ে বা নারীকে সহ্য করতে পারেন না মোটেও। মন্ত্রী অস্ফুট স্বরে বলেন, ‘তুমি কী করে যে মানবাধিকার নেত্রী হয়েছিলে?’ ভাগ্যিস মন্ত্রীর কথা স্ত্রী গুলশান আরার কান অবধি পৌঁছায়নি।

‘দেখো, মেয়েটিকে আমিই আবিস্কার করেছি,’ গুলশান আরা গর্বিত মুখে ফোঁস করে ওঠে, ‘সে কাল চলে যাবে। যাক। আমাদের কাজ হাসিল। দেখলে কেমন হই চই ফেলে দিলাম। গত দু’মাস ধরে আমাদেরকে নিয়ে কাগজগুলোর কেমন মাতামাতি, পাতা ভরে বিপুল প্রসংশা। মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়ে তোমাকে পুলিশের বড়ো মন্ত্রী বানালাম। আগে ছিলে পাতি, পরিচয় দিতে লজ্জা করতো, এখন ফুলমন্ত্রী, নিজেও কমিশনের সভানেত্রীর পদ বাগালাম। সবই আমার কৃতিত্ব। নেত্রী বলেছেন, আগামী ইলেকশনে তেঁতুলিয়া থেকে নমিনেশন দেবেন,’ কথাগুলো ঝট পট বলে, বুক ভরে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে, শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে, বিলম্বিতলয়ে বলেন, ‘মেয়েটি ভালোয় ভালোয় বিদায় হলেই বাঁচি।’

মন্ত্রী মহোদয় খাওয়া-দাওয়ার শেষ প্রান্তে এসে স্বীয় হাতের তালুর পর একে একে আঙুলগুলোয় তৃপ্তির শেষ চাটন দিতে দিতে বলেন, ‘ভাবছি, মেয়েটিকে আমার সহকারি করবো কি না। সহকারি একান্ত সচিবের পদটি খালিই আছে। সেখানে তাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে তোমার-আমার উভয়েরই ভাবমূর্তি আরো বাড়বে। কী বলো?’

স্বামীর পরিকল্পনাটি গুলশান আরা লুফে নেন। সন্দেহ, অবিশ্বাস পরেও করা যাবে স্বামীকে। মেয়েটি তাদের জন্য ভাগ্যফুল। ওর জন্যই তাঁদের এত উন্নতি। স্বামী ঠিকই বলেছেন। মাঝে মধ্যে মন্ত্রীর মাথাটা বেশ খোলে। এই মুহূর্তে স্বামীকে ধন্যবাদ দেন মনে মনে। এখন ফুলেশ্বরীকে পুনর্বাসন করা গেলে ভবিষ্যতে আরো উন্নতি হবে বলে মনে হয় তাঁর। এসব ভেবে তিনি খুশিতে চিৎকার করে ফুলেশ্বরীকে ডাকেন। তিনিই ফুলেশ্বরীকে আবিস্কার করেছেন। কে বা কারা অচেতন অবস্থায় ধর্ষিত ফুলেশ্বরীকে উত্তরার একটি হাসপাতালে ফেলে গিয়েছিলো। টেলিভিশনের প্রতিবেদন দেখে মিসেস গুলশান আরা ফুলেশ্বরীকে তুলে এনেছিলেন নিজেদের সরকারি বাড়িতে। এতে তাঁদের লাভ যশ সবই বেড়েছে ষোলো আনার চেয়ে আঠার আনা। আগে স্বামী ছিলেন প্রতিমন্ত্রী, ফুলেশ্বরী ঘটনার পর, এখন তিনি পুলিশের পূর্ণমন্ত্রী, এতদিন মিসেস গুলশান আরার কোনো সরকারি বা দলীয় পদবি ছিলো না, মাঝে মধ্যে বাচাল কথা বলে টেলিভিশন গরম করে বেড়াতেন, ফুলেশ্বরী উদ্ধারের পর, এখন তিনি তারকা হয়ে উঠেছেন বলেই-না নেত্রী খুশি হয়ে মানবাধিকারের সভানেত্রী করেছেন। ফুলেশ্বরী পুনর্বাসিত হলে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে নিশ্চিত উন্নতি ঘটবে, যা কেবল ধারনা নয়, সেটা অংক বা বিজ্ঞানের সূত্রের মতো খাপের খাপ মিলে যাওয়ার মতো মনে হয় তাঁর। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, অথবা সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ, কথাগুলো মিথ্যা বলার সাধ্য আছে কার। হন্তদন্ত হয়ে ফুলেশ্বরী মহামান্যের ভোজন টেবিলের কাছে এলে, মিসেস গুলশান আরা শাশ্বত জননীর স্নেহে বলেন, ‘মা ফুলেশ্বরী, কাল যাচ্ছো, যাও। কিন্তু কী করবে ভাবলে? অফিসের একান্ত সচিবের কাজ তোমার পছন্দ কি?’ মিসেস গুলশান আরা জানেন, যে কোনো কাজই ফুলেশ্বরী লুফে নেবে। কেনোনা, দাঁড়ানোর জন্য যেমন পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া চাই, চাকরি হলো তেমনি বেঁচে থাকার জন্য ঝুঁকিহীন নিশ্চিত নিরাপত্তা, পায়ের তলার সেই শক্ত মাটি।

ফুলেশ্বরীর মরু প্রান্তরে খানিকটা জলের ঝাপটা লাগে। তার চোখ মুখে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ।

পুলিশমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু কাজটি সহজ নয়, বেশ রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে হবে। ঝামেলাও কম নয়। আমার নির্বাচনী এলাকা থেকে আগত মানুষজনের সাথে ডিলিং করতে হবে। সেটাই শুধু না, অফিসে নানান কিসিমের মানুষজনের সাথে ওঠবোস করা বা তাদের সাথে আমার মিটিংয়ের অ্যারাঞ্জমেন্টও করতে হবে, অতিথিদের আপ্যায়ন তো আছেই। ইউজুয়্যালি সকাল এগারো-বারোটা থেকে মধ্যরাত নাগাদ কাজের ব্যাপ্তিকাল। কাজ তেমন কঠিন কিছুই না, সময়টা পার করাই হলো আসল কাজ। বেতন মাসে চল্লিশ হাজার, থাকা-খাওয়ার ভাতা আলাদা। চাকরিটা স্থায়ী নয়, আমাদের সরকারের মেয়াদকাল পর্যন্ত। অর্থাৎ আর মাত্র এক বছর’, বলেই তিনি ফুলেশ্বীর ঝলসে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কী পারবে?’

ফুলেশ্বরী আনন্দমুখর হয়ে বলে, ‘কবে নাগাদ যোগদান করা যাবে?’

মন্ত্রী বলেন, ‘কালই জয়েন করতে পারো। মনে রাখবা, ওনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। প্রয়োজন হলে আমাকে বলো, কিন্তু ডিজওনেস্ট হয়ো না। এন্ড রিমেম্বার, ডু নট ডিসিভ, ডন্ট বি ডিসিভ্ড।’

ফুলেশ্বরী বলে, ‘ইউ কুড বিলিভ ইন মি। আই উড কিপ মাই ওনেস্টি বাই ডিন্ট অব মাই ভারচু।’

ফুলেশ্বরীর মুখে ইংরেজি কথা শুনে মহামান্যরা বিস্মিত ও চমকিত হন। তাঁদের জানা ছিলো না মেয়েটির মেরুদন্ড এতখানি শক্ত। ভালোই হবে। মেয়েটি যেমন সুদর্শনা, তেমনি ইংরেজিতে পারঙ্গম। পরদিন ফুলেশ্বরী শেরেবাংলা নগরের কাঁটাবনের পাশে মধুবন নামক বাড়ির পুলিশমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অফিসে যোগদান করে। ভারী কাজ বলতে তেমন কিছুই না। সময়টাই খালি লম্বা। সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। তার প্রধান কাজ মন্ত্রী মহোদয়ের নির্বাচনী এলাকা থেকে আগত মানুষজন তথা পার্টির হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করা, তাদের খবরাখবর রাখা, আর টেলিফোনে অফিসের প্রতিদিনের হালচাল মন্ত্রী মহোদয়কে অবহিত করা। ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, চাকরিপ্রার্থী, হোমরাচোমরা, দলীয় মস্তান-ক্যাডার বা সমাজ বিরোধীদের সাথে মন্ত্রী মহোদয়ের সাক্ষাৎ বা আলোচনার ব্যবস্থা করাও তার কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ফুলেশ্বরীর আবাসিক ব্যবস্থাও মধুবনেরই বেসমেন্টে। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু সুন্দর। সাজানো গোছানো। বাড়িটি ন্যামফ্লাট সংলগ্ন হওয়ায় এই এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব জোরালো। ফুলেশ্বরী একজন ব্যস্ত ব্যাচেলর এখন। তার অফিসে আগত মনুষ্যপালের অধিকাংশই পুরুষ প্রজাতির। যারা সকলেই ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলাতে আসে এখানে, এবং কাকতালীয়ভাবে আগতদের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তদবিরের ফেরি করা। অতিথিরা এখানে ভারমুখে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আসে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। কেউবা তারও বেশি। কাজ হয়ে গেলে তারা হাসিমুখে ফিরে যায়। কী অব্যর্থ মহৌষধি মন্ত্রী বাহাদুর স্বয়ং! আজ পর্যন্ত কাউকে বিপন্ন মুখে ফিরে যেতে দেখা যায় নি। দর্শনার্থীরা চাতকের মতো মন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। কারা আসে এখানে? আসে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ভদ্র, অভদ্র, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর, শিক্ষক, ছাত্র, আমলা, চাকুরীজীবী, অবসরপ্রাপ্ত, সন্ডা গুন্ডা, খুনি, ধর্ষক, সমাজবিরোধি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, উঠতি ছাত্র-নেতা, চাকরি সন্ধানী বেকার আকার সাকার। সারাদিনের অপেক্ষার পর মন্ত্রীর দর্শন পেলে দর্শনার্থীদের ভারনত ক্লান্ত মুখ দোয়েল বুলবুলির মতো খুশিতে নেচে ওঠে। অদর্শনে হতাশ হয় না কেউ। পরের দিন আবার তারা ধর্ণা দেয়, এবং কোনো এক সময়ে মন্ত্রীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়ই হয়। বাঙালি যে প্রচন্ড আশাবাদী তা কি কারো অজানা। ফুলেশ্বরীর টেবিলে মাত্র দু’টি ফাইল। আর সাদা, কালো ও লাল রঙের তিনটি বাচাল টেলিফোন। বেশির ভাগ সময় তাকে টেলিফোনেই কাটাতে হয়। প্রতিদিনই তাকে জী, হ্যাঁ, না, আচ্ছা ইত্যাদি শব্দ হাজার বার উচ্চারণ করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা নোট বইয়ে টুকে রাখা, আগতদের অলস অথবা ফালতু প্রশ্নের উত্তর দেয়া, নয়তোবা মন্ত্রীর নির্দেশ মতো বিভিন্ন অফিস বা মহলে ফোন লাগানো তার কাজের অন্যতম বাধ্যতামূলক অংশ। ফুলেশ্বরীর মধুবনে মহামান্য পুলিশমন্ত্রী দৈনিক বার দুয়েক পদধুলি দেন, যদি তিনি ঢাকায় থাকেন। তবে রাত দশটার দিকে মন্ত্রী প্রায়ই আসেন সেখানে। মন্ত্রী মহোদয় মধুবনে এলে অফিস ঘর বর্ষার জলোচ্ছ্বাসের মতো চ ল হয়ে ওঠে। তখন ফুলেশ্বরীকে মহামান্যের পাশে বসা ছাড়া তেমন কিছুই করার থাকে না। মহামান্যের নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যাপার স্যাপার যন্ত্রসজ্জিত খাঁকি পোশাকধারীরাই সামাল দেন। কিন্তু এত লম্বা সময় টানা কাজ করা ফুলেশ্বরীর ভালো লাগে না। অল্প দিনেই চাকরির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। সবাই কেমন ড্যাব ড্যাব চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকে ফিসফিস করে, ‘সেই মেয়েটি’ বলে। ফুলেশ্বরী কান পেতে শোনে না শোনার ভঙ্গিতে।

মহামান্য মন্ত্রী মধুবনে আজ কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটায় উপস্থিত হলেন। প্রতিদিনের মতো অর্থহীন ক্লান্তির সাথে বিজয়ের আনন্দ তাঁর চোখে মুখে পোশাকে লেগে আছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে পরিবেষ্ঠিত হয়ে তিনি দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন হল ঘরের দিকে। পিছু পিছু ছুটে চলেছেন নাছোড় ক’জন টেলিভিশন সাংবাদিক। তিনি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িটির নির্দিষ্ট ঘরের রাজকীয় রিভলভিং আরাম কেদারায় ধপাস করে বসে গা এলিয়ে দিলেন, এবং অতঃপর হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। ফুলেশ্বরী হলুদ রঙের ফাইলের পাতা উল্টিয়ে মহামান্যের সামনে মেলে ধরে। মন্ত্রী মহোদয় আনমনে তাতে অলস দু’চোখ বুলিয়ে ঘস ঘস করে আট-দশটিতে সই করলেন। আর এতেই আগন্তুকদের ক্লান্ত শুষ্ক ঠোঁটে এক চিলতে হাসির আভা ঝিলিক খেলে যায়। মন্ত্রী মহোদয় মধুবনের অফিসে আধ ঘণ্টাকাল ব্যয় করার পর সকলের উদ্দেশে গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আজকে আমার অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে, আপনাদের আর সময় দিতে পারবো না বলে দুঃখিত। আপনারা কাল ছয়টার পরে আসবেন।’ নেতা-কর্মীদের কাউকে ফিসফিসিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘এই গুমারে ছুইটার পামু কনে?’ আমরাও বুঝতে পারি না, মন্ত্রী সাহেব অতিথিদের পরের দিন সন্ধে ছ’টার পর, নাকি ভাদ্র মাসের গরমের মধ্যেও সকলকে সোয়েটার গায়ে দিয়ে আসতে বলেছেন।  অন্যরা টু শব্দটি করে না। বাধ্য গৃহপালিত পোষা প্রাণীর মতো ফিরে যায়। তবুও মধুবনে থেকে গেলেন জনাদশেক হোমরা-চোমরা, যাদের আসা যাওয়া কখনো শেষ হয় না। এরা কারণে অকারণে প্রতিদিন আসে মন্ত্রীসমীপে। সরকারের শেষদিন পর্যন্ত এরা আসতেই থাকবে। এমনকি ভিন্ন মতাদর্শের সরকার ক্ষমতাসীন হলেও তারা লেবাস বদল করে আসতেই থাকবে। মন্ত্রী মহোদয় আসা-যাওয়াঅলাদের বিদায় বেলায় প্রত্যেককে একটি করে হলুদ খাম হাতে ধরে দিলেন। ফুলেশ্বরী জানে, খামের মধ্যে কি আছে।

দৈবাৎ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মোবাইল বেজে ওঠে। তিনি পুলকিত মনে ফোনটি ধরলেন, এবং বলেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। চলে আসুন। আপনারা ক’জন? নো প্রবলেম। আমিই তো সমাধান করি সব সমস্যা। অনলি মাই কিউট এপিএস উইথ মী। বাকিরা চলে যাচ্ছে।’ কথা শেষে তিনি মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে সবাইকে বলেন, ‘তোমরা আজকের মতো যাও। আমার জরুরি মিটিং আছে। ওরা আসছে। আই মিন দে আর অন দ্য ওয়ে। সো ইউ গায়িস মাস্ট লিভ দিস প্লেস ইমিডিয়েট।’ হোমরাচোমরারা হাসিমুখে চলে যায় আগামীকাল আসবে বলে।        ফুলেশ্বরী ক্লান্ত। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ফ্লাটে চলে যাওয়ার জন্য বসের অনুমতি প্রার্থনা করলে, ‘মন্ত্রী বলেন, তোমার তো এখানেই বাস। তোমার আবার চলে যাওয়া কীসের? থাকো প্লিজ। পুষিয়ে দেবো।’

ফুলেশ্বরী কথা বাড়ায় না। কিছু বলতে ইচ্ছাও হয় না। পোষা কুকুরের মতো মনিবের পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।

মন্ত্রী ফুলেশ্বরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দাঁড়িয়ে কেনো? বসো।’

ফুলেশ্বরী বসে।

মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কয়েকজন ভি আই পি গেষ্ট আসছেন। দে আর অন দ্য ওয়ে। এ্যানি মোমেন্ট দে উইল বি হিয়ার। দু’জন সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী, একজন আমলা, একজন সাবেক জেনারেল, দু’জন শিল্পপতি রাজনীতিক ও একজন বিরোধী দলের প্রভাবশালী বিপ্লবী রয়েছেন সেই টিমে। ওদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে বসতে হবে। তুমি না থাকলে চলে কেমনে। অ্যাট লিস্ট তুমি ওদের অভ্যর্থনা বা আপ্যায়নটা করতে পারো। প্লি জ হেল্প এন্ড সেফ মী আউট।’

ফুলেশ্বরী বসের অনুরোধকে আদেশ মনে করে থেকে যায়।

ভিআইপিদের গাড়ির অহেতুক ভেঁপু বা যান্ত্রিক শব্দ নীরব রাতের স্নিগ্ধতা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। হেডলাইটের ঝলসানো তীব্র সাদা আলো দৃষ্টিনন্দন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অলস কৃত্রিম হ্রদের স্থির জলে পড়ে জলকে আরো উজ্জল করে তোলে। হ্রদের কিনারা ঘেঁষে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ভীরু চাইনিজ লাল কাঁকড়ার দল, কোরিয় ব্যাঙ ও বোস্তামি ঢাউস কচ্ছপগুলো জলের সাথে ঝিকমিক করে। মন্ত্রী মহোদয় ফুলেশ্বরীকে সাথে নিয়ে অতিথিদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে এলেন। আগন্তুকেরা গোল টেবিলের চারদিকে ঘিরে বসলেন। ফুলেশ্বরীকে ‘হেড অব দ্য টেবিলে’ বসে থাকা পুলিশমন্ত্রীর বাঁ পাশে বসতে দেওয়া হলো। ফুলেশ্বরীকে খানিকটা সংকুচিত দেখায়। অতিথিরা পুলিশমন্ত্রীর সাথে ব্রিফকেস বদল করে উল্লাসে ফেটে পড়েন। মন্ত্রী একটি সুদৃশ লাল প্যাকেট ফুলেশ্বরীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এটা তোমার জন্য। দেশের প্রধান ভূস্বামী, খ্যাতিমান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও বিশুদ্ধধারা গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজের সম্মানিত কর্ণধার, যিনি বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিক-আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন গোখরো সাহেব ফ্রান্স থেকে এনেছেন তোমার জন্য।’

আলীমুদ্দিন গোখরো সাহেব সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন ফুলেশ্বরীর দিকে।

পুলিশমন্ত্রী হাসতে হাসতে ফুলেশ্বরীকে ‘রাখো’ বলেন। ফুলেশ্বরী বিব্রত বোধ করলেও, উপহারটি যত্ন করে পার্সের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে। চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মনে হয় তাকে। সে বোধ হয় কিছুটা ভীত অথবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশমন্ত্রী বলেন, ‘কী হলো ফুলেশ্বরী, হাত মেলাও। ওনারা আমার কাছের মানুষ, খুব আপনজন।’

ফুলেশ্বরী আলীমুদ্দিন গোখরোর সাথে করমর্দন করে।

আলীমুদ্দিন গোখরো ফুলেশ্বরীর কোমল হাতে হাত রেখে মৃদু করে ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে, ‘তোমার মতো সুন্দরী কমলার দরকার বাঙলার প্রতিটি অফিস আদালতে। তাহলে মেহমানদারি, জনসেবা আর ব্যবসা সবই হবে কড়াগন্ডায়। কী বলো,’-বলেই প্রবলভাবে হাসতে থাকেন। ফুলেশ্বরী কেঁপে ওঠে। ভেতরে তার নীরব চিৎকার, নিঃশব্দ রোদন। এমন সময় পুলিশমন্ত্রীর দু’জন খিলজি চারজন মাংসল বঙ্গ-সুন্দরীদেরকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢোকে। মহামান্যরা করতালি ও হর্ষধ্বনিতে নতুনদের অভিবাদন জানায়। সুন্দরীগণ মহামান্যদের ফাঁকে ফাঁকে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে। স্বচ্ছ শাড়ি পরা সুন্দরীদের নাভি বা শরীর বা বুকের মাখনের মতো মসৃণ মাংস স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নীল আলো জ্বলে উঠলে শুরু হয় পাশ্চাত্যের আদলে বঙ্গীয় ঝড়ো রক সঙ্গীত। বোতল বা গেলাশের টুং টাং শব্দে মুখরিত চারপাশ। এতে রাতের মসৃণ পরিবেশ ভেঙে গেলেও কার বাপের কি। এরূপ পরিবেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেগে ওঠে মহামান্যদের শরীরের স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়সমূহ। সবাই পান করছেন, দেদারচে, আর চিবিয়ে চলেছেন দেশীয় মুরগির সুস্বাদু বারবিকিউ। রঙিন জলের কোমল বৈঠকি আড্ডায় মাংসের সাথে মাংসের সাদৃশ্য বড়ই চিত্তাকর্ষক, খুবই মোহনীয়। কিন্তু ফুলেশ্বরী সেসব পান করছে না, এমনকি স্পর্শও। কেউ খাবে কেউ খাবে না তা কি হয়? শক্তিধর সাবেক মহামান্য জেনারেল নিজের বোতল থেকে আধ গেলাশ ভদকা ফুলেশ্বরীর মুখে এক প্রকার জোর করেই ঢেলে দিলেন। বর্ষার নদীর স্রোতের মতো কলকল করে উঠলেন সবাই। অতিথিরা, পুলিশমন্ত্রী মহোদয় নিজে, কিংবা খিলজিরা সবাই বোতলের পর বোতল খালি করতে থাকেন। সবাই গিলছে পেগের পর পেগ, কেউ ডাউন হচ্ছে না। কিন্তু ফুলেশ্বরীর ভেতরটা ডাউন হয়ে আসে, বুকের গহীনে হাহাকার করে ওঠে বিস্তীর্ণ চরের বালুকারাশির মতো। যেহেতু আরও চারজন নারী রয়েছে সেখানে, সেহেতু কোনো রকম অঘটন ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয় মনে মনে সে। তাছাড়া উপস্থিত সবাই দেশ ও সমাজের দায়িত্বশীল, এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু পেটে মাল পড়লে যে সবাই নিজেকে প্রতাপশালী সম্রাট ভাবে, আর অবশিষ্টদের মনে করে শূদ্রর প্রজা, সে কথাইবা ক’জনে জানে। যে জানে না সে বোধ হতভাগ্যের চেয়ে বেশি কিছু। মহামান্যরা চার উর্বশীর শরীর থেকে শাড়ি খুলে নিলেন। উর্বশীরা আনন্দে পুলকিত, উল্লাসে ঝরণাধারার মতো মাতোয়ারা। সুন্দরীরা তাদের উদোম বুক দোলাতে দোলাতে মহামান্যদের সাথে ডিসকো নাচ নাচতে থাকে। ঝড়ো সঙ্গীত এবার সুনামির মতো বেপরোয়া আরো। মধুবনে এখন শুধুই মাংসের তুফান বইতে থাকে। আলিমুদ্দিন গোখরো একে একে উর্বশীদের শরীর থেকে অন্তর্বাস খুলে নিচ্ছেন। মহানন্দে উর্বশীরা বুক উচিয়ে, কোমর দুলিয়ে, পাছা ফুলিয়ে, ময়ুরপঙ্খীর মতো ডানা মেলে আরো দুরন্ত বেগে নাচতে থাকে। আর মহামান্যরা উর্বশীদের মাংসের ভেতরে বিপুল বিক্রমে ঢুকতে, এবং বেরোতে থাকেন। ফুলেশ্বরীর চোখে মুখে ভীরুতা ও ক্ষোভের সংমিশ্রিত গভীর ছাপ। সহ্য করতে পারে না এসব। লজ্জায়, রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে পাশের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে দেয়। সাবেক জেনারেল ও গোখরো সাহেব অলরাউন্ডার। বেশ ক’টি চার মারের পর ফুলেশ্বরীকে খুঁজতে থাকেন ছক্কা হাঁকার জন্য। আশপাশে ফুলেশ্বরীকে না পেয়ে তাঁরা বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। ফুলেশ্বরী ভীত সন্ত্রস্ত। সম্ভ্রম বাঁচাতে সে খাটের নিচে লুকায়। শক্তিমানেরা সেখান থেকে তাকে ধরে এনে খাটের ওপর শোয়ায়, এবং তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাত্তরেও তাঁরা এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বহু ফুলেশ্বরীকে বিরঙ্গনার খেতাব এনে দিয়েছিলেন! মহামান্যরা দ্রৌপদীর মতোন করে ফুলেশ্বরীকে বস্ত্রহীন করে, এবং কামনার হিংস্র নিঃশ্বাস, ঠোঁট আর আঙুল দিয়ে তার শরীরের ওপর যেমন খুশি তেমন করে বিচরণের চেষ্টা চালায়। ফুলেশ্বরী নরকের যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে থাকে। রোদন করে। ক্ষতবিক্ষত হয় দানবের নখের আঁচড়ে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে প্রায়। তবুও বিদ্রোহ করতে থাকে। সে বসের সাহায্য কামনা করে। “বাঁচাও, বাঁচাও” বলে আর্তনাদে কাঁপতে থাকে। অবশেষে বিধাতার আশীর্বাদে মহামান্য পুলিশমন্ত্রী ফুলেশ্বরীকে হায়েনাদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ভেতরের একান্ত ঘরে। ফুলেশ্বরী তখনও বিবস্ত্র। মন্ত্রী ফুলেশ্বরীকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। এ যেনো বিধাতার প্রেরিতজনের বুকে ফুলেশ্বরীর নিরাপদ আশ্রয়। ফুলেশ্বরীর ভয় কাটে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার চেষ্টা করে। সম্ভ্রমহানী থেকে বেঁচে যাওয়া ফুলেশ্বরী আনন্দে কাঁদে। মন্ত্রী ফুলেশ্বরীকে অভয় দেন। ফুলেশ্বরী দু’হাত দিয়ে লজ্জা স্থান ঢেকে আড়ষ্ট গলায় উচ্চারণ করে, ‘আমার শাড়ি!’

মন্ত্রী জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলেন, ‘দরকার কী? আমি তো আছি। আমিই তোমার শাড়ি।’

ফুলেশ্বরী কেঁপে ওঠে। তার হৃৎযন্ত্র হিম-শীতল যেনো, বিকল হওয়ার উপক্রম। রক্ষকই কি তবে ভক্ষক! ঘরের শত্রু বিভীষণ!

মন্ত্রী বৃথা বাক্য ব্যয় না করে ফুলেশ্বরীর ভেতরে দোর্দন্ড প্রতাপে ঢুকতে থাকেন। ফুলেশ্বরী চিৎকার করে। সেই চিৎকারের ধ্বনি বেশি দূর এগোতে পারে না। সঙ্গীতের ঝড়ো পরিবেশে মুখ থুবড়ে পড়ে চার দেয়ালের শব্দ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে। ফুলেশ্বরী শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে মন্ত্রীর শরীরের তল থেকেই বিদ্রোহ করতে থাকে, কিন্তু পশুশক্তির সাথে পেরে ওঠে না। অবশেষে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে ফুলেশ্বরী খোপা বাঁধা ধাতব ‘চপষ্টিক’, যা সে পুলিশমন্ত্রী কর্তৃক উপহার পেয়েছিলো কিছুদিন আগে, তা-ই দিয়ে মন্ত্রীকে আঘাত করে। কিন্তু আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঢুকে যায় মন্ত্রীর ষাঁড়ের মতো ঝুলানো অন্ডকোষের ভেতরে। চিৎকার করে কোঁকাতে থাকেন শক্তিমান পুলিশমন্ত্রী। অতিথিরা বিস্মিত হন চিৎকারের পট পরিবর্তনে। কিছু বুঝে উঠতে পারেন না তাঁরা। পুলিশমন্ত্রী দু’হাত দিয়ে অন্ডকোষের ক্ষত স্থান চেপে ধরে আছেন। তাঁর দু’হাত বেয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। ভীত ফুলেশ্বরী দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, এবং বৈঠক ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়িটি কুড়িয়ে দ্রুত শরীরে পেঁচায়। পুলিশমন্ত্রী তখনও মেঝেতে পড়ে কোঁকাচ্ছেন। অবশিষ্টরা শশকের মতো ব্যস্ত হয়ে ছুটে যান সেখানে। রক্তাক্ত মন্ত্রীকে ছটফট করতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। আক্রান্ত রক্তভেজা মন্ত্রীকে তাঁরা দ্রুত, এবং গোপনে ঢাকার বিষেশায়িত একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এবং তারপর তাঁরা ফুলেশ্বরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। ফুলেশ্বরী জ্ঞান হারায়। মহামান্যদের শরীরে বিস্তর দয়া-মায়া। তাই বোধ হয় ফুলেশ্বরীকেও তাঁরা আরেকটি হাসপাতালে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন। এবং নিজেদের মধ্যে পরবর্তী করণীয়, প্রয়োজনীয় আলাপচারিতা সারেন।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশটির সবকিছুই ওপেন-সিক্রেট। দেশের খোদ পুলিশমন্ত্রী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিষয়টি চারদিকে চাউর হয়ে পড়ে। এ সবই মিস্টার জাকারবার্গের কৃতিত্বে সম্ভবত। তাঁর ডিজিটালি বুকে বাংলার সহজলভ্য রূপসী মুখ না দেখা গেলে, সেসব এত সহজে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। উৎসুক জনতা, রাজনীতিক, শুভাকাক্সক্ষী, শুভানুধ্যায়ী, অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকেরা হাসপাতালে ভিড় করেন। স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইউটিউব, ফেসবুব-টুইটারের বদৌলতে দেশবাসী মহামান্য পুলিশমন্ত্রীর আহত হওয়ার খবর দ্রুতই অবগত হয়। কিন্তু অজানাই রয়ে যায় কে বা কারা কখন কীভাবে তাঁকে আহত করেছে? কি ঘটেছিলো সেদিন?

ফুলেশ্বরী হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুশয্যায় কাঁতর। তরুণী ডাক্তার মেহজাবিন কল্পনার তত্ত্বাবধানে ফুলেশ্বীর জ্ঞান ফেরে ঘটনার দু’দিন বাদে, সন্ধ্যে নাগাদ। পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো তার, তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা। ডাক্তার মেহজাবিন ফুলেশ্বরীকে আশ্বস্ত করে, দু’তিন দিনেই ব্যথা দূর হবে, এবং সুস্থভাবে চলাফেরা করতে পারবে। ডাক্তার মেহজাবিন ফুলেশ্বরীর শিয়রে বসে ফুলেশ্বরীর মাথায় হাত বুলিয়ে, প্রয়োজনীয় ঔষধের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে, ব্যথানাশক এন্টিবায়োটিক নিজ হাতে খাইয়ে দেয়, এবং সেই সাথে ইনজেকশনও করে শরীরে। ফুলেশ্বরীর চোখ বেয়ে ফাগুনের ধারা ঝরে পড়ে। মেহজাবিন  মাতৃস্নেহে তা মুছে দেয়। ফুলেশ্বরী ভেজা গলায় ডাক্তার মেহজাবিনকে বলে, ‘আমি হয়তো বাঁচবো না। চারদিকে হায়েনাদের হিংস্র থাবা। আমি ভয়ের মধ্যে বেঁচে আছি লাশ হয়ে। যে কোনো সময় গুম হয়ে যেতে পারি।’

মেহজাবিন কল্পনা ফুলেশ্বরীকে কথা বলতে বারণ করে। এ সময় বেশি কথা না বলাই ভালো। আবেগ বা উত্তেজনা যথাসম্ভব পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। তবুও ফুলেশ্বরী ধীর শান্ত গলায় সেদিনের কালরাতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলে। ডাক্তার মেহজাবিন সব শুনে অস্ফুট আর্তনাদ করে।

জাপান-আমেরিকার যৌথ বিনিয়োগে বুড়িগঙ্গার তীরে যে বিশাল অত্যাধুনিক  হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, তার আশপাশে রোগি বা তাদের প্রকৃত স্বজন দু-একজন ছাড়া তেমন কাউকেই এতদিন চোখে পড়তো না, কিন্তু ফুলেশ্বরীকান্ডের পর, হাসপাতালের চারপাশে এখন অজস্র পেশীশক্তির সমাবেশ দৃশ্যমান হয়। মেহজাবিন কল্পনা ফুলেশ্বরীর চিকিৎসার চেয়েও ফুলেশ্বরীর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ওপর থেকে নির্দেশ আসে ফুলেশ্বরীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খালাস করে দেয়ার। অথচ ফুলেশ্বরীর আরো সপ্তাহ খানেক নিবিড় পরিচর্যায় থেকে চিকিৎসা করা জরুরি ছিলো। মেহজাবিন তার অফিস প্রধান ও আরো দু-একজনের সাথে সলা-পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়, ফুলেশ্বরীকে নিজের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করানোর। তিনদিন পর, মেহজাবিন কল্পনা ফুলেশ্বরীকে হাসপাতাল থেকে খালাস দিয়ে নিজের বাড়িতে রাখে। যা শুধু বাড়ির লোকজন বা আস্থাভাজন দু-একজন ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ জানে না। মেহজাবিনের বাবা-মা ও তার আরও দু’টি ভাই ফুলেশ্বরীকে খুব খাতির-যত্ন করে। ফুলেশ্বরী যেনো তাদের বাড়িরই আরেকটি মেয়ে হয়ে ওঠে।

এ ক’দিনে মহামান্য পুলিশমন্ত্রী মহোদয় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মাঝখানে তিনি চার্টার বিমানে করে ভিনদেশে উড়াল দিয়ে আরো উন্নত চিকিৎসা করিয়েছেন। দেশের মানুষও বেমালুম ভুলে গেছে মন্ত্রী মহোদয়ের আহত হওয়ার খবর। এদেশ বড়ই বিচিত্র! অল্পতেই ফুঁসে ওঠে, আবার সহজেই দমে যায়।

মেহজাবিনের সাংবাদিক বন্ধু আগুন মাহমুদ দৈনিক প্রলেতারিয়েতের অনুসন্ধানী মেধাবী রিপোর্টার মেহজাবিনের ফোন পেয়ে ছুটে আসে মেহজাবিনের বাড়িতে। জানতে পারে ফুলেশ্বরীর জীবনে ঘটে যাওয়া অঘটনাদির আদ্যোপান্ত, ফুলেশ্বরীর ধর্ষিত হওয়ার উপাখ্যান। আগুন ফুলেশ্বরীর মুখে সেদিনের রাতে ঘটে যাওয়া অঘটনের বর্ণনার প্রয়োজনীয় অংশ কাগজে টুকে রাখে, এবং কথোপকথন শব্দযন্ত্রে ধারণ করে। সে বাড়ি ফিরে রাত জেগে জেগে ফুলেশ্বরীর ধর্ষণ সংক্রান্ত অঘটনের প্রতিবেদন তৈরি করে। খবরটি সে দৈনিক প্রলেতারিয়েতের পাতায় প্রধান শিরোনাম করে সংবাদ ছাপাতে চায়, কিন্তু সম্পাদক রাজি হন না। পরে না সরকারের হিংস্র থাবায় পড়ে পত্রিকাটিই বন্ধ হয়ে যায়! প্রগতিকেও কখনো কখনো বশ্যতা স্বীকার করতে হয় প্রতিক্রিয়াশীলের কাছে। তবুও, আগুন নিভে যাওয়ার পাত্র নয়, জ্বলতেই থাকে। নাতিদীর্ঘ খবরটি ছাপে ‘লেজকাটা পুলিশমন্ত্রীঃ আদিম বর্বর কাহিনি’ নামে ছোট শিরোনামে। ফুলেশ্বরীর ধর্ষণের রাতে ঘটে যাওয়া সব কিছুর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণসহ ধারাবাহিকভাবে কাগজে তুলে ধরা হয়। খবরটি ভিন্ন মাত্রা পায়, তুমুল জনপ্রিয় হয়, ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে পড়ে, এবং খবরের কাটিং, সে সংক্রান্ত মতামত, সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকায়, টেলিভিশন চ্যানেল, মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, জরিপ প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গণসংগঠন, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল সমূহের কার্যালয় ও আদালতে পাঠানো হয়; সেই সাথে ফুলেশ্বরীর সাক্ষাতকারের অডিও-ভিডিও ক্লিপও। দেশব্যাপী ব্যাপক হই চই পড়ে। সরকার নিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো সরকারি চাপের মুখে ফুলেশ্বরীআখ্যান সম্প্রচার না করলেও, ফেসবুক টুইটার ইউটিউবে ভাইরাল হয়। দেশবাসী বিস্ময়ে হতবাক, বিবেকি মা-বোন-ভাইয়েরা বেদনায় নীল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। প্রগতিশীল সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, রাজনৈতিক কর্মীরা ধিক্কার জানায় মিছিল গণসংযোগের মধ্য দিয়ে। দেশে হচ্ছেটা কী? রক্ষক কি না ভক্ষক! ছি, ছি, খোদ পুলিশমন্ত্রী এত খারাপ! ফুলেশ্বরীর ধর্ষণ সংক্রান্ত খবরটি বিশেষ মাত্রা নিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, লঞ্চ , বাস, হাটে, মাঠে, ঘাটে, মুদিদোকান, চা’র স্টল, মন্দির, গীর্জা, পবিত্র ঘর, সংসদ, গুহা, পানশালা বা সাধারণের ঘরে ঘরে আলোচিত হতে থাকে। প্রগতিশীলেরা, নারীবাদীরাও  মানববন্ধন বা জনসংযোগ করে ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। আর বুদ্ধিজীবীগণ শুধু বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন, এর বেশি তাঁরা কোনো কালেই এদেশে কিছু করতে পেরেছেন কি? অন্যদিকে, দৈবাৎ বিধাতার প্রেরিত স্বর্গীয় ইস্যু পেয়ে বিরোধী দল ভোরের জল কুমুদের মতো চাঙ্গা হয়ে ওঠে; দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর সংসদে আবার তাঁরা তেজি মূর্তিতে আবির্ভূত হন, দাবি তোলেন, ফুলেশ্বরীর ধর্ষণের সংসদ ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচারের।

সাংবাদিক আগুন সতর্কতা ও সাবধানে ফুলেশ্বরীকে হাজির করে বিবিসি টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সিপিবি বা কর্পোরেশন ফর পাবলিক ব্রডকাস্টিংয়ের সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে। সেখানে ফুলেশ্বরী অকপটে সব কথা বলে, সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়, সেদিনের কালরাতে মহামান্যগণ কর্তৃক তার শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে পুলিশমন্ত্রীর কীর্তিকলাপ সে যতটুকু জানে সব প্রকাশ করে; বলতে দ্বিধা করে না মন্ত্রীর স্ত্রী মানবাধিকার নেত্রী গুলশান আরা’র জঙ্গিবাদ ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে সম্পৃক্ততার খবরও, মন্ত্রীর বাড়িতে আশ্রিতা থাকাকালীন ফুলেশ্বরী ওসব কুকীর্তি জেনে গিয়েছিলো। মন্ত্রীর গোপন কারবার বা বেপরোয়া গণবিরোধী কার্যকলাপ ফাঁস হওয়ায়, দেশের আপামর মানুষ বিস্ময়ে হতবাক, ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশব্যাপী পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবির আওয়াজ ওঠে, এবং তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করা ও গ্রেফতারের দাবি জনরোষে, জনদাবিতে পরিণত হয়।

ক্ষমতাসীনরাও বসে বসে আঙুল চোষার পাত্র নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের দলীয় ভাবমূর্তি, এবং পুনরায় ক্ষমতায় ফেরা বা না-ফেরার ভাগ্যপ্রশ্ন। ঘিলুহীন সরকারের বুদ্ধিহীন অথচ চৌকস বুদ্ধিমান বলে পরিচিত বাহিনি কর্তৃক সব জেনে শুনে বুঝে, তাদেরই বিশেষ সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দারা শায়েস্তা করতে গুন্ডা লেলিয়ে দেয় সাংবাদিক আগুনের পিছে। কি স্পর্ধা এই তুচ্ছ পামরের! বিষাক্ত সাপের লেজে পা দিয়ে মস্তক থেকে মুক্তো কুড়াতে চায়। সরকারি ও সিভিলিয়ান খিলজিরা দৈনিক প্রলেতারিয়েতের অফিস গুড়িয়ে দেয়, প্রেসে আগুন ধরায়, এবং আগুনকে খুঁজে বের করে তার হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে বিদেশে পাঠিয়ে আবার তাকে চিকিৎসাও করিয়ে আনে। সব কিছুই কেমন নাটকীয়, উপভোগ্য, এবং বিস্ময়কর বলে মনে হয়। অবশেষে ফুলেশ্বরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে, কোনো এক বর্ষণমুখর জোনাকি রাতে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ডাক্তার মেহজাবিনের বাড়ি তল্লাশি করে ফুলেশ্বরীকে ধরে নিয়ে যায়। খবরের ছাড়পত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রন বলবত থাকার পরও, ইন্টারনেট বা ফেসবুকি কল্যাণে খবরটি রটে যায় দেশব্যাপী। দেশের প্রতিটি শহর-গঞ্জের প্রতিবাদী মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, যেনো প্রতিবাদের আষাঢ়ি ঢলে প্লাবিত সমগ্র বাঙলাদেশ। প্রগতিশীলেরা ফুলেশ্বরীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। প্রতিটি থানা ও জেলা সদরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়। সকলের অভিন্ন দাবি, ফুলেশ্বরীর নিঃশর্ত মুক্তি, পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলার সংসদ ও বিচার বিভাগীয় যৌথ তদন্ত কমিশন, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, এবং সমগ্র বিচারিক কার্যক্রম সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারে ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এতেও সরকারের টনক না নড়ে, এবং অনেক জায়গায় সহিংস ঘটনা ঘটতে থাকায়, দিন দুয়েক বাদে, মাননীয় উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফুলেশ্বরীর ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা আমলে নিয়ে সংসদ, স্পীকার ও সরকার প্রধানকে এতদ্বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের অধীনে সংসদ ও বিচার বিভাগীয় স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন, বিচার কার্যক্রমের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন নিশ্চিতকরণসহ দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করা, এবং বিচারিক কার্যক্রম দেশের সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচারেরও বিধান রাখার আইন জারি করেন। আদালতের এমন নজিরবিহীন, এবং সময়পোযোগি সিদ্ধান্তসমূহ দেশের সমস্ত প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়, এবং জাতীয় সংসদেও আদালতের নতুন বিধানের অনুলিপি পাঠানো হয়। সরকার গণমানুষের গণদাবি ও প্রবল চাপের মুখে বিজ্ঞ আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ মেনে নিলেও, জলজ্যান্ত মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও খুঁজতে থাকে; বুদ্ধি-পরামর্শ ফেরি করতে থাকে স্ব-ঘরানার বুদ্ধিজীবী, উপদেষ্টা বা সভাপতিমন্ডলীর কাছ থেকে। তারপর কি না কি ভেবে সরকার খানিকটা দ্রুতার সঙ্গেই গঠন করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। এছাড়া দ্বিতীয় পথও আর খোলা ছিলো না সামনে। দেশব্যাপী আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ, এবং সরকার কর্তৃক সে সব সিদ্ধান্ত সমূহের বাস্তবায়নের পদক্ষেপের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে, আমজনতা আদালতের ভূয়সী প্রশংসা, এমনকি সরকারি সিদ্ধান্তের সাধুবাদ জানাতেও কার্পণ্য করে না। আন্দোলনের মাধ্যমে চাপে ফেলে সরকারকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তে সরকারের নৈতিক পরাজয় ঘটে বলে মানুষজন মনে করে। এতে জনতার বিজয়, এবং সরকারের পরাজয়ের খবরের যে আনন্দ, সে আনন্দের বহি:প্রকাশ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকাশ্য রাজপথে ফাটাতে না পারলেও ফেসবুকে ফাটতে থাকে। বিক্ষোভে, বিপ্লবে লাল হতে থাকে ফেসবুকের পাতার পর পাতা।

তদন্ত কমিটি বিস্তর খেটেখুটে তদন্তের ফলাফল তিন দিনের মাথায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর পেশ করেন, এবং চতুর্থতম দিনে ফুলেশ্বরীর ধর্ষণ মামলার কার্যক্রম বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। যে বাড়িতে, পুলিশমন্ত্রীর মধুবনে, ফুলেশ্বরীর শ্লীলতাহানী করা হয়েছিলো, জনতার দাবি ও আদালতের নির্দেশে সেই বাড়িটিই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। বাংলার মানুষ কি না পারে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে পারে, জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে, প্রতিরোধ গড়তে পারে, স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারে, নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীন দেশ গড়তে পারে; এবং তারপরও, বাঙালির অজস্র চাওয়া পাওয়া অপূর্ণই রয়ে যায়।

পুলিশমন্ত্রীর ধর্ষিত মধুবনের বাড়িটি এখন নতুন পবিত্র আদালত। এ এলাকা এমনিতেই সুরক্ষিত। সাধারণের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ সীমিত। তার ওপর স্পর্শকাতর ধর্ষণ মামলার বিচারিক কার্যক্রমের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মর্যাদাপ্রাপ্ত হওয়ায় নিরাপত্তা বলয় আরো কড়া করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে টেরিস্টেরিয়াল টেলিভিশনের টাওয়ার ও রিলে করার যাবতীয় যন্ত্রপাতি সংস্থাপন করা হয়েছে, দেশব্যাপী সরাসরি সম্প্রচার নির্বিঘ্ন করার প্রত্যয়ে। এসব যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বরাবরের মতো প্রকৃত দামের চেয়ে দু-তিনশ গুন বেশি খরচ দেখানো হলেও, বাঙালির কিছু করার থাকে না, কেমন যেনো গা সহা হয়ে গেছে। তবুও মন্দের ভালো যে, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার সুযোগ জাতির সামনে হাজির হয়েছে। প্রতিদিন বিরতিহীনভাবে দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আদালতের কার্যকম চলতে থাকে। ছুটির দিনে ও মুসলমানের জুম্মার নামাজের পরেও আরো তিনঘণ্টা করে আদালত সচল থাকে। বিচারকালীন সময় পুরো শেরেবাংলা নগর প্রতিবাদী উৎকণ্ঠিত আমজনতা ঘিরে রাখে। টেলিভিশনের দোকানগুলোতেও উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভীড়, সকলের নজর ছোট পর্দার ওপর। বিচারিক কার্যক্রমের লাইভ দেখে কর্মব্যস্ত মানুষজন ক্লান্তি দূর করার প্রয়াস চালায়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ট্রাইবুনালের প্রতিদিনের তাজা খবর ছাপে। বাজার কাটতি দেখে পত্রিকাঅলারা সান্ধ্য সংস্করণও ছাড়ে। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে কিছুটা শ্লথ গতি নেমে আসে। সকলের দৃষ্টি রেডিও টিভি পত্রিকা ফেসবুক ইউটিউবে কি না। এইভাবে টানা উনিশ দিন শ্বাসরুদ্ধকর বিচারিক কার্যক্রম অতিবাহিত হয়।

আজ ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বিংশতিতম দিন। নয় সদস্যের জুরি বোর্ডের সামনে বাদি ফুলেশ্বরী, এবং  আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো পুলিশমন্ত্রীসহ আরো সাত জন-যাঁরা সমাজে মান্যবর, শক্তিমান বলে খ্যাত, এবং ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তও বটে। ফুলেশ্বরীর উকিল ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায়। আর আসামিপক্ষে যৌথভাবে দাঁড়িয়েছেন আইনজীবী ডক্টর ব্যারিস্টার আরমান হোসেন ও ব্যারিস্টার জাকির-উল-আলম। এজলাস কক্ষে অন্যান্যের মধ্যে আরো আছেন সরকারের পাঁচজন পদস্থ কর্মকর্তা, সরকার ও বিরোধী দলীয় সাতজন সাংসদ, তিনজন নারীনেত্রী, অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল সমূহের থেকে চারজন রাজনীতিক, দু’জন সাবেক বিচারপতি, এগারজন জাঁদরেল সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সর্বজনমান্য ছয়জন ব্যক্তিত্ব, তিনজন শিক্ষাবিদ, আর রয়েছেন সম্মানিত বিজ্ঞ প্রধান বিচারক, এবং টেলিভিশনের পর্দার ওপর কোটি বাঙালির উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত বিস্ময়ভরা কোটি চোখ।

পুলিশমন্ত্রীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জাকির-উল-আলম, ফুলেশ্বরীকে জেরা করেন, ‘মিস ফুলেশ্বরী, তুমি তো টানবাজারেই থাকতে।’

ফুলেশ্বরী লজ্জায় মরে যেতে থাকে। বলে, ‘না।’ টেলিভিশনের দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শেরে বাংলা এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতা ফুলেশ্বরীর পক্ষে শ্লোগান দেয়।

ব্যারিস্টার জাকির বলেন, ‘সমাজে বা এই সোনার বাংলায় এত ব্যবসা থাকতে দেহ ব্যবসাকে পেশা হিশেবে বেছে নিলে?’

ফুলেশ্বরী চিৎকার করে বলে, ‘আপনি অসভ্যের মতো কথা বলছেন।’

ব্যারিস্টার জাকির বলেন, ‘তোমার মতো প্রমোদবালা কী করে ফুলের মতো পবিত্র মহামান্য পুলিশমন্ত্রীর আবাসিক কক্ষে ঢুকে পড়েছিলে?’

ফুলেশ্বরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘আপনি অশ্লীল। অসংস্কৃতভাবে কথা বলছেন।’

ব্যারিস্টার জাকির বলেন, ‘তোমার বুকের বা শরীরের অন্তর্বাস তুমি কি নিজে থেকে খুলেছিলে?’

ফুলেশ্বরী লজ্জায় আড়ষ্ট, কথা বলতে পারে না, এজলাসের মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ব্যারিস্টার জাকির প্রশ্ন করেন, ‘তোমার বুকে বা প্রাইভেট এরিয়ায় কে হাত দিয়েছিলো প্রথম?’

ফুলেশ্বরী লজ্জা দুঃখ ঘৃণা অপমানে লাল হয়ে ওঠে। উত্তর দিতে পারে না।

ব্যারিস্টার জাকির বলেন, ‘তুমি অভিযোগ করেছো বর্তমান পুলিশমন্ত্রীসহ জনা সাতেক তোমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছেন, এটা ঠিক?’

ফুলেশ্বরী ঘৃণাভরা ক্ষুব্ধ চোখে ব্যারিস্টার জাকিরের দিকে তাকায়।

ব্যারিস্টার জাকির আবার বলেন, ‘উত্তর দাও। চুপ করে থাকা সম্মতির লক্ষণ, জানো নিশ্চয়।’

ফুলেশ্বরী লজ্জায় মরে যায়। ছলছল চোখে মাথা ঝাঁকায়।

ব্যারিস্টার জাকির প্রশ্ন করেন, ‘তোমাকে ইয়ে করার সময় বাধা দিয়েছিলে?’

ফুলেশ্বরী নীরব। আঁচলে মুখ ঢাকে। এমন অশ্ল ীল প্রশ্নের জবাব সে জানে না। এমন সময় ফুলেশ্বরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এজলাজ কক্ষের বাহিরের সংক্ষুব্ধ মানুষজনের চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞ বিচারক, এরকম মানহীন প্রশ্ন অবান্তর। একজন নারীর পক্ষে জনসমক্ষে আমার প্রতিপক্ষ বন্ধুর অসংস্কৃত প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। শুধু ফুলেশ্বরী কেনো, আমি নিজেও এ রকম প্রশ্নের উত্তর দেয়া দূরের কথা, সেসব শুনতেও বিব্রত বোধ করছি, এবং প্রতিটি বিবেকবান মানুষেরই বিব্রত বোধ করা উচিৎ। মেডিকেল রিপোর্টে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ মিলেছে ধর্ষক একাধিক, এবং আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অভিযুক্ত সকলেই আমার মক্কেলের ধর্ষক।’

এজলাস কক্ষে মৃদু গুঞ্জন ওঠে। বিজ্ঞ বিচারক হাতুড়ি দিয়ে টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী ডক্টর ব্যারিস্টার আরমান হোসেন এবার এজলাসে দাঁড়ানো ফুলেশ্বরীর মুখোমুখি হলেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘কে তোমাকে প্রথম সেই কাজ করেছে? আর যেই হোক পুলিশমন্ত্রী নয় নিশ্চয়?’

ফুলেশ্বরী এবারও নিরুত্তর। বেদনায় নীল। সে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেনো একখন্ড মেঘ জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে তার দু’চোখের পর্দায়। দু’চোখ ভরে আছে জলে। যে কোনো মুহূর্তে তা ঘন হয়ে বর্ষাতে পারে।

ডক্টর আরমান তেজি-ভরাটকণ্ঠে বলেন, ‘তুমি নিজে থেকেই বে-আব্রু হয়ে যৌন আবেদন জানাও। কেউ সাড়া না দিলে তুমি বিরোধি দলের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য পুষ্পের মতো পবিত্র আমার মক্কেল মহামান্য পুলিশমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে জাপটে ধরো। এবং মন্ত্রীমহোদয়কে পটাতে না পেরে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাতে জখম করো। আকষ্মিক ঘটনায় বিহব্বলিত পুলিশমন্ত্রীর দেহরক্ষীরা ছুটে এলে তোমার হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। টেরর মাওবাদী বা জঙ্গিগোষ্ঠির সাথে তোমার সম্পৃক্ততা আছে, তুমি নষ্টা, ভ্রষ্টা; তুমি দেহপসারিনী ও প্রবঞ্চ ক। তোমার শাস্তি হওয়া উচিত।’

ফুলেশ্বরী পাথরের মতো স্তব্ধ। সে টলছে না, কিছু বলছে না, পা দু’টো যেনো কাঠগড়ার মেঝের সাথে আটকে আছে। অপমান ও ক্ষোভে তার শুভ্র নির্মল মুখ মলিন হয়ে ওঠে।

ফুলেশ্বরীর আইনজীবী আবার লাফিয়ে উঠলেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে বলতে থাকেন, ‘মহামান্য আদালত, আমরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আইনজ্ঞ হয়েছি, হয়েছি সাংসদ, কেউ মন্ত্রী বা বিচারক। এতক্ষণ আমার প্রতিপক্ষের মগজহীন অজ্ঞ-বন্ধু উকিলগণ অশ্ল ীল বাংলা সিনেমার বেঢপ চরিত্রের মতো অশালীন, অসংস্কৃত, অবান্তর, হৃদয়হীন প্রশ্নবানে আমার কোমলমতি মক্কেলকে অতিষ্ঠ করে তুলছেন, এবং ক্রমাগত মানসিক পীড়ন করছেন। দেশবাসী জানেন, তারা এসব করছেন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আশির্বাদ পাওয়ার জন্য। চা ল্যকর এই ধর্ষণ মামলাটি ইতোমধ্যে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে, দেশের বিবেকবান মানুষ তাকিয়ে আছে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায়। দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম আদালত, যার কার্যক্রম সরাসরি দেশ ও বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত হচ্ছে লাইভ। দেশের তথা সমগ্র বিশ্বের বাঙালীর নজর এখন এই বিশেষ আদালতের এজলাসের দিকে। তাই আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিৎ। শুধুমাত্র অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করলে দেশবাসী তথা বিশ্ববিবেক তা মানবে না। তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি। ধর্ষণ একটি আদিম সামাজিক ব্যাধি। মানুষের ভেতরের পশুবৃত্তিগুলো মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলে অসভ্য ইতর বর্বর দানবেরা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য পশুবৃত্তিতে মেতে ওঠে। যার শাস্তি কঠিন হওয়া বা নীয়। ডাক্তারি রিপোর্টে স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে, পুলিশমন্ত্রী ও তাঁর সেদিনের আমন্ত্রিত ভিআইপি অতিথিরা ফুলেশ্বরীকে জোরপূর্বক পাশবিক নির্যাতন করেছেন, ফুলেশ্বরীর দেহে পুলিশমন্ত্রীর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, স্পার্ম বা ডিএনএ টেস্টেও অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে।’

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় ফাইল থেকে ডাক্তারি রিপোর্ট বের করে বিচারকের সামনে হাজির করলেন। বিজ্ঞ বিচারক টেবিলের ওপর রাখা চশমাটি হাতে নিয়ে তাঁর পরণের কালো গাউনের প্রান্ত দিয়ে ভালো করে মুছে চোখে লাগিয়ে রিপোর্টটি পর্যবেক্ষণ করলেন। টেলিভিশনের সামনে দর্শকবৃন্দ ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায়ের নামে হর্ষধ্বনি দেয়, তাঁর বিস্ময়কর বাগ্মিতা, উপস্থিত বুদ্ধি, সততা বা পেশাদারত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে।

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় বলতে থাকেন, ‘আমার মক্কেল ফুলেশ্বরী পুলিশমন্ত্রীর বিশেষ সহকারির চাকরি করতো। এই নিন তার নিয়োগপত্রের মূলকপি, এবং বেতনের চেকের কপি,’  বলে তিনি ব্রিফকেস থেকে সেগুলো বের করে বিচারকের টেবিলে মেলে ধরেন। বিচারক প্রমাণপত্রগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করেন। এসময় প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা কিছু বলতে চাইলে, বিজ্ঞ বিচারপতি তাঁদের থামিয়ে দেন, এবং ব্যারিস্টার রায়ের দিকে মুখ তুলে বলেন, ‘প্রোসিড, প্লিজ গো অন।’

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় বলতে থাকেন, ‘ঘটনার দিন ছিলো বর্ষণমুখর কালরাত….’

প্রতিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘রাতের রঙ বরাবরই কালো হয়। কালোরাত বলে কোনো কথা ইতিহাসে বা কেতাবে উল্লেখ নেই। কবি সাহিত্যিক গাঁজাখোরেরাই কেবল রাতে জোছনার বদলে সূর্য দেখে আর দিশেহারা হয়ে দিনে তারা গোনে। আপনি আইনজীবী না হয়ে গঞ্জিকি সাহিত্যিক হলে আরো উন্নতি করতে পারতেন।’ কথাগুলো শুনে দু’একজন যারা হাসলো, তারা আসামিপক্ষের প্্রতি সদয়, এবং দুর্বল বোঝা যায়।

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় ঠোঁট বাঁকা করে তাচ্ছিল্যের ঢঙে মৃদু হাসলেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘রাতের রং কালো হলেও বিশেষ বিশেষ রাতই কেবল কাল উপাধি পায়। জোছনার রাত ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি রাতই বর্ণহীন কালো, তবে ২৫ শে মার্চের রাত কালরাত বলে আখ্যায়িত। তেমনি এই মামলায় আমার মক্কেলের নির্যাতিত হওয়ার রাতও কালরাত্রি; সভ্যতার অরক্ষিত দুর্গের বর্ণচোরা কালরাত্রি। সেই কালরাতে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশে ফুলেশ্বরী সেখানে থেকে যায়, এবং পুলিশমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টেড সাতজন আমন্ত্রিত ভিআইপি, যাঁরাও আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত, তাঁরা সবাই সেদিনের সেই জলসায় যোগদান করেন আরো চারজন সুন্দরী প্রমোদবালাকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে সঙ্গীতের ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দেওয়া হয়, কঠিন রঙিন জল, মানে হার্ড লিকারের বন্যায় প্লাবিত হচ্ছিলো পুলিশমন্ত্রীর নামে বরাদ্দকৃত পবিত্র এই এজলাসের তৎকালীন নারকীয় স্থানটি। ফুলেশ্বরীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করে মদ খেতে বাধ্য করা হয়। পুলিশমন্ত্রীর হাত দিয়ে সমাজের আরেক মহামান্য জনাব গোখরো সাহেব ফুলেশ্বরীকে উপঢৌকন দেন। এতে আমার মক্কেল বিব্রত বোধ করে, এবং মহামান্যদের প্রতি সন্ধিহান হয়। এক পর্যায়ে গোখরো সাহেব গোখরো সাপের মতো নির্মমভাবে আমার মক্কেলের ওপর বর্বর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফুলেশ্বরী নিজেকে বাঁচাতে তারই ত্রাণকর্তা পুলিশমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করে। এই সুযোগটি আমাদের মহামান্য পুলিশমন্ত্রী মহোদয় প্রবলভাবে কাজে লাগান, এবং ফুলেশ্বরীকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় সম্ভ্রমহানী করেন। ফুলেশ্বরী নিজেকে বাঁচাতে, উপায়ন্তর না দেখে, খোপা বাঁধা চপষ্টিক দিয়ে পুলিশমন্ত্রীকে আঘাত করে সম্ভ্রম রক্ষা করতে চায়, কিন্তু পারে না। দোর্দ- প্রতাপশালীদের পৌরষেয় শক্তির সাথে সে পেরে ওঠে না। উন্মত্ত, উম্মাদ মহামান্যের দঙ্গল তাকে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে। এতে আমার মক্কেল সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে, কে বা কারা তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতাল রেখে যায়। হয়তো তাঁরাই। যদিবা তাঁরাই আমার মক্কেলকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে থাকেন, তবুও তাঁদের ধন্যবাদ জানাই আমার মক্কেলের জীবন বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য, যদিও আমার মক্কেল জীবিত থেকেও মৃত প্রায়।’

প্রতিপক্ষের আইনজীবী ডক্টর আরমান ব্যারিস্টার সত্যব্রতকে বলেন, ‘আপনি বলছেন, ফুলেশ্বরী আত্মরক্ষার্থে নিজের খোপার চপস্টিক দিয়ে মহামান্য মন্ত্রী মহোদয়কে আঘাত করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে, মন্ত্রী মহোদয়ের শরীরে সে আঘাতের কোনো চিহ্ন বা জখম হওয়ার প্রমাণ আপনার কাছে আছে কী?’

এজলাস কক্ষে গুঞ্জন ওঠে। বিচারকের কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায়, অর্ডার অর্ডার বলে। এজলাসের ভেতরে, এবং বাহিরের একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। ঘটনা কি প্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছে। ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় বার ক ঢোঁক গেলেন। চাপরাশি জলভর্তি ঠা-া বোতল এগিয়ে দিলে, তিনি ঢক ঢক করে পান করলেন। দর্শক-শ্রোতার মুখ প্রায় পা-ুর। চোখে আতঙ্ক। হেরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে যে অবস্থা হয়, তেমন অবস্থা। কিছুসময়ের জন্য নীরবতা নেমে আসে, কি এজলাস কক্ষে কি বাহিরে বা টেলিভিশনের সামনে। অবশেষে বিচারকের নির্দেশে ‘বিশেষ দু’জন জুরি বোর্ডের সদস্য’ পুলিশমন্ত্রীর শরীর পরীক্ষা করেন। কিন্তু আঘাতের কোনো চিহ্ন আবিস্কার করতে পারেন না।

বিচারক বলেন, ‘প্রমাণ ছাড়া আদালত কোনো তথ্য আমলে নেয় না, প্রমাণ ছাড়া আইন কথা বলে না। চাই প্রমাণ।’ আবারো গুঞ্জন। ‘অর্ডার অর্ডার অর্ডার’, বলে শব্দ উচ্চারণ করেন তিনি। গুঞ্জন থেমে যায়।

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় পকেট থেকে রুমাল বের করে স্বীয় মুখের ঘামের কণাগুলো মুছে নিলেন। বাম হাতে ধরা বোতল মুখে লাগিয়ে বাকি জল টুকুও নিঃশেষ করলেন। এবং ডান হাতের আঙুল দিয়ে গলাবন্ধনীর বাঁধন ঢিলে করে বুক ভরে শ্বাস টানলেন। এসব দেখে জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সে কী ভীষণ ব্যাকুল প্রতীক্ষা! ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় গলা খুকনি দিয়ে গলাটা কিি ত পরিষ্কার করলেন, এবং বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি আমার ৩২ বছরের ক্যারিয়ারে কখনো মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করি নাই। আজও আমি একবিন্দু মিথ্যে বলছি না।’

বিচারক, জুরি বোর্ড ও উপস্থিত সবাই তাঁর কথায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। একে অপরের মুখের দিকে তাকান। এরপর আর কি প্রমাণ আছে তাঁর ঝুলিতে।

বিজ্ঞ বিচারক ব্যারিস্টার সতব্রত রায়কে বলেন, ‘তাহলে কী আমরা মিথ্যে দেখলাম? আপনি একাই সত্যব্রত, আর আমরা মিথ্যাব্রত।’

অনেকেই হেসে ওঠে। শুধু হাসতে পারে না ফুলেশ্বরী, সত্যব্রত রায়, রাজপথে গভীর প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন, আর হাসতে পারে না টেলিভিশনের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়া বিবেকি দর্শক-শ্রোতা।

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় বলেন, ‘মন্ত্রীসাব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, যা দেশবাসী অবগত, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত, আপনি অনুমতি দিন মাননীয় পুশিশমন্ত্রীর পরনের কাপড় খুলে পরীক্ষা করতে।’

সত্যব্রতের কথায় এজলাস কক্ষের সবাই হতবাক। নীরবতা। কি দু:সাহস! টেলিভিশন সেটের সামনে যারা লাইভ দেখছিলেন, তারা অনেকেই হেসে উঠলেন হো হো করে। আসামিপক্ষের আইনজীবীদ্বয় ব্যারিস্টার সত্যব্রতের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় অটল। অবশেষে, জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্তে বৃদ্ধ বিচারক নিজে, এবং জুরি বোর্ডের অন্য দু’জন সদস্যকে সংগে নিয়ে গোপন কক্ষে গিয়ে পুলিশমন্ত্রীর প্যান্ট ও আন্ডারওয়ার খুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিৎকার করে উঠলেন। হুলোস্থুলো কা- বেধে যায়। সবাই দৌড়ে গিয়ে বিচারক মহোদয়কে উদ্ধার করলেন। বিচারক হাঁপাতে হাঁপাতে এজলাস কক্ষে ফিরে এলেন। সকলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বিচারকের ওপর। মাননীয় বিচারক ব্যথা ভারাক্রান্ত মনে ধীরে ধীরে বলেন, ‘আমি দুঃখিত, লজ্জিত, হতভম্ভ,এবং বাকরহিত! মাননীয় পুলিশমন্ত্রী মহোদয়ের শিশ্নে ব্যান্ডেজ বাঁধা, এবং তাঁর একটি অ-কোষ অনুপস্থিত, ক্ষতস্থান দিয়ে এখনও বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরছে।’

আদালতে উপস্থিত জুরি বোর্ড, সম্মানিত নাগরিকবৃন্দ, এবং দেশবাসী হতবাক। বিস্মিত। ফুলেশ্বরী লজ্জায় আড়ষ্ট। সত্যব্রত রায়ের দু’চোখ বিস্ফারিত। দর্শক-শ্রোতা কেউ কেউ হাসলেন। বিপুল কষ্টের দিনে এমন বিনোদনও কি নাটক বা সিনেমায়ও পাওয়া যায়? হাসতে পারেন না পুলিশমন্ত্রী। তিনি আহত নেকড়ের মতো ছটফট করছেন। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মন্ত্রীর সহযোগী সাত ধর্ষকও কুঁকড়ে গেলেন, তাঁদের ভেতরে ভূমিকম্প হতে থাকে।

ব্যারিস্টার সত্যব্রত রায় বলতে থাকেন, ‘মাননীয় আদালত, পুলিশমন্ত্রীর জখম হওয়ার কারণ আমি আদালতে উপস্থাপন করে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। খবরটি বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছে ইতোমধ্যে। জীবনে বহু যুক্তি-তর্ক-বির্তকে অংশ নিয়েছি, আজকে না হয় নাই-বা করলাম। আমি শুধু আদালতকে একটি কথা বলতে চাই, আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মহামান্যরা সেদিনের সেই কালরাতে আমার মক্কেলকে বর্বরভাবে পাশবিক নির্যাতন করেছেন। আইনের রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ভন্ড, লম্পট, লুটেরা অপশক্তি শুধুমাত্র একটি নারীকে ধর্ষণ করেনি, ধর্ষণ করছে সভ্যতাকে, আইনকে ধর্ষণ করছে, ধর্ষণ করছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ইি  মাটিকে। বিজ্ঞ নিরপেক্ষ আদালতের কাছে আমি ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করি ইওর অনার।’

সত্যব্রতের কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে, বেদনার মেঘমালা তাঁর ফর্সা মুখাবয়বে ভাসতে থাকে। সকলের অলক্ষ্যে তাঁর চোখ বেয়ে দু’ফোটা জলও গড়ে পড়ে।

বিজ্ঞ বিচারক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘ধন্যবাদ দুই পক্ষের সম্মানিত আইনজীবী, ধন্যবাদ বিজ্ঞ জুরি বোর্ড, সাংবাদিক ও উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ধন্যবাদ দেশের আপামর জনসাধারণকে, যারা টেলিভিশনের সামনে এই বিশেষ আদালতের কার্যক্রম দেখছেন। আপনারা সকলে চা ল্যকর এই ধর্ষণ মামলায় আদালতকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। জাতির ইতিহাসে এই মামলা ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এই আদালত একটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আপনারা টানা কুড়ি দিন ধৈর্য ধরে ন্যায় বিচারের জন্য লড়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত করে রায় ঘোষণা করতে হবে। আমি অক্ষরে অক্ষরে আদালতের নির্দেশ পালন করবো। আমাদের হাতে আর মাত্র একদিন সময় আছে। এর মধ্যেই রায় ঘোষণা করতে আমরা আইনত বাধ্য। কিন্তু আমি মনে করি, শুনানী আর দীর্ঘায়িত করার কোনো হেতু নেই। সমস্ত তথ্য-উপাত্ত আমরা পেয়ে গেছি। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি, আমি আগামীকাল এই মামলার রায় ঘোষণা করতে চাচ্ছি না।’

উৎকণ্ঠিত বিবেকি মানুষ , যারা বিচারপতির শেষ কথাগুলো শুনেছে, তারা প্রচ- খাঁদে হোঁচট খেলো যেনো। বিস্ময়ে স্তব্ধ। চারপাশ থেকে চাপা গুঞ্জন গুঞ্জরিত হতে থাকে। তাহলে কী সব ভেস্তে যাবে? বিচার কার্যক্রম কী কেবলই প্রহসন? এজলাসের সামনে উপস্থিত সম্মানিত নাগরিকবৃন্দের মধ্যেও বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচাল খেলা করতে থাকে।

বিজ্ঞ বিচারক টেবিলে হাতুড়ি চাপড়ে বলেন, ‘অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার।’

সুনশান নীরবতা। বিবেকিদের হৃৎপি-ের কম্পন বেড়ে যায়। ঢিপ ঢিপ ঢিপ!

বিচারক বলতে থাকেন, ‘কাল দিলেও যে রায়, পরশু, এক মাস, এমনকি এক বছর পরে দিলেও সেই একই রায় ঘোষিত হবে। তবে কালকের জন্য অহেতুক সময়ক্ষেপন কেনো। তাই আমি এই ঐতিহাসিক মামলার ঐতিহাসিক রায় আজই ঘোষণা করতে চাই। আগামীকাল আমি নাও বাঁচতে পারি। বা বেঁচে থাকলে বদলিও হয়ে যেতে পারি। এদেশে এমনটি আগেও ঘটেছে বহুবার। কী দরকার অযথা সময় নষ্ট করা। সুযোগ যখন পেয়েছি, কোপ একটি মেরেই দিই। আমি আশা করবো, আপনারা সবাই আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আদালতের রায় মেনে নেবেন।’

আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত উৎসুক নাগরিকবৃন্দের ভেতরে আদালতের প্রতি বিশ্বাস ও স্বতঃস্ফূর্ততা পুনরুজ্জীবিত হয়। বিচারের জন্য অপেক্ষেয়মানদের ভেতরে প্রাণচা ল্যতা ফিরে আসে। আমজনতা আশায় বুক বাধে। টেলিভিশন সেটের সামনে বসে থাকা ব্যাকুল জনতার সে কী বিশ্বাসী আবেগ! অনেকে শ্লোগান দেয়, ‘ফুলেশ্বরীর কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে; লেজকাটা পুলিশমন্ত্রীর, শাস্তি চাই ফাঁসি চাই।’ কিন্তু ফাঁসি দিলেই কি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়? অপরাধ কমে?

বিচারক বলতে থাকেন, ‘এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার আগে আমি ফুলেশ্বরীকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।’

ফুলেশ্বরীর চোখে মুখে ক্ষোভ, বিশ্বাস ও সাহসের স্ফুলিঙ্গ। সে বলতে থাকে, ‘মহামান্য আদালত, আমি সমাজের চোখে নষ্টা ভ্রষ্টা ধর্ষিতা। সমাজের চোখে আমি অপরাধী। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? আমি তো চাই নি ধর্ষিত হতে। আমি তো চাই নি কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে। আমি সমাজের আর দশজন নারীর মতো সম্ভ্রমের সাথে, গৌরবের সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি বাঁচতে চাই। এই নিষ্ঠুর সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রহীন ভ-, লম্পট, বর্বরেরা বারে বারে আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমি প্রথম ধর্ষণের স্বীকার হই পুরুষ শাসিত রাষ্ট্রের প্রচলিত বিধান দ্বারা। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী নারী পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারে পুরুষের অর্ধেক। এই আইনের গ্যাঁড়াকলে আমি আমার জন্মদাতা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বি ত হই। বিধান অনুযায়ী আমার ভাগের পৈত্রিক সম্পত্তির ভাইয়ের অর্ধেকও পাই নি। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের এই বৈষম্যময় আইন আমি মানি না, এবং এই বিধান আমি ঘৃণা করি। টিন এজ পেরোবার পর, পিতা-মাতা গত হলে, আমার বড় ভাইয়ের প্রবাসী ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্তৃক আমি দ্বিতীয়বার শারীরিক ধর্ষণের শিকার হই। আমার দুর্বলতা ও সরলতার সুযোগে বাবার বন্ধু বিশিষ্ট সমাজ সেবক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও শহরের বড় একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান, এবং ভূতপূর্ব সাংসদ কর্তৃক আমি তৃতীয়বার ধর্ষিত হই। এরপর বান্ধবীর শান্তশিষ্ট পতিœনিষ্ঠ একনিষ্ট ভদ্রবেশী স্বামী ও অফিসের বস কর্তৃক প্রথমে যৌন হয়রানি ও পরে ধর্ষিত হই। বাবার পেনশনের টাকা উত্তোলনের সহযোগিতার নামে জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। তারপর, জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টসে চাকুরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য কোনাবাড়ীর কর্পোরেট অফিসে গেলে, সেখানকার আল্ল ার দান গার্মেন্টসের চারজন যৌথ মালিক কর্তৃক যৌথভাবে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হই। তারা আমাকে অচৈতন্য অবস্থায় আশুলিয়ার ঝিলের ধারে ফেলে আসে। জনৈক কৃষকের সহযোগিতায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মানবাধিকার নেত্রী মিসেস গুলশান আরা আমাকে আইনি সহযোগিতা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। যার স্বামী কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ধর্ষক পুলিশমন্ত্রী। কিছুদিন তাঁদের আশ্রয়ে থাকার পর, আমি চলে যেতে চাইলে, পুলিশমন্ত্রী আমাকে তার সহকারি নিয়োগ করেন। অঘটনার দিন, পুলিশমন্ত্রীসহ আরও দুইজন মন্ত্রী, একজন আমলা, একজন সাবেক জেনারেল, দু’জন শিল্পপতি, এবং একজন বিরোধীদলীয় প্রভাবশালী নেতা আমার ওপর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন চালায়, যারা সকলেই কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন। তারপরের ঘটনা আপনারা কমবেশি জানেন। শুধু জানেন না আরো কিছু গোপন কথা।’

বিজ্ঞ বিচারক ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘কী সেটা? তুমি নির্ভয়ে বলে যাও। আমরা শুনতে চাই।’

ফুলেশ্বরী বলতে থাকে, ‘আমার জীবন রক্ষাকারী ডাক্তার মেহজাবিনের বাড়ি থেকে সরকারের গোয়েন্দারা আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর, তারা দু’দিন ধরে আমার শ্লীলতাহানী করার পর থানায় সোপর্দ করে। থানার দারোগা ও পুলিশ আমাকে ধর্ষণ করে সোপর্দ করে জেলহাজতে। সেখানে জেলার আমাকে ধর্ষণ করে, কারারক্ষীরা আমাকে রাতের পর রাত ধর্ষণ করতো।’

ফুলেশ্বরী বলতে থাকে, ‘সংসদ নাকি গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি আমার দেহখানি কি ধর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু? আমার সর্বাঙ্গে ধর্ষণের ক্ষত।’

ফুলেশ্বরী বলে, ‘জেলহাজতে গমনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি অসংখ্যবার ধর্ষণের শিকার হয়েছি। এমনকি আজকে আদালতে আসার আগে, জেল থেকে প্রিজন ভ্যানে ওঠার আগে, বড় জেলার, ছোট জেলার যৌথভাবে আমাকে ধর্ষণ করেছে। ওরা প্রতিদিনই আমাকে ধর্ষণ করতো।’

ফুলেশ্বরী চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমার দেহখানি যেনো ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দেয়া ভোগের মেশিন। আমার শরীর যেনো সুস্বাদু মাংসের কারখানা, স্বর্গীয় সুরা। পশুর চেয়ে হিংস্র পশুরা, শকুনের চেয়েও অধিক মাংসভুক ইতর জানোয়ারগুলো আমার মাংস খাবড়ে ছিঁড়ে খায়।’

ফুলেশ্বরী বলে, ‘মাননীয় আদালত, আমি আর বাধা দেবো না, বিদ্রোহ করবো না; আমি শক্তিহীন, অবলা; আপনারা সবাই একযোগে আসুন, আমাকে ধর্ষণ করুন।’

ফুলেশ্বরী কাঁপতে থাকে। চিৎকার করে বলে, ‘দেশের রাজনীতিবিদগণ, বুদ্ধিজীবীগণ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ, এমপি-মিনিষ্টারগণ, সবাই আমাকে ধর্ষণ করুন। চোর, গু-া, বদমাস, হুজুর, কৃষক, শ্রমিক, মজদুর আপনারা আমাকে ধর্ষণ করুন। আমার শরীর প্রস্তুত আপনাদের জন্যে।’

ফুলেশ্বরী বলে, ‘দেশের দামাল ছেলেরা, সোনার ছেলেরা, আপনারা সবাই আমাকে ধর্ষণ করুন। আপনারা আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছাতু করে ফেলুন, মাটির সাথে ভেঙ্গে চুরে গুড়িয়ে দিন, পিষে ফেলুন। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ম্যাজিষ্ট্রেট, ইউএনও, জর্জ, ব্যারিস্টার, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, হাজী, গাজী, পাঁজি সবাই জোটবদ্ধ হয়ে আমাকে ধর্ষণ করুন।’

ফুলেশ্বরীর কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। আর কিছু বলতে পারে না। হাঁপায়।

জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্যবর্গের কেউ কেউ তাঁদের ভেজাচোখের প্রান্তগুলো মুছলেন। উপস্থিত সাংবাদিক ও নাগরিকবৃন্দ অস্ফুট আর্তনাদ করেন। টেলিভিশন সেটের সামনে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় প্রহর গোনা বিবেকি মানুষের ভেতরটায় মরুভূমির হাহাকার যেনো। মায়েদের চোখ ছলছল। ব্যথায় ভরা। বিচারক মহাশয় এজলাসের চেয়ারের সাথে গুটিসুটি হয়ে মিশে যেতে থাকেন। তাঁর চোখের কোণে জল জমে। কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। স্বাভাবিক হতে ভেতরে ভেতরে যুদ্ধ চালান। কাউকে বুঝতে দেন না নিজের দুর্বলতার কথা। বিচারকের দুর্বলতা প্রকাশিত হতে নেই। বিচারককে হতে হয় ঈশ্বরের মতো কঠিন। নির্দয়। নিষ্ঠুর। নিরপেক্ষ। তিনি শক্তি স য় করে দরাজ কণ্ঠে বলেন, ‘আমি বেদনাহত। ফুলেশ্বরীর জীবনে ঘটে যাওয়া অঘটনগুলোর নিন্দা জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই। আমি এই অসভ্য বর্বর দেশের বিশেষ আদালতের একজন হতভাগ্য বিচারক, ভাবতেই ব্যথায় মন ভরে যায়, আমি এই দেশের একজন আইনজীবী, ভাবতেই আমার ঘৃণায় বমি আসে, এই ইতর দেশের আমি একজন নাগরিক, আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। অথচ আমরাই ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি, মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছি। জানি না কবে মুক্তি আসবে।’ বিচারপতির এই কথাগুলো শুনে আবেগি মানুষেরা তাদের চোখের জল সম্বরণ করতে পারে না।

গণমানুষের বুকে অসীম নারকীয় যন্ত্রণা। সমগ্র বাংলা ডুবে আছে ব্যথার সাগরে।

হঠাৎ বিচারপতি মহোদয়ের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি ক্রীং ক্রীং করে বাজে। তিনি পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে বিরক্তভরা চোখে পরখ করলেন, এবং ফোনটি টেবিলের ওপর খটাস করে রাখলেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘উপস্থিত সম্মানিত জুরি বোর্ড, জাতির বিবেক সাংবাদিকগণ, উপস্থিত গণ্যমান্য নাগরিকবৃন্দ, এবং টেলিভিশন সেটের সামনে অপেক্ষেয়মান বাঙলার বিবেকি ভাই-বোন বন্ধুগণ, আমি এখনই বহুল আলোচিত চা ল্যকর ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা-’

কথা শেষ না হতেই তাঁর মোবাইলটি আবার বেজে ওঠে। তিনি আবারও নম্বর পরখ করে এড়িয়ে গেলেন। বলতে থাকেন, ‘দুঃখিত। আমি এখনই বহুল আলোচিত চা ল্যকর ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষ….’

তাঁর শেষ কথা শেষ হতে পারে না আবারো। বাক্য শেষ হওয়ার আগেই মোবাইলটি অস্থির নদীর স্রোতের মতো কলকল করে বাজে, এবং বাজতেই থাকে। এবারও তিনি এড়িয়ে গেলেন। বলেন, ‘আবারও দুঃখিত। আমি এখনই বহুল আলোচিত চা ল্যকর ফুলেশ্বরী ধর্ষণ মামলার রায় ঘো-’

তাঁর মোবাইলটি দূরন্ত বালকের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করতে থাকে। অবশেষে, তিনি মন্থর গতিতে হাত বাড়িয়ে ফোনটি ধরলেন। কানের কাছে এনে রাখলেন কিছুক্ষণ। কে ফোন করলো, কী বললো, আর কী শুনলেন, কিছুই বোঝা গেলো না। তাঁর শ্রীমুখ কেমন বদলে গেলো। পা-র। সর্বাঙ্গে ভীতি আর বিপন্নতার ছাপ। মোবাইলটি তাঁর হাত থেকে মহাকাশ হতে উল্কাপি-ের খ’সে পড়ার মতো করে মেঝেতে পড়ে গেলো। গোটা জাতির চোখ টেলিভিশনের পর্দায় চিলের মতো স্থির-স্তব্ধ হয়ে আছে। দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। বিচারক মহাশয় তাঁর বাম হাত দিয়ে চোখ থেকে স্বচ্ছ লেন্সের চশমাটি ধীরে ধীরে খুললেন। রুমাল দিয়ে দু’চোখ ও মুখ মুছলেন, এবং অকষ্মাৎ মুর্চ্ছা যাওয়া রোগীর মতো এজলাসের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলো। পর্দা শম শম শম শব্দে ঝিরঝির করতে থাকে। একটু পরেই সারা দেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। মোবাইল সার্ভিসও বন্ধ। ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক তো কোন ছার! কারো বুঝতে বাকি থাকে-না কী ঘটতে যাচ্ছে। প্রতিবাদী বিবেকি গণমানুষ মুহূর্তে রাস্তায় নেমে আসে, প্রচ- বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শেরেবাংলা নগরের বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে আদালত তথা সংসদ ভবন এলাকা ঘিরে রাখে। ঢাকা শহরের আবাল বৃদ্ধ বণিতা চারদিক থেকে মিছিল নিয়ে শেরেবাংলা নগরের লক্ষ জনতার সাথে মিশে যায়। ঢাকার অলি গলি রাজপথ জনতার অবাধ স্রােতে প্লাবিত। জনসমুদ্র হতে একটাই শ্লোগান প্রতিধ্বনিত হয়, ‘পুলিশমন্ত্রী ও তার দোসরদের ফাঁসি চাই, ফুলেশ্বরীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই।’ বিক্ষোভে, মিছিলে ঢাকাসহ পুরো দেশ কাঁপতে থাকে। এ যেনো আগ্নেয়গীরির দাবানলের ভেতর থেকে উদগীরিত লাখো কোটি শান্তিকামী মানুষের শান্তি প্রগতি সভ্যতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বলিষ্ঠ ও মহৎ ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

শৃঙ্খলা ফেরাতে তথাকথিত দেশ-প্রেমিক গণতান্ত্রিক সরকার চল্লি শ প্লা াটুন সৈন্য, পয়ত্রিশ প্ল াটুন র‌্যাব, একত্রিশ প্ল াটুন দাঙ্গা-পুলিশ ও ত্রিশ ব্যাটালিয়ন দলীয় খিলজি মোতায়েন করে শেরেবাংলা নগরে। সৈন্য-সামন্তগণ সামন্তযুগীয় কায়দায় আলু খাগড়াদের ওপর বিপুল বিক্রমে বর্বরতা দমন পীড়ন করতে থাকে। প্রতিবাদী জনতা সরকারের গু-া বাহিনির প্রাণান্ত বাঁধা-বেরিকেড নস্যাৎ করে এগিয়ে যেতে থাকে বিশেষ আদালতের দিকে। শ্লোগানে শ্লোগানে ভরে ওঠে ঢাকাসহ গোটা বাঙলাদেশঃ “ফুলেশ্বরীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই,” “পুলিশমন্ত্রী ও তার দোসরদের ফাঁসি চাই,” “ফুলেশ্বরীর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”, মিছিলে শ্লোগানে প্রকম্পিত সারাদেশ। ক্ষোভ আর মিছিলের দেশ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।

এজলাসের বাহিরের প্রতিবাদী বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিল আর শ্লোগানের শব্দে ফুলেশ্বরী সোনালি সকালের নিসর্গের মতো উদ্ভাসিত। তার ভেতরে ঝলমল সোনালি রোদের ¯িœগ্ধতা বয়ে যায়, এবং শরীর বেয়ে সেই ¯িœগ্ধতা গলে গলে ঝরতে ঝরতে দাবানলের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ফুলেশ্বরী মেঘের গর্জনের মতো চিৎকার করতে করতে এজলাস থেকে ছুটে বেরিয়ে জনতার কাতারে মিশে যায়। দৈবাৎ একটি বুলেটের কর্কশ দিড়িম শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে ফুলেশ্বরী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জনসমুদ্রে কিছুক্ষণের জন্য মহাকালের নীরবতা নেমে আসে। বিবিসি’র প্রাচীন সাহসী সাংবাদিক মার্ক টালি মাইক্রোফোন হাতে আহত মুক্তিযোদ্ধার মতো লুটিয়ে পড়া ফুলেশ্বরীর নিস্তেজ মুখের কাছে দ্রুত এগিয়ে আসেন। মাইক্রোফোনটি ফুলেশ্বরীর মুখের কাছে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘টোমি কিসু বোলটে চাউ?’

ফুলেশ্বরী চোখ বড় করে মৃত্যুপথ যাত্রী জখম বিপ্লবীর মতো শূন্যে তাকিয়ে।

মার্ক টালি আবার বলেন, ‘হেলো মিস ফুলেশ্বড়ে, টৌমার কিসু বোলবাড় আসে?’

ফুলেশ্বরীর কথা বলার শক্তি নেই।

মার্ক টালি আবার বলেন, ‘মাও ফুলেশ্বড়ে, পিড়িয়ো ফুলেশ্বড়ে, এই ডেশ সম্ফখে কিসু বোলো এ্যাটলিস্ট।’

ফুলেশ্বরীর দেহে এখনও প্রাণবায়ু আছে। যে কোনো মুহূর্তে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে। সে চেষ্টা করে কিছু বলার, কিন্তু পারছে না। কিছুই মনে পড়ছে না। সে শক্তিও নেই তার। চারদিকে কুয়াশার মতো ঝাপসা দেখে। এক সীমাহীন প্রাচীন অরণ্যের ঘন অন্ধকারের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে সে। সমস্ত শক্তি নিংড়ে সে ভারী দু’চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখে। আকাশের নীলে দৃষ্টি স্থির হয়। তার মনে পড়ে সফোক্লীসের কথা, মনে পড়ে সক্রেটিসের কথা, মনে পড়ে প্লে টো, এরিস্টটল, কার্ল মার্কস, লেলিন, তলস্তয়, গোর্কীর কথা; মনে পড়ে জাঁ পল সাঁত্র, রুশো, হেগেলের কথা, মন পড়ে শেক্সপিয়ার, মলার্মে, রাসেল, চেগুয়েভারা, মধুসুদন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিওর কথা; মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, আর হুমায়ুন আজাদের কথা। কাউকেই চোখে দেখেনি সে, দেখার কথাও নয়, তবুও মনে হয় এঁরা সবাই শত বছরের চেনা। সে কেবল তাঁদের কিছু রচনা পড়েছে মাত্র। কেবলমাত্র রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে জীবনে একবার, এবং সেই শেষবারের মতো একুশের বইমেলায় খুনির ধারালো চাপাতির তলে হিমালয়ের মতো দৃঢ় থাকতে দেখেছিলো। ক্ষুব্ধ হুমায়ুন আজাদ তার ভেতরে যা বলছে বলে মনে হয় তার, ফুলেশ্বরী তা-ই, মার্কটালির মাইক্রোফোনটি মুখের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাংলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়োনা/ জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপান্না হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,/ অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যম-লি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,/ মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে পীড়ন করো না,/ আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।’ এরপর সে আর কিছু বলতে পারে না। মার্ক টালির মাইক্রোফোনটি তার হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্তবমি বেরোয়। দু’ চোখ বুঁজে আসে। হৃৎ কম্পন থেমে যায় চিরদিনের জন্য। তার প্রাণহীন নিথর দেহ মাটিতে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ। গণজাগরণ মে র গণসঙ্গীত শিল্পীরা তখন সমবেত কণ্ঠে গাইছিলো, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তারপর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মানুষ ফুলেশ্বরীর লাশ কাঁধে তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। এরপর দিন গড়িয়ে মাস, বছর, এবং যুগ পেরিয়ে যায়, প্রতিদিনই ভোর আসে, সকাল হয়, ওঠে নতুন সূর্য, জাতীয় জীবনে ঘটে নানান ঘটনা, সংসদে নিয়মিত পাশ হয় বস্তা বস্তা আইন, কিন্তু কোনো আইনে ধর্ষক পুলিশমন্ত্রী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের টিকিটি স্পর্শ করা গিয়েছিলো কী না আজ বারো বছরেও জানা যায় নি। ভবিষ্যতে নিশ্চয় জানা যাবে বলে দেখার অপেক্ষায় আছি।