You are currently viewing একটি অমসৃণ পক্ষ || বদরুজ্জামান আলমগীর

একটি অমসৃণ পক্ষ || বদরুজ্জামান আলমগীর

একটি অমসৃণ পক্ষ
বদরুজ্জামান আলমগীর

মোহাম্মদ রফিকের বৈশাখী পূর্ণিমা, ধুলোর সংসারে এই মাটি,কীর্তিনাশা,গাউদিয়া, মেঘে ও কাদায়, ১৯৯৩ সনে বেরুনো খুব দুর্বল বাইন্ডিঙের নির্বাচিত কবিতা আমাদের চিন্তার পাটাতন ভীষণভাবে পোক্ত করে।

আমার কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রথম উসকে দেন মোহাম্মদ রফিকের নাম। ইলিয়াস ভাই বলেছিলেন- মোহাম্মদ রফিকের কবিতা পড়ো, বুঝবে কবিতারও ভাষা এবং জেরায় শিরদাঁড়া থাকা সম্ভব। বিনাবাক্যে মহাত্মা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা ঈমানে তুলে নিই। ইলিয়াসের কথার সত্যতা টের পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমার।

কবিতা চেনার আরেকটা গায়েবি মানদণ্ড আছে আমার ঘরে; এইসুযোগে আমি ওই বাটখারাও ব্যবহার করি: দেখি যে, আমাদের ভীষণ আবৃত্তিকাররা মোহাম্মদ রফিকের কবিতা পড়েন না; এতে আমার ধারণা আরো পাকা হয়- মোহাম্মদ রফিক তাহলে ভালো কবিতা লেখেন।

ভীষণ আবৃত্তিকারদের আওয়াজ ও দাপটের আড়ালে অবশ্যই সৎ নিষ্ঠাবান ডুবুরি আবৃত্তিকার আছেন কেউ কেউ- অতি নিভৃতে থাকেন তারা, তাদের আমি আবৃত্তিকার বলি না- বলি পাঠশিল্পী,আর একান্তেই তাদের প্রণতি জানাই। তবে আবৃত্তিকারদের সিংহভাগের উপর ভরসা করার কোন ন্যায়বান কারণ দেখি না আমি।

একে একে বৈশাখী পূর্ণিমা, ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, খোলা কবিতা পড়ার পর মনে হলো- মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখলে যা হতো মোহাম্মদ রফিকের কবিতা তা-ই। খোঁজ পাই- মানিক কিছু কবিতা লিখেছিলেন, এবং ইহারা যথেষ্ট খারাপ। আশার কথা, এক গদ্যময় জীবনের কথা পদ্যে বয়ান করে মোহাম্মদ রফিক মানিকের মত বিফল হননি, বরং হিলহিলে শস্যের যোগানে তিনি কবিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন।

মহাকাব্যের দম নিয়ে মোহাম্মদ রফিক কবিতা রাষ্ট্র করতে এসেছিলেন, ফলে তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বুঝি কবিতার বীজধান হাতে এক বৈশম্পায়ন এসে হাজির হয়েছিলেন, ছোট ছোট পয়ারে মেলে দেন মহাভারত, কী অডিসির জগৎ- যার প্রটাগনিস্ট সব আমাদের ভাঙাচোরা মানুষ।

ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, গাওদিয়া, খোলা কবিতা, কপিলা, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়, মেঘে এবং কাদায়, রূপকথা কিংবদন্তী, মৎস্যগন্ধা, নোনাঝাউ, দোমাটির মুখ, মাতি কিসকু, কালের মান্দাস, বিষখালি সন্ধ্যা, বন্ধু তুমি প্রসন্ন অবেলায়,কালাপানি- সবখানে তিনি এঁকে গ্যাছেন এক ফলিত দীর্ঘশ্বাস, আর বাসনার রক্তকরবী।

মোহাম্মদ রফিক একটি অসাধ্য সাধন করেন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ দাশকে বাঙলার পানের বাটায় এক সংশ্লেষে ধরতে তিনি সফল হন। এ-কথা ঠিক- বাঙলা কবিতার ভালোত্বের যে আদুরে আদুরে কাঁচা এক মানদণ্ড দাঁড় করানো হয়েছে- সেই ছাঁচে মোহাম্মদ রফিক লাগসই নন; তিনি একটি অমসৃণ পক্ষ, দড়িপাকানো খসখসে কৃষকের রাফ খাতা, কপিলার অমীমাংসা।

কবিতার ইতিহাসে কোন কোন কবির ললাটে একটি উজ্জ্বল দুর্ভাগ্যের তিলক জ্বলতে দেখি- তাঁদের দীর্ঘ পরিশ্রমী কল্পনাপ্রসূ জীবনে একটি দুটি লাইন দুর্মর খ্যাতির বিধ্বংসী চক্র এনে দেয়। পশ্চিমে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস বললেই যে কেউ ঠাসঠাস বলে দেবে: The falcon can not hear the falconer; Things fall apart; the centre can not hold. যেনবা দি সেকেন্ড কামিংই সবটুকু ইয়েটস। চিনুয়া এচিবের উপন্যাস ফল এপার্ট- এর আরো ষোল কলা পূর্ণ করে।

এরশাদের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিসত্যিই মোহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন- সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই। এই লাইন তাঁকে মানুষের মুখে মুখে বসিয়ে দেয়, কিন্তু তা আড়ালে ফেলে তাঁর অন্তহীন প্রান্তিক মানুষের নির্ঘুম পদাবলী- বৃক্ষের নাভিমূলে কাঙ্ক্ষার দ্বিতীয় দরোজা।

জীবনানন্দ দাশের উপর মোহাম্মদ রফিকের লেখা আমার জীবনানন্দ বইটিও সবাইকে পড়ার অনুরোধ করি। অসামান্য এক গদ্যে মোহাম্মদ রফিক জীবনানন্দ দাশকে দর্শন, রাজনীতি ও ইতিহাসের কাদাজলে আমাদের সামনে এনে হাজির করেন।

অরুণ সেন পাঠ পুনর্পাঠে মোহাম্মদ রফিকের মন, মনন ও প্রতিজ্ঞার ঘনবদ্ধতা ঠিকঠিক চিহ্নিত করতে পারেন; মোহাম্মদ রফিকের নির্বাচিত কবিতার অনুপুঙ্খ ভূমিকায় অরুণ সেন তা সবিস্তার বিবৃত করেন।

শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ঘরানার বাইরে অন্য মেজাজের কবিতাও বাঙলাদেশে আছে। অনেক তো চোখ বেঁধে পাতিল ভাঙার খেলা হলো- এবার চারপাশটা খুঁজেপেতে দেখি।

এই নিদানকালে মোহাম্মদ রফিকের নাম লৈয়া দূর দিগন্তে চাহি- এমন হোক, দলকানা মাজাভাঙ্গা ফেউয়ের দল নয় আর- আসুক, শত সহস্রে নির্ভীক কবি- রাস্তার কিনারায় পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল- কবি সক্রেটিসদের ঝুঁকিপূর্ণ সিন্থেসিস, বোগাস গণতন্ত্রের জগদ্দলের উপর ভিড় করে নামুক শকুন নয়, শিরদাঁড়াওয়ালা কবিদের দল।

মোহাম্মদ রফিকের আত্মরক্ষার প্রতিবেদন, স্মৃতি বিস্মৃতি অন্তরাল, খুচরো গদ্য ছেঁড়া কথার নিরেট গদ্যে আছে আরও চাক্ষুষ, নিরাপোষ এক বয়ানচিত্র।

গদ্যে, দার্শনিক জেরা ও কবিতায় জীবন ঘষে মাটি জ্বলেজ্বলে উঠুক- মানুষ শীতে ও ভাসমানতায় কাঁদছে বড়!

***************************
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক
***************************