You are currently viewing একটি ফুলকে বাঁচাব বলে / ফারুক মঈনউদ্দীন

একটি ফুলকে বাঁচাব বলে / ফারুক মঈনউদ্দীন

একটি ফুলকে বাঁচাব বলে

ফারুক মঈনউদ্দীন

জুট মিলের শ্রমিক কলোনির একটা কাঁচা ঘরে ওকে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় হারুন বলেছিল, এটাই আপাতত সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ওর যুক্তিটাও বেশ জোরালো, মিল এলাকায় নানান জাতের মানুষ আসে যায়, ভাসমান এসব মানুষের খবর কজনই বা রাখে? পাড়াগাঁয়ের মধ্যে বরং গা ঢাকা দিয়ে থাকায় বিপদ আছে। এমনিতেই গ্রামের মানুষ বড্ড বেশি কৌত‚হলী, তার ওপর শত্রুর ভয়ে সন্ত্রস্ত একটা জনপদে আচমকা অচেনা লোক দেখলে কৌত‚হলের চেয়ে বেশি হবে বিপদের ভয়। ওদের ঘটনাহীন বিবর্ণ জীবনে নতুন কিছু ঘটনা কিংবা অচেনা মানুষের মুখ দেখলেই তার নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত পিছু লেগে থাকতে পারে ওরা।  এরকম কাউকে দেখলে প্রথমে তীক্ষ্ম চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জরিপ করবে, তারপর উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে জান খারাপ করে ফেলবে। সুজাউদ্দিনকে সান্তনা দেওয়ার জন্যই বোধ হয় লম্বা একটা রচনার শেষে উপসংহারের মতো হারুন বলে, ‘গা ঢাকা দেবার জন্যি বড় শহরের বাসাবাড়ির মতো ইরাম জায়গাও ভালো, কে কোয়ান থে আইল কোয়ানে গেল পিছে লাইগে থাকবে না। শহরে যায়ে থাকেন, দেখবেন কেউ চাইয়েও দেখবি না। ’

ওর কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয় সুজাউদ্দিন, একটু হেসে বলে, ‘ঠিক আছে, বুঝলাম, এডা কার ঘরে তুইলে দিলি, যার ঘর সে কোয়ানে?’

হারুন বলে, ‘যার ঘর সেও থাকবে, ও সব জানে, আমাগের মানুষ।’ তারপর আবার বলে, ‘ওসব কতা চিন্তা করতি অবে না নে। আমি চিন্তা করতিসি আৎকা কেউ জিগ্যাস করলি কি কবেন। কতি অবে, বদলী কাজ করতি আইছেন। ইরাম বহু বদলী লেবারের আসা যাওয়া আছে এহানে। আবার কেউরে কতি পারেন, টেম্পরালি, শুদ্ধ কইরে আবার টেম্পোরারি কয়ে দিয়েন না য্যান। টেম্পোরারি শ্রমিকও এহানে ম্যালা।’ সুজাউদ্দিন আবারো হাসে, ছেলেটা কেবল চটপটে নয়, বুদ্ধিও রাখে।

বর্ডার ক্রস করে আসার পর সুজাউদ্দিনের এটাই প্রথম ডেরা। নিজ এলাকায় হুট করে যাওয়া এখনই নিরাপদ নয়। এখানে থেকে এলাকার পরিস্থিতি দেখে শুনে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে অন্য দিকে এগোতে হবে। আপাতত এদিককার গলিঘুঁজি পথঘাট, লোকজনের চলাফেরার ভাবগতিক বুঝে নেওয়া দরকার। ট্রেনিংয়ে থাকার সময়ের কঠিন দিনগুলোর চেয়ে অবস্থা এখানেও খুব বেশি ভালো নয়। মনে হবে সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক, কিন্তু চারপাশে একটা বিমর্ষ মেঘলা দিনের গুমোট ভাব। রোদটাও ম্লান, যেন বহুদিন বন্ধ পড়ে থাকা ঘরের দেওয়ালের মতো ছাতলা পড়ে আছে। পথে নামা লোকজনের মধ্যে ত্রস্ত পলায়নপর ভঙ্গি, কোনো রকমে বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরতে পারলেই যেন নিরাপত্তার দেয়ালের পেছনে গা ঢাকা দেওয়া যাবে। ওপাড়ে থাকার সময় এদিককার অবস্থা ঠিক কেমন, ধারণা করতে পারেনি। কখনো ভেবেছে সরকারি দাবি মোতাবেক সব কিছু আগের মতো চলছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই। আবার কখনো মনে হয়েছে রোজ রাতের অন্ধকারে ধুন্ধুমার হামলা হচ্ছে, তারপর গ্রাম খালি করে ভয়ার্ত মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে আপাত নিরাপদ আশ্রয়ে। সীমান্ত পেরিয়ে ও দেশে ঢুকেছে এক হপ্তা পেরিয়ে গেছে, এরকম কাঙ্খিত কোনো আলামত পাওয়া যায়নি এখনো।

যেমন ভেবেছিল প্রকৃত অবস্থা ঠিক সেরকম না হলেও মানুষজন যেমন জবুথবু হয়ে চলাফেরা করে, জলপাই রঙের ট্রাকের অস্ত্রধারীরা সেরকম না হলেও খুব বুক ফুলিয়ে চলে বলে মনে হয় না। সতর্ক সন্ত্রস্ত চোখে ওরাও এদিক সেদিক তাকিয়ে নির্জন জনপদের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। ট্রাকের জান্তব শব্দের নিচে চেপে রাখতে চায় ওদের ভয়। রাতের বেলা ওদের চলাফেরা একবারেই বন্ধ, সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই ক্যাম্পের গর্তে সেঁদিয়ে যায় সবাই। সীমান্ত পেরিয়ে ভেঙে ভেঙে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ঠিক এরকমই মনে হয়েছে ওর। তবে এপারে পা দেওয়ার পরই ভেতরের কোথাও যেন একধরণের স্বস্তির হাওয়া বয়ে গিয়েছিল, সেটা শরীরে নাকি মনে, ঠিক ধরতে পারেনি সুজাউদ্দিন। সীমান্তের দুধারের প্রকৃতি ও আবহাওয়া অভিন্ন হলেও কিছু একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে, সেটা যে  ঠিক কী, ধরা যায় না। ওদের পোশাক, কথাবার্তা, দোকানপাটের সাইনবোর্ড, নাকি ছাপড়া ঘরের বেড়ায় লাগানো উৎকট প্লাস্টিকের পর্দায় অপরিচিত নাম ও ভাষার বেমানান দৃশ্যপট-কে জানে?

নতুন ডেরায় এসে প্রথম কদিন বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সুজাউদ্দিন। ট্রেনিং ক্যাম্পের কষ্টকর দিনরাতগুলোর পর দীর্ঘ পথশ্রম আর অনিশ্চিত আশঙ্কার ক্লান্তি ঘোচানোর জন্য ঘুমই ছিল একমাত্র আশ্রয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছানোর আগের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা এখন ভাবতে না চাইলেও মাঝে মাঝে এসে হানা দেয়। মাইলের পর মাইল মানুষের মিছিলের সাথে হেঁটে যাওয়া, খাঁ খাঁ করা গ্রামের মধ্যে আচমকা দেখা পাওয়া শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে থাকা উদভ্রান্ত একাকী মানুষ-এসব দৃশ্য এখনো স্মৃতিমলিন হয়নি। একটা অপরিচিত নদী পার হয়ে ট্র্রাকের পেছনে পশুবোঝাই অবস্থায় সীমান্তের ওপারে পৌঁছে স্বস্তি মিললেও অচেনা সেই ছোট লোকালয়ের সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে পরিচয়হীন মানুষের মাঝে বুক খামচে ধরা একধরনের হাহাকার কাবু করে ফেলেছিল ওকে। শরণার্থী শিবিরের মানুষের অসহায় স্বার্থপরতার নজির দেখে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ও। ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার পর একঝাঁক সহযোদ্ধাকে পেয়ে আবার বেঁচে থাকার আশা জেগে উঠেছিল ওর ভেতর।

সেসব দিনের ক্লান্তি আর দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটানোর জন্যই যে ঘুম দরকার, তা নয়, অপরিচিত জায়গায় লোকজনের দৃষ্টি এড়ানোর জন্যও ঘরের ভেতর নিজেকে বন্ধ রাখার দরকার ছিল। ঘরের আদি বাসিন্দাটি এখনো আসেনি একবারও, তার বদলে হারুন এসে ওর সাথে থেকেছে। সুজাউদ্দিনকে বলেছে, ‘ওরে আমার ওহানে থাকতি বলিছি, ভাবলাম ওর সাথে থাকতি আপনার অসুবিধে হতি পারে।’ তাছাড়া চেনা পরিচয় কম হওয়াই নিরাপদ। কেউ একজন ধরা পড়ে গেলেও নাম চেহারা জানা না থাকলে বাকিরা নিরাপদ। ‘আর্মি ক্যাম্পে ধইরে নিয়ি গেলি টর্চার কইরেও কারো নাম পরিচয় বাইর করতি পারবে না নে।’ ছেলেটার এই গোছানো পরিকল্পনায় সুজাউদ্দিন আশ্বস্ত বোধ করে। ওর বাড়ি ঠিক এখানে নয়, তবে আত্মীয়কুটুম আছে বলে অনিয়মিত আসা-যাওয়ার সুবাদে একেবারে অচেনা ভিনদেশী নয়। এদিকে পরিচিত অনেকেই আছে ওর।

এক বিকেলে ওকে নিয়ে চায়ের দোকানে যায় হারুন। পরিচিত কারো সাথে দেখা হয় না বলে ওর মধ্যে কিছুটা স্বস্তির ভাব। দোকানের বেি তে বসে চায়ের অর্ডার দেয় হারুন। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে এরকম চায়ের দোকানে বসার অভিজ্ঞতা সুজাউদ্দীনের আছে। ছোট কাচের কাপে লিকার চা সামনে নিয়ে বসে থাকা উদভ্রান্ত চেহারার দুয়েকজন ওদের দিকে একবার তাকায়, তারপর আবার নিজেদের মধ্যে নিচুগলায় কথা বলতে থাকে। কেউ কেউ কথা থামিয়ে অন্যদের ওপর চোখ বোলায়। যারা একা বসে চায়ের গøাসে চুমুক দিচ্ছিল, তারা কারো সাথে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে এক এক করে সবার চেহারা জরিপ করে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখাচোখি হলে চোরচোর ভাব করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেয়। সবার ভেতর দিয়ে একটা চাপা সন্দেহের চোরা হাওয়া যেন গোপনে বয়ে যায়। হারুন দোকানের বুড়ো মালিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ও চাচা, খবর-টবর কি?

প্রশ্নটার মধ্য দিয়ে একটু মজা করার চেষ্টাকে আমলে না নিয়ে দোকানের লোকটা খদ্দেরদের ওপর একটা সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বেজার মুখে বলে, ‘নতুন কিছু নেই। কেউর কাছে যেডা ভালো খবর, আরাকজনের কাছে সেইডেই খারাপ। সেজন্যিই কচ্ছি নতুন খবর না হলিই ভালো।’

সুজাউদ্দিন বেশ মন দিয়ে বুড়োর কথা শোনে, লোকটা কোন দিকে ইঙ্গিত করল বোঝা যায় না। হারুন গুমোট আবহাওয়া সরিয়ে পরিবেশটাকে আরো হালকা করার জন্য বলে, ‘খুব মারফতি কতা কলেন চাচা? জব্বর বলিছেন তো।’

দোকানের লোকটা এবারও ওর প্রয়াসে যোগ না দিয়ে বলে, ‘মিলির মধ্যি ক্যাম্প হয়েছে, নতুন লোকজন আসিছে, পাঞ্জাবি পুলিশ।’

হারুন জানায়, ‘দেহিসি, কালো ড্রেস।’

এটুকু বলার পর আচমকা সবাই চুপ করে যায়, নামটা যেন অবাঞ্ছিত কোনো শব্দ, দোকানের লোকটা অবুঝ শিশুর মতো না বুঝেই বলে ফেলেছে। একথায় কেউ কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পায় না, কিংবা আলোচনাটা আর টেনে নিয়ে যায় না। কথা বাড়ালে কোন দিকে বাঁক নেয় ঠিক নেই, তাই কেউ ঝুঁকি নেয় না। জায়গাটাতে নেমে আসে অস্বস্তিকর নিরবতা, নিজেদের মধ্যে যারা গুনগুন করে কথা বলছিল তারাও চুপ করে যায়। কেবল ফিসফিসানির মতো চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার শব্দ ছাড়া কিছুক্ষণ আর কিছুই শোনা যায় না। আসলে অপরিচিত মানুষের মধ্যে কথাবার্তার বিষয়ও সীমিত হয়ে এসেছে, তাই চায়ের দোকানের পরিচিত আবহ পাওয়া যায় না।

চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পড়ে ওরা, ফিরে আসতে আসতে হারুন বলে, ‘এহানে কদিন থাকতি অবে, তাই  আপনারে নিয়ে দোকানে গেলাম, এহানে ওহানে ঘুরবানে কদিন। লোকজন দেখবে আপনারে, আৎকা কেউ য্যান বলতি না পারে আপনি নতুন মানুষ।’ হারুন সায় দেয় ওর কথায়। ওকেও তো জায়গাটা ভালো করে চিনতে হবে। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাই বরং সন্দেহজনক।

দিন কয়েক পর হারুন এসে একটা ফালতু ঝামেলার কথা জানায়। মুক্তিযোদ্ধা নাম দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে একজন। যার কথা বললো, সেই ছেলেটাকে চেনে ও, স্থানীয় কলেজে পড়ত। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভাবভঙ্গি পাল্টে গিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কাজের চেয়ে অকাজেই ব্যস্ত থাকত বেশি। জোর করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কমিটিতে থাকার জন্য মাস্তানী করার জন্য বেশ মার খেয়েছিল দুবার। নামটা মনে ছিল না সুজাউদ্দিনের, হারুন বলার পর মনে পড়ে, আলতাফ। কলেজের সামনের চায়ের দোকানে বাকি খেয়ে পয়সা না মেটানোর জন্য কদিন পরপরই ওর বিচার করতে হতো। মেয়েদের উত্যক্ত করার জন্য একবারতো কলেজ থেকে প্রায় বের করে দেওয়া হচ্ছিল, পরে মাফটাফ চেয়ে কোনোরকমে বেঁচে যায়। সুজাউদ্দিনের মনে পড়ে ইসমাইল ডাক্তারের মেয়ে ফিরোজাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসার পর বহু হুজ্জত হয়েছিল। ফিরোজার ওপর যাদের চোখ ছিল, ওরাও পুরোপুরি নিতে পেরেছিল এই সুযোগ। ইসমাইল ডাক্তার স্থানীয় নেতা, ইলেকশনের কাজের ব্যস্ততায় এটা নিয়ে সময় নষ্ট করার সুযোগ ছিল না। ফিরোজার বড় ভাইয়ের পড়াশোনা শেষ হয়নি তখনো, ফাইনাল ইয়ারের শেষ ধাপে। বড় ছেলেকে ডেকে ডাক্তার কেবল বলেছিলেন যে ছোট বোনকে দেখে রাখার কাজটা ওরই করা উচিত ছিল। তবে ওকেও যে বিশেষ কিছু করতে হয়েছে তা নয়। ফিরোজার গোপন ভক্তদের সামনে একটা বড় সুযোগ এসে গিয়েছিল। ওদের নিয়ে মেয়েটির বড় ভাইয়ের বন্ধুরা সাইকেলের চেন দিয়ে মেরে প্রায় আধমরা করে কলেজ রোডের ওপর ফেলে রেখেছিল আলতাফকে। কোনো বড় ঘরের ছেলে হলে এই কাজের জন্য উল্টো ওদেরই পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হতো। কিন্তু আলতাফের পরিবারের তরফ থেকে এটা নিয়ে কেউ কোনো দরবার করতে আসেনি। আসার ক্ষমতা ছিল না, এলেও লাভ হতো না কোনো। আলতাফের বড় ভাই চাষবাস করা গেরস্ত মানুষ, দৌড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত। কিন্তু ছোটভাইয়ের কীর্তি সম্পর্কে নানান বৃত্তান্ত শুনে আর সামনে বাড়ার সাহস পায়নি। সত্তরের নির্বাচনের ডামাডোলে পুলিশ রাজনৈতিক হাঙ্গামা সামলাতে ব্যস্ত, এই খুচরো মারামারির বিষয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত ছিল না ওদের। আলতাফ সম্পর্কে থানায় ভালো রিপোর্ট ছিল না বলে এই ঘটনায় নাখোশ হয়নি ওরা, কাজটা বরং সোজা হয়ে গিয়েছিল ওদের জন্য। দায়সারা একটা তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে ঘটনাটা শেষ করে দিতে হয়েছিল।

সুজাউদ্দীন ভাবে, তাহলে যুদ্ধ শুরু হলে কোনো এক ফাঁকে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল সেই আলতাফ, কিংবা গিয়েছে কি না কে জানে? জীবন বিপন্ন করে ওর যুদ্ধে যাওয়াটাই অবাক করার মতো বিষয়, ব্যাপারটা ওর সঙ্গে যায় না। যদি সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েও থাকে, তাহলে হয়তো ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরার পর ওর ডাকাতি করার খবরটা নতুন হলেও শুনে অবাক হয় না সুজাউদ্দিন। কলেজে থাকতে ওকে যেভাবে দেখেছে তাতে ওর পরিণতি যে এরকম হবে সেটা একেবারে অভাবনীয় নয়।

হারুন বলে, চিনতি পারিসেন?

সুজাউদ্দিন সায় দিয়ে জিগ্যেস করে, ওর সাথে কারা আছে? ওর একার পক্ষে তো ডাকাতি করা সম্ভব নয়।

হারুন জানায়, সাতে যাগের জুটোয়ে আনিসে ওগের কেউ ট্রেনিং নেয়নি, তয় অস্ত্র চালাতি পারে বোধয়। ইদিকে বদনাম হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাগের। ওর মতে, কোনোরকমে গুলি চালাতে পারলেই হয়, ওদের তো যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। ‘আর গুলি চালাচ্ছে কিডা? অস্ত্র দেহালেই কাজ অয়ে যায়।’ হারুন জানায়, অস্ত্রও যে সবসময় দরকার হয় তা-ও নয়। বাড়ি ছেড়ে প্রায় সবাই পালিয়ে গেছে এমন বাড়িগুলোই আলতাফের টার্গেট। ওসব বাড়িতে লোকজন বেশি থাকে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি হলে তো কথা নেই, তালা দেওয়া ফাঁকা বাড়ি, একটা কুকুরও নেই। অস্ত্র হাতে থাকলে উল্টো বিপদ।

সুজাউদ্দিন বলে, ওকে থামাতে না পারলে তো লোকজন খেপে গিয়ে আমাদের ধরিয়ে দেবে। কিন্তু ও-ই যে কাজগুলো করছে তার প্রমাণ কী? হারুন বলে, ‘কদিন আগে আজিজ শেখের বাড়িতি যাওয়ার পর ওরা চিনে ফেলাইসে। ভাগ্য ভালো বুঝতি দেয়নি ওরে।’ ওকে ধরে নিয়ে সে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলেই ওরা শনাক্ত করতে পারবে। কিন্তু কীভাবে সে বাড়িতে নেওয়া যায় ওকে? অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত একটা পরিকল্পনা ঠিক হয়। আলতাফের দলের একজনকে দিয়ে ওকে ডাকিয়ে বাড়ি থেকে বের করতে পারলে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে আজিজ শেখের বাড়িতে। হারুন বলে, ও নিজেই তো ডেকে আনতে পারে আলতাফকে। সুজাউদ্দিন ওকে থামিয়ে দেয়। যদি ছেলেটাকে মেরে ফেলতে হয়, তখন ওর বাড়ির লোকজন বলবে রাতের বেলায় হারুন এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। সবাই বুঝে ফেলবে কাজটা কার। তাই ওকে ডেকে বের করার কাজটা ওর দলের কাউকে দিয়েই করাতে হবে। হারুন বোকার মতো হেসে বলে, ‘ঠিক বলিসেন তো, ওভাবে চিন্তা করিনি। ইউনিভার্সিটি আর কলেজের মধ্যি এহানেই তফাৎ।’ তারপর জানায় একাজটা আরো সহজ হবে ওর জন্য। আলতাফের দলের দুয়েকজনকে ভালোই চেনে ও। ‘একটা বড় ডাকাতির গপ্পো বানায়ে একডারে ফিট করা যাবে নে।’

পরের রাতেই করতে হয় অপারেশনটা। দুটো ছাতার ভেতর দুজনের দুটো স্টেনগান ঢুকিয়ে শিকগুলোর মাথার দিকটা সুতলী দিয়ে বেঁধে নিলে বেশ ভারি হয়ে যায় ওটা, তবে রাতের অন্ধকারে বোঝার কোনো উপায় নেই। ছাতার ভেতর রাখতে হলে গুলিভর্তি ম্যাগাজিনটা আলাদা করতে হবে, তাই কোমরে গুঁজে নিতে হয়েছে। আগে কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখেছে, ছাতার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে ম্যাগাজিন লাগিয়ে নেওয়ার কাজটা  কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সারা যায়। এই মৌসুমে ছাতা হাতে রাখা অস্বাভাবিক নয়। রওনা হওয়ার পর হারুন বলে, রাজাকার বিটাগের সাতে দ্যাহা না হলিই অয়। ভরসার কতা হচ্ছেগে শালারা রাইতে ভয়ে বারায় না। ওর কথাই ঠিক, পথে কি রাজাকার, কি মানুষ, কারো সাথেই দেখা হয় না। কোনো কোনো পাড়ার দুয়েকটা কুকুর ডাক ছেড়ে ছুটে এসে কিছু আঁচ করতে পেরেই যেন চুপ করে যায়, তারপর ওদের দিকে উৎসুক তাকিয়ে থেকে একসময় সমঝদারের মতো ফিরে যায়। আলতাফের বাড়িতে পৌঁছার আগে একটা বাড়িতে ঢুকে হারুন চাপা গলায় ডাক দেয়। প্রায় সাথে সাথেই বাড়ির ভেতর থেকে তিনজন বেরিয়ে এসে যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। ওদের একজন নিরস্ত্র, আলতাফের দলের। সুজাউদ্দিন আগে কখনো দেখেনি ওদের। হারুন ওদের মধ্যে দুজনকে দেখিয়ে বলে, ম্যালা সাহস এদুডোর। চিন্তা কইরেন না। এরা যে ওদের নিজেদের দলের, সেটা আর বলে দিতে হয় না।

আলতাফদের বাড়িটা গাছপালার ছায়ায় কয়লার বিশাল স্তুপের মতো উবু হয়ে পড়ে ছিল, ভেতরে ইতস্তত কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যায়। ওর দলের ছেলেটা বাড়ির বাইরে থেকে চাপা গলায় ডাক দেয়। ওর ডাকের সাথে সাথে ভেতরের গুনগুন শব্দ থেমে যায়। বাঁশের বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে আসা হ্যারিকেনের হালকা আলোর বিন্দুগুলোও মুছে যায় নিঃশব্দে। ছেলেটা আরেকবার ডাক দেয়, আলতাফ ভাই? ভেতর থেকে কে যেন সন্তর্পনে বলে, কিডা? ছেলেটা এবার বেড়ার গায়ে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘ভাইজান, আমি আতিয়ার, একটা খবর আছে।’

এটাই ওকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিচিত গলা পেয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে খালি হাতেই বেরিয়ে আসে আলতাফ। সাথে সাথে আলতাফ আর ওদের সাথে আসা ছেলেটার হাত আর মুখ বেঁধে ফেলে ওরা। মুহূর্তের মধ্যে ছাতার ভেতর থেকে স্টেন গান বের করে নিয়েছে সুজাউদ্দিন, কোমর থেকে ম্যাগাজিন বের করে ফিট করে নেয়। হারুনও তা-ই করে। বড় করে বাঁকানো ছাতার হাতলটা কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে নিয়েছে। ধাক্কা দিয়ে বাড়ির সীমানা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার সময় আলতাফ হাত বাঁধা অবস্থাতেই ঠেকানোর চেষ্টা করে। হারুন চাপাস্বরে বলে, ‘আমভগের সাতে না গেলি এহানেই শ্যাষ কলাম।’

মুখে বাঁধা গামছার ভেতর থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে আলতাফ, হারুনের সাথে আসা একজন বলে, ‘কোনো কতা না কয়ে হাঁটতি থাক। উল্টোপাল্টা করলি ঝাইড়ে দেবানে।’ অন্ধকারের ভেতর অপরিচিত রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সুজাউদ্দিন দুয়েকবার হোঁচট খেয়ে সামলে নেয়।

আলতাফ আবারো কিছু একটা বলতে চাইলে হারুন বলে, ‘কোয়ানে যাচ্ছি? দেখবা নে খানিক বাদে।’ আলতাফ অনিচ্ছুক পায়ে দাঁড়িয়ে পড়তে চায়। ওর পিঠে স্টেনগানের নল দিয়ে গুঁতো দিয়ে হারুন বলে, ‘সুজা বাই, তাহলি এহানে ফেলায়ে দিই মালডারে?’ একথার পর আলতাফের পা আবার সচল হয়।

আজিজ শেখের বাড়িতে এসে যখন ওরা পৌঁছায়, বাড়ির সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এত রাতে অপরিচিত গলার ডাক শুনে আজিজ শেখ কিছুতেই দরজা খুলতে চায় না। ঘুমভাঙা গলায় কেবল খুব সাবধানে বলে, ‘কিডা এত রাইতে?’ সুজাউদ্দীন এগিয়ে এসে বলে, ‘চাচা, আপনাগের বাড়িতি ডাকাতি করিসিল যারা, দ্যাহেন চিনতি পারেন কি না।’

একথা শোনার পর ভেতরে খানিক শলাপরামর্শ চলে হয়তো। তারপর আজিজ শেখের ছোট ভাই বের হয়ে আসে। হাত মুখ বাঁধা দুজনকে দেখে বড় ভাইকে ডাকে। ওদের মুখের বাঁধন খুলে দিলে হাতের হ্যারিকেন তুলে ধরে ভালো করে দেখে দুই ভাই। তারপর বলে, ‘দ্যাহা লাগবেনা নে। সেদিনই চিনতি পারিসি। আরো দুজন ছিল, ওরা কোয়ানে? আইসে কয়, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। শুইনে সন্দেহ না কইরে দরজা খুইলে দিলাম।’

‘ঠিক আছে, আর কতি অবে না। খানকির ছাওয়ালগের বিচার আমরাই করবানে’ বলে হারুন আবার ওদের মুখ বেঁধে দেয়। যাওয়ার আগে সুজাউদ্দিন আজিজ শেখকে বলে, ‘কি কি ডাকাতি করিছে পরে আইসে শুনবানে। চিন্তা কইরেন না য্যান।’

তারপর দুজনকে নিয়ে নদীর দিকে রওনা হয় ওরা। দুজনের পেছনে দুটো অস্ত্র তাক করা। আলতাফ এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার মুখবাঁধা গামছার পেছন থেকে গোঁ গোঁ করে বলার চেষ্টা করে, ‘আর করবো না নে ভাইজান, আমাগের আপনার দলে ঢুকোয়ে নেন।’ সুজাউদ্দিন কোনো কথা বলে না। হারুন বলে, ‘ঢুকোচ্ছি আমাগের দলে।’ আলতাফের দলের ছেলেটা একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, হারুন ওকে মাথার চুল ধরে টেনে তোলে। তারপর বলে, আরাকবার পড়লি কলাম আর টাইনে তুলবনা নে। কি করব বুইজে নিস।

ওরা যখন নদীর পাড়ে পৌঁছে, তখন মরা কাটালের জোয়ারের জল যেন থম মেরে আছে। খাড়া পাড়ের কাছে দাঁড় করিয়ে মাত্র দুটো গুলি খরচ করে সুজাউদ্দিন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘এগের জন্যি গুলি খরচ করাও লোকসান।’ নিশুতি রাতে গুলির শব্দের ধকল কাটাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওরা। শরীর দুটো ততক্ষণে স্থির হয়ে আসে। হারুন ওদের মুখের ওপর টর্চ জ্বেলে দেখে, তারপর লাথি মেরে দেখে সত্যিই মরেছে কি না। বাকি দুজন ওদের শরীর হাতড়াতে থাকে, যদি কিছু পাওয়া যায়। সুজাউদ্দিন তাগাদা দেয়, জলদি এখান থেকে সরে পড়তে হবে। গুলির শব্দে কেউ এসে পড়লে মুশকিল।

আলতাফের পকেট হাতড়ে কিছুই পাওয়া যায় না। হারুন ওদের বলে, এহন যে যার ডেরায় যায়ে ঘুমো। সুজাউদ্দিনের সাথে আস্তানায় ফিরতে ফিরতে বলে, যারা ওরে মুক্তিযোদ্ধা বইলে চেনে, তারা মনে করবে রাজাকারেরা মারিসে ওরে। কিন্তু চিন্তুা করতিসি রাজাকারেরা কি চিন্তা করবে। ওরা তো মারেনি, তাহলি মারল কিডা? সুজাউদ্দিন কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটে, তারপর বলে, পয়লা অপারেশনে হাতটা গন্ধ করে ফেললাম। তবু এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেছে। সবাই ভাববে এটা রাজাকারদের কাজ, এই সুযোগে একটা ডাকাত নিকেশ হলো।

শ্রমিক মহল্লায় ঢুকে খুব স্বাভাবিক গলায় গুনগুন করে ‘আমায় ভাসাইলি রে’ গান ধরে হারুন, যেন যাত্রা দেখে ঘরে ফিরছে। সুজাউদ্দিন শিখিয়ে দিয়েছিল, চলাফেরায় সহজভাব রাখতে হবে, যাতে মনে না হয়, কিছু গোপন করছে ওরা। গান থামিয়ে হারুন চাপা স্বাভাবিক গলায় বলে, অস্ত্র নেওয়ার জন্যি আর ছাতা নেওয়া যাবে না নে। অন্য কায়দা বার করতি অবে। হারুন কেবল ‘হুম’ শব্দ করে সায় দেয়।

কয়েকদিনের সতর্ক ঘোরাঘুরিতে সুজাউদ্দিন বুঝতে পারে, এখানে বড় সমস্যা রাজাকারদের উৎপাত, মিলিটারি নয়। অচেনা দেশের প্রত্যন্ত অ লের ভেতরের খোঁজখবর মিলিটারিরা জানে না, এসব সংগ্রহ করে দেওয়ার কাজটা এরাই করে। এখানকার রাজাকার কমান্ডার ইলিয়াস চেয়ারম্যান ওদের ক্যাম্প অফিস করেছে কমিউনিটি সাইক্লোন শেল্টারে। ঘাঁটিটা কেবল ওদের অপারেশনাল অফিস নয়, রাজাকারের একটা দল নিয়ে রাতেও এখানে ঘুমায় ইলিয়াস চেয়ারম্যান। পুরো দলটাকে নিকাশ করতে পারলে একটা বড় কাজ হবে। নতুন কেউ এই কাজে ঢুকতেও ভয় পাবে। বাজারে হেঁটে টহল দেওয়া গরীব চেহারার দুয়েকটা ছিঁচকে রাজাকারকে খতম করে লাভ হবে না। পালের গোদাকে ধরতে পারলে এলাকার বেকার অভাবী ছেলেদের চাকরির লোভ দেখিয়ে রাজাকারের দলে ঢোকানো কঠিন হবে ওদের জন্য। কাঁধে থ্রি নট থ্রি ঝুলিয়ে কায়দা করে হেঁটে হেঁটে এতদিন হাট বাজার পাহারা দেওয়ার কাজ করছিল ওরা। কিন্তু ইদানিং সাহস বেড়েছে বলে মনে হয়। ইসমাইল ডাক্তারের খালি বাড়িতে হামলা করেছে সেদিন। সেখানে গোপনে আশ্রয় নেওয়া টিপুকে নিরস্ত্র পেয়ে ওকে ঘিরে ধরে মেরে ফেলেছে। টিপুর বাবা রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক, এখানকার স্টেশন থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার পর টিপু থেকে গিয়েছিল হারুনদের দলের সাথে। এখন ওর বাবা-মায়ের কাছে কী জবাব দেবে ওরা?

এই ঘটনার পর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, পালের গোদাসহ দলের কয়েকজনকে একসাথে শেষ করতে হবে। আজ টিপু গেছে, কাল আরেকজন যাবে। অপারেশনের জন্য দল তৈরি হয়, আরেকটা প্লাটুন থেকে যাদের নেওয়া হয় তাদের মধ্যে ইলিয়াস চেয়ারম্যানের ভাইপো সুবেদার নাজিমের ব্যাপারে সুজাউদ্দীনের আশঙ্কা ছিল। তবে নাজিমের প্লাটুন কমান্ডার নিশ্চিন্ত করে, বলে, সে দলে থাকলে বরং সুবিধাই হবে। চাচা হলেও জায়গা-সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ওদের ভেতর সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়, এই সুযোগটা কাজে লাগাতে দুবার ভাববে না নাজিম। অপারেশনটার নেতৃত্বে সুজাউদ্দীন, তাই কাকে দলে নেওয়া হবে তার চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্তও ওর, তবু প্রথম বড় অপারেশন বলে দোনোমোনো করেও নাজিমকে রাখতে রাজি হয় ও। এরকম সময় অন্য গ্রুপের সাথে বিরোধে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

কয়েকবার রেকি করে ঠিক হয়, মাঝরাতের পর ঘুমের মধ্যে গিয়ে ধরতে হবে ওদের। একটা দল জায়গাটা ঘিরে ফেলবে, আরেক দল দোতলায় উঠে ওদের সারেন্ডার করাবে। সীমানা দেওয়াল নেই বিল্ডিংটার, ওঠার সিঁড়ির মুখে দুজন বসে পাহারা দেয়, তবে সেটাও নামকাওয়াস্তে, আসলে বসে বসে ঝিমায়। এলাকারই গরিব ঘরের ছেলে এরা, কাজটা কেবলই চাকরি। ওদের অপরাধ একটাই মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে রাজাকারের চাকরি নিয়েছে।

নির্দিষ্ট রাতে ওদের দলটা ধানক্ষেতের আল ধরে নীরবে এগিয়ে যায়, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘযুক্ত আকাশে বাংলা বল-সাবানের মতো ক্ষয়ে আসা চাঁদটা ঘর-বাইর করছিল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, বহু দূর থেকে অশুভ বিলাপের মতো মাঠের ওপর দিয়ে ভেসে আসছিল বেপাড়ার কুকুরের প্রলম্বিত ডাক। ধানক্ষেতের মাঝে কেয়াঝোপে ঢাকা ছোট কুয়োর মধ্যে মাছের আচমকা মৃদু ঘাঁইও রাতের নিস্তব্ধতাকে চলকে দেয় যেন।

মাঠের বিস্তার শেষ হওয়ার আগেই হালকা আলোয় সাদা বিল্ডিংটার ম্লান ছায়া দেখা যায়। সুজাউদ্দীনের ইশারায় দলটা ছড়িয়ে পড়ে। পেছন থেকে দুদিক দিয়ে এগিয়ে সামনের সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতে হবে। সেন্টার আর প্রাইমারি স্কুলের মাঝের খোলা জায়গাটাতে সবাই জড়ো হয়। স্কুলের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ইট বিছানো রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, তার পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানগুলোর অন্ধকার ঝুপসি ছায়ার পেছন দিয়ে নীরবে দুটো দল দুই দিকে চলে যায়। দোকানের সামনের রোয়াকে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরের কান ফাঁকি দিতে মাটিতে পায়ের কোনো শব্দ করে না কেউ। বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে গিয়ে সামনের বন্ধ জানালাগুলোর গা ঘেঁষে দুপাশ থেকে ওরা যখন আচমকা সিঁড়ির সামনে পৌঁছায়, ঝিমুতে থাকা দুই পাহারাদার লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, লম্বা রাইফেল দুটো কোনো কাজে আসে না। ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে হারুন বলে, ‘গলা দে আওয়াজ বার করলি ফুটোয়ে দেবানে।’ অন্ধকারে ওদের চোখের দৃষ্টি দেখা যায় না, সহজাত প্রবৃত্তিতে বাধা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বুঝতে পারে বাধা দিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। ওদের হাত মুখ বেঁধে ফেলতে ফেলতে দুজনকে নিচে পাহারায় রেখে দলের বাকিদের নিয়ে দ্রুত দোতলায় উঠে যায় সুজাউদ্দীন।

ইলিয়াস চেয়ারম্যান কোন রুমে থাকে খবরটা আগেই জোগাড় করা হয়েছিল। সেই ঘরের বন্ধ দরজায় শব্দ করে সুবেদার নাজিম ডাক দেয়, ‘ও কাহা।’ দুবার ডাকতেই ‘কিডা ওহানে’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে ইলিয়াস চেয়ারম্যান। নাজিম নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, ‘দরজা খোলেন কাহা। খুব জরুরী।’ ভেতরে কাউকে যেন ডেকে ওঠায় চেয়ারম্যান, তারপর দরজার খিল খোলার শব্দ শোনা যায়। বাইরে আধো অন্ধকারে এতগুলো মূর্তি দেখে ইলিয়াস চেয়ারম্যান নাজিমকে বলে, ‘তোর সাতে এরা কিডা?’ এসময় সুজাউদ্দীন এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘আমাগের চিনবেন না। বুইঝে নেন। আমরা আপনারে নিতি আইসি। আপনার ভাইস্তেও আছে আমাগের সাতে। আপনারে এমন নিরাপদ জায়গায় সরায়ে নিচ্ছি, আর্মি আপনারে খুঁইজেও পাবেনা নে। ওহানে বইসে কেবল দোয়া করবেন আমাগের জন্যি।’

ততক্ষণে অন্য ঘরের ভেজানো দরজা লাথি মেরে খুলে টর্চের আলোয় চোখ ঝলসে দিয়ে আরো সাত-আটজন রাজাকারকে অস্ত্রের মুখে বের করে আনে আরেকটা দল। ঘুমচোখে উঠে রাইফেল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কেউ কেউ, টর্চের পেছন থেকে একজন বলে, ‘খবরদার, রাইফেলে হাত দিলি ব্রাশ ফায়ার।’ ওদের গরু খেদানোর মতো নিচতলায় যাওয়ার সিঁিড়র দিকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ইলিয়াস চেয়ারম্যান রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমারে কোয়ানে নিবি তোরা খানকির ছোয়াল? তোগের বাপ শেখ মুজিব কোয়ানে অ্যাহন? বাংলাদেশ বানাতি চাচ্ছো? অই মাতারি ইন্দিরা গান্ধী এডারে ইন্ডিয়া বানায়ে নেবে দেহিস। তোরা যুদ্ধ করবি পাকিস্তানীগের সাতে? আর কদিন যাতি দে, যুদ্ধ তোগের ইয়ে দে ঢুকোয়ে দেবে নে।’ নাজিম কিছু বলার আগে হারুন নিচু গলায় বলে ‘বুঝতি পারিসি, ভালো কতায় কাম অবেনানে। অ্যাই বাঁইধে ফেলা এডারেও।’ ইলিয়াস চেয়ারম্যানের গালাগালির তোড়ে উত্তেজিত হয়ে দুজন শক্ত হাতে ওর হাত মুখ বেঁধে ফেলে। প্রবল ধ্বস্তাধস্তি করেও একসময় নিস্তেজ হয়ে যায় চেয়ারম্যান। সুজাউদ্দীন শান্ত গলায় বলে, ‘আপনি মুরুব্বী মানুষ, ভালো কতা কলাম, নিজির সম্মান নিজি রাখতি পারলেন না।’ তারপর নাজিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘বল নাজিম, কি করব এনারে?’ নাজিম এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, এবার বলে, ‘আমি কি আর কবো। গেরিলা যুদ্ধের আইনে যা অয় সেডাই করবেন।’

ইলিয়াস চেয়ারম্যানকে যখন অস্ত্রের গুঁতোয় ঠেলে নিচে নামিয়ে আনা হয়, তখন বাকি রাজাকারদের ঘিরে পাহারা দিচ্ছিল দলের বাকি ছেলেরা। ওদের মধ্যে কম বয়সী একজন মুখ বাঁধা অবস্থায় হুঁ হুঁ করে কাঁদছিল। একজন ওকে ধমক দেয়, ‘অ্যাই চুপো কচ্ছি।’ ছেলেটা সাথে সাথে থেমে যায়। দোতলায় পড়ে থাকা রাইফেলগুলো নামিয়ে আনতে কয়েকজনকে পাঠায় সুজাউদ্দীন। হারুন বলে, ‘ও কুঁদো বন্দুক থ্রি নট থ্রি দিয়ে কি করবানে আমরা?’ সুজাউদ্দীন বলে, এখানে ফেলে রেখে গেলে অন্য রাজাকারেরা এগুলোই ব্যবহার করতে পারবে। তাই সবগুলো নদীর মধ্যে ফেলে দিতে হবে, পরে কেউ খুঁজে পেলেও ততদিনে আর কোনো কাজে লাগবে না ওগুলো।

পুরো দলটাকে হাঁটিয়ে নদীর দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় দুজন হঠাৎ দৌড় দেয়, পেছন দিকে হাত বাঁধা থাকায় বেশিদূর যেতে পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। দুজন গিয়ে ওদের পাঁজরে লাথি মেরে বলে, ‘উইঠে পড়, দৌড়োয়ে লাভ অবে না নে।’ ওরা ওঠার কসরত করতে শুরু করলে চুলের মুঠি ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয় একজন। এসময় অল্প বয়সী ছেলেটা আবার কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে কিছু বলতে চায়। সুজাউদ্দীন একজনের উদ্দেশে বলে, জায়গামতো গিয়ে শুনতে হবে কি বলতে চায় ও।

পুরো দল নিয়ে ওরা যখন নদীর ধারে পৌঁছায় তখন চাঁদটা হালকা সরের মতো মেঘের পেছন থেকে অনুজ্জল আলো ফেলছিল পৃথিবীর সেই প্রান্তে। সুজাউদ্দীন কিশোর বয়সী ছেলেটার মুখের বাঁধন খুলে দিলে ও কাঁদতে কাঁদতে যা বলে তাতে বোঝা যায়, সে রাজাকার নয়, বাড়িও এদিকে নয়। এই ক্যাম্পে ভাত রান্নার কাজ করত ও। ওকে বাইরে কোথাও যেতে দিত না ওরা। ছেলেটাকে অন্যপাশে সরিয়ে নিতে বলে সুজাউদ্দীন। এসময় আগে থেকে ঠিক করে রাখা নির্দেশমতো বাকিদের নদীর দিকে মুখ করে একসারিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সুজাউদ্দীনের চাপা গলার নির্দেশে হারুনের হাতের অস্ত্র থেকে প্রলম্বিত লয়ে দিগন্ত ছাড়ানো একটানা খইফোটার মতো শব্দের সাথে বসে থাকা মূর্তিগুলো ঢলে পড়ে। সেই শব্দে দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাকও কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। নদী তীরের গাছ থেকে ত্রস্তে ডানা ঝটপট করে উড়ে যায় কয়েকটা পাখি। পড়ে যাওয়া শরীরগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করার প্রয়োজন নেই, তবু গুলির একটানা শব্দের পর চরাচরে নেমে আসা আচমকা নিস্তব্ধতার মাঝে সবাই কিছুক্ষণ কান পেতে রাখে, কোনো পাল্টা শব্দ ভেসে আসে কি না।

তারপর সাথে বয়ে আনা রাইফেলগুলো এক এক করে বর্শার মতো নদীর পানির গভীরে ছুড়ে ফেলে দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে যায় ওরা। সবাই একদিকে একসাথে যায় না, আলাদা আলাদা পথে ছড়িয়ে পড়ে। ভাত রান্না করা ছেলেটা তখনো বসে বসে কাঁপছিল, ওর কান্না থেমে গেছে। হারুন বলে, ‘এডারে রাইখে দিলেন যে? আপনিইতো বলিছেন গেরিলা যুদ্ধে শত্রুরে বাঁচায়ে রাখার নিয়ম নেই।’ সুজাউদ্দীন বলে, এটা একেবারেই বাচ্চা, শত্রুও নয়, খামোখা মেরে ফেলব কেন? তবে ছেড়ে দেওয়াও যাবে না। সাথে নিয়ে দেখি ওকে কি কাজে লাগানো যায়। একটা জীবন তো বাঁচবে।