You are currently viewing একটি রাজকীয় বিয়ে ও একজন জাতীয় নেতার মৃত্যু > মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ

একটি রাজকীয় বিয়ে ও একজন জাতীয় নেতার মৃত্যু > মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ

একটি রাজকীয় বিয়ে ও একজন জাতীয় নেতার মৃত্যু

(ঢাকার ছেলে সাইয়ুদ ও কোলকাতার মেয়ে বিজয়ার গল্প)

মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ

 

বিজয়া প্ল্যান করে সব ভয় ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মস্কো থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতি করলো কায়রোতে, তার প্রেম-বর সাইয়ুদের সান্নিধ্য পেতে। এটাই যে তাদের শেষ ছোঁয়া হবে জানত না তারা। বিজয়া যাচ্ছিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একটা মিটিংএ, আর এই সুযোগটাই কাজে লাগালো বিজয়া। বিজয়া কায়রো নেমে সাইয়ুদকে ভালোবাসায় স্নান করিয়ে নিউইয়র্কের পথে পা দিল, তার দুদিন পরেই ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকে মাত্র একষট্টি বছর বয়সে সাইয়ুদ চলে গেলো পৃথিবী ছেড়ে, বিজয়াকে একলা রেখে।

সাইয়ুদ মিশরে সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রথম  রাষ্ট্রদূত, আর বিজয়া রাশিয়ায় ভারতের প্রথমরাষ্ট্রদূত। ইতিমধ্যেই হয়তো চিনে ফেলেছেন এরা কারা! সাইয়ুদ ঢাকার নবাব সাইয়ুদ মোহাম্মাদ আজাদের ছেলে ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকের ঢাকার সবচেয়ে বড়ো জমিদার ও ভদ্রলোক মীর আশরাফ আলির বংশধর আর বিজয়া ভারত কংগ্রেসের দু’বারের অধিপতি মতিলাল নেহেরুর মেয়ে ও ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জাওহরলাল নেহেরুর বোন।

 

বিজয়া ও সাইয়ুদ হোসাইন

 

গোড়ার কথা:

কোলকাতায় বেড়ে ওঠা হ্যান্ডসাম ইয়ং সাইয়ুদ হোসেন আলিগড় থেকে পড়াশুনা শেষ করে কোলকাতায় সাব-ডেপুটি কালেক্টরের চাকরী পেল, কিন্তু ভালো লাগেনা সে চাকরী, ছেড়ে দেয় চাকরী। সিদ্ধান্ত নিলো লন্ডনে যাবে ব্যারিস্টারি পড়তে, সেটা ১৯০৯। ভর্তিহলো কেমব্রিজ  বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে পেলোজওহরলাল নেহেরুকে, যিনি ছিলেন তার দুই বছরের সিনিয়র। সেখানে পড়া শেষ না করেই ভর্তি হলোলিংকন ইন-এ ল’ বিভাগে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হুংকার চলছেসারা ইওরোপ জুড়ে। পড়াশুনা কিছু হচ্ছেনা। এদিকে ভারতে হোমরুল নিয়ে মাতামাতি, গান্ধীও চলে এলেন ভারতে ১৯১৫-এ। হোমরুল পাবার জন্য ভারতে নানারকমের ব্রিটিশ বিরোধী অন্দোলন চলছে। সাইয়ুদ এসব শুনে পড়াশুনা ছেড়ে লন্ডন থেকে চলে এলো ভারতে ১৯১৬-তে। সে খুব ভালো ইংরেজী লিখতো, বলতেও পারতো তেমন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে লেখার জন্য একটা দৈনিকে সম্পাদনার কাজ পেলো কোলকাতায়। চারিদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়লো সাইয়ুদের, সংগে ইংরেজদের খাতায় ব্ল্যাকলিস্টেডও হলো।

এদিকে মতিলাল নেহেরু এলাহাবাদে একটা দৈনিক কাগজ খুললেন “দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট”। মতিলাল সাইয়ুদের মতো এক নির্ভীক সাংবাদিককে খুঁজছিলেন, সাইয়ুদ পেলো প্রধান সম্পাদকের চাকরীটা। সেই সুবাদে সাইয়ুদ-এর যাতায়াত শুরু হলো মতিলাল নেহেরুর আনন্দভবনে।

একদিন পরিচয় হলো মতিলালের ১৯ বছরের রূপসী মেয়ে স্বরূপ ওরফে নান (পরে বিজয়া) এর সংগে, সাইয়ুদের বয়স তখন ৩১, সেটা ১৯১৯। কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রেমের গভীর পর্বে প্রবেশ করলো। মতিলাল নেহেরু তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, ছেলে জওহরলালকে মহাত্মা গান্ধী তখন তৈরী করছেনতাঁরউত্তরাধিকারী হিসেবে। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলায় বিজয়া পালিয়ে গিয়ে উঠলো সাইয়ুদের বাসায়, এলাহাবাদেই, কাঁদতে কাঁদতেবললতার বিয়ে প্রায় পাকাপাকি, সাইয়ুদকিছু একটা যেন করে এখুনি। সাইয়ুদ ভেবে ভেবে এক কাজীকে ডেকে এনে মুসলিম রীতিতেই বিয়ে করে ফেললো। খবরটা শুনে বিব্রত মতিলাল তখন লাহোরে কংগ্রেসের একটা মিটিং তাড়াহুড়া করে শেষ করলেন। এদিকে জওহারলাল নেহেরু ও তাঁর মা ছুটে গেলেনগান্ধীর কাছে সাহায্যের জন্য। গান্ধীকে খুব শ্রদ্ধা করতো সাইয়ুদ। গান্ধী সাইয়ুদকে ডেকে বোঝালেন, দেশের এই অবস্থায় এই ঘটনা উত্তেজনা সৃস্টি করবে। গান্ধী আরও বললেন এ ভালোবাসায় তোমায় পরীক্ষা দিতে হবে, সবকিছু শান্ত হওয়ার পরেও যদি এমন ভালোবাসা বর্তমান থাকে তাহলে তোমরা আবার ইউনাইটেড হতে পারো। সাইয়ুদ নীরবে সায় দিল গান্ধীর কথায়। লিখিত দিতে হলো যে সে বিজয়াকে ডিভোর্স দিবে ও বিজয়াকে আর খুঁজবেনা।ডিভোর্স হলো। বিজয়াকে নেয়া হলো গান্ধীর সবরমতি আশ্রমে পাপ মোচনের জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বিবাহ দেওয়া হয় রঞ্জিত সীতারাম পণ্ডিতের সংগে। আর সাইয়ুদকে দেশান্তরিত করা হলো। গান্ধীই তাকে পাঠালেন লন্ডনে ১৯২১-এ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরী করতে। বলে দেয়া হলো আর যেন সহসা ফিরে না আসে। এদিকে তাদের বিয়ের সব ডকুমেন্ট পুড়িয়ে ফেলা হলো। লন্ডন হয়ে সাইয়ুদকে চলে আসতে হলো আমেরিকায়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ও ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরী করতে।এখানে সে একটানা ২২ বছরনির্বাসনে ছিল।প্রায় ৪৮-টা স্টেট ঘুরেছে, এমন কোন বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় নেই যে সে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সেমিনার করে নি।

এর পর বহুদিন গড়িয়ে গেছে। ওদিকে বিজয়ার স্বামীর মৃত্যু হয় ১৯৪৪-এ, বাচ্চারা আমেরিকায় পড়াশুনা করছে তাই বিজয়া আমেরিকায় চলে এলো ১৯৪৫-এ তাদের কাছে, সেই সংগে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য জনমত তৈরী করার দায়িত্ব নিল। এই সুযোগে প্রেম যেন প্রাণ পেল; বিজয়া আর সাইয়ুদের পূনর্মিলন ঘটলো। সুন্দর কাটছিলো দিনগুলো। দুজনে একসংগে আমেরিকা ঘুরে বেড়াচ্ছে জনমত তৈরী করার লক্ষ্যে। এই পূনর্মিলন ভারতের আনন্দভবনে আবার যেন নাড়া দিলো। প্রেমিকযুগলের একসংগে আর থাকা হলনা। ভারতের স্বাধীনতা আসন্ন, সাইয়ুদ ফিরে গেল ভারতে স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৬-এ। কিছুদিন পর বিজয়াও ফিরে গেল ভারতে, আবার পূনর্মিলন ঘটলো। দেশ স্বাধীন হলো; পরের বছর, ১৯৪৮-এ জওহরলাল নেহেরু সাইয়ুদকে পাঠিয়ে দিলেন মিশরের রাষ্ট্রদূত করে আর বিজয়াকে পাঠালেন রাশিয়ায়, এভাবেই তারা শাস্তির বাটখারা বইতে থাকে সারাজীবন। ঐ যে বললাম বিজয়ার শেষ দেখা কায়রোতে, রাশিয়া থেকে জাতিসংঘে আসার নাম করে কায়রো যাত্রাবিরতিতে। শোনা যায় সাইয়ুদের মৃত্যুর পরও বিজয়া মাঝে মাঝে কায়রো যেত ও কবরের পাশে দাড়িয়ে কাঁদত।

 

শেষ কথা:

কে এই সাইয়ুদ হোসেন! সে ঢাকার এক নবাব সাইয়ুদ মোহাম্মাদ আজাদের ছেলে। আর একটু খোলসা করে বলি, আমাদের শেরে-এ-বাংলা ফজলুল হক ও স্যার হাসান সুরাওয়ার্দী (নেতা সুরাওয়ার্দীর বড় ভাই) এদের শ্যালক। আমেরিকায় নির্বাসনে থাকার সময় সাইয়ুদ ১৯৩৭-এ একবার ঢাকার বেগমবাজারে এসেছিল আত্মীয়দের সংগে দেখা করতে। সাইয়ুদ লন্ডনে যাবার আগে১৯১৯-এ একটি বইও লিখেছিল‘ইকোস ফ্রম ওল্ড ঢাকা’।গবেষকরা বলেন সাইয়ুদ বাইশ বছরে একাই আমেরিকাতে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরী করে। ১৯৪৬-এ ফিরে গিয়ে বিভক্ত যে ভারত সে দেখেছিল তা সে চায়নি, তবে তা অংকুরেই ছিলো, মুসলমানদের জন্য আলাদা এক রাষ্ট্র। আরও জানতে চাইলে পড়ুন এনএস বিনোদ এর বই ‘এ ফরগটেন এম্বাসেডর ইন কায়রো, দ্য লাইফ এন্ড টাইমস অব সাইয়ুদ হোসাইন’।

 

১৯১৩ লন্ডন, সাইয়ুদ হোসেন কেবল লন্ডনে গিয়ে পৌছাল পড়াশুনার জন্য। ছবির বাম দিক থেকে, স্যার হাসান সুরাওারদি(লেঃ কর্নেল; এমডি; এফআরসিএস; কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য (১৯৩০-১৯৩৪), হুসাইন শহীদ সুরাওারদি(রাজনৈতিক নেতা, স্যার জাহিদ সুরাওারদির ছোট ছেলে), শাহিদ সুরাওারদি (হুসাইন সুরাওারদির বড়ো ভাই, রাষ্ট্রদূত, ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন,দ্য কোলকাতা স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রধান আর্ট ক্রিটিক, চিরকুমার ছিলেন) ও সর্বডানে সাইয়ুদ হোসাইন।