একগুচ্ছ কবিতা
সুলতান মাহমুদ রতন
আমারে নিলো না কেউ
বাওরি বাতাসে নিলো শিরিষের ফুল
মেঘে নিলো জলের আধার
জল বেয়ে চলে গেল ধীমান জলজ
প্রজাপতি ফুল ছেড়ে ফুলে
আমারে নিলো না কেউ।
আঁধারের ঘর খুলে দেখি
আরো এক নিকট আঁধারে তুমি চুপ
টুপ করে নামলে সকাল
বাকল বদল করে হবে জানি ঋতুর বণিক
সারাদিন যাপনের পর
উড়ে যায় পরিযায়ী পাখি
সোনালু শেফালি ফুলে পড়ে থাকে স্মৃতির দঙ্গল
এই চাঁদ মেঘের উজান বেয়ে
থেকে থেকে কোথায় চলেছে
সেখানে কি ভাঁট ফুল ফোটে
সেখানে কি ভাটিয়ালি গায়
সেখানে কি মানুষেরা একা।
এক মাটি ভাগ হলো জনে জনে অসম-বিষম
দলে দলে ভেদ হলো সাদা-কালো রকমারি নামে।
রোদ বর্ষা বুঝে যে যেমন ফিরে গেছে ঘর
স্কুলগামী বাস গেছে দূরের পাহাড়ে
কুমারিকা নদী নিলো শেষ ঝরা পাতাটিও
কেবল আমারেই নিলো না
নিলো না
কেউ।
করবী ফুফুর ঘুমঘর
জানা যাবে করবী ফুফুর কোন নাকফুল নেই। মেরুন রঙের পাড়ে ফুল প্রজাপতি আঁকা শাড়িও ছিল না। মেহেদি আঁকানো হাত শিউলি কুড়িয়েছিল সারা ভোর ধরে। সেই হাত ধরেছিল তারাবাতি গ্রামের যুবক। করবী ফুফুর বিয়ে হয়েছিল সতেরোতে। এক আশ্বিনের শেষে। তারাবাতি গ্রাম থেকে এসেছিলো বরের বহর। মা খালারা গান গেয়েছিল সারারাত। রাতভর গানেগানে পাকান নকশি আর পাটিসাপটার মতো বাহারি পিঠায় ভরে উঠেছিল ডালা। সেইরাতে শেষতাকে লিখেছিল কেউ ভালো থেকো। করবী ফুফুর চোখে পালং নদীর ভাটা জল স্থির হয়েছিল। বাড়ির উঠোন ঘিরে রঙে রঙে জমে উঠেছিল উৎসব। পালং নদীর পাড়ে সেইদিন হাঁট বসেছিল। হাঁটবার পার হয়ে করবী ফুফুর ঘুমঘর দুলতে দুলতে চলে গেল নদীর ওপারে।
পালং নদীর মতো বুজে গেছে করবী ফুফুর ভরা জলের নয়ন। একদিন জানা হয়ে যাবে তারাবাতি নামে কোন গ্রাম নেই। করবী নামের কেউ ছিল না কখনো।
কেরানি হবো না
জানি এ অফিসগামী পথ
যাবে না পাহাড়ে কোনদিন
যাবে নাতো পার হয়ে নদী
আমার কাশিমপুর গ্রাম
গ্রাম মানে সোনালি খালার ভেঁজা চোখ
সুর করা কান্নার গান
নদী ঘেঁষা কাইজের হাট
ধানে ভরা হলুদ উঠোন
দাদা বাড়ি, করবী ফুফুর নাকফুল, ভেজা পিঠা, হুরুম-মিঠাই
রোদে জলে এক ঘরে থাকা।
আমাদের আলাদা ঘরের এই দিন
আকাশ হারানো শিশুটির চোখে
চুপ হয়ে আছে বহুদিন
বহুদিন আঁটোসাঁটো পোশাকের কয়েদি জীবন এই
বুকের বোতাম খুলে পাহাড়ে পাহাড়ে যেতে চায়।
প্রতিভোর দরজা খুলেই দেখি
অফিসের পথ এসে ঢুকে আছে ঘরের ভেতর
আজ আমি অফিস যাবো না
আর আমি অফিস যাবো না
আমার দাদার নাম বাউল ফকির চান
আমি কারো কেরানি হবো না।
আতিয়ারের মৃত্যু
মৃত্যু কামনা করে ফজরের পর ঘুমিয়ে পড়েছে আতিয়ার। ফুলতুলি গ্রাম থেকে এশহরে এসে; আম্বিয়া খাতুনকে বলেছিল আমাদের ঘর পাকা হবে। ছেলে হবে বড় অফিসার। আতিয়ার নির্ঘুম কতো শত রাত। আজ তার ঘুম হবে। নিশ্চিন্তে ডুবে যাবে অনন্ত ঘুমের ভেতর। চারপাশে গোরের বাতাস; মেঘে থমথম।
আকাশ উজাড় করে বৃষ্টি নেমেছে। স্যাতঁস্যাতেঁ পরিত্যক্ত বাড়িটিকে ঘিরে বৃষ্টি অঝোর। বৃষ্টির ছিটেফোঁটায় নড়ে ওঠে প্রথম আতিয়ারের ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল, তারপর চোখের কেশর। একপল ভাবনায় না আসে সন্তান তার, না প্রাচুর্য। শুধু মনে হয় ভেসে যাচ্ছে আম্বিয়া খাতুন। বৃষ্টি নামলেই যে কিনা পড়তো ‘রহমাতুন, রহমাতুন’ সুরে জলের দুরূদ। আজ এই ভোরে বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে আম্বিয়া খাতুনের কবরের ঘাস। ডুবে যাচ্ছে আম্বিয়া খাতুন।
মৃত্যু কামনা করে ঘুমিয়ে পড়লো আতিয়ার।